টক্সিক_রিলেশনশীপ,২৬,২৭

0
1118

টক্সিক_রিলেশনশীপ,২৬,২৭
-ঈপ্সিতা শিকদার
২৬
মানুষটিকে প্রবেশ করতে দেখে চমকিত মুখে দাঁড়িয়ে যায় সকলে। এ লোকটি আর কেউ নয়, দেশের সুনামধন্য রাজনৈতিক সংগঠন সাধারণ জনতা পার্টির সাময়িক প্রধান জমশেদ আলী। তাঁকে দেখে নায়িম নিজ চেয়ার ছেড়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় তাঁর দিকে।

“আঙ্কেল কেমন আছে? আপনার কোনো অসুবিধা হয়নি তো আসতে?”

“না, না, বাজান। তুমি থাকতে আমি খারাপ থাকমু না কি?”

“আসেন, আসেন। যেয়ে বসে এই ঝামেলা আগে শেষ করি।”

উভয়ে নিজেদের জন্য নির্ধারিত আসন গ্রহণ করতেই আবারও প্রশ্নের তীর ছুড়তে শুরু করলেন সাংবাদিকগণ। জমশেদ আলী রাগচটা মানুষ, রাগে দিয়ে বসলেন এক রামধমক। অতঃপর পিনপতন নীরবতা।

নায়িম হালকা ঠোঁট ভিজিয়ে বলতে শুরু করল,

“আপনারা জমশেদ আলী আঙ্কেলকে তো চিনেনই? বনি মোস্তফা সাহেবের পর যিনি কি না বনি মোস্তফার নাতির অনুপস্থিতিতে সাধারণ জনতা পার্টি পরিচালনা করে আসছেন। তাঁর আমার সম্পর্কটা এই বনি মোস্তফা সাহেব দিয়েই। আমি হলাম বনি মোস্তফা সাহেবের একমাত্র নাতি। নায়িম ফাজ খান!”

কথাটি বলতেই কানাঘুঁষা শুরু হয়ে গেল সবার। নায়িম সেসবে ধ্যান না দিয়েই আবারও নিজ কথা শেষ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

“আপনারা আমাকে চিনেন আর.জে বা সিঙ্গার নায়িম হিসেবে। যা আমি নিজ যোগ্যতায় অর্জন করেছি। তবে জন্মগত ভাবে আমার যে অস্তিত্ব তা হলো, আমি বনি মোস্তফার একমাত্র কন্যা ও নিয়াজ খানের একমাত্র ছেলে। নিজের নিরাপত্তার জন্য এতকাল পরিচয় গোপণ করে থাকতে হয়েছে আমার। নিজের বিয়ে, স্ত্রী ও সন্তানকেও গোপণ করেছি একই উদ্দেশ্যে।

আসলে আমার নানা বনি মোস্তফার সৎ বোন বাতাসী মোস্তফার স্বামী-সন্তানের চোখ মোস্তফা বংশের সম্পত্তি ও পার্টির চেয়ারপার্সনের পদবীর দিকে। ঠিক এই জন্যই আমাকে নিজেকে ও নিজের স্ত্রী-সন্তানকে গোপণ করতে হয়েছে। কারণ চেয়ারপার্সন আমার নানাজান আমার সন্তানকে করে দিয়ে গেছেন, তার বড় হওয়া অবধি যার দায় আমার।

আর মোস্তফা বংশের সকল সহায়-সম্পত্তি আমার স্ত্রীর নামে। ফলে আমি আমার স্ত্রীকে শুধু ধর্মীয় ধারাতেই বিয়ে করেছি, আইনত নয়। যাতে তার উপর ঝুঁকি কম। কিন্তু তবুও… গতকাল আপনারা নিজেরাই হাসপাতালে যেয়ে দেখেছেন আমাদের অবস্থা। আমার দুধের বাচ্চাটাকে মেরে ফেলার জন্যই আমাদের অনুপস্থিতিতে আমার ধানমণ্ডির গোপণ ফ্ল্যাটে হামলা করে তারা।

আশা করি, এবার আপনারা সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন।”

“কিন্তু স্যার তাদের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেননি আপনারা?”

