টক্সিক_রিলেশনশীপ,১০,১১

0
1543

টক্সিক_রিলেশনশীপ,১০,১১
ঈপ্সিতা শিকদার
১০

সারাটা রাত্রি নির্ঘুম কেটেছে বাসন্তীর। ভেবেই পাচ্ছে না নায়িমের মতোন ছেলের জীবন এতটা জঘন্য কেটেছে! ছেলেটার মাঝে এত কষ্ট লুকানো এক বিছানায় শুয়েও বুঝতে পারেনি সে।

নিজের পেটে হাত দিয়ে মনে মনে বলে,
“তুই চিন্তা করিস না বাবু। আমি তোর দাদীর মতোন আমি হব না। নিজে শহীদ হয়েও তোকে রক্ষা করব।”

আরও চিন্তা বাসন্তীর। সে তো সাধাসিধে জীবন চেয়েছিল, এত জটিল জীবন নয়। আর সে বিপ্লবীই বা কী করে হবে? এর দ্বারা কী বুঝিয়েছে অনিমেষ? সে যত দূর জানে বিপ্লবীদের দৃষ্টিভঙ্গি থাকে স্পষ্ট, দৃঢ়তা থাকে তাদের মতমতে। বাসন্তীর স্বভাব-আচারণেই এসব নেই। সে কী করে…?

আলোয় ঝলমল করছে চারিধার। রাত্রি ভর নিদ্রাহীন কাটানোর জন্য তন্দ্রাবিষ্ট বাসন্তীর চোখ-মুখ। অস্থির চিত্তে আর শুয়ে থাকতে না পেরে বিছানা থেকে উঠে পড়ে। বিশাল ঘরটা ত্যাগ করে করিডরে হাঁটাহাঁটি করছে সে।

“গুড মর্নিং, ভাবী।”

অনিমেষ চোখ ডলতে ডলতে ঘুম মাখা কণ্ঠে বলে উঠে। বাসন্তী কিছু না বলে মাথা ঝাঁকায়।

“ভালো হয়েছে দেখা হলো। কাল রাতে সব শুনার পর কিছু ভেবেছেন…?”

“কী ভাবব আমি? ভাইয়া, আমি তো এত জটিলতা বুঝি না। মানুষটার কষ্ট লাঘব করতে চাই, একটু ভালো থাকতে চাই স্বামী-সন্তান নিয়ে। কিন্তু কী করে? কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। যার স্বামী তারই সন্তানকে জন্মের সাথে সাথে অন্য জায়গায় ফেলে দেওয়ার পরিকল্পণা করেছে সেই হতভাগা আমি! কীভাবে করব নিজের কপালের লিখন পরিবর্তন!”

বলতে বলতেই সশব্দে কেঁদে দেয় বাসন্তী। মুহূর্ত না পেড়ুতেই সূক্ষ্ম এক ব্যথার সূচনা হয় তার মাঝে। ধীরেধীরে তা যেন মহৎ আকার ধারণ করছে। পেটে হাত রেখেই আর্তনাদ করে উঠে রমণী।

বাসন্তী আর্তনাদ শুনে ঘুম ছুটে যায় বাকি সকলের। অনিমেষ বাসন্তীর শেষ কথা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল, হুট করে চিৎকার শুনে হচকচিয়ে যায় সেও। চৈতালির দরজার সম্মুখেই দাঁড়িয়ে তারা, তাই সে-ই সবার আগে ছুটে এসে ধরে বাসন্তীকে ধরে। নায়িমও এসে পড়ে।

“বসন্ত, কী হয়েছে তোমার? অনিমেষ, চৈতালি কী হয়েছে ওর?”

