টপ_টেন_মডেল,পর্বঃ ১২

0
2508

টপ_টেন_মডেল,পর্বঃ ১২
ঋতু_পান্না

পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে সবাই বেরিয়ে পড়ল ভেন্যুর উদ্দেশ্যে। শবনমের মুখে তখনও আশানুরূপ হাসি রেখা দেখা গেল না। তনিমা ভাবতে লাগল, তাহলে এটা কী নতুন কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস!

রাস্তায় তনিমা বারবার নিজের ফোন চেক করছিল। গতকাল রাতে রাজ আর কোনো কল বা মেসেজ কিছুই করিনি। তনিমার রাজের উপর রাগ বাড়তে লাগল তবে তার রাগের চেয়ে অভিমানের পাল্লাটায় ছিল বেশি ভারী। রাজের একটা কল বা মেসেজের আশায় তার এই বারবার ফোন চেক করা। অন্বেষা তনিমার এই ছটফটানির বিষয়টা খেয়াল করে মুচকি হাসল।

ভেন্যুতে পৌঁছেই তারা বুঝল সেখানে ইতোমধ্যে হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটেছে। ঘটারই কথা টপ টেন ফাইনাল বলে কথা! পুরো সিনেমা জগৎ, ফ্যাশন জগৎ থেকে মাত্র দশজনকে বাছাই করা হয় তাদের কাজ, নৈপুণ্য, শারিরীক গঠন, পরিশ্রম ইত্যাদি সকল কিছুর উপর ভিত্তি করে। তাই স্বাভাবিকভাবেই পুরো দুনিয়ার চোখ এখন এই টপ টেন ফাইনালের প্ল্যাটফর্মে।

-“আবির আর শবনম তোমাদের দু’জনের সাথে আমার কিছু পার্সোনাল কথা ছিল!”
তারা দু’জনেই দু’জনের মুখে চাওয়াচাওয়ি করল। আবিরই বলে উঠল,
-“হুম, তো বলো।”
তনিমা মাথা নাড়িয়ে জানাল সে এখানে বলতে পারবে না। তাই সে তাদের একটি রুমে নিয়ে রুমের দরজা ভিতর থেকে লক করে দিল। শবনম আর ধৈর্যে কুলাতে না পেরে বেশ শান্তভাবেই বলে উঠল,
-“কী এমন কথা বলবে যে দরজা পর্যন্ত বন্ধ করে দিলে!”
আবির আর শবনমের দিকে তাকিয়ে তনিমা,
-“আবির, শবনম তোমরা কি জানো না কোনো প্রেগন্যান্ট মহিলাকে টপ টেন এওয়ার্ড দেওয়া হয় না!”

খানিকটা উত্তেজিত হয়ে আবির বলে উঠল,
-“মানে! কি বলতে চাচ্ছো কি তুমি?”
তনিমা ইশারা করে অন্বেষাকে কিছু বোঝাতেই সে এসে শবনম আর আবিরের হাতে কিছু ফাইল ধরিয়ে দিল। তারা অবাক হয়ে বলে উঠল,
-“কী এগুলো!”
-“আরে খুলেই দেখো না!”
ফাইলগুলো হাতে নিয়ে চোখ বোলাতেই তাদের আর বুঝতে বাকী রইল না এগুলো শবনমের প্রেগন্যাসি রিপোর্ট। সাথে এতদিন ধরে করে আসা শবনমের সো’র জায়গা তনিমার সো করার রিপোর্ট। তারা দুজনেই অবাক দৃষ্টিতে তাকাল তনিমার দিকে।
-“এগুলো কোথা থেকে পেয়েছ তুমি?”
-“কোথা থেকে পেলাম সেটা বড় কথা না, বড় কথা হলো এগুলো যদি মিডিয়ার কাছে যায় তাহলে ঠিক কি হতে পারে সেটা ভাবতে পারো?”
-“কী চাও তুমি?”
উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল আবির।
তনিমা জোরে জোরে হেসে ফেলল,
-“আমি চাই, আমি তোমাদেরকে দুইটা অপশন দিচ্ছি, নাম্বার ওয়ান এই টপ টেন ফাইনালে শবনম থাকবে না। আমি জানি এতে ওর স্বপ্ন ভাঙবে তাতে আমার কিচ্ছু করার নাই কারন তোমরা প্রতারক, ঠক। এন্ড নাম্বার টু, শবনম যদি সো’তে থাকে তাহলে আমি রিপোর্টগুলো মিডিয়ার হাতে তুলে দিতে বাধ্য হবো। নাও ডিসিশন ইজ ইয়োর্স।”

