টক্সিক_রিলেশনশীপ,১৪,১৫
ঈপ্সিতা শিকদার
১৪
বেলা বিকেল যখন নায়িমের গোপণ শত্রুর পাঠানো লোকগুলো বাড়িতে পা রাখে। তাদের বড়ো সাহেব তাদের অপেক্ষাতেই ছিলেন।
“বড় সাহেব আমরা আপনার আর নূর ভাইয়ের কথা মোতাবেক হাসপাতালে গিয়েছিলাম, কিন্তু…”
“কিন্তু কী? ”
“হাসপাতালে কাউকে পাইনি। আর হাসপাতালে একজনের ডেলিভারি গতকাল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার নাম-ঠিকানা কেউই জানে না। আমরা অনেক চেষ্টা করেও কিছুই জানতে পারিনি।”
রাগে সামনে পড়ে থাকা চেয়ারে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে লাথি মারেন তিনি।
“আমি নিশ্চিত ঐটা নিয়াজের ছেলের বউই ছিল। ওদের যত দ্রুত সম্ভব খুঁজে বের করতে হবে, নাহলে আমার খুব বড় ক্ষতি হতে চলেছে।”
মধ্যবয়স্ক পুরুষটির উত্তেজনা যেন সীমা হারিয়ে যাচ্ছে। নূর তা খেয়াল করে শুধায়,
“সাহেব, সবই তো আপনার হাতের মুঠোয় ঐ দুই দিনকার ছেলে আর কী করতে পারবে?”
“নূর, খরগোশ আর কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতায় খরগোশ ভেবেছিল খেলা তার হাতেই, সে-ই জিতবে, আর এই ভাবনাই তাকে হারিয়েছে। শত্রু যতই ছোট হোক নিজের চেয়ে, তাকে খতম করাই শ্রেয়। কখন যে কচ্ছপ থেকে বাঘ হয়ে কামড়ে ধরে বলা যায় না। এখন তো মূল হোতা পৃথিবীর মুখ দেখেছে।”
তাঁর কথায় চুপ হয়ে যায় নূর। লোকটা খাণিকটা সময় নিয়ে কী যেন ভাবতে শুরু করেন। তারপর বলেন,
“তোরা আরও খোঁজ লাগা। বাংলাদেশে প্রতি প্রান্তের পরিচিত গুপ্তচরদের টাকা দে নিয়াজের ছেলেকে খুঁজতে। আর বলে দিস পাওয়ার সাথে সাথে যেন তাকে আর তার সন্তানকে… বুঝতে পেরেছিস তো?
বাঁকা দৃষ্টিতে তাকান তিনি নূরের দিকে। নূর মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে প্রস্থান করে।
___
ইন্টারভিউ শেষ করার বেশ অনেকটা সময় পড়ে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ভিন্ন গাড়ি করে ধানমণ্ডির এপার্টমেন্টের উদ্দেশ্যে রওনা হয় অনিমেষ ও নায়িম।
পৌঁছে বেল বাজাতেই দরজা খুলে চৈতালি।
“এসেছো তবে? তোমাকেই কল করতে নিচ্ছিলাম এখন নায়িম। বাবুর জন্য একটা প্যাকেটজাত দুধ এনিয়ে রাখো নায়িম। তোমরা থাকো না সবসময়, কখনো লাগলে…”
আমতা আমতা ভাব চৈতালির। নায়িম কিছুটা কপাল ভাজ করে অনিমেষকে বলে নিয়ে আসতে। আর সে কোনোদিকে না তাকিয়েই বেডরুমে ঢুকে যায়।
বাসন্তী তাকে দেখে চোখ-মুখ খিঁচে হালকা চেঁচিয়ে উঠে। বস্তুত, বাসন্তী বাবুকে খাওয়াচ্ছিল। নায়িম কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না, সে তার মতো দরজা আটকে টিশার্ট খুলতে শুরু করে প্রতিদিনকার ন্যায়।
