টক্সিক_রিলেশনশীপ,১৬,১৭

0
1219

টক্সিক_রিলেশনশীপ,১৬,১৭
ঈপ্সিতা শিকদার
১৬

বাসন্তী মন মরা হয়ে বিশাল বারান্দার দোলনায় বসে আছে। এমন সময় আকস্মিক গোলাগুলির শব্দ শুনে ভয়ে শিউরে উঠে সে। ধীরে ধীরে রেলিংয়ের দিকে চোখ রেখে এগিয়ে যেয়ে নিচে তাকালে দেখতে পায় তুমুল মারামারি হচ্ছে নিচে। এত মানুষ যে বাড়ির সামনের বিশাল উঠান ভরে গেছে। কারো হাতে চাপাটি, তো কারো হাতে পিস্তল, তো কারো হাতে হকিস্টিক, ব্যাট।

“হায় আল্লাহ! এসব কী হচ্ছে!”
আঁতকে উঠে বাসন্তী, জীবনে প্রথম টেলিভিশজ জগতের বাহিরে মারামারি দেখছে সে।

একটু বাদেই খেয়াল করে মুখে রুমাল বেঁধে হাতিয়ার সমেত নায়িমও এই রক্তের খেলায় সমান তালে মেতে উঠেছে। মুখ বাধা থাকার পরও নায়িমকে চেনার কারণ হলো তার নীল মণি বিশিষ্ট রক্তিম দুটো চোখ। বাসন্তীর ভাবনাগুলো গুলিয়ে যাচ্ছে।

“নায়িম ছুড়ি, পিস্তল…! কিন্তু ও তো সাধারণ এক গায়ক। আর এ লোকগুলোই বা কে?”

ঝড়-ঝামেলার মাঝেই নায়িম দেখতে পায় বাসন্তী বারান্দায়। এমন স্থান মানেই যে কোনো সময় গুলি লাগতে পারে তার।

“হ্যাভ ইউ গন নাটস্? তুমি এইখানে কী করো? ভিতরে যাও! এক্ষন ভিতরে যাও!”
চেঁচিয়ে উঠে সে।

বাসন্তী কেঁপে উঠে ছুটে চলে যায় বারান্দা থেকে। ভীতিগ্রস্ত রমণী গুটিসুটি মেরে বসে থাকে সে, থরথম কাঁপছে গোলাগুলির শব্দে।

ঘণ্টা খাণেক পর সবকিছু থেমে যায়। শুধু নীরব নয়, নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে পরিবেশ। সেই নিস্তব্ধতা কাটাচ্ছে নায়িম ও কিছু মানুষের কথোপকথন এবং কণ্ঠস্বর।

বাসন্তী ধীরপায়ে বেডরুম থেকে বের হয়। হলওয়ে হয়ে নিচে যাওয়ার পথে স্টাডি রুম থেকে অনিমেষের কণ্ঠ শুনতে পায়। কী একটা ভেবে যেন সেদিকেই এগিয়ে যায় সে নায়িমের কাছে যাওয়ার ভাবনা বাদ দিয়ে।

ঠকঠক শব্দ শুনে কল কেটে দরজা খুলে দেয় অনিমেষ। বাসন্তী উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

“নিচে এসব কী হচ্ছে অনিমেষ দা? নায়িম কী করে পাক্কা গুন্ডাদের মতোন মারামারি করছে? আর এই লোকগুলোই বা কারা? আমরা এই বাড়িতে কেন এসেছি?”

বাসন্তী রীতিমতো অস্থির হয়ে পড়েছে। এমনিতেই সদ্য বাচ্চা জন্ম দিয়েছে দুর্বল দেহমন, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও চাপে তো একবার জ্ঞান হারিয়েছেই, আবারও তেমনই পরিস্থিতি। যুবতীকে শান্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অনিমেষ

“আপনি শান্ত হন ভাবী। সবকিছু ঠিক আছে।”

“কিন্তু ঐ যে গোলাগুলি, মারপিট…?” বড্ড স্তব্ধ, কনফিউজ, ভীতিগ্রস্ত গলা তার।

“এগুলো সামলে নিবে নায়িম। আপনি এসব নিয়ে ভাববেন না। শুধু নিজের খেয়াল রাখুন।”

“আপনি লুকাচ্ছেন সত্য তাই না অনিমেষ দা? আমি প্রস্তুত, হয়তো একটু ব্যথিত হব, তবুও বাস্তবতা সম্পর্কে জ্ঞাত থাকাই শ্রেয়।”

ছলছল চাহনি বাসন্তীর, কথায় স্পষ্টতা। শঙ্কিত হয় অনিমেষ। আনমনেই ভাবে,

-নারী যেমন কোমলমতি, মায়াবতী তেমনই নারী সর্বগ্রাসী, সর্বনাশী। এ কথা কেন যে ভুলে জীবনে তাণ্ডব বয়ে আনে পুরুষ!