কাজের মেয়েগুলোও ছুটে এসেছে। তাদের মাঝেই একজন অল্প বয়স্ক মেয়ে উদ্বিগ্ন গলায় উত্তর দেয়,
“ছোটো মালকিনের তো মনে হয় ডেলিভারি সময় এসে পড়েছে। উনাকে হাসপাতালে নিয়ে যান তাড়াতাড়ি।”

নায়িম তাড়াতাড়ি বাসন্তী কোলে তুলে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করে। চৈতালি ও অনিমেষও পিছন পিছন নামছে। গাড়ির পিছনের সিটে চড়ে বসে সে বাসন্তীকে নিয়ে চৈতালিও, অনিমেষ গাড়ি ড্রাইভ করছে। কাছের এক হাসপাতালে এসে গাড়ি থামে।

নায়িম গাড়ি থেকে নামতে নিবে তখনই অনিমেষ হাত ধরে নিষেধ সাধে।
“হুতাশে তুই ভুলে যাচ্ছিস তুই কে। তুই ঠিক হয়ে পরে আসি। আমি আর চৈতালি ভাবীকে নিয়ে যাচ্ছি।”

অনিমেষের কথা শেষ হতেই দুজন হাসপাতালের স্টাফ স্ট্রেচার সমেত এসেছে। চৈতালি কোনোরকম বাসন্তীকে ধরে গাড়ি থেকে নামায়৷ অত্যন্ত ব্যথায় বাসন্তীর অবস্থা খারাপ। অনিমেষ ও চৈতালি তাকে ধরে স্ট্রেচারে বসায়৷ স্টাফ সহ তারা দুজন বাসন্তীকে নিয়ে ভিতরে চলে যায়।

নায়িম নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাদের হাসপাতালে ঢোকা দেখছে। আজ কেন যেন অনুভূতি শূণ্য নায়িমের চোখে বহু বছর পর অশ্রু জমেছে।অসহায়ত্বে জর্জরিত লাগছে। তবুও কেমন শক্ত ভাব চেহারায়, যেন কিছুই হয়নি। নিজের অভিমতকে নিজেই অস্বীকার করছে সে।

“অর্থ, প্রাচুর্য, যশ শুধু আনন্দ, সুবিধা ও সুখ বয়ে আনে না; সাথে আসে সূক্ষ্ম অসহায়ত্ব, অসুবিধা, হারানোর ভীতি, সবকিছু লোকালয়ের আড়ালে রাখার দুশ্চিন্তা।”

____

অনিমেষ, নায়িম ও চৈতালি ওটি এর সামনে দাঁড়িয়ে। সবেমাত্রই ভিতরে ঢুকানো হয়েছে বাসন্তীকে। ভিতর থেকে একজন ডাক্তার ও নার্স বেড়িয়ে এলো চিন্তিত ভঙ্গিমায়।

“পেশেন্টের পরিবারের লোকজন কারা?”
রুক্ষ কণ্ঠ নার্সের।

“আমি। মানে আমি ওর হাজবেন্ড। কী হয়েছে বলুন!” নায়িম এগিয়ে আসে।

“আচ্ছা অসতর্ক লোক তো আপনি! চেকআপ করাননি সময়ে সময়ে? এত কমপ্লিকেশন প্রেগন্যান্সিতে… দেখেন, আপনার উচিত ছিল আরও আগে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে রাখা বা বাসায় রাখলেও এক্সট্রা যত্নে রাখা। যাকগে সময়ের আগেই ডেলিভারি করতে হবে এখনই। তবে এতে বাচ্চার আর পেশেন্টের দুজনেরই রিস্ক থাকবে।”

নায়িম জমে গেছে সব শুনে। কী বলবে বা করবে সে? এমন কী সে দুঃখিত, শোকাহত না কি স্তব্ধ নিজেই বুঝে উঠতে পারছে না। সে স্বাভাবিক, তবুও কী যেন একটা বিধছে বুকের মাঝে।

অনিমেষ জানে না নায়িমের আড়ালে রাখা চোখ-মুখের প্রতিক্রিয়া শুধু ধারণা থেকেই তাকে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু কীসের জন্য সান্ত্বনা পাচ্ছে নায়িম এও নায়িম নিজেই জানে না।

প্রায় ঘণ্টা খাণেক পর সাদা তোয়ালে জড়ানো ফুটফুটে এক বাচ্চা কান্নার সুর তুলে নার্সের কোলে চড়ে বেড়িয়ে এল। নার্স এসে নায়িমের দিকে এগিয়ে ধরল বাচ্চাটিকে।

“এই দেখেন, জান্নাত এসেছে আপনার বাড়িতে। মেয়ে হয়েছে আপনার।”

নায়িম গোল গোল চোখে বাচ্চাটিকে দেখছে। তার আঁখি যুগলে আজ অন্যরকম অনুভূতি প্রবাহিত হচ্ছে। এমন আগে কখনো হয়নি। এ বুঝি পিতৃত্বের সুখ?

