#ঝিলের_ওপারে_পদ্মফুল,২০,২১
তন্বী ইসলাম
২০
থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছে সেলিমের বাবা। তার চারপাশে উৎসুখ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির বাকিসব মহিলারা। আলেয়ার মনে স্পষ্ট ভয়, দুদিন পর তার মেয়ের বিয়ে। এর মধ্যে কোনো অঘটন ঘটলো না তো? মনে তার কু ডাকছে বার বার। ভয়ের চোটে জুবেদা কিছু জিজ্ঞেস করার সাহসটুকু হারিয়ে ফেলেছে। আসমা শাশুড়ির একপাশে গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। সেলিমের বাবা যে চেয়ারটায় বসে আছে তার ঠিক পেছনেই বাবার মাথার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সেলিম। তার চোখেমুখেও দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। আসমা ইশারায় সেলিমের কাছ থেকে কিছু জানার চেষ্টা করলো। বিনিময়ে হাতের ইশারায় তাকে চুপ থাকার নির্দেশ দিলো সেলিম। আসমাও কোনো কথা বাড়ালো না আর। সমস্ত ভয়কে একপাশে সাইড করে হাবিবা খাতুন বলে উঠলেন
“কি জন্য ডাকলেন ভাইজান? কিছু কন না কেন? আমাগো সবার মনে ডর লাগা শুরু করছে তো।
সেলিমের বাবা এবার মাথা তুলে সামনের দিকে তাকালেন। কয়েক সেকেন্ড নিরব থাকার পর সামান্য গড়া খাকাড়ি দিয়ে বললেন
“আলেয়া, শাপলা কই?
“ঘরে ভাইজান। কেন, কি হইছে?
“ওরে কও বিয়ার লাইগা প্রস্তুতি নিতে। কাইল ই বিয়া হইবো।
“কাইল? খানিক চমকে উঠলেন আলেয়া। সে কিছু বলার আগে উৎসাহিত গলায় হাবিবা বলে উঠলো
“বিয়া তো আগামী পরশু হওনের কথা ভাইজান। তয় কাইল কেন?
সেলিমের বাবা একটু নড়েচড়ে বসলেন। বললেন
“হো পরশু হওনেরই তো কথা আছিল। কিন্তু একটা সমস্যা হইয়া গেছে যে।
“কি সমস্যা? কপালে চিন্তার ভাজ টেনে বললেন আলেয়া।
সেলিমের বাবা ইশারায় আসমাকে এক গ্লাস পানি আনার জন্য বললেন। শশুড়ের ইশারা পেয়ে দৌড়ে ঘরে চলে গেলো আসমা। ততক্ষণ সেলিমের বাবা আর কোনো কথা বললেন না। আসমা পানি এনে দিলে সে পানিটুকু ঢকঢক করে এক ঢোকেই খেয়ে নিলেন তিনি। এরপর আহহ করে শব্দ করে বললেন
“গলাটা শুকাইয়া কাঠ হইয়া গেছিলো। অনেক তর্ক করছি কিনা!
এবার মুখ খুললেন জুবেদা।
“কার সাথে তর্ক করছেন? আর কি নিয়াই বা তর্ক করছেন?
পানির গ্লাসটা আসমার হাতে দিতে দিতে সেলিমের বাবা বললেন
“শাপলার শশুড় আর হবু শশুড়ের সাথে। বাজারে যাওয়ার পরপরই তাগো ফোন আসলো আমার ফোনে। রিসিভ কইরা ধরতেই একটা দোকানের কথা কইলো, ওই দোকানে গিয়া দেখা করার লাগি। হন্তদন্ত হইয়া ঐখানে গেলাম আমি আর সেলিম। দেইখা মনে হইলো ওরা আমাগো লাইগাই বইয়া রইছে।
“তারপর?
প্রশ্নটা করতেই জুবেদার দিকে কিড়মিড় করে তাকালো সেলিমের বাবা। উনার তাকানো দেখে জুবেদার মুখটা চুপসে গেলো। তিনি আবারও নিরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন পাশে। সেলিমের বাবা চোখ ফিরিয়ে হাবিবার দিকে তাকালেন। এরপর ধীরস্থির ভাবে বলতে লাগলেন..
