টক্সিক রিলেশনশীপ,৪,৫
ঈপ্সিতা শিকদার
৪
নায়িম বেশ কয়েক গ্লাস ড্রিংক সাবাড় করার পরও তাকে স্বাভাবিক দেখে অবাক হয়ে যায় তার সাথে থাকা মানুষগুলো। প্রডিউসার সাহেব মুখে বিস্ময়বোধক চিহ্ন এঁকে বললেন,
“বাব্বাহ্ নায়িম! কী পাক্কা খেলোয়াড় তুমি! এত ড্রিংক করার পরও তোমার নেশা হচ্ছে না।”
হেসে দেয় নায়িম। বারটেন্ডার পাশ থেকে তার হয়ে উত্তর দেয়,
“স্যার তো মকটেইল ড্রিংক করছে এতক্ষণ ধরে। নেশা হবে কী করে!”
নায়িম আর কোনো কথা না বলে উঠে পড়ে। তার যেতে হবে। এই ক্লাবটা উত্তরায়, আর বাসন্তীর এপার্টমেন্ট লালমাটিয়াতে। ভালোই দূর।
নীলচে বর্ণের মণি সমৃদ্ধ গভীর তীক্ষ্ম চোখজোড়া অন্ধদের ন্যায় কালো রঙা চশমায় ঢেকে নেয়, মুখ ঢাকে মাস্কে। অতঃপর নীল হুডি পরে গাড়ির বাহিরে পা রাখে সে। ফ্লাটে ঢুকে সবসময়কার ন্যায় আজও সর্বপ্রথম পা রাখে বাসন্তীর ঘরে।
নির্নিমেষ চাহনিতে থাকে ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় শুয়ে থাকা রমণীর দিকে। এই মেয়েটির মুখশ্রী তার নিকট সদাই কেমন যেন নিষ্পাপ ও পবিত্রতার ছোঁয়ায় পরিপূর্ণ লাগে। ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যায় আলতো হাতে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর আলমারির উপর থেকে ফাস্ট এইড বক্স নামিয়ে বাসন্তীর গায়ের প্রতিটি আঘাতে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দেয়।
“মায়া-মমতা হীন রাক্ষুসে মানব বসন্ত কুমারী, তুমি তা না জেনেই দিয়েছিলে হানা। তবুও কেন যে তোমায় মায়া দেখাতে ইচ্ছে করে মাঝেসাঝে?”
অনেকটা আক্ষেপের সাথেই হিসহিসিয়ে বলে নায়িম। ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হতে।
__
চৈতালি বুঝতে পারে নায়িম এসেছে। ছোট্ট একটা ম্যাসেজ পাঠায় সে তাকে আসতে বলে। দুঃখী দুঃখী চেহারা করে বসে থাকে যুবকের আগমনের আশায়।
নায়িম ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে ফোনের আলো জ্বলছে। হাতে নিতেই দেখতে পায় চৈতালির ম্যাসেজ। চোয়াল শক্ত হয়ে যায় তার। এমনিতেই জীবনে ঝামেলার শেষ নেই, তার উপর জুটেছে উটকো এক বোঝা। বাথরোব পরেই চলে যায় চৈতালির ঘরে। হালকা নক করে বলে,
“ডেকেছিলে?”
চৈতালি এগিয়ে আসে। তার মুখে মেকি বেদনার ছাপ, বিনীত তার ভঙ্গিমা।
“হ্যাঁ, আমি জানি বিরক্ত হচ্ছো। কিন্তু কী করব বলো? আমিও নিরুপায়। ব্যবস্থা করতে পেরেছো কিছু আমার জন্য?”
“চেষ্টা করছি। হলে আমিই জানাব। ততদিন তুমি নিশ্চিন্তে এই বাড়িতে থাকতে পারো।”
কথাটা কোনোরকম বলা শেষ করতেই। চৈতালি মিথ্যে কান্না কান্না ভাব নিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে।
“তুমি যে কী উপকার করলে নায়িম… নাহলে বলো কোথায় যেতাম আমি একা মেয়ে?”
