টক্সিক রিলেশনশীপ,পর্ব-১
ঈপ্সিতা শিকদার
সাত-সকালে পাঁচ মাসের অন্তসত্ত্বা বাসন্তীকে একের পর এক আঘাত করে যাচ্ছে খ্যাতনামা গায়ক নায়িম। কারণটা বাসন্তী জানে না। হয়তো তার গর্ভধারণ করার সাথেই জড়িত। বাসন্তী ভেবেই পায় না এই সন্তানটা তো তার একার না, তবে কেন এত ঘৃণ্য নিষ্পাপ জানটি।
আর মার সহ্য করতে না পেরে চোখজোড়া বন্ধ হয়ে যায় বাসন্তী। নায়িমের তবুও ক্ষ্যান্ত হওয়ার নাম নেই। মারতে মারতে যখন নিজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখনই থামে। রাগে হনহন করে বাহিরে চলে যাওয়ার আগে বাসন্তীর অচৈতন্য মুখ খানার দিকে একদফা তাকিয়ে একদলা থুথু মেঝেতে ফেলে। বিচ্ছিরি এক গালি ছুড়ে বলে,
“কী ভাবসিলি তুই তোর বাসনা আমি বুঝি না! পেট একটা বাধাইয়া তার বাহানায় বাইরে যায়া যায়া তামাশা করোস? আবার আরেক শয়তানের তে বুদ্ধি নেস? সবই জানি আমি। ”
বাসন্তীর যখন জ্ঞান আসে তখন ভরা দুপুর, সারা শরীর ঘামে ভিজে টইটুম্বুর। সে জেগে অসহনীয় ব্যথা-বেদনা সবকিছু বাদ দিয়ে প্রথমেই হাত রাখে নিজের পেটে। তার মমতাময়ী মনের দুশ্চিন্তা এবং প্রশ্ন,
“আমার সন্তানটা সুস্থ আছে তো?”
নায়িমের সাথে তার সাংসারিক জীবন পাঁচ বছর। এই পাঁচ বছরে কতগুলো নিষ্পাপ জীবন যে পৃথিবীর মুখ দেখানোর আগেই মারতে হয়েছে সে। নায়িমের পৈশাচিক মানসিক, শারীরিক অত্যাচারের কাছে তার মাতৃত্ব হার মেনেছিল বারবার। কিন্তু এবার কিছু কারণ বশত আর পারেনি সে।
তার ভাবনার মাঝেই চৈতালী ঘরে ঢুকল। সম্পর্কে সে নায়িমের কেমন যেন বোন।
“বোন?” শব্দটি মনে মনে আওড়াতেই হাসি পেল তার। কত রাত-বিরাত এই ‘বোন’ এর ঘর ঢুকতে আর বের হতে দেখেছে হিসেব নেই।
চৈতালী তাকে উঠিয়ে বসাতে বসাতে অনুরাগের সুরে বলল,
“তোমাকে কে বলেছিল ওর কথা ছাড়া বাইরে যেতে। জানো তো ও কেমন? ছেলেটা তো তোমায় কত ভালোবাসে, এজন্যই তো এমন করে।”
“হুম, অনেক ভালোবাসে। তাই তো বিয়ের পরের দিনই পাটকেলের বারি খেয়েছি৷ কী অবাককর কাণ্ড না! হাতের মেহদির দাগ উঠে গেছে, তবে এই ইটের ভালোবাসার দাগ উঠেনি।”
বলতে বলতেই তার চোখজোড়া ভিজে আসে। মনে পড়ে যায় বিয়ের পরদিনের কথা।
বাসন্তীর সাথে নায়িমের বিয়েটা প্রেমের, তিন বছরের প্রণয়ের পর পূর্ণতা তার কাছে স্বপ্নের চেয়ে কম কিছু ছিল না। কারণ সে জানত, মানত নায়িমের মতোন কেউ তাকে ভালোবাসার নয়।
সেদিন রাত্রিযাপনের পর সকাল সকাল গোসল করে বারান্দায় যেয়ে চুলের পানি ঝাড়তে ঝাড়তে মনের আনন্দে ‘আমারো পরানে যাহা চায়’ গানটি গুনগুনাচ্ছে তখনই চুলে টান অনুভব করে। নায়িম তার মুঠিতে চুল ধরে টেনে ঘরে নিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে মারে তাকে।
বাসন্তী অবাক চোখে তাকায়, আকস্মিক এই আক্রমণের মানে খুঁজে পাচ্ছে না। নায়িমের রাগ সে আগেও দেখেছে, তবে এতটা ভয়ংকর নয়, সে ভয়ে কুঁকড়ে গেছে। নায়িম এদিক-ওদিক পাগলের মতোন কী খুঁজছে কে জানে হুট করেই দরজার পাশ থেকে পাটকেল এনে কোনোদিক না দেখেই মারতে শুরু করে বাসন্তীকে। সাথে রাগী গলায় বলতে লাগে,
“মুখপুড়ি, তোর রূপ দেখাইতে ভাল লাগে মাইনষেরে তাই না রে? দামড়া দামড়া পোলাগো সাথে রঙ-তামাশা করতে যাও!”