“তখনই ওরা বললো বিয়াটা একদিন আগায়া আনার লাইগা। আমি কারণ জিজ্ঞাসা করলে বললো তাগো বাপ মানে আরহামের দাদা’র নাকি হঠাৎ শ্বাসকষ্ট ভাসছে। দম যায় যায় অবস্থা। এতোদিন নাকি ভালোই ছিলো, কোনো সমস্যা ছিলো না। কিন্তু হঠাৎ কইরাই এমন রোগ ভাসার কারণটা তারাও ঠাহর করতে পারে নাই। হয়তো বয়স হইছে তাই। কথাটা বলে আবারও থামলেন তিনি।।
কয়েক সেকেন্ড বাদে আলেয়া বললেন
“তার সাথে বিয়া আগায়া আনার সম্পর্ক কি?
সেলিমের বাবা খানিক কড়া গলায় বললেন
“তোমাগো ধৈর্য আসলেই অনেক কম। অতো অধৈর্য হইলে চলে নাকি। কওয়ার জন্যই তো ডাকছি।
হাবিবা কথায় বাধ সেধে বললেন
“ওর মাইয়ার বিয়া ভাইজান। যেহেতু ওর মাইয়ার বিয়া নিয়াই কথা হইতাছে তাইলে ও তো জানতে চাইবোই। কথায় কথায় ওতো রাগ দেখাইলে হয় না। হাবিবার কথার প্রসঙ্গে আলেয়া তাকে চুপ থাকার জন্য ইশারা করলো। সেলিমের বাবা আবারও বললেন
“ওর দাদার ইচ্ছা বউ দেইখা তারপর মরবো। এখন যখন হঠাৎ কইরাই রোগ ভাসছে, শরীরও নরম হইয়া গেছে। তাই সবাই চাইতাছে একদিন আগেই বিয়াটা করাইয়া নেক। বুড়া মানুষ, কখন কি হয় তা তো কওয়া যায় না।
“তা আপনে কি কইলেন? প্রশ্ন করলো হাবিবা।
“আমি রাজি হই নাই প্রথমে। এই নিয়া আমরা বাপ বেটা কম তর্ক করি নাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ঠিক থাকতে পারলাম না। সত্যিই তো, বুড়া মানুষ কখন কি হইয়া যায়। আর আইজ হইলেও তো মাইয়ার বিয়া দিবা, কাইল হইলেও দিবা। একদিন আগে দিলেও সমস্যা নাই।
“তাই বইলা কাইল? অহনো বিয়ার বাজার সদাই কিছুই করা হয় নাই। জামাই’রে বওয়ানোর প্যান্ডেল করা হয় নাই। কাম কাজ সব বাকি। খানিক অসহায় ভরা গলায় বললেন আলেয়া। সেলিমের বাবা তাকে আশ্বস্ত করে বললেন
“এতো চিন্তার কিছু নাই। বাজার সদাই যা লাগে তা অহনই আমি আর সেলিম গিয়া কইরা নিয়া আসমু। আমরা তো তেমন কোনো আয়োজন করতাছি না। মোটামুটি নিজেরা নিজেরাই তো। বাইরের কাউরে দাওয়াত দেই নাই যে আহামরি বাজার করা লাগবো। আর প্যান্ডেলের লোকগো রে বইলা আইছি, ওরা ফজরের আজানের পরই চইলা আইবো। আলো ফুটনের আগেই দেখবা প্যান্ডেল বাধা শেষ। অহন তোমার কোনো আপত্তি নাই তো আলেয়া?