“তারা পলাতক। আপনাদের এ কারণেও ডেকেছি।” বলে কাউকে কী যেন ইশারা করে।

সাথে সাথেই নায়িম, অনিমেষ, বাসন্তী ও জমশেদ আলীর পিছনে ফেলে রাখা শুভ্র পর্দায় ভেসে উঠে সাদিক মিয়া ও শামসুর মিয়ার ছবি। সেই ছবিটির দিকে ঈঙ্গিত করেই জমশেদ আলী শুধায়,

“এই ছবির মানুষটিকে ওয়ান্টেড, ক্রিমিন্যাল হিসেবে প্রচার করুন আপনারা। এতে আমাদের সুবিধা হবে অপরাধীদের যোগ্য শাস্তি দিতে।”

এ বিষয়ে নানারকম প্রশ্ন করে সাংবাদিকেরা। নায়িম, অনিমেষ ও জমশেদ আলী ধৈর্য্য সহকারে উত্তর দেন।

তারপর ক্যামেরা ফোকাস করা হয় বাসন্তীর দিকে। রমণী প্রচণ্ড নার্ভাস, অনবরত হাত-পা কাঁপছে। অথচ, সেদিন কী বাঘিনীটাই না হয়েছিল! ঘটনাটি ভেবে সে-ই বাক্যহারা হয়ে পড়ে।

“ম্যাম, নায়িম স্যারের সাথে আপনার বিয়ে কীভাবে হয়েছিল?”

“ম্যাম, আপনাদের কি লাভ না কি এরেঞ্জ ম্যারেজ?”

“নায়িম স্যার বাংলাদেশের প্রায় মেয়েদের স্বপ্নপুরুষ, বিষয়টিকে কীভাবে নেন আপনি? আর স্বামী হিসেবে কেমনই বা লাগে তাকে আপনার?”

এমন নানা প্রশ্ন করে যাচ্ছে সাংবাদিকগণ। বাসন্তী উত্তর দিবে আর কী? বরং, লজ্জায় লাল হয়ে পড়ছে তার উজ্জ্বল শ্যামা মুখশ্রী নিকাবের আড়ালে।

“ইয়ে মানে আমি এত উত্তর… শুধু এটুকুই বলব উনি স্বামী হিসেবে কেমন তা প্রশ্ন নয়, আমি তাকে ভালোবাসি। এটাই হয়তো আমার কাছে সবচেয়ে বড়।” চোখ বন্ধ করে এটুকু বলেই স্থান ত্যাগ করে সে।

নায়িম তার যাওয়ার দিকে অদ্ভুৎ দৃষ্টিতে তাকায়। সাংবাদিকেরা তার চলে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে হতভম্ব। অনিমেষ নানা কথার দ্বারা সামলে নেয় তাদের।

___

ফাহিমের হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার দিনটি আজ। সীমা সব গুছিয়ে নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসল। সীমার হবু বর আমল সহায়তায় ফাহিম পিছনের দুই সিটে আরাম করে বসল।

তাকে ঠিকঠাক করে আমল সীমার পাশে তথা চালকের আসনে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। হুট করে সীমা শুধায়,

“চৈতালিকে এমন মিথ্যে বলে কাজটা তুমি ঠিক করোনি ফাহিম। মেয়েটাকে আরেকটা সুযোগ দেওয়াই যায়।”

ফাহিম উদাসীন হয়ে জানালার বাহিরে তাকিয়ে থাকে। বস্তুত, কিছুদিন আগেই সীমার বিয়ে ঠিক হয়েছে ব্যাংকের সিইওর একমাত্র ছেলে আমলের সাথে। আমল অফিসে এসে প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে এই নারীর। আমল সীমার একতরফা ভালোবাসা সম্পর্কেও জ্ঞাত, তবে তার মতে এটা বড় কোনো বিষয় নয়।

