টক্সিক_রিলেশনশীপ,২০,২১
ঈপ্সিতা শিকদার
২০
“আপনার হাজব্যান্ডের একাধিক ডিজঅর্ডার আছে। এমন মানুষের সাথে আপনি এত বছর ধরে সংসার করছেন তা-ই ভেবে পাচ্ছি না।”
অরবিন্দ ভট্টাচার্যের কথা শ্রবণগত হতেই হচকচিয়ে উঠল সবাই। বিশেষ করে বাসন্তী। এমনটাও শুনতে সে চায়নি। মূলত অনিমেষের কথার দ্বারা তার মনে ক্ষীণ আশার সঞ্চার হয়েছিল। যে নায়িম আর আট-দশটা স্বামীর মতোই হবে একটু চিকিৎসা পেলেই।
“এসব কী বলছেন আপনি আঙ্কেল? নায়িম তো একদম স্বাভাবিক। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি, মার্জিত, মাদকদ্রব্য থেকে দশ হাত দূরে থাকে, শিক্ষিত একজন শিল্পী; তবে ও কীভাবে…?”
মৃদু হাসলেন অরবিন্দ ভট্টাচার্য।
“নায়িমের ওসিডি আছে। ওসিডি বলতে ওবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার। এই যে বললেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি, মাদক সেবন করে না এর দ্বারা সে নিজেকে পার্ফেকশনিস্ট হিসেবে রাখতে চায়। এই রোগীরা সাধারণত মাত্রাতিরিক্ত পরিষ্কার, পরিপাটি চায় সবকিছু। ধরেন চামুচের জায়গায় চামুচ না রেখে ভুলবশত ঘরে রাখলেন, দেখে পুরো ঘর উদ্ধার করে ফেলবে। ভায়োলেন্টও হতে পারে। নায়িম তো বোধহয় হয়ও।
নায়িমের নিশ্চিত অপরিষ্কার মানুষ একদম পছন্দ নয়। আপনাদের কথায় মনে হচ্ছে পবিত্রতা এই টার্মটাও নায়িমের একটা অবসেশন। সে চায় সবকিছু পবিত্র থাকুক। দেখবেন যখনই নায়িমের মনে হবে কিছু অপরিষ্কার বা অপবিত্র হয়ে গেছে তখন তাকে বারবার পরিষ্কারের প্রয়াস করবে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধুবে।”
শেষ করতেই শব্দ করে কেশে উঠেন তিনি। ইদানীং যেন সর্দি বেড়েই চলেছে। তাঁর কথায় বাসন্তীর মনে পড়ে যায় এসকর্ট সার্ভিস থেকে ছাড়া পাওয়া দিনটি। যখন জ্ঞানহারা হওয়া অবধি নায়িম তাকে বাথটবে রেখেছিল।
“আর মিসেস খান? আপনার স্বামী আপনাকে মাত্রাতিরিক্ত পজেজিভ বা প্রোটেক্টিভ কেন? বেশি ভালোবাসে বলেই। তাহলে তো অনিমেষ তোমাকেও তোমার বন্ধু বড় বেশিই ভালোবাসে। তাই তো এত বছরেও কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে দেয়নি।” হেসে উঠেন তিনি। অনিমেষ একটু লজ্জাই পায় এমন রসিকতায়।
“বাঙালিদের এক অভিমত হলো যারা বেশি ভালোবাসে, তারাই না কি সন্দেহ করে, মাত্রা ছাড়া পজেজিভ হয়। আসলে যা হয় তা হলো, তারা মানসিক রোগী বৈকী কিছুই নয়। আপনার স্বামীর একটা অবসেশন আপনি নিজেও। তাই-ই আপনাকে নিয়ে এত সীমাহীন সতর্কতা তার।
আর আপনার স্বামীর এমন সন্দেহপ্রবণ আচারণ করার কারণ কী জানেন? উনার ডিলিউসন্যাল জ্যায়ালসি ডিজঅর্ডার আছে। এটাকে ওথেলো সিন্ড্রোম বা মরবিড জ্যায়ালসিও বলে। ইট’আ সাইকোলজিকাল ডিজঅর্ডার, যেটাতে কোনো প্রমাণ ছাড়াই সর্বক্ষণ মানুষ ভাবে তার পার্টনার বা স্পাউজ বা ফিয়ন্সেকে সন্দেহ করে। তাদের প্রেমনিষ্ঠা নিয়ে সন্দেহ ভাবনা তাদের মনে আসে। ভয়ে থাকে প্রিয় মানুষ হারানোর। কোনো পুরুষের সাথে কথা তো দূরে থাক দেখলেই… যেমনটা নায়িমের ক্ষেত্রে হয়।”
