টক্সিক_রিলেশনশীপ,৩৮,৩৯ শেষ ১ম অংশ

0
1506

টক্সিক_রিলেশনশীপ,৩৮,৩৯ শেষ ১ম অংশ
-ঈপ্সিতা শিকদার
৩৮
বাসন্তী ভ্রু কুঁচকে ফেলে এসব দেখে। ড্রাইভারের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাতেই দেখে সে নত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। বাসন্তীর বুঝতে বাকি রইলো না এই কাজ করেছে। গম্ভীর মুখেই ফুলগুলো এক সাইডে চাপিয়ে গাড়িতে বসে সে। কী মনে করে যেন চিরকুটটা হাতে তুলে নেয় সে।

উদাস মনে চিরকুটটা খুলতেই,
“ও গো উদাস মনা কন্যা প্রিয়তমাসু বসন্তকুমারী,
আমার হৃদয় পোড়ার গন্ধও কি বলে না বড্ড ভালোবাসি?”

এই ছোট্ট দুই চরণের বাক্যে কী ছিল কে জানে? বাসন্তীর উদাস মনে জাদুর মতো কাজ করলো। উত্তেজনায় ধুকধুক শব্দটা বেড়েই চলেছে।

আপন মনেই বিড়বিড়ায় সে,
“ও গো গম্ভীর মুখো শাস্তিপ্রাপ্ত প্রিয়তমেষু,
হৃদয়ের গহীনে আমি আজও তোমারেই তো পুষি।”

জানালার দিকে তাকাতেই দেখতে পায়, তাদের গাড়ির সাথে পাশে তালে তাল মিলিয়ে আরেকটি গাড়ি চলছে। গাড়িতে বসে থাকা মানুষটি বাসন্তীর খুব অপ্রিয় প্রিয়জন তথা নায়িম। তাই তো তাকিয়েই মুখ ফিরিয়ে নেয় রমণী। নিকাবের আড়ালে তার মুখশ্রী শুধু বাঁকা দুই ঘোলাটে চোখই দৃশ্যমান

যুবক একটু আশাহত হয় সত্য, কিন্তু পরাজিত হয়নি। বরং, বাসন্তীর দিকে তাকিয়েই সে গেয়ে উঠে,

“ছটফট করে মনটা আমার,
সুখ গেল মরিয়া।
প্রেয়সীটা পাষাণ হইসে
দেয় না মোরে দেখা।”

বাসন্তী ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে নায়িমের দিকে তাকায়। নায়িম চোখ টিপ দিয়ে বাঁকা হাসে। রমণী খেয়াল করে ড্রাইভার এবং মধু মিয়াও মিটিমিটি হাসছেন।

সে হুংকার দিয়ে বলে,
“গাড়ির স্পিড বাড়াও! বাসায় যেতে হবে নাহিবার কাছে!”

ড্রাইভার তাড়াতাড়ি গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে নায়িম্ব্র গাড়িকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যায়। এতক্ষণ ইচ্ছে করেই কম গতিতে চালাচ্ছিলো, দুটো গাড়ির তাল মিলানোর জন্য।

বাসন্তী নাকের পাটা ফুলিয়ে মনে মনে শুধায়,
“যখন আমি প্রেয়সী তখন তুমি হৃদয়হীন মানব,
যখন তুমি প্রেমিক তখন আমি অভিমানী,
ভাগ্যের লিখনটা এমন কেন হলো?”

___

– পূর্ণতা চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে গভীর ভাবনায় ডুবে। হুট করেই এক ছায়ামূর্তির আগমন হয় তার চোখের সম্মুখে। একটু অবাক হয় সে।

ছায়ামূর্তিটি হাসির ছন্দে বলল,
“চিন্তা কোরো না। আমি তোমারই অংশ, তোমার বিবেক। তোমাকে কিছু প্রশ্ন করতে এসেছি। সারাজীবন ভালোর পথে চলে, আজ এত নিচে নেমে গেলে? এতটা পাপের বোঝা নিয়ে থাকতে পারবে?”

বিব্রত হলো না পূর্ণতা। বরং, তার চোখে-মুখে আবিষ্কার হলো তাচ্ছিল্যের হাসি।

“ভালো থেকে, পর্দা করে, নিজের চরিত্রকে হেফাজত করে কী পেয়েছি? ধর্ষিতা হওয়ার ছাপ? পদে পদে নিজ পরিবার সহ প্রতিটি মানুষের কটূক্তি? দোষী না হয়েও এত অপমান, অবজ্ঞা, কষ্ট নিয়ে যেহেতু বেঁচে গিয়েছি। পাপের বোঝা নিয়েও বাঁচবো।”

“এতও সহজ না সবকিছু। নিজের করা অন্যায়ের ফল এই পৃথিবীতেই পেতে হয় তা কি ভুলে যাচ্ছো?”