সীমা এঙ্গেজমেন্টের এক মুহূর্ত আগেও তাকে কল করে কেঁদেছে। ফাহিম চাইলেই পারত সঙ্গীহীন, অনির্দিষ্ট এই জীবনে সীমাকে জুড়ে দিতে। সে তা করেনি, তাকে বুঝিয়েছে রাজি হতে। কারণ এজন্য নয় যে বর্তমানেও সে চৈতালি ছাড়া কাউকে নিয়ে ভাবতে চায় না। বরং, সীমার যোগ্য তার নিজেকে মনে হয় না।

“তুই জানিস ও আমায় কতটা হার্ট করেছে? এই প্রথম নয় এসব। আমার আগের বস যে কি না প্রায় পঞ্চাশ উর্ধ্ব ছিলেন, উনার সাথে ও আমার সামনে বসে ফ্লার্ট করেছে। কারণ কী? উনার টাকা। একজন পুরুষের জন্য এটা কতটা অপমানকর বুঝিস? তাও আমি সহ্য করে নিয়েছি, বুঝিয়েছি। কিন্তু কী হত? কয়েকদিন ঠিক, তারপর আবার সুযোগসন্ধানী।

প্রতিটা মুহূর্ত আমাকে ও যেই মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে না? আমার জায়গায় অন্যকোনো ছেলে থাকলে এতদিনে আত্মহত্যার পথ বেছে নিত। আমার সন্তান…”
সম্পন্ন করতে পারে না সে। গলা ভেঙে আসছে। তবুও আজ সে বলবে। আর পারছে না মনের ফুটন্ত বিষজল মনেই আটকে রাখতে।

“বিয়ের পর থেকে আমাকে না জানিয়ে আমার প্রতিটা সন্তান পেটে আসা মাত্রই সে মেরে ফেলেছে। তারপরও আমি মেনে নিয়েছি। আমার সামনে আমার অসুস্থ মাটাকে এমন আপত্তিকর ভাষায় গালি-গালাজ করত, যে আমি তোকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। বিনিময়ে ধমক বৈকি কিছুই করিনি আমি।

কেন জানিস? পুরুষ হলেও ভালোবেসেছিলাম কিছু বাঙালি নারীর মতো আত্মসম্মান হাওয়ায় মিশিয়ে। এজন্য মানুষ আমায় বউয়ের গোলাম, মা**। আমার বোন, বোনের জামাই পর্যন্ত আমার আড়ালে এসব বলত, বলে। আমার হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে মন চাইত তখন! কিন্তু ঐ যে ছোটবেলায় আব্বা বলেছিল, পুরুষ হয়ে জন্মাইসোস, কিন্তু কাঁদলে হবি কাপুরুষ।

আমি ওর জন্য কী করি নাই? ওর কাপড়-চোপড় সুদ্ধ ধুয়ে দিসে, সকাল নয়টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ওভার টাইম করে আবার বাড়িতে যেয়ে রান্না করসি, ও বলতে পারবে না ওর এঁটো থালাটা ও আমার অসুস্থতা বাদে কোনোদিন ধুইসে। সবকিছুতে মানিয়ে নিয়ে চলছিলাম তো আমি।

কিন্তু ও কী করল? আমার এত ধৈর্য্যের ফলস্বরূপ আমাকে ছেড়ে গেল আমার স্ত্রী। নিছক টাকার জন্য দিনের পর দিন একটা পরপুরুষের সাথে থেকেছে। শুধু এটাই নয় অফিসের কাজে বনানী যাওয়ায় আমি নিজ চোখে দেখেছি ও কীসব কাপড় পরে প্রডিউসারের অফিসে ঢুকেছিল! বিশ্বাস কর ঐদিন এমন অনুভূতি হচ্ছিল যেন আমার সারা দেহে কেউ এসিড ফালিয়েছে।