___

বড় সাহেব তথা সাদিক সাহেব বৈঠক ঘরে বসে পায়ে পা তুলে আয়েশ করে চা পান করছে। তাঁর মনে আজ রঙধনুর সাত রঙ লেগেছে। আশেপাশের সকল গ্রামে মিষ্টি বেলাবে সে, শুধু সুসংবাদ মানে ফাজ খানের মৃত্যু সংবাদ আসার অপেক্ষা।

“বড় সাহেব! বড় সাহেব! সব্বনাশ হয়ে গেছে গো, সব্বনাশ!”
হাঁপাতে হাঁপাতে মোস্তফা ভিলাতে ঢুকে সাদিক সাহেবের বিশ্বস্ত এক ত্রিশ উর্ধ্ব লোক। নায়িমের চোখের আড়ালে পালিয়ে এসেছে সে।

কপালে ভাজ স্পষ্ট হয় সাদিক সাহেবের। ত্রাসিত হয়েছেন না কি বিরক্ত বোধগম্য হলো না।

“আহা! কী বলতে চাচ্ছিস? হয়েছে কী সোজাসুজি বল না?”

“বড় সাহেব ঐখানে যাওয়ার পর ফাজ খানের ছেলেপেলেরা একদম বেলে দিয়েছে আমাদের লোকগুলোতে। আমি বহু কষ্টে নিজের জান বাঁচিয়ে ভেগে এসেছি। ওরা মনে হয় এদিকেই আসছে।”

বিচলিত হয়ে পড়লেন সাদিক সাহেব। একটু দূরে দাঁড়িয়ে সবই শুনছিলেন তার পিতা শামসু মিয়া। যৌবন পেরিয়ে জীবনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। বয়স পেরিয়ে গেলেও মাথার মাদকের নেশা, লোভ, হিংসা একটুও কমেনি। তাঁক লাগানো বুদ্ধি তাঁর।

“আরে ব্যাটা, এতে তো ভয় পাওয়ার কিছু নাই। এক মাঘে শীত যায় না, ওদেরও দিন এসেছে আজ ভেবে নে। তাছাড়া বুদ্ধিমান তো সেই নাবিকই যে হাওয়ার দিক পরিবর্তনের সাথেই তাল মিলিয়ে চলে।”

খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসলেন তিনি। সাদিক সাহেব বাবার কথার ভাবসম্প্রসারণ অনতি দেরিতেই বুঝে ফেললেন। কুটিল হাসি ফুটে উঠল তাঁর চেহারায়।

___

নায়িম রক্তমাখা হকিস্টিক হাতে ডাইনিংরুমে সোফায় আধশোয়া হয়ে আছে। তার দিকে নজর ঠেকিয়ে রেখেছে তিন জোড়া কৌতূহলী চোখ। কিন্তু কেউই কিচ্ছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। নায়িম তাদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়।

“আমার কী রূপ বেড়ে গেছে না কি? এভাবে তাকায় আছো কেন সবগুলো?”

“নায়িম দেখ আমরাই তোর আপন জন, আমাদের সব জানার অধিকার আছে। বিশেষ করে বাসন্তী ভাবী। তোকে এটাক করতে আসা লোকগুলো কারা? আর কী-ই বা তাদের উদ্দেশ্য? তুই তো একজন গায়ক মাত্র, এসব গান-টান তোর কাছে কেন? আর এত পারদর্শীই বা কীভাবে এসব চালাতে?”
অনেকটা সাহস জুগিয়ে প্রশ্ন করেই ফেলে অনিমেষ। বাসন্তীকে যে আজ একজন বড় ভাই হয়ে ওয়াদা করেছে সব সত্য তুলে ধরবে তার সামনে।

