টপ_টেন_মডেল,পর্বঃ ১৩ ( শেষ পর্ব)
ঋতু_পান্না
ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে গেল তনিমা। রাজ রাজ বলে পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে লাগল। পাশ থেকে অন্বেষা বলে উঠল,
-“কি হলো তনিমা! বস কোথায়?”
তনিমা অস্হির হয়ে বলতে লাগল,
-“রাজ.. রাজ! রাজের বিমান.. বিমান এক্সিডেন্ট করেছে! ও কোথায়..ও কোথায় অন্বেষা!”
তনিমার অস্হিরতা দেখে অন্বেষা বুঝতে পারল ও হয়তো রাজ স্যারকে নিয়ে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছে।
-“রিল্যাক্স তনিমা, স্যারের কিছুই হয়নি। তুমি দুঃস্বপ্ন দেখেছ। রিল্যাক্স! স্যারের কিছুই হয়নি।”
বেশ অনেকক্ষণ বোঝানোর পর তনিমা এবার খানিকটা ঠান্ডা হলো। আসলে সো’থেকে ফেরার পথে গাড়িতে ঘুমিয়ে গিয়েছিল সে। আর তখনই এই স্বপ্নটা দেখে।
শবনমকে এম্বুলেন্সে করে হসপিটালে নেওয়া হচ্ছে। এম্বুলেন্সে শবনমের পুরোপুরি সেন্স না থাকলেও সে আবিরের আহাজারি স্পষ্ট টের পাচ্ছিল।
-“জান, জান তুমি চোখ খুলে রাখো। আমরা..আমরা চলে এসেছি! কিচ্ছু হবে না। তুমি..তুমি এটা কেন করলে! তোমার কিছু হলে আমার কি হবে? তোমাকে ছাড়া আমার কী হবে!.. তুমি কেন করলে এটা! কেন শবনম.. কেন..” কান্নার কারনে আবির আর কোনো কথায় বলতে পারছে না।
আবিরের চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছিল। আবিরের কোলে মাথা রেখে শবনমও কাঁদছিল। কারন তার জানা ছিল না, আবির তাকে এত্তটা ভালোবাসে। ওর পাগলামি দেখে শবনমের আফসোস হতে লাগল।
যেই মানুষটা তাকে এত ভালোবাসে তাকে রেখে কী করে সে স্বার্থপরের মতো মরতে চলে গেল।
-“আবির আমি বাঁচতে চাই। তোমার সাথে.. তোমার জন্য, তোমার সন্তানের.. জন্য, তোমার হয়ে.. বাঁচতে চাই আবির..”
আর কিছু বলতে পারল না শবনম তার আগেই তার চোখ দুটি অন্ধকারের অতলে হারিয়ে গেল।
-“হোয়াট! কি বলছেন কি আপনি?”
-“জ্বি ম্যাম, শবনম ম্যাম সুইসাইড এটেম্প নিয়েছিলেন। উনাকে হসপিটালে নেওয়া হয়েছে।”
হোটেলে ফিরে আবির আর শবনমকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে হোটেল ম্যানেজারের কাছ থেকে এসব জানতে পারল তনিমা আর অন্বেষা । ততক্ষণাৎ তারা হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়।
হসপিটালে পৌঁছে তারা দেখল আবির হসপিটালের ইমার্জেন্সি কেবিনের সামনের একটা বেঞ্চে বসে কাঁদতেছে। তনিমা ও’র সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ও তনিমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে বাচ্ছাদের মতো কাঁদতে লাগল।
-“তনিমা, তনিমা..আমার শবনম। ও.. ও সুস্হ হয়ে যাবে তো! ওকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকব..”
আর কিছু বলতে পারছে না সে কান্নায় ভেঙে পড়ছে বারবার। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা তনিমার জানা নেই। শবনমের এই অবস্থার জন্য কিছুটা সেও দায়ী। সে তো এমনটা চাইনি!
শবনমের কিছু হয়ে গেলে সে নিজেকে কোনোদিনও ক্ষমা করতে পারবে না!
