টক্সিক_রিলেশনশীপ,৩৬,৩৭

0
1330

টক্সিক_রিলেশনশীপ,৩৬,৩৭
-ঈপ্সিতা শিকদার
৩৬
বেশ কয়েকদিন কেটে গিয়েছে নায়িমের নানীমায়ের মৃত্যুবার্ষিকীর। এর মাঝে একবারও নায়িম আর এই বাড়ির দোয়ারে এসে দাঁড়ায়নি। বাসন্তীর দিন কেটেছে কাজে ডুবে, আর রাত্রির সমাপ্তি ঘটেছে নায়িম নামক অনুভূতিতে নিমজ্জিত হয়ে।

বাসন্তী বর্তমানে উষ্ণ চা একটু একটু গলাধঃকরণ করতে করতে ভাবছে,
– তার তো খুশি হওয়া উচিত, ফিরে যাওয়া উচিত নায়িমের কাছে। বাসন্তীর তো জীবনে এই একটাই অপূর্ণ স্বপ্ন, কামণাই ছিল। তবে এখন যখন স্বপ্ন পূরণ হয়েছে সে আগলে নিচ্ছে না কেন?

উত্তর পেল না। শুধু জানে তার মনের গহীনে কোনো একটা কিছু আছে যার দ্বারাই বাধাপ্রাপ্ত সে। কী তা কে জানে?

ভাবনার মাঝেই দু’জন গৃহপরিচারিকা হাসাহাসি ও কথোপকথন শুনতে পায় সে।

“জানিস, ছোটো মালিকের ইইন্টারভিউ দেখাচ্ছে আরশ চ্যানেলে। কী যে সুন্দর লাগছে না উনাকে! মন চাচ্ছে ঠাশ করে একটা চুমু দিয়ে দেই।”

“তা যা বলেছিস! তার উপর উনার গান!”

“আরে ছোটো মালিকের তো বিশেষত্বই এটা যে উনি কোনোপ্রকার বাদ্যযন্ত্র ছাড়া গান গায়। উনার গানের গলা তো পুরাই মধু।”

রাগে গা পিলপিলাচ্ছে বাসন্তীর। ভেঙচি কেটে বলল, “আমার জামাইয়ের দিকে জরিনা থেকে ক্যাটরিনা সবাই-ই নজর কেন যে দেয়!”

তারপর কিছু একটা ভেবেই বেডরুমে ঢুকে সে। ছোট্ট একটা বারো ইঞ্চির এলসিডি লাগানো রুমটায়। সেটা ছেড়েই ইন্টারভিউ বের করে বসে সে।

সে চ্যানেলটি আনতেই দেখতে পায় ইন্টারভিউয়ার নায়িমকে বলছে,
“বাসন্তী ম্যাম ও আপনার সম্পর্ক নিয়ে অনেক ধোঁয়াশা। এই বিষয়টা নিয়ে আপনারা কেউ মুখ খুলছেন না কেন?”

“ধোঁয়াশাময় বিষয়গুলোই বেশ আকর্ষণীয়, তবে আমাদের সম্পর্কটাও নাহয় তেমনই থাক। আপনাদেরও তো লাভ এতে টিআরপি তো এই সুযোগে ভালোই লুটছেন।” জবাব দিয়েই ভুবন ভুলানো মুচকি হাসি দিল নায়িম। নীল চোখজোড়া যেন ঝলকানি দিয়ে উঠল সাথে।

অষ্টাদশী যুবতী ইন্টারভিউয়ার অপমানেও অপমানবোধ করলেনই না। বরং, নজর ঝুঁকিয়ে লজ্জারাঙা হাসি দিল।

“স্যার এভাবে হাসবেন না। আপনার হাসি যে কত হৃদয় ঘাতক তা যদি জানতেন… আর শ্যাম গড়নে নীল মণি তো আহা! যাকগে একটা গান শুনাবেন না এতদিন পর ফিরে এসে?”

“একটা নতুন গানই গাই। প্রিয় কারো উদ্দেশ্যে লিখা।”

“অবশ্যই”

নায়িম গাইতে শুরু করলো,
তুই ছিলিস, তুই আছিস,
তুই আমার আকাশে
রংধনু হয়ে ভাসিস।
তোর নামটুকু – হৃদ পাথরে লেখা,
চাইলেও মুছবে না কখনোই।

ভালোবাসি, ভালোবাসবো,
কতবার বললে তুই বুঝবি?
অভিমানের দেয়ালের ওপাড়ে
তুই ঘুমাস বড়োই স্বস্তিতে,
এপাড়ে নির্ঘুম রাত্রি কাটে।
অনুতাপে না বিরহতে কে জানে?
কে খবর টুকু-ই বা রাখে?