তনিমার শর্ত শুনে পাশ থেকে অন্বেষা খানিক চেঁচিয়ে,
-“তনিমা! তুমি ওদের এভাবে ছেড়ে দেবে। তুমি কেন ওদের সুযোগ দেবে, ওরা এটার যোগ্য না।”
মুচকি হেসে তনিমা জানাল,
-“তোমায় কে বলল আমি ওদের সহজেই ছেড়ে দিচ্ছি। শবনম ফারিহার স্বপ্ন আমি বেআইনি পন্থায় পূরণ করতে দিব না। আর এভাবে আমার প্রতিশোধ ঠিকই নেওয়া হচ্ছে আবার আমি ওদের একটা সুযোগও দিচ্ছি। সমসময় যে খারাপের সাথে খারাপ করতেই হবে সেটার কোনো মানে নেই। ভালোভাবে বাঁচার একটা সুযোগ দিচ্ছি। পুরো দুনিয়ার কাছে ওদের সম্মান আমি বহাল রেখেছি। ওরা চাইলেই একটা সুন্দর পরিবার গড়তে পারে।”

তনিমার শর্ত শুনে শবনমের যেন হার্ট এট্যাক হওয়ার অবস্থা। তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নের পরিসমাপ্তি ঘটবে এই ভাবে!

-“তো শবনম ডিসিশনটা তুমি নাও। তোমার কাছে কোনটা বেশি দামী তোমার টপ টেনের স্বপ্ন নাকী আবিরের ভালোবাসা, সম্মান আর স্ট্যাটাস!”

শবনম এবার আবিরের দিকে তাকল। আবিরের মুখে স্পষ্ট অসহায়ত্বের ছাপ। কয়েক সেকেন্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে চোখের পানি কোনোরকম আটকে বলতে লাগল,
-“আমি আবিরকে চাই। যেকোনো কিছুর মূল্যে আমি আবিরের সম্মান, ভালোবাসা আর কেয়ারিং চাই। সারাটাজীবন ওর সাথে থাকতে চাই। তুমি চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরে আসো তনিমা। তোমার লাইফে আজ থেকে এই শবনম নামের কোনো ছায়া থাকবে না। আমি আর টপ টেনের স্বপ্ন দেখব না, দেখব না।”
শবনমের চোখে স্পষ্ট পানির আভাস। স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে এসে স্বপ্ন ভেঙে গেলে যে কতটা কষ্ট লাগে সেটা হারে হারে টের পাচ্ছে শবনম। স্বপ্ন পূরণের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে একটা অসুস্থ মানুষও দিব্যি বেঁচে থাকতে শিখে যায়, কিন্তু স্বপ্ন ছাড়া একটা মানুষ কিভাবে বাঁচবে!
শবনমের চোখের পানি আজকে তনিমার মন গলাতে পারল না। সে শবনমের দিকে একটা পেপার এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“সরি টু সে শবনম। আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না। কি করব বলো? আমরা তো মানুষ আমরা নিজেও নিজেকে বিশ্বাস করতে পারি না। এই দেখো না, কাল রাতেও ভাবলাম সবার সামনে তোমাদের মুখোশের আড়ালের মুখগুলো টেনে আনব। কিন্তু এখন সেটা আর করতে পারছি না, আমার ভেতরটা আমাকে সেটা করতে সায় দিচ্ছে না। এই পেপারে অফিসিয়ালি স্টেটমেন্ট দেওয়া আছে তুমি নিজ ইচ্ছায় এই ফাইনাল থেকে বিদায় নিচ্ছ। তুমি জাস্ট এখানে একটা সিগনেচার করে দাও।”

