টপ টেন মডেল,পর্ব:৫
ঋতু_পান্না
-“আমি বুঝলাম না! এটা তুমি কেন করলে? তুমি নিজেই নিজেকে কীডন্যাপ করালে আবার নিজেই হুট করে সো’র মাঝে চলে এলে!”
-“হুম। দেখেছ আমার প্ল্যানটা কত পারফেক্টলি কাজ করল। পুরো দুনিয়ার সামনে তনিমাকে মিন মাইন্ডেট প্রমাণ করলাম। আর আমি কত ভালো দেখ! ওর মতো এত বড় অপরাধীকে কোনো কারন ছাড়াই ক্ষমা করে দিলাম। শবনম ফারিহা কত উদার মানসিকতার তুমি দেখ!” ন্যাকামি সুরে কথাগুলো বলেই পৈশাচিক হাসিতে মেতে উঠল সে।
-“ব্রিলিয়ান্ট! কিন্তু ঐ লোকগুলো তোমার কাছে তনিমাকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করল। বেচারির কি অবস্থাটাই না হয়েছিল চিন্তা কর।”
আবিরের কথায় বাঁকা একটা হাসি দিয়ে শবনম,
-“আরে আবির! তুমি কি আমাকে বোকা ভাব! আমি এত কিছু করলাম আর তনিমাকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়াব না তা কি করে হয়? ঐ লোকগুলো আমার হায়ার করা ছিল।”
আবির অবাক হয়ে গেল,
-“মানে! তনিমার সাথে আমরা বাড়াবাড়ি করে ফেলছি না তো?”
-“তোমার কি ও-র জন্য কষ্ট লাগছে নাকী.!”
খানিকাটা রেগে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল শবনম।
তড়িঘড়ি করে আবির জবাব দিল,
-“বিশ্বাস কর আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। তোমার সব চাওয়া আমি পূরণ করব।” বলেই ও-কে জড়িয়ে ধরল।
কয়েক ঘন্টা পর একটা ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্টে অন্বেষার সামনে বসে আছে তনিমা। তাকে অন্বেষা ফোন করে এখানে আসতে বলেছিল। সে আসতে না চাইলেও অন্বেষা তাকে জোর করে এনেছে।
-“দেখ তনিমা। যেটা হল সেটা আমি নিউজে দেখেছি। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমার কিছু করার ছিল না।”
তড়িৎ গতিতে তনিমা প্রশ্ন করল,
-“তুমি কোথায় ছিলে অন্বেষা! তুমি জানো ঐ মুহূর্তে আমার নিজেকে কতটা অসহায় মনে হচ্ছিল। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। আবির আবারও আমার সাথে প্রতারণা করল, মানছি সো’টা করার ইচ্ছা আমারও ছিল। কিন্তু আমি রাজি তো ওর কথায় হয়েছিলাম, তবুও ও কিভাবে বলতে পারল সবটা আমার ইচ্ছাতে হয়েছে..উফ্ অন্বেষা আমার কিছু ভালো লাগছে না। আমি..আমি চলে যাব এই দেশ ছেড়ে। উফ্!”
কথাগুলো বলতে গিয়ে ওর চোখ চিকচিক করে উঠল। পাবলিক প্লেস না হলে ও নিশ্চিত কেঁদেই দিত।
অন্বেষা এবার নরম স্বরে,
-“তনিমা সো’টা শুরু হওয়ার কিছুসময় পর আমার কাছে মায়ের কল আসে। আমার বাবা হার্ট এট্যাক করেছিল। আর কোনো উপায় না পেয়ে আমাকে যেতেই হয়েছিল। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে আমার ফোনটা হাত থেকে পড়ে সুইচস্টপ হয়ে গিয়েছিল।”
বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অন্বেষা।
-“আঙ্কেল এখন কেমন আছেন?”
-” হুম, এখন ঠিকঠাক। শোনো তোমাকে একটা ইনফরমেশন দিতে ভুলে গেছি। আমি এবার এমন কিছু কালেক্ট করেছি যেই সত্যিটা সবার সামনে আসলে শবনম ফারিহার ক্যারিয়ার শেষ।” অনেকটা রহস্যময় ভাব নিয়ে বলল অন্বেষা।
খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে,
-“কি পেয়েছ তুমি?”