ভুল করেছি জানি,
মানি অপরাধী আমি,
যোগ্য নই তোর আর।
তবুও হৃদয় পুড়ে প্রণয়ের দহনে,
কী করে বাঁচব উপায় খুঁজে যাই।

আমি জানি না, জানি না, আমি জানি না।
শুধু জানি তুই হীনা আমি কিছু না,
এক ক্লান্ত পথিক পথ হারিয়েছে যে,
তৃষ্ণার্ত কোকিল বসন্ত দেখেনি যে।

আমি হারাতে চাই তোর শহরে আবার,
পথ খুঁজে নিতে চাই তোর হৃদয়ের,
ফিরে পেতে চাই বসন্তকে।
কারণ_
তুই ছিলিস, তুই আছিস।
তুই আমার আকাশে
রংধনু হয়ে ভাসিস।
(কবিতা – (রংধনু) ঈপ্সিতা শিকদার। ক্রেডিট ছাড়া কেউ কপি করবেন না)

বাসন্তীর সারা শরীর শিহরিত হলো। এই প্রথমবার নায়িমের গান শুনে এমন বোধ করছে। কারণ একটাই এই প্রথমবার নায়িম প্রকৃতপক্ষে অনুভূতি নিমজ্জিত কিছু তার জন্য গেয়েছে। আর তা বোধ করার ক্ষমতা রমণী তা রাখে। তবুও যে তৃষ্ণার্ত এই পথিক নায়িমের আকুতি তার হৃদয়ের মরুভূমি ভেজালো না। এমন কোন অনুভূতির বাঁধ দিয়েছে কে জানে?

___

ফাহিম দরজা খুলতেই দেখতে কূর্তি-পায়জামা পরিহিতা এক রমণী সামিরা রহমানের ঘরে গলা ছেড়ে গান গাচ্ছে। অর্ধভেজা চুলে ঢেকে আছে হাটুর নিচ অবধি। উলটো দিকে ফিরে হাঁটায় ঠিক দেখতে পাচ্ছে না যুবক। যদিও সে জানে এই নারী পূর্ণতা

“নেশা লাগিলো রে,
বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিলো রে।
হাসান রাজা পেয়ারির প্রেমে মজিল রে।
নেশা লাগিলো রে…”

গাইতে গাইতে দরজার দিকে ঘুরতেই হতবাক হয়ে গেল পূর্ণতা। নিজের হাত দিয়ে গা জড়িয়ে নিল। ফাহিমও তড়িৎগতিতে উল্টো দিকে ঘুরলো।

“তুমি দরজা বন্ধ করোনি কেন? আর কাপড়-চোপড় ঠিক-ঠাক রাখতে পারো না? এটা তো তোমার। পরপুরুষ থাকে।”

“সখা, আপন ছাড়িয়াছে মোরে, পরে করে লালন। এখন আর কে-ই আপন আর কে-ই পর?” ওড়না গায়ে মাথায় জড়াতে জড়াতে উত্তর দিল পূর্ণতা।

আজও পূর্ণতার কথার মানে ধরতে পারলো না ফাহিম।

“মানে? ”

“কিছু না। এখন এদিকে ঘুরতে পারেন। আর আমি লক করিনি তো কী হয়েছে? আপনিও তো নক করেননি।”

“হয়েছে। তোমার সাথে এখন তর্ক জুড়ার আমার ইচ্ছে নেই। এক কাজ করো খালাকে নিয়ে মার্কেটে যাও, আমার বসের ছেলের বিয়ে, সেখানে যাওয়া লাগবে।”

“তো?”

“কাপড়-চোপড় কেনা লাগবে না? তোমার তো বিয়েতে পরার মতো তেমন কিছু নেই।”

“আপনি কেন দিবেন? কে আপনি আমার?”

