টক্সিক_রিলেশনশীপ,২৮,২৯
-ঈপ্সিতা শিকদার
২৮
ভোরের আলো ফুটতে কিছু মুহূর্ত বাকি। হাসনাহেনার মিষ্টি সুভাষে মেতে উঠেছে। বাসন্তী নিদ্রাহীন রাত্রি যাপন করেছে। শুধু ভেবেই গেছে সারাটি রাত। পুরো ছয়টা ঘণ্টা এই বারান্দার অন্ধকারময় পরিবেশে কাটিয়েছে সে। তাকে না স্পর্শ করেছে কোনো ভীতি, না নিদ্রা। গা ছমছমে অনুভূতিও হয়নি আজ তার। মেয়েটাও বেশ বুঝদার হয়েছে, সারাটা রাত্রি একটুও কাঁদেনি।
ভোরের আলো ফুটতেই কী যেন হলো রমণীর কে জানে? যন্ত্রচালিত মানবের ন্যায় নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ঘরে চলে গেল সে। বহুদিন পর তার পুরাতন ডায়েরিটা বের করল। অনেক বছর ধরেই এই ডায়েরি ছোঁয়া হয় না তার, অযত্নে পড়ে থাকে একসময়কার প্রিয় বস্তুটি৷
সাধারণভাবেই ধুলো জমেছে ডায়েরিটিতে। বাসন্তী হাতে নিয়েই শাড়ির আঁচলে মুছে নেয়। কলম হাতে নিয়ে লিখতে বসে। আগে রোজ লিখত বিয়ের পর আর ধরা হয়নি, অলক্ষ্যেই এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
—
অপ্রিয় প্রিয়তম,
নামটা অদ্ভুৎ না গায়ক সাহেব? কী করব বলো? তুমি আমার প্রিয়তম তা সত্য, তবে আজ জীবনের এ পর্যায়ে অপ্রিয় মানুষও বড়ো তুমি।
মনে আছে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম তোমায়। লম্বাটে গম্ভীর মুখের এক পুরুষ, যার সুগভীর নীলচে আঁখিজোড়ায় চোখ রাখার সাহস আমার ছিল না।
তুমি যখন ডেকেছিলে, আমি তিরতির করে কাঁপছিলাম ভয়ে। বড্ড ভীতু, সাহসহীন, হীনমন্যতায় জর্জরিত কিশোরী ছিলাম যে আমি। ভাবলাম কী না কী ভুল করে ফেললাম আমি, যার জন্য শাস্তি দিতে ডাকছে আমায় অজানা এক যুবক। তোমার কণ্ঠটাও ছিল তেমন রাগী, রসকষহীন, গম্ভীর।
ভীতিগ্রস্ত, কম্পিত দেহ নিয়েই তোমার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। তুমি জিজ্ঞেস করলে, আমাকে তুমি চিনো? আমি হলাম কি না অভাগিনী আশ্রিতা। এসব রেডিও-টেডিও শোনার ক্ষমতা কই আমার?