চৈতালির আবেদনময়ী পোশাক আচার-আচারণ স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে নায়িমকে, সে চাইলে অন্যভাবেও পেতে পারে। ঘৃণায় আবার গা গুলিয়ে আসে যুবকের। বিবাহিত নারী কেন অন্য পুরুষের সংস্পর্শে আসা যেকোনো নারীর গা ঘেঁষাতে তার অতিরিক্ত ঘিন লাগে। ইচ্ছে তো করছে ঠাটিয়ে এক চড় মারতে, তবুও সয়ে তাকে সরিয়ে দেয় নায়িম।
নায়িমকে যে মহিলা বড় করেছিলেন তারই মেয়ে চৈতালি। এই মেয়ে তার আগা-গোড়া সব সত্যি জানে বলেই এতটা নীরব সে। নাহলে তো কবেই ঘাড় ধাক্কা দিত।
চৈতালি অনেকটা সময় নায়িমকে নানা সুখ-দুঃখের গল্প শুনিয়ে বসিয়ে রাখল। যখনই নায়িম উঠতে যাবে তখনই কিছু না কিছু বলে থামিয়ে দিত।
এর মাঝে বাসন্তী একবার ঘুম থেকে জেগে তাদের দেখে গেছে। তার এসবে সয়ে যেয়েও যেন যায়নি। নিস্তব্ধ অশ্রুর বিসর্জন দিতে দিতেই পুনরায় ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় সে।
___
কয়েক ঘণ্টা পর ছাড় পায় যুবক। চৈতালির থেকে নায়িম মেকি হাসি দিয়ে বিদায় নেয়। অনেক কষ্টে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করেছে সে।
শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে সোজা গোসল করতে যায় সে। একদম সাবান দিয়ে ডলে ডলে গোসল করে সে। তারপর বক্সার পরে বাসন্তিকে ঝাপটে ধরে চোখ বুজে ফেলে।
ঠিক সেই মুহূর্তেই মনে পড়ে অসম্পূর্ণ কাজের কথা। বাসন্তির বক্ষে মাথা এলিয়ে শবনমের র-ভিডিও কে.কে সহ বিভিন্ন নিউস মিডিয়ার লোকদের কাছে ফরওয়ার্ড করতে করতে বলে,
“তোমার নিষ্পাপ দেহে মিশে পাপ কাজ করছি বসন্ত কুমারী। আমার জগত পাপ, মিথ্যে, প্রতারণায় ঘিরে, আর আমার জগৎই তোমার একমাত্র আশ্রয়। এসবের সাথে তো তোমায় চলতেই হবে।
তবে ভুলেও এগুলোর রেশ মাত্র আমা যাবে না। তোমায় সদা পবিত্র, নিষ্পাপ, সরল মায়াজাল ও স্বস্তির অস্তিত্ব হয়েই থাকতে হবে আমার পাপিষ্ঠ জীবনে। থাকতে হবেই তোমায় বসন্ত কুমারী!”
___
ফজরের আজানে ঘুম ভাঙতেই নিজেকে নায়িমের বাহুবন্ধনে পায় বাসন্তী।
“কতটাই না নিষ্পাপ লাগছে ঠোঁটের কিনারায় তিল যুক্ত এই পুরুষটিকে! কত নিরাপদই না বোধ হচ্ছে নিজেকে! কিন্তু সত্যিই কি আমি নিরাপদ? না কি সবটাই ধোয়াশা হৃদয়ের? কিন্তু হৃদয় তো কখনো ধোঁকা দেয় না তাহলে?”
