টরেটক্কা-৯ (শেষপর্ব)

1
1950

টরেটক্কা-৯ (শেষপর্ব)
Afsana Asha

‘তুই মাহীকে বিয়ে করবি?’
‘করলাম!’ নিরাসক্তচোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম আমি।
‘ওই এইদিকে তাকা? আকাশে কী দেখিস? আমার দিকে তাকিয়ে কথা বল?’
‘কেন? তুই কোথাকার হুরপরী যে তোর দিকে তাকিয়ে ধ্যান করা লাগবে?’
‘রাফিন? তাকা আমার দিকে? তারপর বল, করলাম মানে কী? মাহীকে কেন বিয়ে করবি তুই?’ দীঘি রেগে আছে৷
‘তাতে তোর সমস্যা কী? জ্বলে? বেশি জ্বলে? আর তুই, তুই যে নাচতে নাচতে আংটি পরে নিলি তাতে কিছু না? আমি বিয়ে করতে চাইলেই সমস্যা? কেন? তুই আমার সামনে আরেকজনকে বিয়ে করবি, আমি করলে দোষ হয়ে যাবে? করব। একশোবার বিয়ে করব৷ মাহীকে করব, রাহীকে করব, জুহিকেও বিয়ে করব! তোর কী? তুই আমার সামনে ড্যাঙড্যাঙ করে আরেকজনের বউ হয়ে যাবি আর আমি চান্দা মেরে চান্দা গাইব? তুই কেন আমাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতে রাজি হলি?’
আমি হড়বড় করে কী কী বললাম জানি না, রাগ উধাও হয়ে দীঘির চোখ টলটল করছে। এক্ষুনি জল গড়িয়ে পড়বে পড়বে।
দীঘির নাক ফুলছে, ঠোঁট কাঁপছে। ও বলল ‘তুই তো আমাকে বিয়ে করবি না বলেছিলি!’
‘রাগ করে বলেছিলাম। তুই গালাগাল দিয়েছিলি আমাকে। তাই বলে তুই আরেকজনকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাবি?’
‘কিন্তু কোনোদিন তো ভালোবাসিস বলিসনি!’
‘কে বলল ভালোবাসি? এখন বলেছি?’
‘আমি জানি।’
‘জানিস? জানতিস?’
দীঘি উত্তর করল না। মাথাটা উপরনিচে ঝাঁকালো শুধু।
‘আগেও বলিনি, এখনো বলিনি। তাও বুঝে গেলি, ভালোবাসি?’
‘হুম। তোর মনের কথা আমার চাইতে বেশি কে জানে?’
‘আর তুই? তুই ভালোবাসিস আমাকে?’
দীঘি ওর দীঘির মতো দুটো টলটলে চোখ নিয়ে তাকালো।
আমি আবার জানতে চাইলাম ‘বল? বল, ভালোবাসিস আমাকে?’
‘হু!’
‘তবে তুইও তো বলিসনি!’
‘অনেকবার বলেছি। অনেকরকম করে বলেছি।’
‘কই? কোনোদিন তো শুনিনি! মনে মনেই বলেছিস?’
‘ইশারায় বলেছি, যেন তুই বুঝে নিস!’
‘ওরকম টরেটক্কা করে বললে আমি বুঝব কী করে? এমন করে কেন বলিসনি?’ আমি দীঘির কাছাকাছি এলাম। ওর মুখটা তুলে ধরলাম আমার দিকে। ও চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল ‘তুই খুব মজা করতিস তাহলে, ভয় হতো হয়তো ঠাট্টাই করবি আমাকে নিয়ে। তাই বলিনি! আমি খুব লজ্জা পেতাম যদি তুই আমার অনুভূতিগুলোকে তামাশা বানিয়ে নিতিস?’
‘তবে এখন কেন বললি? এখন তামাশা করব না, কথা দিয়েছি আমি?’
‘আর সহ্য পারছিলাম না! ওদিকে সৌরভ আর এদিকে মাহী!’ দীঘি কেঁদে ফেলল।
‘আমি মাহীকে বিয়ে করতে না চাইলে সহ্য করতে পারতি? সৌরভের বউ হয়ে যেতি?’
দীঘি মাথা নাড়ল জোরে জোরে। নাক টেনে টেনে বলল ‘আমি ওদের আংটিটা ফিরিয়ে দিয়েছি!’
‘কবে? কখন?’
‘আজ সকালেই। ক্ষমা চেয়েছি ওদের কাছে। বলেছি, আমি এই বিয়েটা করতে পারব না।’
‘আরিব্বাস! এইজন্য এই গন্ধগাধা আমাকে ফোন করে করে পাগল করে ফেলেছে। ওর জন্যই আমি ফোন ফ্লাইটমুডে রেখে দিয়েছি!’
‘গন্ধগাধা কে?’
‘ওই তোর সৌরভ!’
আমার চক্ষুশীতল করে দীঘি হেসে ফেলল ‘যাহ! কী সুন্দর নাম লোকটার, তুই কী বানিয়ে দিলি!’
‘মায়া লাগছে? খবরদার, আর কখনো যদি ওই গাধার জন্য মায়া লাগে বলেছিস, তোর খবর আছে!’
দীঘি আমার হাতে খামচি দিলো। আমি চিৎকার করলাম ‘আরেহ কুকুরের নখ, আমার দুইকেজি মাংস তুলে নিল। রাক্ষসী, মানুষখেকো!’
‘ইতর!’ গালাগালও দিলো আবার আমার হাতে আঁচড়ও কেটে দিলো দীঘি।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে দ্রবীভূত হতে থাকলাম। মনে হলো অসভ্য, ডাইনি, মানুষখেকো হলেও মেয়েটা মিষ্টি। খুব মিষ্টি। মিষ্টি টু দ্য পাওয়ার ইনফিনিটি। আর এই মিষ্টি ইনফিনিটি আমার শরীরের সব মাংস, চামড়া, হাড্ডি তুলে ফেললেও আমি খুব আনন্দিত হব।
নিজেকে নিজে বললাম ‘বাহ, রাফিন, তোর জীবনটা তো চমৎকার। অতি চমৎকার!’