এতক্ষণ তো শুধু কম্পন সৃষ্টি করেছিলে তুমি, আর তোমার নিকট যেতেই বাকশক্তিও বন্ধ হয়ে গেল। কারণ তোমার এই প্রশ্ন করার মাঝে কিছু একটা ছিল, যা আমাকে ছুঁয়ে ছিল। অতঃপর ইশারাতেই বুঝালাম চিনি না।
তুমি অদ্ভুৎ দৃষ্টি তাকালে কয়েক মুহূর্ত। তারপর পা থেকে মাথার চুল অবধি একদফা আমাকে পর্যবেক্ষণ করলে। তুমি হয়তো জানো না, সেদিন স্পর্শ ছাড়াই তুমি ছুঁয়ে ছিলে আমায়। জানো অতটা গভীর ভাবে কেউ স্পর্শ দিয়েও যে ছুঁতে পারে তা-ই আমি জানতাম না। অথচ, তুমি শুধু দৃষ্টিতেই সেভাবে ছুঁয়েছিলে আমায়। আমার দেহের প্রতিটি লোম লোম সেদিন পুলকিত হয়েছিল। নিজ হৃদয়ের ধকধকানি নিজ কানে শুনেছিলাম। সারাটা রাত নিদ্রাবিহীন কাটালাম, শুধু এপিঠ-ওপিঠ করেই রাত এগারোটা থেকে ভোর পাঁচটা অবধি পাড় করেছিলাম।
এর দুদিন পর স্কুল থেকে বাড়ি ফিরার জনমানবহীন পথে আবার তোমার দেখা। আমি লজ্জায় মাথা নুয়ে চলে যেতে নিলাম। তুমি হাত ধরে আটকালে। আমি হাত ছাড়াতে ছাড়াতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বললাম,
“কী করছেন? ছাড়েন প্লিজ। কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।”
তুমি তো ছাড়লেই না, বরং বক্ষে মিশিয়ে নিলে আমায়। আবেগ-অনুভূতির সুখময় যন্ত্রণায় নিপীড়িত হলাম আমি। তুমি বাঁকা হেসে বললে,
“পুড়তে না জানলে কেন এই যুবককে পোড়ালি কেন পিরিতের আগুনে কিশোরী? এই যৌবনা হৃদয়ের দহনে যে এবার তোকেও পুড়তে হবে গভীর ভাবে।”
তোমার কথায় আমার হৃদয়ে আবেগ হতে সঞ্চার হয়েছিল প্রেমের। সেদিন প্রথম তোমার প্রেমে পড়েছিল। প্রথম উদ্যোগেই আমি আবদ্ধ হয়েছিলাম বলে খুব সস্তা লেগেছিল না তোমার এই বাসন্তীকে? বিশ্বাস করে সস্তা ছিলাম না মোটেও।
কৈশোরে ছিলাম, দিন-দুনিয়ার জ্ঞানহীন ছিলাম, নিঃসঙ্গ ছিলাম, একটু ভালোবাসার জন্য তৃষ্ণার্ত ছিলাম। জীবনে প্রথম এই সবকিছুর বাহিরে যেয়ে আমার প্রিয়জনের অভাব পূরণ হয়েছিল। কেউ আমার সাথে একটু মিষ্টি কথা বলেছিল। কিশোরী মন তখন আবেগাপ্লুত হয়েছিল এতটাই যে ঠিক-ভুল জ্ঞানটাই ভুলে গিয়েছিলাম।
তুমি সেদিন শুধু দামী মোবাইলটাই আমার হাতে গুঁজে দিয়ে যাওনি। আমার হৃদয়ে বুনে দিয়ে গিয়েছিল রঙিন প্রজাপতির ন্যায় রঙ্গিলা স্বপ্ন অজ্ঞাত ভাবেই। এরপর থেকে শুরু হয় আমি তন্দ্রাহীন রাতগুলোর গল্প, তোমার ভালোবাসায় ধীরেধীরে নিমোজ্জিত হওয়ার গল্প, প্রতিটা দিন ধরা পড়ার ভয় নিয়ে তোমার সাথে জুড়ার গল্প।
কী যে বেদনাময় কষ্টকর সুন্দর দিন ছিল তখন! কারণ তুমি অনিন্দনীয় সঙ্গীত শিল্পী হওয়ার সাথে বেশ ভালো অভিনেতাও। একটা বারও বুঝতে দাওনি তুমি আমায় ভালোবাসো না। তুমি ভালোবাসো আমায়, এ ধারণা নিছকই এক ভ্রান্তি আমার। অথচ, আমি এই ভালোবাসা প্রাপ্তির আশায়, ভরসায় নিজ বাড়ি ছেড়েছি। কত কী না সহ্য করেছি!