ভাবতে ভাবতেই বিছানা ছাড়ে বাসন্তী। সাত মাসের সন্তান গর্ভে নিয়েও নামাজ পড়তে, ইবাদত করতে কৃপণতা করে না। তবুও যে কেন আল্লাহ মুখ তুলে তাকায় না এ নিয়ে বিশাল আক্ষেপ তার।
ঘুম থেকে উঠে নিস্তার নেই তার। এখন নায়িমের ডায়াট চার্ট অনুযায়ী রান্না করতে হবে। আটটার মধ্যেই উঠে যাবে সে। তারপর হালকা পাতলা খেয়ে খাণিক রেস্ট নিয়ে ব্যয়াম করবে।
নিউজে বড় বড় করে লেখা আসছে, “কে.কে. এর গার্লফ্রেন্ডের গোপণ ক্লিপ ভাইরাল, অফার করেছেন তরুণ গায়ক নায়িমকেও”। ঘুম থেকে উঠেই বেডরুমের টিভি অন করে এই খবর দেখে কতটা পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে নায়িম তা তার চোখ-মুখে উপচে পড়া হাসি দেখেই বোঝা যায়।
সেই সাথে ফেসবুক নিউসফিডেও চোখ বুলাচ্ছে সে। সাধারণ জনতা বেশ খুশি এবং গর্বিত তার উপর এমন মেয়ের বাজে প্রস্তাবে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়াই। অনেক পজেটিভ নিউস হয়েছে তাকে নিয়ে। যেমন প্রথম আলো থেকে ” বর্তমান সময়ে এসেও নারী ও মাদক নেশা মুক্ত, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী ব্যাচলর সেলেব্রেটি”। একদিনেই প্রায় আড়াই লাখ ফলোয়ার্স বেড়েছে তার।
নিজের খুশি নিয়ন্ত্রণে এনে মনে মনেই বলে,
“তুই ছোট ছোট খুশির চক্করে মূখ্য বিষয় ভুলে যাচ্ছিস। তোকে যে করেই হোক বসন্ত পাখির নতুন নতুন গজানো ডানা কেটে দিতে হবে। তা কী করে করবি ভাব?”
___
ফাহিম অনেকটা বাধ্য হয়েই সাজিয়াকে কল করে। এছাড়া কোনো উপায় দেখছে না সে। প্রায় পাঁচেক সেকেন্ড রিং হওয়ার পর কলরিসিভ হয়। কিন্তু রিসিভ করে তার দুলাভাই।
“হ্যালো? ফোন দিয়েছো কেন? বুঝেছি বউ এখনো আসেনি।”
তার গম্ভীর সুরেই যে বিরক্তের ছোঁয় তা বেশ ভালোই বুঝে ফাহিম। বড়োই রাশভারী ও হিসাবী মানুষ তার দুলাভাই মইনুল, কারো সাথে মাত্রাতিরিক্ত খাতির বা মাখামাখি সম্পর্ক রাখতে অপছন্দ তার। সে যে-ই হোক, নিজের আপন মায়েরও বছরে একবার খোঁজ নেয় না। সেখানে সাজিয়ার রোজ রোজ আসা নিয়ে নির্ঘাত সে নাখুশ।
“আপু আছে?” ফাহিম খাণিকটা সময় নীরব থেকে জিজ্ঞেস করে। ফোনের অপরপাশে থাকা পুরুষটি নাক-মুখ কুঁচকে ফেলে স্ত্রীকে ডাক দেন।
“নেও তোমার ভাই শেহজাদার ফোন। আবার খাটাইতে ডাকছে।”
“আহা… এমন করে কেন? যাও টেবিলে ভাত দিয়েছি খেতে বসো।”
রাগে হনহন করে বেডরুম থেকে বেরিয়ে যান মৈনুল। সাজিয়া শান্ত গলায় শুধায়,
“দেখ, ভাই আমার নিজেরই স্বামী-সংসার আছে। এছাড়া তোর দুলাভাই কেমন ধরনের মানুষ তুইও জানিস। আমি কীভাবে রোজ রোজ…?”