জীবনে প্রথম এত ভয়ানক মার খেয়ে বাসন্তীর যেন জান বের হওয়ার উপক্রম। পিঠ আর হাতের মনে হয় হাড়টাই ভেঙে গেছে। মাথায় চোট লাগতেই চোখের স্মমুখে ধোঁয়াশা।
জ্ঞান ফিরতেই কারো ফুঁপানোর আওয়াজ শুনে। সে অনেক কষ্টে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নায়িম তার আঘাতে মলম লাগাতে লাগাতে কাঁদছে আর বলছে,
“তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে তাই না বসন্ত? আমি সরি জান। কী করব বল তুমি আমাকে এত রাগিয়ে দিয়েছিলে যে…”
এত আঘাতের পর অভিমানে বাসন্তী মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তারপরই বিনতি করে বলেছিল,
“তুমি আমাকে প্লিজ ক্ষমা করে দাও। আমার ওয়াদা তোমার গায়ে আর একটা আঘাতও দিব না। জানো তোমার দিকে কেউ ভুলে তাকালেও আমি সহ্য করতে পারি না, সেখানে বামের ছাদ থেকে ঐ ছেলেটা তোমায় কেমন করে দেখছিল!”
বলতে বলতেই যেন আবার হিংস্র হয়ে উঠছে সে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে আবারও ক্ষমার আবেদন করতে শুরু করে। বাসন্তীও আর রাগ ধরে রাখতে পারে না। কারণ সে জানত রেগেও লাভ নেই, ফিরে যাওয়ার রাস্তা সে বন্ধ করেই এসেছেছে। তাই লোকটির প্রতিশ্রুতিতে মিথ্যে ভরসা করে নেয়। মনে মনে নিজেকে মিথ্যে সান্ত্বনা দেয় এই বলে যে,
“ও তো আমাকে ভালোবাসে বলেই তো আমায় নিয়ে এতটা পজেজিভ। ও তো আমার ভালোর কথা চিন্তা করেই রেগেছে। আর যে ভালোবাসে সে তো এট্টু শাসন করতেই পারে। আমারই ভুল হয়েছে ওকে না জিজ্ঞেস করে যেয়ে।”
‘কী সস্তা নারী তুমি!
কতটা সস্তা তোমার ক্ষমা, রাগ, অভিমান, প্রেম।
তুমি যে মেরুদণ্ডহীন এক মানুষে পরিণত আজ,
তা কি তুমি বুঝবে কভু?’
___
বর্তমানে পাশের ভবনের ভাড়াটে মৈত্রীর সাথে হাসপাতালের করিডোরে বসে বোরখার আড়ালে অপেক্ষা করছে বাসন্তী। খ্যাতনামা মানুষের স্ত্রী হয়ে তো মুখ দেখিয়ে সাধারণভাবে চলতে পারে না। হাসপাতালের এক গাইনি ডাক্তার মৈত্রীর পরিচিত বলেই এত তাড়াতাড়ি আল্ট্রাসাউন্ড করে রিপোর্ট দেখাতে পারছে সে। কয়েক মুহূর্ত পরেই তাদের ডাক আসল।
মৈত্রী বাসন্তীকে ধরে ধরে চেম্বারে নিয়ে যায়। বাসন্তী নিকাব উঠাতেই ডাক্তার রোকসানা রোগীকে দেখেই মুখ বিদঘুটে করে ফেলে।
“ইশ! কেমনে মেরেছে রে! বিশ্বাসই হয় না একজন শিল্পী এমন কুৎসিত মনা হতে পারে! এই মেয়ে তোমার ভিতরে কি ব্যথাবোধ নাই? কেমনে এই জানোয়ারের সংসার করছো?”
