ডাকপাড়ি #পর্ব_১৭,১৮

0
201

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_১৭,১৮
#আফনান_লারা
১৭
________
অপরিচিত লোকদের এই এক সমস্যা। না জেনেশুনে মুখের উপর কথা বলে দেয়।কোথায় তার দেড় বছরের ভালবাসার মানুষ আর কোথায় ঐ কয়েকদিনের অচেনা একটা মেয়ে,যাকে এখনও সে ভাল ভাবে চেনেইনা।কার সাথে কার তুলনা করছে লোকটা।
ফারাজকে বিরক্তির চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে লোকটা চলে যাচ্ছিল চুপচাপ।ফারাজ তখন ওনাকে থামিয়ে বলে,’শুনুন,আমি মোহ হোক,ভালোবাসা হোক,কিংবা মায়া হোক সব একজনের উপরই করেছি এবং পড়েছি।সেই মানুষটার ছবি আঁকবো এখন। ভুলবশত অন্য মানুষের ছবি আঁকা যেতেই পারে।এটা আর নতুন কি।আমরা চিত্রকর। আমাদের দ্বারা ভুল হওয়া স্বাভাবিক নয় কি?’

লোকটা এবার ফারাজের দিকে ফিরে দাঁড়ালেন।হাত ভাঁজ করে কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন,’চিত্রকর দ্বারা ভুল কেন হবে?চিত্রকরের আঁকা ছবিটার মানুষটাই তো ভুল’

এবার লোকটি চলে গেলো।ফারাজের মেজাজ আরও খারাপ হয়েছে।কোথাকার কোন লোক এসে ঠিক বেঠিক বুঝাবে কেন?এই জন্য অপরিচিত মানুষদের সাথে ফারাজ কখনওই আগ বাড়িয়ে কথা বলেনা।বললেই যত ঝামেলা শুরু করে।
আগের জায়গায় বসে ফারাজ তার প্রতিমার ছবি আঁকায় মন দিয়েছে আবারও।একবারও পূর্ণতার কথা ভাবেনি।এবার ছবিটা খুব সুন্দর হলো।মুখে হাসি ফুটিয়ে ছবিটা সে নিয়ে গেছে একটা দোকানে।সেখানে ফ্রেমে বাঁধাই করে বাসায় এনে রুমে লাগিয়ে রাখবে।
———–
পূর্ণতা যে স্কুলে পড়াতো সেটার সামনে এসে তার মুখের কথা আর হাঁটার শক্তি গায়েব হয়ে গেলো।না আছে স্কুল আর না আছে কোনো লোকজন।মাত্র ৩দিনে সব কি করে উধাও হতে পারে।পূর্ণতা ইয়া বড় হা করে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছিল।আজব ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছেনা তার।
ওকে এভাবে মূর্তির মন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা লোক সেখান দিয়ে যাবার পথে থেমে বললো,’আপনিও কি বাচ্চাকে পড়াবেন বলে এই স্কুলে পাঁচ হাজার টাকা জমা দিয়েছিলেন?’

পূর্ণতা হা বন্ধ করে বললো,’নাহ,কেন?’

‘আমি টাকা দিয়েছিলাম।এখন পরেরদিন ছেলেকে নিয়ে এসে দেখি স্কুলটাই উধাও।তাবু লাগিয়ে উঠাতে যে সময় লাগে এই স্কুল উধাও হতে তেমনই সময় লাগিয়েছে।অসাধারণ চোরাই বুদ্ধি!যদি একটিবার এই স্কুলের একটা টিচারকে আমি ধরতে পারতাম।গলা টিপে আমার টাকার রস বের করতাম।আচ্ছা আপনি কি এই স্কুলের কোনো টিচারকে চিনেন?’