মনে আছে তুমি একবার এক মেয়ের সাথে বাহিরে যেয়ে ফুচকা খাওয়ায় খুব বকেছিলে আমায়। বাজে ভাষায় বাপ-মা তুলে গালাগাল করতেও পিছপা হওনি। আমি কাঁদতে কাঁদতে চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলেছিলাম, অভিমানে কথাও বলিনি প্রায় তিনদিন। চতুর্থ দিনই পুনরায় এক অনাকাঙ্ক্ষিত সাক্ষাৎ তোমার, সেই প্রথমদিনের জায়গাটিতে।
আমার হাতজোড়া ধরে বিনতী গলায় বললে, “জানিস তো, প্রেম হলো দিয়া আর বাতির মতোন, বাতি জ্বললে দিয়াকে পুড়তেই হয়।”
আমি তোমার সেই কথা আট বছর পালন করেছি। তোমার সব অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করেছি। বিনিময়ে শুধুই আশা করেছি তোমার ভালোবাসা। কতবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি, নিজের মাতৃত্বকে গলা টিপে মেরেছি শুধুই ভালোবাসার জন্য। বিনিময়ে কী পেলাম? ভালোবাসা নামক অভিনয়।
ভালো! বেশ ভালো! জীবনে এবার প্রথম স্বার্থপর হওয়ার মতো শক্ত আবরণে আবৃত হচ্ছে হৃদয়। আমি স্বার্থপর হব! তুমিহীনা ভালো থাকব, সুখে থাকব! ভালোবাসার সাগর যে আজ তিক্ততার বিষে বিষাক্ত।
ইতি,
তোমার বিষক্রিয়ায় মৃত
বসন্ত।
____
এক বছর পর, বাসন্তী গাড়ি থেকে নামছে। উদ্দেশ্য পার্টির অফিসে ঢুকা। তার কোলে ছোট্ট নাহিবা। সে অফিসে ঢুকতেই সবাই সালাম দেয়। বাসন্তী অসৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে আসন গ্রহণ করে।
হুট করেই পার্টিতে ঢোকা নতুন এক লোক টিপ্পনী দিয়ে উঠেন,
“আজকাল পার্টির অফিস বাচ্চাদের প্লেগ্রাউন্ড হয়ে উঠেছে। এমন না করে বাসায় বসে বাচ্চা পাললেই তো পারে! এসন সিট-টিট সামলানো মেয়েদের কাজ না কি…”
বাসন্তী বাঁকা হাসে। চোখে চোখ রেখে বলে,
“স্বাভাবিকভাবে একজন মানুষ ৪৫ ইউনিট ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু মায়ের জাত নারী জাতিকে আল্লাহ এর অনেক বেশি ইউনিট ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা দিয়েছে। তাহলে সামান্য গদি কী জিনিস? আর আপনার যদি এতই সমস্যা হয় একজন নারীকে ক্ষমতায় দেখে, তবে আপনাকে পার্টি থেকে বের করে দিতে পারি।”
বাসন্তীর কথায় ঘাবড়ে যায় ব্যক্তিটি। শুকনো ঢোক গিলে সে। কিছু বলবে তার পূর্বেই বাসন্তী…
চলবে…
#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||২৯তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
কিছু বলবে তার পূর্বেই বাসন্তী মুচকি হেসে অন্যান্য সদস্যদের সাথে দরকারী কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। চৈতালি গর্ব ও তৃপ্তির হাসি দেয় বাসন্তীর এমন আচারণে।
মনে মনে বলে,
“আমার প্রচেষ্টা তুমি সফল করেছো আল্লাহ। এভাবেই মেয়েটাকে শক্ত করে রেখো, নাহলে যে খান ও মোস্তফা বংশের ঐতিহ্য, সম্মান, ক্ষমতা ধুলোয় মিশে যাবে।”
