টক্সিক_রিলেশনশীপ,৩০,৩১
– ঈপ্সিতা শিকদার
৩০
নায়িমের কথা শুনে বিস্ময় নিয়ে তাকায় অনিমেষ তার দিকে। নায়িম ফাজ খান বলছে সে বাসন্তীকে ভালোবাসে। অবিশ্বাস্যকর!
“এই তুমি সত্যি বলেছিস তো যে তুই ভাবীকে ভালোবাসিস? না কি আমি ভুল শুনলাম?” আঙুল দিয়ে কান পরিষ্কার করার ভঙ্গিমায় প্রশ্ন করল সে।
“অনি মজা নিবি না তো। যা এইখান থেকে।” বলেই বালিশ ছুঁড়ে মারে অনিমেষের মুখের উপর।
তাতে অনিমেষের আর কী ক্ষতি হওয়ার? সে বরং নায়িমের হৃদয় পুড়িয়ে আরও নাটকীয়তার সহিত শব্দ করে হাসে।
নায়িম রক্তচক্ষু নিয়ে তার দিকে তাকায়। তা খেয়াল করেও না করার ভঙ্গিমায় হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায় সে।
নায়িম ফোঁস করে এক শ্বাস ফেলে। সাদাটে বিছানায় আধশোয়া হয়েই জানালার বাহিরে দৃষ্টি স্থির করে সে। উজ্জ্বল রৌদ্র বাহিরে, গাছগুলো শীতের আগমনে পাতার খোলস ছাড়িয়েছে। হাড্ডিসার অবস্থা আর কী!
নায়িমের খুব করে ইচ্ছে করছে একটু বাহিরে যেয়ে হাঁটতে। ঐ যে জনমানবহীন স্থানে বেঞ্চিটি দেখা যাচ্ছে, সেখানে বসে প্রকৃতি উপভোগ করতে। কিন্তু সে অপারগ। অন্যের উপর নির্ভরশীল। এই বিষয়টাই খুব করে পোড়ায় যুবককে।
ছোট থেকেই আত্মনির্ভরশীল থেকেছে, তার আজ যা আছে সবই তার আপন কর্মের ফলস্বরূপ। এমন কী তার নিজের জন্মগত ভাবছে পাওয়া ক্ষমতা এবং সম্পত্তিও সে এমনি এমনি পায়নি। অর্জন করে নিতে হয়েছে। জীবনের কোনো পর্যায়ে তার মনে হয়নি কাউকে তার প্রয়োজন। অথচ, এখন প্রায় সবকিছুতেই কারো না কারো উপর নির্ভরশীল সে।
নায়িমের ভাবনা চিন্তার মাঝেই দরজা খুলে প্রবেশ করেন নায়িমের চাচা। দুই মাস হবে নায়িমের চাচা তাকে সিঙ্গাপুর থেকে কানাডাতে নিয়ে এসেছেন। কারণ সিঙ্গাপুরের যান্ত্রিক পরিবেশে নায়িমকে আরও যেন মানসিক ভাবে অসুস্থ করে তুলছিল। এখানে শুধুমাত্র তার শারীরিক নয়, মানসিক চিকিৎসাও চলছে। নায়িমের চাচাতো ভাই নিজেই একজন মনোবিশেষজ্ঞ।
“এখন কেমন লাগছে নায়িম? সবকিছু ভালোভাবে চলছে তো?”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো চাচ্চু। আমিই তো ঠিকঠাক চলি না, অচল মানুষ, সবকিছু আর কী!”
নিজের প্রতিই যেন তাচ্ছিল্য করল নায়িম। নায়িমের চাচা বুঝতে পারলেও ব্যাপারটা নিয়ে ঘাটলেন। বরং, আশ্বস্ত করলেন,
“ডাক্তার বললেন আগামী দুই মাসের মধ্যেই তুমি পুরোপুরি বিপদমুক্ত হয়ে যাবে। তার এক মাস আমার বাড়িতে বেডরেস্টে কাটিয়ে তুমি যেকোনো মুহূর্ত ঢাকা যেতে পারব।”
কথা শেষ করে নায়িমের দিকে তাকালেন। যুবকের মাঝে খাপছাড়া ভাব। আবারও মুখ খুললেন তিনি,
“যাকগে সেসব। কিছু বাংলাদেশী সাংবাদিক এসেছে তোমার ইন্টারভিউ দিতে। তুমি কি দিতে ইচ্ছুক?”