চুপ করে থাকে ফাহিম। বোন যে একটা কথাও মিথ্যে বলেনি তা সম্পর্কে সে পুরোপুরিই জ্ঞাত। সাজিয়াও কিছুটা বিরতি নিয়ে মুখ খুলে।
“ঐ মেয়ে আর ফেরত আসবে না। ও সংসার করা মেয়েই না, যার এত টাকার খাই তারে দিয়ে কী আর সংসার হবে! আমি একটা মেয়ের কথা শুনলাম আজ মৈনুলের চাচীর থাকে, তুই বিয়েটা এবার…”
“টুৎটুৎ” কথাটা সম্পন্ন করার পূর্বেই এই শব্দ শুনতে পেল সাজিয়া। সে ক্রোধান্বিত হয়ে যায়। ভেঙচি কেটে বিড়বিড়ায়,
“মাইয়াগো মতো ঢং লাগায় একটা ভালোবাসার! আমার আর কাজ নাই, আমি যায়া উনার সংসার সামলাব, আর উনি বউরে মানাবে।”
ফোন কেটে মায়ের ঘরে উঁকি দেয় ফাহিম। তিনি গভীর তন্দ্রায় ডুবে। আনমনেই ভাবে,
“পুরুষদের জীবনটা এমন কেন? মেয়েদের প্রেমে ব্যর্থ হলে, ভালোবাসা হারালে কম-বেশি সবাই সহানুভূতি দেখায়, তার কষ্ট বুঝার চেষ্টা করে। অথচ, ছেলেরা এমন পরিস্থিতি পড়লে বন্ধু-বান্ধব, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সবাই এমন একটা ভাব করে যেন এসবে আমাদের কোনো কষ্টই লাগে না।
কোনো প্রভাবই পড়া উচিত না এতে আমাদের উপর, এসব একদম স্বাভাবিক যেন আমাদের জন্য। কী আশ্চর্য! আমরা কী মানুষ নই? না আমাদের হৃদয় নেই বা ব্যথা অনুভব করি না আমরা? এসবও বুঝি মেয়েদের জন্য তোলা?
এজন্যই এখন প্রেমিকার সুইসাইড হারের চেয়ে প্রেমিকের সুইসাইডের হার বেশি। কারণ তাদের কষ্ট কেউ বুঝতেই চায়। উলটা খিল্লিই উড়ানো হয় দেবদাশ সহ কত শত নাম দিয়ে।”
চলবে…
#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||৫ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
বাসন্তীকে শান্ত হয়ে রান্নাঘরে কাজ করতে দেখালেও সে ভয়ে অসম্ভব রকমের কাঁপছে। সে জানে নায়িম তাকে এক চুল ছাড় দেওয়ার নয়। তাছাড়া গতকাল যে সাহসিকতা সে দেখিয়েছে যুবক যে তাকে শায়েস্তা করতে অগ্রসর তাতে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তবুও কীসের এত অপেক্ষা তার? এখনো এসে তাকে কেন ঘেরাও করেনি সে?
অন্যমনস্ক রুটি উল্টাতে যেয়ে ডান হাতে ছ্যাঁকা লাগে বাসন্তীর। “আহ্!” মৃদু আর্তনাদ বেড়িয়ে আসে তার দু’ঠোঁটের ফাঁক থেকে।
আওয়াজ শুনে দ্রুত সেখানে উপস্থিত হয় নায়িম৷ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে, “কী হয়েছে?” বলতে বলতেই এগিয়ে যায় তার দিকে।
উজ্জ্বল গায়ে একদম লাল দাগ পড়ে গেছে। নায়িমের কপালের রগ স্পষ্ট হয় রাগে। শক্ত করে চিবুক চেপে ধরে বাসন্তীর। একে তো হাতের ব্যথা তার উপর নায়িমের হাতের শক্ত চাপ। বেদনারা দলা পাকিয়ে আসছে যেন গলা থেকে।
“তুই আমার সাথে তেজ দেখায়া ইচ্ছা করে করসোস এসব, তাই না? আমি বুঝি না ভাবসোস?”
রক্তচক্ষু নিয়ে বাসন্তীর চুলের মুঠি চেপে ধরে নায়িম। বাসন্তী ভয়ে থরথর কাঁপছে। সে জানে নায়িম ভাবছে, এই ব্যথা তার ইচ্ছেকৃত প্রাপ্তি। যুবকের এই ভাবনার পিছনেও দায়ী বিয়ের কিছুদিন বাদের এক ঘটনা।
তখন সপ্তাহ খাণেক হবে বাসন্তী ও নায়িমের বিয়ের। এই কয়েকদিনেই প্রায় সারাক্ষণ খ্যাঁচখেঁচি আর বকাই শুনেছে নায়িমের রমণী। তবে সেদিন মুখে মুখে উত্তর দেওয়ায় চড়ই দিয়ে বসে তাকে নায়িম। গাল চেপে ধরে হুমকি দেয়,
“তোরে যত ছাড় দেই, তুই অত মাথায় উঠে বসিস পুড়োমুখী! মেরে একদম সব তেল বের করে দিব!”