পরিশিষ্ট ঃ

‘রাফিন আর দীঘি দুইজনের উদ্দেশ্যেই এখন আমি কিছু কথা বলব।’
হায়াত আংকেল লম্বাচওড়া ভাষণের জন্য প্রস্তুত। আংকেল বলব নাকি বাবা, আমি একটু দ্বিধাগ্রস্ত এই প্রশ্নতে, তাই ওদিকে না গিয়ে বললাম ‘জি বলেন!’
‘আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর ইচ্ছায় তোমরা এখন বিবাহিত। আমাদের দুইপরিবারের ইচ্ছাও পূরণ হয়েছে। আমরা খুশি এই সম্পর্কে। তোমাদের ভেতরেও বোঝাপড়া আছে। কিন্তু যেহেতু ছেলেবয়স নেই আর কারোরই তাই আশা করব এবারে দুজনেই ছেলেমানুষিগুলো ত্যাগ করবে। বাচ্চাদের মতো মারামারি, গালাগাল করাটা এখন আর সাজে না তোমাদের। আশা করি বুঝেছ তোমরা, আমি কী বলতে চাইছি!’
দীঘি মাথা নাড়ল। আমিও মাথা নাড়লাম। বুঝেছি।
হায়াত আংকেল আবার বললেন ‘একটা সুস্থ ও সুখী সম্পর্ক হোক তোমাদের, সেই দোয়া থাকল আমাদের সবার পক্ষ থেকে।’
এত দোয়াআত্তির পরে আর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা যায় না, কদমবুসি তো বানতা হ্যায়! আমি টুক করে আংকেলের পায়ে হাত দিতে চেষ্টা করলাম। মুরব্বির পায়ে হাত ছুঁতে নিচু হতেই ঢুশ খেলাম দীঘির মাথার সাথে। চোখে অন্ধকার দেখলাম। দীঘির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলাম ‘ধুশ শালা, কানা হইছিস? কানির বাচ্চা কানি, চোখ কপালে উঠিয়ে রাখার চাইতে তুলে ফেলে দে না?’
‘ওই খান্নাস, বদ, চিল্লাইতেছিস কেন? আমি চোখে কম দেখি মানলাম, নইলে তোকে বিয়ে করতে রাজি হই? তুই কি কপালে হ্যাজাকলাইট লাগিয়ে রেখেছিস? তুই দেখিসনি? পাথরের মতো মাথা একটা। দিলো আমার মাথাটা ফাটিয়ে।’ বিরাট খোঁপার একপাশ হাতে ডলতে ডলতে দীঘিও চিৎকার করল।
‘আমি চাইছি তোকে বিয়ে করতে? আমি চাইছি? খুব যে রাজি হইছিস বলে ক্রেডিট নিতেছিস। আমি তো মাহীকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। কী সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে!’
‘দেখলা আব্বু? দেখলা? এই ইতরকে বিয়ে না করে সৌরভকে বিয়ে করলে আমাকে মাথায় করে রাখত!’
‘তোরে না বলছি ওই নাম মুখে আনবি না?’
‘নিজে যে মাহী মাহী করতেছিস? আমিও আনব। একশোবার আনব। সৌরভ, সৌরভ, সৌরভ…!’
সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীর মুখে অন্য পুরুষের নাম শুনলে কার না রাগ হয়? বলেন, কার না রাগ হয়? আমারও হলো। রেগে গিয়ে বললাম ‘তোর সাথে আজই আমার সম্পর্ক শেষ। শেষ মানে শেষ। খতম। টাটা বাই বাই। দুনিয়া উল্টায়ে আদুনি হয়ে যাক, আমি রাফিন যদি তোর সাথে কথা বলেছি তো আমার কান কেটে কুত্তার গলায় ঝুলিয়ে দেবো! হুহ!’