“ডাকান তাদের। একটা সরাসরি ইন্টারভিউয়ের প্রয়োজন আছে। অনেক চ্যানেল ও পত্রিকাই বাসন্তীর উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে।”
নায়িমের চাচা সাংবাদিকদের কেবিনে নিয়ে আসে। খুব বেশি মানুষ নয়, এক জন রিপোর্টার ও দুই জন ক্যামেরাম্যান। নায়িমের মুখখানা অসুস্থতায় ফ্যাকাসে হয়েছে ঠিকই, তবে আগের চেয়েও অধিক পরিপক্বতা এসেছে তার মাঝে। যা তাকে আরও সুদর্শন করে তুলেছে। মুখোভঙ্গিমায় সবসময়কার ন্যায়ই গম্ভীর, আর ঠোঁটের কোণে বাঁকা সেই হাসি।
“স্যার, সবার আগে আপনার থেকে জানতে চাই কেমন আছেন আপনি?”
“আলহামদুলিল্লাহ, এখন মোটামোটি ভালো। অসুস্থতা থেকে অনেকটাই রিকোভার করেছি।”
“স্যার, আমরা শুনতে পাচ্ছি বাসন্তী ম্যাম না কি ইচ্ছে করে আপনাকে এখানে ফেলে রেখেছেন? যাতে উনি নিজে সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে পারেন।”
শব্দ করে হেসে দেয় নায়িম। কটাক্ষ করে বলে,
“যাদের থেকে এসব শুনছেন তাদের বলে দেন, আমার স্ত্রী আমার সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী, তাদের মতোন ছোটোলোক বা ফকিন্নি না। পুরো মোস্তফা এম্পায়ার তার নামে।”
আরও নানারকমের কথোপকথনের পর ইন্টারভিউ সমাপ্ত হয়।
___
রাত প্রায় দশটা, নাহিবা মেঝেতে বসে খেলছে, মুখ ব জাতীয় আওয়াজ করছে। আর বাসন্তী রুমের এক কোণে পড়ে থাকা রকিং চেয়ারা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিণীতা উপন্যাস পড়ছে। চোখজোড়ায় এঁটে আছে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। পরিণীতা ও সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন বইটি তাকে উপহার দিয়েছে চৈতালি। বলেছে,
“দুর্বল বোধ করলে এই বই দুটি পড়বে। শক্তি পাবে আবার অংশগ্রহণের যুদ্ধে।”
এমন সময় দরজায় নক করে কেউ। বাসন্তী বইয়ের দিকে দৃষ্টি স্থির করেই বলে, “কাম ইন।”
চৈতালি নিজের মোবাইলটা দু’হাতে শ্যুট করার মতোই ধরে ঘরে প্রবেশ করে। তার মুখশ্রীতে চাপা হাসি। বাসন্তী আড়চোখে তাকায় সেদিকে। মনে মনে বলে,
“নিশ্চিত নায়িমের কল।”
হলোও তাই চৈতালি এগিয়ে এসে বসল মেঝেতে নাহিবার সাথে। বাবাকে দেখাল তার রাজকন্যাকে। এই এক বছরে আজ প্রথম বিনয়ী কণ্ঠে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
“প্রিন্সেস, আমার প্রাণপাখি কেমন আছো? বাবাকে মিস করেছো?”
নাহিবা কী বুঝল কে জানে? সকলের বোধগম্যতার বাইরে যেয়ে কত রকম যে শব্দ উচ্চারণ করল সে!