যদি ও কারো থেকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসা পেয়ে চলে যেতো তাহলেও আমার অভিযোগ থাকত না। নিজেকেই দোষতাম বটে। তবে নিছক টাকার জন্য এমন পতিতা সাজা আমি মেনে নিতে পারিনি।”

ক্লান্ত হয়ে উঠে ফাহিম। তৃষ্ণা পাচ্ছে তার। চোখ উঠিয়ে দেখে সীমা তার দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লুকিং গ্লাসে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আমলের থমথমে চাহনি। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে সে। পুনরায় মুখ খুলে।

“তারপর তো এক্সিডেন্টই করলাম। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে একটা কথাই মনে হয়েছে, কারো ভালোবাসা, সঙ্গ পেতে যদি এত সব কষ্ট সহ্য করা লাগে, তাহলে কি সে সত্যিই ভালোবাসার যোগ্য! অথবা তার ভালোবাসা আসলেই আমার এত দরকার যে এতটা বেহায়া হয়েছি আমি! মন নীরবতা পালন করল। মস্তিষ্ক জবাব দিল, না। সেদিন থেকে মনে ঘৃণা নয় তিক্ততার এক শক্ত দেওয়াল গড়ে নিয়েছি আমি। এই টক্সিক রিলেশনশীপ থেকে হৃদয় মুক্তি নিয়েছে সেদিনই।”

সীমা পানির বোতলটি এগিয়ে দিল তার দিকে। পানির দিকে তাকিয়ে ভাবল,

– তার জীবনটাও পানির মতোই রঙহীন ছিল, আছে। ভার্সিটিতে পড়াকালীন বাবা মারা যায়, বড় বোন তখন পরের বাড়ির আমানত। মাকে সামলে নিয়েছে সে একা হাতে। এমন কী তার অসুস্থতাও। এই রঙহীন জীবনকে চৈতালি নামক রমণীর রঙে রাঙাতে চেয়েছিল। অথচ, মেয়েটি রঙের বদলে নিয়ে আসলো একঝাঁক নীল রঙা বিষ৷ তার চেয়ে বরং এই রঙহীন জীবনই তার ভালো, রঙহীন পানির মতোই মূল্যবান এবং আর দশটা পুরুষের মতো আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন।

___

প্রায় মাস খাণেক কেটে গিয়েছে। অনিমেষ তার বাবা-মাকে নিরাপত্তার জন্য নিজের ভারতীয় আত্মীয়দের নিকট পাঠিয়ে দিয়েছে। আজ নায়িম নিজ পরিবার ও চৈতালি, অনিমেষ সহ নিজের পিতৃভূমিতে চলে যাচ্ছে। একবারে স্থায়ীভাবে থাকার উদ্দেশ্যে, নিজের হক এবং অধিকার টুকু নেওয়ার উদ্দেশ্যে। যদি সে জানত এই পদক্ষেপই ঝড় বয়ে আনবে তাদের জীবনে।

চলবে…

#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||২৭তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
আজ আনুষ্ঠানিক ভাবে সকলের সামনে এসে পার্টির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিবে নায়িম। বাসন্তী, নাহিবা ও অনিমেষ সকলেই যাবে। সকাল সকাল তৈরি হয়ে নায়িম নিজের চাচাকে কল দেয়, যে কি না তাকে বানের জলে ভেসে যেতে দেয়নি। দূর থেকেই অনুপ্রেরণা জগিয়েছে। তিনিও নিরাপত্তার জন্য স্বপরিবার কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন।

“আসসালামু আলাইকুম চাচ্চু। কেমন আছেন? আর চাচী, বাচ্চারা?”