লোকটি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে বাসন্তীকে। এ যেন ভিন্ন এক নারী। হ্যাঁ, এই পুরুষটির খুব করে চেনা বাসন্তীকে। কারণ উনি হলেন বাসন্তীর বড় মামা মীর উদ্দীন।
মিটিং শেষে বাসন্তী নিজের নির্ধারিত আসন থেকে উঠে পড়ে। তাকে সম্মান জানাতে উঠে পড়ে সকল সদস্য। কিন্তু অতীতের দাম্ভিকতায় এ কাজ করতে পারেন না মীর উদ্দীন। দুই টাকার চাষার মেয়ের সম্মানে তিনি দাঁড়াবেন ভাবতেই রাগ পাচ্ছে তাঁর।
বাসন্তী বিষয়টা খেয়াল করতেই মুখশ্রী গম্ভীর করে।ফেলে। অগ্নিময় চাহনি রমণীর, যেন সব ধ্বংস করে দিতে তৎপর।
“চৈতি বুবু, জনাব মীর উদ্দীন সাহেবকে পার্টি থেকে বের করার ব্যবস্থা করুন। উনি আমার সম্রাজ্যে বসে আমার সাথেই বিদ্রোহ দেখাচ্ছেন। আমি মোস্তফা এবং খান বাড়ির পুত্রবধূ, নিজ আঙিনায় সাপ পালার মতোন ভুল আমি করব না।” বলেই কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে যায়।
চৈতালিও কারো কানে কানে কিছু একটা বলে নাহিবাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে কক্ষ হতে। তার আগেই দুটো বাক্যই উচ্চারণ করে সে।
“নায়িম ফাজ খান অনুপস্থিত বলে কেউ মাথায় চড়ে বসতে যাবেন না। মনে রাখবেন জনাবা বাসন্তী নায়িমের মতো বিষাক্ত মানুষ তো সামলেছেই, তার বিষাক্ত রক্তের অংশও পেটে ধরেছে।”
মীর উদ্দীনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েন। রাজনীতিতে নামার জন্য তাঁর সহায়-সম্পত্তি সব বিকিয়ে বসেছেন। এমতাবস্থায় পার্টির টিকেট ক্যান্সেল হলে তার পথে বসতে হবে। ভাবছেন,
– যেকোনো ভাবে তাঁর বাসন্তীকে মানাতে হবে, বাসন্তীর সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে। নাহলে তার থাকার মতোও ঠাঁই থাকবে না।
তিনি ভেবেছিলেন বাসন্তী যেমন সরলমনা মেয়ে, রাজনীতিতে নামার সাথে সাথে তাকে ভীতিগ্রস্ত করেই সকল ক্ষমতা ও সম্পত্তি আত্মসাৎ করে নিবেন। কিন্তু তিনি তো জানেন না নম্র বাসন্তী বিষক্রিয়ায় মিটে গেছে, এখন যা আছে তা হলো এক তিক্ততার শক্ত বেড়াজালে আবদ্ধ নারী।
___
চৈতালি অফিস থেকে বেরিয়ে দেখে বাসন্তী আগে থেকেই গাড়িতে বসে। চৈতালি কোনো কথা না বলেই নাহিবাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে।
“মীর লোকটা তোমাকে আগে থেকে চিনে হলো। সত্যিই কী তাই?”
“সম্পর্কে আমার মামা হয়। সহজসরল বাসন্তীকে চিনে, তাই এই জটিল বাসন্তীকে বুঝতে ভুল করে ফেলেছে।” খাপছাড়া ভাবে জবাব দেয় বাসন্তী।
আর কোনো কথোপকথন হয় না গাড়িতে। গাড়ি সোজা পৌঁছায় নায়িমের গোপণ আড্ডাখানায়। যেখানে নায়িম সকল সরকারী থেকে বেআইনী ব্যবসায়ী সহ গুণ্ডাদের নিয়ে আসর বসাতো।
বাসন্তী প্রবেশ করতেই সবাই উঠে দাঁড়িয়ে এক সুরে বলে উঠে,
“আসসালামু আলাইকুম ছোটো সাহেবা।”
বাসন্তী ইশারায় সবাইকে বসতে বলে সেও নিজের জন্য নির্ধারিত চেয়ারে বসে পড়ে। থানার সাব-ইন্সপেক্টর হাসি হাসি মুখ করে প্রশ্ন করে,
“কেমন আছেন ছোটো সাহেবা? আর ছোটো খান সাহেব কবে আসবেন?”