হচকচিয়ে গেল ফাহিম। নিরুত্তর রইলো। পূর্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে হাড়তাড় করে বেরিয়ে গেল।

পূর্ণতা হাসলো। তারপর তৈরি হয়ে মার্কেটে চলে সামিরা রহমানকে নিয়ে। সেখানে পরিচিত মুখে চোখ পড়তেই তাড়াতাড়ি সামিরা রহমানকে নিয়ে বাড়ি ফিরে সে।

___

চৈতালি দোলনায় বসে চন্দ্রবিলাশ করছে। খান বাড়ির ছাদটায় বিশেষ এক ব্যবস্থা আছে। ছাদের উপর ছোট্ট দুই কামরার ঘর, উপরে মুন রুফ করা। চন্দ্রবিলাশের জন্য একটা স্থান।

চৈতালির খুব ভালো লাগে এখানে। তবে আফসোস ভালো লাগা ভাগাভাগি করার মতো মানুষ নেই। সে নিজ উদ্যোগেই হারিয়েছে। আনমনেই বিড়বিড়ায় সে,

“অনুভূতি তুমি কেন এত একা?
বিবেক তুমি কেন দেওনি আগে সাড়া?”

“মিস. চৈতি এত রাত করে এখানে কী করছেন? মেয়েদের জ্বীন-ভূতের ভয় থাকে, আপনার নেই না কি?”

হাসিমাখা কণ্ঠ ও মুখশ্রীতে শুধালো অনিমেষ। এগিয়ে দিল বাম হাতের এক কাপ কফি। চৈতালি ম্লান হেসে হাতে নিল তা। এক চুমুক মুখে নিল।

“বাহ্! বেশ ভালো বানান তো আপনি!”

“হয়তো। আগে রাত রাত জেগে পড়ার জন্য বানাতে বানাতেই ভালো হয়ে গেছে মনে হয়।”

নিঝুম রাত্রি, নিঃশ্চুপ দুই মানব। অনিমেষ একবার পলকহীন ভাবে চৈতালিকে পর্যবেক্ষণ করলো। ধূসর রঙের থ্রিপিস পরনে। জীর্ণ, ফ্যাঁকাসে চেহারা, মলিন হাসি, কষ্টে টইটুম্বুর দাগ পড়া নয়নযুগল। তবুও কেন যে স্নিগ্ধ লাগে? হয়তো পবিত্রতার ছাপ তা।

খু-খু করে শুকনো কেশে নীরবতায় বাধাদান করে অনিমেষ। চৈতালি চোখ তুলে তাকায় তার দিকে। জিজ্ঞেসু দৃষ্টি রমণীর। শুকনো ঢোক গিলে যুবক।

“মাইন্ড করবেন না, একটা প্রশ্ন করবো। আপনার ফিরে যেতে মন চায় না ফাহিমের নিকট? অনেক তো হলো আমার মনে হয় আপনার এখন যাওয়া উচিত। আপনি তো জানেনই ফাহিম মিথ্যে বলেছে সে কোনো বিয়ে করেনি।

তাছাড়া এতকাল নিজের স্থান অযত্নে ফেলে রাখা উচিত নয়। সুযোগসন্ধানী মানুষের অভাব নেই দুনিয়াতে। কারণ যা আমাদের নিকট এভারেজ বা কম মূল্যবান, তা হয়তো কারো চোখে দামী। তাই যখন তখন শূণ্য স্থান দখল হতে পারে।”

“আমি তো তা-ই চাই। কেউ আসুক, অধীনে নিক ওকে। আমি ওর যোগ্য আর নই। বিশ্বাস করেন ক্ষমা চাওয়া তো দূরে থাক, ওর সামনে দাঁড়ানোর অবধি আমার সাহস নেই। তার উপর আপনারা সিঙ্গাপুর যাওয়ার পর অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম ডাক্তার দেখিয়ে জানতে পেরেছি আমার মা হওয়ার চান্স খুবই কম। অনেক তো পুড়িয়েছে ছেলেটাকে, নিজের অপূর্ণতার ভোগান্তি ওর হোক চাই না। ও ভালো থাক অন্যকারো সাথেই, যে পরিপূর্ণ করবে ওকে।”

চৈতালির কথায় ফ্যালফ্যাল চাহনিতে তাকায় অনিমেষ। সেদিকে ধ্যান নেই চৈতালির। সে কেমন যেন বিব্রত হয়ে পড়েছে সব ছেড়ে-ছুঁড়েই নিচে চলে যায় সে। অনিমেষ সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।

