টক্সিক_রিলেশনশীপ,২২,২৩
ঈপ্সিতা শিকদার
২২
অন্ধকারচ্ছন্ন ঘর, মাথার উপর ছোট্ট একটা হলদে আলোর উৎস শুধু। কমিশনার সাহেব বসে বসে দরদর ঘামছেন, চিন্তিত এলাকার পরিচিত বড় ভাই সাদ্দাত নামক প্রতিদিন গরীব হকারদের কাছ থেকে টাকা তুলা গুন্ডাটিও। তবে এসপি মশাই বেশ শান্ত, এবার কোনো গভীর ভুল তিনি করেননি। কিন্তু তবুও মনের কোনো এক কোণে ভয়।
এলাকার ছোট থেকে বড় ক্ষমতাবান সরকারি কর্মচারী, মাস্তান সবাই চিন্তিত। আজ যে বৈঠক বসেছে আবার।
তাদের চিন্তা-ভাবনার মাঝে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করল এক আগুন্তক। পরনে তার কালো হুডি, মুখে মাস্ক। হাবভাবেই বুঝা যায় অল্প বয়স্ক ছেলে। তবুও তাদের কেমন নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে।
“সালাম সবাইকে, কী অবস্থা আপনাদের?” ভার গলায় বলতে বলতেই বসে পড়ল নিজের জন্য নির্ধারিত চেয়ারে বসে পড়ে সে।
“ওয়ালাইকুম আসসালাম, ছোট খান সাহেব। আপনি কেমন আছেন?”
“আমি তো ভালোই আছি, তবে আপনারা মনে হয় বেশিক্ষণ ভালো থাকবেন না।”
রাশভারী কণ্ঠ। একটু ত্রাসিত হয় সেখানে উপস্থিত সকলেই।
“সাদ্দাত, শুনলাম প্রতিদিন একশো টাকা করে নিচ্ছো হকারদের কাছ থেকে? তা তোমার বাপ কি তাদের কাছে তোমার জন্য টাকা কামাই করে রেখে গিয়েছিল?”
“আসলে…”
“আমি অত আসলে নকলে বুঝি না বাপু। তোমাকে আমি একদম টাকা তুলতে তো মানা করছি না। ভিখারি তুমি, ভিক্ষে তুলবে ঠিক আছে। কিন্তু এত টাকা তো আর ভিক্ষা নেওয়া যাবে না।”
মাথা নুয়ে ফেলে সাদ্দাত। ভদ্র ভাষায় কী অপমানটাই না করল ছেলেটা!
“কমিশনার সাহেব, এসপি সাহেব আর বাকিরা আপনাদের ছোট্ট একটা কাজ দিয়েছি করতে, সাদিককে খুঁজতে। বিনিময়ে টাকা-পয়সা সকল রকম সুবিধা দিচ্ছি। তাও আপনারাও পারছেন না? দেন আপনাদের ক্ষমতায় রেখে আমার লাভ কী?”
“প্লিজ এমন করবেন না ছোট সাহেব। আমি আপনাকে নিশ্চিত করছি কিছুদিনের মধ্যেই সাদিককে আমরা আপনার হাতে তুলে দিব? কী বল সবাই?” কমিশনার সাহেব মিনতি করলেন।
“হ্যাঁ! হ্যাঁ!” সবাই এক সুরে সায় জানাল।
বাঁকা হাসে নায়িম। তারপর চোখ তুলে শুধায়,
“আর মিনহাজ, তুমি কিন্তু কাজে আজকাল বেশ ভালোই ফাঁকি দিচ্ছ। অন্ধকার এই দুনিয়ায় কোথায় কী হচ্ছে সে খবর দেওয়ার কাজ তোমার। অথচ, আজকাল আমি কোনো খবরই পাই না।”
আরও বেশ কিছুক্ষণ নানা বিষয়ে আলোচনা করে বের হতে নেয় নায়িম। দরজার দিকে যেতেই হুট করেই মাস্কের দড়ি ছিঁড়ে যায়। চমকিত হয়ে পড়ে নায়িম, তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু ততক্ষণে সাদ্দাত তার এক ঝলকান পেয়ে বসেছে। আপন মনেই সে বিড়বিড়ায়,
“গায়ক নায়িম!”