“আলহামদুলিল্লাহ, সবাই ভালো বাবা। আজ অবশেষে এত অপেক্ষা, পরিশ্রমের তোমার সিংহাসনে তুমি বসতে চলেছো। তবুও বাবা সাদিক যেহেতু এখনো আটক হয়নি, মানে বিপদও কাটেনি। সাবধান থেকো।”

“আমার মনে হয় না সাদিক এখানে আসার সাহস করব। আপনি চিন্তা করবেন না।”

অল্প কিছুক্ষণ ভাব বিনিময়ের পর কল কেটে দেয় নায়িম। ব্যালকনি থেকে বেরিয়ে দেখে বাসন্তী ছোট্ট নাহিবাকে তৈরি করছে। দুদিন আগেই বাসন্তী অনিমেষের সহায়তায় অনলাইন থেকে এই গাউনটি ক্রয় করেছিল, গতকাল দিয়ে গেছে। আসলেই বড্ড মোহনীয় লাগছে নাহিবাকে। যেন সত্যিকার অর্থেই কোনো রাজ্যের রাজকন্যা। আনমনেই বলে সে,

“আমার রাজ্যের রাজকন্যা।”

সবাই তৈরি হয়ে সদর দরজার সম্মুখে জড়ো হয় যাওয়ার উদ্দেশ্যে। বাড়িতে থেকে যায় শুধুই চৈতালি। ফাহিমের থেকে প্রত্যাখ্যান পাওয়ার পর থেকেই নিজেকে বেশির ভাগ সময়ই চার দেওয়ালের ঘরেই বন্ধ করে রাখে সে। তার অনুতপ্ত মন কিছুতেই ভালো বোধ করতে দেয় না তাকে।

বাসন্তী আজ ব্লাশ পিংক রঙের এমব্রয়ডারি কাজ করা বোরখা পরেছে, নাহিবার গাউনের রঙের সাথে মিল রেখে। বেজায় খুশি আজ যুবতী! অবশেষে তার স্বামীর অগ্নিময় তৃষ্ণার সমাপ্তি হবে। অনিমেষ ও নায়িম তাদের মুখেও মৃদু হাসি। এক ধ্বংসনীয় ঝড় যে একটা অপেক্ষাতে আছে তা কে জানে!

___

গ্রামীন সরু পাঁকা রাস্তা হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি আপন গন্তব্যের দিকে। রাস্তার দু’পাশে সরিষা ক্ষেত। নিরাপত্তার জন্য নায়িমের গাড়ির পিছন পিছন চলছে আরও তিনটি গাড়ি, তাতে শুধু বডিগার্ডরা যাত্রা করছে।

বকুলতলা পাড় হতেই গাড়ির টায়ার পাঞ্চার হয়ে যায়। টায়ার বদলাতে নায়িম ও অনিমেষ নেমে যায়। বডিগার্ডদের গাড়ি তিনটিও তাদের থামতে দেখে স্থির হয়ে অপেক্ষারত। হুট করেই কোথা থেকে বছর পাঁচেকের এক বাচ্চা এসে নায়িমের প্যান্ট ধরে টানাটানি বিলাপ শুরু করে।

“সাহেব, আমারে এট্টু দয়া করেন! আমার মায় মেলা অসুস্থ। এট্টু চইলা দেহেন না! ও সাহেব! সাহেব!”

ছেলেটির গা মেটো, গা থেকে ঘামের বিশ্রীরকম গন্ধ আসছে, শ্বাস থেকেও উটকো গন্ধ। নায়িমের গা ঘিনঘিন করে উঠে। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় বাচ্চাটিকে।

“যা তো ছেলে! জ্বালাইস না! এই নে এই দুই হাজার টাকা রাখ।” বলে পকেট থেকে দুটো হাজার টাকার নোট মাটিতে ফেলে।

গাড়ির ভিতর থেকে বাসন্তী এ দৃশ্য দেখে এগিয়ে আসে। এক হাতে নাহিবাকে ধরে। আরেক হাত সেই বাচ্চাটির দিকে এগিয়ে দিয়ে শুধায়,
“তোমার লাগেনি তো বাবা? উঠো! উঠো!”