বাসন্তী পিটপিট করে তাকিয়ে দেখে যুবক নিজের মতো কাজ করছে, আর এদিকে তারও আগের মতোই অবস্থান। নাহিবাকে সরাবে এমন ভাব, তখনই রাম ধমক দেয় নায়িম।
“ভুলেও না। নাহিবাকে খাওয়াও চুপচাপ। কিছুই তো আমার অদেখা নয়, তাহলে তো আর বাচ্চার মা হতে না। সো এইসব ফালতু কারণে আমার প্রিন্সেসের খাওয়াতে বিন্দুমাত্র সমস্যা চলবে না।”
নায়িমের হুমকিতে ভেঙচি কাটে বাসন্তী। আপন মনে বিড়বিড়ায়,
“এখন দরদ একদম উতলিয়ে পড়ছে।”
“কিছু বললে মনে হলো?” অস্পষ্ট কিছু একটা শুনে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাল নায়িম।
জিহ্বায় কামড় দেয় বাসন্তী। নত দৃষ্টিতে জবাব দেয়,
“না, না, তেমন কিছু না। আমি বলছিলাম নাহিবা, এত সুন্দর নামটা কে রাখল? নিশ্চয়ই অনিমেষ দা?”
“আজব তো! অনিমেষ কেন আমার মেয়ের নাম রাখবে? আমি কী মরে গেছি না কি?”
“না, না, আমি তা বলতে চাইনি তো।”
“চুপ থাকো তুমি! আর একটা কথাও বলবে না। অসহ্যকর!”
নায়িম ট্রাউজার নিয়ে বাথরুমে চলে যায় গোসল করতে। বাসন্তী তৃপ্তির হাসি দেয়। আনমনেই বলে,
“আল্লাহ আমি চেয়েছিলাম আমার স্বামী আমার বাচ্চাকে যাতে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, পিতৃত্ব যাতে তার হৃদয়-মস্তিষ্ক ছোঁয়৷ তুমি আমার দোয়া কবুল করেছো আল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ! ”
কিন্তু বাসন্তী কি জানে নায়িমের মনে জাগ্রত পিতৃত্বই তার মাতৃত্বের জন্য কাল হতে পারে?
বাসন্তী নাহিবাকে শোয়াতে গেলে আবারও ব্যথায় কোঁকিয়ে উঠে। নায়িম বাথরুম থেকে ছুটে আসে।
“বেশি ব্যথা করছে না কি? ডাক্তার ডাকব?”
“না, আমি ঠিক আছি। এমন তো হয়ই।”
নায়িম কী যেন মনে করে ফোন হাতে নেয়। কিছু একটা বেশ খাণেক ক্ষণ সময় নিয়ে ঘেটেঘুটে দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। একটু বাদে ফেরত আসে গরম পানির ব্যাগ নিয়ে।
“এটা পেটে দাও আরাম লাগবে। আমি চেক করেছি বেশি গরম না, তারপরও তোমার সয় না কি দেখো।”
বাসন্তী কথা মোতাবেক ব্যাগ হাতে নিয়ে উদরের উপর রাখে। সত্যিই অনেক আরাম লাগছে তার। সারাটা সময় যন্ত্রণায় থেকে এখন একটু স্বস্তি পেয়ে চোখ বন্ধ হয়ে আসে তার আরামে।
“তুমি কিছু খেয়েছো?”
“হ্যাঁ, চৈতালি আপু স্যুপ দিয়েছিল।”
“আচ্ছা, তাহলে এখন ঘুমানোর চেষ্টা করো। তোমার পা নিশ্চিয়ই ব্যথায় ধরে আছে। আমি তেল দিয়ে মালিশ করে দিচ্ছি।”
পা টিপে দিতে শুরু করে নায়িম, চেহারা সবসময়কার মতোই গাম্ভীর্যপূর্ণ। বাসন্তী অবাক হয় না। সামনের পুরুষটা এমনে যতই নিষ্ঠুর হোক, বাসন্তীর অসুস্থতায় বাসন্তীকে রাণী ভিক্টোরিয়া বানিয়ে ফেলতে বাদ রাখে না। মাঝে মাঝে আফসোস হয় বাসন্তীর। লোকটা কেন সবসময় এমন যত্নশীল, ভালোবাসাময় থাকে না?