-“আসলে হসপিটাল থেকে বের হয়েই শবনমের এসিস্ট্যান্টকে দেখলাম শবনমকে ফোনে কোনো কিছু একটার রিপোর্ট নিয়ে কথা বলতে। তারপর আমি ও-কে ফলো করলে দেখলাম ও-কে ডক্টরের সাথে শবনমের প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট নিয়ে কথা বলতে। ও চলে যেতেই আমি ডক্টরের থেকে আরো কিছু ইনফরমেশন পাই।”
অন্বেষা কিছু পেপারস তনিমার দিকে এগিয়ে দিয়ে,
-“দেখ শবনম প্রেগন্যান্ট আর ওর অনাগত সন্তানের পিতার নাম আবির আহমেদ।”
কথাটি শুনে তনিমা হতবাক হয়ে গেল। কয়েক মিনিট রিপোর্ট গুলোতে স্থির দৃষ্টি রেখে এবার আর নিজেকে সামলাতে পারল না। ওর চোখ থেকে পানি ঝরতে লাগল। ওর ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। বুকের বা পাশটা’ই চিনচিনে ব্যাথা হতে লাগল।
-“তনিমা নিজেকে শক্ত কর। ওদের প্রতারণার শাস্তি ওদের দিতেই হবে।”
কিছু একটা ভেবে নিজের চোখের পানি মুছে ঘাড় কয়েকবার উপর নিচ করে তনিমা,
-“হ্যা! ওদেরকে ওদের পাপের শাস্তি পেতে হবে। আমি আর কষ্ট পাব না। দেখ আমি আর.. আমি আর কাঁদব না।”
কথাগুলো বলতে বলতে আবারও অন্বেষাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল। অন্বেষা ওকে সামলানোর চেষ্টা করতে লাগল।
এখন ওর একটু একা থাকার প্রয়োজন। নিজের মনকে শান্ত করা প্রয়োজন সবচেয়ে বেশী। তাই অন্বেষা ওকে ওর বাড়িতে দিয়ে আসল। কিছু খাইয়ে দিয়ে ওকে একা থাকার জন্য কিছু সময় দিল।
আর নিজের রুমে এসে তনিমা ভাবতে লাগল সেইদিন গুলোর কথা যখন তনিমা, শবনম আর আবির ছিল তিনজন বেস্টফেন্ড। তনিমা ছিল সেন বাড়ির একমাত্র মেয়ে। টাকা পয়সা, ধন দৌলত, আভিজাত্য কোনো কিছুরই কমতি ছিল না। শবনমের পরিবার তনিমাদের মতো এত বিত্তশালী ছিল না। তবুও এই শবনমই ছিল তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। কি সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো!