“আমি কেমন আছি বা উনি কখন আসবেন সেটা ব্যাপার না। ব্যাপার হলো আপনি না শুধরালে আপনি ভালো থাকবেন না।”
শীতল পরিবেশেও ঘাম ঝরে যায় সাব-ইন্সপেক্টরের। অন্যরাও কাঁপছে ভয়ে। কারণ সবাই জ্ঞাত যে এই কালো বোরখায় নিজের মুখশ্রী ব্যতীত আপাদমস্তক ঢেলে রাখা নারীটিও নিজের স্বামীর মতোন কাউকে এক চুল ছাড় দিবে না।
“আমি কী কোনো ভুল করেছি ছোটো সাহেবা?” কম্পিত কণ্ঠ তার।
“আপনি যে ঘুষ খান, নির্ধারিত সুবিধার বাইরেও বাপের সম্পত্তির মতোন সরকারী সুবিধা ভোগ করেন, তা সবার জানা। তাতে কখনো বাঁধা পড়েছে উপরমহল থেকে? না, কারণ আপনি আমাদের লোক। কিন্তু আপনি কী করেছেন? ছোটো ছোটো ট্রাফিক ভুলে রাস্তাঘাট থেকে মানুষের একটু একটু করে টাকা জমিয়ে কেনা গাড়ি, বাইক, স্কুটি বেআইনী ভাবে দখল করছেন।”
সাব-ইন্সপেক্টরের ফো অজ্ঞান হওয়ার দশা। সে এই অবৈধ কাজটি অত্যন্ত গোপনীয়তার সহিত করতেন। তবে বাসন্তীর কানে গেল কীভাবে? কেনোনা, তার ধারণা ছিল মেয়ে মানুষ এতটা গভীর খোঁজখবর নিতে পারবে না।
“হয়েছে কী ম্যাডাম, আমি তো…”
“আমি কী হয়েছে না হয়েছে জানতে চাই না। এ পর্যন্ত যতগুলো যানবাহন নিজের অধীনে নিয়েছেন তা স্ব স্ব মালিকের কাছে হস্তান্তর করবেন। আর তার রিপোর্টও আমাকে দেওয়ার দায়িত্ব আপনার।”
“জ-জী ম্যাডাম। আপনি যা বলেন।”
এবার বাসন্তী তার তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এসপি নেওয়াজের দিকে। এসপি নেওয়াজ তা দেখে জোরপূর্বক হাসি দেয়।
“আর আপনি এসপি মশাই, আপনার ধ্যান কই থাকে? আপনার থানার অফিসার এমন কাজ করছে, আর আপনি অজ্ঞাত থাকছেন। এমন চললে হবে না। তবে আপনাকে আপনার স্টাফ সুদ্ধ ট্রান্সফার করা লাগবে।
রাজনীতিতে জনতার মন রাখা এবং তাদের সমর্থন অনেক জরুরি। তাদের একবার বোধ করাতে পারলেই হলো আমরা অন্য দলের চেয়ে ভালো আর উপর দিয়ে ফিটফাট দেখাতে পারলেই হলো, তারপর ভিতরে সদরঘাট না কি তার খোঁজ নাইন্টি পার্সেন্টই নেয় না।
আমি এখানে ফ্রীর বেতন দিতে বসায় রাখি নাই আপনাদের পদে পদে। কাজ আমার মতো চলতে দিতে হবে, নাহলে ছুঁড়ে ফেলতে দেরি লাগবে না আমার।” বাসন্তীর গলা একদম নিচু, তবুও ক্রোশে টইটুম্বুর এবং গাম্ভীর্যপূর্ণ।
আরও কিছুক্ষণ সবার সাথে নানা বিষয়ে আলোচনা করে বাসন্তী। তারপর সেখান থেকে বের হয়ে যায়। সে বের হতেই স্বস্তির শ্বাস ফেলে সকলে। কিন্তু এর পরপরই বাসন্তীর দুজন লোক ঘরে ঢুকে সাদ্দাত নামক ছেলেটিকে তুলে নিয়ে যায়। সবাই আবার চিন্তিত হয়ে উঠে।
সাদ্দাতকে বডিগার্ডরা নিজেদের সাথে নিয়ে যাওয়ার আগে বাসন্তী তার সামনে এসে। দাড়িময় গালটা চেপে ধরে শুধায়,
“আমার কচি খোকা রে, তোর কি মনে হয়েছিল নায়িম ফাজ খানের বিরুদ্ধে সাদিকের সাথে ষড়যন্ত্রে মিলিত হয়ে তুই বেঁচে যাবি? খান বংশের সাথে বেইমানি করলে একটু দেরি হতে পারে বন্দী করতে, তবে বন্দী তো হবেই।”