নায়িমের কণ্ঠস্বর বাসন্তীর কানে পৌঁছাতেউ বুক কেঁপে উঠল তার। কিন্তু তার ভালোবাসা যে তিক্ততার বেড়াজালে বন্দী। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সেদিকে চোখ রাখল না।
তবুও তার অবচেতন প্রণয়িনী মন বারবার যেন সেদিকেই ধ্যান দিচ্ছে। বইটির কাহিনীতেও আর মন বসছে না তার। দেখতে মন চাচ্ছে প্রিয়তমকে। কতকাল ধরে দর্শন নেই যুবকের।
এদিকে নায়িম খাণিক মুহূর্ত দর্শন পেয়েছিল বাসন্তীর। অবাক হলো সে। মেয়েটা যুবতী হয়েছে বহু আগেই। তবুও তার মাঝে কৈশোর ও অপরিপক্বতা স্পষ্ট ছিল সবসময়। আজ চশমা চোখে বই পড়ার দৃশ্যে যেন একদম পরিপক্ব ও পরিণীতা লাগছে।
বাসন্তী অবচেতন মনেই আজ অদ্ভুৎ সব কাণ্ড করল। গুছানা বিছানা আবারও গুছালো, কারণ বিছানার দিকটা থেকে ফোনের স্ক্রিন সোজাসুজি দেখা যায়। আলমারির ভাজ করা কাপড়গুলো বের করে আবার গুছিয়ে রাখল। এতে ক্যামেরায় একটু তাকেও দেখা যাবে। তবে কি বাসন্তীর হৃদয় তার চেতনার আড়ালেই চাচ্ছে অপ্রিয় প্রিয়তমের দর্শন পেতে, নিজের দর্শন দিতে।
চৈতালি বাসন্তীর কাজ-কারবার খেয়াল করে মুখ টিপে হাসে। আনমনেই বিড়বিড়ায়,
“ভালোবাসা হলো বেলি ফুলের সুভাষের মতোন। তাকে তিক্ততার বেড়াজালে আটক বা আড়াল করে রাখা যায় না। ঠিকই একসময় বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পরিবেশে প্রকাশিত হবে।”
নায়িম কল কাটে। বাসন্তীরও চেতনা ফিরে। নিজের উপরই ভড়কে যায়। মনে মনে নিজেকেই বকতে শুরু করে।
“তোর মধ্য কি একটুও আত্মসম্মান নেই বাসন্তী? আর কত বেহায়া হবি এই হৃদয়হীন মানুষের ভালোবাসা পেতে? আরে ঐ লোকটার হৃদয়ই নেই, তবে তুই জায়গা করবি কীভাবে?”
____
নায়িম কপালে হাত দিয়ে গাম্ভীর্যপূর্ণ মুখশ্রী নিয়ে শুয়ে আছে। তার চোখজোড়া বন্ধ।
অনিমেষ বিরক্তির ভঙ্গিমায় বলে,
“তুই এতটা স্বাভাবিক কীভাবে? দেখছিস ভাবীর তোর প্রতি কতটা রাগ জমেছে? তুই একটা বছর ধরে অসুস্থ একবার তোর খোঁজ নেওয়া তো দূরে থাক, আমি জানাতে গেলেও কল কেটে দিয়েছি। কতটা তিক্ততা জমেছে ভেবেছিস!”
“আমিও তো কম করিনি মেয়েটার সাথে। তিক্ততা জমার ছিলই, জমেছে। কারো জন্য এত কিছু করার পরও যদি কারো থেকে ভালোবাসা, প্রাধান্য না পাওয়া যায়, তবে তিক্ততা কেন ঘৃণাও জমবে।” কণ্ঠস্বর শান্ত ও অত্যন্ত গম্ভীর নায়িমের।
“তুই রিয়েলাইজ করেছিস, অনুতপ্ত এটা খুবই ভালো। কিন্তু ভাবীকে কী করে মানাবি? তার শুধু ভালোবাসা নয় বিশ্বাসও ভেঙে দিয়েছিস তুই।”
নায়িম কোনো উত্তর দেয় না। নায়িমকে নিশ্চুপ দেখে অনিমেষ ধীর পায়ে কেবিন ত্যাগ করে।
নায়িম নিজ ভাবনায় ডুব দেয়। আনমনেই ভাবে,
– সত্যিই কি তার কাছে বাসন্তীর মূল্য বেশি ছিল? বাসন্তীকে বাঁচাতে কি সে খ্যাতি, ক্ষমতা ও সম্পত্তি হাত ছাড়া করত?