হতাশ আর বিস্মিত একদল দর্শক পেছনে রেখে আমি প্রস্থান করলাম। উদ্দেশ্য নিজের ঘরে যাব। কিন্তু আমার ঘরের দরজা বন্ধ। নক করলে বিপাশা উঁকি দিলো ‘আমাদের এখনো হয়নি ভাইয়া। প্লিজ আরেকটু পরে আয়। আগে দীঘি আসবে। তারপর তুই।’
‘খাইছে হালায়!’ মনে পড়ল আমার ঘরে বাসর সাজানো হচ্ছে। ইয়া আল্লাহ একটু আগে এইটা আমি কী করে আসলাম। আজকে তো আমার বাসরের এয়সি কী ত্যায়সি! সর্বনাশ করেছি। যাই হোক চুপচাপ হয়ে গেলাম। দরকার হয় টুক করে দীঘির পা জড়িয়ে ধরব। মহাজ্ঞানী লোকেরা বলে গেছেন, বউয়ের পা ধরাতে কোনো লজ্জা নেই। দুনিয়া চলেই বউয়ের পা ধরে!এইটা কোনো ব্যাপারই না। দুনিয়ার মোড়ল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনকেও বউয়ের পা ধরে বেডরুমে জায়গা পেতে হয়েছিল। তবুও বিছানায় ঘুমানোর অনুমতি মেলেনি, সোফায় শুতে হয়েছিল! বিমর্ষ মুখে এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলাম। একটু আগের ঝগড়াটা মুছে দিতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু কী করব বলেন, কী সুন্দর নতুন শ্বশুরমশাইকে সালাম করতে ফেলাম, দিলো মাথায় গুঁতো। আচ্ছা আমি সালাম করছি, নতুন জামাই করতেই পারি। তোর তো বাপ। এত গদগদ হয়ে হুটহাট পায়ে পড়ার কী আছে! ঢঙ! যত্তসব!