অতঃপর বাসন্তী চৈতালির কোল থেকে মেয়েকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। গন্তব্য খান নিবাস।
___
বাসায় পৌঁছে কোনো দিকে না তাকিয়েই বাসন্তী নাহিবাকে নিয়ে সোজা বেডরুমে চলে যায়। চৈতালি অপলক দৃষ্টিতে এই পর্বতের ন্যায় দৃঢ় বাসন্তীকে।
হ্যাঁ, এই একটা বছরে বাসন্তীর আচারণ ও ব্যবহারে অনেকটা পরিবর্তন এনেছে। তাকে বদলাতে বাধ্য করেছে তাকে পরিস্থিতি, সময়, রাজনীতির মারপ্যাঁচ ও মমত্ববোধ।
নায়িমকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তাররা জানায় তার দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার প্রয়োজন পুরোপুরি সুস্থ ও বিপদমুক্ত হতে। নায়িমের চিকিৎসার জন্য তার পাশে অনিমেষের থাকার প্রয়োজন।
বিপদ বাড়ে তখন যখন হঠাৎই হার্ট এ্যাটাক করে মারা যান নায়িমের নানার বিশ্বস্ত লোক জমশেদ আলী। বাসন্তী ও নাহিবার বানের জলে ভেসে যাওয়ার পরিস্থিতি। এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয় যে কাউকে অবশ্যউ আসন ও ক্ষমতা আনুষ্ঠানিক ভাবে নিতেই হবে, নাহলে সব খান ও মোস্তফা বংশের নাম মিটে যাবে সাধারণ জনতা পার্টির ইতিহাস থেকে। কারণ রাজনীতির এই মহলে কেউ আপন নয়। নায়িম না থাকায় এবং কেউ তথা বাসন্তীও দায়িত্ব নিতে এগিয়ে না আসায় সকলের শকুনের নজর আসনের দিকে, সম্পত্তির দিকে।
অনিমেষ তাই বাসন্তীকে উপদেশ দেয় সবকিছু নিজের অধীনে নিতে। কিন্তু বাসন্তীর ন্যায় স্বল্প শিক্ষিত এবং দিন-দুনিয়ার জ্ঞানশূণ্য নারী কী করে এত বড় দায়িত্ব পালন করবে?
প্রতিকূল এই সময়ে বাসন্তী ও নাহিবার ঢাল হয়ে দাঁড়ায় চৈতালি। বাসন্তীর মনোবল ও আত্মবিশ্বাস বাড়ায় সে, তাকে শক্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা জাগায়, প্রতিটি কদমে কদমে শুভকাঙ্ক্ষী হয়ে সঠিক পরামর্শ দেয় সে। চৈতালির কুবুদ্ধিপূর্ণ মস্তিস্ক রাজনীতির প্রতিটি ধাপে কূটনৈতিক কৌশল হয়ে কাজে দিচ্ছিল বাসন্তীর জন্য। এর মাঝে যতবার বাসন্তী নার্ভাস হয়ে যেত কিংবা দুর্বল হয়ে পড়ত ততবার চৈতালি তাকে মনে করিয়ে দিত।
“তুমি মা, তোমার সন্তানের ঢাল। তুমি দুর্বল মানেই তোমার সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের মৃত্যু, জীবনের ধ্বংস। মনে রাখবেসবাই তোমাদের মা-মেয়ের জীবনের পিছনে হাত ধুয়ে পড়ে আছে।”
___
বাসন্তী ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দেখে অনিমেষের কল। তার বুকটা আপন মনে ধকধক সুর তুলে। হৃদয়ে অদ্ভুৎ ভাবে কাতরাতরার সাথে অতি বিতৃষ্ণা ও তিক্ততারও সঞ্চার হয়। কম্পিত হাতে কল রিসিভ করে সে।
“হ্যালো ভাবী? কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। আপনি?”