“ভুল বললে এই পৃথিবীতে খারাপই ভালো থাকে, ভালোরা খারাপ। পাশের বাড়ি কাকী আমার চরিত্র নিয়ে দশ কথা শুনিয়ে যায়। আমার চরিত্রে বারবার কালিমা লেপণ করে। অথচ, তার নিজের মেয়েই দিন নাই, রাত নাই বাড়ির বাহিরে যায় প্রেমিকদের সাথে। কই? সে তো রেপ হয়নি। হয়েছি আমি। আর বলবে নাই বা কেন? এতকিছুর পরও তার মেয়ের বিয়ে দিতে তেমন কাঠখড় পোড়ানো লাগেনি।

এমন কী আমাকে রেপ করা ঐ কুত্তাটাও লকআপের বাহিরে বের হয়ে বুকেরপাটা ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সেই জানোয়ারটারও বিয়ে হয়েছে, সন্তান-সংসার সব হয়েছে। দুনিয়া, সমাজ সবাই তার অপরাধটা ভুলে গেছেই প্রায়।

অথচ, আমি যে কি না জীবনও কোনোদিন কাউকে কটূক্তি অবধি করিনি, কোনো হারাম সম্পর্কে জুড়া তো দূরে থাক, কোনো নন-মারহামের সাথে কথা অবধি বলিনি। এমন কী যাকে ভালোবেসেছি তাকে আড়চোখে দেখা ছাড়া, কথাও কখনো বলিনি।

তবুও তো আমিই আজ ধর্ষিতা। যেখানে এসব জানোয়ার, এমন কী আধুনিক পতিতারাও বুক ফুলিয়ে চলে, আমায় থাকতে হয় ঘরে লুকিয়ে। ভালো হয়ে দেখেছি। দুনিয়া আমার সাথে ভালো করেনি। উল্টো যারা খারাপ, তারাই সুখে আছে, সম্মানিত সবার নিকট।”

“এক পরপুরুষকে নিজের করতে এক পরপুরুষকে এতটা আকৃষ্ট করা…? তাও যে পুরুষ আগে থেকেই বিবাহিত তার সাথে!”

“সতী থেকে তো দেখেছি, কিছুই জুটেনি কপালে অপমান, কষ্ট, ক্ষত, অবজ্ঞা, কটূক্তি ছাড়া। এখন বেহায়া হয়ে নিজের আকাঙ্ক্ষাপূরণ করতে ক্ষতি কী? সবাই স্বার্থপর হয়ে নিজেরটা দেখেছে। বাবা তার ছেলের চাকরির জন্য আমাকে বিক্রি করতে দমেনি, মা তার সংসার বাঁচাতে আমাকে রক্ষা করতে আগায়নি। কই? তখন তো কারো গায়ে কাঁটা লাগেনি।

আমাকে যখন দিনের পর যা তা ভাষায় গালাগাল করতো বাবা, মা মারতো। ভাই অভুক্ত রাখতো। তখন কেউ এগিয়ে আসেনি। আর ফাহিম বিবাহিত তো কী হয়েছে? চৈতালি তো নেই এখানে। সে চলে গেছে। সে তো এসে আগলে নিচ্ছে না তার সংসার। সেখানে আমি নিঃস্ব মানুষ আগলে রাখলে ক্ষতি কী? বরং, আমি তো আর যত্ন করছি। তাহলে কেন তুমি খারাপ বোধ করাচ্ছো আমাকে?”

“হয়তো মেয়েটা অনুতাপে ফিরে আসছে না। আর যত যাই হোক সংসারটা আজও তার। তুমি বুঝো পূর্ণতা, যা অন্যের তাতে মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই।”

“চাইলেই সব নিজের হয়। চেষ্টা করতে ক্ষতি তো নেই। এমনেই তো আমার সব শেষ। একবার স্বার্থপর হয়ে সুখ ধরার চেষ্টা তো করতেই পারি। আমি ফাহিমকে জেতার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। আর আমার ওয়াদা কখনো অমর্যাদা করবো না আমি ফাহিমের!”

“না,পূর্ণতা। পরের সুখ ছিনিয়ে কখনো নিজের কপালে আনা যায় না। কখনোই না! তুমি কখনোই ফাহিমকে পাবা না।”

“না!” চেঁচিয়ে উঠে সে।

ঘুম ভেঙে যায় পূর্ণতার। সারা শরীর ঘামে গোসল হয়ে গেছে। কী অনাকাঙ্ক্ষিত এক স্বপ্নই না দেখলো সে!ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বেলা এগারোটা, সব ভাবনা ছেড়েই বিছানা ছাড়ে সে।

___

অনিমেষ আপন মনে কোল্ড কফির স্ট্রয়ে ঠোঁট বসিয়ে পান করে চলেছে। ফাহিম বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। তখনই ফাহিমের ফোনে একখানা কল আসে আননোন নাম্বার থেকে।

“হ্যালো, আমি পূর্ণতার বাবা বলছি। তোমাকে সোজা সোজা জিজ্ঞেস করছি, তুমিও আমাকে সোজাসাপটা উত্তর দিবে। তুমি কি আমার মেয়েকে বিয়ে করবে?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফাহিম দৃঢ় গলায় জবাব দেয়, “না।”

“বিরক্ত হচ্ছেন? আসলে এখানকার কফি আমার খুব পছন্দ।”

“আমার একটু তাড়া আছে, কী জন্য ডাকিয়েছেন তা খাণিক তাড়াতাড়ি বলেন।”

“চৈতালি… ”

“খুব ভালো আছে। ডিভোর্স চাই ওর নতুন সংসার পাততে, তাই তো?”