লোকটার প্রশ্নে পূর্ণতা হালকা করে একটা কাশ দিলো।তারপর চট করে গলা থেকে আইডি কার্ডটা লুকিয়ে দাঁত বের করে হেসে বললো ‘জানিনা,জানলে আমিই গলা টিপতাম।আপনি জানলে আমাকে বলবেন’

এটা বলেই পূর্ণতা সোজা এক দৌড় দিলো।এত বড় ধোকা!!এখানে টিচারের চাকরি পাওয়ার জন্য সেও তো পাঁচ হাজার টাকা বকশিশ দিয়েছিল ঐ শয়তান হেড মাস্টারকে।এভাবে ওকেও ঠকালো।এখন ঐ শয়তানকে কই পাওয়া যাবে!!
————
পূর্ণতা হাঁপাতে হাঁপাতে সেই পার্ক অবধি আসলো।তারপর কি মনে করে হলের দিকে চললো আবার।একবার প্রেমার সাথে দেখা করবে তারপর বাড়ি ফিরে যাবে।হলে প্রেমা আর তিশার সাথে বেশ ভাল একটা সময় কাটিয়েছে পূর্ণতা।তার ফিরতে বিকাল গড়িয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে আসার পর পূর্ণতা দেখলো একটা নতুন মানুষ।

সোফায় বসে আছে একটি মেয়ে।পূর্ণতাকে দেখে মিসেস সোনালী এগিয়ে এসে বললেন,’দেখো তো মা।এই মেয়েটিকে চিনো কিনা?সে নাকি সুদূর কলকাতা থেকে এসেছে আমাদের বাড়ি।কিন্তু আসার পর থেকে আর কিছু বলছেনা।বারবার ব্যাগ খুঁজে চিঠি বের করে কি যেন খুঁজছে।’

এরপর মিসেস সোনালী মুখটা পূর্ণতার আরও কাছে এনে ফিসফিস করে বললেন,’কপালে সিঁদুর দেখা যায়।মেয়েটা মনে হয় হিন্দু।তাই ভাবলাম তোমার চেনা-জানা কেউ হতে পারে।কিংবা তোমার বাবা পাঠিয়েছেন তাও হতে পারে’

পূর্ণতার যতদূর মনে আছে সে এই মেয়েটিকে চিনেনা।তাও আন্টির জোরাজুরিতে সে মেয়েটির পাশে ঘেঁষে বসলো।মেয়েটা তখনও হন্থদন্ত হয়ে চিঠিতে কি যেন খুঁজছিল।পূর্নতা ওকে প্রশ্ন করে সে কি খুঁজছে।মেয়েটি জবাবে বলে একটা ঠিকানা।
পূর্ণতা মেয়েটার আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা চিঠিগুলো থেকে একটা চিঠি হাতে নিয়ে চোখ বুলাতেই চিনে ফেললো হাতের লেখা।এটা ফারাজের হাতের লেখা।আচ্ছা এই কি সেই প্রতিমা!তবে কপালে সিঁদুর যে।তার কি বিয়ে হয়ে গেছে?

পূর্ণতা মেয়েটির দিকে চিঠিটা বাড়িয়ে ধরে বললো,’আপনার নাম কি প্রতিমা?’

‘হ্যাঁ,আপনি জানলেন কি করে?’

‘আপনি কি ফারাজের বাসার ঠিকানা খুঁজছেন?’

‘হ্যাঁ,আসলে আমি ঠিক ঠিকানায় এসেছি কিনা মনে সন্দেহ জাগছে।কারণ ফারাজ আমায় যে ঠিকানা দিয়েছিল সেটা একটা চিঠিতে লেখা ছিল।ঐ চিঠিটা বের করতে পারলে পুনরায় নিশ্চিত হতাম।নাম ধরে খুঁজতে আমার কেমন যেন লাগছে।কার না কার বাড়ি!তাছাড়া ফারাজ হয়ত এখনও ওর পরিবারের কাউকে আমার বিষয়ে জানায়নি’

‘হ্যাঁ এটা ওনারই বাড়ি’

‘তবে আসার পর থেকে একবারও যে দেখলাম না’

‘উনি তো সারাদিন বাইরে থাকেন।আচ্ছা আপনার কি বিয়ে হয়েছে?’