___
“বড় সাহেব, একটা খবর দেখলাম। কাজের বা সম্পর্কিত না কি জানি না, তবুও আপনাকে বলতে হবে মনে হচ্ছে।”
“হেয়ালি না করে বলে ফেলো তো নূর। এমনেই কম চিন্তা নেই যে এখন তোমার ধাঁধা নিয়ে ভাববো।”
“নায়িম নায়ক এক গায়কের একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। উনি একজন ছেলে ও দুইজন নারী সমেত আমাদের এখানকার সদর হাসপাতালে গিয়েছে। আর তার মাঝে একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীও ছিল, যার সদর হাসপাতালেই ডেলিভারি হয়েছে।
ভিডিওটি খুব সম্ভবত গতকালেরই। আর আমাদের তথ্য মতে সেদিন হাসপাতালে একজনেরই বাচ্চা হয়েছিল, সে খান বাড়ি থেকে যাওয়া মেয়েটি।”
“মোস্তফাকে ডাকাও। দেখো এটা খান বাড়িতে ঢুকা গাড়ি কি না। গাড়ি হাসপাতালে গিয়েছে তা শোনা কথা হলেও গাড়ি খান বাড়িতে ঢুকতে তো ও দেখেছে।”
মোস্তফা নামক যুবককে ডাকানো হয়। সে আমতা আমতা করে বলল,
“আসলে সাহেব আমি তো গাড়ির নম্বর তুলতে পারিনি। আবার খান বাড়িতে ঢুকতে দেখেছিলাম সন্ধ্যার আবছা আলোয়, তাই দেখেছি অস্পষ্ট। তবে যত দূর মনে হচ্ছে গাড়িটা এমন আকার আর এমন ধরনেরই ছিল৷ রঙটাও তো কালোই।”
মোস্তফাকে কয়েকটা হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিছু সময় নীরব কাটিয়ে নূর জিজ্ঞেস করে,
“এখন কী করবেন বড় সাহেব?”
“এই ছোকরাকে বাড়ি থেকে যত ক্ষমতা ব্যয় করে পারো তুলে আনো আমার আস্তানায়। সাথে ওর বাড়িতে যারা যারা থাকবে সবাইকে তুলে আনবে। একবার আমার আস্তানায় তুলে আনলেই সন্দেহ পরিস্কার হয়ে যাবে।”
চলবে…
#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||১৫তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
“স্যার বাসায় কারা কারা ঢুকে যেন সব ভাঙচুর করে গেছে। আমরা বারবার চেষ্টা করেও আটকাতে পারিনি, আমাদের আটকে রেখেছিল তাদের লোকজন।”
ঘুম ঘুম চোখে কলটা রিসিভ করতেই এ কথা বলে উঠে ফোনের অপরপাশের ব্যক্তিটি। নায়িমের ঘুম যেন উবে যায়। ফোন কান থেকে সরিয়ে সামনে এনে দেখে গুলশানের বাসার কেয়ার টেকার কল করেছে।
“হোয়াট! মানে কী এসবের? কখন, কীভাবে হলো…?”