___
বাসায় ফিরে ঘরে ঢুকতেই দেখতে পায় বাসন্তী দরজার বিপরীত দিকে ঘুরে শুয়ে আছে। তখন আসর নামাজের সময়। এই অবেলায় ঘুমিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা চিন্তিত হয়ে তাকে দেখতে এগিয়ে যায় যুবক।
শান্ত হয়ে শুয়ে আছে মেয়েটি, যেন সেই রূপকথার ঘুমন্ত রাজকন্যা। কে বলবে এই মেয়েই সকালে এমন কাণ্ড ঘটিয়ে ছিল! হুট করেই নায়িমের বড্ড বেশি তৃষ্ণা পেয়ে যায় এই যুবতী শুষ্ক দু’খানা অধর গভীর স্পর্শে সিক্ত করে দিতে। কিন্তু মেয়েটা তো ঘুমুচ্ছে। হুট করে এক দুষ্টু ভাবনা ধরা দেয় নায়িমের মাথায়।
“বসন্ত কুমারী, খুব জ্বালিয়ে ছিলিস না আমাকে? শোধ তো দিতে হবেই। যাক এখন নাহয় শুধু আসলটাই নিলাম।”
বিড়বিড়িয়েই নিজের আয়ত্বে নিয়ে নেয় প্রণয়িনীর অধরজোড়া।
তন্দ্রাচ্ছন্ন বাসন্তী শক্ত ছোঁয়া ও দমবন্ধ অনুভব করায় ছটফট করতে শুরু করে। তবে এতই কী আর সহজ পুরুষালি বন্ধনের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হওয়া! ছটফট করতে করতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে চোখ খুলে সে। চোখ খুলতেই দেখতে পায় নায়িমের চেহারার অর্ধাংশ। নায়িম চোখ টিপ দিয়ে বেশ জোরে একখান কামড় দিয়ে মুক্ত করে দেয় তাকে।
বাসন্তী মৃদু আর্তনাদ করে বলে,
“মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার? এমন কেউ করে? কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি!”
তার এতগুলো কথা নায়িম নির্দ্বিধায় উপেক্ষা করে ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। টানা আধঘণ্টা গোসল করে বের হয়ে তো সে অবাক। বাসন্তী নিজেকে খিমারে আচ্ছাদিত করে বসে আছে।
“এগুলো কেন পড়েছো? তুমি বাহিরে যাবে? কোন আশিকের আস্কারা পেয়ে ডানা গজিয়েছে তোর?এই ডানা কেটে দিতে দেরি…”
তার কথার মাঝেই বাসন্তী এগিয়ে এসে পা উঁচু করে গলা জড়িয়ে ধরে তার। নিকাবে ঢাকা অধরের আলতো স্পর্শ দেয় গলা। তার ক্ষমতা যে ঐ অবধি। সাহায্য ছাড়া নায়িমের মুখশ্রীতে ঠোঁট ছোঁয়ানোর ক্ষমতা আল্লাহ তাকে দেয়নি।
“উফঃ জনাব এত রাগলে চলে? আগে শুনেন তার পর বলেন। আমরা দুজনেই ডাক্তার অরবিন্দ ভট্টাচার্যের কাছে যাচ্ছি আপনার চিকিৎসা করাতে। সাথে নাহিবা সোনাও যাবে।”
ব্যঙ্গাত্মক হাসি ফুটে উঠে নায়িমের চেহারায়।