“আরে মিস্টার পুরো কথা তো শেষ করতে দিন। আপনার মিসেস আপনাকে ছাড়া একটুও ভালো নেই। সে প্রতি মুহূর্ত নিজের পাপের অনুতাপের দহনে পুড়ছে।”

“হুম, বেশ ভালো অনুতপ্ত সে। তাই তো আমার কল রিসিভ করেনি। একবারও আমার রাগ, অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করেনি। ওর কাছে আদৌ আমার, এই সম্পর্কের এক আনা মূল্য আছে কি না তা-ই সন্দেহ।”

“হয়তো অনুতপ্ত বলেই চাচ্ছে না আপনার কাছে ফিরে যেতে। এছাড়াও একটা কারণ আছে।”

অনিমেষ পকেট থেকে নিজের ফোন বের করে। চৈতালির ফাহিমের কল কাটার পর তার ও নিজের কথোপকথন মোবাইলে রেকর্ড করে রেখেছে। সেটাই চালু করে শোনায়।

পুরো রেকর্ডিং শুনে ফাহিম স্তব্ধ। আনমনেই ভাবছে,
– তবে সত্যিই কি চৈতালি বদলে গিয়েছে? হয়ে গিয়েছে তার পুরনো চৈতালি, যার কি না প্রেমে পড়েছিল সে ছাত্রজীবনে? সেই সাদাসিধা মেয়েটি, যার সাজসজ্জাহীন রূপেই ঘায়েল ছিল সে।

অনিমেষ বুঝতে পার তার মনের অবস্থা। হাতে হাত রেখে আত্মস্থ করে বলে,
“দেখো এখনো, সময় আছে, ভালোবাসাকে হারিয়ে যেতে দিয়ো না। ভালোবাসা হলো ছোট্ট সূচের মতোন, আর পৃথিবী শস্যক্ষেত। এই পৃথিবীতে একবার তা হারিয়ে গেল, আর খুঁজে পাবে না কখনোই। চৈতালি আজ কানাডা চলে যাচ্ছে নায়িমের চাচার কাছে। আটকাবে না তাকে? আগলে নিবে না বুকে?”

ফাহিম মাথা ঝাঁকায়, নিঃস্তব্ধ তার চোখ-মুখ। কিছু বলবে তার পূর্বেই সশব্দে বেজে উঠে তার ফোন। কল রিসিভ করে কানে ধরতেই সামিরা রহমান উৎকণ্ঠার সহিত দ্রুতো বাসায় ফিরতে বলে। কোনো বিপদ হয়েছে কি না ভেবে ফাহিমও বড় বড় পদচারণায় রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যায়।

যাওয়ার আগে শুধায়,
“ওকে একটু আটকে রেখো আমি আজই ফিরবো ওর কাছে।”

বাড়িতে ফিরে দেখতে পায় সামিরা রহমান মাথায় হাত দিয়ে চাপা কাঁদছেন। আতঙ্কিত হয় সে।

“কী হয়েছে? এভাবে আসতে বললে যে… আর তুমি কাঁদছোই বা কেন?”

“পূর্ণতাকে ওর বাবা-ভাই নিয়ে গেছে। ওর বাপ যে আধবুড়োটার সাথে বিয়ে ঠিক করেছে, সে বড়োই গণ্যমান্য লোক। নেতা! নেতা! উনিই লোক নিয়ে এসে সবার সামনে হামিদ ব্যাপারীকে দিয়ে তোরে ফোন দেওয়ায়। তুই না বলার ওরে জোর করে নিয়ে চলে গেসে।

মেয়েটা কত কান্নাকাটি করলো তাও ফিরাতে পারলো না। তোর জন্য ঐ মেয়েটার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। তুই জানিস ঐ আধবুড়ো ওর বাপের চেয়েও বড়ো বয়সে। কম করে হলে পয়ষট্টি হবে। হায় রে কপাল! এমন ভালো মেয়েটার সাথে…! সব গুছায়া যাওয়ার আগে তোরে একখান চিঠি লেখে গেছে।”

সামিরা রহমান ফাহিমের হাতে একটা ছোট্ট কাগজ ধরিয়ে দিলেন। একে চিঠি না বলে চিরকুট বলাই বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। ফাহিম চিরকুটটি খুলে দেখে তাতে গোটা অক্ষরে লিখা,

