টক্সিক_রিলেশনশীপ,৬,৭
ঈপ্সিতা শিকদার
৬
বাসন্তী শয্যাশায়ী। নায়িমের আদেশ আজ থেকে দশদিন সে ঘর থেকে বেড়ুবে না। তার যা দরকার সব চৈতালি এনে দিবে। হয়তো তাকে দ্রুত সুস্থ করতেই এই ব্যবস্থা।
“এই যে নেও তোমার খাবার। খেয়ে নেও, নাহলে আবার তোমার বর আমাকে ধরবে।”
অদ্ভুৎ চোখে তাকাল মেয়েটির দিকে বাসন্তী। এই মেয়েই সুযোগ পেলে অভিযোগ জানাত, স্বামীর সংসারে খাটতে খাটতে না কি শেষ হয়ে যাচ্ছে। অথচ, অন্যের সংসারে ঠিকই খাটছে। এত কী প্রাপ্তির আকুতি, কী সুখ এই দুনায়াবি লাভে!
বাসন্তীও মাঝে মাঝে জানতে চায় তা। তবে সে পারেনি, একজন খ্যাতনামা, ধনী গায়কের স্ত্রী হয়েও তাকে প্রাচুর্য, অর্থের বিছানা দেয়নি, এমন কী একটা মোবাইলও নেই, না কাজের বুয়া। বড়লোকী জীবন তাকে দেয়নি নায়িম।
“কী হলো কী এত ভাবছো? খাও খাবারটা… আসলে সুখে আছো তো বুঝো না।”
বলতে বলতেই পাশে বসে আঁচলে কপালের ঘাম মুছে নেয় চৈতালি। বাসন্তী অকস্মাৎ প্রশ্ন করে উঠল,
“তোমার কি মনে হয় আমি সুখে আছি?”
“অবশ্যই। নায়িম খ্যাতনামা গায়ক, সুদর্শন, সম্পত্তিশালী, আগলে রাখতে জানে। আর কী দরকার! তুমি তোমার অতীতের কথা ভাবো, আর আজকের কথা ভাবো। আকাশ-পাতাল পার্থক্য।”
বাসন্তীর মুখে হাসি খেলা করে যায়। চৈতালি জানে এটা শুধুই বিদ্রূপার্থে। তার মতোন চতুর নারী অন্য নারীর ভঙ্গির ভাষা বুঝবে না, এ অসম্ভব। সে টাইলসে চোখ রেখেই বলে,
“যা কারো কাছে পৃথিবীর সুখ, তা কারো কাছে হয়তো আবার ধোঁয়াশা। এ এক মহাসত্য।”
বাসন্তী কোনো কথা না বলেই খাবার খেয়ে নেয়। চৈতালি কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে নীরবে বেড়িয়ে যায়।
বাসন্তী আনমনেই ভেবে উঠে তার মামা বাড়ির কথা। তার অতীত জীবনের কথা।
বয়সটা তখন কতই হবে এই এগারো কী বারো বছর। মামাতো বোনের নতুন জামা দেখে তার সে কী কান্না নতুন জামার জন্য। বাবা যে প্রতি বছর নিজে পোশাক না নিলেও আদরের রাজকন্যার জন্য জামা কিনতে ভুলতেন না। বদরুন্নেসা শত বলেও থামাতে পারলেন না।
তখন অত শত বুঝত না। সে যে এতিম হয়েছে, বাবা হারা, ছায়াহীন হয়েছে এও জানত না। মামী মিথ্যে মায়া দেখাতে মামাতো বোনের একটা অতি পুরানো সেলাই খুলবে খুলবে ভাব ফ্রক এনে দিলেন। বাসন্তী সেসময় বড্ড চঞ্জলা আর জেদি ছিল বটে। জামা খানা ছুঁড়ে ফেলে বলেছিল,
“ছিঃ! এইটা তো পুরান জামা। আমার আব্বা আমার জন্য নতুন জামা আনে।”
নানা তেড়ে এসে হাতের লাঠি দিয়ে ঠাশ করে এক আঘাত দেয় বাসন্তীর পিঠে। বাসন্তীর চেঁচামেচিতে তার মেজাজ গরম হয়ে উঠেছে, অথচ অন্য নাতি-নাতনিদের আবদার পূরণে একটুও রাগ বা কৃপণাতে লাগে না তার।
“ঐ ছেড়ি তর কী বাপ আছেনি যে কাপড় পাবি? চালচুলোহীন একখান মেয়ে আবার নতুন-পুরাতন দেখাইতে আসে। তুই হইল কী না বাড়ির চাকর, আশ্রিতা। তোর আবার এত কীসের দেমাগ?”
