টক্সিক_রিলেশনশীপ,৩২,৩৩

0
1213

টক্সিক_রিলেশনশীপ,৩২,৩৩
– ঈপ্সিতা শিকদার
৩২
বাসন্তী আজ চৈতালি ও নাহিবাকে নিয়ে মোস্তফা বাড়ি এসেছে। ঘুরে ঘুরে দেখছে গোটা বাড়িটিকে। মোস্তফা বাড়ি বিশাল জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে, যতটা জায়গা জুড়ে গাজীপুরের সাধারণ একটা রিসোর্ট হয়ে থাকে।

চৈতালি বুঝতে পারছে না তাকে বাসন্তীর হুট করেই এখানে নিয়ে আসার কারণ। পৌঁছে বাসন্তী তাকে তা জানাবে ভেবে চুপ ছিল সে।

কিন্তু এখন আর ধৈর্য্য ধরতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেলল,
“হঠাৎ এখানে নিয়ে আসলে কেন বাসন্তী?”

বাসন্তী বাগান জুড়ে ঘুরতে ঘুরতেই জবাব দিল,
“প্রয়োজন আছে বলেই এসেছি চৈতালি বুবু। আকরাম সাহেবের আসার কথা। এখনও পৌঁছায়নি কেন কল করে জিজ্ঞেস করো তো।”

আকরাম সাহেবের নাম শুনে সচকিত হয়ে তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে চৈতালি। কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে তার। বলা বাহুল্য, আকরাম সাহেব হলো নায়িমের লোক, বাড়ি কিংবা ফার্ম হাউস অথবা অফিস, মাদরাসা, স্কুল যা তৈরি করার হয় তা উনিই নিজ দায়িত্ব শেষ করান।

“আকরাম সাহেবকে ডাকিয়েছো? কিন্তু কেন? উনার তো এখানে কোনো প্রয়োজন নেই।”

“তুমি না বুবু আজকাল বড্ড বেশিই কথা বলো।প্রয়োজন আছে না কি নেই তা আমি দেখবো। তুমি শুধু কল দাও।”

বাসন্তীর হাবভাব ভালো ঠেকছে না চৈতালির কাছে। তবুও বাসন্তীর অধীনস্থ সে। তাই কথা না বাড়িয়ে নির্দেশ অনুযায়ী আকরাম সাহেবকে কল করে চৈতালি।

কিন্তু কল দেওয়ার মুহূর্তেই তাদের সামনে এসে দাঁড়ায় আকরাম সাহেব। ষাটোর্ধ বয়স্ক তাগড়া পুরুষ তিনি। সবসময়ই সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা তার গায়ে সাজে। টাক মাথার এই বৃদ্ধকে মানায়ও বড্ড এই পোশাকে।

“আম্মাজান কীয়ের জন্যে ডাকসেন? নয়া কোনো ইস্কুল বানাইবেননি?”

“তেমনই কিছু। চলেন আমার সাথে।”

বাসন্তী চলতে শুরু করে বাড়ির পিছনের দিকে। এক জায়গায় এসে থামে। জায়গাটি নানা গাছে ঘেরা। এখানের মাঝ বরাবর ছোট্ট একখানা পুকুর। গোলাপি রঙা পদ্ম ও শাপলা ভাসছে তাতে, গুটি কয়েক পদের মাছও আছে হয়তো।

“এখানে আমার তিনটা একতলা বাসা লাগবে। প্রতিটি বাসা দুই রুমের হবে, সাথে একটি বাথরুম থাকবে। বড় একটা রান্নাঘর দিবেন শুধুমাত্র মাঝখানের বাসাটায়।”

“টিনশেড বাসা না কি আম্মাজান। আর তিনটা বাসা কি এক রোতে না কি গোলাকারে করব?”