কিশোরচিত্ত প্রিয় মানুষের এত নিষ্ঠুরতা যেন সইতে পারে না। হঠাৎ করেই বিকেল বেলা এক অকাজ করে বসে সে। নিজের হাতে তিনটা আঁচড় কাটে ছুড়ি দিয়ে। আরেকবার আঘক করবে তখনই সদর দরজা খুলে প্রবেশ করে নায়িম। যুবকের তো পাগল হওয়ার দশা। তাড়াতাড়ি হাত ব্যান্ডেজ করতে শুরু করে সে। যা তা ভাষার প্রয়োগ তো সাথে আছেই।
“তোর তেজ বাইরা গেসে? নিজের গায়ে হাত লাগাস তুই? তুই জানোস এই দেহটা, আত্মাটা সবকিছু শুধুই আমার। মারা, কাটা যা খুশি আমি করব তোর সাহস হয় কী করে!”
নায়িমের উন্মাদ আচারণে তার বসন্ত কুমারী তো ভয়ে কেঁদেনেয়ে অস্থির। তার ভয়ই সত্য হয় ব্যান্ডেজ করে বেধড়ক মারে নায়িম। এতটাই যে আর কখনো সাহস হয়নি তার নিজেকে আঘাত করার।
এরপর থেকে নায়িমের তার গায়ে ক্ষত দেখলেই ভাবত সে ইচ্ছাকৃত ভাবে উত্যক্ত করতে করেছে। নায়িমের মাঝে যেই ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল তা কখনো দূর করা সম্ভব হয়নি, হয়তো হবেও না। কথায় আছে, ঘুমান্ত মানুষকে জাগানো যায়, কিন্তু জেগে থাকা মানুষকে কখনোই না।
___
ফাহিম শেষপর্যন্ত খুব কষ্টে একজন কাজের লোকের ভরসায় মাকে রেখে অফিসে আসে। সে অফিসে আসতেই খেয়াল করে তাকে দেখে তার কলিগদের মুখে কেমন যেন বাকি হাসি ফুটে উঠে। বিষয়টায় খটকা লাগে তার। তবুও চুপ থাকে সে।
সে তার নির্ধারিত চেয়ারে বসেছে তখনই তার কলিগ ভাবনা আসে সেখানে। মেয়েটা তার ক্লাসমেটও ছিল, বেশ কয়েকবার তাকে প্রপোজ করেছিল, কিন্তু প্রেমের টানে আর ধোঁকা দেয়নি সে।
“আমাকে রিজেক্ট করে খুব তো চৈতালিকে বিয়ে করেছিলে। দেখলে তো কী হলো? ছেড়ে চলে গেল তো তোমায়।”
ভাবনা আজ নিজের মনের সব ক্ষোভ ভাষায় বলে। তারপর মুখ ঝামটা মেরে চলে যায়। একটু বাদেই ফাহিমের সিনিয়র আহমদ সাহেব আসেন।
“শুনলাম তোমার বউ চলে গেছে তোমায় ছেড়ে। তা কেন সুখে রাখতে পারোনি বুঝি?