পূর্ণডার কথা শুনে মেয়েটার মুখ মলীন হয়ে গেলো।চটপটে কথা বলা মেয়েটি যেন বোবা হয়ে গেছে।আর টু শব্দ ও তার মুখ দিয়ে বেরোইনি।
পূর্ণতা উঠে মিসেস সোনালীর কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে। সোনালী ওকে খুঁচাচ্ছে জানার জন্য আসলে মেয়েটি কে।

পূর্ণতা ভাবছে ফারাজকে কি করে এখানে আনবে।মেয়েটি চিঠি সব গুছিয়ে নিজেই ওদের কাছে এসে দাঁড়ালো।চোখের কোণার পানি মুছে বললো,’আমি একবার ফারাজের সাথে কথা বলতে চাই।ও কোথায় জানেন?’

সোনালী বললো বাসায় নেই।মেয়েটি মন খারাপ করে তাই চলে যাচ্ছিল,তখন পূর্ণতা ওকে থামিয়ে বলে ফারাজ এখনই এসে পড়বে।সে যেন আরেকটু অপেক্ষা করে।

মেয়েটি পূর্ণতার আশায় ওর সাথে ওর রুমে গিয়ে বসে থাকলো।পূর্ণতা ফারাজের নাম্বারে অনেকবার কল করলো কিন্তু সে বারবার কেটে দিচ্ছে।ওদিকে মেয়েটা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে শেষ।

হঠাৎ সেসময় ফারাজের গলা শুনে পূর্ণতা এক দৌড় দিছে।ফারাজ নিজের রুমে যাচ্ছিল তখন পূর্ণতা ছুটে এসে ওর সামনে দাঁড়ায়।
ফারাজ বিরক্ত হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।ওর জানা আছে পূর্ণতা এখন বিরক্ত করতেই এসেছে এখানে।এদিকে পূর্ণতা হাঁপানোর জন্য কথাই বলতে পারছিলনা।অনেক কষ্টে বললো,’প্রতিমা আপু’

ফারাজ ওর কথায় তোয়াক্কা না করে নিজের রুমে এসে ফ্রেম করা ছবিটা দেয়ালে ঝুলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

‘আরে আমার কথা তো শুনুন।আপনার প্রতিমা আপনার বাড়িতে এসেছে’

‘দেখুুন পূর্ণা ম্যাডাম,আমাকে বিরক্ত করবেন না।বিশেষত প্রতিমাকে নিয়ে।বের হোন এখন।আমার কাজ আছে’
——–
‘ফারাজ?’

প্রতিমার গলা শুনে ফারাজের হাত চলা বন্ধ হয়ে গেলো।পূর্ণতা আস্তে করে সরে গেছে ওখান থেকে।প্রতিমা রুমের ভেতরে এসে আবার বললো,’আমি এসেছি ফারাজ’

ফারাজ পেছনে তাকিয়েছে এবার। প্রতিমাকে দেখে সে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে।ছুটে আসলো জড়িয়ে ধরবে বলে ঠিক সেসময় ওর কপালের লাল সিঁদুর তার পথ আটকে দেয়।যেন মাঝে একটা দেয়াল তুলে গেলো হঠাৎ।ফারাজ থম হয়ে আছে সেই সিঁদুর দেখে।প্রতিমা ও বুঝে গেছে ফারাজ কেন চুপ।
প্রতিমা নিজের কপাল ছুঁতেই ওর নিজের চোখে পানি ভর্তি হয়ে গেলো।চোখ মুছে সে ফারাজের দিকে চেয়ে বললো,’তোমার সব চিঠি আমি পেয়েছি ফারাজ।তাই এসেছি।আমি জানি তুমি আমার অপেক্ষায় থাকবে,কিন্তু!”

‘তোমার কপালে সিঁদুর পড়লো কবে?তারিখটা বলবে একটু?’