আলেয়া করুণ স্বরে বললো
“আপনি যহন সব ঠিক কইরাই আইছেন তখন আর আপত্তি থাইকা কি হইবো। আপনে যা ভালো বুঝবেন তাই হইবো।।
কথাটা বলে থেমে গেলেন আলেয়া। ততক্ষণে পদ্ম’ও এসে দাঁড়ালো সবার পেছনে। আলেয়া আবারও বলে উঠলো
“কাইল বিয়া, কিন্তু শ্রাবণের তো অহনো পরীক্ষা শেষ হয় নাই ভাইজান। শত হইলেও ও শাপলার বড় ভাই, বিয়াতে না থাকলে কেমন দেখায় না ব্যাপারটা? মাইনষে কি কইবো? বোইনের বিয়াতে ভাই নাই ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু লাগে।
“ওর সাথে কথা কইয়া নিমু নে। এমনিতেও তো কাইল পরীক্ষা দিয়া ও চইলা আসবো। দেখবা শাপলারে উঠাইয়া নেওয়ার আগেই ও চইলা আইবো।
আলোচনা তখনকার মতো সেখানেই শেষ। জুবেদা, আলেয়া, হাবিবা, আসমা যথাসম্ভব বিয়ের কাজে লেগে পরলো। হাতে একদমই সময় নেই। একটা রাত মাত্র সময়। তাতেই যতটুকু করা যায় করতে হবে। শাপলার কানেও আগামিকালের বিয়ের খবরটা চলে গেলো। কিন্তু তার চেহারা কিংবা মনের কোনোরুপ পরিবর্তন হলো না। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সবটা মেনে নিলো সে। ঘরের পেছনদিকে শাপলার ফোনটা হাতে নিয়ে চলে গেলো পদ্ম। মনটাই তার খারাপ হয়ে গেছে।
কত কি ভেবে রেখেছে, বোনের বিয়েতে শ্রাবণ ভাইয়ের সাথে খুব সুন্দর সুন্দর মুহুর্ত কাটাবে। কিন্তু সব কিছুতেই যেনো এক নিমিষেই বেগড়া চলে এলো। ধুর ভাল্লাগে না, মুখ কালো করে দাড়ালো পদ্ম। বাটন ফোনের বাটন টিপে টিপে শ্রাবণ ভাইয়ের নাম্বারটা বের করলো সে। রিং ঢুকানোর পরে একবার কল বাজতেই ওপাশ থেকে কলটা কেটে দেওয়া হলো। আবারও কল দিলো পদ্ম, যতবার কল দিচ্ছে ততবারই কল কেটে দিচ্ছে শ্রাবণ। এবার নিজেকে বেশ অসহায় ভাবতে লাগলো সে। আজই কেন এমন হচ্ছে। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, পনেরো মিনিট.. এভাবে প্রায় পঁচিশ মিনিট কেটে গেলো, শ্রাবণের কল এলো না। শেষে হতাশ হয়ে ঘরে ফিরে যাবার জন্য পা বাড়ালো পদ্ম। এমন সময় ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। তরিঘরি করে নাম্বারের দিকে না তাকিয়েই কলটা রিসিভ করলো সে। কানে ঠেকিয়ে হ্যালো বলতে যাবে তার আগেই ওপাশে অপরিচিত একটা কন্ঠস্বর শুনে থেমে গেলো পদ্ম। ওপাশ থেকে তীব্র উঠকন্ঠা নিয়ে কেউ বলে উঠলো
“শাপলা.. শাপলা? কথা বলছো না কেন? আর ফোন ব্যস্ত ছিলোই বা কেন?
পদ্ম ফোনটা নামিয়ে নাম্বারটা দেখলো। অপরিচিত একটা নাম্বার। সে আবারও ফোনটা কানে নিয়ে বললো
“কে? কে বলছেন?
হঠাৎ যেনো ওপাশের মানুষটা নির্জীব হয়ে গেলো। পদ্ম আবারও প্রশ্ন করলো
“কে বলছেন না কেন?
“আ-আমি আ-আরহাম। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো ওপাশে থাকা মানুষটি।
পদ্ম’র মুখে হাসি ফুটলো। সে হবু দুলাভাই এর সাথে এর আগে কথা বলে নি, তাই কন্ঠস্বর শুনেও চিনতে পারেনি।।
পদ্ম দুষ্টুমি করে হবু দুলাভাই এর সাথে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফোনটা ছিনিয়ে নিলো শাপলা। ফোনের স্ক্রিনে নাম্বারটা দেখে বেশ রাগতস্বরে বললো
“আমার কল তুই রিসিভ করলি কেন পদ্ম? তুই যে কারণে ফোন নিছিস সেই কাজটাই কর না।।
“এমন করতাছিস কেন আপা? হবু দুলাভাই এর সাথে কি আমি কথা বলতে পারি না?
“হবু দুলাভাই? বিস্ময়ে বললো শাপলা। এরপর ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আবারও নাম্বারটা দেখে পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে বললো
“কি কথা বলছিস তুই? আর সে তোরে কি বলছে?
“আমি জিজ্ঞাসা করছি উনি কে। উনি তো দুলাভাই এর নাম কইলো।
শাপলা এবার চোখ একটা লম্বা নিশ্বাস ছাড়লো। যেনো হাঁফ ছেড়ে বেচেছে। পদ্ম অবাক হয়ে বললো
“এমন করতাছোস কেন আপা? উনি কি আমার দুলাভাই না?