ভিতর থেকে উত্তর আসে, ‘না’। বস্তুত, সত্য তো এটাই সেই মুহূর্ত বাসন্তী প্রাধান্য তার নিকট অনেকটাই কম ছিল নিজের কষ্টে অর্জিত ক্ষমতা ও সম্পত্তির চেয়ে।
চিনচিনে ব্যথা অনুভব নায়িমের। মনে মনে বলে,
“এমন কী যদি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে না যেতাম, এই বিরহবেদনা না ভোগ করতাম তবে কোনোদিনও বসন্তকে ভালোবাসা হতো না। মৃত্যুমুখে এসে বারবার বাঁচতে চেয়েছি, আল্লাহর কাছে জীবন চেয়েছি। তবে তা অর্থ-সম্পদ ভোগ করতে নয়। বরং, বসন্তের সাথে আর কটা মুহূর্ত বাঁচার আশায়। একসাথে জান্নাত পাওয়ার কর্ম করার আশায়। একসাথে বার্ধক্যে নুয়ে পড়ার আশায়। তখন বোধ করেছি আমার সবচেয়ে বড় চাওয়া, কামনা, আশা, স্বপ্ন হলো বাসন্তী৷ সে ছাড়া আমি আত্মা বিহীন লাশের ন্যায়।
এই উপলব্ধিও খুব বেশি সময় টিকত না, যদি এই অসুস্থতা না আমায় বিরহ ভোগ করাতো। যদি খুব তাড়াতাড়িই সুস্থ হয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠতাম কিংবা বসন্ত চোখের সম্মুখে থাকত, তবে কখনো তাকে ভালোবাসাও হতো না। তাকে না পেয়ে আমি প্রতিটা সময় তাকে মনে করেছি, অনুভব করার চেষ্টা করেছি। এই অনুভবের চেষ্টা কবে যে ভালোবাসার রঙ হয় হৃদয়ে আচ্ছন্ন হলো কে জানে!”
চিন্তা করতে করতে হাঁপিয়ে উঠে নায়িম নিজেই। সে শুধু জানে সে ভালোবাসে বাসন্তীকে। তার লোমে লোমে সেই উপলব্ধি, সেই ভালোবাসার সাধনা। এই প্রথম ভালোবাসার যন্ত্রণাময় শান্তি অনুভব করছে সে। সেই বেদনাময় তৃপ্তিতে তার গাম্ভীর্যপূর্ণ মুখশ্রীতে ফুটে উঠে প্রশান্তিকর হাসি।
ভালোবাসাটা হলো উপলব্ধির বিষয়। আপনি ততক্ষণ কাউকে ভালোবাসেননি যতক্ষণ তা বোধ করেননি।
যেই মুহূর্তে উপলব্ধি হয়েছে সেই মুহূর্ত থেকেই বোধ করবেন ভালোবাসার যন্ত্রণা, সুখ, উত্তেজনা সবকিছু। নায়িমের ক্ষেত্রেও তা হয়েছে। এতটা বছর একসাথে থেকেও ভালোবাসার রেশমাত্রও তাকে ছুঁতে পারেনি। অথচ, যেই ভালোবাসলো ভালোবাসার সকল আবেগ-অনুভূতি তাকে ছুঁয়ে দিল।
আজকাল তাই নায়িম প্রায়শয়ই ভেবে উঠে,
“পৃথিবীর সকল প্রেমিক ভালোবেসে বিরহ পায়। আমি বিরহে তোমায় ভালোবেসেছি প্রিয়তমা।”
চলবে…
#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||৩১তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