তার লাঠির আঘাতের চেয়ে গায়ে লেগেছিল সেদিন বেশি কথার আঘাতগুলো। তিনি যে রুক্ষতার সহিত বাস্তবতার সাথে আঘাত করেছিলেন।
ধীরেধীরে বাসন্তী যতটা জীবনের বাস্তবতা জানছিল, তার মায়ের থেকে ততটাই দূরে সরে যাচ্ছিল। কারণ ঘুরেফিরে সত্য তো এটাই, তার মায়ের জন্যই বাবা ছাড়া এত বিভীষিকাময় তার জীবন হয়েছিল।
ঐ বাড়িতে বাসন্তী সবার চোখের বালি নয়, গলার কাটা ছিল। যাকে না নিগলে ফেলা যায়, না উপড়ে ফেলা। তাই সবার এই অবান্ঞ্ছিত মেয়েটির প্রতি ক্ষোভ একটু বেশিই ছিল। যা তারা কথাবার্তা, আচার-ব্যবহার, কাজকর্ম সহ সবকিছুতেই বুঝিয়ে দিত। সবচেয়ে অপমানজনক লাগত তখন যখন তারই মামাতো, খালাতো ভাই-বোনেরা তাকে তাচ্ছিল্য করতে, সবার সামনে কাজের লোক বলত।
যতটা বছর ঐবাড়িতে ছিল ততটা বছর বাসন্তীর জীবন তরীর সবচেয়ে করুণতম সময়। সেখানে মামী, খালা এমন কী ভাই-বোনরাও যখন খুশি তখন তাকে মারতে। সবসময় বোঝাতে এ কিছুই তার নয়, সে কত বড় বোঝাতো। বড় মামী তো তাকে সদাই মরার কথা বলত। অনেক বার সে চেয়েছে মরে যেতে, সাহসে কুলোয়নি, তখন বুঝত নিজেকে মারাও সহজকথা নয়।
সে খামখেয়ালি করে নায়িমের সাথে পালায়নি, বিয়ে করেনি। সবটাই হয়েছিল পরিমাপ করে। নায়িমের সাথে তাকে হয়তো কারো নাম মাত্র দ্বিতীয় স্ত্রী তথা রক্ষিতা হয়ে বেঁচে থাকতে হত। এখানে এসে সে খারাপ আছে। তবে আগের মতো নয়।
সেখানা না ভর পেট খাওয়া পাওয়া যেত, না স্বস্তিকর কোনো কথা, না কোনো যত্ন-আদর, মিথ্যে লোক দেখানো কিছুও তার প্রাপ্তির খাতায় ছিল না। প্রতিদিনকার মতোন যার তার মার আর অপমান সহ্য করতে হয় না৷
নায়িম আঘাত করলেও পরে মলমটা সে-ই লাগায়। ভালোবাসা দেখায় লোক দেখানো হলেও। এখানে নায়িমকে তার আপন লাগে কখনো কখনো, তো কখনো মায়ামমতাহীন এক রাক্ষস। সেখানে একমুহূর্তের জন্যও কাউকে আপন মনে হয়নি, নিজের মাকেও না। এসব ভেবেই কষ্টের মরুভূমিতে খাণিক স্বস্তির শীতলতা পায় সে। কারণ মুক্তির তো উপায় নেই, যাওয়ার জায়গা নেই যে।
“আমি মুক্ত পাখি হতে চাই। খাঁচা বন্দী জীবন আমার কাম্য নয়। তবে আমি উপায়হীন।”
অন্যমনস্ক হয়েই বিড়বিড়ায় সে।