___

শুক্রবার দুপুর গড়িয়েছে মাত্র, তবুও উষ্ণ পরিবেশ। ফাহিম নতুন প্রজেক্ট সম্পন্ন করায় ব্যস্ত। পূর্ণতা ফাহিমের মায়ের পা মালিশ করে দিচ্ছে, সাথে সামিরা রহমানের সাথে পুরো দমে আড্ডা তো আছেই। এমন সময় ক্রিংক্রিং শব্দে ধ্যানভঙ্গ হয় সবারই।

পূর্ণতা সামিরা রহমানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আন্টি, আপনি বসেন। আমি দেখছি কে এসেছে।”

লক ঘুরিয়ে দরজা খুলে চোখ তুলে কে এসেছে দেখার আগেই জোরালো এক থাপ্পড় পড়ে পূর্ণতার গালে। রমণীর স্নিগ্ধ শুভ্র কপোল গোলাপের ন্যায় টকটকে লাল হয়ে উঠে হাতের ছাপ বসে গেছে।

স্তম্ভিত হয়ে তাকাতেই দেখতে পায় তার বাবা হামিদ ব্যাপারী, ভাই প্রবীণ ও কিছু মানুষজন দাঁড়িয়ে। সে অস্পষ্টভাবে ‘বাবা’ শব্দটি উচ্চারণ করতেই ধমক দিয়ে উঠেন হামিদ ব্যাপারী।

“চুপ! তোর এই পাপী মুখ দিয়ে আমার নাম উচ্চারণ করবি না। লজ্জা করে না একবার তো আকাম করায়া মান-ইজ্জত মারলি, আবার মারলি ভাইগ্যা!”

“আরে আব্বা ও আপনার কথা ভাববে কেন? না** জুটাইসে না!” প্রবীণ রাগান্বিত সুরে।

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে পূর্ণতা। হামিদ ব্যাপারীর মেয়ের অশ্রুতে কোনো ভাবনা নেই, তিনি বকা দিতে দিতে সেই সময়টুকুও পাচ্ছেন না।

চেঁচামেচি শুনে বসার ঘরে আসে ফাহিম ও সামিরা রহমান। সামিরা রহমান প্রথম দেখাতে হামিদ ব্যাপারীকে চিনে ফেলেন। তাই তিনি কথা না বাড়িয়ে পূর্ণতাকে আগলে নেন।

ফাহিম ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
“আপনারা কারা? ভদ্রতা বজায় রাখুন। আর পূর্ণতা তুমি কাঁদছে কেন?”

“আমরা কারা তুমি যেই মেয়েকে নিয়ে ভাগসো আমরা সেই মেয়ের পরিবার। বিয়ে তো করবা না আমার মেয়ে রে, শুধু ফাতরামি করতেই আনছো। বুঝি না আমি!”

“হোয়াট! কার কথা বলছেন আপনি? ওয়েট, পূর্ণতার কথা…? আপনি ভুল বুঝছেন। আমি অফিস থেকে ফেরার পথে দেখি কিছু নেশাখোর ছেলে ওর ক্ষতি করার চেষ্টা করছিল, আমি ওকে বাঁচাই।

তারপর জানতে পারি ও কানাডায় স্টুডেন্ট ভিসা পেয়েছে, তা রেখে না কি আপনারা এক বুড়োর কাছে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। তাই ওকে আমি আশ্রয় দিয়েছি, এই তো দিন কয়েক সামনেই ওর ফ্লাইট।”

“পূর্ণতা, তুই ওকে এসব বলেছিস?”

ভীত মুখশ্রী, নত দৃষ্টিতে কোনোরকম মাথা ঝাঁকায় পূর্ণতা। শুনে হামিদ ব্যাপারী হুংকার দিয়ে উঠেন।

“আরে আপনি রাগছেন কেন? আপনার তো আলহামদুলিল্লাহ বলা উচিত আপনার মেয়ে সেফ আছে। আবার এত ভালো পর্যায়ে যেতে পারছে। কোনো ক্ষতি তো হয়নি।”

“আর কী ক্ষতি হবে? যা ক্ষতি হওয়ার তা তো তিন বছর আগেই হয়েছিল।” ব্যধিত কণ্ঠ বয়স্ক পুরুষটির।

সামিরা রহমান আবেদন করেন,
“ঘরে বসে কথা বলি, ভাইসাব? মানুষজন দেখছে, খারাপ দেখায় বিষয়টা।”

সামিরা রহমানের দিকে না তাকিয়েই সায় জানান হামিদ ব্যাপারী। ছেলে ও সাথে আসা লোকগুলোকে নিয়ে সোফায় বসেন। চোখ উঠিয়ে খেয়াল করেন সামিরা রহমানকে।

“ভাবী, আপনি মোতালেব ভাইয়ের বউ না? আপনি তো আমার মেয়েকে চিনেন, তবে জানালেন না কেন? সবই তো জানা আপনার।”

একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন সামিরা রহমান। ফাহিমের কৌতূহল ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে। উত্তেজনা ধরে না রাখতে পেরে জিজ্ঞেস করে,

“এখানে কী হচ্ছে আমাকে কেউ বোঝাবে?”