“না, না, টিনশেড ছাদ দিবেন। ফাউন্ডেশন দেওয়ার দরকার নাই। তবে মজবুত করেই করবেন। আর পুকুরটাকে মিডেলে রেখেই করবেন।”

আরও নানারকম আলোচনা করল বাসন্তী আকরাম সাহেবের সাথে কীভাবে কী করবে তা নিয়ে। শেষে বলল,
“আকরাম সাহেব আমার কিন্তু দেড় মাসের মাঝে কাজটা কমপ্লিট চাই। কারণ দেড় মাস পরই এই ঘরগুলোর বাসিন্দারা এসে পড়ব।”

তারপর আকরাম সাহেব থেকে বিদায় নিয়ে খান বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো সকলেই। চৈতালি এতক্ষণ নীরব হয়ে সব কথা শুনেছে। কিন্তু অনুধাবন করতে পারছে না কিছুতেই।

“বাসন্তী আমি জানি আমার প্রশ্ন করার অধিকার নেই। তবুও নিতান্তই উদ্বিগ্নতা থেকে জিজ্ঞেস করছি বাসাগুলোতে কাদের জন্য বানাচ্ছো? কারাই বা আসছে?”

নিকাবের আড়ালেই বাসন্তীর চোখ ভরে আসে নোনাজলে। ভাবে,
– মেয়েটা নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছে তার আচারণে। এই মেয়েটা যার জন্য আজ বানের জলে ভেসে যায়নি তারা মা-মেয়ে, তাকে সে কষ্ট দিল? সে তো কাউকে কষ্ট দিতে চায় না। তবে আজকাল মনের তিক্ততার স্তর এতটাই বেড়েছে অজান্তেই রূঢ় আচারণ করে ফেলছে সে। নিজের আশেপাশে সকলকেই অসহ্যকর লাগছে। কী অদ্ভুতুড়ে এক যন্ত্রণা! মনে হত সবার চোখের আড়ালে হলেই যেন বাঁচি।

ভাবনা শেষে। চোখের কোণে একবিন্দু অশ্রু মুক্তার মতো জ্বলজ্বল করছে। তা মুছে বিনীত ভঙ্গিমায় বলে,

“আপু প্লিজ এভাবে বোলো না। আমি ভীষণ দুঃখিত তোমায় কষ্ট দিয়ে ফেলায়। বিশ্বাস করো আমি ইচ্ছে করে করিনি।”

“আরে আমি কিছু মনে করিনি বাসন্তী। তুমি কষ্ট পেয়ো না, ইট’স ওকে। শুধু জানতে চাচ্ছি কারা এখানে থাকবে?”

“এই জেলারই এক এতিমখানা ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গায় হয়েছিল। সেই জায়গাটাতে মালিক এপার্টমেন্ট তুলবে, তাই বের করে দিচ্ছে। আমি ভাবলাম নানাজানের বাসাটা তো এমনেই পড়ে থাকে। সুতরাং, এখানেই তাদের থাকার ব্যবস্থা করা যাক।”

“তোমার ভাবনাটা বেশ ভালো। বেশ!”

বাসন্তী কিছু বলে না জানালার দিকে দৃষ্টি স্থির রাখে। তার চোখ থেকে মনে হচ্ছে এই সবুজা-শ্যামলা পরিবেশ যেন পিছন দিকে ছুটে যাচ্ছে। অথচ, গাছের দৃষ্টিকোণ থেকে সে ছুটছে তার গন্তব্যে।

বাস্তবতায় পৃথিবীতে কিছুই বা কেউ-ই স্থির নয়। সবাই ছুটছে। শুধ দৃষ্টিকোণের বদল হয়।
কেউ নিজের লক্ষ্যের পিছনে, কেউ টাকার পিছনে, কেউ ভালোবাসার পিছনে ছুটছে; আবার কেউ কেউ বা অতীত, কষ্ট, বেদনা থেকে পালিয়ে ছুটছে।

যেমনটা বাসন্তী নিজেই পালাতে ছুটে চলেছে। অথচ, সে স্থির সকলের সাপেক্ষে, সকলের দৃষ্টিকোণে। আনমনেই চোখজোড়া বাহিরে স্থির রেখে বিড়বিড়ায় সে,
“হুম, বেশ ভালো চিন্তা-ভাবনা আমার চৈতি বুবু। সকল অনুভূতিময় মানুষটি থেকে মুক্তি নিয়ে অন্য দুনিয়ার বাসিন্দা হওয়ার চিন্তা আমার।”