“কী নির্মল ও নিষ্পাপ দেখতে! যেন পৃথিবীর কোন মোহ-মায়ার কলুষতা কিংবা ধূলিকণার ছোঁয়া পায়নি ও। আমার পাপিষ্ঠ, মলিন হাত কী ওর যোগ্য! আমি ওর যোগ্য তো? জানি না, জানতে চাইও না। শুধু জানি সর্বক্ষণ, সব পরিস্থিতিতে তোকে আগলে রাখব এই বুকে। রাজকন্যা নয়, সম্রাজ্ঞী হবি তুই খান আর মোস্তফা সম্রাজ্যের।”

কথাগুলো ভাবতেই নার্সের কোল থেকে শিশুটিকে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে নেয় সে। মনে পড়ে যায় বাসন্তীর কথা। স্বাভাবিক কণ্ঠেই প্রশ্ন করে,

“বাসন্তী কোথায়? ও ঠিক আছে তো?”

“ওনার অবস্থা তো খুবই গম্ভীর। যদি কাল সকালের মাঝে হুশ না আসে তাহলে ধরে নিতে হবে কোমায় ফল করতে পারে এমন কী মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকবে। আর বাবুকেও আজ অবজারভেশনে রাখতে হবে। প্রিম্যাচ্যুর্ড বেবি, বুঝতেই পারছেন।”
বলে নার্সটি বাচ্চাকে নিয়ে চলে যায়।

নার্সের কথা শুনে নায়িমের মস্তিষ্ক, দৃষ্টিভঙ্গি যেন এবার একবারেই শূণ্য হয়ে পড়ে। যেই মানুষটার মস্তিষ্কে সারাদিন নিত্যনতুন বুদ্ধি, পরিকল্পণা খেলা করত , আল্লাহ আজ এমনই খেল খেলেছে তার চিন্তাশক্তি ও মস্তিষ্ক উভয়ই ফাঁকা হয়ে গেছে।

___

করিডোরে দাঁড়িয়ে জানালার বাহিরে বিশাল আকাশ দেখতে ব্যস্ত নায়িম। লক্ষাধিক তারা কী ঝলমল করছে! তার আচার-আচরণ দেখে কারো বোঝার উপায় হবে না আড়ালে রাখা বেদনা। অনিমেষ এক কাপ কফি এগিয়ে দেয়।

“তোর পছন্দের লাটে নাহলেও খেতে খারাপ না। টেস্ট করে দেখ।”

নায়িম বিনা কথাতেই ওয়ান টাইম কাপটি হাতে নেয়। এক চুমুক পান করে।

“একটা কথা বলি রাগ করিস না। তুই কি এখনো বলবি তুই বাসন্তী ভাবিকে ভালোবাসিস না?”

“ভালোবাসা তো মিস্টার এন্ড মিসেস খানেও কম ছিল না তবুও সময়ের সাথে… ভালোবাসা কী বা কেমন আমি জানি না। বুঝতেও চাই না, বসন্তকে ভালোবাসতেও চাই না। সেটা ফিঁকে হয়, মরিচীকা পড়ে তাতে সময়ের সাথে, ভালোবাসা সঙ্গ ছাড়ে। আমি শুধু জানি আমার জীবনে বসন্ত মানে সুখ, আনন্দ, ভালো থাকা, সকল চাওয়ার পূর্ণতা, আজীবন না পূরণ হওয়া প্রয়োজন।”

“তুই অনেক চিন্তিত ভাবীর জন্য, তাই না? তবে যত যাই হোক তুই নিজেকে সামলে নিবি মাসুম বাচ্চাটার জন্য, ওকে?”