“সরি টু ইন্টারাপ্ট। আমার অনেক পরিচিত মানুষ আছে যাদের ওসিডি এবং সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স আছে। তারাও ভায়োলেন্ট হয়। কিন্তু নায়িমের মতোন এমন হিংস্র বা অমানবিক কাউকে হতে দেখিনি। এত রাগ বা নিয়ন্ত্রণ হারা হওয়া কেন? এটা কি ডিলিউসন্যাল জ্যায়ালসির জন্য।”
“নায়িমের ইন্টারমিটেড এক্সপ্লোসিভ ডিজঅর্ডারও আছে। এজন্যই ফ্রাস্টেশন সহ্য করার ক্ষমতা শূণ্যের কোঠায়, সহ্যক্ষমতা কম বা নেই, অল্পতেই রেগে যায়। আগুনের মতো ছাড়খাড় করে দেওয়া, ঠিক-বেঠিক জ্ঞানবোধ হারিয়ে ফেলা অন্ধ ক্রোধ, নিয়ন্ত্রণহীন বোধ করা এর কারণেই। এই ডিজঅর্ডারটি মূলত এবং সাধারণত একটি কারণেই হয় তা হলো এবিউসিভ চাইল্ডহুড। মানে ছোটবেলায় কোনো অত্যন্ত ভয়াবহ শারীরিক বা মানসিক বা শাব্দিক আঘাত পাওয়া।”
বলে ভ্রু কুঁচকে তাকান তিনি। বাসন্তী বিনীত সুরে প্রশ্ন করে,
“সুস্থ হবেন তো উনি? কোনো উপায় নেই?”
“অবশ্যই আছে। তবে তার জন্য একান্তই নায়িমের সহযোগিতা প্রয়োজন। আর আমার একটা সন্দেহ আছে যে নায়িমের ওএলডি আছে। অবসেসিভ লাভ ডিজঅর্ডার মানে এমন একটি কন্ডিশন বোঝায় যেখানে আমরা একজন ব্যক্তির প্রতি অবসেসড হয়ে পড়ি আর মনে হয় যে আমি তাকে ভালোবাসি।”
“না, না, নায়িম তো সবসময় বলে যে ও ভাবীকে ভালোবাসে না।” বলেই জিভে কামড় দেয় অনিমেষ। আড়চোখে বাসন্তীর দিকে তাকায় সে। মেয়েটি অবিশ্বাস্য চাহনির সহিত তাকে দেখছে।
“তবে ভালোই।”
ঘোর ভাঙল অনিমেষ ও বাসন্তী দুজনেরই। ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে পড়ল তারা।
বাসন্তীর মনটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়ছে। তবুও নিজেকে জুড়ে রেখে মনকে মিথ্যে আশা দিচ্ছে বারবার।
– না, না, এমন হতে পারে না। নায়িম তো আমাকে কত্ত ভালোবাসে! কত খেয়াল রাখে আমার! উনার সমস্যা বলেই সব রাগারাগী, অত্যাচার। কিন্তু ভালোবাসে তো।
মনে মনেই তার সব ভাবনা, বোঝাপড়া। এত বছর এত অমানবিক অত্যাচার সহ্য করার কারণ কী? শুধুমাত্র একটু ভালোবাসা পাওয়া, প্রকৃত ভালোবাসা, দেবদাস উপন্যাসের পাতায় পাতায় যে ভালোবাসার আভাস পাওয়া যায়, সেই ভালোবাসা। জীবনে কারোরই তো ভালোবাসা পাওয়া হয়নি। বাবার পর নায়িমই একমাত্র ব্যক্তি যে তাকে ভালোবেসে কাছে টেনেছিল। এই একমাত্র মানুষটিকে যাতে খোয়াতে নাহয় তাই-ই তো দাঁতে দাঁত চেপে সব সয়েছে।
নিজেকে শূণ্য মনে হচ্ছে বাসন্তীর। সে এমন নারী যে কি না চিকচিকে সোনা ক্রয়ে টাকা বিলিয়েই গেছে, অথচ নেওয়ার সময় দেখে থলি ভর্তি বালু।
অনুভূতির টানাপোড়নে তার একবার মনে হলো অনিমেষকে প্রশ্ন করবে। তবে জানে তার উত্তর হবে মিথ্যে, অশুদ্ধ কিংবা উত্তরই পাবে না। শুধু শুধু আর শব্দ খরচ করবে কেন ভেবেই চুপ থাকল। নিকাবের আড়ালে ভাঙাচুরা নারীটির অনুভূতি আর কারো জানা হলো না।
___
বেডরুমে বিছানায় বসে বসে ফল কাটছে বাসন্তী। নায়িম দেখেই বিরক্ত এবং রাগান্বিত হলো।
“তোমাকে না কত্তবার বলসি যেখানে যেটা করার সেখানে সেটা করবা। এটা কী ফল কাটার জায়গা? কীচেনে যাও! যত্তসব!”
“আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন?”
বেফাঁস প্রশ্ন বাসন্তীর। চোখে-মুখে কৌতূহল, বেদনার ছাপ, উত্তেজনা স্পষ্ট।
নায়িম আকস্মাৎ এমন প্রশ্নের কারণ বুঝল না। বরং, আরও বেশি বিরক্ত হলো।
“কী সব আজাইরা প্রশ্ন? কীচেনে যাও।”
“বলেন না সত্যি করে, আপনি আমাকে ভালোবাসেন?”
“হ্যাঁ, বাসি। হইসে? আর শুরু করসোটা কী তুমি? আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি।”
বাসন্তীর দিকে তাকাতেই চমকে উঠে সে। রমণী নিজ গলায় ছুড়ি ধরে বসে আছে। তার চোখে অশ্রু, চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে। তাতে অন্যরকম এক জেদ দেখতে পাচ্ছে আজ নায়িম।
“সত্যি করে বলেন ভালোবাসেন না কি? নাহলে এই ছুড়ির আমার চামড়া ভেদ করতে সময় লাগবে না। মিথ্যে বলবেন না দয়া করে। আমি সত্য জানতে চাই।”
শুকনো ঢোক গিলে নায়িম। ভয় হচ্ছে তার, অতিরিক্ত ভয়। যে ভয়ে মিথ্যে বলার জ্ঞান থাকে না।
“বাসি না, বাসি না ভালো। এখন প্লিজ ছুড়ি নামাও। লেগে যাবে বসন্ত। ভয় হচ্ছে আমার।”
বাসন্তীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। সে শুধুই বিড়বিড়ায়,
“চলে যান। একা ছেড়ে দিন আমায়। চলে যান।”
“আমি যাচ্ছি। তুমি প্লিজ নিজের কোনো কোরো না।”
ভীতিগ্রস্ত যুবক ধীর ধীর পায়ে ঘর ছাড়ে। বাসন্তী স্তব্ধ হয়ে সেখানেই বসে। ভাবছে,
– তার ভালোবাসার ঘর তবে মিথ্যে ছিল? কী করবে এখন? কোথায় যাবে? কীভাবে ভালোবাসার খোঁজ পাবে?
___
“মর্নিং, মাই হাবি। একটা কিস্যি দেও তো মর্নিংটা গুড, বেটার, বেস্ট করতে।”
ঘুমুঘুমু চোখে পরিচিত নারী কণ্ঠে এ কথা শুনতেই হুড়মুড়িয়ে জেগে উঠে নায়িম। অস্পষ্ট ভাবে বলে,
“বসন্ত!”
আর কিছু বলতে পারে না তার আগেই যে একঝাঁক কোমল বোলতা তার অধর ছুয়ে দেয়। সে কী বিষধর ছোঁয়া! স্পর্শ শেষে বাসন্তী চোখে চোখ রেখে শুধায়,
“তোমার হৃদয়ের বিষ শুষে নিচ্ছি প্রিয়তম। তোমার সবটুকু বিষ আমায় দিয়ে দাও, আমার ভালোবাসা টুকু তুমি গ্রহণ করে নেও।”
নায়িমের মাথা স্তব্ধ হয়ে গেছে। বাসন্তীর দ্বারা এমন আচারণ কিছুতেই সম্ভব নয়। তাহলে সে স্বপ্নই দেখছে। অন্যরকম বসন্তের স্বপ্ন।
চলবে…
#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||২১তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নায়িমের চিন্তার মাঝেই কামড় পড়ে ঘাড়ে। সূক্ষ্ম ব্যথায় গা শিউরে উঠে। না কি কিছু অন্যরকম অনুভূতির দরুণও এই শিহরণ কে আর জানে?
“হোয়াদ্দা হেল!”