“আসলে বাবা, এই শয়তান মেয়ে তোমাকে মিথ্যা বলেছে। ওর তিন বছর ধরে পড়ালেখা বন্ধ করেছি, স্কলারশিপ পাবে কোথা থেকে? তিন বছর আগে একজন ওকে ধর্ষণ… এরপর আর পড়তে দেইনি। তাও যদি মানুষ ভুলে এই কলঙ্কিনীর কলঙ্ককে ভেবে। বিয়েও হচ্ছিলো না ওর। আমি এত কষ্ট করে পাত্র যোগাড় করলাম। এই মেয়ে আমার কথা না মেনে ভেগে গেল!”

“ব-বিয়ে ঠিক করোনি তুমি আমার আব্বা। এক ষাট বছরের বৃদ্ধের বিছানার সাথী হওয়ার জন্য আমাকে বিক্রি করছো তুমি। তোমার ছেলের চাকরির জন্য টাকা জোগাড় করতে হবে না।”

“বেয়াদ্দপ মেয়ে!” প্রবীণ চেঁচিয়ে উঠে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে মারতে নেয় পূর্ণতাকে। ফাহিম বাধা দিয়ে ঢাল হয়ে দাঁড়ায় পূর্ণতার সম্মুখে।

“ছিঃ! কী নোংরা মানুষ আপনারা! সব শেষে নিজের ঘরের সম্মান বিকাতে বসেছেন?”

“খারাপটা কী? ছোটবেলা থেকে এই হারামজাদিকে খায়িয়ে-পড়িয়ে বড়ো করেছি, ওর দ্বারা একটু টাকা উঠালে সমস্যাটা কোথায়? আর ছেলে তুমি কে আমাদের বিষয়ে বলার? আমি ওর গার্ডিয়ান।” দাম্ভিকতার সুর স্পষ্ট

“পূর্ণতা, তোমার বয়স কত সার্টিফিকেটস্ অনুসারে?”

“বিশ পেড়িয়েছি এবার।”

“শুনেছেন? ও এখন এডাল্ট, আপনাদের দরকার নেই। তা আপনারা এখন নিজেরা আমার ঘর থেকে বের হবেন না আমি পুলিশ ডাকাব?”

হামিদ ব্যাপারী একবার তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে ফাহিমকে দেখে। সবাইকে নিয়ে বেড়িয়ে যান।

“আমাকে এভাবে ধোঁকা দিয়ে তুমি ঠিক করোনি পূর্ণতা!” রাগান্বিত কণ্ঠে বাক্যটি উচ্চারণ করেই হনহন করে নিজের ঘরে চলে যায় সে।

চলবে…

#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||৩৭তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নাহিদ কাঠের জীর্ণ চেয়ারে বসে ভয়ে কাঁপছে। সামনের মানুষটি যে ক্ষুব্ধ হয়ে পায়ে পা তুলে বসে।

নায়িম নিঃশ্চুপ হয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এই যুবককে। আজ তার মেজাজ বেশ চটে। শুধুই রেগেই নেই সে, ঈর্ষান্বিতও। সদ্য যুবক এই চাপদাড়ি ওয়ালা ছেলের কাছে কেন যেন ছোটো ছোটো লাগছে নিজে নায়িমের। বয়স তো তার কম নয়, ত্রিশের গণ্ডি পেড়িয়েছে অনেক সময় এখন। নিশ্চয়ই বাসন্তীর কাছে তার সমবয়সী ছেলের মূল্যই বেশি হবে।

সকালে যখন বাসন্তীর পিছনে আঠার মতোন লেগে থাকতে আদেশ দেওয়া গুপ্তচর ভিডিও পাঠালো ছেলেটির সাথে বাসন্তীর রেস্টুরেন্টে বসে হাসাহাসির, সেই মুহূর্তেই ঢাকার বারিধারা থেকে তুলে খান বাড়িতে আনার নির্দেশ জারী করে সে। আবার দোকানের সিসিটিভি ফুটেজ দেখেও অমর্ষিত হতে বাকি নেই তার। কত বড়ো সাহস এই ছেলের তার বসন্তকে দেখে মুচকি হাসে, পর্যবেক্ষণ করে।

আর থাকতে না পেরে নীরবতা ভাঙিয়ে নাহিদই প্রশ্ন করে,
“স্যার, আমি কি কোনো ভুল করেছি? আমাকে কেন তুলে আনা হয়েছে?”