শবনম আর তনিমা দু’জনেই ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়াশোনা করত। এমনকি শবনমের ফ্যাশন ডিজাইনিং-এর এডমিশন ফি টাও তনিমা দিয়েছিল। আরো অনেক ভাবেই তনিমা ও-কে হেল্প করেছে। কিন্তু তার প্রতিদান হিসাবে ও কি পেল! অবহেলা, অপমান, বিশ্বাসঘাতকতা ! ভাবতেই তনিমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে।
আবিরের সাথে রিলেশনের বিষয়টি যখন তনিমার পরিবার জেনে যায় তখন তারা ও-কে আবিরের মতো সাধারণ একটা ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়াতে বাঁধা দিয়েছিল। বিষয়টি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেলে তনিমা নিজের পরিবার ছেড়ে আবিরের কাছে চলে আসে। কোটি টাকার ধন সম্পদকে তুচ্ছ করে নিজের ভালোবাসার কাছে চলে এসেছিল। যার ফলস্বরুপ সে আজ তার বাবা মায়ের কাছে মৃত।
এত সময় হয়ে গেল আবির তনিমার একটা খোঁজও নিল না। সে শবনমের সাথে শবনমের সাকসেস সেলিব্রেট করতে ব্যস্ত।
বেড সাইড টেবিলে রাখা ছবির ফ্রেমটাকে বুকে জড়িয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগল তনিমা কারন এই ছবির ফ্রেমটা তার কাছে সাধারণ আর পাঁচটা ফ্রেমের মতো না। এটা তার মন খারাপের মুহূর্তে তার ভালোবাসার মানুষ দিয়েছিল। ছবিটিতে তনিমা আবিরের গলা ধরে তার পিঠের উপর চেপে আছে। এটা দেখে তনিমা কান্নার মাঝেই ফিক করে হেসে দেয়। কিন্তু বাস্তবটা মনে পড়তেই আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ে।
এই তনিমা সেনকে যত বারই দেখছে তত বারই অবাক হচ্ছে রাজ। তার ধারণাও ছিল না কোনো মডেল তার প্রেমিকের জন্য এভাবে কাঁদতে পারে। আসলে তনিমা যখন রেস্টুরেন্টে অন্বেষার সাথে কথা বলছিল তখন রাজ সেখানে উপস্থিত ছিল। একটা কোম্পানির সাথে ডিল সাইন করতে ঐ রেস্টুরেন্টে মিটিং করছিল। হঠাৎ তনিমাকে দেখে তার চোখ আটকে যায়। এই প্রথম সে সরাসরি এই মেয়েটিকে পর্যবেক্ষণ করল। মেয়েটি কত কিউট দেখতে! কাঁদলেও কোনো মেয়েকে এত্ত সুন্দর লাগে তা তার ধারণারও বাইরে। কিন্তু তাদের কথোপকথন শুনে এটা বুঝতে পারল সে কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার। কেননা একটা মানুষ অন্য একটি মানুষের সাথে ভালোবাসার অভিনয় করতে পারে, বন্ধুত্বের নাটক করতে পারে। কিন্তু প্রিয় মানুষটার জন্য সেই কাঁদতে পারে যে তাকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসে। চোখের জল কখনো মিথ্যা বলে না।
রাজের ধারনা মডেল মানে যার লাইফে অনেক ছেলের আসা যাওয়া চলে। সে যে কোনো এক পুরুষে সীমাবদ্ধ নয়। ড্রেস চেন্জের মতো ঘন ঘন তাদের প্রেমিক বা লাইফ পার্টনার চেন্জ হয়। কিন্তু এই প্রথম এমন একটি মেয়েকে দেখল যে এই শ্রেণীর হয়েও ঐই দলভুক্ত নই।
এই মেয়েটিকে সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না।
সারাক্ষণ শুধু এই মেয়েটির কথাই মনে আসছে।
বারবার শুধু এই মায়াবিনীর কান্না মাখা মুখটাই খেয়ালে আসছে। না চাইতেও ভুলতে পারছে না।
-“তাহলে কি আমি ঐই মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেললাম। ”
পরক্ষণেই মাথা নাড়িয়ে,
-“ওহ নো! আমি এসব কি বলছি। আমার মতো একজন মানুষের ঐ রকম একজন সাধারণ মেয়ের উপর ইমপ্রশড হওয়া মানায় না। কিন্তু ওর চোখে পানি দেখলে নিজেকে আমার এমন খাপছাড়া খাপছাড়া লাগে কেন! কেন তাকে ভুলতে….
-“স্যার, তনিমা ম্যাম সম্পর্কে আমি পারসোনালি খোঁজ নিয়ে অনেক আননোন ইনফরমেশন জানতে পারলাম।”
এসিস্ট্যান্টে আকাশের কথায় রাজের ঘোর কাটে। সে নিজেই অবাক হয়ে গেল, আরে এতক্ষণ সে কি সব ভাবছিল!
আসলে রেস্টুরেন্টে তনিমাকে ঐ অবস্থায় দেখে রাজ নিজের এসিস্ট্যান্টকে তনিমা সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলেছিল। যেগুলো পুরো দুনিয়া জানে সেগুলো বাদে অজানা তথ্য সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলেছিল।
-” হুম আকাশ বল, কি কি জানতে পারলে।”
চলবে