___

পূর্ণতাকে নিয়ে হোস্টেল দেখতে এসেছে ফাহিম। তবে এসে যেন সে নিজ পায়ে কুড়াল মারলো সে। কারণ তরুণীর যেমন-তেমন মানে সাধারণ হোস্টেলে মন জমে না, আবার মানানসই হোস্টেলে টাকায় জমে না।

গুনেগুনে পাঁচটা হোস্টেল দেখা শেষ পূর্ণতার। এবার বেশ বিরক্তই বোধ করে ফাহিম। তার উপর মেয়েটার অতিরিক্ত বাচালতা ও অত্যন্ত ছটফটে স্বভাবের জন্য রীতিমতো হাপিয়েই উঠেছে সে।

“এই আপনি শুরু করেছেনটা কী? কখন থেকে একটার পর একটা হোস্টেল দেখেই যাচ্ছেন! অথচ, একটাও শেষে পুরোপুরি পছন্দ করছেন না। আমাকে কি আপনার বেয়ারা মনে হয় যে কাজ-কারবার ফেলে সারাক্ষণ এখানে পড়ে থাকব!”

অপমানে ঠোঁট ফুলায় পূর্ণতা। ফর্সা মুখের নাকের পাটা লাল হয়ে উঠে। অদূরেই অশ্রু কণার পতন শুরু হয় তার চোখজোড়া থেকে। তার কথার উপর কেউ কোনোদিন কথা অবধি বলেনি। সেখানে ফাহিম নামক অজানা পুরুষের বকা কী করে সহ্য হয়?

ঘাবড়ে যায় ফাহিম তা দেখে। মনে পড়ে মেয়েটির স্বভাবে আবেগপ্রবণ ভঙ্গি স্পষ্ট। বয়সই আর কত হবে মেয়েটার? সদ্য কলেজ পেড়িয়েছে। এই বয়সী ছেলে-মেয়ে তো একটু ছটফটেই হয়। সেখানে এভাবে কথা শুনানো একদমই উচিত হয়নি।

নত হয় তার কণ্ঠ ও চাহনি। ক্ষমা চাইতে শুরু করে যুবক।

“সরি, সরি। আমি অনেক সরি। আমার এভাবে বলা উচিত হয়নি। আপনি প্লিজ কাঁদবেন না।”

“আমি… আমি আসলে ইচ্ছে করে এমন করছি না। ঐ রকম জায়গায় তো আমি আগে থাকিনি। আমার ওসিডি আছে, ময়লা রুম-বাথরুম, কী করে থাকব আমি? তাই না করছিলাম। আবার ভালো রুম নেওয়ার মতো টাকাও নাই।” ফোঁপাতে ফোঁপাতে শুধায় পূর্ণতা।

এক সুদীর্ঘ শ্বাস ফেলে ফাহিম। শান্ত সুরে বলে,
“তবে এত খোঁজাখুঁজি করে লাভ নেই। আপনার বাজেটে আপনার চাহিদা অনুযায়ী হোস্টেল পাওয়া মুশকিল। আপমি বরং যতদিন প্রয়োজন আমার বাড়িতে থাকেন।”

“আমি কী করে এতদিন আপনার বাড়িতে থাকি?”

“এছাড়া কোনো উপায় নেই মিস.। আর যদি আপনি রাজি না থাকেন তাহলে গাড়ি থেকে নেমে যান, আমার কাজ আছে। আর রাজি থাকলে বলুন আপনাকে বাড়িতে রেখে আমি অফিসে যাব।”

পূর্ণতা বেশ খাণেকটা সময় নিয় ভাবে। আড়চোখে ফাহিমের দিকে তাকায়। ভাবে,
– ছেলেটা একদম খারাপ নয়। ক্ষতি করার হলে গতকালই করতে পারতো। আবার খালামনিরাও তো কত ভালো! তাছাড়া আর তো কোনো উপায়ও নেই।