“এই তো স্যার মিনিট খাণেক আগেই তারা বের হয়ে গেছে। রাতের সাড়ে তিনটার দিকে হুট করেই বেল বেজে উঠে, আমরা আপনি বা আপনার লোক ভেবে ঘরে ঢুকতে দিলেই আমাদের বেধে ফেলে। তারপর আপনার খোঁজ করে, আপনি নেই জেনে তন্নতন্ন করে কী যেন খোঁজে আর ভাঙচুর করে পুরো বাড়িতে।”
নায়িম কয়েক মিনিট চুপ থাকে। কিছু একটা ভাবছে সে। ভাবনা শেষে বিরস গলায় বলে,
“তোমরা বাসা তালা মেরে তোমাদের গ্রামের বাড়ি চলে যাও। যতদিন আমি না বলব ফিরবে না।”
“ঠিক আছে স্যার।”
কল ডিসকানেক্ট করে দেয় নায়িম। কূটনৈতিক ভাবনার অথৈ সাগরে ডুব দেয় সে।
“আমার দুর্ভাবনাই সত্যি হলো তারা আমাকে সন্দেহ করেই ফেলেছে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি নাহিবার, ওকে আগে দূরে সরাতে হবে। বহু দূরে। কিন্তু বাসন্তী…? ও কি রাজি হবে? রাজি নাহলেও কিছু করার নেই, আমার বাচ্চার জানের কাছে ওর অভিমত মেটার করে না।”
ফোন ঘেটে কাউকে কল করে সে। কথা শেষ করে কল কাটতেই পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠে তার চোখেমুখে।
“শকুনি মামা খুব দ্রুতই তোমার শান্তি কেড়ে নিব আমি। তোমার চিন্তা-চেতনা, মন-মস্তিষ্ক সব কিছু ভীতি থাকবে এই নায়িমের। সেই খেলার বয়স থেকে তড়পাচ্ছি আমি।
ক্ষমতা বিস্তার করছি শুধু ভদ্র সমাজেই না, অভদ্র সমাজেও। যেন আমার দহনের আগুনে তুমি মৃত্যুর জন্য তড়পাও। এতটা ভয়ংকর শোধ নিব যে আমার কথা ভাবতেই তোমার রুহু সুদ্ধ কেঁপে উঠবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।”
এদিকে বাসন্তী গভীর তন্দ্রায় ডুবে। সে কী জানে তার প্রাণ ভোমরা ছিনিয়ে নেওয়ার ভাবনায় মশগুল কেউ।
___
বাসন্তীর ঘুম হালকা ভাঙলে বাবুকে ধরার জন্য বামপাশে হাতড়াতেই দেখে বিছানা খালি। চমকিত হয়ে চোখ খুলে সেদিকে তাকায় সে। নাহিবা সেখানে নেই। বালিশের নিচে রাখা ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে যন্ত্রণাময় দেহ নিয়ে কোনোরকম বেডরুম থেকে বের হয় সে।
বের হয়ে দেখে সোফাতে নাহিবাকে কোলে নিয়ে বসে আছে নায়িম। চামচ দিয়ে একটু একটু করে দুধ মুখে তুলে দিচ্ছে সে। স্বস্তির শ্বাস ফেলে বাসন্তী। ভাবে,
“আহ! কী সুন্দর পিতা-কন্যার ভালোবাসার দৃশ্য!”