স্মিত হাসে নায়িম।
“কথায় আছে ‘ঘর পুড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ডরায়’। কিন্তু সেই একই গরুর যদি আরেকবার ঘর পুড়ে, তাহলে আর ভয়-ডর থাকে না। সেলিনা হোসেনের ‘কাকতাড়ুয়া’ উপন্যাসের বুধাকে মনে আছে? ধরে নে সেই বুধার চেয়েও পাকানো পুরুষ আমি, যার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ হারিয়েছে, তাও তাদের নিজের ইচ্ছেতে।

ছোটো বেলায় ধাক্কা সামলেছি এখন আর কী! এসব কিছু আমার ক্ষমতার বাইরে না। খালি একটা জিনিসই চাওয়া এখন আমার সন্তান যাতে আমার ভাগ্য না পায়। অথচ, সে সুস্থভাবে জন্ম নেওয়া মানেই নিশ্চিত সে পেতে চলেছে, হয়তো আমার চেয়েও জঘন্য জীবন। যেখানে তার বেঁচে থাকাই বড়ো কষ্টকর হবে।”

তার ধাঁধাময় কথার কিছুই বুঝে উঠতে পারে না অনিমেষ৷ শুধু চিন্তিতই সে। অথচ, এই ছেলের প্রতিটি কথা বলার ভঙ্গিমা ও কণ্ঠ একদম শীতল ও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। তবে মানে এগুলোও নায়িমের পরিবার সম্পর্কিত ঝামেলা। কিন্তু কী ঝামেলা তা এখনো ধোয়াশা অনিমেষের কাছে। মানুষটা যে হাজারবার জানতে চাইলেও বলবে না। কিন্তু এখন বড় প্রশ্ন বাসন্তী কি বাঁচবে না কি আত্মগ্লানি আর নিষ্ঠুরতার জীবনে ভাসিয়ে দিয়ে যাবে নায়িমকে?

চলবে…

#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||১১তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নায়িম বাসন্তীর অচৈতন্য মুখ খানার দিকে তাকিয়ে আছে। একদিনেই যেন রক্তশূন্য হয়ে পড়েছে হৃদয় লুভানো এই বসন্ত কুমারী। নায়িম চোখের সামনে ভেসে উঠছে প্রথমদিনের সেই কিশোর বয়সী চেহারা।

“বসন্ত কুমারীর চেহারায় বুঝি হৃদয় আটকে ছিল আমার?” প্রশ্নটা মনে আসতেই পুরনো দিনের সোনালী স্মৃতিতে হারিয়ে যায় নায়িম।

অতীত,
নায়িম সবে মাত্র একটা রেডিওতে আর.জে মাত্র। হুট করেই কিছু নিস্তব্ধকর তথ্য সহিত নিজের সবকিছু ফিরে পায় সে। জানতে পারে তার জীবন কতটা তাণ্ডবী। খান বাড়িতে থাকা খান বংশের ছেলে হিসেবে, এ তার কাম্য নয়। এমন কী বিয়েও তার জন্য নয়, না সন্তান-সন্ততি। যদিও নারীকে ঘৃণা করে সে, কিন্তু তাই বলে সে যে একদম জৈবিক চাহিদা শূণ্য এমন তো নয়।

প্রতিটি পুরুষের একজন নারী দরকার, প্রতিটি নারীর একজন পুরুষ; কারণ মানুষের অনেক ভালো-মন্দ, দুষ্টু-মিষ্টি মানসিক, শারীরিক, সাময়িক, স্থায়ী চাহিদা থাকে যা একমাত্র বিপরীত লিঙ্গের কেউই পূরণ করতে পারে। এই জন্যই তো বিয় নামক পবিত্র সম্পর্ক এত আবশ্যক মানবজীবনে।

নিজের শো শেষ করে অনিমেষের বাসায় হাজির হয় সে। অনিমেষের মামনি সুস্মিতা ঘোষ তাকে দেখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না।

“আন্টি, অনিমেষ কী ঘরে?”

“হুম, তুমি যাও। বাবু ঘরেই।”

নায়িম গম্ভীর মুখ নিয়ে অনিমেষের জন্য নির্ধারিত থাকার ঘরে চলে গেল। সুস্মিতা ঘোষের নিকট ছেলেটাকে বড্ড অদ্ভুৎ লাগে। কেমন এক গম্ভীর চেহারা সর্বক্ষণ, কোনোদিন হায়-হ্যালো পর্যন্ত বলে না।

“ব্রো আই নিড আ গার্ল, হু আই ওন।”

“হোয়াট!” বিস্মিত হয় অনিমেষ। হবে নাই বা কেন? যে ছেলেটা নারীদের ঘৃণ্য চোখে দেখে তার মুখে এমন কথা নিতান্তই অবিশ্বাস্য।