ছেলেটিও তার হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়। আবারও সেই একই আবেদন করে। সাথে এও বলল রাস্তার পাশের কুঁড়েঘরটিই তাদের৷ বাসন্তী নব মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়া নারী, এই ডাক সে ফিরাতে পারে না।

“আমি যাই ওর সাথে। দেখে আসি। যদি সত্যিই কোনো দরকার হয়।” নরম কণ্ঠস্বরক তার।

“ওকে ফাইন, যাও। তবে সালামকে নিয়ে যাও। সালাম!”

ডাক দিতেই সালাম এসে হাজির। ছেলেটিকে মনোক্ষুণ্ণ দেখাল। তেজ দেখিয়ে বলল,
“না, না, আমার আম্মা পদ্দাসীল মহিলা। পরপুরুষ ঘরে ঢুকাইতে মানা আছে।”

“হ্যাঁ, নায়িম। এইখান থেকে এইখানে যাব, সালাম ভাইকে নেওয়ার কী দরকার!”

নায়িম আজ কোনো ঝামেলা চাচ্ছে না। তাই মতবিরোধ না করেই রাজি হয়ে গেল। সেটাই হয়তো এক ভুল ছিল। বাসন্তী যেই সদরদরজায় পৌঁছাল, ঠিক তখনই রাস্তার অপরপাশ থেকে এক ধরনের বোম্ব ছুঁড়ে মারল কেউ গাড়ির সম্মুখে। চারিধারে ধোঁয়া আর ধোঁয়া তারপর।

এই ধোঁয়াশাপূর্ণ পরিবেশেই কারা যেন বাসন্তীর মাথার বামপাশে কে যেন কী একটা ঠেকিয়ে ধরল। অনিমেষকেও কেউ ঝাপটে ধরল। নায়িমকেও কাবু করতে এগিয়ে এল দুজন কিন্তু উঠতি বয়স থেকেই মারামারি ও ক্যারাটে শিখায় সম্ভব হয়ে উঠল না।

ধোঁয়া কেটে যেতেই সব স্পষ্ট হয়ে উঠে। বডিগার্ডরা তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে আসে। কিন্তু ততক্ষণে পরিস্থিতি হাতের বাইরেই বলা চলে। শত্রুদের দেখা যাচ্ছে না, গামছা দিয়ে মুখ বাধা চারজনেরই।

অনিমেষ কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে,
“আপনারা কারা? আমাদের সাথে এমন করছে কেন?”

তার প্রশ্ন শুনেই একজন মানুষ শব্দ করে হাসতে হাসতে ক্ষেত থেকে উঠে আসেন। গামছা নামিয়ে ফেলেন মুখ থেকে।।

“আমি তোর বন্ধুর আদরের মামা। আবার তোর বন্ধুর মায়ের…” আবারও হেসে উঠেন সাদিক মিয়া।

রাগে কপালের রগ স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে নায়িমের। সে সবার আড়ালে কিছু একটা ইশারা করে গার্ডদের। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“তোকে ভালোভাবে বলছি ওদের ছেড়ে দে। তা নাহলে এমন ভয়ংকর শাস্তি দিব না তোর রুহ অবধি মৃত্যু ভিক্ষে চাবে।”

“উফঃ ভাগিনা! হারার পর তেজ দেখানো মানায় না বুঝল। তোমার মাও এমন তেজ দেখাতো যখন জানতে পেরেছিল আমার আরেকটা বউ আছে। শালি কোনো কামের তো ছিলই না, একটা পয়সাও বাপে দেয় নাই, আবার দেখাতো তেজ। একদম দিয়েছিলাম মেরে!”