“আ’ম ওয়েটিং মিস।” গম্ভীর গলা ফাহিমের।

“আমি রাজি। ” মৃদু সুরে বলে পূর্ণতা।

মুচকি হাসে ফাহিম। গাড়ি চালু করে বাড়ির ঊদ্দেশ্যে রওনা হয়।

___

দুই মাস পর,
আজ প্রায় দেড় বছর পর দেশের মাটিতে পা রাখল নায়িম। তার চোখে-মুখে ছেয়ে আছে আলাদা রকমের আনন্দ, স্বস্তি ও শান্তি। আশাহত হলো যখন দেখল তাকে নিতে শুধু চৈতালি, নাহিবা আর ড্রাইভার এসেছে। যদিও সে জানতো বাসন্তী আসবে না। তবুও হৃদয়ের কোথাও ক্ষীণ আশা ছিল।

নাহিবা দিকে দ্রুত কোলে তুলে নেয় নায়িম। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয় মেয়ের ছোট্ট চাঁদমুখ খানা। চৈতালিকে খেয়াল করে নায়িম।

এই রমণীর মাঝে বড্ড পরিবর্তন এসেছে। আগের মতো পরনে কোনো পাতলা, স্টাইলিশ শাড়ি বা কামিজ নয়। বিধবাদের মতো অফহোয়াইট সুতি শাড়ি। তার লাস্যময়ী ভঙ্গি নেই আজ। বরং, বার্ধক্য যেন বয়সের আগেই চৈতালিকে জড়িয়ে ধরেছে। চোখের নিচে কালি, গালে ব্রন, ফ্যাকাসে চেহারা সব ম্লানতাই এসেছে। তবুও তার মুখশ্রী শান্তিকর, কারণ তার চরিত্র এখন অমলিন।

“কেমন আছো চৈতালি?” জিজ্ঞেস করে নায়িম।

চৈতালি চমকিত হয়। অস্বস্তিও বোধ করে সাথে। সে জ্ঞাত নায়িমের নিকট সে অপ্রিয় একজন। সে কেমন আছে তা জিজ্ঞেস করার মতোও মূল্য সে রাখে না নায়িমের কাছে। তবে আজ কী হলো এই পুরুষের? না কি তার অনুতাপ রঙ এনেছে? মানুষের চোখে তার জন্য সম্মান এসেছে?

“আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালোই। চলো বাসায় যাই। সবাই তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।” উত্তর দিতে দিতে মাথায় দেওয়া আঁচলটা আরেকবার ঠিক করে নিজের অস্বস্তি এড়াতে।

অতঃপর তিনজন চড়ে বসে গাড়িতে। টানা কয়েক ঘণ্টার যাত্রার পর খান বাড়িতে পৌঁছায় তারা। বিশাল আয়োজন খান বাড়িতে। মরিচ বাতির মিটমিটে সোনালি আলোয় বাহির থেকে সেজেছে গোটা বাড়ি। বাড়িতে প্রবেশ করতেই তার আগমনে পারিবারিক মেজবানি নিয়মানুযায়ীই তাকে খেজুর খাওয়ায় একজন গৃহপরিচারিকা। তার আসার খবর শুনে অনেকে এসেছে দেখা করতে।

এরপর নায়িম ও অনিমেষ সোফায় বসে। তাদের হাত ধোয়ানোর ব্যবস্থা করে দুই জন কেয়ারটেকার। ধীরে ধীরে সবাই নায়িমের সাথে কুশল বিনিময় করে। নায়িম ও অনিমেষ ফ্রেশ হতে নিজ নিজ নির্ধারিত ঘরে যায়।

যখন নিজ রুমের দিকে পা বাড়ায় নায়িম তখন বুকটা অসহনীয় শব্দ করতে শুরু করে। করবে না-ই বা কেন? প্রেয়সীর সাথে সাক্ষাৎ হবে এতদিন পর। কিন্তু বেডরুমে ঢুকে তা বাসিন্দাশূন্য পায় নায়িম। একদম নিস্তব্ধ ঘর। খাটের উপরে তার পোশাক আয়রন করে রাখা। নায়িম জার্নির ক্লান্তিতে এত না ভেবেই বাথরুমে চলে যায় গোসল করতে।

তৈরি হয়ে নিচে তথা বসার ঘরে আসে নায়িম ও অনিমেষ। সবার সাথে বসে খাওয়া-দাওয়া সাড়ে। বেশ কিছুক্ষণ ভাব বিনিময়ের পর তার সাথে দেখা করতে আসা সকল মেহমান ধীরে ধীরে নিজের মতোন চলে যায়।