সে আস্তে আস্তে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়। সকালের চা-নাস্তা তো বানানো বাকি।
“কোনো দরকার নেই। চুপচাপ এখানে এসে বসো, বাবুকে খায়িয়ে আমি খাবার দিচ্ছি।”
বাসন্তী বিপরীতে উত্তর দেওয়ারও সাহস পায় না। চুপচাপ নায়িমের পাশে এসে বসে। নাহিবাকে খায়িয়ে নায়িম চা-নাস্তা নিয়ে আসে। আজ ব্রেকফাস্টের জন্য কফি আর গ্রিল্ড চিজ স্যান্ডউইচ নায়িম নিজ হাতেই বানিয়েছে। এ তার জন্য নতুন কিছু না, তার কৈশোর এবং উঠতি যৌবনকাল যে কেটেছে একাকি হোস্টেলে।
বাসন্তী ইঁদুরের মতোন একটু একটু করে খাচ্ছে, চৈতালি সবে মাত্র ফ্রেশ হয়ে তার জন্য নির্ধারিত ঘরটি থেকে বের হলো। তখনই বেল বেজে উঠে। বাসন্তী নিজের ওড়না ঠিক করে মাথায় কাপড় দেয়।
চৈতালি তন্দ্রাবিষ্ট চোখে গেট খুলতেই অনিমেষ সহ এক জোড়া নরনারী প্রবেশ করে। নারীটির পরনে কালো বোরখা, গোটা দেহের মাঝে মুখশ্রীটাই খোলা শুধু। পুরুষটির পরনে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি। নায়িম হাসি মুখে তাদের স্বাগতম জানায়। অনিমেষ ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে।
“তুই হঠাৎ উনাদের এখানে নিয়ে আসতে বললি কেন?”
“দরকার আছে বলেই বলেছি রে অনি। নাহিবাকে নিতে এসেছে উনারা। এখন থেকে প্রিন্সেস উনাদের কাছেই থাকবে।”
মুখে নেওয়া স্যান্ডউইচের টুকরোটি গলাধঃকরণ করছিল বাসন্তী। কথাটা শুনতেই তার মনে হলো শত শত হাত তার গলা টিপে ধরেছে। খুব কষ্টে খাবারটা গিলে সে।
“কী বলছেন এসব? আমার মেয়ে কোথায় যাবে আমার? কোথাও যাবে না আমার মেয়ে, আমার সাথেই থাকবে।”
বিক্ষুদ্ধ কণ্ঠে বেদনার ছাপও স্পষ্ট। অস্থির হয়ে উঠেছে বাসন্তী। নায়িম ধমক দিয়ে উঠে,
“চুপ! একদম চুপ থাকো! বেশি বুঝো না। নাহিবার জন্য যা ভালো তা-ই আমি করছি।”
নায়িমের ধমকে যার রুহু অবধি কেঁপে উঠত। সে আজ পরম সাহসিকতা সহিত পর্বতের মতোন মাথা উঠিয়ে দাঁড়িয়ে।
নায়িমের কোল থেকে নাহিবাকে ছিনিয়ে নেয় সে। তার চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে কোনো ক্ষত-বিক্ষত বাঘিনী।
“কেন চুপ করব আমি? আটটা মাস পেটে রেখে আমি জন্ম দিসি। আপনি কী জানেন মাতৃত্বের? যেই সন্তানকে বাঁচানোর জন্য আপনার এত মানসিক, শারীরিক অত্যাচার সহ্য করেছি তাও আপনার কথা শুনে এবোরশন করিনি। সেই আমি আমার বাচ্চা দিয়ে দিব এত সহজে!”