‘৭ মাস আগে।২৩তারিখ।’

‘ওহ!ভাল,অভিনন্দন। ‘

‘আমি অনেক চেষ্টা করেছি ফারাজ।বাবাকে রাজি করাতে পারিনি।বাবা এমনিতেও প্রেম ভালবাসার বিপক্ষে ছিলেন,এরপর যখন শুনলেন আমি যে মানুষটাকে ভালবাসি সে মুসলমান তখন তিনি আমায় সাফ সাফ বলে দিলেন হয় আমি তোমার কাছে চলে যাই ওনাদের ছেড়ে,আর নাহয় ওনার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করি

আমি তাকে রাজি করানোর সব চেষ্টা করেছি ফারাজ।কিন্তু তার শেষ কথা ওটাই ছিল।এরপর আমি সিদ্ধান্ত নিই আমি সবাইকে ছেড়ে তোমার কাছে চলে আসবো।কিন্তু মাঝপথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বাবার হার্ট এটাক।মূহুর্তেই আমার সব অন্ধকার হয়ে আসলো।তুমি তো জানো, বাবাকে আমি কত ভালবাসি।আমি যদি চলে আসতাম,বাবাকে হয়ত হারিয়ে ফেলতে হতো।বাবা এই কষ্ট সহ্য করতে পারতেন না।
আমার কাছে আর পথ বাকি ছিল না ফারাজ’

ফারাজ চুপচাপ নিজের আলমারি খুলে এক জোড়া বালা বের করলো।দশ খানেক ছবি এঁকে সেগুলো নানান জায়গায় বিক্রি করে সে অনেকগুলো টাকা পেয়েছিল ওগুলো দিয়ে প্রতিমার জন্য এক জোড়া বালা কিনেছিল,বিয়ের দিন পরিয়ে দেবে বলে।এখন সেই বালা এনে ও প্রতিমার দিকে ধরে বলে,’যদি নিজের পছন্দে বিয়ে করতে তাহলে এই বালা আমি তোমায় দিতাম না।যেহেতু পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে করেছো সুতরাং তুমি আমায় ধোকা দেওনি।এই বালার প্রাপ্য তুমি।তোমার হাসবেন্ডকে বলবে পরিয়ে দিতে’

‘ফারাজ আমায় মাফ করে দিও।আমি শুধু বলতে এসেছি আমার জন্য অপেক্ষা করোনা’

‘প্রতিমা!সবসময় কি মানুষ পাবার আশাতেই অপেক্ষা করে?কিছু জিনিস পাবেনা জেনেও অপেক্ষা করে।তুমি আমার সেই কিছু জিনিস যেটা আমি হারিয়ে ফেলেছি।কোনোদিন পাবোনা তবুও অপেক্ষা করবো।কারণ তোমার জন্য করা অপেক্ষা আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। বলতে পারো জীবন আঁকড়ে ধরার কৌশল’

প্রতিমা কান্নার জন্য কিছু বলতে পারছেনা।
পূর্ণতা দেয়ালে কান লাগিয়ে শোনার চেষ্টা করছিল।ওমনি পাঞ্জাবি পরা একটা ছেলে দেখে সে ছুটে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।পা থেকে মাথা অবধি দেখে বললো,’আপনি প্রতিমা আপুর জামাই’?

‘হুম।ও কোথায় জানেন?সোনালী মাসি বললেন ও উপরে আছে’

‘না না।উনি তো নিচে গেছেন।বাগানের দিকে।আপনি ঐদিকে যান,উনি এখানে নেই’

‘হুম’

‘আচ্ছা শোনেন,আপনার বউ আপনার কাছে কেমন লাগে?’

‘এ কেমন প্রশ্ন!’

‘মানে আপনার বউ আপনাকে ভালবাসে?নাকি ফুলসজ্জারর দিন বলছি “সরি আই হ্যাভ আ বয়ফ্রেন্ড”

ছেলেটার মুখে হাসি ফুটলো পূর্ণতার কথায়।হাত ভাঁজ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,’তা বলেনি,তবে বলেছে সে একজনকে ভালবাসে।সেই ভাগ কাউকে দেবেনা,তবে আমার জন্য নতুন ভাগ তৈরি করবে।আমি আপাতত সেই ভাগের কাস্টমার বলতে পারেন’

‘প্রতিমা আপু জিতছে।দারুণ একটা বর পেয়েছে।আচ্ছা আপনার হিংসা হয়না ঐ ছেলেটার প্রতি?