বলে এমন ভাবে হা হা করে হাসে যেন কী হাস্যকর এক কাণ্ড ঘটেছে। মোটা মানুষ তিনি হাসতে হাসতে নিজেই হাঁপিয়ে যায়। একে একে সব ছেলে কলিগই কোনো না কোনো মন্তব্য দেয় ব্যপারটি। কারো সান্ত্বনার দেওয়ার প্রয়াশ, কারো দ্বিতীয় বিয়ে করার প্রেরণা, কারো বা ক্ষতে লবণ-মরিচ দেওয়া।
লজ্জায়, অপমানে ফাহিম চোখজোড়া ছলছল করে উঠে। সে অফিসের এক নীরব কোণে যায় সিগরেট ফুঁকার জন্য। সিগরেট প্রাণঘাতক হলেও এক মিথ্যে শান্তি পায় পুরুষ, যা শুধু পুরুষই জানে। এও জানে এই শান্তি মিথ্যে, তবুও নিজেকে আটকে রাখতে না পারার ব্যর্থতা।
নিকেটিনের ধোঁয়ায় যখন সে কষ্টগুলো উড়িয়ে দিতে ব্যস্ত তখনই তার কাঁধে হাত রাখে কেউ। পিছনে ঘুরে দেখে ভাবনা।
” আরও কিছু বলার আছে?” তার কথায় ঠাট্টা সমেত বেদনারও গাঢ় ছোঁয়া।
“আমাকে ক্ষমা করে দিবে। এতদিনের ক্ষোভ হঠাৎ করে সুযোগ আসায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। আর সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে আল্লাহর উপর ভরসা রাখো।”
ভাবভঙ্গিতেই বুঝা গেল মেয়েটা সত্যিই অনুতপ্ত। সে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানায়। তারপর বিরাট জানলার সম্মুখে দাঁড়িয়ে সামনের দৃশ্য দেখতে থাকে। আনমনেই ভাবে,
“আমার এই ছন্নছাড়া জীবনের কোনো গতি আদৌ আছে কী? আমার কী সত্যিই চৈতালির আশা বাদ দিয়ে দেওয়া উচিত?”
___
বর্তমানে, অতীতের সকল ঘটনা ভেবেই ভয়ে গা শিউরে উঠছে বাসন্তীর। নায়িম তার চুলের মুঠি ধরে বেডরুমে নিয়ে আসে তাকে বেডে বসায়।
হাতে বার্নল লাগাতে লাগাতে শান্ত সুরে বলে,
“তোর অনেক সাহস বাড়সে ইদানীং বসন্ত কুমারী? আমার অবাধ্য হচ্ছিস তুই। বাহ্! তা এত সাহস কোথা থেকে আসছে? ঐ মৈত্রী নামক মহিলা থেকে না কি তার স্বামী থেকে?”
তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বাসন্তীর দিকে সে। এমন কুৎসিত মন্তব্য শুনে বাসন্তীর ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসছে। তবুও তার কিছু বলার নেই, অশ্রুর স্রোত বাইতে দেওয়া ছাড়া, নাহলে যে হিতে-বিপরীত হয়ে যাবে।
“চড়ুই পাখির ডানা গজালে তা কীভাবে কেটে দিতে হয় আমার জানাই আছে। যাকগে এত ভুল করসোস পরিণতিতে তো শাস্তি পাবিই। আজ তোকে একটা ডিসকাউন্ট দেই, তোর শাস্তি তুই চ্যুজ কর আজ। হয় পাঁচ ঘণ্টা এক পায়ে বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবি, নয় দুই ঘণ্টা একদম বেধড়ক মার খাবি বেতের। কোনটা চাস?”
উত্তর দেয় না বাসন্তী। আরও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। ধমক দিয়ে উঠে নায়িম,
“কী হলো বল কোনটা চাস? প্রথমটা?”
ধমকে কম্পিত হয় বাসন্তীর পুরো শরীর। সে ঠিক-বেঠিক না বুঝেই মাথা ঝাঁকায়।
“ওকে স্টার্ট নাউ। যেয়ে দাঁড়া। কাটায় কাটায় পাঁচ ঘণ্টা। যদি একবারও পা নামে না আবার প্রথম থেকে কাউন্ট শুরু হবে।”
নায়িমের কথা শুনে বাসন্তী দ্রুত যেয়ে তার কথা মোতাবেক কাজ করা। কিন্তু সাত মাসের পেট নিয়ে এক পায়ে দাঁড়ানো কী সহজ কথা! মুহূর্তেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে সে, হাত-পা ভেঙে আসে তার। তবুও নায়িমের ভয়ে পা নামাতে পারছে না। দেহ আর সায় না দেওয়ায় অজান্তেই পা নামিয়ে ফেলে সে।
“আবার প্রথম থেকে শুরু করো বসন্ত কুমারী।”
“আ-আমার খুব খারাপ লাগছে। প্লিজ একটু…”
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে নিজের কষ্ট জাহিরের চেষ্টা করে বাসন্তী। কিন্তু তাতে কোনো ধ্যান দেয় না নায়িম। এর থেকে প্রায় আধঘণ্টার মাঝেই অসুস্থ দেহ আর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে চেতনা হারিয়ে পড়ে যেতে নেয়, নায়িম তাড়াহুড়ো করে উঠে যেয়ে ধরে তাকে। কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুয়িয়ে দেয়।
নিজের বসন্ত কুমারীর অধরে হাত বুলাতে বুলাতে শুধায়,
“তোমার এই দেহে শুধুই আমার হক বসন্ত কুমারী। তোমারও কোনো হক নেই তাতে আঘাত দেওয়ার। তবুও কেন যে তুমি…? জানো তো আমার আদালতে ক্ষমা হয় না তবুও কোন সাহসে ভুল করো তুমি?”