শাপলার হাসলো এবার। বললো
“হো, তোর দুলাভাই-ই।
যেহেতু রাত পোহালেই বিয়ে তাই দুরের মেহমান যারা ছিলো তারা মোটামুটি এসে যাওয়ার পথে। কাছে যাদের বাড়ি তারা সকাল নাগাদ চলে আসবে। সন্ধ্যার আগ নাগাদও বাড়িটা মোটামুটি নিরব ছিলো। তবে এখন বাড়িটা গমগম করছে। আসমার ভাই আশিক চলে এসেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। বাকিরা আগামীকাল আসবে। আসার পর থেকেই পদ্ম’র পিছু জোকের মত লেগে আছে সে। বড্ড বিরক্ত পদ্ম। একে’তো শ্রাবণ ভাইয়ের সাথে এখনো অব্দি কথা হয়নি তার, তার উপর আগামীকাল বোনের বিয়েতেও সে থাকবে না। এতো এতো মানুষের ভীড়েও নিজেকে বড্ড একা মনে করছে সে। তার উপর এই আশিক নামের আপদটা লেগে আছে তার পিছে। পদ্ম না পারছে তাকে সহ্য করতে আর না পারছে রেগে কিছু বলতে।
শাপলাও সেই কখন থেকে ফোনে কথা বলা শুরু করেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। রাত পোহালেই বিয়ে, তার পর থেকে দুলাভাই চব্বিশ ঘন্টাই তার সাথে থাকবে। তারপরও এতো কিসের কথা বুঝি না বাপু। মনে মনে একরাশ বিরক্তি নিয়ে কথাগুলো ভাবলো পদ্ম।
প্রায় ন’টার দিকে ফোন করলো শ্রাবণ। শাপলা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে হাসিমুখে শ্রাবণ বললো
“কিরে বিয়ের কনে, কি করছিস?
শ্রাবণের কথায় মৃদু হাসলো শাপলা। বললো
“বিয়ের কনের তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, তাই বসে বসে বিয়ের দিন গুনছি আর অপেক্ষা করছি। শ্রাবণও হাসলো শাপলার কথায়।৷ বললো
“বাহ’ তোর তো দেখছি বেশ তাড়া।
“বিয়ে যখন করাই লাগবে তাহলে মনমরা হয়ে বসে থাকলেই আর কি হবে। তারচেয়ে প্রহর গুণাই ভালো।
“তা ঠিক। সে কোথায়?
শাপলা দুষ্টুমি করে মৃদু হেসে বললো
“কার কথা বলো?
“আমার পদ্মফুল।
“যেখানে থাকার কথা।
“কোথায়?
“ঝিলে।
শ্রাবণ অবাক হয়ে বললো
“ঝিলে মানে?
“তোমাকে অনেক বার কল দিছে, কিন্তু তুমি ধরো নাই। তাই মন খারাপ করে ঝিলের পাড়ে বসে আছে।
“এই রাতের বেলায়? প্রচন্ড বিস্ময়ে বললো শ্রাবণ।
“অনেক বার বারণ করছি, তাও গেছে। তার নাকি কিছুই হবে না, ভয়ও পাবে না। বেশি বললে সবাই শুনবে, শেষে আরেক ঝামেলা হবে। তাই আমিও চুপচাপ বসে আছি।
“তুই তারাতাড়ি যা, ফোনটা ওর হাতে দিয়ে কানটা ধরে বাড়ির ভেতর নিয়ে আয়। বড্ড সাহস হয়ে গেছে তোর বোনের। আমি আগে এসে নেই কাল, এর শাস্তি সে পাবে।
শাপলা হেসে বললো
“আজ্ঞে ঠিক আছে।
শাপলা ফোনটা হাতে নিয়ে সবার অলক্ষে এগিয়ে গেলো ঝিলের ধারে। ঝিলটা বাংলা ঘরের পেছন দিকে, সেখানে একটা লাইটও লাগানো আছে। লাইটের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মাচার উপর দু’পায়ের উপর মাথা রেখে এতিমের মতো বসে আছে তার বোনটা। সে এগিয়েই যাচ্ছে পদ্ম’র দিকে, এমন সময় ওকে পাশ কাটিয়ে পদ্ম’র কাছে আশিক যেতে নিলে শাপলার সাথে তার ধাক্কা লাগে। সাথে সাথেই দাঁড়িয়ে যায় আশিক। শাপলার দিকে তাকিয়ে হেসে দুষ্টুমির ছলে বলে
“আমার ভুল হয়ে গেছে আফা, আমারে মাফ করে দেন।
খিক করে হেসে দেয় শাপলা। বিনিময়ে আশিকও হাসে। এরপর চলে যায় পদ্ম’র কাছে। ওপাশ থেকে আশিকের কন্ঠস্বর শ্রাবণের কানে ভেসে যায়। চোখমুখ শক্ত করে শাপলাকে প্রশ্ন করে
“এটা কার গলা শুনলাম রে শাপলা?