‘হিংসা কেন হবে?প্রতিমা তো আমার হয়ে গেছে।তার তো হয়নি।হিংসা তো তার হবার কথা’

চলবে♥

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_১৮
#আফনান_লারা
________
সারথি বলছে সে বাড়ি ফিরবেনা।আনাফ যেন জোরাজুরি না করে।
আনাফ তো নাছোড়বান্দাতে একসের।সে কিছুতেই সারথিকে ওর বাড়িতে দিয়ে আসা পর্যন্ত ছাড়বেনা।সারথি শেষে বিরক্ত হয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।আনাফের মা বারবার ফোন করছেন এটা জানার জন্য যে আনাফ কখন বাসায় ফিরবে। এদিকে সারথির একটা ব্যবস্থা করা অবধি তো সে হাসপাতাল থেকে নড়তেও পারছেনা।কি করা যায় অনেক ভাবনাচিন্তা করে শেষে একটা বুদ্ধি আসলো মাথায়।যেটা করা উচিত না সেটাই করতে হবে আর তা হলো হুমকি দিতে হবে।
সে সারথিকে বললো সারথি যদি বাড়ি না ফিরে তাহলে উর্মির থেকে সজীবের নাম্বার নিয়ে ওকে কল করবে আনাফ।
সারথির প্রচুর রাগ হলো আনাফের উপর।শেষে উপায় না পেয়ে রাজি হলো বাড়ি ফেরার জন্য।আনাফ তার গাড়ী ডেকে এনেছে।ড্রাইভারকে চলে যেতে বলেছে, সে নিজেই ড্রাইভ করবে আজ। সারথিকে পাশের সিটে বসিয়ে মনের আনন্দে সে গাড়ী চালিয়ে যাচ্ছে।একজন বিবাহিতা নারীকে পাশে বসিয়ে তার কেন এত আনন্দ হচ্ছে সে কথা মাথায় আসায় মূহুর্তেই ব্রেক কষলো আনাফ।সারথি সিট বেল্ট চেপে ধরে বললো,’কি সমস্যা?’

‘নাহ কিছুনা’

আনাফ আবারও গাড়ী স্টার্ট দিলো।কিন্তু এবার গাড়ী স্টার্ট হলোনা।কি মুশকিল!
বাইরে বের হয়ে চেক করছে সে।সারথি অনেকক্ষণ বসে থেকে নিজে নিজে বের হলো গাড়ী থেকে।জানতে চাইলো আর কতক্ষণ লাগবে।

‘কেন?বাড়িতে না যেতে চাইছিলেন না?তবে তাড়া কিসের?’

‘প্রশ্ন করা অপরাধ?’

আনাফ আর কিছু বললোনা।ফোন বের করে ড্রাইভারকে আসতে বললো।সারথি গাড়ীর সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চুপভাবে।আনাফ ওর দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়েছিল।মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।জিজ্ঞেস করা ঠিক হবেনা জেনেও সে জিজ্ঞেস করেই বসে।সে জানতে চাইলো সারথি কেন সজীবকে ডিভোর্স দিতে চায়।

প্রশ্নটি শুনে সারথি উত্তরে কিছুই বলেনি।যেমন করে দাঁড়িয়ে ছিল তেমন করেই দাঁড়িয়ে আছে।

আনাফ আরেকটু এগিয়ে এসে প্রশ্নটা আবার করেছে।তার জানার দরকার এই জবাব।
সারথি আর কি করবে ফাঁকা েথে গল্প-গুজব না করলে সময় কাটবে কেমন করে।তাও সে শুধু বললো ডিভোর্স সজীব দিতে চায়।

আনাফ যেন হাতে প্রশ্নের ঝুড়ি পেয়ে গেছে।আরেকটু কাছে এসে জানতে চাইলো কি কারণে ডিভোর্স দিতে চায়।
সারথি গম্ভীর গলায় বলে,’তৃতীয় ব্যাক্তি’

‘তাহলে এই ব্যাপার!’