রাত প্রায় বারোটা, ফাহিম অফিস থেকে বাড়ি ফিরছে। ম্যানেজার হিসেবে প্রায় মিটিংয়েই তাকে উপস্থিত থাকতে হয়। আজকেও একটা ভিনদেশী কোম্পানির সাথে মিটিং ছিল, ডিনারটাও সেখানেই সেরে এসেছে।
ফাহিমের গাড়িতে গান চলেছে,
পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি
সোজা পথের ধাঁধাঁয় আমি অনেক ধেঁধেছি
পথ হারাব বলেই এবার পথে নেমেছি
নিষেধের পাহারাতে ছিলেম রেখে ঢেকে
সে কখন গেছে ফিরে আমায় ডেকে ডেকে
নিষেধের পাহারাতে ছিলেম রেখে ঢেকে
সে কখন গেছে ফিরে আমায় ডেকে ডেকে
নয়ন মেলে পাবার আশায় অনেক কেঁদেছি
এই নয়নে পাব বলেই নয়ন মুদেছি…
(পথ হারাবো বলেই- হেমন্ত কুমার)
গানটার যেন ফাহিমের হৃদয়ের কথা বলছে। তার চোখে-মুখে অবিরাম আকুতি। কীসের আকুতি কে জানে? সে তো প্রিয়মানুষের থেকে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, লয়ালটি বা আনুগত্য সবই পেতে ব্যর্থ।
হুট করেই গাড়ির ডান পাশের আয়নাতে খেয়াল করতেই দেখল একজন শাড়ি পরিহিতা মেয়ে তার গাড়ির পিছু পিছু ছুটছে। দ্রুত ব্রেক কষে সে। ততক্ষণে মেয়েটা মুখ থুবড়ে পড়েছে মাটিতে।
ফাহিম সিটবেল্ট খোলে মেয়েটাকে যেয়ে ধরে। কিন্তু দেখতে পায় চেতনাহীন হয়ে পড়ে আছে সে। তবুও নিজের ব্যাগটাকে বেশ সামলে ধরেছে।
“ঐ শালা! এই মাইয়ারে ছাইড়া দে। আজকে রাইতের লিগা এই মেয়ে আমগো।”
কারো নেশাযুক্ত কণ্ঠে এই কথা শুনে মাথা ঘুরায় ফাহিম। দেখতে পায় দূর থেকে একঝাঁক নেশাখোর ঢুলু ঢুলু পায়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। বুঝতে পারে মেয়েটি সাহায্য চাইতেই তার গাড়ির পিছু পিছু ছুটছিল।
ফাহিম দ্রুত ব্যাগ সহ মেয়েটিকে কোলে তুলে নেয়। তাড়াহুড়ায় মেয়েটাকে কোলে নেওয়া অবস্থাতেই গাড়ি চালু করে। কিছু দূর যেয়ে বিপদমুক্ত হয়ে ফাহিম গাড়ি থামায়। মেয়েটাকে নিজের পাশের প্যাসেঞ্জার সিটে বসিয়ে পায়ের নিচে রাখা পানির বোতল বের করে পানির ছিটে দেয় মুখে।
তার প্রচেষ্টা সফল হয় আস্তে আস্তে জ্ঞান ফিরে মেয়েটির। মিটমিট করে চোখ খুলে তাকায় মেয়েটি। বিমোহিত হয় ফাহিম। কী ডাগর চোখ যুবতি! কোনো কবি সম্মুখে থাকলে নির্ঘাত বলে উঠতেন,
‘এলোকেশী কন্যা সে যে,
ডাগর ডাগর চোখ,
চাহনিতে বিজলি থাকে,
এমনই তার রূপ।’
ফাহিমকে এত কাছে দেখে ঘাবড়ে যায় মেয়েটি। মৃদু ধাক্কায় সরিয়ে দেয় তাকে। যুবকেরও ঘোর ভাঙে। ইতঃস্তত ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি ঠিক আছেন না কি হাসপাতালে নিতে হবে?”