সবাই বুঝতে পারল এই তনিমা আর আগের তনিমা নেই। এই তনিমার কাছে মানুষের ইমোশনের কোনো দাম নেই।
শবনম সিগনেচার করে দিতেই তনিমা আর অন্বেষা পেপারটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। শবনম আবিরকে ঝাঁপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। শবনমকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো শব্দই খুঁজে পেল না আবির।

ওদের সাথে এতটা খারাপ ব্যাবহার করতে তনিমারও বেশ খারাপ লাগছিল। কারন শবনমের চোখের পানি আজকে মিথ্যা ছিল না। এই চোখের পানি কখনো মিথ্যা বলে না।
কিন্তু তনিমাকে এতটুকু কঠিন আজকে হতেই হতো।

অতঃপর জমকালো আয়োজনে ফাইনাল শুরু হলো। প্রথম পর্যায়ে পনেরো জন প্রতিযোগী থেকে মোট টপ টেন অর্থাৎ দশ জনকে নির্বাচন করা হলো। এই দশ জনের মধ্যে তনিমা থাকলেও এবার মূল লড়াই শুরু কারন এবার টপ টেন থেকে সেরার সেরা টপ থ্রি বিচার করা হবে। যেহেতু এটা আন্তর্জাতিক একটি এওয়ার্ড সো ছিল তাই সেখানে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগী ছিল। সবাই নিজেদের সংস্কৃতি, সামাজিকতা, পছন্দ অনুযায়ী নিজেদের সাজিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় উপস্থাপন করছিল।

ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে একমাত্র বাঙালি হিসাবে সেখানে শুধুই তনিমা ছিল। রাজ তনিমার জন্য বিখ্যাত ডিজাইনার, মেকআপ আর্টিস্ট ঠিক করে দিয়েছিল। তবে তনিমা জানত উনারা পরী এন্টারটেইনমেন্ট এর সাথে চুক্তিবদ্ধ আর্টিস্ট। যেহেতু রাজের ফ্যাশন, মডেলিং সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা ছিল তাই সে নিজেই কস্টিউম ডিজাইনারের পরামর্শে তনিমার ড্রেস, মেকআপসহ যাবতীয় সকল কিছু নিজেই সিলেক্ট করেছে। তনিমার সাজের থিম ছিল পাশ্চাত্য কোনো সংস্কৃতির আধুনিক কোনো সাজগোজ নই বরং একজন ‘বাঙালি বধূ’।

যথারীতি তনিমাকে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি, মাথায় ঘোমটা, খোঁপায় বেলী ফুলের মালা, চোখে কাজল, হালকা মেকআপ দিয়ে খুব করে তৈরি করানো হলো। যখন সে স্টেজে উঠে আসল তখন মনে হচ্ছিল এ যেন প্রাচীন রূপকথার কোনো দেবীর উত্থান। তনিমা সাজের বিশেষত্ব ছিল তার পায়ে কোনো জুতা ছিল না। তার ধবধবে সাদা শরীরটায় যেন লাল রঙা আভা ছড়াচ্ছিল। এক মনোমুগ্ধকর পারফর্মেন্সের মধ্য দিয়ে তার পারফর্মেন্স শেষ হলো। প্রতিটা মুহূর্তে সে রাজকে মিস করেছে। রাজের কথা ভাবতে ভাবতেই সে নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছে কারন সে নিজেকে তখনই রাজের যোগ্য মনে করবে যখন সে টপ টেনের মধ্যে ভালো একটা পজিশনে আসতে পারবে।

হোটেল রুমে বসে এগুলো দেখছিল আর চোখের পানি ঝরাচ্ছিল শবনম। তার ভিতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। কষ্টে তার ভিতরটা ফেটে যাচ্ছিল। ফট করে টিভিটা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেল। যেহেতু আবির তার এজেন্সির প্রতিনিধি হিসাবে ছিল তাই তাকে অডিটোরিয়ামে উপস্থিত থাকতেই হলো। এসময়টা তার শবনমের পাশে থাকা দরকার ছিল। কিন্তু কিছু করার নেই তাকে এখানেই থাকতে হবে।