“বাসন্তীকে কেমন লাগে তোমার?”

এমন বেমানান প্রশ্নে ঘাম ঝরে যায় যুবকের। নায়িম চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে তার দিকে।

“কী হলো উত্তর দিচ্ছো না কেন রাস্কেল!”

“খারাপ লাগে না স্যার। ভালোই তো ম্যাডাম। বুদ্ধিমতী, বুঝদার, দয়াশীল।”
কোনোরকম হেসে আমতা আমতা করে জবাব দেওয়ার প্রচেষ্টা নাহিদের।

নায়িম তৃপ্তি পায় না যেন চেয়ার থেকে উঠে, নিজ চেয়ারটাই লাথি মেরে ফেলে দেয় সে। নাহিদ বুঝলো প্রকৃত অর্থে আঘাতটা তার উদ্দেশ্যে ছিল।

“শোনো ছেলে, যা আমার তা অন্যকারো সামনে আসাও পছন্দ নয়। তাকে কেউ স্পর্শ করুক তো দূরে থাকে, মুগ্ধ চোখে দেখলেও সেই চোখ নষ্ট করতে আমার হাত কাঁপে না। বুঝলে তো?

আর আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং দামী রত্ন হলো বসন্ত। তার সাথে রেস্টুরেন্টে বসে কেউ হাসাহাসি করবে, চা, তান্দুরী খাবে… উহু, এ আমার সহ্যের বাইরে। ঐ মানুষটাকেই না আমি আগুনে ফেলে তান্দুরী বানাবো। তুমিই বলো ভালোবাসার মানুষের সাথে কাউকে সহ্য করা যায়?”

নাহিদের চেয়ারের দিকে ঝুঁকে অন্যদিকে তাকিয়ে ছটফটে ভঙ্গিমায় কথাটা বলে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে নাহিদের চোখে চোখ রাখে। তার ঠোঁটের কোণে অতি পরিচিত ক্রুর বাঁকা হাসি।

নাহিদ ভালোই বুঝলো নায়িমের ইঙ্গিতময় কথাবার্তা। তার বেহাল দশা, মূত্রত্যাগ করেনি সে সকাল থেকে। ভয়ে না ইজ্জতভ্রষ্ট হয়ে যায়। ভয়ে ভয়ে মাথা ঝাঁকায় সে।

নায়িম যুবকের মাথার চুলগুলো বা’হাতে এলোমেলো করতে করতে শুধায়,
“যাকগে সেসব, শুনলাম তোমার না কি ম্যানেজারের পোস্টে চাকরিটা করতে ভালো লাগছে না? তাহলে আগামীকাল থেকে আর চাকরিতে যাচ্ছো না, বাসায় থাকছো তাই না?”

সঙ্গে সঙ্গে মুখ খুলল নাহিদ,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি আর কোনো চাকরি-বাকরি করবো না। বাড়ি যেয়েই মধু মিয়াকে কল করে রিজাইন করবো।”

নায়িমের চোখে-মুখে তৃপ্তি। পাশের কালো পোশাকধারী তরুণ দুজনকে ইশারা করতেই নাহিদের হাত ধরে তারা কক্ষের বাহিরে চলে যায়।

পাশে দাঁড়িয়ে আপন ধ্যানে মুড়ি চাবাতে থাকা অনিমেষকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“দেখলি কেমন শায়েস্তা করলাম একে! আর কোনো ছেলে যাতে বাসন্তীর আশেপাশেও না আসে। স্পেশালি অল্পবয়স্ক ছেলে তো না-ই।”

“আরে ব্যাটা এত হিংসা করিস কেন? তাও আবার এদের সাথে! এগুলো তো তোর…”

“নখের যোগ্যও না, তাই তো? কাউকে ছোটো ভাবে দেখা ঠিক না, বিড়াল কখন বাঘ হয়ে যায় বলা যায় না।”

“আরে ব্যাটা বলতে তো দিবি। আমি কি কমন ডায়লগ দিব না। তাছাড়া তোর মতোন নখ অনেকের আছে। এগুলোর তোর পাদেরও যোগ্যতা নেই।”

“হোয়াট অনি! ইয়াক!”