“হোয়াট হোয়াট? আই নিড আ ক্যাম্পেনিয়ন। আই ওলসো নিড আ ফ্যামিলি লাইক ইউ।”

“তাহলে আর কী বিয়ে করে নে। তোর তো হাজার ভক্ত আছে তার থেকে একটাকে… অর ইলজ্ আমি খুঁজব? দ্য হ্যান্ডসাম আর.জে নায়িমের জন্য তো যে কেউ-ই রাজি হয়ে যাবে।”

“উহু, বিয়ে করব বাট করব না। এমন কোনো মেয়ে লাগবে যে টাকা-পয়সা, আরাম-আয়েশ সহ সব মোহ-মায়া মুক্ত। যাকে এসব এখনো ছুঁতেই পারেনি। যে অমলিন, পবিত্র, নিঃস্ব, অজ্ঞাত দিন-দুনিয়া সম্পর্কে। যার পৃথিবী অত্যন্ত ক্ষুদ্র, সেই পৃথিবী হব আমি। যে চল-চাতুরী ভাবনা, দুনিয়াবি সুখের মায়া, নিজের অধিকার সম্পর্কে জ্ঞাতই নয় এমন মেয়ে লাগবে।”

“তুই তাহলে মঙ্গলে যা মেয়ে খুঁজতে। কারণ এই দুনিয়ায় না পাগলেও নিজের অধিকার ধরতে জানে। আর বিয়ে করবি, আবার করবি না, কেমন আজগুবি কথা?”

“মানে খুব সহজ। সে আমার স্ত্রী হবে পৃথিবীর আড়ালে শুধু আমার ঘরে, সবার সামনে সে কেউ না আমার। বিয়ে করব, তবে ধর্মীয় ভাবে, আইনত নয়। তাই তো এমন মেয়ে লাগবে যে কোনো দিন-দুনিয়ার জ্ঞানই জানে না। নিজ অধিকার দিতে জানে কিন্তু নিতে না। যে এখনো অবুঝ।”

“তবে তো তোর পিচ্চি বিয়ে করা লাগবে। কারব একমাত্র তারাই কিছু বুঝে না। কাল তো এক গ্রামের স্কুলে যাচ্ছিস একটা অনুষ্ঠানের জন্য, তো সেখানেই দেখিদ অমলিন নিষ্পাপ পিচ্চি খুঁজে পাস কি না?” কথাটা নিছক ঠাট্টা করে বলল অনিমেষ। কিন্তু কে জানত এ সত্যি হতে চলেছে?

অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে সকাল নয়টাতেই স্কুলে পৌঁছে যায় তারা। মিষ্টি রোদ, শীতল বায়ু, পুকুরপাড় ঘেষেই বিদ্যালয়। গার্লস্ স্কুল ছাত্রীরা আসতে শুরু করেছে। নায়িম ভেবেছিল গ্রামের বাসিন্দা হওয়ায় খুব বেশি মেয়েরা শহরের মতো উন্মাদনা দেখাবে না তাকে নিয়ে, রেডিও কয়জন গ্রামের মেয়েই বা শুনে? কিন্তু তাকে অবাক করে প্রায় সকল মেয়ে অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য, কথা বলার জন্য পাগল ঘেরাও করে তাকে।

বিরক্ত হয় যুবক। সবচেয়ে বেশি বিরক্ত হয় প্রতিটি মেয়ের মুখের আজগুবি মেকআপ দেখে। মানে এত জমকালো সাজ, হিল? জোরজবরদস্তির স্মার্ট হওয়ার প্রচেষ্টা। বিয়ে বাড়ি না কি বুঝতে পারছে না নায়িম।

“কোনো শিষ্টাচার নেই না কী! স্কুলে এসব এলাও করে কী করে!” কথাগুলো আপন মনেই বিড়বিড়ায় সে। তখনই চোখ যেয়ে পড়ে দূর থেকে এগিয়ে আসতে থাকা এক মেয়ের দিকে।

মেয়েটার মাথা নত মাথার দুই পাশে দুই বেনি দুলিয়ে দুলিয়ে এগুচ্ছে সে। পরনে সাধারণ স্কুল ড্রেস। মেয়েটি যতই সামনে এগুচ্ছে ততই তার অস্পষ্ট ছবিটি স্পষ্ট হচ্ছে নায়িমের চোখের সামনে। এই মেয়েটি আর কেউ নয় বাসন্তী।