“উনি তারই যোগ্য ছিল। সেই প্যাঁচাল এখন পেরে লাভ নেই।”

নায়িমের কথা বলার মাঝেই দুজন বডিগার্ড বাসন্তীর মাথায় গান তাক করে রাখা মানুষটিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে বাসন্তী ও নাহিবাকে গার্ডদেরর কাছে গাড়িতে দিয়ে আসে।

অনিমেষও ততক্ষণে গুন্ডাদের ল্যাং মেরে বন্দীত্ব থেকে ছাড়া পেয়েছে। অতঃপর দুপক্ষে তুমুল মারামারি শুরু হয়। বাসন্তী দূর থেকে দেখতে পায় নায়িমের দিকে কেউ ক্ষেত থেকে দাঁ নিয়ে এগিয়ে আসছে। গাড়ির ভিতর থেকেই বাসন্তী “নায়িম পিছনে…” বলে চেঁচিয়ে উঠে। কিন্তু এতসব গোলাগুলি ও চেঁচামেচির শব্দের মাঝে কথাটা যেন নায়িমের কানে পৌঁছানোর পূর্বেই হারিয়ে যায়।

বাসন্তী গার্ডদের বাধা পেড়িয়ে তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে নায়িমের নাম ধরে চেঁচাতে চেঁচাতে তার দিকে ছুটতে শুরু করে। অবশেষে নায়িম শুনতে পেয়ে সেই মানুষটির আঘাত থেকে বেঁচে যায়। কিন্তু বিপদে পড়ে বাসন্তী, তার মাথায় বন্দুক তাক করে তাকে বন্দী করেন সাদিক মিয়া।

পৈশাচিক হাসি সমেত শুধান,
“এইবার নায়িম ভাগিনা? তোমার তোতা পাখি তো আমার কাছে, এখন কী করবা?”

নায়িম ও কিছু গার্ড ধীর গতিতে বাসন্তী ও সাদিক মিয়ার দিকে এগিয়ে যেতে নেয়। আকাশে গুলি চালান সাদিক মিয়া।

“ভুলেও এগুবি না কেউ। নাহলে পরের গুলিটা উপরে নয়, তোর বউয়ের মাথায় পড়বে, তারপর একদম উপরে।”

“শুয়ো** বাচ্চা! তোরে আমি…!”

“কুল ভাগিনা, কুল। তোমার বউকে তো আমি মারছি না। তুমি শুধু এই পেপারটাতে সাইন করে দাও যে তুমি নুসরাত মোস্তফা ও নিয়াজ খানের ছেলে নও।”

নায়িমের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটে উঠে। সাদিক মিয়া অবাক হয়ে যায়। এমন প্রতিকূল পরিবেশে ছেলেটার মুখে হাসির কারণ ভেবেই পাচ্ছে না সে।

“ওলেলে! তোর মনে হয় আট বছরের সঙ্গির জন্য আমি আমার পনেরো বছরের মেহনাত বিফলে যেতে দিব? যেই বয়সে পোলাপান খেলে বেড়ায় সেই বয়সে আমি সখ-আহ্লাদ বাদ দিয়ে সবটা সময় দিয়েছি হক আদায়ে। বসন্ত মরলে খুব বেশি হলে কী হবে? নিঃসঙ্গতাই হবে। ও আমার নিঃসঙ্গতার সঙ্গি, ভালোবাসা নয়, যে ওকে বাঁচাতে নিজের এত বছরের শ্রম তোর হাতে তুলে দিব।”

বাসন্তী যেন জমে গেছে। স্তব্ধ তার গোটা দেহমন। আপন মনেই ভাবছে,
– সত্যিই কী যা শুনছে সে তা সত্য! নায়িম তাকে আজও ভালোবাসে না। স্বার্থহীন হয়ে এতটা দেওয়ার পরও সে কি ভালোবাসার যোগ্য নয়? সত্যিই নয়? সে তো ভেবেছিল নায়িমের অসুস্থতার কারণে ভালোবাসাটা অনুভব করতে পারছে না। কিন্তু না, নায়িম সত্যিই তাকে ভালোবাসে না। নাহলে সে যখন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তখন এই ক্ষমতা-সম্পত্তিকে তার চেয়ে অধিক মূল্যবান হিসেবে ব্যক্ত করত না। আজ তাকে হারাতে বসার এই পরিস্থিতিতে অনুভব করেই ফেলত সে যে ভালোবাসে।