অনেক কারসাজি করে ঘরে ঢুকতে হলো আমার। বোঝেন অবস্থাটা, আমার ঘর, আমার বউ, কড়কড়ে কতগুলো হাজার টাকার নোট দিয়ে তবেই এখানে ঢুকতে পারলাম আমি। ঢুকতাম না শালা, ছাদেই রাত কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু মহাজ্ঞানী, মহাজনরা বলে গেছেন বেড়ালটা বাসররাতেই মারতে হয়। নইলে সারাজীবন নাকি বউয়ের আন্ডারে লেফট রাইট করা অবস্থায় কাটাতে হবে। অসম্ভব! দুনিয়া উল্টায়ে আদুনি হয়ে গেলেও এটা সম্ভব না। আমি রাফিন, দীঘির কথায় উঠছি আর বসছি, ডাইনে যাচ্ছি আর বাঁয়ে হাঁটছি, এটা ভাবতেই তো পাগল পাগল লাগছে আমার।
বেড়াল মারার জন্য হলেও হাজার হাজার টাকার মায়া ত্যাগ করে আজকের জন্য ঘরে ঢুকলাম আমি।
‘ও মাই গড! ওহ মাই গড!’ একটু আগেও এই মেয়েকে দেখেছি আমি। এমন কিছু আলাদা লাগেনি তখন। বেশি মেকআপ দিয়ে ফেলেছে মনে হচ্ছিল। আর এখন সেই একই সাজে ভয়াবহ দেখাচ্ছে। ভয়াবহ সুন্দর! লাল শাড়িতে টুকটুকে বউ। লাল শাড়িটা নেওয়ার সময় দীঘিকে খুব কনফিউজড দেখাচ্ছিল। বারবার বলছিল ‘আমি কালো, লাল শাড়িতে কি ভালো লাগবে আমাকে?’ আমি একটা ঝাড়ি মেরে বলেছিলাম ‘পছন্দ হলে নিবি। মনে চাইলে লালই পরবি। সারাদিন লাল পরে ঘুরবি। চুলেও লাল রঙ করে ফেলবি। ঠোঁটে লাল দিয়ে ভরিয়ে রাখবি। তোর নিজের ভালো লাগলেই হলো। অন্যের চোখে ভালো লাগানোর দরকার নেই!’
এখন দেখো, এই লালেই আগুনসুন্দরী দেখাচ্ছে। আমার ঘাম ছুটে গেছে। খুব নার্ভাস লাগছে। মনে হচ্ছে ঠাস করে পড়ে যাব। মাথা বনবন করে ঘুরছে। আমি ধুপ করে দীঘির পাশে বসে পড়লাম। দীঘিকে স্পর্শ করার জন্য আকন্ঠ পিপাসা পেয়ে আছে। সেই তৃষ্ণা মেটাতে আমি আস্তে করে দীঘির মেহেদিরঙা হাতটা ছুঁয়ে দিলাম। দীঘি হাসছে মিটিমিটি। ওর দুচোখ উপচে পড়ছে হাসিতে। ওর আঙুলগুলো যেমন হাতে ছুঁয়ে দিলাম তেমনি ওর হাসিটাও ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। উত্তেজনায় আমি অসাড় হয়ে যাচ্ছি। নিজের হতবিহ্বল অবস্থা সামলে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বললাম ‘হাসছিস কেন?’
দীঘি হাসি চেপে বলল ‘ওই কাপটা দে।’ বেডসাইড টেবিলের উপর একটা কাপ রাখা, পিরিচ দিয়ে ঢেকে দেওয়া।
‘কী আছে কাপে?’ পুরোনো দিনের মতো বাসরঘরে ঢুকে দুধ খেতে হবে নাকি? চিন্তায় পড়ে গেলাম।
‘দে না!’ দীঘি তাড়া দিলো।
পিরিচটা উঠিয়ে কাপটা পিরিচের উপর রাখতে গিয়ে দেখলাম কাপের ভেতর চা। গরম এক কাপ চা। আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম ‘তুই এখন চা খাবি? রং চা? তুই তো রং চা খাস না!’
‘এখন থেকে খাব ভাবছি! দুধ ছাড়াই চা খাব। ভেবে দেখলাম, তোর কথাই ঠিক। কনসেন্ট অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একেবারেই হেলাফেলা করা উচিত না। এখন থেকে আমি কনসেন্ট ছাড়া কোনো কাজ করব না, চাপাতার কনসেন্ট ছাড়া চায়ে দুধ মেশাব না, তেমনি কাউকে হুটহাট কনসেন্ট দিয়েও দেবো না!’
দীঘি চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল।
‘টরেটক্কা করবি না, দীঘি! স্পষ্ট বল কী বলতে চাইছিস!’
দীঘি হাসল। পুরো কাপের চা শেষ করে হেসেহেসেই বলল ‘আমার ঘুম পাচ্ছে রাফিন। আমি শুয়ে পড়ছি, তুই বসে বসে টরেটক্কা উদ্ধার কর!’
সর্বনাশ, সর্বনাশের মাথায় বাড়ি, ওর ইঙ্গিত, এবারের টরেটক্কা আমি স্পষ্ট পড়তে পারছি। আপনারা বুঝতে পেরেছেন?
দীঘি বালিশ টেনে নিয়েছে। এখনই শুয়ে পড়বে। আমাকে একটু বুদ্ধি ধার দেন, প্লিজ! আমি কি দীঘির সামনে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইব? নাকি অন্যকিছু করব? আজ রাতেই তো বিড়ালটাকে মারা খুব দরকার…। দরকার কিনা বলেন? একেবারে ওর পা দুটোই জড়িয়ে ধরব নাকি…? বিশেষ বিশেষ সময়ের বিশেষ প্রয়োজনে বউয়ের পা ধরাটা তেমন দোষের না, বলেন?

শেষ, খতম, টাটা বাই বাই।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here