“আরে সত্যিই তো বলসি। তোর পাদে যেই গন্ধ, তা আর সারা দুনিয়ার কারো পাদে নেই।”

“হ, তোর সামনে দিয়েছিলাম তো, আর তুই শুঁকেছিলি!” মুখ ঝামটা দিয়ে চলে যায় নায়িম।

অনিমেষ মুড়ি চাবাতে চাবাতে বিড়বিড়ায়,
“শালা রে একদিনও রোস্ট করতে পারলাম না। ও-ই আমাকে রোস্ট করে দেয়।”

___

মাথায় কারো স্পর্শ অনুভব হওয়ায় ঘুম থেকে হুড়মুড়িয়ে জেগে উঠে ফাহিম। তন্দ্রাভাব কাটতেই দেখতে পায় পূর্ণতা। কিছুটা বিব্রতভাব আসে তার মাঝে।

“পূর্ণ, তুমি এখানে এভাবে…?”

“জী, আমি এখানে, এভাবে। আমার ছোঁয়ায় বুঝি গা ঘিনঘিন হচ্ছে আজ আপনার? কারণ বুঝি আমি ধর্ষিতা, কারো ব্যবহার্য বলেই? কিন্তু এখানে আমার কী দোষ ছিল? আমি তো ইচ্ছে করে করিনি এসব। আপনিও তাড়িয়ে দিবেন আমায়?” ফুঁপিয়ে ফুঁপিতে নাকে-কানে লালচে আভা ছড়িয়ে কেঁদে উঠে রমণী।

সামলাতেই একটু এগিয়ে যেয়ে গাল মুছে দেয় ফাহিম। উদ্বিগ্নচিত্তে শুধায়,
“তুমি ভুল ভাবছো পূর্ণ। আমি এটা বুঝাইনি। না তোমাকে আমি তাড়াবো। তোমার দোষ নয় তা। এতটা কাছে তো কখনো আসেনি, তাই… এটা ঠিক নয়।”

“আপনি আমাকে তাড়িয়ে দিবেন না ভালো। তবে কেন আপন করে নিচ্ছেন আমায়? বুঝেন না ভালোবাসী? এত অবুঝও কোনো পুরুষ হয় না যে নারীর ভালোবাসার আবেদন বুঝবে না।”

থমকে যায় ফাহিম। সত্যিই সে প্রতিবার বুঝেছিল পূর্ণতার আবেদন, ইশারা। তবে প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ছিল শুধুই না বুঝার ভান। কারণ কোথাও একটা বাধা। কীসের বাধা কে জানে? হয়তো অতীতের, প্রথম প্রেমের, সম্পর্কের টানে।

জাগতিক, দৈহিক, মানসিক চাহিদা ও নিঃসঙ্গতার কাছে হার মানা ক্লান্ত মস্তিষ্ক বারবার বলেছিল এ ইশারায় সাড়া দিতে। যুক্তি দেখিয়েছিল, ‘একা সারাটা যৌবন কাটানো খুব করুণ, তার চেয়ে মুশকিল নিঃসন্তান জীবন, আর সবচেয়ে কঠিন বার্ধক্যে একা কাটানো’। তবুও হৃদয়ের কোনো এক কোণ থেকে, গহীন থেকে বাঁধায় সে সাড়া দেয়নি। আজও পারলো না।

“পূর্ণ, নিজের ঘরে যাও। তোমার হুশ নেই উত্তেজনায়। পরে কথা হবে।”

“আমার জ্ঞান একদম ঠিক আছে। এত লুকোচুরি কেন ফাহিম? চৈতালি আপু তো চলে গেছেন। একবারও ফিরে তাকাননি, আমাকে কেন কাছে টেনে নিচ্ছেন না আপনি?”

“যতো যাই হোক, চৈতালি এখনও আমার স্ত্রী। আমি বিবাহিত তা এতটাও ভুলো না। ওর থেকে দূরে থাকলেও তালাক দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।”

“কবুল করলাম, ফাহিম।”

“তুমি বুঝছো না কেন পূর্ণ? আমাকে বিয়ে করা মানে ধ্বংস বৈকী কিছুই না। কারণ আমি চিনি আমাকে, চৈতালি যতই ভুল করুক, চক্ষুর সম্মুখে ওর আকুতি দেখলে সারা দুনিয়া ছেড়েও আমি ওর দিকেই অগ্রসর হবো। তখন মেনে নিতে পারবে?”