‌‌‌‌‌ >< জানি পড়বেন কি না, তবুও লিখে যাচ্ছি। আপনি বিনা আর কারো নামে কবুল বলার আগে এই দেহ হয় রক্তশূণ্য হবে নাহয় বিষপূর্ণ। তবে মৃতুতে হবেই। - পূর্ণতা ফাহিমের পায়ের নিচ থেকে যেন জমিন সরে যাচ্ছে। এ কোন দ্বিধায় ফেললো তাকে সৃষ্টিকর্তা। একদিকে চৈতালিকে দূরে যাওয়া থেকে আটকাতে হবে, অপরদিকে পূর্ণতাকে মৃত্যু থেকে। এ যেন বিবেক আর ভালোবাসার যুদ্ধ। জয়ী হবে কে? ___ ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে নাহিবাকে কোলে তুলে নেয় বাসন্তী। অসংখ্য চুমুতে ভরিয়ে দেয় ছোট্ট মেয়েটাকে৷ ছোট্ট শিশুটিও সারাদিন পর মাকে দেখে কী মায়াবী হাসিই না দিচ্ছে! সাহেরা বানু দরজায় নক করেন। বাসন্তী মেয়ের সাথে খেলতে খেলতেই ভিতরে আসতে ইশারা করে। "এই যে ছোটো বউমা, কে যেন এই বক্সটা বসার ঘরে রাইখা গেসে। উপরে তোমার নাম লিখা।" "যে পাঠিয়েছে তার নাম নেই?" "না, খালি তোমার নামই লিখা।" বাসন্তী নাহিবাকে রেখে বক্সটা হাতে নেয়। সাহেরা বানু প্রস্থান করেন। ছোট্ট কাগজের বক্স। খুলতেই দেখে ভিতরে দুটো চিরকুট। "বেনামি চিঠি পাঠিয়েছে প্রিয়তমা, ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। তারাই প্রকাশ করে দিবে চিঠিটি কার।" "আমি সেই তৃষ্ণার্ত কোকিল, বসন্ত। একটু আসবে? একপলকের দর্শন দিয়ে আমায় আনন্দিত করবে?" বাসন্তীর না ভেঙে অভিমান, না ক্ষতের জ্বালাতন। তবে ভালো লাগছে, ভীষণ রকমের সুখানুভূতি তার হৃদয়ে। প্রিয়জনের চিঠির মায়াই হয়তো এমন। তা সে প্রিয় যতোই অপ্রিয় হোক না কেন! চলবে... #টক্সিক_রিলেশনশীপ ||শেষ পর্ব|| -ঈপ্সিতা শিকদার ফাহিমের পিছু পিছু অনিমেষও আসে ফাহিমের বাসায়। দরজায় দাঁড়িয়ে সামিরা রহমান ও ফাহিমের কথোপকথন শুনে বেশ কনফিউজই হয়ে পড়ে সে। পরে ফাহিমের সম্মুখে এসে প্রশ্ন করলে সে একবিন্দুও লুকায় না, সব বলে দেয়। অনিমেষ ভীতু গলায় তাকে প্রশ্ন করে, "তাহলে তুমি কার সাথে থাকতে চাও বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছো?" "অবশ্যই চৈতালি। এক ছাদের নিচে একসাথে বসবাস করলে নিঃসঙ্গ, প্রতারিত হৃদয়ের কারো প্রতি মোহ তৈরি হবে, সেটা অস্বাভাবিক নয়। তার উপর পূর্ণ আমার যত অপূর্ণ চাওয়া ছিল নিজের বৈবাহিক সংসার থেকে সব পূর্ণ করছিল। মোহ একটা তৈরি হয়েছিল তা সত্য। তবে পূর্ণতা সবসময়ই আমার চাহিদা ছিল। চাহিদা কখনোই ভালোবাসার চেয়ে বড় হয় না। কিন্তু এভাবে বিবেকের কাছে হেরে আমি কী করে চৈতালির কাছে...?" "তুমি চৈতালির কাছে যাও। আমি পূর্ণতার বাড়িতে যাচ্ছি। আমার ওয়াদা কোনো ভাবেই মেয়েটার জীবন নষ্ট হতে দিব না।" অনাকাঙ্ক্ষিত খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠে ফাহিমের চোখজোড়া। কিছু একটা ভেবেই কাগজ কলম নিয়ে বসে সে। অনিমেষের কাছে আবেদন করে, "তোমাকে ধন্যবাদ জানানোর ক্ষমতা নেই আমার। আরেকটা আবেদন করে এই চিঠিটা পূর্ণতাকে দিয়ো।" "ঠিক আছে, বাহিরে গাড়ি ড্রাইভার সহ অপেক্ষা করছে। তুমি খান বাড়িতে চলে যাও। আমি আসছি।" ___ ব্যালকনিতে আনমনেই বসে আছে চৈতালি। দৃষ্টি স্থির তারাময় আকাশটির দিকে। হুট করেই কেউ নিজের উষ্ণ বন্ধনে আবদ্ধ করে নেয়। সচকিত হয়ে পিছনে ঘুরে চৈতালি। অবাক কণ্ঠে অস্ফুটভাবে বলে উঠে, "ফাহিম?" ফাহিম নৈশব্দে জড়িয়ে ধরে তাকে। চৈতালিও পরম আবেশে চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলে। "তুমি এসেছো ফাহিম? আমি জানতাম তুমি আসবেই, তুমি তো আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো।" "এতটা কষ্ট নিয়ে কেন ছিলে চৈতি? একবার আসতে আমার দোয়ারে চৈতি। বুঝাতে তুমি বদলে গেছো।" ফাহিমের বচন শ্রবণগত হতেই