বিকেল বেলা,
কোনো মেহমান আর বাড়িতে উপস্থিত নেই। অনুষ্ঠানের রেশও কেটে গিয়েছে। নায়িম, অনিমেষ ও চৈতালি নাহিবার সাথে খেলছে। এমনসময় হুট করে বড় একখান ট্রলি ব্যাগ সহ বাসন্তী উপস্তিত হয় সেখানে।

সবাই চকিতদৃষ্টিতে তার পানে তাকায়। তবে রমণী সেসবে ধ্যান দেয় না। তার মাঝে খাপছাড়া ভাব। নায়িমের দিকে নিজের চাবির তোড়া এগিয়ে দিয়ে বলে,

“আপনার কষ্টে অর্জিত সকল কিছু আপনাকে ফিরিয়ে দিয়ে গেলাম গায়ক সাহেব। আমার দায়িত্ব আপনি আসা অবধিই ছিল। তবে একটা জায়গা নিয়েছি আমি, মোস্তফা বাড়িটা। আপনার স্ত্রী হিসেবে, আপনার সন্তানের মা হিসেবে সেটা আমার হক। তারপরও যদি আপনি সেখান থেকেও বের করে দিতে চান, সেটাও পারেন।

জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছি অন্যের মতো চলে। বিনিময়ে যা চেয়েছি বা নিয়েছি স্বর্ণকণা মনে করে। একদিন খোঁজ নিয়ে জানলাম তা স্বর্ণ নয় বালু। তাই আশা ছেড়েছি সকলের, ভালোবাসার সাগর এখন মরুভূমি। কাউকে চাই না আমার, কারো ভালোবাসা তো দূরে থাক কিছুরই আশা রাখতে চাই না। যতটা সময় বেঁচে আছি, একা থাকতে চাই নিজের মতো।”

বলেই বাসন্তী নাহিবাকে কোলে তুলে নায়িমের সামনে দিয়ে বের হয়ে গেল। আর নায়িম? সে তো স্তব্ধ, বাক্যশূণ্য। তার শব্দভাণ্ডারে আজ অভাব হয়েছে শব্দের অনুভূতি প্রকাশে।

?

প্রেমের শহরে তিক্তিতার ছড়াছড়ি
প্রবেশ নিষেধ তোমার।
অপ্রাপ্তির যে দহনে পুড়িয়েছো তুমি,
তুমিও পুড়বে কাছে এসেও দূরে থেকে।
চলবে…

#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||৩৩তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
ধূমিত চায়ে ঠোঁট ছোঁয়ায় বাসন্তী। সাথে সাথেই কুয়াসায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে তার চোখে এঁটে থাকা চশমা। চশমা খোলে ফেলে রমণী। শব্দ করে এক শ্বাস ফেলে। শীতল বাতাসে কর্পূরের মতোন হারিয়ে যায় হতাশা মিশানো সেই তপ্ত শ্বাস। কত ভালোই না হতো যদি কষ্ট বা বেদনাময় অতীতের সঙ্গ এভাবে ছাড়ানো যেতো!

আনমনেই বিড়াবিড়ায় বাসন্তী,
“তুমি ভালোবাসোনি ক্যানো জিজ্ঞেস করব না আমি কভু, তোমার বিরহে, তৃষ্ণাতেই তো নিজেকে পেয়েছি। আমার দেহ থেকে নিঃসৃত প্রতিটি তপ্ত শ্বাসে আজও তোমার নাম লিখা, তবে গৃহীত শ্বাসের কোথাও তুমি নেই। কখনোই নেই।”

আজ প্রায় দুই মাস হলো বাসন্তী মোস্তফা বাড়িতে। এই দুই মাস সে নিজের মতো থেকেছে। না, চার দেওয়ালে বন্দী হয়ে থাকেনি সে। তার এখন বহু কাজ। সত্তরটি শিশুর দায়িত্ব তার কাঁধে এখন, দায়িত্ব নিয়েছে গ্রামের চালচুলোহীন বা স্বামীহীনা নারীদের ও বেকার যুবকদের।