“কবুল।”

“আমি তোমাকে ভালোবাসি না। চৈতালির জায়গা তুমি কখনোই পাবে না।”

“কবুল। তবুও আমাকে সহধর্মিণীর জায়গা দিন। সতীনের সংসার, অবহেলার সংসার করতেও আমার অভিযোগ নেই। সবশেষে নাহয় আমাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্যই বিয়ে করুন। আমি বেহায়া হয়েছি ফাহিম, নিজের রূপ, গুণ, কাজ সব দিয়ে আপনাকে চেয়েছি। চৈতালি আপুর আকুতি দেখে ভালোবাসা জাগলে, আমার আকুতি দেখে কি করুণাও জাগে না?”

“ঘরে যাও, পূর্ণ। আমি রেগে যাচ্ছি।”

ধমকের সুর ফাহিমের। পূর্ণতা কেঁপে উঠে মুখে ওড়না চেপে চাপা ক্রন্দনের সহিত স্থান ত্যাগ করে।

ফাহিম ফোঁস করে এক নিঃশ্বাস ফেলে। তার মন, মস্তিষ্ক দুটোরই শোচনীয় দশা। কোথায় যাবে বা কী করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। হুট করেই ফোনটা হাতে নিয়ে কল করে চৈতালির নম্বরে। তার স্বস্তির জায়গাটি যে এই নারীটিই ছিল, আছেও হয়তো।

চৈতালি বসে বসে সাদিয়া খান সুবাসিনীর সূর্যতামসী পড়ছিল। কল আসায় বিরক্তি নিয়ে ফোনটা হাতে নেয় সে। স্ক্রিনে ভেসে উঠা নাম পড়তেই দমবন্ধ অনুভূতি হয় তার, হাত-পা কম্পিত হচ্ছে সমান তালে। কলটা কাঁপা হাতেই কেটে দেয়।

“কলটা কাটলেন কেন, চৈতি? হয়তো ফিরে পেতে চলেছিলেন ভালোবাসা।” অনিমেষ জিজ্ঞেস করে উঠে। সে সদ্যই ঘরে ঢুকেছিল।

“এখন সম্পর্কটা ফিরে পেলেও আগের সম্মানটা পাব না। প্রিয় মানুষটার চোখে দেখবো না আর নিজের জন্য বিশ্বাস। ঝগড়াতে হয়তো রাগের মাথায় অজান্তেই খোঁটা দিয়ে আমার হৃদয় ভঙ্গ করে বসবেই।

জানেন তো, পরের কথা সহ্য করার ক্ষমতা থাকে, আপন মানুষের না। কিছু ক্ষেত্রে দূরত্বই ভালো। ভালোবাসাটা তাও ভালো থাকে। অনেক তো মলিন হলো আর কত?”

চৈতালি লাগোয়া ওয়াশরুমে চলে গেল। অনিমেষ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওয়াশরুমের দরজার দিকে।

এদিকে ফাহিম কল কেটে দিয়েছে বুঝতে পেরে কষ্টে, রাগে বৃষ্টি নামিয়েই ফেলল আজ নয়নযুগল থেকে। রিনরিনে গলায় বলল,
“বিরহ তো আমি দিয়েছিলাম, অভিমান এবার আমার পাওনা ছিল। ভাঙানোর চেষ্টা অবধি করোন। ভুল করার অধিকারের সাথে, অভিমানটাও বুঝি তোমার?”

___

বাসন্তী ঢাকা এসেছে মধু মিয়ার সাথে। গতকালই রিজাইন করেবে বলেছে নাহিদ মধু মিয়াকে। কাল পর্যন্ত হিসাবটা বুঝে নিতেই আসা রমণীর। যদিও যুবকের হুট করে চাকরি ছাড়ার বিষয়টি তার বোধগম্য হলো না।

সব হিসাব বুঝে খাতা নিয়ে আপাদত সেলসম্যানের ভরসায় শো-রুমটি রেখে বের হয় সে। গাড়ির দরজা খুলতেই দেখতে পায় চন্দ্রমল্লিকার সমাহার, একটি চিরকুটও সাথে। তবে কি নব দিওয়ানা এলো বাসন্তীর?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here