চৈতালি তড়িৎ গতিতে তার বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যায়। ছলছল চাহনি তার চোখজোড়ায়। "তুমিই তো বলেছিলে আমাকে ক্ষমা করা যায় না। আমি টাকার মৌমাছি, যেদিকে টাকা দেখি সেদিকেই যাই। তোমার পরোয়া করি না কত কী! তবে ফিরে কেন যেতাম?" কথাটা শুনেই ফোঁস করে এক নিঃশ্বাস ফেলে ফাহিম। কী অভিমানী কণ্ঠ যে আজ রমণীর! "আমার রাগ, তোমার প্রতি বিক্ষুব্ধ হওয়া কি জায়েজ ছিল না? আমি যা বলেছিলাম তা কি মিথ্যেই ছিল? অভিমান, রাগ আমার ছিল। ভাঙানোর দায়িত্ব তোমার ছিল। তুমি কী করলে? নিজের অহং নিয়ে বসে থাকলে।" "মোটেও এটা ভেবো না ফাহিম। আমি দাম্ভিকতায় তোমার দরবারে যাইনি, এমন নয়। যাইনি হীনমন্যতায়, যাইনি অনুতাপে, যাইনি লজ্জায়। যতবার তোমার প্রতি হাত বাড়াতে গিয়েছি ততবার আমি আদৌ তোমার যোগ্য কি না এই প্রশ্নে, এই দ্বিধায় বাধাগ্রস্ত হয়েছি। আমার অপরাধটা এত বড়, কী করে তোমার কাছে যেয়ে ক্ষমার আবেদন করতাম? তার উপর আমার প্রেগন্যান্সির কমপ্লিকেশনস্..." ফাহিম পুনরায় বুকে আগলে নেয় প্রেয়সীকে। এই রমণী যে একান্তই তার। শুধায়, "বাচ্চা হওয়া, না হওয়া আল্লাহর কাছে। তাই অতীতের সব কথা বাদ দাও। এখন আমাদের আবার এক হওয়ার দিন এসেছে। যাবে না আমার সাথে? আমাদের সংসারে?" চৈতালি মুখ লুকায় যুবকের বুকে। অস্পষ্টভাবে "হুম" উচ্চারণই তার সম্মতি। ___ অনিমেষের সাথে গাড়িতে বসে আছে পূর্ণতা। অনিমেষ মৃদু কণ্ঠে পানি এগিয়ে দিয়ে শুধায়, "একটু পানি পান করবেন? ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে।" "না, ধন্যবাদ। ফাহিম কোথায়?" "চৈতালির কাছে। আমি নিজে উঠিয়ে দিয়ে এসেছি গাড়িতে। তোমাকে এই চিঠিটা দিয়েছে ফাহিম।" অনিমেষ ভাবছিল মেয়েটা কাঁদবে, ভাঙবে, রাগবে; কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। চমকিতও হয় না পূর্ণতা। বেশ স্বাভাবিক ভাবেই চিঠিটা খুলে। পূর্ণতা, জানি আমার উপর রাগ তোমার, নিরাশ তুমি। তবে তুমি নিজেই একবার ভাবো আদৌ আমার মনে প্রিয়জন হিসেবে নিজের পৃথক জায়গা তুমি নিয়েছিলে? না, তুমি চৈতালি হয়ে চৈতালির জায়গা টুকু চেয়েছিলে। চৈতালির পোশাকাদি, পছন্দ আপন করে নিয়েছিলে আমাকে নিজের করতো। চৈতালি যেসব জায়গায় অপূর্ণ ছিল, তুমি সেসবে নিজেকে পারদর্শী দেখিয়েছো। আমি মুগ্ধ হয়েছি ঠিকই, মোহে পড়েছি ঠিকই। তবে মায়ায় পড়িনি। তুমি যা, তুমি তা হয়ে আমার সামনে থাকোনি। তুমি চুপচাপ থাকা মেয়ে, চেষ্টা করছিলে চৈতালির মতোন খুশমেজাজ, বাঁচাল, দুষ্টু সাজার। আমি খুব করে ভাবলাম তোমার প্রতি আমার মনে বিন্দুমাত্র অনুভূতি আছে কি না? নাহ্, আমি তোমার প্রতি না, তোমার চৈতালিময় চরিত্রের প্রতিই বিমোহিত হয়েছিলাম। আমার প্রতারিত হয়েছিলাম চৈতালির দ্বারা। নিঃসঙ্গ, প্রতারিত হৃদয়কে তুমি উষ্ণতা দেওয়ায় একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম তোমার প্রতি। কখনো তোমাকে স্পষ্টভাবে না বলতে পারিনি। তবে প্রিয়জন হওনি, হয়েছিলে আমার প্রয়োজন। হয়তো একসময় প্রিয়জন হয়ে যেতে, তবে ভালোবাসার আবেগ আর টানটা অনেক বেশি। তোমার দিকে এগুনো সম্ভব হয়নি। আমাকে ক্ষমা করবে। কোনো দাবী রাখবে না দয়া করে। ইতি, ফাহিম চিঠিটা পড়ে চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলল রমণী। বিরস মুখে বলল, "তবে এখান থেকে আমাকে বাঁচানো কি মহান সাজার জন্য? আমি কোথায় যাব বা কী করব এখন তা তো একবার ভাবেনি কেউ।" অনিমেষ বুঝলো পূর্ণতার অবস্থা। সত্যিই এই পশুর শহরে একদম একা হয়ে পড়েছে মেয়েটি। তবে মনে প্রশ্ন উঠলো, আদৌ কি ফাহিমকে ভালোবাসতো সে না কি শুধুই আশ্রয়ের