“এতটা বছর ধরে সংসার করো আমার সাথে এটুকুও বুঝতে পারোনি এই নারী দেহের মোহ-মায়া আমাকে ভুলাতে পারে না সব। তোমার মাঝে আমি কখনোই হারাইনি, বরং নিজের বোধশক্তি নিয়েই তোমাকে আবিষ্কার করেছি। তোমার কাছে আসার চেয়ে পাশে থাকাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি।
অথচ, তুমি কি না আর দশটা মেয়ের মতো এসেছো এই চুমু, লাস্যময় ভঙ্গিমা, রোমান্টিকতা দিয়ে আমাকে ভুলিয়ে কাজ সারাতে। হাস্যকর ব্যাপারস্যাপার! এগুলো কাজ করে অন্যান্য পুরুষের সাথে। কিন্তু এই নায়িম ভিন্ন। তার মন ভুলাবে এমন কেউ বা কিছু নেই এই ধরণীর কাছে। তবে তোমরা সব মেয়েরাই এক। সবসময় পুরুষকে পোষ মানানোর ধান্ধায় থাকো।”
বাসন্তী একটু বিব্রত হল। ভেবে উঠল,
– আসলেই ছেলেটা কখনোই তার দেহকে ভোগ্যবস্তু বোধ করায়নি। সে অত্যাচার করেছে বহু। কিন্তু স্ত্রী হয়ে এটুকু সে বলতে পারে নারীর শরীরের নেশা নেই নায়িমে। সে তার মন-মস্তিষ্ককে নিজের অধীনে রাখতে চেয়েছে, অসুস্থতার দরুণই হয়তো।
নিজেকে সামলে নেয় রমণী। স্বাভাবিক হয়।
“এগুলো আমার অধিকার, ইচ্ছে, ভালোবাসা। কোনো মন ভুলানোর উপায় নয়। উল্টাপাল্টা বুঝবা না। এখন রেডি হও, তোমার চিকিৎসা প্রয়োজন তর্কের চেয়ে বেশি।”
“কীসের চিকিৎসা দরকার আমার? আমার কি অসুখ আছে না কি? আজব!”
“ওসিডি, মরবিড জ্যায়ালসি ইন্টারমিটেড এক্স কী যেন…”
“কী বলতাসো হাবিজাবি?”
“এগুলো তোমার ডিজঅর্ডারের নাম। এখন বুঝছো কীসের চিকিৎসা লাগবে?”
বিচলিত হয়ে পড়ে নায়িম, সাথে আশ্চর্যও বোধ করে সে। তারপর গম্ভীর সুরে উত্তর দেয়,
“আমি কোথাও যাচ্ছি না। আমি একদম ঠিক আছি, ঐ টাকলু ডাক্তারেরই মাথা নষ্ট।”
“আচ্ছা যেয়ো না। আমিও অনিমেষ ভাইয়াকে বলব নাহিবাকে দূরে কোথাও রেখে আসতে তোমার থেকে।”
“তোরে তো আমি…!” বলেই চড় মারতে নেয় বাসন্তীকে। কিন্তু অনিমেষ তার হাত এসে ধরে ফেলে।
অনিমেষ বেশ কিছুক্ষণ আগেই এসেছে বাসন্তীর কল পেয়ে। বাসা ধানমণ্ডিতেই হওয়ায় খুব সময় লাগেনি তার আসতে।
“একদম ভাবীকে কিছু বলবি না। তুই নিজেই ভাব রাগের মাথায় সেদিন তুই ভাবীকে যখন ধাক্কা মেরেছিল তোর এটুকুও সেন্স ছিল না ভাবীর কোলে নাহিবা। পড়ে গেলে যেকোনো অঘটন ঘটতে পারত! এখন তুই বল, তোর রাগের জন্য কি তোর সাথে সেফ নাহিবা?
