টরেটক্কা – ৬

0
808

টরেটক্কা – ৬

‘মেয়ে আমাদের খুবই পছন্দ হয়েছে, মাশাআল্লাহ।’ সৌরভের বাবার কথা শুনে হায়াত আংকেল স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।
‘আলহামদুলিল্লাহ। ছেলে আর মেয়ে দুজন দুজনকে পছন্দ করলে আর তো কিছু লাগে না।’
‘ঠিক তাই। আর জুটি তো উপরওয়ালাই তৈরি করে দেন। আমরা তো উছিলা মাত্র।’
‘আমরা তাহলে মিষ্টিমুখ করি। খুশির খবরে মিষ্টি খাওয়া সুন্নত। আমাদের ছেলেমেয়ে, আমাদেরই তো বেশি খুশি!’ সৌরভের আনা মিষ্টির প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে হায়াত আংকেল বললেন সবাইকে মিষ্টিমুখ করাও রাফিন।’
সবাইকে মিষ্টি দিয়ে দীঘির কাছে আসলে ও ফিসফিস করল ‘আমাকে দুটো মিষ্টি দে রাফিন।’
আমি অবাক হলাম ‘লালমিষ্টি তো তুই খাস না!’
‘আজ খাব। আমার বিয়ের মিষ্টি আমি খাব না? দে আমাকে। দুটোই দিবি।’
আমার মুখে মিষ্টি তেতো লাগল। পুরো প্যাকেট ওর দিকে ছুঁড়ে দিলাম ‘খা। জন্মের মত খা। খেয়েখেয়ে ওজন দুইমণ বানিয়ে ফেল। ঢেপসি মেয়ের দিকে তখন আর কেউ তাকাবেও না।’
‘আমার দিকে কেউ না তাকালে তোর কী সুবিধা!’
‘আমার কী সুবিধা হবে?’
‘তবে বললি কেন?’
‘আমার মন চাইছে আমি বলছি। তুই কি অর্থমন্ত্রী? সারাবছরের বাজেট দিবি? আমার কথার উপর ভ্যাট, ট্যাক্স বসাবি?’
‘মন চাইলেই বলবি কেন?’
‘আমার মন, আমার কথা। আমি বলব, বলব, বলব.. ‘
আমাদের মাঝে আরেকটা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধটাইপ ঝগড়া লেগে যাওয়ার আগেই সৌরভের মা এইদিকে বোম ফাটালেন ‘ভাইসাহেব আমরা চাইছি আজকেই দীঘিকে আংটি পরিয়ে যেতে। আপনাদের যদি কোনো আপত্তি না থাকে!’
হায়াত আংকেল অপ্রস্তুত হলেন। আমতা আমতা করে বললেন ‘কিন্তু আমরা তো তৈরি না। আমাদের আত্মীয় স্বজনরা আছে, তাদেরকে কিছু জানাইনি। হুট করে এনগেজমেন্ট, কেমন হয়ে যায় না?’
‘আংটি পরানো মানেই তো আর বিয়ে না। আমার একটাই ছেলে, আমিও ধুমধামে অনুষ্ঠান করতে চাই। তবে আংটি পরানো মানে পাকা কথা হয়ে যাওয়া। ছেলেমেয়ে উভয়েরই বিয়ে নিয়ে যে অস্থিরতা সেটা কেটে যায় এই ভেবেই এসেছি আমরা।’ ভদ্রমহিলা কটমট করে তাকালেন ছেলের দিকে। সম্ভবত ছেলের জন্যই এই তাড়াহুড়ো করা। ওনাকেও খুব একটা সন্তুষ্ট দেখাচ্ছে না এই সিদ্ধান্তে৷ একদিন আগেই মাত্র সৌরভের সাথে দেখা হলো দীঘির আর আজই পাকাকথা, বেশিই তাড়াতাড়ি ঘটছে সব।
সৌরভের বাবা উদ্যোগী হয়ে বললেন ‘জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ উপরওয়ালার হাতে। চলেন ভাইসাহেব বিসমিল্লাহ করে ফেলি। মেয়ে দেখতে এসে বিয়ে পড়ানোর গল্পও কম নেই ইতিহাসে।’
হায়াত আংকেল আমার আব্বুর দিকে তাকালেন। আব্বুও দ্বিধায়। এদিকে গন্ধগাধাটা আমাকে মেসেজ দিয়েই যাচ্ছে। ‘ভাইয়া প্লিজ!’
এত লোক থাকতে এই গাধার আমাকে জ্বালাতন করার কথা কেন মনে হলো এটা আমার মাথায় আসছে না। কোন এক প্রবন্ধে পড়েছিলাম, একসাথে থাকতে থাকতে নাকি স্বামী-স্ত্রীর চেহারা একইরকম হতে শুরু করে। দীঘি আর ওর বিয়ে তো এখনো হয়নি। তবে ওদের স্বভাবে এত মিল কী করে এলো? মনে পড়ল, জুম্মাবারে হুজুর বলেছিলেন ‘নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে স্বামীর পাজরের হাড় থেকে।’ যে মেয়ের জন্মই হয়েছে আমাকে জ্বালাতন করার জন্য, যার সারাদিনের ধ্যানজ্ঞান আমাকে বিরক্ত করা, সেই মেয়ের হবুস্বামীও যে বিরক্ত করার জন্য আমাকেই খুঁজে নেবে এ আর কঠিন কী অংক!

আমি যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছি। এই গাধার এত তাড়া কীসের? দীঘি কি ভেগে যাচ্ছে? এটা তো ভালো জাতের ছাগল দেখছি। গন্ধওয়ালা ছাগলটা আবার মুখ করুণ করে তাকিয়েছে আমার দিকে। আমার মায়া লাগছে। কোরবানির আগে দুটো কাঁঠালপাতার জন্য ছাগলের চোখে আকুতি দেখে যেমন মায়া লাগে তেমন মায়া লাগছে। আর ওই কাঁঠালপাতা তাড়াতাড়ি শশুর বাড়ি গেলে আমারই লাভ। বিপাশার লাগানো নতুন পাথোসের টবে কুলির পানি ফেলতে কেউ বাধা দেওয়ার থাকবে না। আমি দীঘির দিকে তাকালাম। এই মেয়ের চোখ খুব দুর্বোধ্য৷ এই চোখের ভাষা ডিকোড করতে গেলে অনেকগুলো প্রগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ শিখতে হবে।
কী দরকার? বাংলা পারি, ইংরেজি পারি, আরবিও পারি, হিন্দিও টুকটাক মে আতাহু, তুম যাতিহু পারি। আর ভাষাটাষা প্রোগ্রাম শেখার দরকার নেই। দীঘির চোখের না পড়তে পারা ভাষা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে আমি হায়াত আংকেলকে চুপি চুপি বললাম ‘আংকেল আংটিই তো পরাবে শুধু। সমস্যা কী। আজকে যাবে, আরেকদিন আবার আসবে, এইসবে সময়ও নষ্ট, আর খরচও তো আছে। ঘটায়ে দেন।’ বলে ঘাড় কাত করে নিজের যুক্তিতে ভালোমতো জোর দিলাম।
আংকেল আমার পরামর্শে খুব একটা প্রভাবিত হলেন বলে মনে হলো না। নিজেই দীঘিকে জিজ্ঞেস করলেন ‘কী রে মা তুই কী বলিস? তুই চাইলে সময় নে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। একদম কোনো চাপ নেই।’
দীঘি মাথাটা নিচু করে ফেলল। কড়াৎ কড়াৎ করে বাজ ফেলে যে গলা দিয়ে সেই গলা দিয়েই সুমিষ্ট কোকিলকণ্ঠী হয়ে বলল ‘তোমরা যা ভালো মনে করো!’
হায়াত আংকেল দীঘির মায়ের দিকে তাকালেন। আন্টিও বললেন ‘এত করে চাইছে, পায়ে ঠেলার কী দরকার? আর বিয়ে তো না। পাকা কথা শুধু।’
সবদিকেই বেশ সুন্দর সম্মতি পাওয়া গেল। সবাই একমত। সৌরভকে দীঘির পাশে এনে বসানো হলো। সৌরভের মা একটা আংটি বের করে দীঘিকে বললেন, ‘দেখি তোমার হাতটা!’
দীঘি বাঁহাত এগিয়ে দিলো। ওর হবুশাশুড়ি ওর ডানহাতটা টেনে নিয়ে বললেন ‘বাঁহাতের অনামিকার সাথে হৃদয়ের কী একটা যোগাযোগ আছে, বলে সবাই। ওই আঙুলে আংটি সৌরভই পরাবে।’
দীঘির শ্যামলা মুখটা লজ্জায় লালটুকটুক করতে থাকল!
আমার কেমন বুকটা জ্বালাপোড়া করছে। চানাচুর বেশি খেয়ে ফেলেছি মনে হয়। বম্বে সুইটস চানাচুরের প্যাকেটের সবগুলো বাদাম বেছেবেছে খেয়ে নিয়েছি। এসিডিটি হচ্ছে এখন। কী জ্বালা! বুক জ্বলছে, পেট জ্বলছে, গলা জ্বলছে, মাথাটাও গরম হয়ে উঠছে!
এই সুন্দর ছবিটা নষ্ট করে দিতে ইচ্ছে করছে। এত সুন্দর একটা ছবি। এত সুন্দর! আমার বিয়ে করার ইচ্ছেটা মাথা নাড়াচাড়া দিয়ে উঠল। এমন লালটুকটুক একটা ছবি আমারও চাই। আমিও কারো অনামিকায় আংটি গলাতে চাই। কালই। মনে মনে সিদ্ধান্ত পাকা। একদম পাকা। কাল সকালেই মিশন বিয়ে শুরু,
‘দরজা খুইলা দেখুম যারে,
করুম তারে বিয়া!’

চলবে..

Afsana Asha

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here