উজ্জ্বল শ্যাম গড়ন, ক্লান্ত ও কোমল ভঙ্গিমা, শীতল চাহনি। ললাট বেয়ে ঘাম ঝরছে দীর্ঘ সময় হাঁটায় হয়তো, ঘর্মাক্ত হাড্ডিসার গোলগাল ভাসা ভাসা চোখ সমেত মুখশ্রীতে অন্যরকম এক প্রশান্তিকর কিছু আছে।

“এই মেয়ে এদিকে আসো?” নায়িম উচ্চ স্বরে বলে।

ভয়ে কেঁপে উঠে বাসন্তী। সে জানে না কে এই লোক। জানবে কীভাবে? রেডিওই শুনার ক্ষমতা আছে তার? তার ভয় হচ্ছে যে সে ভুল কিছু করেছে কি না কিংবা শাস্তি দিবে না তো লোকটি?

“জ-জী, বলেন?”

তার ভীতিগ্রস্ত গলায় কিছু একটা ছিল যা স্পর্শ করে নায়িমকে। হয়তো তার ভীতিই কিংবা অন্যকিছু।
“আমাকে চিনো তুমি?”

মাথা দুবার ডানে-বামে ঘুরায় বাসন্তী। অর্থাৎ, সে জানে না। আর কোনো কথা হয় না তাদের মাঝে সেদিন। তবে নায়িমের জানত এই মেয়েটিই তার কাঙ্ক্ষিত। লোক লাগিয়ে খোঁজ নেয় সে, জানতে পারে তার অসহায়ত্ব৷ একদম নিশ্চিত হয় সে যে এই মেয়েটিকেই তার চাই।

বলতে গেলে বাসন্তী প্রেমে পড়েনি নায়িম কিংবা ভালোও বাসেনি সে, কারণ এ দুটোই হৃদয়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু সে বাসন্তীর বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করেছিল অত্যন্ত বুঝে-চিন্তে এবং ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে। নায়িমের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত সুর পায় সে বাসন্তীর মাঝে, তার চাওয়াগুলোর পূর্ণতা বাসন্তী। পছন্দ এবং প্রিয় করেছিল সে বাসন্তীকে সেদিন, ভালোবাসেনি।

বর্তমানে,

“এই যে শুনছেন? ভিজিটিং আওয়ার শেষ। আপনি এখন যেতে পারেন।”

নার্সের ডাকে ঘোর ভাঙে নায়িমের। পা নাড়ায় না সে। ধূর্ত চাহনি তার নার্সের দিকে। কাউকে কল করার সাথে সাথেই একজন ওয়ার্ড বয় তাড়ার সাথে কক্ষে ঢুকে।

“সরি স্যার৷ উনি জানত না আসলে।” বলে নার্সটিকে টেনে নিয়ে চলে যায়।

___

“মি.তাহজিব একটা খবর জানানোর ছিল। গায়ক নায়িমের নিজস্ব গাড়িকে একটা হসপিটালের সামনে দেখা গিয়েছে৷ আর সেই গাড়ি থেকে তার অফিশিয়াল উকিল সহ একজন উঠতি যৌবনা নারী এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীকে নামতে দেখা গেছে। তারপর আরেকজন পুরুষও নেমেছে, কিন্তু সে কে চোখ-মুখ ঢাকা থাকায় বুঝা যায়নি। মেয়েটির হয়তো ডেলিভারি ছিল।”
মিনমিন করে বলে তাহজিবের ভাড়া করা লোক।

“হোয়াট! খোঁজ নেওনি কে ঐ দুটো মেয়ে? আর রেকোর্ড করেছে বিষয়টা?”