আশায় এতটা? মুখে কিছু বলল না সে। প্রস্তাব রাখলো, "আপাদত, আপনাকে একটা হোস্টেলে রেখে আসি। আমি কয়েকদিন বাদে একবারের জন্য কানাডায় চলে যাচ্ছি, আপনিও চাইলে আমার সাথে যেতে পারেন।" ভ্রু কুঁচকে তাকায় পূর্ণতা। ঢোক গিলে অনিমেষ। "না, মানে আপনার স্টাডিস্ কমপ্লিট করতে পারেন সেখানে যেয়ে, পাশাপাশি চাকরিও। এছাড়া আর ভালো কোনো প্রস্তাব আমার কাছে নেই।" পূর্ণতা কিছুক্ষণ ভেবে সায় জানায়। সবটা সে এবার ভাগ্য আর আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছে। ভালো হলে ভালো। খারাপ হলে খারাপ। ___ বাসন্তীর নামে আবার বেনামি চিঠি এসেছে। বাসন্তী জানে প্রতিটি চিরকুটের মূল কথা একই। তারপরও পরম উত্তেজনার সহিত চিরকুটটি খুলে সে। প্রিয় বসন্তকুমারী, লোকে বলে হেমলক থেকে মায়াময় বিষাক্ত না কি কিছু হয় না। কিন্তু আমরা দুজন, দুজনার কাছে হেমলক থেকেও বিষাক্ত। কারণ একে অপরকে ছাড়া ভালো নই আমরা, আবার একে অপরের সাথেও হয়তো ভালো ছিলাম না। আমার অতীতের, অসুখের বিষে বারবার ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়েছে তোমাকে। এখন আমি ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছি তোমার বিরহের বিষে। বেঁচে থাকার স্পৃহা, প্রেরণাই যেন হারিয়ে ফেলছি ধীরেধীরে। আমাকে কি আর একটা সুযোগ দেওয়া যায় না বসন্ত? একটা সুযোগ? ভিখারি ভেবে দয়া করেই নাহয়। ইতি, তোমার অপ্রিয় কেউ। চিঠিটা যেন বাসন্তীর হৃদয় নিংড়ে সবটুকু আনন্দ শুষে নিল। শুধু চাপা দুঃখ, কষ্ট রয়ে গেল। তবুও অত অত বিষাক্ত স্মৃতি কি এত সহজেই ভুলা যায়? কিন্তু আগে তো বারবার ভুলে যেতো নায়িমের সামান্য মিষ্টি কথায়। তবে এখন কেন এত আকুতির পরও হৃদয় গলছে না কেন তার? নিজেকেই নিজে উত্তর দেয় বাসন্তী, "অহং ও আত্মসম্মানবোধের জন্য। তোমাকে সবসময় নিজের এবং নিজের আত্মসম্মানবোধের উর্ধ্বেই রাখতাম না, বরং তোমাকেই আমি নিজের সম্মান ও অহংকার মনে করতাম। কিন্তু সেবার সব আশা-ভরসা তুমি চূর্ণবিচূর্ণ করার পর সেই স্থানটা হারিয়ে ফেলেছো। আমি চাইলেও পারছি না তোমায় নিজের করতে এতটা শক্ত দেয়াল তুলেছো তুমি তিক্ততার আমাদের সম্পর্ক। তোমাকে ক্ষমা করেছি আমি, অভিযোগ নেই তোমার প্রতি, আজও ভালোবাসি। তবুও আমি পারছি না। আমার মনের জানালা-দোয়ারই হয়তো মিটে গিয়েছে, তাই তোমার প্রবেশও অসম্ভব হয়ে উঠেছে।" বিকেল বেলা, বাসন্তী কাজ শেষে নিজের ঘরে ঢুকে দেখে পুরো ঘর গোলাপ ও রজনীগন্ধায় সাজানো। ফুলের মিষ্টি সৌরভে মৌ মৌ করছে সারা ঘর। একটু এগিয়ে যেতেই নায়িম বারান্দা থেকে বের হয়। বাসন্তী ও নায়িম একে অপরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। নায়িম তার হাত ধরে বলে উঠে, "অনেক তো হলো রাগ, মান-অভিমান। এবার প্লিজ চলো শুরু করি না আবার নতুন করে।" বাসন্তী আড়ষ্ট হয়ে হাত ছাড়িয়ে নেয়। নায়িমকে কী করে বলবে নিজের মনের কথা কিংবা আদৌ বলতে পারবে কি না তা তার নেই। "বসন্ত, জানি আমার ভুলের ক্ষমা হয় না। তবে একটা সুযোগ নিজের ভুল শুধরানোর কি আমার প্রাপ্য নয়? তুমি তো আজও ভালোবাসো, তবে কেন নিজেদের সুখকে দেখার আরেকটা চেষ্টা করতে এত বাধা?" বাসন্তী ছোট্ট এক নিঃশ্বাস ফেলে। কম্পিত কণ্ঠে বলে, "একজন নারীর অহং কখনো ভাঙতে নেই। তার ক্ষমা হয় না। কারণ নারীর কোমল হৃদয়ই সেটার স্বীকৃতি দেয় না। তোমার ভালোবাসা, তুমি, তোমার প্রতি বিশ্বাস আমার অহং আর আত্মসম্মান ছিল। যখন তুমি সেদিন আমার অহংকে গুড়িয়ে দিলে না, সেদিন সেই বাসন্তীরও মৃত্যু হয়েছিল। জন্মেছিল এক নতুন বাসন্তী, যার হৃদয়ে তোমার জন্য ভালোবাসা তো আছে, কিন্তু আক্রোশ তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি। যে তোমাকে ভালো তো বাসে, কিন্তু যার অহং তুমি নও। যার ভালোবাসা হারে তারই আত্মসম্মানের প্রখরতার নিকট। তোমাকে ক্ষমা করেছি আমি। তবে বিশ্বাস করো বহুবার তোমায় আপন করে নিতে চেয়েছি, কিন্তু পারিনি। কারণ কী জানো? তা আমার আত্মসম্মানকে আঘাত করে। আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না তোমার আমাকে প্রতিবার হতাশ করা। ভুলতে পারি না তোমার আমাকে ভালোবাসাকে অস্বীকার করা। ভুলতে পারি না আমায় করা অপমান, অবজ্ঞা, আঘাত। হ্যাঁ, এটা সত্য তোমাকে ছাড়া কাউকে আপন করে নেওয়া অসম্ভব। তবে যেদিন পর্যন্ত ঐ বিষাক্ত স্মৃতিগুচ্ছ না ঘোলাটে হচ্ছে, মুছে যাচ্ছে ঐ অবধি তোমাকে আপন করা সম্ভব নয়।" নায়িম বাসন্তীর কথার বিপরীতে আর একটি শব্দও উচ্চারণ করে না। করে না সে মার্জনার আবেদন। হতাশ চোখে, ছলছল নয়নে গৃহ ত্যাগই হয় তার কর্ম। ___ অনিমেষ পূর্ণতাকে নিয়ে সারাজীবনের জন্য কানাডা চলে যাচ্ছে আজ। নায়িম, বাসন্তী ও নাহিবা এসেছে তাকে এয়ারপোর্টে রেখে আসতে। যাওয়ার পথে চৈতালির বাড়ির সম্মুখে গাড়ি থামায় অনিমেষ। নায়িমকে ইশারা করে বেড়িয়ে পড়ে সে। বেল বাজাতেই চৈতালি দরজা খুলে। অনিমেষ খেয়াল করে আজ রমণীর পরনে আর রঙহীন পোশাক নেই। বরং রগরগে লাল রঙের শাড়ি। মুখেও হাসি লেগে আছে। "আপনি? ঘরে আসেন অনিমেষ।" "না, না, আজ বড্ড তাড়া আমার। কানাডা চলে যাচ্ছি সারাজীবনকার মতোন। বিদায় নিতে আসলাম। সাথে কিছু দিতে। " বলেই একটা মোড়ানো কাগজ নরম হাতে গুঁজে দিয়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে দৌড়ানোর ভঙ্গিমায় বেড়িয়ে যায় সে। চৈতালি হতবাক। ঘটনার আকস্মিকতায় এমন হওয়ায় অস্বাভাবিক কিছু নয়। সোফায় বসে মোড়ানো কাগজটি খুলে সে। গোটা গোটা অক্ষরে লিখা, প্রিয় কদমফুল, তোমাকে প্রথম যখন দেখি তখন তুমি সদ্য কিশোরী। নায়িমের সাথে যেয়ে তোমায় দেখা। সে কী দুষ্টুমি খেলা করছিল তোমার চোখজোড়ায়! হাত ডুবিয়ে নয়, যেন মন ডুবিয়েই কাঁচা আম খাচ্ছিলে তুমি। আর ইচ্ছে করে আঁটিটা আমার দিকে মারলে। বিশ্বাস করো মনে দাগ কেটেছিলে তুমি গভীর ভাবে সেদিন। বুকের মাঝে চিনচিনে ব্যথায় সারাটা রাত্রি নির্ঘুম আমার। চোখ বন্ধ করলেই ভাসছিল তোমার চেহারা। এই নব অজানা অনুভূতির আগমনের ভয়ে নায়িমকেও কিছু বলিনি। এরপর নায়িমকে ছাড়াই না জানিয়ে বহুবার তোমার বাড়ির সামনে গিয়েছি। আড়াল হতে তোমায় দেখেছি। কারণ জানতাম তুমি আমার হওয়ার নয়, মাঝে যে ধর্মের বিশাল দেওয়াল। এরপর পড়ার চাপ বাড়লো, উকিল হতে হবে মায়ের ইচ্ছে। পড়ায় ডুবে তোমাকে ভুলার প্রচেষ্টা। না ভুললেও, ভুলে থাকতে ভালোই কাজে দিল এই উপায়। দিন কাটতে কাটতে লাগলো। একদিন নায়িমের থেকে শুনলাম তুমি এসেছো, তোমার সংসার হয়েছে। আহত হলাম, খুশিও। পরে শুনলাম বিপথগামী, তোমার সংসার ভাঙার পথে। আমি যেন পুরোপুরি ভেঙে পড়লাম। আমার অবুঝ কিশোরীর এত ধ্বংস যেন মেনে নিতে পারছিলাম না। যখন দেখলাম তুমি শুধরেছো নিজের কাছে ওয়াদা করলাম তোমাকে তোমার ভালোবাসা, সংসার ফিরিয়ে দিব। উপরওয়ালার কৃপায় ফিরাতে পেরেছি এতেই আমার সন্তুষ্টি। এখন তুমি ভালো থাকো, সুখে থাকো এটাই একমাত্র আমার চাওয়া। ইতি, অনিমেষ। চিঠিটা পড়তে পড়তেই অশ্রু জমে উঠলো চৈতালির নেত্রে। এতটা নিঃস্বার্থ ও গভীরভাবেও কেউ ভালোবাসতে পারে বুঝি? ___ দেখতে দেখতে তিন বছর কেটে গিয়েছে অনিমেষের যাওয়ার। কানাডার এক মুসলিম এতিম ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছে পূর্ণতার অনিমেষ। আজ ছয়মাস হলো বিয়ের। জীবনটা কাটছে রমণীর স্বপ্নময় ভাবে। জীবন থেকে