“জী, ঠিক আছি।”
“ভুল ভাবে নিবেন না। এত রাত করে বাড়ির বাহিরে বের হওয়া ঠিক না। ইট’স্ নট সেফ। যাই হোক, আপনাকে আপনার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি। ঠিকানা বলুন।”
শেষ দুই বাক্য শ্রবণগত হতেই কেমন একটা ত্রাস লক্ষণীয় হয় যুবতীর চোখে-মুখে। দ্রুত নিজ শাড়ির আঁচলে মুখশ্রী মুছতে মুছতে বলে,
“না, না, আমি কোথাও যাব না। আসলে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি। ফিরে যাওয়া অসম্ভব।”
“মানে? পালিয়েছেন কেন? বিয়ে-প্রেম টাইপের কেস না কি?”
“তা হবে কেন? দুই মাস পরই আমার ফ্লাইটের ডেট। আমি কানাডার একটা ভার্সিটি ফুল স্কলারশিপে পড়ার চান্স পেয়েছি। কিন্তু আমার বাবা আমাকে এক টাকলা বিসিএস ক্যাডারের সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছে। তাই…”
“বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এখন যাবেন কই?”
“আসলে আমার তো যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। কোনো লজ বা গার্লস্ হোস্টেলে যদি থাকার ব্যবস্থা করে দিতেন।”
অত্যন্ত অসহায় কণ্ঠ মেয়েটির। সহানুভূতিই বোধ হয় ফাহিমের।
“এখন তো হোস্টেল খোলা থাকবে না। আর একা মেয়ে লজে উঠা সেফও হবে না। আপনার কোনো অসুবিধা না হলে আজ রাতটা আমার বাসায় থাকতে পারেন। আমি, আমার মা আর আমার খালা থাকি।”
অজানা মেয়েটি বেশ খাণেক ক্ষণ খোশামোদী করেও রাজি হয়ে গেল। হয়তো উপায়হীন বলেই অচেনা এক পুরুষকে বিশ্বাস করল।
ফাহিম পুনরায় গাড়ি স্টার্ট করল। চালাতে চালাতে মেয়েটিকে তার নাম জিজ্ঞেস করল।
মেয়েটি এক শব্দে উত্তর দিল, “পূর্ণতা”।
এরপর আর কোনো কথা হয় না তাদের মাঝে। নিঝুম রাতে এয়ারপোর্ট গামী নিস্তব্ধ রোডে একজোড়া নরনারীর যাত্রা চলমান। কে জানে কোথায় এই যাত্রার সমাপ্তি।
___
“ছোটো মালকিন! ছোটো মালকিন! আপনার সাথে কারা যেন দেখা করতে এসেছে!”
একজন গৃহপরিচারিকার ডাক শুনে ওড়না দিয়ে দেহ ও মাথা আবৃত করে নিচে নামে বাসন্তী। বিরক্তির সুরে শুধায়,
“কোন মন্ত্রী-আমলা এসেছে যে এত জোরে জোরে ডাকছো! এমনিতেই নাহিবাকে কত ঝড়-ঝাপটা পেড়িয়ে ঘুম পারালাম, যদি উঠে যেত তবে…”
কথাগুলো বলতে বলতেই সোফার সম্মুখে দাঁড়ায় বাসন্তী। অতি পরিচিত এক খানা চেহারা চোখের সামনে স্পষ্ট হতেই থমকে যায় সে। আপনমনেই অস্ফুটস্বরে বলে উঠে,
“ম-মা?”
হ্যাঁ, বাসন্তীর মা বদরুন্নেসা দাঁড়িয়ে। পাশে তার বড় মামা মীর উদ্দীনও বসে। এতটা সময় পর মাকে দেখে কিছুটা আবেগপ্রবণই হয়ে পড়ে বাসন্তী। মায়ের উপর শত রাগ থাকুক, বাস্তবতা তো এটাই এই নারীটি তার গর্ভধারিণী।
সে ভাবে,
– নিশ্চিত তার কথা মামার কাছে শুনেই তাকে দেখতে ছুটে এসেছে মা! তাকে নিশ্চয়ই এখন বুকে আগলে মমতার ছোঁয়া সিক্ত করে নিবে। সেও কিছুটা অভিমান করব, পরে ঠিকই জড়িয়ে ধরবে মাকে।
কিন্তু না এমন কিছুই হলো না। বরং, বদরুন্নেসা গম্ভীর গলায় বললেন,
“কী শুনি এইসব বাসন্তী? তুই না কি বড় ভাই রে পার্টির থেকা বাইর কইরা দিতাসোস? আমগো মান-ইজ্জত ডুবায়া আরেক পোলার হাত ধইরা পলায়াও তোর মনে শান্তি লাগে নাই? এহন আরও ধ্বংস করতে চাস!”