নায়িম আসার প্রায় অনেক দিন আগে এই মোস্তফা ভবনকেই ছোট্ট একটা এনজিওতে পরিণত করেছে সে। অফিস স্বরূপ ব্যবহার করেছে মোস্তফা বাড়ির শালিস ঘরটি। এই বাড়ির পাশে দুই কামরার ঘর তুলে তাতে নানা দরকারী সরঞ্জামাদি এনে তৈরি হয়েছে কারখানা। শহরে একটা শোরুমও খুলেছে সে এসবের ন্যায্য মূল্য পেতে।

তার প্রচেষ্টার পুরোটাই দেশের গরীব, অসহায়, বেকার নারী, পুরুষ ও শিশুদের জন্য করা। এই এনজিওতে পেশাগত লোকদের দ্বারা হস্তশিল্প যেমন শখের হাড়ি সহ নানা ধরনের মৃৎশিল্প, নকশিকাঁথা, বেতের বা পাটের বিভিন্ন শৌখিন ঘর সাজানোর জিনিসপত্র, বাটিক প্রিন্টের কাজ, হাতের সেলাই ইত্যাদি শিখানো হচ্ছে।

নিপীড়িত নারী ও বেকার পুরুষদের অধিকাংশ গ্রামের হওয়ায় তারা আগে থেকেই এই কাজে অভ্যস্ত। পেশাদার শিল্পীদের সহযোগিতায় আরও নিপুণহাতে কাজ করছে তার। বাসন্তীর শহরে খোলা শোরুমটাও ইতিমধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছে।

এতসব কাজের মাঝে কোথায় যেন ভাটা পড়ে যায় অতীত। চাপা পড়ে যায় সেই আবেগ ও কষ্টগুলো। হ্যাঁ, মুক্তির স্বাদ পেয়েছে বাসন্তী। মানুষের থেকে তো মুক্তি পাওয়া যায়, মানুষের তৈরি কারগার থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
তবে অনুভূতির কারাগার? অনুভূতি হলো আস্ত অজগর এক সাপের ন্যায়। প্যাঁচিয়ে ধরে থাকে সর্বক্ষণ। অনুভূতির কারাগারে মুক্তি নামক শব্দটি নেই।
এই অনুভূতির কারাগারেই বন্দী বাসন্তী।

“দেখো, দেখো, ছোট বউমা। তোমার এইটুকুনি মেমসাহেব আমারে খামচিয়ে করলো দেখো।”
বলতে বলতেই ঘরে ঢুকলেন সাহেরা বানু।

আঁচলে মুখ চেপে হাসছেন সাহেরা বানু। তিনি হলেন মোস্তফা বাড়ির কেয়ারটেকার মধু মিয়ার স্ত্রী। বর্তমানে তিনি এবং তাঁর স্বামী উভয়ে বাচ্চাদের দেখাশোনার দায়িত্বও সমান তালে পালন করছেন।

বাসন্তীর ঘোর ভাঙে। হালকা হেসে এগিয়ে যায় সাহেরা বানুর দিকে। নাহিবাকে কোলে তুলে নিয়ে। আলতো হাতে গাল ছুঁয় তার।

কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
“এমন জল্লাদপনা করে না কি মা? তোমার দাদুন হয় না? এমন করলে কিন্তু পিট্টু দিব তোমাকে আম্মো।”

“বপ!” চোখ রাঙিয়ে চেঁচিয়ে উঠে নাহিবা।

নাহিবার এমন আচারণে অবাক হয়নি বাসন্তী, না হয়েছেন সাহেরা বানু। মেয়েটা বড্ড দস্যু হয়েছে, একে মারবে, ওকে মারবে। বিপরীতে কিছু বললে বা বকা দিলেই ‘বপ’ তথা ধমক দিতে ভুলে না। তবে আজকাল খুব বেশি একটা শব্দ উচ্চারণ করে নাহিবা। তা হলো ‘বাবা’। যা শ্রবণগত হতেই আরও পোড়ন বাড়ে বাসন্তীর।