___
ললিতা’স ইন্টারোগেশন অনুষ্ঠান থেকে ইনভাইট করা হয়েছে নায়িমকে। নায়িম খুব ভালো করেই জানে ললিতা সেন আর শবনমের ভাব কতটা! নির্ঘাত তাকে প্রশ্নের দ্বারা হেনেস্তা করেই কোনো ভাবে শবনমকে জনগণের নজরে উঠাতে চাওয়ার প্ররোচনা।
“ওকে, আমিও রাজি ইন্টারভিউয়ের জন্য। তবে ইন্টারভিউটা হবে আমার সময় মতো। সামনের মাস ছাড়া সময় হবে না আমার।”
সময়ের অভাব না ছাই, প্রস্তুতি গ্রহণের সুযোগ চাই শুধু তার। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বাসন্তীর কামরায় গা দুলাতে দুলাতে ঢুকে পড়ে সে। গতানুগতিক নাইটি পরিহিতা বাসন্তী সেই ক্ষণে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় তেল দিচ্ছে। পাঁচমাসে পা দেওয়ার পর থেকেই মাথা গরম হয়ে প্রায়শয়ই ব্যথা করে তার।
নায়িমের মাথায় আগুন জ্বলে যায়। এই পোশাক, সন্তানসম্ভবা দেহ যে তাকে খুব করে কারো কথা মনে করিয়ে দেয়। ঘৃণায়, রাগে তার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে গেলে।
“এই মেয়ে! তোমাকে কয়দিন না করসি এসব নাইটি-ফাইটি না পরতে? তাড়াতাড়ি খুলো এসব।”
তার ধমকের ঝংকারে যেন গোটা বাড়িই কম্পিত হয়। নায়িম মেয়েটাকে এখন আর কোনো পৈশাচিক আচারণে কাহিল করতে চাচ্ছে না, তাই দ্রুতোই বারান্দায় চলে আসে সে।
“মিস্টার এন্ড মিসেস খান, এতটা বিভীষিকাময় আমার জীবন না করলেও পারতেন। এতটাই বিষাক্ত আমি আজ যে আমার সাথে জুড়ে থাকা সবকিছুই বিষাক্ত। বিষাক্ত আমার আর বসন্ত কুমারীর সম্পর্কও। আমি মনে করি নারী জাতের মাঝে সবচেয়ে পবিত্র আমার বসন্ত কুমারী, তবুও সদাই সন্দিহান আমি, কোথায় একটা প্রশ্ন, দ্বিধা, সন্দেহ, ভীতি কার্যকর।”
___
একটা মাস পেড়িয়ে গেছে, বাসন্তীর গর্ভের সন্তানটা এখন আট মাসের। সে যামিনীর আঁধারে মিশে নিদ্রায় ডুবে। নিদ্রার ঘোর হয়তো গভীর ছিল না, তাই তো কথার অল্প শব্দেই ভেঙে গেল। কিন্তু সে যা শুনতে পেল তাতে তার লোমে লোমে ভীতি, হাহাকার নেমে এল।
“আরে বাবা বাচ্চা এবোর্ট করার সময়কাল যদি এখন শেষ হয়ে যায় তাহলে বাচ্চাটা কাউকে দিয়ে দিলেই হবে। হ্যাঁ, হওয়ার পরপর কাউকে না জানিয়ে কোনো এতিম খানায় রেখে আসলেই হবে।”