সামনে তাকাতেই মুখে তালা লাগে যুবকের। সেই একই নারীমূর্তি চাপা হাসছে তাকে কামড়ে। তাহলে কী বাস্তব সবই!
“উঠো না নায়িম! আজকে আমাকে রান্নায় হেল্প করবে, বুঝলে? চৈতালি আপুর শরীর খারাপ রাত থেকে… আমি একা একা ওত কাজ কী করেই বা সামলাব?”
নায়িম ড্যাবড্যাব করে দেখেই যাচ্ছে নিজের বসন্তকুমারীকে। এ কোন রূপ দেখাচ্ছে আজ তার একান্ত নিকটবর্তী নারী? গতকাল রাতে বাসন্তী প্রশ্নবিদ্ধ করার পর সে যখন শুতে আসে বাসন্তী তখন তন্দ্রায় ডুবে। তা দেখে কোনো কথা ছাড়াই সে একপাশে ঘুমিয়ে পড়ে।
“কী হলো? উঠো! আজব তো!” কাটখোট্টা কথাবার্তা বাসন্তীর।
চিন্তায় ভাটা পড়ে যুবকের। যুবতীর হাবভাব তার নিকট ভালো ঠেকছে না। ভাবে,
– কষ্ট পেয়ে পাগল হয়ে যায়নি তো এই মেয়ে?
“তুমি ঠিক আছো বসন্ত? এসব নিয়ে কষ্ট পাওয়ার কী আছে? দেখো আমি তো তোমার সাথেই আছি, থাকব। অন্যকেউ তোমার জায়গা নিতে পারবে না আমার জীবনে। তুমিই একমাত্র নারী থাকবে যে আমাকে গভীর ভাবে ছুঁয়েছে, ছুঁবে।”
তার সান্ত্বনায় যেন আরও ভড়কে গেল বাসন্তী। মনে মনে বলে,
– ওরে পাগল, বলোস কি না আমি পাগল?
“কী সব আজাইরা কথা লাগায় দিয়েছো? উঠো তো বিছানা থাকে। কিছু তো করো না, খালি প্যানপ্যানানি আর ঘ্যানঘ্যানানি। আমার হয়েছে আচ্ছা জ্বালা।”
ঠিক সেই মুহূর্তের মায়ের চেঁচানোর আওয়াজে সশব্দে কেঁদে উঠল নায়িমের পাশে শুয়ে থাকা নাহিবা। নায়িম হুড়মুড়িয়ে উঠে কোলে নিয়ে শান্ত করতে শুরু করল তাকে।
বাসন্তী বাবা-মেয়ের ভালোবাসা দেখে আলতো হাসল। তারপর বিছানা গুছাতে লেগে পড়ে।
“ওকে আমার কোলে দেও, আর তুমি ওর ট্রলিটা নিয়ে আসো। যেটা অনিমেষ ভাইয়া গিফট্ করসে সেটা আনবা, তোমার কেনাটা না।”
অত্যন্ত স্বাভাবিকতার সাথেই আদেশ করল বাসন্তী, যেন এমনটা কারো জন্যই নতুন না। নায়িমকে কিছু বলতে না দিয়ে নাহিবাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে। তার চোখেমুখে ব্যস্ততা ও প্রয়োজনের অধিক স্বাভাবিকতা।
নায়িম হাত-মুখ ধুয়ে, একদম পরিপাটি হয়ে ট্রলি নিয়ে ড্রইংরুমে আসলো। বাসন্তী তখন ভাজি করার জন্য গাজর কাটছে।
“এসেছেন মহারাজ? বেশ তাড়াতাড়িই এসে পড়েছেন মনে হলো। আরও আধঘণ্টা পর আসতেন ট্রলি নিয়ে।”
নায়িম এতক্ষণ না রাগলেও বাসন্তীর এমন বিদ্রূপমাখা কথায় বেশ রাগান্বিত হয়ে উঠল।
“এবার কিন্তু বেশ বাড়াবাড়ি করছো বসন্ত! মেজাজ খারাপ করে ফেলছো।”
তার এই ক্রোধ ঠাহর পেল না বাসন্তীর কাছে। বরং, বেশ রসকষহীন জবাব রমণীর।
“রান্নাঘরে যান, রাতের বাসন পড়ে আছে কয়েকটা। একটু সাহায্য করো আমায়।”