“তোমার ভাইয়ের শালা।
শ্রাবণের রাগ মাথায় চাপে। শক্ত করে কড়া গলায় বলে
“ওই বানরমার্কা আশিইক্কা আবার কেন আসছে? আমার পদ্ম’র মাথাটা আবার খাওয়ার চেষ্টা করছে না তো?
চলবে…….
#ঝিলের_ওপারে_পদ্মফুল
তন্বী ইসলাম -২১
“পদ্মফুল’
শ্রাবণের মিষ্টিমধুর কন্ঠস্বরে হালকা নড়ে উঠলো পদ্ম। মুখ খুললো কিছু বলার জন্য, কিন্তু পরক্ষণেই ভুলে গেলো সে কি বলবে। আবারো মুখ ভার করে বসে রইলো মাচার উপর। ওপাশ থেকে শ্রাবণ সামান্য ধমকের গলায় বললো
“আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস না পদ্মফুল? উত্তর দিচ্ছিস না কেন?
পদ্ম’র এবার কান্না পেলো। একে’তো কাল বিয়ের দিন সে থাকবেনা, তার উপর এখন আবার বকছে। এবার অভিমানে গাল ফুলালো পদ্ম। বললো
“নাহ! কমুনা আমি কথা।
পদ্ম’র কথা শুনে কিঞ্চিৎ হাসলো শ্রাবণ। বললো
“কেন কথা বলবে না আমার পদ্মফুল?
“পদ্মফুলের মন খারাপ তাই।
“সেটার কারণ জানতে পারি আমি?
“তুমি জানো না শ্রাবণ ভাই?
“কি জানিনা! বিস্ময়ে বললো শ্রাবণ।
পদ্ম এবার নড়েচড়ে উঠলো। মাচা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে বললো
“কাল যে আপার বিয়ে তা তুমি জানো না?
“কাল! ওর বিয়ে না পরশু হওয়ার কথা?
পদ্ম এবার নরম গলায় বললো
“একদিন আগায়া আনছে বিয়া।
“আমাকে তো কেউ কিছু বললো না। একা একা বিড়বিড় করে বললো শ্রাবণ। কথাটা কানে গেলো পদ্ম’র। আবারও রাগ হলো তার।
রাগে ফুসে উঠে বললো
“তুমি জানবা কেমনে, কেউ কল দিলে তুমি কি ধরো নাকি? ওইসময় কতগুলা কল দিছি। তুমি রিসিভ করো নাই কেন? উলটা আরো ফোন কেটে দিছো।
পদ্ম’র কন্ঠে স্পষ্ট অভিমান। শ্রাবণ তার পদ্মফুলের অভিমান বুঝতে পেরে ক্ষীন হেসে নরম গলায় বললো
“আমার রুমের সুইচবোর্ডটা হঠাৎ কাজ করছে না রে পদ্ম। ফোনে চার্জ ছিলো না তাই পাশের ফ্রেন্ডের রুমে মোবাইল চার্জে লাগিয়ে ছিলাম। তুই তখনই বোধহয় কল করেছিলি। আমিও দরকারে একটু বাইরে গেছিলাম, তাই ওরা ফোন কেটে দিছিলো। আমি স্যরি রে পদ্মফুল।
পদ্ম’র রাগ এবার কিঞ্চিৎ কমলো। ভারী গলায় বললো
“এখন কি হইবো শ্রাবণ ভাই? তোমারে ছাড়া আপার বিয়াটা আমার কাছে একদমই ভালো লাগবো না। কাঁদোকাঁদো মুখ করে বললো পদ্ম।
“মন খারাপ করিস না রে পদ্মফুল। কিন্তু বিয়ের ডেইট চেঞ্জ করলো কেন?