“আমি জানি তোমার জন্য এটা মুশকিল। কিন্তু নাহিবার ভালোর জন্যই আমি ভেবে-চিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এজন্য আমি বলেছিলাম বাচ্চা নেওয়ার দরকার নেই।”
নায়িমের চেহারা গাম্ভীর্যপূর্ণ, কথাবার্তা একদম শান্ত ও স্বাভাবিক। যেন এমনটাই হওয়ার ছিল। তার এমন ভাব দেখে আরও তেঁতে উঠে বাসন্তী। রাগে রীতিমতো হিতাহিত জ্ঞান শূণ্য হয়ে পড়েছে রমণী। তার কণ্ঠস্বর সুউচ্চ।
“হেয়ালি করবেন না। আপনি আসলে আমার মেয়েকে দেখতেই পারেন না, ঘৃণা করেন; এজন্যই তো পৃথিবীর মুখ দেখার আগেই মেরে ফেলতে বলেছেন। তারপরও আমার বাচ্চাটা যখন যুদ্ধ করে পৃথিবীতে এসেছে, তাও আপনার সহ্য হচ্ছে না। দূরে রেখে আসতে চাচ্ছেন। আমার তো মনে হয় সবকিছুই একটা বাহানা। আমার মেয়েকে মেরে ফেলতে চান আপনি।”
বাসন্তীর রাগ, চেঁচামেচি, অত্যাধিক সাহসিকতা তার সম্মুখে ইত্যাদি সব সহ্য করে ফেললেও শেষ বাক্যটি শ্রবণগত হতেই নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি নায়িম। সবার সম্মুখেই চুলের মুঠি ধরে ঠাশ করে এক চড় মেরে দেয় বাসন্তীকে। তারপর টানতে টানতে বেডরুমে নিয়ে যায় বাসন্তীকে।
অন্য কোনোদিন হলে বাসন্তী কাঁদত, ভয় পেত। আজ তার চোখে কোনো ভীতি নেই। বরং, ভিন্ন এক তেজ শোভা পাচ্ছে দুই আঁখিতে।
মাতৃত্ব যে নারীর কোনো দুর্বলতা নয়, বরং তার সবচেয়ে বড় শক্তি তা।
ঘরে নিয়ে দরজা লাগিয়ে নাহিবাকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে। ক্ষুব্ধ চোখ নিয়ে ঘুরে বাসন্তীর দিকে।
“কী করবেন এখন? মারবেন আমাকে? দরকার হলে শহীদ হব আজ। তবুও নিজের সন্তানকে আপনার হাতে শেষ হতে…”
তেড়ে যেয়ে বাসন্তীর গাল চেপে ধরে কথায় বাধ সাধে নায়িম।
“কী বললি তুই? আমার মেয়েকে আমি মারব? আরে আমার মেয়ের সাথে যা হচ্ছে আর হবে না তার জন্য শুধু তুই দায়ী। আর কিছু সময় অপেক্ষা করে বাচ্চা নিলে কী হত, হ্যাঁ? আমার মেয়ে একটা ভালো, নিরাপদ জীবন পেতো। আরে শালা আমার জীবনই যেখানে ঝুঁকিপূর্ণ, মৃত্যু কাঁধে নিয়ে ঘুরি আমি। আমার বাচ্চা তো তাদের কাঙ্ক্ষিত সেখানে ওর জীবন নিতে আর কী!
যে কোনো সময় ওকে খুঁজে মেরে ফেলতে পারে। তুই বুঝিস ঐ কষ্ট? যেখানে তোর সারাটা ক্ষণ বোধ হয় তোর ভালোবাসার মানুষটি অনিরাপদ শুধু তোর সাথে সম্পর্কিত থাকার জন্য! নাহিবা ভূমিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে প্রথমবারের মতোন আমি প্রতি মুহূর্ত এই কষ্টের দহনে পুড়ছি।
তুই ওকে কষ্ট করে পৃথিবীর মুখ দেখিয়েছিস, ওর মা, তোর কষ্ট হচ্ছে ব্লাহ ব্লাহ… আই ডোন্ট কেয়ার! আমার জাস্ট আমার বাচ্চাকে, আমার ভালোবাসাকে, আমার একমাত্র প্রিয় মানুষকে সেফ রাখা দিয়ে কাজ। এন্ড আ’ম ডুয়িং সো। হোয়াট ইউ থিংক, হোয়াট ইউ উইল , আই লিটারালি ডোন্ট কেয়ার। জাস্ট গো টু হেল।”
বলে নাহিবাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে যায় সে। বাসন্তীর মাঝে বাধা দেওয়ার শক্তি টুকু নেই।
নায়িমের কথা শুনে পৃথিবী থমকে গেছে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে। মাথার ভিতরটা যেন শূণ্য হয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে চোখের সামনে সবকিছু ঘোলাটে হতে শুরু করেছে। পরমুহূর্তেই সবকিছু অন্ধকার।
___
বাসন্তীর চেতনা ফিরতেই চেতনা হারানোর পূর্বের সবকিছু মনে পড়ে যায়। জন্মদানের জন্য হওয়া নিজের শারীরিক যন্ত্রণা ভুলেই বসেছে সে সন্তানের হাহাকারে। কিন্তু উঠে দেখে সে ঐ আলিশান বাড়িটির কামরায়।
“নায়িম! নায়িম! আপনি কোথায়? আমার মেয়ে কই নায়িম?”