___

ফাহিম অফিস থেকে এসে জানতে পায় আর পনেরো দিন পরই পূর্ণতা কানাডার ফ্লাইট। বিষয়টা জানতে পারার পর থেকেই বুকটা ভার ভার লাগছে তার। মনে হচ্ছে তার অতি প্রিয় কী যেন হারিয়ে যেতে চলেছে। এ এক অন্যরকম যন্ত্রণা।

আনমনেই ভাবে সে,
– এমনটা তো শুধু চৈতালির জন্য বোধ হতো। এখন পূর্ণের যাওয়ার কথা শুনার পর থেকেই… তবে কি শূণ্য হৃদয়ে পূর্ণতাকে নিয়ে কোনো অনুভূতির জন্ম হলো?

তার প্রশ্নের উত্তর বহু খোঁজ করেও জানতে পারল না। ঘাম সিক্ত শার্ট নিয়েই বসে থাকল বিছানায়। একটু বাদেই বেডরুম থেকে হাসাহাসির শব্দ শুনতে পায়। ধীর পায়ে ঘরের দরজা খুলে দাঁড়ায় সে।

দেখতে পায় পূর্ণতা তার মা ও খালার সাথে আড্ডায় ব্যস্ত। কথার মাঝেই পূর্ণতা ও তার খালা শব্দ করে হেসে উঠছে। তার শয্যাশায়ী মাটাও নীরবে হাসছি। এ হাসি দেখা যায় না, চোখের ভাষায় প্রকাশিত হয়।

ইদানীংকালে ফাহিম খেয়াল করেছে তার ইটের নীরব, নিস্তব্ধ দালানটা হুট করেই যেন প্রাণোচ্ছল ও কলরবমূখর বাসা হয়ে উঠেছে। এখন মনে হয় এখানে একটি পরিবার থাকে।

এই সব পরিবর্তনের পিছনে পূর্ণতারই হাত তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। মেয়েটাই এমন সারা ঘর সবসময় মাতিয়ে রাখে। এমন কী ফাহিমকে নিজের কথার জালে ফাঁসিয়ে অতীতের ক্ষতগুলো ভুলিয়ে রাখে।

ফাহিম আপন মনেই বিড়বিড়ায়,
“পূর্ণতাকে ভালোবাসতে কিংবা চৈতালির জায়গা দিতে পেরেছি কি না জানি না। কিন্তু পূর্ণতার জন্য একটা ভালো লাগা বা মায়া তো তৈরি হয়েই গেছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো তাকে আমার প্রয়োজন। আমার ইটের দালানকে শান্তির নীড় বানাতে তাকে প্রয়োজন।”

ফাহিম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে পূর্ণতার সম্মুখে একটা প্রস্তাব সে রাখবেই। রাজি হোক কিংবা না হোক সেটা পূর্ণতার বিষয়। তবে যুবকের মনে পাকাপোক্ত এক আশা আছে যে মেয়েটা তাকে ফিরাবে না। অন্ততঃ পক্ষে এই মানুষগুলোর জন্য তো না-ই।

___

নায়িম এক মনে লেপটপে ডুবে আছে। অনেক কাজ জমে আছে তার। বাসন্তী সব সামলে নিলেও ব্যবসার হিসাব ও অন্যান্য বিষয় সহ ও বড় বড় প্রজেক্টগুলো নিয়োজিত লোকদের ভরসাতেই চলেছে গোটা বছর।

কারণ একদম অনভিজ্ঞ ও স্বল্পশিক্ষিত স্বল্পশিক্ষিত বাসন্তী, চৈতালির পক্ষে এই কাজে ধরা সম্ভব হয়নি। নায়িম আসার পর থেকেই অবিশ্রাম ভাবে কাজে উঠে-পড়ে লেগে আছে।

অনিমেষ গোল গোল চোখে বন্ধুর কাজ-কারবার খেয়াল করে। সে ভেবেছিল বাসন্তীর বাড়ি ছাড়ায় নায়িম জ্বলে-পুড়ে ছাড়খাড় হবে, চার দেওয়ালে বন্দী হবে, ডিপ্রেশনে তলাবে। মানে দেবদাশের দশা হবে আর কী!