বসন্ত কুমারীর এমন খামখেয়ালিপনা আর সহ্য হচ্ছে না নায়িমের। ক্রোধে দেহের সর্বশক্তি দিয়ে সোফায় লাথি মারে নায়িম। বাসন্তী জোরালো শব্দে কেঁপে উঠলেও প্রতিক্রিয়া নেই। এ যেন ঘি হয়ে পড়ে নায়িমের ক্রোধের অনলে।
বাসন্তীর দিকে ঝুঁকে গাল চেপে ধরে তার।
“বেশি বাড় বাড়িস না, জানে মেরে ফেলব।”
“তোমার হাতে মৃত্যুও অমৃত প্রিয়। বিষাদে মরণ হয়েছে কতবার, কিন্তু আফসোস সেই ভয়ানক বেদনার মৃত্যু তোমার নজরে পড়ল না।”
চাকু সামনে আনে বাসন্তী। নায়িম খাণিক সরে যায়।
“তোমার হাত নোংরা করবে কেন প্রিয়? আমিই নাহয় তোমার কাজ সহজ করে দেই।”
বলে যেই না গলায় ছুড়ি ঠেকাতে যাবে তখনই নায়িম ছুড়ি ছিনিয়ে নিয়ে সজোরে আছাড় দেয় মেঝেতে। চুলের মুঠি চেপে রিনরিনে সুরে শুধায়,
“পেয়েছোটা কী তুমি? সবসময় এই ছুড়ি ছুড়ি খেলা…! আমাকে পোষ মানাতে চাও তুমি? আমাকে? আমি সেই ছেলে না।”
ব্যথা লুকিয়ে শব্দ করে হেসে উঠে বাসন্তী।
“তুমি বুঝি কুকুর পোষ বানাব তোমায়? আমি তো তোমায় জয়ী করে তোমাকে জয় করতে চাই। আর কতবার ছুড়ি ছিনিয়ে নিবে আমার, এক ফাঁকে একা করেই দিব তোমায়।”
ধাক্কা দিয়ে বাসন্তীকে সরিয়ে দেয় নায়িম। টেবিলে থাকা সবকিছু ছুড়ে ফেলে দেয় মেঝেতে। ফ্রাস্টেশনে মাথায় দাউদাউ করে ক্রোধানল জ্বলছে তার। নিজের মাস্ক আর চশমা বের করে নেয় ড্রয়ার থেকে।
“এই বা*র ঘরে থাকবই না আমি! তুই আমার সাথে বাহাদুরি করোস? আমিও দেখব তোর এই সাহস কতক্ষণ থাকে। আসলে তোরা সব মেয়ে এক পদের, সব দাস বানাইতে চাস ভালোবাসার নামে। এইজন্যই ভালোবাসি নাই তোরে কখনো।”
কথাটা কানে ঢুকতেই অস্থির হয়ে পড়ে বাসন্তী। ছুড়ি তুলে নিয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে যায় নায়িমের দিকে।
“যুবক, বল ভালোবাসি, অধরে দে ভালোবাসার ছাপ। তা নাহলে মুক্তি দিব? এক ধরণী দিব আমি বিহীন, সুখী হ না তুই আমি হীনা হয়ে। না করেছে কে বা?”
দৃঢ় কণ্ঠ তার। নায়িম খেয়াল করল বাসন্তীর চোখে আজ অন্যরকম জেদ, অটলতা। তাকে কেন যেন প্রভাবিত করল তা। বাসন্তী তার অমূল্য রতন, যে রতন জীবনে একবারই পায় মানুষ। তাই হারাতে দেওয়ার সুযোগ নেয়। অধরে শুষ্ক এক ছোঁয়া দিয়ে। অনুভূতিহীন ‘ভালোবাসি’ উচ্চারণ করেই ঠাশ করে দরজা লাগিয়ে বের হয়ে যায় সে।
বাসন্তীর চোখে অশ্রুময় তৃপ্তি। সে আপন মনেই বিড়বিড়ায়,
“আমার সবটুকু আবেগ, সুখ, অনুভূতি নিংড়ে দিয়ে বেদনা, কষ্ট, অবজ্ঞা, অপমান মাথা পেতে নিয়েছি তোর ভালোবাসার বিনিময়ে প্রিয়। আর তুই কত সহজেই বলে দিলি ভালোবাসিস না। আমিও ভেবে নিয়েছি তোর ভালোবাসা আমি ছিনিয়ে নিবই, নিব!”
___
– কেন এতো বিষের বিক্ষোভ জ্বেলে তনুতে পরানে
বার বার কষ্টের করুন হার কণ্ঠে তুলে নাও?