নায়িমের আর কোনো আওয়াজ পাওয়া গেল না। বরং, বাথরুমের দরজা লাগানোর শব্দ। বাসন্তী যেন শোকে বোবা বনে গেছে। সে সেভাবেই পড়ে থাকল, যেন কোনো অনুভূতিহীন যন্ত্রমানব।
সকালের আলোর আগমনে ঘুম ভাঙে নায়িমের। কিন্তু ঘুম থেকে জাগতেই কেন যেন তার ঘরটাকে অদ্ভুৎ রকমের নীরব লাগছে, নিস্তব্ধতা গ্রাস করছে চারিধারে। মনে হচ্ছে কী যেন নেই, কেমন একটা অভাব বোধ, হাহাকার।
সে এত ধ্যান না দিয়ে ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে। তারপরও বাসন্তীকে ডাকতেই কোনো সাড়া পেল না। সূক্ষ্ম ঘাম বেয়ে পড়ল, কপালে চিন্তার ভাজ। অজানা এক ভয়ে গ্রাসিত হচ্ছে সে।
দ্রুত পদে সারা ঘর তালাশ করল যুবক। বাসন্তীর ছোঁয়া পেল সবজায়গায়, কিন্তু সে নেই। মাস্ক, চশমা, হুডি পরে পাড়া-প্রতিবেশী, মৈত্রীর কাছেও খোঁজ করল। না মেয়েটি নেই, ঘরের সবকিছু ঠিক জায়গায়, বাসন্তীর পোশাক-আশাক, সব। তবে কি কর্পূরের মতোন মানুষও হাওয়ায় মিলিয়ে যায়? বাসন্তী গেছে?
কী করবে ভেবে না পেয়ে অনিমেষকে কল করে সে। উন্মাদের মতোন বলে,
“দোস্ত আমার সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। তাড়াতাড়ি আয়, আমার সর্বনাশ দেখছি অতি নিকটে।”
___
বাসন্তী হুশ ফিরলেই নিজেকে অপরিচিত এক নোংরা বিছানায় আবিষ্কার করে। বাহির থেকে নোংরা নোংরা কথা শুনা যাচ্ছে পুরুষ ও নারী গলায়।
তবে কি মায়ের মতোই ভুল করে বসল সে? মায়ের চেয়েও নিষ্ঠুর একেবারে মৃত্যুকাম্য জীবন পেতে চলেছে সে?
চলবে…
#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||৭ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
পূর্বের আকাশে সোনালী আলোর খাণিক রেশ স্ফুরিত হচ্ছে। ফজরের আজান দিতে আরও বেশ কিছু সময়ের অপেক্ষা। বাসন্তী এক পোশাকে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এপার্টমেন্টের বাহিরে এসে দাঁড়াতেই দেখা হয় মৈত্রীর স্বামী সায়মানের সাথে। অবশ্য প্রথমে সে চিনেনি মাস্ক ও ক্যাপ পরা থাকায়। খেয়াল করতেই বুঝে যায়।
লোকটাকে বেশ ভালো ও সরল মনের লাগে বাসন্তীর কাছে। দেখা হলেই বোন, বোন বলে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলে। আপন ভাইরাও এত বিনয়ী হয় কী না…
“কী ব্যাপার? তুমি এই অসময়ে বাসার বাহিরে কী করো?”