বাসন্তীর মাথা নত। তার কাছে কোনো উত্তর নেই। কোন মুখে বলবে এই পৈশাচিক লোকটির জন্যই সে সব ত্যাগ করে এসেছিল? কোন মুখে বলবে এত আঘাতের পরও তার ভালোবাসায় এতটুকুও খাদ পড়েনি?
মৈত্রী তাড়া দিয়ে বলে,
“দেরি হচ্ছে রোকসানা। না প্যাঁচিয়ে বল বাচ্চা ঠিক আছে?”
ডাক্তার সাহেবার প্রতিবাদ খাণিক দমে শক্ত কথায়। তবে অবিশ্বাস্যও লাগে তার, কারণ যেখানে মৈত্রী নিজেই এসবের ভুক্তভোগী ছিল একসময়, সেখানে সে কী করে এত স্থবির?
“বাচ্চার গায়ে আঘাত লেগেছে, তেমন ক্ষতি যদিও হয়নি। ব্যথা হতে পারে কিছু ঔষধ দিচ্ছি ব্যথা হলে খেয়ে নিয়ো। আর হ্যাঁ নিজের বাচ্চাকে সেফ রাখতে চাইলে এই জঙ্গল থেকে বের হও৷ তোমার মতোন মেয়েদের জন্যই এরা সাহস পায়। আজ তুমি সহ্য করছো, কাল তোমার মেয়ে সহ্য করবে। কারণ তোমার থেকে তো সে এটাই শিখবে।”
এবার বাসন্তীর একটু বিরক্তই লাগে। সাদা এপ্রোন গায়ে জড়ানো মহিলাটির অতিরিক্ত নাক গলানো তার ভালো লাগছে না। বেশি রাগ লাগছে দুনিয়ার সব মেয়ের অত্যাচারিত হওয়ার জন্য তাকে দায়ী ঘোষণা করায়।
“রোকসানা, এসব বলে শুধুই রাগ আর বিরক্তির পাত্রী হবি। প্রেমের ঘোরে ডুবেছে, তাও কৈশোরে বোনা প্রেমের ইন্দ্রজাল, এত তাড়াতাড়ি মুক্তি হবে কি? বাচ্চার জীবনের চেয়ে গায়ক স্বামীর প্রেমটাই না বড়!”
মৃদু হেসে কিছুটা কটাক্ষ করেই বলল মৈত্রী। তা ঠিক ধরতে পারে বাসন্তী। লজ্জা ও অনুশোচনা হচ্ছে বটে। যে মানুষগুলো তার এবং তার অনাগত সন্তানের মঙ্গল কামণা করছে তাকে নিয়ে এমন কুচিন্তা সে কী করে করতে পারল?