হঠাৎ ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড থেকে ডাক্তার বেরিয়ে আসলে তারা দৌড়ে তাঁর কাছে যায়।
ডাক্তার জানায়, শবনম এখন শঙ্কামুক্ত তবে এখনও সেন্স আসিনি। কয়েট ঘন্টা সময় লাগবে।
প্রায় আড়াই ঘন্টা পর শবনমের সেন্স আসে। প্রথমেই গুটিগুটি পায়ে আবির কেবিনে ঢুকে।
-“তুমি এমনটা কেন করলে শবনম। আমার কথা তোমার একটি বারের জন্যও মনে আসেনি!”
শবনমের শরীর প্রচন্ড দুর্বল। তবুও থেমে থেমে সে বলল,
-“আমি কি জানতাম নাকী আমার পাগলটা আমাকে এত্ত বেশি ভালোবাসে! তোমাকে প্রমিজ করছি, আর কোনোদিন তোমাকে আর তোমার বেবিকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবব না।”
দু’জনেই মুচকি হেসে উঠে। আবির শবনমের কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে বুকে জড়িয়ে নেয়।
কেবিনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে দুজনেই খানিক ছিটকে গেল।
-“আরে তনিমা, এসো ভিতরে এসো!”
-“কেমন আছো?”
-“এই তো বেঁচে গেলাম। ও কনগ্রাচুলেশনশ তনিমা!”
-“আ’ম সরি শবনম। আসলে আমি..”
তনিমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই শবনম মুচকি হেসে বলে উঠল,
-“আরে তুমি কী ভাবছ আমি হেরে গিয়ে কিছুই পায়নি! তুমি একাি সব পেয়ে গেছ! আমিও পেয়েছি, আমি আবিরের মতো একজন লাইফ পার্টনার পেয়েছি যে আমাকে ভালোবেসে সারাজীবন আগলে রাখবে।”
যাক, এতক্ষণে তনিমার নিজেকে একটু হালকা লাগছে।
-“তনিমা আমরা দেশে ফিরেই বিয়েটা করে নিব। তুমি আমাদেরকে ক্ষমা করে দিও।”
-“হ্যাঁ, এবার থেকে ছুটিয়ে সংসার করব। ভুলে যেও না তুমি কিন্তু খালামনি হতে যাচ্ছ তোমার অনেক দায়িত্ব। ”
শবনমের কথায় সবাই হেসে দেয়।
তিনদিন পর তারা দেশে ফিরে আসে। এর মাঝে রাজ কোনোভাবেই তনিমার সাথে যোগাযোগ করেনি, তনিমার ইচ্ছা থাকলেও সে রাজের কোনো খোঁজ বের করতে পারল না।
বাড়িতে এসে লম্বা একটা ঘুম দিল তনিমা। ঘুম থেকে উঠে দেখে বিকাল হয়ে গেছে। ফ্রেশ হয়ে রুমে আসতেই কেউ তার মুখে কিছু একটা স্প্রে করে দেয়। সাথে সাথেই সেন্স হারিয়ে ফেলে সে।
সেন্স ফিরতেই সে পিটপিট করে চোখ খুলে নিজেকে কোনো বাড়ির ড্রয়িংরুমে আবিষ্কার করে। চারদিকে তাকিয়ে, আশেপাশের মানুষগুলোকে দেখে অবাক হয়ে গেল সে। কারন এই মুহূর্তে সে আর কোথাও না স্বয়ং নিজের বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে আছে। সেখানে রাজকে দেখে তো তনিমা ভূত দেখার মতো চমকে উঠে। রাজ তার বাবার সাথে বসে উনার সাথে হাসিমুখে কথা বলছেন।
এতদিন পর বাবা, মা’সহ পুরো পরিবারকে পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে গেল সে সহ সকলেই। যখন তার বাবা জানতে পারলেন উনার মেয়ের বিয়ে আবিরের সাথে না বরং রাজের সাথে হয়েছে তখন আর আপত্তি করলেন না। তার উপর মেয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করেছে অতএব মেয়েকে দূরে রাখার কোনো মানেই হয় না।
সকলের সাথে কথা বলে সবাই তাকে আর জামাইকে রুমে যেতে বলল। রাজ মনে মনে বলল,
-“লাভ ইউ শাশুমা, এটা শোনার অপেক্ষাতেই তো ছিলাম।”
অতঃপর রাজ আর তনিমা, তনিমার রুমে চলে এলো।
-“থ্যাংকস আ লট রাজ! আমাকে এত বড় একটা গিফট দেওয়ার জন্য। আমি ভাবতেও পারিনি বাবা, মা আমাকে মেনে নিবেন। থ্যাংকস এ্যাগেইন!”