কেন এতো কষ্ট পাও, কেন এতো কষ্ট পাও তবে?
সারা রাত্রি হেঁটে এসে শেষে যদি না পেলে সকাল
তবে এই জাগরন কেন, কেন এই হেঁটে আসা
দুঃখময় কুয়াশার রাতে? কেন তবু শুশ্রূষার দিকে ছুটে ঘৃনাকে হারানো?
যেদিকে ফিরেছে মন সেইদিকে ফেরাও নিজেকে।(রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ)’
বিষাদ মনে কবিতাটি আবৃত্তি করে যাচ্ছে চৈতালি। সে সাহিত্যানুরাগী মেয়ে নয় মোটেও। তবে কবিতা আবৃত্তির প্রতি একটা ঝোঁক আছে, বিশেষ করে রুদ্র বাবু আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা আবৃত্তির দিকে।
এই কবিতাগুলোর মাঝে অন্যরকম এক শক্তি আছে, যা প্রেমে না পড়েও তার মাধুর্যতার আভাস দেয়, বিরহবেদনা না পেয়েও বিরহের দমবন্ধ অনুভূতি বোধ করায়।
“বেশ ভালো আবৃত্তি করো তো তুমি আপু। থামলে কেন?”
চৈতালি সচকিত হয়ে চোখের অশ্রু মুছে নিয়ে বাসন্তীর দিকে ঘুরল। তার জন্য নাস্তা নিয়ে এসেছে সে। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ বহু বেশি দ্বিধাহীন লাগছে মেয়েটিকে।
“শুধু শুনেই গেলে মনে আর নিতে পারলে না।”
“মানে?”
“সারা রাত্রি হেঁটে যদি সকালই না পাও, তবে কেন এই জাগরণ বা হেঁটে আসা? কেন এত কষ্ট সয়ে নেওয়া? ভালোবাসা কি তবুও পেল?”
“আমার মা-বাবার যখন তালাক হয় তখন আমার বয়স মাত্র দশ। সেই তালাকের পর থেকে একটা মুহূর্ত শান্তির পাইনি, কেউ কখনো ভালোবাসেনি। মা তো মারতই, আবার যে যখন মন চাইত গায়ে হাত তুলত। খুব লাগত বুঝলে? মায়ের মার সহ্য করা যায়, তার শাসন করার অধিকার ভালোবাসার সাথে, কিন্তু ভালোবাসা বিহীন শাসন…?
মাটাও না কোনোদিন এই বাবা ছাড়া মেয়েটিকে আদর করেনি। আমি বড় বেশিই তৃষাতুর ছিলাম শুধু একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য এবং নিজের সবটুকু ভালোবাসা দেওয়ার জন্য। আফসোস কেউ নেয়নি, কেউ দেয়নি, নায়িম ছাড়া। তার মার-ধর সব সহ্য করতে ঐ যে দিনশেষে তার দুটো প্রেমময় কথা, আদর-সোহাগ, আমার অসুখে যত্ন পেতাম। ভালোবাসিও তো বলত, হয়তো মিথ্যেই।
তবুও কেউ ভালোবাসার ছিল, কপট হলেও। আমার ভালোবাসার তৃষ্ণা আমাকে বাধ্য করেছিল সব মেনে নিতে। তাছাড়া যেতামই বা কোথায়? কেউই তো নেই আমার।” থেমে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল সে।
চৈতালি ভাবল,
-মেয়েটা আসলেই আজ কেন যেন দ্বিধাহীন, শক্ত।
“আমি তো আমিই, বোকাসোকা এক তৃষ্ণার্ত নারী। তুমিও তো শুধু কবিতা বলেই গেলে মনে লাগালে না। ‘যেদিকে ফিরেছে মন, সেইদিকে ফিরাও নিজেকে’, তোমার মন কি সত্যিই এইদিকে? না কি পড়ে আছে সেই ছোট্ট দুই রুমের স্বস্তা ফ্ল্যাটে কম আয়ের মানুষটার সাথে? ভালো আছো তো তুমি? সত্যিই ভালো আছো?”
বাসন্তী চৈতালির হৃদয়েকথার বিষ মাখা তীরে ছুড়ে দিয়ে আর একদণ্ড দাঁড়াল না, বের হয়ে গেল। নির্দয়ের ন্যায় একবার তাকিয়ে দেখলেও না তার তীরে কতটা তড়পাচ্ছে লাস্যময়ী তরুণীটি।
চলবে…