বাসন্তী নিজ মনের সাথে যুদ্ধ করতে ব্যস্ত, সেই মুহূর্তেই গুলি চালানোর ভয়ংকর শব্দে কেঁপে উঠে পরিবেশ। চমকে উঠে পিস্তল মাথা থেকে সরিয়ে নেন সাদিক মিয়া।

বাসন্তী চোখ উঠিয়ে দেখে নায়িমের নিথর দেহ পড়ে আছে মাটিতে। ঠিক যেমন কুরবানির গরু পড়ে থাকে মাটিতে। কিছুই ভাবতে পারে না সেও, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

সাদিক মিয়া খেয়াল করেন ক্ষেত থেকে বন্দুক হাতে উঠে আসছেন তার বাবা শামসুর মিয়া। বুঝতে পারেন খুব ভুল পদক্ষেপ নিয়েছেন তার বাবা। এখন যখন মূল লোকগুলোই নির্জীব, তার লোকদের হিংস্র খেলায় মেতে উঠতে দেরি লাগবে না। পালানোর প্রয়াসও বাঁচাতে পারে না তাঁকে, বাপ-ছেলে আটক গার্ডদের হাতে। অনিমেষ কয়েকজন গার্ডের সাথে বাসন্তী ও নায়িমকে কাছের হাসপাতালে নিয়ে যায়।

নায়িমকে ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করালে সেখানকার প্রধান ডাক্তার বলেন,
“দেখেন মি.নায়িমের অবস্থা শোচনীয়। বাঁচার চান্স একদম নূন্যতম। ভালো হবে আপনি তাকে যতদ্রুত সম্ভব ঢাকা নিয়ে যান।”

অনিমেষ ডাক্তারের কথা মোতাবেকই জ্ঞানহীন বাসন্তীকে চৈতালি ও অন্যান্য দেহরক্ষীদের ভরসায় রেখে। নায়িমকে নিয়ে প্রাইভেট জেট করে ঢাকায় যায়।

___

বাসন্তীর জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে সেই বিলাসবহুল বেডরুমে আবিষ্কার করে। ধীরেধীরে সব ঘটনা মনে পড়ে তার। কিন্তু আজ সে কাঁদে না। বরং, তার চোখ-মুখ শক্ত ও গম্ভীর। হয়তো কাঁদতে কাঁদতে অশ্রুর সাগরটাও বোধহয় শুকিয়ে গেছে।

বাসন্তী বিছানা থেকে স্বাভাবিক ভাবেই গোসল করে আসে। নাহিবাকে খাওয়ায়। চৈতালি অবাক হয়ে দেখে তার এই অনাকাঙ্ক্ষিত আচারণ। একটু বাদেই অনিমেষ কল করে।

“হ্যালো ভাইয়া?”
বাসন্তীর কণ্ঠে খাণিকটাও বিচলতা, আগ্রহ, কষ্টবোধ নেই। কেমন যেন ঝড়ের পূর্বাভাস স্বরূপ পরিবেশ যেমন নিঃস্তব্ধ হয়, তেমন নিঃস্তব্ধতা।

অনিমেষ ব্যথিত গলায় জবাব দেয়

“ডাক্তার বলেছেন নায়িমের বাঁচার চান্স প্রায় নেই। আমি নায়িমকে নিয়ে সিঙ্গাপুর যাচ্ছি ভালো চিকিৎসার জন্য। আমার বিশ্বাস…”

“ভাইয়া কিছু মনে করবেন না, আমি আসলে উনার বিষয়ে কিছু জানতে চাচ্ছি না।” তাকে থামিয়ে এটুকু বলেই কল ডিসকানেক্ট করে দেয় সে।

মানুষের সহনশীলতা, স্বার্থহীনতা, উদারতা, মায়া-মমতা প্রভৃতি সবকিছুরই একটা সীমা আছে। কারণ সে সৃষ্টি। বাসন্তীর সেই সহ্য, ভালোবাসার সীমাটাও পাড় হয়ে গেছে। তবে কি নায়িমের ধ্বংসতেই নব্য বাসন্তীর জন্ম হবে?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here