পদ্ম মলিন গলায় কারণটা শ্রাবণকে বললো। সবটা শুনে শ্রাবণ বললো
“এখন আর কি করার। আমিতো আর এক্সাম ছেড়ে আসতে পারবো না। তাই অপেক্ষা করতে হবে। আমার ফিরে আসার অপেক্ষা।
“হুম। মলিন মুখে বললো পদ্ম।
“শাপলাকে উঠিয়ে নেওয়ার আগেই আমি চলে আসবো পদ্মফুল। আমার জন্য অপেক্ষা করবি না? শ্রাবণের কন্ঠে উদগ্রীব। পদ্ম হেসে বললো
“করবো তো শ্রাবণ ভাই।
শ্রাবণ হেসে বললো
“তা কাল শাপলার সাথে কে যাবে ও বাড়ি?
“আমি। হেসে বললো পদ্ম।।
“একদমই না। সাথে সাথেই নিষেধ করে বসলো শ্রাবণ। পদ্ম’র মুখটা চুপসে গেলো। বললো
“কেন?
“তুই বড় হয়েছিস না? এতো বড় মেয়ের ওখানে যাবার কোনো দরকার নেই।
“তাই বলে আমার দুলাভাই এর বাড়ি আমি যামু না শ্রাবণ ভাই?
“যাবি তো। আমার সাথে যাবি। আগে আমি আসি, তারপর।
“তোমার সাথে কি আম্মা আমারে দিবো যাওয়ার লাইগা? চিন্তিত গলায় বললো পদ্ম।
“সে আমি দেখে নিবো।
“আচ্ছা।
“এবার আমি রাখি রে পদ্মফুল। পড়া বাকি আছে অনেক।
পদ্ম মলিন গলায় বললো
“রাখবা? আইচ্ছা তাইলে রাখো।
পদ্ম ফোন রাখতেই যাচ্ছিলো, এরমধ্যে আবারও শ্রাবণের কন্ঠস্বর শোনা গেলো। সাথে সাথেই ফোনটা আবারও কানে ঠেকালো সে। বললো
“কিছু বলবা শ্রাবণ ভাই?
“তুই কি এখনো ঝিলের কাছে আছিস?
“হুম।
“এক্ষুনি বাড়ি যা। আর কোনো দিনই যাতে না শুনি তুই রাতে ঝিলের পাড় গিয়েছিস। আর একটা কথা..
“কও শুনি। ভাবলেশহীন ভাবে বললো পদ্ম।
“আশিকের কাছ থেকে নিজেকে যথেষ্ট দূরে রাখবি। সবসময়ই মাথায় রাখবি একটা কথাই, তুই শুধুই তোর শ্রাবণ ভাইয়ের।
কথাটায় বেশ লজ্জা পেয়ে গেলো পদ্ম। কিছু বলার মতো সাহস আর হলো না তার। শ্রাবণ আবারও বললো
“আমি সব সহ্য করতে পারবো, কিন্তু আমার পদ্মফুলকে অন্য কারো সাথে ভাবতেও পারবো না।
“শ্রাবণ ভাই!
আবেশে ডাকলো পদ্মফুল। শ্রাবণ মৃদুহেসে বললো
“কি?
“ভালোবাসি তোমারে।
শ্রাবণ হেসে বললো
“ইশশ, এখন যদি তুই আমার সামনে থাকতি রে পদ্ম।
পদ্ম’র মুখটা চুপসে গেলো হঠাৎ। বললো
“থাকলে কি করতা?