বাসন্তী অর্ধচৈতন্য অবস্থায় সবই শুনতে পায়। কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেওয়ার আক্ষেপ টুকুও নেই তার মাঝে।
___
অনিমেষ পাঁচ পাঁচটা ভোডকা শটস্ সাবাড় করে দিয়েছে বারে আসতে না আসতেই। নায়িম তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছে।
“আরে ব্যাটা আস্তে খা। কেউ নিয়া যাবে না।”
তার কথায় ভেঙচি কাটে অনিমেষ। নায়িমের একমাত্র ভালোবাসার এবং বিশ্বস্ত মানুষ সে পৃথিবীতে। নায়িমের প্রিয় বন্ধু অনিমেষ ঘোষ, পেশায় একজন উকিল।
“এট লিস্ট তোর মতোন বউ পিটাই না। কুটনামি করে আরেকজনের লাইফ নষ্ট করি না।”
নায়িম কিছুই বলে না শুধু হাসে। অনিমেষ বিরক্ত হয়, নিরাশ হয়।
“তোর সমস্যাটা কী আমি বুঝি না? না কোনো টাইপের নেশা করোস, না মেয়েবাজ, আবার পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তোর মতোন শয়তানি ভাবনা কেউ রাখে না কি আল্লাহ জানে। তুই তো সিংহের থেকেও খারাপ, সে আক্রমণ করার আগে তো জানান দেয়। তুই না জানিয়ে, না বুঝিয়ে একদম নিগলে ফেলে ধ্বংস করে দিস।”
নায়িম উত্তর দেয় না কোক পানে ব্যস্ত। যেন কোকেই তার সব ধ্যান, খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ এটা। অনিমেষ জানে এই ছেলের স্বভাব তাই উপেক্ষিত হয়েও রাগান্বিত হয় না।
“সবই বুঝলাম কিন্তু এভাবে টর্চার করিস কেন বাস…”
আর বলতে পারে না নায়িমের চোখের জ্বলন্ত দৃষ্টির সামনে। সামান্য ঢোক গিলে বলে,
“আই মিন ভাবীকে এভাবে টর্চার করিস কেন?”
“আমি শুধু শুধু কিছু করি না। আমার অবাধ্য হলেই… ও খুব ভালো করেই জানে আমি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে জানি না, তবুও অবাধ্য হয়ে উত্যক্ত কেন করে আমায়? ইদানীং তো অতিরিক্ত। ঐ ডিভোর্সি মহিলা, তার হাজব্যান্ডের সাথে কথা বলতে না করসি, তার সাথেও পেটে পেটে খাতির। বাচ্চা নিতে না করসি তাও রাখসে পেটে একখান। ঘর থেকে বাইর হইতে না করি তাও…”
বলতে বলতেই হিংস্রতায় ছেয়ে যাচ্ছে চোখ-মুখ। অনিমেষ বুঝতে পেরেই হুট করে ভিন্ন এক প্রশ্ন করে ফেলে নায়িমকে বিচলিত করার জন্য।
“তুই কি সত্যি ভালোবাসিস মেয়েটিকে?”