-“শুধুই থ্যাংকস! আমি তো আরও অন্য কিছু আশা করেছিলাম।” বাঁকা হেসে বলল রাজ।
তনিমার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই সে জোরে জোরে চেঁচিয়ে বলতে লাগল,
-“এই, এই আপনি এতদিন কোথায় ছিলেন বলুন তো! আমার একটা খোঁজও নেন নি।” খানিকটা অভিমানী সুরে বলল তনিমা।
রাজ সরাসরি উওর দিল,
-“ব্যাংকক গিয়েছিলাম, তোমার চার নাম্বার সতিনের সাথে হানিমুন সারতে।”
তনিমার চোখ রসগোল্লার মতো হয়ে গেল। চোখ পাকিয়ে রাজের দিকে তাকাতেই রাজ ভয় পাওয়ার ভঙ্গিতে হাত জোড় করে বলল,
-“বিশ্বাস করো তোমার কোনো সতিন নাই! রাহাত আর অন্বেষা বলেছিল কিছুদিন তোমাকে অবহেলা করতে তাহলে নাকী তুমি আমাকে ভালোবাসো কি না বুঝতে পারবে। আর কে বলল আমি আমার বউয়ের খোঁজ নেয়নি, তোমার প্রতিটা সেকেন্ডের খোঁজ রেখেছি।”
-“তো আমাকে কি কল দিয়েছেন বা কোনো টেক্সট করেছেন?”
-“শুনলাম তুমি নাকী আজকাল আমাকে খুব মিস করো! কাহিনী কি সত্যি?”
-“হুর আপনি কে যে আপনাকে মিস করতে যাব!”
-“তো ভালোবাসো না আমায়?”
-“নাহ, আপনাকে কেন ভালোবাসতে যাব! হু আর ইউ?”
রাজকে রাগানোর জন্য বলল তনিমা। রাজ এবার তনিমার কাছে এসে নিয়ে,
-“আমি কে তাইনা! আমি কে তাই দেখাচ্ছি।”
বলেই তনিমাকে কোলে করে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। আর তনিমা রাজের বুকে ইচ্ছেমত কিল, ঘুষি মারতে লাগল।
-“হ্যালো কে?”
-“আমি গো আমি, তোমার মেয়ের বাপ।”
-“এই আপনি আবার উল্টাপাল্টা কথা বলছেন!” খানিক রাগ দেখিয়ে বলে উঠল অন্বেষা।
রাহাত প্রায় সময়ই অন্বেষাকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করে। প্রথম প্রথম অন্বেষার এগুলো বিরক্ত লাগলেও এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।
-“জানো আমাদের মেয়ের নাম রাখব ‘ফুলকলি’। সুন্দর না নামটা?”
-“ছি! এটা কোনো নাম হলো আমাদের মেয়ের নাম রাখব ‘রাইসা’!”
রাহাত তড়িঘড়ি করে প্রশ্ন করল,
-“কি বললে, কি বললে আমাদের মেয়ে মানে কি? তার মানে তুমি কি আমার প্রেমে পড়ে গেছ আর এখনই আমাকে নিজের মেয়ের বাবা ভাবতে শুরু করেছ।”
-“ধূর! আমি কিছু বলিনি! ফোন রাখুন!”
-“রাখব না, আমি আমার বউয়ের সাথে আমি কথা বলছি তাতে কার বাপের কি? হু!”
এভাবেই প্রতিটা মানুষ নিজের ভালোবাসার, ভালোলাগার মানুষকে নিয়ে আনন্দ, খুশি আর অফুরন্ত ভালোবাসার জগৎ তৈরি করুক।
সমাপ্ত।