তুই কি নিজেকে মি.খানের মতোন নিকৃষ্ট পিতা বানাতে চাস? নিজের বাচ্চার জন্য এটুকু করতে পারবি না? তোর রাগ স্বাভাবিক নয় দোস্ত। একটু ভাব। ভাবী না হোক এট লিস্ট নাহিবা, ঐ ছোট্ট অবুঝ শিশুটার জন্য ভাব।”
বন্ধুর আবেগ মাখা গলার কণ্ঠ শুনে সত্যিই ভাবুক হয় নায়িম। আড়চোখে দোলনায় শায়িতা নিজের রাজকন্যার দিকে তাকায়।
-না, এই মেয়ের জন্য সে সব করতে পারে। শুধু এই মেয়ের জন্য! তার রাজকন্যা যে।
নায়িমকে চুপ থাকতে দেখে ফুঁসে উঠে বাসন্তী।
“একে বুঝিয়ে লাভ নেই ভাইয়া। নিজের সন্তানের ভালো-মন্দ তো পাগলও বুঝে। কিন্তু উনি…”
কাটখোট্টা হয়ে বলল নায়িম,
“আমি রাজি। ”
বাসন্তী ও অনিমেষ দুজনেই এই কথায় খুশিতে আটখানা হয়ে গেল। আপন মনেই বিড়বিড়াল রমণী, “অবশেষে সুবুদ্ধি হলো গাঁধার!”
নায়িম অস্পষ্টভাবে বাক্যটি শুনে তেঁতে উঠল।
“এই বসন্ত? কী বললা তুমি আমায়?”
“যা সত্য, তা-ই বলেছি।”
নায়িম কিছু বলবে তার আগেই তাকে ঠেলেঠুলে বাসন্তীর বের করে রাখা কাপড়-চোপড় সহ বাথরুমে পাঠাল নায়িম। তারপর বাসন্তীকে চোখ টিপ দিয়ে বলল,
“ওয়েল ডান, ভাবী! ভালোই তো শায়েস্তা করেছো আমার বন্ধুকে।”
___
চৈতালি বিনা শব্দে শুধু অশ্রুই ফেলে যাচ্ছে। ফাহিমকে আনব্লক করে বেশ কয়েকবার কল দিয়েছিল সে। কিন্তু যুবকের ফোন বন্ধ। ছেলেটার সাথে কথা না বলে শান্তি পাবে না সে। কিন্তু কাকে কল দিবে?
হুট করেই মনে পড়ে আজ তো ফাহিমের ওভার টাইম করার কথা। নিশ্চয়ই সে অফিসে। ফাহিমের একজন কলিগের নম্বর আছে তার নিকট। তবে কী মনে করে আবার লোকটা এই ভেবে আর কল দিতে যেয়েও দিল না। অবশেষে অনেক বোঝা-পড়ার পর কল করল ফাহিমের কলিগকে।
অপরপাশের মানুশটির থেকে যা শুনল তাতে যেন পা থেকে মাটি সরে । তার সোনার সংসাস তাহলে ভেঙেই গেল!
চলবে…
#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||২৩তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
“হ্যালো? হ্যালো? আপনি কলে আছেন ভাবী?”
ফোনের অপরপাশের মানুষটির কথায় ঘোর ভাঙে চৈতালীর। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে সে।
তার মানুষটি যে ভালো নেই। হ্যাঁ, তার ব্লক মারার চার দিনের মাথাতেই ফাহিমের এক্সিডেন্ট হয়। তারপর থেকে হাসপাতালের বাসিন্দা সে
“ফাহিম কেমন আছে? কোন হাসপাতালে ও?”
“ফাহিম তো সিটি হসপিটালে ভর্তি। কিন্তু আপনি তা জেনে… মানে আপনি তো ওকে ছেড়ে চলে গেছেন শুনেছি।”
বুক কেঁপে উঠল চৈতালির। সত্যিই মানুষটাকে যখন একা করে দিয়ে চলে এসেছেই সে। তবে তার কী হক আছে খোঁজ-খবর নেওয়ার!
স্তব্ধ গলায় সে “ধন্যবাদ” বলেই কল ডিসকানেক্ট করে দেয়। আপন মনেই ভাবতে থাকে,
– এবার কেন খোঁজ খবর নিবি রে তুই? ছেলেটাকে কম তো পোড়ালি না। জানিস ছেলেটা তোর পাগল, তবুও তো একা করেই দিলি।
নিজেকে ধিক্কার জানাতে শুরু করে রমণী। তবে তাতে কী আর অতীত শুধরে যাবে? যেই বীজ রোপণ করেছে, সেই ফল তো পেতেই হবে।
অনেক ভেবে-চিন্তে সে সিদ্ধান্ত নেয় সে সিটি হাসপাতাল যাবে ফাহিমকে দেখতে। ঐ মানুষটির সাক্ষাৎ পাওয়া না অবধি তার মনে শান্তি অনুভব হবে না। যদি এক পলকের দর্শন পায় তা-ই তীর্থযাত্রা।
পরনে থাকা শাড়িতেই পার্স নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। কিন্তু হাসপাতালে ঢুকতেই আরেক ঝামেলা, রুম নাম্বার বা কয় তলাতে কিছুই তো তার জানা নেই।
রিসিপশনিস্ট একজন অহংকারী ও রূঢ়ভাষী নারী। তার কাছে জিজ্ঞেস করতেই কেমন যেন তেঁতে উঠে সে। বহু কষ্টে অনেক অনুরোধের দ্বারা ফাহিমের অবস্থান জানতে পারে।
বন্ধ লিফট বেয়ে উপরে উঠার সময় মনে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে তার। কতদিন পর আজ স্বচক্ষে ফাহিমকে দেখবে! তার অনুভূতির স্থায়ীত্ব হয়তো খুব বেশি সময় থাকবে না।
কেবিনের সামনে আসতেই শুনতে পায় একজন অপরিচিত নারীর হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠ। চমকিত হয়। আড়াল হয়েই উঁকি দেয় কেবিনে। সাথে সাথেই যেন হৃদয়ের মধ্যিখানে হাজার খাণেক সুঁই এসে আঘাত করল। কী চিনচিনে বেদনা সে যে!
ফাহিমকে এক অচেনা নারী একটু একটু করে স্যুপ খায়িয়ে দিচ্ছি। তাদের হাস্যরসিক কথোপকথনে হাসি ছুটছে দুজনের মুখ থেকে। কিন্তু চৈতালির এত কষ্ট কেন? সে তো চলে গিয়েছিলই ফাহিমের প্রেমিক হৃদয় শূণ্য করে, তবে শূণ্য ঘর অন্য কেউ পূর্ণ করলে এত কেন লাগছে।
দুনিয়ার রীতি তো এটাই, কোনো স্থান বা পদবিই সারাজীবন শূণ্য থাকে না। শূণ্য হলে যে একসময় তা পূর্ণ হবেই। হোক তা মানুষের হৃদয়!
অতঃপর ভঙ্গিত হৃদয় নিয়ে বেরিয়ে আসে সে হাসপাতাল থেকে। ফাহিমের চোখের সম্মুখে যেয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তার মাঝে আর বেঁচে নেই।
___
অরবিন্দ ভট্টাচার্যের বাসা থেকে বের হতেই নায়িমের আরেকটা গানের পরিচালকের কল আসে। নায়িমের মাথায় যেন বাজ পড়ে এই প্রজেক্টের কথা ভুলেই বসেছিল সে। লোকটার প্রজেক্ট এতদিন বাজিয়ে রাখা ঠিক হয়নি।
“আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। আমি অনেক বেশি দুঃখিত। প্রজেক্টটার কথা প্রায় ভুলেই বসেছিলাম।”
“হুম, আমিও তাই-ই ভেবেছি। নাহলে তোমার মতোন ছেলের এতটা ইনডিসিপ্লিন, আনপ্রোফেশনাল বিহেভ কীভাবে সম্ভব! যাই হোক, তুমি কি এখন ঢাকায়?”