মিষ্টি গলার মানুষটার উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত গলা শুনে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারে না বাসন্তী। সে এমনিতেও এই ক্ষণে মানসিক ভাবে অত্যন্ত বিধ্বস্ত ও দুর্বল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে একে একে বলে দেয় সবকিছু। সেই সাথে এও বলে সে এখান থেকে দূরে চলে যেতে চায়।
কী যেন একটা ভাবে সায়মান। তারপর হুট করেই প্রস্তাব রাখে,
“বোন, আমার এক পরিচিত জায়গা আছে। তুমি চাইলে আপাতত রেখে আসতে পারি। পরে নাহয় অন্য এক ব্যবস্থা করে দিলাম।”
বাসন্তী বিনা কোনো ভাবনায় রাজি হয়ে যায়। মানুষটাকে সে খুব বিশ্বাস করে, কোনো সাহায্য না করলেও ক্ষতি যে করবে না এ সে নিশ্চিত, তবুও কোথাও একটা দ্বিধা, অনিষ্ঠ হওয়ার ভয়।
তারপর সায়মানের সাথেই এগিয়ে যায় বামের রাস্তা ধরে এগিয়ে যায় বাসন্তী। সায়মান কাউকে কল করলে একটা বেশ পুরনো মডেলে গাড়ি এসে দাঁড়ায় তাদের সামনে। তাতে চড়ে বসার পর সায়মান তাকে পানি করতে। অদম্য সব দুর্ভাবনায় বাসন্তীর তৃষ্ণা পেয়েছিল বেজায়, তাই না ভেবেই পান করে নেয়। অতঃপর কিচ্ছু মনে নেই।
বর্তমানে, নিজের মন্দ ভোরটির কথা ভাবছে বাসন্তী। এখনো সে সেই নোংরা খাটেই গুটিশুটি দিয়ে বসে। না কেউ এসেছে এই ঘরে, না সে বাহিরে বের হয়ে সব পর্যবেক্ষণ করার মতোন দুঃসাহসিকতা দেখিয়েছে। বারবার নিজেকে ধিক্কার জানাচ্ছে সে জীবনের সবচেয়ে জঘন্য সিদ্ধান্তটা নেওয়ার জন্য।
“এ কী ভুল করলাম আমি! নিজেকে কলঙ্কিনী বানানোর ব্যবস্থা করলাম! সমাজে আর ঠাঁই হবে না আমার। সবাই ঘৃণ্য চোখে দেখবে। নিজের জীবন তো ধ্বংস করলাম, বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসার আগেই তার ললাটেও এই কালিমা লেপণ হবে। আল্লাহ! এর চেয়ে ভালো তুমি মৃত্যু দেও আমায়!”
এসব কিছুর মাঝেও বাসন্তীর মনে ক্ষীণ ভাইয়ের মতোন সম্মানিত মানুষটা তাকে ধোঁকা দিবে না। তবুও বাস্তবতা? তাকে অস্বীকার করা যে অসম্ভব।
___
নায়িমের ব্লাড প্রেশার হাই, ডাক্তার সহ দুজন নার্স বিরতিহীন ভাবে তাকে অবজার্ভেশনে রাখছে। কারণ যেকোনো সময় একটা এক্সিডেন্ট ঘটে যেতে পারে। চৈতালি সামনে তেঁতুল টক এনে রেখেছে তার খাওয়ার জন্য, কিন্তু খাওয়ার নাম নেই নায়িমের। সে তো উন্মাদ হয়ে রয়েছে বসন্ত কুমারীর খোঁজে।
“কী রে অনিমেষ? বসন্তের কোনো খবর জানতে পারলি না? তাহলে কী হবে এত পাওয়ার, ফেম, আর টাকা দিয়ে?”