“জী, স্যার রেকোর্ড করেছি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও খোঁজ নিতে পারিনি। এমন কী রিসিপশনে যেয়ে অনিমেষ ঘোষ আর গায়ক নায়িমের নাম নিতেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে আমায়। টাকা অফার করেছিলাম বলে আরেকবার দেখলে জানে মেরে ফেলবে।”

“ধুর! তোমাদের দিয়ে না কিচ্ছু হবে না! আমাকে ফুটেজটা পাঠাও এখন।”

কল কাট করে দেয় তাহজিব। এত সময়ে বহু বার খুঁজেও ছেলেটার সম্পর্কে একটা আড়ালে থাকা তথ্যও বের করতে পারেনি। যদিও লোকসমাজে ছেলেটা এতিম এবং এতিমখানায় বড় হয়েছে বলে প্রচার। তবে তাহজিবের এ কথা বিশ্বাস হয় না।

ছেলেটাকে অনেক বেশিই ক্ষমতাধারী মনে হয় তাহজিবের। নাহলে এতবার চেষ্টা করেও ছেলেটার সম্পর্কে একটাও খারাপ দিক কী করে না পেতে পারে সে! কোন মানুষ এতটা তুলসি পাতা হয়! আবার তার নিয়োগ করা চারের অধিক মানুষ লাপাত্তা খোঁজ নিতে যেয়ে।

তাহজিব হলো নায়িমের প্রতিদ্বন্দ্বী। তাদের দুজনের ক্যারিয়ার একসাথেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু নায়িমের যেখানে অনেক সংঘর্ষ করতে হয়েছে এবং বিভিন্ন পর্যায় হয়ে আজকের এই জায়িগায় পৌঁছিয়েছে। সে সেখানে একজন মিডিয়ার লোককে ঘুষ দিয়ে এক চান্সেই বড়সড় প্রজেক্ট পেয়ে গিয়েছিল।

সাপ-লুডুর খেলায় নিরাব্বইতে যেয়ে সাপের মুখে পড়ে তাহজিব, একদম নিচে নেমে আসে। একের পর এক ফ্লপ দেয়, অপরদিকে নায়িমের প্রতিটি গান এবং শো হিট। নায়িমের বাহ্যিক ব্যক্তিত্বের জন্য জনপ্রিয়তা বাড়ছিল তিনগুণ হারে। সেখান থেকেই হিংসার সূচনা এবং নিচে নামানোর প্রচেষ্টা।

টুং-টুং শব্দে ফোনের দিকে ধ্যান দেয় তাহজিব। ফুটেজটা বেশ খেয়াল করে দেখে সে।

“হোক না হোক এই মাস্ক, ক্যাপ, গ্লাসেস পরা লোকটাই নায়িম।” সন্দেহ মাখা কণ্ঠ নায়িমের৷
নিজের নিয়োগ করা লোকটাকে কল করে তাহজিব।

“হ্যালো।”

“জী, স্যার। ভিডিও পেয়েছেন?”

“হুম, পেয়েছি আর দেখেছিও। শোনো এই ফুটেজটা বিভিন্ন সুনামধন্য নিউস চ্যানেলে পাঠাবে বুঝলে। আর আমি রাখছি এখন।”

কলটা কেটে আপন ভাবনাতেই হাসে তাহজিব।

“মেবি তোর ধ্বংসের কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে দ্য গ্রেট নায়িম!”ক্রোধান্বিত চোখে ব্যঙ্গ করে বলে সে। তবে কি সত্যিই খারাপ সময় আসতে চলেছে নায়িমের?

__

নায়িম খেয়াল করে বাসন্তীর হাত নড়ছে। ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরছে তার। নায়িম ছুটে যেয়ে ডাক্তার ডাকে। ডাক্তার এসে চেক-আপ করে বলে,

” শি ইজ ফাইন নাউ।”

ডাক্তার ও নার্স বেড়িয়ে যেতেই বাসন্তী উঠে বসার চেষ্টা করে। কিন্তু সেলাইয়ের জায়গায় চিনচিনে ব্যথা সহ জন্মদানের দুর্বলতায় তা পারে না, বরং কোঁকিয়ে উঠে ব্যথায়৷

“আরে করছোটা কী?” ধমকিয়ে উঠে নায়িম।

ঔষধের মতো কাজ করে এই ধমক। শান্ত হয়ে যায় বাসন্তী।

“আ-আমার বাবু?”

বাসন্তীর দুর্বল গলায় নায়িমের কণ্ঠও নরম হয়।

“ও সুস্থ আছে৷ অবজারভেশনে রেখেছে এখন। সকাল হলেই আমাদের দিয়ে দিবে।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here