কাঁদতে কাঁদতে চেঁচাচ্ছে সে৷ নায়িম ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। ছুটে আসে অনিমেষ আর চৈতালি তাদের মুখশ্রীও মলিন।
দুর্বল দেহ নিয়ে নায়িমের বুকে মাথা ঠেকিয়েই বাসন্তী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,
“আপনার আমাকে আর আমার মেয়েকে পছন্দ নয় তাই তো? আমি আমার মেয়েকে নিয়ে বহুদূরে চলে যাব। তবুও আমাকে আমার মেয়ে ফিরিয়ে দিন।”
বাসন্তীর দুই অধরে আঙুল চেপে ধরে নায়িম।
“বসন্ত কুমারী, আমি মরে গেলেও তোমরা আমার ছায়া মুক্ত হবে না। তুমি আমার সবচেয়ে প্রিয় রতন প্রাণভোমরা, নাহিবা আমার ভালোবাসা জীবনপাখি। সুতরাং, এ কথা তো বোলোই না। আর তুমি শান্ত হও, এই ফাজ নায়িম খানের ওয়াদা খুব দ্রুতোই নাহিবাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিব। শুধুমাত্র ওর নিরাপত্তাটা নিশ্চিত হোক।”
প্রেমময় কণ্ঠ, আবেগী বুলি শুনে শান্ত হয় বাসন্তী। নীরব অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকে নায়িমের বুকে মুখ লুকিয়ে। নায়িম তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মনে মনে ভাবে,
“এসব কিছুর হিসাব আমি নিব শকুনি মামা। তোর জন্য আজকে আমার বউয়ের এত স্পর্ধা বেড়েছে। আমারও বাধ্য হয়ে তাকে সায় দিতে হচ্ছে, সান্ত্বনা দিতে হচ্ছে, নিচু হতে হচ্ছে আমার সামনে। আগে তোকে ঠিক করি। তারপর আবার স্ত্রীকে পোষ মানানোর কাজে লাগতে হবে।”
___
“বড় সাহেব! বড় সাহেব!”
দুপুরের ভোজন সেড়ে ঘুমুচ্ছিলেন মধ্যবয়স্ক পুরুষটি। কাজের লোকের ডাকে ঘুম ভাঙে তার। বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বের হন তিনি।
“কী হলো? ডাকাত না চোর এসেছে বাড়িতে, হ্যা? এভাবে হাঁকাচ্ছিস কেন?”
“বড় সাহেব, খান বাড়িতে ফাজ খান ফিরে এসেছে একদম সবসময়কার জন্য নিজের অধিকার নিতে। আজ বিকেলের মধ্যে আপনাকে আনন্দ ভিলা মানে এই বাড়ি খালি করে দিতে খবর পাঠিয়েছে।”
“শিকার তাহলে নিজে এসে ধরা দিয়েছে শিকারীর কাছে। বাহ্ ভালো তো, বেশ ভালো। আমার লোকদের পাঠাও খান বাড়িতে, খান বংশ যেন একদম নিশ্চিহ্ন করে রেখে আসে তারা।”
প্রচণ্ড রাগ ও ক্ষোভে কাঁপতে কাঁপতে বলেন তিনি। তবে কী নায়িম আর বাসন্তীর জীবনকে পৃথক করতে চলেছে মৃত্যু নামক অনিবার্য সত্য? নাহিবাও কি নায়িমের ন্যায় এতিম জীবন পেতে চলেছে?
চলবে…