“হ্যাঁ, স্যার। কেন বলেন তো?”
“গ্রেট! শুনো স্টুডিও রেডি আছে। গানটা আজই রেকর্ড করে ফেলি, শুটিং পড়ে করব নে। তাহলে নির্ধারিত রিলিজ ডেটের মধ্যে হয়তো কমপ্লিট করা সম্ভব।”
“কিন্তু কোনো প্র্যাকটিস ছাড়া আমি কী করে…?”
“আরে ছেলে তুমি হলে কি না ন্যাচরাল। একদম জন্মগতভাবে পাওয়া প্রতিভা তোমার। কিচ্ছু হবে না, তুমি পারবে। এসে পড়ো।”
উপায়হীন হয়ে রাজি হয় নায়িম। সেখান থেকেই উবার দিয়ে সোজা যায় স্টুডিওতে।
কিন্তু কাজ করার সময় কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল তার। মনে হচ্ছে কেউ তার পিছু নিচ্ছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে খোঁজে সে, সন্দেহ করার মতো কাউকেই পায় না৷
“আরে নায়িম, মন কই তোমার? আজকের মধ্যে রেকর্ডিং শেষ করতে হবে। কাজে মনোযোগ দাও রে বাবা।”
পরিচালক সাহেবের তাগাদা দেওয়ায় আর নিজের মনের অস্বস্তিতে ধ্যান দেয় না সে। কাজে মনোযোগ দেয়। এই সামান্য অসতর্কতাই কী ঝড় বয়ে আনবে তার জীবনে!
___
কেটে গেছে বেশ কিছুদিন, নাহিবাও একটু বড় হয়েছে৷ নায়িমকে বেশ ভালোই চিনে সে, দেখলেই মিটিমিটি হাসে। নায়িমও প্রতিনিয়ত চিকিৎসা নিয়ে যাচ্ছে অরবিন্দ ভট্টাচার্যের কাছ থেকে। বাসন্তীও এখন আগের নীরব বালিকা নেই, রায় বাঘিনী হয়েছে৷ যদিও নায়িমের সম্মুখে তার এই সাহস ধরে রাখা খুবই কঠিন।
আজকে দুপুরেও নায়িমকে নিয়ে অরবিন্দ ভট্টাচার্যের কাছে। সেই কখন থেকে বাসন্তী তাকে তৈরি হতে বলছে, কিন্তু যুবক তার কথা একদম উপেক্ষা করে যাচ্ছে। এই খামখেয়ালিপনা দেখে রীতিমতন রেগে উঠছো বাসন্তী।
“কী অবস্থা! তুমি এখনো রেডি হওনি কেন? যাও, শাওয়ারে যাও।”
নায়িম একবার গম্ভীর চাহনিতে তাকে দেখে আবারও টিভিতে মনোযোগ। কে জানে কী বুঝে এতে বাবার কোলে শুয়ে থাকা নাহিবা, চওড়া হাসি ফুটে উঠে তার মুখশ্রীতে।
বাসন্তী রেগে টিভির মেইন সুইচ বন্ধ করে দেয়। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,
“তুমি কি যাবা না কি যাবা না? আমার তোমাকে সারাদিন যাও, যাও বলার সময় নাই। সিঙ্কে যেয়ে দেখো কত থালাবাসন জমে আছে।”
“আজ নাহিবার টিকা আছে। ওকে টিকা দিতে নিয়ে যেতে হবে আমি কোনো অরবিন্দ-মরবিন্দের কাছে যাচ্ছি না।”
বাসন্তীর মনে পড়ে যে আজ সত্যিই নাহিবাকে টিকাদানের তারিখ। বাসন্তী ভাবুক হয়ে পড়ে।
– হ্যাঁ রে বাসন্তী, বাবুর তো আজ টিকার তারিখ। কিন্তু অরবিন্দ বাবুও তো কাল ইন্ডিয়া যাচ্ছে প্রায় সপ্তাহ খাণেকের জন্য। নায়িমের সেখানাও যাওয়ায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
“দেখেন, আপনার ডাক্তারের কাছে যাওয়াটা আজ জরুরি। কিন্তু বাবুর ডাক্তার…?”