বিধ্বস্ত হয় বাসন্তীর হৃদয়। মনে মনে বলে, “মানষ কোনোদিন বদলায় না”। তবে চেহারায় এই হতাশার রেশ মাত্রও আনে না। বরং, অত্যন্ত রাজকীয় ভঙ্গিমায় পায়ে পা তুলে তাদের সামনের সোফায় বসে।
“সরি, কে আপনি? আর আপনার সাহস কী করে হয় আমাকে তুই বলে সম্বোধন করার বা আমার সাথে এভাবে কথা বলার? বয়সও বড় বলে এই ভুল ক্ষমা করলাম। তবে দ্বিতীয় বার এই ভুল করার ভুল করবেন না। নাহলে পুরো পরিবার সুদ্ধ রাস্তায় নামানোর ব্যবস্থা করব। এটা যে আমার রাজ্য সেটা মাথায় ভালো মতোন ঢুকিয়ে নিন।”
“বেয়াদব মেয়েলোক কোথাকার! নিজের মামা-মায়ের সাথে এভাবে কথা বলছিস!”
“মামা কে? মা কে? আমার মা তো আমি ছোটো থাকতেই মারা গেছে, সাথে আমার মায়ের চৌদ্দ গোষ্ঠীও। আর হ্যাঁ, আপনারা আসলে কথা শোনার মানুষ না। সিকিউরিটি! সিকিউরিটি! এদের ঘাড় ধরে বের করো! আর মি. মীর উদ্দীন আপনার এইবারের টিকেট তো আমি ক্যান্সেল করবই৷ এন্ড আই উইল মেক শিউর আপনি বেঁচে থাকতে আর কোনোদিনই রাজনীতিতে যোগ না দিতে পারেন।”
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কথাগুলো বলেই হনহন করে নিজের বেডরুমে চলে যায় সে। বদরুন্নেসা ও মীর উদ্দীনকেও আদেশ অনুযায়ী ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় গার্ডরা।
বাসন্তী ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়। দরজায় গা ঠেকিয়ে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে। আনমনেই বিড়বিড়ায়,
“কেন আমাকে কেউ একটুও ভালোবাসে না? একটুও প্রাধান্য দেয় না কেন? আমার নিজের মায়ের কাছেও আমার কোনো মূল্য নেই! তার কাছে আজও তার ভাই-বোনই বড়। আমার প্রতি বিন্দুমাত্র মায়া তার নেই৷
আমি ভেবেছিলাম এত বছর আমি নেই তার কাছে, একটু তো মায়ার সৃষ্টি হবে। আমার প্রতি ভালোবাসা না হোক, কিছুটা মমত্ব তো জাগবে। কিন্তু না! তেমন কিছুই হয়নি! মানুষ কখনোই বদলায় না।
যারা কষ্ট দিয়ে এসেছে, তারা সদাই কষ্ট দিবে। ভালোবাসা দেখালে তা শুধুই বানোয়াট, অভিনয়। যেমন অভিনয় করেছে নায়িম। যেমন অবহেলা করেছে মা। কাউকে ক্ষমা করব না আমি। কাউকে না! আমি ঘৃণা করি, সবাইকে ঘৃণা করি।”
___
নায়িম এক মনে বাসন্তী ও নাহিবার ছবিগুলো দেখছে। তার মুখশ্রী গম্ভীর ও হাসির ছোঁয়া মুক্ত।
আনমনেই বিড়বিড়ায় সে,
“কতোটা অভিমান জমিয়েছো বুকের কোণে?