অনিমেষের আমতা আমতা কথা শুনে ছোট্ট এক শ্বাস নির্গত হয় নায়িমের দেহ থেকে, বিষাক্ত শ্বাস। নায়িমের জন্মের সাথেই জুড়ে আছে বিষাক্ততা, তাই তো সে নিজে বিষাক্ত, তার সাথে জুড়ে থাকা প্রতিটি সম্পর্ক সহ সবকিছুই বিষাক্ত৷ তার অতীত, বাস্তবতাও নিশ্চয়ই এর বাহিরে নয়। তাই তো সবার আড়ালে রেখেছে সে নিজের বিষাক্ত বাস্তবিকতাকে নায়িম, তবে আজ মনে হয় সত্য উন্মোচিত হবেই।

চলবে…

#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||১৭তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নায়িম নীরব হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার চাহনি আজ বড়োই অদ্ভুৎ, তবে এই চাহনির বেড়াজাল ভেদ করে এই চাহনির অর্থ কারোরই বোধগম্য হলো না কারো। নীরবতা কাটিয়ে উঠানোর দায়িত্ব আবারও অনিমেষই পালন করল।

“নায়িম?”

“হ-হ্যাঁ?” ঘোর ভাঙল নায়িমের। চোখ নামিয়ে কিছু একটা ভেবে পুনরায় গাম্ভীর্যপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল তিন জোড়া জিজ্ঞেসু আঁখির দিকে।

“আমি ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা বলব না, কারণ তোমাদের কাছে লুকানোর কিছু নেই। জানলেও বলার উপায় তোমাদের কারোরই নেই। তা সম্পর্কে তোমরাও জ্ঞাত।

আমি ভদ্র সমাজে গায়ক, অভদ্র সমাজে রাজনীতিবিদের সাথে মাফিয়াও বলা যায়, বড় বড় গুন্ডা আমার হাতের মুঠোয় থাকে, লোকালয়ের আড়ালে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মোস্তফা সাহেবের নাতি তার পার্টির চেয়ারপার্সন নাহিবা খানের বাবা।”

নায়িমের বাস্তবতার উন্মেচনটা যেন একটু বেশিই স্বাভাবিকতার সহিত হলো। বাংলা সিনেমা বা হিন্দি নাটকের মতোন বিদ্যুৎ চমকালো না, গম্ভীরতার সুর ধরা মিউজিক বাজলো না। সকলে বিস্মিত হলো, স্তব্ধ হলো, তবুও যেন কিছুই হলো না।

“হয়েছে তো এবার? অনিমেষ আমার এক জায়গায় যেতে হবে। আমি যতক্ষণ না আসি ততক্ষণ সবার খেয়াল রাখিস। আর কোনো বিপদের আভাস পাওয়া মাত্রই আমাকে কল দিবি।”
অত্যন্ত খাপছাড়া ভঙ্গি নায়িমের। অথবা, খামখেয়ালির আড়ালে অনুভূতি লুকানোর প্রচেষ্টা।

অনিমেষ নিজেকে সামলে শুধায়,

“তুই তো বললি না এই লোকগুলো কারা।”

“নুসরাত মোস্তফার সাবেক প্রেমিক, তার সৎ ফুপির ছেলে। ধরতে গেলে আমার দূরসম্পর্কের মামা।” স্পষ্টতার সাথে কথাটা বলে হনহন করে বেরিয়ে গেল নায়িম।

এদিকে সবাই যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। যা জানা ছিল, তাও অগোছালো হয়ে গেল। আর বাসন্তী…? সে তো বাক্যহারা। এতটা শঙ্কিত, কঠিন, জটিল জীবন তো তার কাঙ্ক্ষিত নয়। সে তো আর কিছু চায়নি আল্লাহর কাছে। কম অর্থে থাকলেও প্রিয় মানুষের বুকে দু বেলার খাবার খেয়ে সাধারণ জীবনযাপন করতে চেয়েছে।

___

নায়িম লোকজন নিয়ে মোস্তফা ভিলার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। তার চোখে-মুখে ক্রূরতা ছেয়ে আছে। জীবনের কত সময় সে ব্যয় করেছে এই মুহূর্তটি পাওয়ার জন্য তা একমাত্র আল্লাহ আর সে জানে।

গাড়ি নির্ধারিত স্থানে এসে থামল। নায়িম তার লোকদের নিয়ে এগিয়ে গেল মোস্তফা ভিলার দিকে। কিন্তু ভিতরে ঢুকতেই এ কী অবস্থা! সারা বাড়ি জুড়ে শূণ্যতা।

“হোয়াদ্দা হেল! সাদিকের বাচ্চা কই গেল!” আক্রোশে ফেটে পড়ছে নায়িমের কণ্ঠ। তার সাথের লোকগুলো ভয়ে কম্পিত হচ্ছে।