বিকট শব্দে বলল নায়িম। সে দু’হাতে চুল আঁকড়ে বসে আছে। খ্যাতনামা, স্টাইলিশ গায়ক নায়িমের কী বিধ্বস্তপ্রায় এলোমেলো দশা এই মেয়েটিকে হারিয়ে। অথচ, মেয়েটিকে তার জীবনে অতিনগণ্য বলেই সর্বদা জেনেছে সে, মেনেছে সে।
এদিকে অনিমেষ ফোনে কমিশনার, আইজি সহ বিভিন্ন পাড়ার মাস্তান ও আন্ডারওয়ার্ল্ডের লোকদের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। তার নিতান্তই বিরক্ত লাগছে নায়িমের আচারণে।
“তুই না বললি তুই ভাবীকে ভালোবাসিস না। তাহলে…? তোর পবিত্র, চল-চাতুরী বোঝহীন মেয়ে লাগবে তো আমি দুদিনের মাঝেই হাজির করব। একদম স্কুল গোয়িং চৌদ্দ-পনেরো বছরের মেয়ে।”
তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে নায়িম। রেগে পাগলের মতোন চেঁচিয়ে বলে,
“তোরে কী আমাকে দেখলে মি. খানের মতোন লাগে? আমার জীবনে একটা নারীই থাকবে, যাকে আমি গভীর ভাবে ছুঁব। আর সেই নারীর জীবনেও আমি একটাই পুরুষ থাকব, শুধু আমার ছোঁয়াই লাগবে তার দেহে।
আমি কিচ্ছু জানি না, আই জাস্ট নিড মাই গার্ল। একদম ইন্টেক লাগবে আমার ওরে, যেমনে গেছে তেমনেই। যত পাওয়ার ইউজ করা লাগে, টাকা খরচ করা লাগে কর। যদি ওরে না পাই না, পুরা দুনিয়া তছনছ করব আমি।”
অনিমেষ বলতে চেয়েও বলতে পারছে না তার হৃদয়ের বুলিগুলো। যতটা সে ঘটনাটা পরখ করে ধারণা পেয়েছে তা হলো, মেয়েটা নির্ঘাত কোনো মন্দ চক্রের হাতে পড়েছে। কারণ রেইল স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, সিএনজির স্ট্যান্ড এমন কী এয়ারপোর্ট কোথাও যায়নি মেয়েটা। এছাড়া তার অতীতের বন্ধু-বান্ধব, নানার বাড়ি, বাপের বাড়ি সব স্থানে খোঁজ নেওয়া শেষ।
“কী রে? তুই হাতে হাত রেখে বসে আছিস কেন? কিছু কর!”
“এই ছেলে রে কী করে বোঝাই তার বউ শুধু পালায়ই নাই কুরবানির ছাগলও হইসে! যেই মেয়ের দিকে তাকালেও এই ছেলের রক্ত ফুটতে শুরু করে সে… কীভাবে মেনে নিবে এই ছেলে?”
কথা টুকু মনে মনেই শুধাল অনিমেষ। মুখে বলার সাহস তার নেই। বরং, মুখে বলল,
“আমি দেখছি। কী একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া নিসোস সিসিটিভিও নেই! তা থাকলেও একটা উপায় ছিল।”
নায়িমের চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠে। যেন সিক্ত দিয়াশলাইয়ের আগুন জ্বলে উঠেছে।
“পুরো ধানমণ্ডি এলাকাতে যত বাড়ির বা শপের সিসিটিভি ফুটেজ আছে সব বাইর কর। কারণ ও মনে হয় ফজরের আগে বের হয়েছে, তখন তো কোনো যানবাহন পাওয়ার কথা না। এই এলাকা দিয়েই যেহেতু গিয়েছে, কোনো না কোনো বাড়ির ফুটেজে তো নির্ঘাত ওকে পাওয়া যাবেই।”
অনিমেষ অনিমেষনেত্রে চেয়ে রইল। এই যুবক আসলেই তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন। সে একটা উকিল হয়ে এতক্ষণ ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেও যা বের করতে পারেনি তা সে মাথা গরম অবস্থাতেই ভেবে নিয়েছে।
___
বাসন্তীর এপার্টমেন্টের বিপরীতে দুই বাড়ির পরের বাড়ির বাহিরের ক্যামেরার ফুটেজেই পাওয়া যায় বাসন্তীকে। তার সাথে এক অজানা যুবক ছিল। কিন্তু যুবকটিকে চেহারা দেখা যাচ্ছে না মাস্ক ও ক্যাপের জন্য। হুট করেই নায়িমের মনে পড়ে এই ক্যাপ আর শার্টটা সে মৈত্রীর বাসায় দেখেছে।
নায়িমের মাথায় হাত। সে আগে থেকেই ভালো চোখে দেখত না এই দম্পতিকে। সে তো ভেবেই পাচ্ছে না বাসন্তীর এত সাহস হয় কী করে এক পুরুষের পায়ে পা মিলিয়ে বেড়িয়ে যাওয়ার? তার চোখজোড়া রক্তলাল, মাঝে নীলচে মণি। দেখতে ভয়ংকর ও সর্বনাশাই লাগছে তাকে।
“খালি একবার হাতের কাছে পাই তোমায় বসন্তকুমারী। তোমার লোম লোমকে যদি পালানোর সখ না বুঝিয়েছি তো আমিও নায়িম নই!”