“আমার পদ্মফুলকে আমার বুকের সাথে শক্ত করে মিশিয়ে নিতাম।
লজ্জায় লাল হয়ে গেলো পদ্ম। ফোনটা কান থেকে সরিয়ে নিলো ঝট করে। আর কিছু শুনতে পারবে না সে, আর কিছু বলতেও পারবে না। ওপাশ থেকে আর্তনাদের মতো শ্রাবণ ভাইয়ের ডাক খুবই ক্ষুদ্রভাবে কানে ভেসে আসছে। আসলে আসুক, এখন সে কোনোভাবেই তার শ্রাবণ ভাইয়ের সাথে কথা বলবে না।
বিয়েতে যারা যারা আসার কথা ছিলো তারা সবাই প্রায় এসেই গেছে। গুটিকয়েক বাকি আছে তারা কাল সকালে আসবে। মহিলারা লেগে গেছে কাটাকুটির কাজে। কেউ পেয়াজ কাটছে তো কেউ রসুন। কেউ আদা জিরা বাটার কাজে ব্যস্ত৷ মেয়ে কাল পরের ঘরে চলে যাবে সেই শোকে কাজ করতে গিয়েও করতে পারছে না আলেয়া। ক্ষনে ক্ষনে নিরবে কেঁদে উঠছেন তিনি। আসমা আর জুবেদা তাকে সামলাচ্ছে তখন। তারাও নানারকম কাজে ব্যস্ত।
প্রচুর ঘুম পাচ্ছে পদ্ম’র। ঘুব পাবেই বা না কেন, রাত যে প্রায় এক’টা ছুইছুই। কিন্তু শাপলার জন্য ঘুমোতেও পারছে না। খচরখচর করে একটু বাদে বাদে কি যেনো করে যাচ্ছে আপন মনে। সে যা করছে করুক, তাতে তার কোনো সমস্যা ছিলো না। কিন্তু খচখচানির শব্দে চোখে ঘুম এসেও আসছে না।
অবশেষে উঠে বসলো পদ্ম। কারেন্ট থাকলেও তাদের রুমের লাইটটা অফ করা। মুলত ঘুমানোর জন্যই অফ করেছিলো শাপলা। লাইট অফ থাকলেও পুরো ঘর অন্ধকার হয় নি তখনও। উঠোনের লাইট জ্বালানো, আর মাঝঘরের লাইটও জ্বলছে৷ যে কারণে ওপাশেও লাইটের অস্পষ্ট আলোতে সবকিছু ঝাপসা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। এতো দিন ওদের রুমটা পর্দা দিয়ে আলাদা করা ছিলো, পর্দা থাকলে আরো ক্লিয়ার ভাবে সব দেখা যেতো। কিন্তু মেয়ের বিয়ে তাই রঙ্গিন টিন আনিয়েছেন আলেয়া। সে টিন দিয়ে মাঝখানে পার্টিশন বসিয়েছেন। মেয়ের জামাইকে তো আর পর্দার পার্টিশন দেওয়া রুমে বসানো যাবে না। আবছা আলোতে পদ্ম খেয়াল করলো শাপলা কি যেনো করছে। কিন্তু কি করছে সেটাই বুঝা যাচ্ছে না। এক প্রকার বিরক্ত হয়ে শাপলাকে উদ্দেশ্য করে পদ্ম বলে উঠলো
“এতো রাইতে তুই ওইখানে কি করিস রে আপা?
পদ্ম’র কথায় কিঞ্চিৎ চমকে উঠলো শাপলা। এরপর মৃদু হেসে বললো
“তুই ঘুমাস নাই এখনো পদ্ম?
“ঘুমামু কেমনে? তুই যেমনে খচখচানি করতেছিস, ঘুমানোর উপায় আছে কি?
শাপলা এবার তরিঘরি করে এগিয়ে এলো পদ্ম’র কাছে। বললো
“এই নে, আমিও শুয়ে পরছি। এবার ঘুমিয়ে যা।
“কিন্তু তুই করতেছিলি কি এতো রাইতে? তোর না কাইল বিয়া? হয়তো তুই ঘুমাবি, নয়তো বইসা বইসা শুইয়া শুইয়া কানবি। তা না কইরা অন্ধকারে কিসব করতাছিস।
বোনের কথায় হেসে উঠলো শাপলা। বললো
“কান্না করার জন্য তো কাল সারাদিনই পইরা রইছে পদ্ম।
“কিন্তু তুই করতাছিলি কি?
শাপলা এবার মলিন গলায় বললো
“ও তুই বুঝবি না রে পদ্মফুল। নে এবার ঘুমা।
বালিশে মাথা রেখে কপালের উপর হাত দিয়ে শুয়ে পরলো শাপলা। পদ্মকেও তাড়া দিলো শোয়ার জন্য। যেহেতু চোখভরা ঘুম ছিলো, তাই আর কোনো কথা না বাড়িয়ে নিজেও শুয়ে পরলো বোনের পাশে। কয়েক সেকেন্ড বাদেই শব্দ করে হেসে উঠলো পদ্ম। ওর হাসি শুনে ভ্রু বাকালো শাপলা। বললো
“পাগলের মতো হাসিস কেন?
“কাইল থেইকা এই বিছানাতে আমি একা থাকমু আপা!
“এই জন্য হাসছিস?
“না। একলা থাকতে তো আমার ভাল্লাগবো না, ভয় লাগবো।
“ভয় লাগলে মানুষ হাসে নাকি পাগল।
“এর লাইগা আমি হাসি নাই তো আপা।
“তা কিসের লাইগা হাসছোস? মাথাটা উচু করে একহাত মাথার উপর নিয়ে রেখে বোনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো শাপলা। পদ্ম দুষ্টু হেসে বললো
“কমু?