“বলছিলাম কী নায়িম…”
“ভাইয়া, প্রতিদিন একই কথা বলি, তবুও আপনি প্রতিদিন… ঠিক আছে, আবারও বলছি। আমি উনার বিষয়ে কিছুই শুনতে চাই না, জানতে চাই না। যার জন্য নিজেকে নিঃশেষ করেও তবুও তার মন পাইনি। তার জন্য মনে থাকা ভালোবাসার রঙিন প্রজাপতিগুলো মৃত। এখন তো শুধু একঝাঁক বোলতার ন্যায় বিষাক্ত তিক্ততাই আছে, যা ক্ষণে ক্ষণে ব্যথাতুর করে আমায়।”
কল ডিসকানেক্ট করে দেয় বাসন্তী। ঝরঝর করে কেঁদে দেয় সে। শুরু হয় নোনাজলের বর্ষণ। আনমনেই বিড়বিড়ায়,
“না, বাসন্তী বদলায়নি। সে আজও ভালোবাসার কাতর, ইমোশনাল, ভীতু, নার্ভাস সেই মেয়েটি। শুধু নিজের ইমোশন, অনুভূতি, আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে শিখেছে। নিজের দুর্বলতা, ভীতি লুকাতে শিখেছে দৃঢ়তা, রাগ, গাম্ভীর্য ও ক্ষমতাবলের দ্বারা।”
___
কল স্পিকারে রেখে বাসন্তীর অনিমেষকে বলা প্রতিটা কথা শুনছিল নায়িম। অবাককর হলেও সত্য, সে একটুও রাগেনি। বরং, তার চোখেমুখে খামখেয়ালি ভাব। অনিমেষ কোনো সময়ই বুঝতে পারে না এই পুরুষটিকে, আজও না।
“তোর রাগ লাগছে না? যেই মেয়েটাকে জোর করে হলেও নিজের অধীনে, কাছে রাখতে চাইতি আজ তাকে দূরে দেখেও এমন প্রতিক্রিয়াবিহীন তুই। চাইলেই তো পারিস নিজে ভাবীর কাছে যেতে বা ভাবীকে এখানে আনতে। পরিস্থিতি তোর পক্ষেই। তবে কারণটা কী?”
“জানিস কাল এই বেডে শুয়ে শুয়েই ইরফান খান আর ঐশ্বর্য রায়ের একটা মুভি দেখেছি। সেখানে ক্ষমতাধারী ইরফান খান ঐশ্বর্য রায়কে যেতে দিলে তার সাথের ছেলেটি জিজ্ঞেস করে কেন যেতে দিল তাকে? কারণ সে তো ঐশ্বর্যকে চায়। তখন ইরফান বলেছিল ভালোবাসা ও এজন্যই যেতে দিয়েছি, জেদ হলে তো বুকে থাকতো।”
থামল সে, গাম্ভীর্যপূর্ণ মুখশ্রী তার। ঠোঁটের কোণে অন্যরকম এক প্রশান্তিকর হাসির ফুটে উঠল। ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে তার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
“বসন্তকে বেধে রেখেছিলাম, কারণ সেসময় সে আমার হৃদয়ের জেদ আর নেশা অবধিই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে এখন সে আমার ভালোবাসা, আর ভালোবাসাকে কঠোরতা নয় নমনীয়তার সাথে রাখতে হয়। নাহলে যে ভালোবাসা ম্লান হয়ে যায়।”
চলবে…