তার চেয়ে দ্বিগুণ প্রণয়ের বীজ বুনব আমি,
প্রণয়ের তরুলতার শীতল ছায়ায় অভিমানের শুষ্কতা কাটাবো আমি।”
অনিমেষ পাশেই বসেছিল। নায়িনের কথা শুনে তার মুখশ্রীতে স্মিত হাসি ফুটে।
আবেগপ্রবণ গলায় সে বলে,
“হায়! কবে যে আমি প্রেমে পড়ব! প্রেয়সীর ভালোবাসার নেশায় ডুবে কবি হব।”
“রাসেল ভাইও জানে তোর কপালে প্রেম নেই রে মগা। তোর কপালে প্রেম নেই।”
বিদ্রূপাত্মক ভঙ্গু নায়িমের। হয়তো বন্ধুকে হেনেস্তা করার প্রচেষ্টা।
“তুই আগে নিজের চিন্তা কর। তোর কি মনে হয় ভাবীর কাছ থেকে ক্ষমা পাবি এতসব হওয়ার পর?”
“জানি তো। যতটা করেছি আমি, যতটা সয়েছে সে, তারপরও শূণ্য থলি দিলে কে-ই বা করবে ক্ষমা?”
“তার মানে কি তুই ভাবীর কাছে ক্ষমা চাবি না?”
“আমি অনুতাপ বোধ করেছি, অনুতপ্ত আমি। ক্ষমা চাইব। ক্ষীণ আশা আছে ক্ষমা পাব। তবে না করলেও অভিযোগ নেই। দিনশেষে আমি অন্যায় করেছি বসন্তের প্রতি, আমি ক্ষমার যোগ্য কি না তা বিচার করার অধিকারও একান্তই তার। এতে ফরমায়েশি করার জো নেই আমার।”
কী একটা ভেবেই যেন বোকা বোকা হেসে অনিমেষ শুধায়,
“আমি কী বলি শোন? দেশে যাওয়ার পর ভাবী না চাইলেও তাকে জোর করে নিজের সাথে সাথে রাখবি, তবে মান-অভিমান সব ভুলে আবারও তোর প্রতি আসক্ত ও অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। ঐ যে গল্প-নাটকে তো এমনই করে নায়করা।”
“ভালোবাসাকে লালন করতে হয় জলের মতো। তাকে মুঠোবন্দী করে আটকে নয়, দুই হাতে আগলে রাখতে হয়। নাহলে তা বিলীন হয়ে যায়।”
গাম্ভীর্যপূর্ণ গলায় বলল নায়িম।
“মানে তুই এমন কিছু করবি না? তাহলে…?”
“ও জীবনে কিছুই নিজ ইচ্ছানুযায়ী করতে পারেনি। আমি সবসময়ই নিজের ইচ্ছে চাপিয়ে আসছি ওর উপর। এখন যেহেতু নিজের মতোন থাকতে চাচ্ছে, তাতে দখলদারি না করলেই নয়। আমি ক্ষমা চাইব ওর কাছে আমার কর্মের জন্য। আল্লাহর কাছেও ক্ষমা চাব, দোয়া করব ওর মন জয় করার।
যদি মৃত্যুর পূর্বে কোনোদিন ওর তিক্ততার বরফ আমার প্রণয়ের উষ্ণতায় গলাতে পারি, তাতেই সই… তবে ওর ইচ্ছেকে আমি কখনোই দাবাবো না, যথাসাধ্য সম্মান দিব। বাকিটা ওর ইচ্ছে আর আল্লাহ যা কপালে রেখেছে। জোরাজুরি কখনোই করব না। কারণ জোরাজুরি করে কাজ সম্পাদন করানো যায়, ভালোবাসা পাওয়া যায় না।
ভালোবাসা আর ক্ষমা উভয়ই মনের অধীনস্থ, আর মনের উপর জোর-জবরদস্তি চলে না।”
চলবে…