চৈতালি মাঝ থেকেই উত্তর দিয়ে বসে,
“আমি নিয়ে যাব নে।”
“তাহলে তো হলোই, বাবুকে টিকা দিতে চৈতালি আপু নিয়ে যাবে। আপনি আমার সাথে ডাক্তারের কাছে যাবেন।”
নায়িমের চোখ-মুখ কুঁচকে যায় রাগে, বিরক্তিতে। চৈতালি তার দৃষ্টিতে একটি অপবিত্র নোংরা কীটের থেকে কম কিছু না। নিজের মেয়েকে সর্বক্ষণই নিজ কোলে রাখে চৈতালির থেকে দূরে। যাতে এই তরুণীর অপবিত্র দেহের পরশ নাহিবার গায়ে না লাগে।
আগের থেকে রাগ তার তুলনামূলক কমলেও পবিত্রতা নিয়ে অবসেশনে খাদ পড়েনি এখনো। যদিও হিংস্রও এখন খুব কমই হয় সে।
“না, দরকার নেই। আমার মেয়েকে আমিই টিকা দিতে নিয়ে যাব।”
অনিমেষ হয়তো বুঝতে পারল বন্ধুর মনোভাবটি। তাই সে আত্মস্থ করে বলল,
“আরে সমস্যা নেই, তুই যা। আমি আছি তো এখানে।”
অনিমেষের অনেক বোঝানোর পর নায়িম এই প্রস্তাবে রাজি হয়। বাসন্তী ও অনিমেষ তৈরি হয়ে উত্তরার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
___
নায়িম ও বাসন্তী এপার্টমেন্টের নিজ ফ্ল্যাটের ফ্লোরে পা রাখতেই দেখতে পায় এপার্টমেন্টটি কেমন সর্বস্বান্ত। একটু এগিয়ে যেতেই দেখে তাদের ফ্ল্যাটের দরজা খুলা। জানা ভয়ে বুক কেঁপে এই দম্পতির।
বড় বড় পা ফেলে ফ্ল্যাটে ঢুকে দুজন। এ কী অবস্থা ফ্ল্যাটের! পুরো ফ্ল্যাটে যেন টর্নেডো বয়ে গেছে, এমন ভাবে তছনছ হয়ে আছে সবকিছু। নায়িম তো নিজেকে শক্ত রেখে বাসন্তীর যেন পাগল হওয়ার দশা।
“নায়িম, আমার মেয়ে কই?” বলতে বলতেই পাগলের মতোন দুই শোয়ার ঘর সহ পুরো ফ্ল্যাটে খুঁজতে শুরু করে চৈতালি, অনিমেষ ও তাদের কলিজা নাহিবাকে।
কোথাও এই তিনজন মানুষের ছায়া অবধি নেই। যেন এক দমকা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে তিন জন জ্যান্ত মানব।
“আমার মেয়ে!” ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বাসন্তী।
ঠিক তখন নায়িমের ফোনে টুং শব্দ বেজে উঠে। একটা খবরের লিংক। ক্লিক করতেই মাথায় যেন আরেক দফা আকাশ ভেঙে পড়ে।
“গায়ক নায়িম বিবাহিত, লিক হয়েছে তার বিয়ের ছবি এবং ফুটেজ।” এই শিরনামে ভরে আছে প্রতিটি নিউস চ্যানেল।
কী করবে এবার নায়িম? এতগুলো বিপদ একসাথে কীভাবে সামলাবে সে? নায়িমের বাস্তবতা কি এবার লোক চক্ষুর সম্মুখে এসেই পড়বে?
চলবে…