“তোরা দাঁড়ায় আছিস কেন? পুরা বাসা চেক কর! বাগান, গ্যারেজ কেন কোনো আনাচে-কানাচে বাদ রাখবি না।” নায়িমের ধমকিয়ে উঠতে দেরি, কারো আদেশ পালনে।

মোস্তফা ভিলার প্রতিটি কোণা পর্যবেক্ষণ করা হলো। তারপরও একটা কাকপক্ষীরও সাক্ষাৎ মিলল না। সবাই অসহায় মুখ নিয়ে নায়িমের সামনে এসে দাঁড়ালে। নায়িম ব্যর্থতার ক্রোধে লাথি মারে বৈঠক ঘরে থাকা টেবিলে। ছিটকে পড়ে যায় টেবিলে বিদ্যমান সকল কিছু। কিন্তু নায়িমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ছোট্ট একটা কাগজের টুকরো।

সে এগিয়ে যেয়ে হাতে তুলে নেয়। পড়তে থাকে কাগজের উপর লিখা বাক্যটি।

“আজ তোমার বর্ষা তুমিই বর্ষণ হও চারিধারে। বেঁচে যেহেতু আছি কাল যে আমার বর্ষণ হবে না তার নিশ্চয়তা নেই৷ তাই এটুকু জয় করেই আবার আনন্দ উদযাপন কোরো না ভাগিনে।”

পড়ে মাথায় দাউদাউ করে জ্বলে উঠে ক্রোধের আগুন। চেঁচিয়ে উঠে তীব্র রাগে,

“সাদিকের বাচ্চা তোরে একবার খালি হাতে পাই। জাহান্নামের স্বাদ সম্ভব নাহলেও মৃত্যুর চেয়েও তিক্ত স্বাদ আমি তোকে পৃথিবীতে দিব।”

___

নায়িম বাড়ি ফিরে কোনোদিকে না তাকিয়েই বেডরুমে চলে যায়। রাগ কিছুটা শান্ত হলেও একদম মাটিতে মিশেনি। তার উপর সারা গা ঘামে ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে। গা ঘিনঘিন করছে তার। দরজা লক করে তাড়াতাড়ি শার্টটা খুলে প্যান্টের বাটনে হাত দিবে তখনই ফোন আপন সুরে বেজে উঠেছে।

বেশ বিরক্ত বোধ করে যুবক। হাতে নিয়ে দেখে পরবর্তী গানের প্রযোজকের কল। আর কী অনিচ্ছা সত্যেও তুলতে হয়।

“আসসালামু আলাইকুম স্যার। কেমন আছেন?” কথাতে মাধুর্য বজায় আছে নায়িমের।

“আমি তো ভালোই। তুমি না কি প্রজেক্ট পোস্টপন করতে বলেছো? কী সমস্যা হলো আবার?”

“আপনি তো জানেননই কতটা হ্যাকটিক কেটেছে আমার লাস্ট কিছু সময়। প্রথমে শবনমের কেস, তারপর মিস ললিতা, তারপর মিডিয়ার সাহায্য দুর্নাম করার প্রচেষ্টা। আমি কিছুটা সময় কাটাতে চাচ্ছিলাম, ঝড়-ঝামেলা ছাড়া, বাহিরে ঘুরতে এসে।”

“থাক, থাক, বাবা বুঝেছি আমি। ট্রিপে গেছো আগে বলবে না! তুমি তোমার মতো ট্রিপ ইঞ্জয় করো, হ্যাঁ? আমি রাখলাম।”

“ঠিক, আছে স্যার।”

কলটা ডিসকানেক্ট করে বিরক্তিমাখা এক নিঃশ্বাস ছাড়ে নায়িম। চোখ উঠিয়ে বারান্দার দরজায় বাসন্তী দাঁড়িয়ে, চোখ গোল গোল করে দেখছে তাকে।

“কী হলো? জীবনও দেখো নাই আমারে খালি গায়ে না কি প্যান্ট খোলার অপেক্ষায় আছো?”

চটজলদি চোখ সরিয়ে নেয় বাসন্তী, বারান্দায় ঢুকে পড়ে সে। মূলত বিভিন্ন অনুভূতিময় ভাবনার অথৈ সাগরে ডুবে ছিল সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে, দরজা আটকানোর শব্দে এখানে আসে। আর নায়িমকে এত কঠিন ও জটিল মুহূর্তেও একাধারে মিথ্যা বলতে দেখেই বিস্মিত হয় সে।

আনমনেই ভাবে, “লোকটা আস্ত শয়তান! নাহলেও এতও সম্ভব!”