___
এপার্টমেন্টের সামনে রিকশা থামতেই রিকশাওয়ালা ভাড়া চাইতেই বাসন্তীর ম্লান চোখজোড়া আরও অনুজ্জ্বল হয়ে পড়ে। বলতে গেলে সে বড়লোকের বউ, কিন্তু সত্য হলো তার কাছে একটা কানাকড়িও নেই। যা ছিল তা যাওয়ার ভাড়া, ভিজিট আর ঔষধ কিনে শেষ৷
মৈত্রী হয়তো তার ঢাকা মুখের দোটানাও বুঝতে পারে। কিছু না বলে সে নিজেই ভাড়াটা মিটিয়ে দেয়। এপার্টমেন্টে ঢুকার আগমুহূর্তে হাত ধরে মাত্র দুটি বাক্যই বলে বাসন্তীকে।
“তোমার কী করা উচিত বা অনুচিত তা আমি গুণাবো না। শুধু বলব, এই বাচ্চাটা বুঝদার হওয়া পর্যন্ত তাকে প্রটেক্ট করার, আগলে রাখার কর্তব্য তোমার; আশা করি নিজের কর্তব্য পালনে পিছ পা হবে না।”
বাসন্তী চুপচাপ শুনে এ কথা। উত্তরে শুধু এক সুদীর্ঘ উত্তপ্ত শ্বাস নির্গত হয় তার শরীর থেকে। এই নিঃশ্বাসের অর্থ একটাই। তা হলো আমার মনের অবস্থা আর পরিস্থিতি কোনোটাই আপনার জানা নেই।
বাসায় ঢুকতেই নায়িমের ঠাশ করে এক চড় পড়ে বাসন্তীর গালে, এত জোরেই পড়ে যে তার মাথা যেয়ে পড়ে ডাইনিং টেবিলের কোণায়৷ চমকে উঠে সামনে তাকাতেই ভয়ে কুঁকড়ে যায়। নিচু গলায় বিনতি করে বলে,
“আমি হাসপাতালে গিয়েছিলাম বাচ্চা সুস্থ আছেনি দেখতে। আপনি দয়া করে আমাকে মারবেন না, বাচ্চার ক্ষতি হবে।”
“শালা বাচ্চা, বাচ্চা করবি না! এই বাচ্চার বাহানা দিয়া আমারে ধোঁকা দেস? বাইরে যাস? এই বাচ্চাই আর রাখব না এখন।”
বলেই পা উঠাতে নেয় বাসন্তীর পেটে লাথি মারার উদ্দেশ্যে। ঠিক তখনই বাসন্তী টেবিল থেকে ছুরিটা তুলে সামনে ধরে দৃঢ় গলায় বলে,
“খবরদার! ভুলেও আমার সামনে আসবেন না!”
“ওহ, জল এত দূর গড়িয়েছে। এখন আমাকে মারতে উদ্যত হইসোস! আয়, মার আমারে, আমি তোরে ডরাই?”
বিদ্রূপের সুরে বলল নায়িম। হুট করেই বাসন্তীর ভীতু চোখ জোড়ার সব ভয় যেন হারিয়ে গেল। একদম নির্ভয়ে আলতো হেসে উঠে সে।
“কে বলেছে আমি তোমাকে মারব? যার জন্য নিজেকে নিঃস্ব করেছি তাকে শেষ করার মতোন সাহস তো আমার নেই। আমি তো সব ঝামেলার গোড়াই শেষ করব। তাকে শেষ করব, যাকে শেষ করলে তোমার শান্তি, আবার আমারও মুক্তি। নিজেকেই মেরে ফেলব আজ।”
অকপটে কথা টুকু শেষ করেই নিজের গলায় ছুরি ধরে সে। নায়িম ভয়ে কেঁপে উঠে৷ তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু, মানুষ, খেলনা বাসন্তী৷ এত সহজে তাকে হারাতে পারে না৷
ভয়ার্ত মুখে কাঁপা কাঁপা গলায় শুধালো,
“ন-না, না, আ-আমি চলে যাচ্ছি। ত-তুমি ছুরি ফেলো প্লিজ।”
সে চলে যায় সদর দরজা বাহিরে। তবে যাওয়ার আগে একপলক রাগী দৃষ্টিতে তাকায়। এর মানে সুযোগ পেলেই চেপে ধরতে হাত কাঁপবে না তার।
বাসন্তী ছিটকিনি লাগিয়ে দরজায় গা ঠেকিয়ে শব্দ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এখানে থাকলে তার সন্তানের ক্ষতি যেকোনো ক্ষণে হতে পারে। তাই এখান থেকে চলে যাওয়াই শতভাগ উচিত।
কিন্তু পাঁচ বছরের বৈবাহিক জীবনের বা আট বছরের সঙ্গীর মায়া কাটানো কি এত সহজ? এই মায়ায়ই তো কতবার নিজের মমতার গলা টিপে মেরে ফেলেছে। সে কি পারবে এই সংসারকে, নায়িমকে ত্যাগ করতে? আর সবচেয়ে বড় কথা সে তো এখনো জানেই না মানুষটির এমন আচারণের কারণ কী?
চলবে…?