দশজন প্রতিযোগীরই আকর্ষণীয় পারফর্মেন্স একে একে শেষ হলো। সবাই নিজেদের সেরাটা দিয়ে নিজেদের মেলে ধরেছে। বিচারকগণ কঠিন বিচারকার্য সম্পন্ন করে রেজাল্ট তুলে দিলেন অর্গানাইজার কমিটির কাছে। তারা ফাইনাল রেজাল্ট ঘোষণা করবেন।

অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ চলে এলো। এখন টপ থ্রি’র রেজাল্ট ঘোষণা করা হবে। একে একে সব প্রতিযোগীকে স্টেজে ডেকে নেওয়া হলো। সবার মাঝেই এই মুহূর্তে উত্তেজনা তুঙ্গে।

প্রথমেই চ্যাম্পিয়ন অর্থাৎ টপ ওয়ানের নাম ঘোষণা করা হবে তনিমা চোখ বন্ধ করে উপর ওয়ালার কাছে প্রার্থনা করতে লাগল। কিন্তু টপ মডেল হলেন জেমি বার্ভস’। উনি একজন আমেরিকান মডেল। নামটি শোনার সাথে সাথেই তনিমা চোখ খুলে নিল। নাম ঘোষণার সাথে সাথেই চারিদিক সবাই হাত তালি দিয়ে তাকে অভিবাদন জানাল। চারপাশ থেকে নানা রঙের লাইটের আলো এসে পড়ল, সাথে আতশবাজির ঝলক। মুহূর্তেই পুরো অডিটোরিয়ামে হৈইচৈই শুরু হয়ে গেল।

এবার টপ টু’র নাম ঘোষণা করার পালা তনিমার হাত পা কাঁপতে লাগল। টেনশনে তার দম আটকে আসার উপক্রম। ‘তনিমা সেন’ নামটি শোনার সাথে সাথেই চোখ খুলে ফেলল সে। আনন্দে সে লাফিয়ে উঠল। সাথে সাথেই উপর ওয়ালার শুকরিয়া জানাতে ভুল করল। প্রথমেই তার চোখে মা,বাবা আর রাজের ছবি ভেসে উঠল। আনন্দে সে প্রায় কেঁদেই দিবে এমন অবস্থা। আবারও আগের বারের ন্যায় অডিটোরিয়ামে হৈইচৈই পড়ে গেল।
স্টেজের বাইরে অন্বেষা আনন্দে কেঁদেই দিল। আবিরও খুব খুশি হয়েছে যা তার মুখ দেখেই বোঝা গেল। এরপর টপ থ্রি’র নাম ঘোষণা করা হলো।
ঘোষনা শেষে তাদের তিনজনকে মাথায় সেরার সেরা মুকুট পরিয়ে দেওয়া হলো। লাইট, ক্যামেরার ভীড়ে পরিবেশটা আবারও গরম হয়ে উঠল। মুকুট পরানো শেষে তাদেরকে তাদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে অনুরোধ করা হলে, সবাই তাদের আনন্দ অনুভূতি সকলের সাথে শেয়ার করল। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উওর দেওয়াসহ সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তারা স্টেজ থেকে নেমে এলো। অন্বেষা তনিমাকে জড়িয়ে ধরে দুজনেই কেঁদে দিল। একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে দুজনেই ফিক করে হেসে দিল।

-“আচ্ছা আবির কোথায়?”
অন্বেষা খানিক ভেবে উত্তর দিল, -“কিছুসময় আগেও তো এখানেই ছিল।”
আর কথা না বাড়িয়ে তারা হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
তনিমার মনে রাজের জন্য অভিমানের পাহাড় জমতে লাগল। মনে মনে রাজকে বকাবকি শুরু করে দিল।

আবির হোটেলে ফিরে দৌড়ে শবনমের রুমে যায়। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হতবাক হয়ে, শবনম বলে জোরে চিৎকার করে উঠে। কারন রুমের সারা ফ্লোর রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। আর শবনমের হাত কাটা..

এদিকে ইউ.এস এ-র ফ্লাইটে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার শিকার রাজ..

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here