কিন্তু তাকে অবাক করে নায়িম তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। বরং, তার আচারণ স্বাভাবিক ও গম্ভীর৷ চেহারায় গাম্ভীর্যপূর্ণ, বেদনার ব মাত্রও নেই তাতে।

হ্যাঁ, যেদিন বাসন্তী চলে গিয়েছিল সেদিন খাণিক ক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রমণীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু তারপর কাজে ডুবে যায়। দুটো মাস যে কেটে গিয়েছে, তার মধ্যে একবারও বাসন্তী বা নাহিবার নাম সুদ্ধ উচ্চারণ করেনি নায়িম।

অনিমেষ আজ বেশ বিরক্তই হয়ে উঠে নায়িমের প্রতি। সেদিনই তো বলেছিল ভালোবাসি, আর এখন এতটা অনুভূতিহীন আচারণ।

“তুই কি ভুলে গিয়েছিস ভাবী রাগ করে চলে গেছে? তোর মধ্যে সামান্যতম খারাপ লাগা আছে এ নিয়ে? মানে সিরিয়াসলি এতটা ইনসেন্সেটিভ মানুষ কীভাবে হয়!”

তার কটাক্ষ-বানেও নায়িমের ধ্যান ভঙ্গ হয় না। চোখ জোড়া লেপটপে স্থির রেখে সে গম্ভীর গলায় জবাব দেয়,
“তো কী করব? দরজা আটকিয়ে ঘরে বসে বসে কাঁদব না কি সারা জীবন ধরা-ছোঁয়ার বাহিরে রাখা মদ-সিগারেটকে আপন করে নিব? কিন্তু এতে কি বসন্ত ফিরে আসবে? তা হবে না, তবে আমার ব্যবসা আরও ডুববে বটে।”

“ভালোবাসা আদায় করে নিতে হয়। বাসন্তী ভাবীকে বুঝা তুই তাকে ভালোবাসিস। ক্ষমা চা বারবার, কাছে টেনে নে, বারবার কর্মে, কথায় সবকিছুতে বুঝা ভালোবাসি। তবেই তো প্রাপ্তির থলি পূর্ণ হবে, ভালোবাসা আদায় হবে।”

“যেই ভালোবাসা অলরেডেই আমার, তা আমি কী আদায় করব? বাসন্তী আমাকে আজও ভালোবাসা। কিন্তু আঘাত করেছি আমি তার হৃদয়ে। যার জন্য তিক্ততায় আবৃত সে আজ।

জীবন, বয়স, সময় কোনো কিছুতেই থেমে থাকে না। সময় সব ক্ষতই পূরণ করে, শুধু সময়কে একটু সময় দেওয়া প্রয়োজন।
দেহের ক্ষততে সঙ্গে সঙ্গে মলম দেওয়া লাগে, কিন্তু মনের ক্ষতকে আগে শুকাতে দিতে হয়।

আমিও তাই দিচ্ছি। এখন ক্ষমার মলম লাগালে তা নিছক অভিনয় ছাড়া বসন্তের নিকট কিছুই লাগবে না।”

অনিমেষ রিনরিনে গলায় শুধায়,
“শালায় চালাক আছে। কিন্তু দেখবো নে এই চালাকি কত দিন ভাবীর মান-অভিমানের সামনে?”

___

রাতের বেলা, নায়িম বিছানায় বসে টিভিতে নিউস ছেড়ে মোবাইলে দেখছে। হুট করেই সে শুনতে পায় রিপোর্টার চড়া গলায় বলছে,
“আলাদা বসবাস করছে আদর্শ দম্পতি নায়িম-বাসন্তী, তবে কি ডিভোর্স হতে চলেছে তাদের?”

নায়িমের মাথায় হাত। মিডিয়াতে বাসন্তী ও তার সম্পর্কের বর্তমান অবস্থার কথা লিক হলে ইমেজ নষ্ট হতে দেরি লাগবে না। তবে এখন কী করবে সে? তাকে কী তার অপরাধী চেহারা নিয়েই উপস্থিত হতে হবে বাসন্তীর সম্মুখে? যদি তাই-ই হয় তবে বাসন্তী কি গ্রহণ করবে তার আবেদন?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here