প্রায় নিরাশ হয়েই বসেছিল পূর্ণতা। এই ছেলেটা এসে আবার রঙে মাখিয়ে দিল তার জীবনে। অনিমেষের কাছে সদা কৃতজ্ঞ সে। --- আজ একবছর হলো ফাহিম চাকরি হারিয়েছে কোম্পানি বন্ধ হওয়ার কারণে। এখন একটা শো-রুমে সেলসম্যানের কাজ করে যত টুকু বেতন পায় তাতেই দিন চলে। এই অভাবের দিনে চৈতালি আবার যেন সেই পুরাতন চৈতালি হয়ে গিয়েছে। সারাদিন খিটখিটে মেজাজ, একটু বাদে বাদেই টাকা-পয়সা নিয়ে খোঁটা, তার মাকে গালিগালাজ। কাজের বুয়াটা বাদ দিয়েছে প্রায় আটমাস। অফিসের সব কাজ করে ফিরে বাড়ির কাজ এবং মায়ের সেবা দুটোই ফাহিমের করা লাগে। ভয় লাগে ফাহিমের আজকাল ভীষণ মেয়েটা যদি আবার ছেড়ে চলে যায়। বোনটাও যে চৈতালিকে ফিরিয়ে আনার কারণে সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছে বহু আগেই। খালা কসম কেটে গিয়েছে এ বাড়িতে পা রাখবে না। এই সময়ে আবার চৈতালি চলে গেলে ফাহিম একদম নিঃস্ব হয়ে পড়বে। যদিও আগের মতোন তেমন মানুষের গায়ে পড়া ভঙ্গিমা এখনও করতে দেখেনি সে। প্রায়শয়ই ফাহিম অতিরিক্ত দুঃখে মনে মনে বলে উঠে,"আজ চৈতালিকে ডিভোর্স দিয়ে, পূর্ণতাকে বিয়ে করলেই বোধহয় ভালো থাকতাম। আসলে খালা সত্যিই বলেছিল, কয়লা ধুলে ময়লা যায় না, স্বভাব যায় না না মরলে।" বস্তুত, মানুষের মন, মস্তিষ্ক ও আচারণ জটিল থেকেও জটিলতর। অনুতাপ সবসময় সারাজীবনকার হয় না। কিছু অনুতাপ হয় সাময়িক। পুনরায় একই পরিস্থিতিতে ফেললে আবার খোলস ছাড়তে সময় খুব ক্ষুদ্রই লাগে। চৈতালির ক্ষেত্রেও হয়তো তাই হয়েছে। তবে এখন একটা স্বস্তির ও মেলবন্ধনের স্থান আছে ফাহিম ও চৈতালির। তাদের একমাত্র ছেলে মাগফিরাত। মাগফিরাতকে দেখলেই সব কটুকথা ভুলে যায় ফাহিম। চৈতালিও সারাদিনের গলাবাজি, রাগ, দুনিয়াবি আকাঙ্ক্ষার প্রতি আকর্ষণের বিরতি ঘটে ছেলের আধো আধো বুলি শুনে। হয়তো ছেলের বড় হওয়ার সাথে সাথেই শুধরাবে সে না কি এমনই থাকবে? কে জানে? মানব মনের রহস্য আজ অবধি তো কেউ উদঘাটন করতে পারেনি। --- অনেক কিছু বদলে গিয়েছে বাসন্তী ও নায়িমের মাঝেও। এখন নায়িম খান বাড়ি ছেড়ে মোস্তফা বাড়িতে থাকে বাসন্তীর সাথে। বাসন্তীর আবেদনেই। এর পিছনে মূল কারণ অবশ্য নাহিবা। 'দুনিয়ার সবার বাবা-মা একসাথে একঘরে থাকে, তার বাবা-মা কেন নয়?' এই প্রশ্নবাণ থেকে বাঁচতেই এমনটা করে বাসন্তী। কারণ সে চায় তার মেয়ের ছেলেবেলা যাতে তার মতো নাহয়, বাবা-মা দুজনের সঙ্গ ও ভালোবাসাই যাতে নাহিবা পায়। বাসন্তীর কক্ষে তো জায়গা হয়েছে নায়িমের। একই ছাদের নিচে, একই খাটে ঘুমায় দুজন। তবুও দূরত্ব যেন হাজার মাইলের। নায়িম যত্নশীল তার প্রতি, কিন্তু কখনো বাসন্তীর জীবনে দখলদারি করে না কিংবা স্বামীর অধিকার কখনো চাপায় না বাসন্তীর উপর। এই বিষয়টাতেই বারবার বিমোহিত হয় বাসন্তী। একজন পুরুষের সহ্যক্ষমতা কতটুকু হলে এমন করে তা-ই ভেবে পায় না সে। বাসন্তী নিজেও চায় এখন নায়িমকে নিজের করে নিতে, তবে কোথাও একটা বাধা, পুরনো ক্ষতের জ্বালা। সময়ের সাথে সাথে হয়তো এই বাধাও পেরিয়ে যাবে, ক্ষতও শুকিয়ে যাবে। --- বিকেল বেলা, নিজের কুকুর জুলিয়াকে নিয়ে সোডিয়ামের আলোয় হেঁটে চলেছে অনিমেষ। তার মুখশ্রীতে ম্লান হাসি। দিনশেষে সুখ-দুঃখ, ভালো-খারাপ মিলিয়ে সবাই বেঁচে আছে নিজ নিজ সঙ্গীর সাথে। নিঃসঙ্গ জীবন কাটছে শুধু অনিমেষের। বাবা-মাকে তো হারিয়েছে বেশ সময় হলো। আর প্রিয়জন, স্ত্রী, সঙ্গী? সে জায়গাটা সে কাউকে দিতে পারেনি। কিছু মানুষ এমনই হয় সবার জীবন রঙ, তুলির দ্বারা সাজিয়ে দেয়। অথচ, নিজে থাকে রঙহীন হয়ে। চলবে...

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here