অনিমেষ খুব ভালো করেই বুঝতে পারে নায়িমের এই চাহনিকে। তার সাঙ্গপাঙ্গকে কিছু একটা ইশারা করে চোখজোড়া দিয়ে। কয়েক মিনিটের মাঝেই তারা মুখ, হাত, পা বেধে তুলে এনে মৈত্রী ও সায়মানকে।
কাঠের বেত তেল দিয়ে মাখিয়ে নায়িম এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করে মৈত্রী ও সায়মানকে। সায়মান আর সহ্য করতে না পেরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠে,
“ব-বলছি, ব-বলছি। আ-আর মারবেন না প্লিজ।”
নায়িম অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে থামে। মৈত্রী ক্লান্ত নজরে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে সায়মানের দিকে।
“তাড়াতাড়ি বল বসন্ত কোথায়?”
ভয়ে ফটাফট ঠিকানা বলে দেয় সায়মান। অনিমেষ ঠাশ করে এক চড় লাগায়।
“তোকে কত বিশ্বাস করত মেয়েটা আর তুই…! তোদের ধর্মে নারীদের ঘরের রাণী, মূল্যবান রত্ন, একজন মা নামক নারীর নিচে জান্নাত বলা হয়েছে, আমাদের ধর্মে মেয়েদের দেবী তুল্য বলা হয়। নারীরা প্রতিটি ধর্মেই সম্মানিত। কিন্তু তোদের মতোন জ্ঞানহীন মূর্খ জানোয়ার, কুলাঙ্গারের জন্য তাদের শানে দাগ পড়ে। আগে ভাবীকে আনি, তোর এমন হাল করব না…”
“ভাই দয়া করে মাফ করে দেন আমায়। ঐ এসকর্ট সার্ভিসের মালিক আমার থেকে অনেক টাকা পায়। অনেকদিন ধরে সেই টাকার জন্য হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। সেই টাকা পরিশোধে করতেই আমি এই নোংরা কাজ…”
তার ভয়ার্ত গলা, চোখের পানি কিছুতেই সামান্য প্রতিক্রিয়া নেই কারো। মৈত্রী পূর্বেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
___
“হে লেডি, গেট রেডি ফাস্ট! একটু বাদেই তোমাকে ক্লায়েন্ট দেখতে আসবে।”
কারো ডাকা ঘোর ভাঙে বাসন্তীর। সে ভীতিগ্রস্ত হয়ে তাকায় এই গলার মালিকের দিকে। ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরুয়া একজন বিশ উর্ধ্ব নারী। সে অবাক হয়ে যায় তার মুখের বুলি শুনে ও চালচলন দেখে।
“পতিতারাও বুঝি শিক্ষিত হয়? এত স্মার্ট হয়?”
“হোয়াদ্দা হেল? গেট রেডি গার্ল, ক্লায়েন্ট আসবে তোমার জন্য। ম্যাম আসলে ইউ আর জাস্ট গন্না বি ডেড।”
ভয়ে সারা শরীর এক সূক্ষ্ম শীতলতা বয়ে যায়। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে তার। কী হবে তার? ভাগ্য কী তার উপর নিষ্ঠুরতম এই হাতিয়ার চালিয়েই দম ফেলবে। নায়িম যদি তাকে এ যাত্রায় বাঁচিয়েও ফেলে বাসন্তির প্রতি তার নিষ্ঠুরতা কত দূর এগুবে?
চলবে…