“হু।
“বিয়ার পরে যখন তুই তোর জামাইরে নিয়া আমাগো বাড়ি আসবি তখন তো এই বিছানাতেই থাকবি। যদিও তখন তোর সাথে আমি থাকমু না, তোর জামাই থাকবো।
“তাতে কি হইছে?
“আমি তো তখন আম্মার সাথে থাকমু। আইচ্ছা আপা, তোর শরম করবো না পুরুষ মানুষের সাথে থাকতে? ঘুম থেইকে উইঠা আমার আর আম্মার সামনে আসবি কেমনে তুই ? আমার তো ভাব্লেও শরম লাগে। বলে আবারও দুষ্টু হাসলো পদ্ম।
বোনের কথায় চোখ কপালে উঠার উপক্রম হলো শাপলার। বললো
“ওরে দুষ্টু রে। এইবার ঘুমাবি নাকি আম্মারে ডাকমু?
পদ্ম চোখ বন্ধ করে বললো
“ডাক আম্মারে। আম্মা আইসা দেখুক তার গুণধর মাইয়া বিয়ার টেনশিনে ঘুমাইতে পারে নাই এখনো।
শাপলা লম্বা একটা নিশ্বাস ছেড়ে বললো
“আহ পদ্ম, তুই যার কপালে জুটবি তার কপালে যে কি আছে আমি শুধু সেইটাই ভাবি।
“এমনিতেই তুই আমার আর শ্রাবণ ভাইয়ের মাঝখানে যেমনে ঝরের মতোন ঢুইকা পরিস, সেইটাই অনেক বেশি। আর আমাগো নিয়া চিন্তা করিস না বোইন, পরে যদি এর চাইতেও ভয়ংকর ভাবে ঢুকে যাস তখন আমাগো কি হইবো! কথাটা বলে দুষ্টুমির ছলে কাঁদতে লাগলো পদ্ম। শাপলা হাসতে হাসতে বললো
“আর কান্দিস না পদ্ম। কালই তো আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো, এরপর তোরা নিশ্চিন্তে প্রেম করিস। আমি আর কাবাব মে হাড্ডি হমু না।
বোনের কথায় পদ্ম’ও হাসলো। এরপর দুজনেই নিশ্চুপ। কিছুক্ষণ বাদেই ঘুম এসে ঠিকরে ভর করলো পদ্ম’র চোখে। ঘুমের জগতে পাড়ি দিলো সে গভীরভাবে। কিন্তু ঘুম এলো না শাপলার চোখে। চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারছে না সে। বার বার শুধু মনের মধ্যে ঘোরপাক খাচ্ছে একটা কথায়, ‘আজকের রাতটাই এ বাড়িতে তার শেষ রাত। আজকের পর এ বাড়িটা হয়ে যাবে পরের বাড়ি, নিমিষেই হয়ে যাবে সে এ বাড়ির মেহমান।’
খুব ভোরে মোরগের ডাকে ঘুম ভাংলো পদ্ম’র। হাই তুলতে তুলতে উঠে দেখে বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তবে লাইট জ্বলছে তখনও। অনেক মানুষের শোরগোল কানে আসছে। তার মানে এখনো সবাই সজাগ, সারারাত জেগে কাজ করেছে তারা। এখনো করছে। পাশে তাকাতেই চোখ গেলো শাপলার দিকে। মাথার উপর বালিশ রেখে উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছে সে। শরীরের এক অংশ একদিকে, আরেক অংশ আরেকদিকে। বাকা হয়ে ঘুমিয়ে আছে সে। বোনের এমন ধরণের ঘুমানো দেখে হাসি পেলো পদ্ম’র। কিন্তু সে হাসলো না।।খুব ধীরে ধীরে সতর্কতার সাথে বিছানা ছাড়লো সে যেনো শাপলার ঘুম ভেঙ্গে না যায়। আজ সারাটা দিন বেচারির উপর দিয়ে বেশ ধকল যাবে।
হাসিমুখে ঘর থেকে বেরোনোর জন্য পা বাড়ালো পদ্ম। কিন্তু হঠাৎ চোখ গেলো ঘরের এক কোনে ভাঙ্গা চেয়ারের উপর। অবাক হলো সে প্রচন্ড রকমের। বিস্ময়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো সেদিকে।
চলবে…..