“জানিস তো নেশা বড়োই ঘাতক মানবের জন্য। এজন্যই আমি নিজেকে সব ধরনের নেশা থেকে রক্ষা করে চলি। হোক তা মেয়ের হোক তা মাদকের। আর সবচেয়ে বড় এবং ক্ষতিকর নেশা হলো ভালোবাসার আসক্তি। এই নেশা ইচ্ছাশক্তি, মন ও মস্তিষ্ককে ভিতর থেকে দুর্বল করে দেয়। আমি এতটাও বোকা নই যে সব আসক্তির থেকে গা বাঁচিয়ে এখানে গা ডুবাব।”
নায়িম একটুও বিচলিত হয়নি, বরং বেশ ঠাণ্ডা ভাবে জবাব দিয়েছে।
“ও শুধুই আমার জীবনে স্বস্তি ও পবিত্রতা অস্তিত্ব। তোদের ভাষায় বলতে গেলে আমার জীবনে পবিত্রতার দেবী সে।”
“দেবীকে বুঝি কেউ এভাবে জানোয়ারের মতোন মারধর করে?”
“উহু, এ আমার আরধনা। নারী বলতেই ছলনাময়ী, প্রতারক একদলা মানুষরূপী মাংসপিণ্ড। তারা পূর্ণতা পেলেই প্রতারণা করে, তাদের দুনিয়াবি চাহিদা বেশি, তাই তো তার মূল সম্পদটাকে একান্ত মানুষটাকে অর্পণ করা ছাড়াও বাকিদের কাছেও বিলিয়ে বেড়ায় নিজ লাভে।
আমি আমার বসন্ত কুমারীকে পেয়েছি একদম সদ্য ফুটন্ত অবস্থায়। যখন তার মন-মস্তিষ্ক প্রতারণা, প্রাচুর্য, আর্থিক শান্তি, দুনিয়াবি লাভ কিছুই বুঝতো না। তাই তো এই নিঃস্ব রমণীকে সর্বস্বান্ত করে নিজের করেছি। তবে সে তো নারী, একবার প্রতারণার স্বাদ পেলে, বারবার করবে।
তোর ভাষায় আমার পবিত্র দেবীকে তো আমি কলুষিত হতে দিতে পারি না। তাই তাকে শাসনে, শোষণে রাখি। যাতে সে দমে থাকে, পবিত্রতার শীতল ছায়া হয়ে আমার জীবনেই থাকে।”
“বড়োই অদ্ভুৎ তোর লজিক। সব বুঝলাম তবে বাচ্চাটাকে নিয়ে এমন করছিস কেন?”
“সন্তান হলে নারীর সাহস বাড়ে। সন্তানকে ঢাল বানিয়ে প্রতারণা করে। দেখসোস না মি. খান, আর চৈতালির বরের অবস্থা? মেয়েদের ছাড় দিয়ে রাখলে এমনই হয়। আমি এই ভুল করছি না।
তাছাড়া মূল সমস্যা হলো, বাচ্চা হলে ও প্রেশার দিবে দুনিয়ার সামনে ওদের পরিচয় দেওয়ার। যা আমি চাচ্ছি না। তারপর আবার বাকি সবটির মতোন মিডিয়ায় খবর দিবে। এতে আমার এত সুন্দর সুইট, ইনোসেন্ট ইমেজটা নষ্ট হবে, তাই না? আর হ্যাঁ অনেক প্রশ্ন-উত্তর হয়েছে নাউ শাট আপ।”
___
চৈতালি নায়িমের দেওয়া ঠিকানা মোতাবেক প্রোডাকশন হাউসে পৌঁছিয়ে গেছে। বেশ আবেদনময়ী ছোট-খাটো, টাইট পোশাক পরে এসেছে সে। তাকে লাগছেও লাস্যময়ী। পঞ্চাশোর্ধ লোকটি তার দিকে শকুনের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাতে খারাপ নয়, বরংচ বেশ ভালোই বোধ করছে সে। মনে হচ্ছে এবার সুখ তার মুঠোর ধরা দিবে। তবে এ কী সুখ না কি মরিচীকা তা তো সময়ই বলে দিবে।
চলবে…