“যত্তসব!” বাসন্তীকে যেতে দেখে রাগের সাথে বিড়বিড়ায় নায়িম। তারপর ব্যস্ত হয়ে পরনের পোশাক ছেড়ে ঘরে পরার পোশাক পরতে।

___

রাত প্রায় নয়টা, খাওয়ার টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছে সবাই। বাসন্তীর মনে হচ্ছে সে কোনো রাজপ্রাসাদে এসেছে। কী রাজকীয় সকল বাসন! স্বর্ণের পানি জড়ানো মনে হচ্ছে। আবার কী রাজার ভোজন! গরুর গোশতের কোফতা, মুরগি ভুনা, ইলিশ মাছ ভাজা, চিংড়িমাছের মালাইকারি, পায়েস ও রসমালাই।

এতসব খাবার দেখেও বাসন্তী খেতে পড়ল না। তার গলা যেন সংকুচিত হয়ে খাবার নামতে দিচ্ছে না। কত ধরনের অনুভূতি বোধ হচ্ছে। মনে পড়ছে নানুর বাড়িতে ভালো রান্না হলে খাটনি সে দিলেও এঁটো খাবার ছাড়া কিছুই ভাগে পড়ত না তার। সবচেয়ে বেশি দম আটকে আসছে নাহিবার জন্য। দুধের শিশু দূরে রাখলে কী আর মায়ের মন মানে!

সে শুনেছে আড়াল থেকে নায়িমের শত্রুরা না কি বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। সেই কথার রেশ ধরেই এক আবেদন করে বসলো সে।

“বলছিলাম কী, আমরা যখন এখানে আছি আর আপনার শত্রুরাও তো পালিয়েছে। তাহলে নাহিবাকে কি এখানে নিয়ে আসতে পারেন না? এ বয়সী শিশুদের জন্য মায়ের দুধই তো সব। দুধের শিশু কীভাবে…”

“হ্যাঁ, খুব দ্রুতোই ও বাড়ি এসে পড়বে। তবে ভুলেও যেন এক থেকে দুই কান না হয় যে নাহিবা আমার মেয়ে। শুনতে পেরেছো?”
শেষ প্রশ্নটা ধমক দিয়েই বলে নায়িম। বাসন্তী সহ সবুজ শাড়ি পরিহিতা মেয়েগুলো কেঁপে উঠে ভয়ে।

“ছোট বাবু, আমাদের চৌদ্দ জন্ম আপনার বাড়িতে কাজ করেছে, নূন খেয়েছি আমরা এই বাড়ির, বেইমানি করব না। আপনি আমাদের ভুল বুঝবেন না আমাদের।”

একজন অল্প বয়স্কা নারী ভয়ে ভয়ে বলে। নায়িম ভ্রুক্ষেপ করে না। চুপচাপ খাবার খেতে থাকে। খাওয়া শেষে সবাই ধীরে ধীরে উঠে চলে যায়। হাত ধুয়ে নায়িম মোবাইল নিয়ে সোফায় বসে। অনিমেষও ধপ করে এসে তার পাশে বসে। তার দৃষ্টি নায়িমের মাঝে আবদ্ধ।

নায়িম বিষয়টা বুঝতে পেরেও এড়াতে উঠে চলে যেতে প্রস্তুত হয়। কিন্তু উঠতে নিলেই অনিমেষ হাত ধরে আটকায়।

“জীবনের প্রতিটি কদমে যত দূর সম্ভব তার চেয়েও এগিয়ে যেয়ে তোর পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। অথচ, কত কিছু থেকে আমাকেই আড়াল করেছিস তুই। এতটা অবিশ্বাস করিস আমাকে?”

“বাচ্চামো করিস না তো অনিমেষ। তুই নিজেও জানিস আমার জীবনে সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষ তুই। শুধু তুই।”

“তাহলে বলিসনি বা এখনও বলছিস না কেন? নিজের সত্য শিকার করলি। অথচ, অনেক কিছুই আড়াল করেছিস। নুসরাত মোস্তফার প্রাক্তন যদি তোকে এটাক করে, সে নিজে কই? তোর পিছনে কেন লেগেছে? নাহিবা বা ভাবীর কেন জীবনের ঝুঁকি? এসব আধোআধো কথা বা শুধু তোর বাস্তবতা গোটা অতীত জানতে চাই আমি।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here