‘আচ্ছা আপনার আমার বিষয়ে এত আগ্রহ কেন বলতে পারেন?একজন অবিবাহিত ডাক্তারের জন্য কি মেয়ের অভাব পড়েছে?”

আনাফ হাসলো।তার হাসির আওয়াজ পৌঁছালো না সারথির কানে।হাসি আটকে আনাফ বলে,’প্রচুর অভাব।আমাকে দেখে মনেই হয়না আমি যে একজন ডাক্তার।সবাই বলে ইন্টারে পড়ি।কি সমস্যা দেখলেন!’

‘বলুন তো আমি কিসে পড়তাম, দু বছর আগে? ‘

‘উমমম,কঠিন প্রশ্ন। মনে হয় ইন্টার পাশ করেছেন’

‘আমি গ্র্যাজুয়েট।যাই হোক আপনাকে একটা কথা বলে রাখি।সৌন্দর্য্য দুদিনের আবেগ পালতে পারে তবে আজীবনের না।যেমন আমার আর সজীবের সম্পর্কটাকেই দেখে নিন।আমাকে পছন্দ করে বিয়ে করে এখন তিনি আরেকজনে মোহিত। দোষটা রুপের।পৃথিবীতে একজন নারী আরেকজন নারী থেকে অত্যাধিক সুন্দরী।সজীবের চোখে শুরুতে আমি সুন্দর ছিলাম,এখন অন্য কেউ।আর নয়তবা এইসব কিছুইনা।মূল কারণ আমি অন্ধ বলে।’

‘আপনি যে অন্ধ তাতে কিন্তু আমার কোনো সমস্যা নেই’

‘সমস্যা হবে কেন?আমি তো আপনার স্ত্রী না।যদি হতাম তবে সমস্যা হতো।’

আনাফ ঠিক করেছে আর কিছুই বলবেনা।যেটাই বলে সেটাতেই সারথি কড়া করে একটা জবাব দিয়ে দেয়।কি আজব!!’

আনাফ নিরব হয়ে গেলো বলে সারথি হাসলো।ওর হাসি দেখে আনাফ আবার বললো,’হাসেন কেন?আমি তো অবাক হচ্ছি আপনার যুক্তি দেখে’

‘এমন যুক্তির কি লাভ যদি স্বামী ধরে রাখতে না পারি’

‘আপনি একটা ডাক্তার দেখে বিয়ে করে সজীবকে দেখিয়ে দিন’

‘আরও একবার একটা ছেলে রুপ দেখে আবেগ ধরে বিয়ে করে দিনের পর দিন মানসিক অত্যাচার করবে।আমার দ্বারা এই ভুল আর হবেনা।যদি আগের মতন পরিবার আবার জোর করে এবার আমি আত্নহত্যাতে জোর দেবো’

‘বিয়ে করলে জীবনটা আপনার গুছিয়ে যাবে’

‘যার জীবন একবারে গুছায় না, তার আর কবে হবে?বাদ দিন।আমি ঠিক নিজের একটা পথ বেছে নেবো।আপনি বরং আপনার ডাক্তার বউ খুঁজেন’

‘আমি ডাক্তার মেয়ে বিয়ে করবোনা’

‘তবে যাকেই করুন।আমাকে বলতে হবেনা।হেঁটে যাব বাসায়?’

‘আপনি কি বুঝতেছেন আমি কি বলছি?’

‘হ্যাঁ বুঝছি।এইরকম আবেগ আরও দেখেছি’
———-
প্রতিমা ফারাজের হাত ধরতে চাইলো কিন্তু ফারাজ হাত সরিয়ে নিজেও দূরে সরে গেছে।মুখ ফিরিয়ে নিছে অন্যদিকে।প্রতিমা বালা টা বিছানায় রেখে বললো,’এটা তোমার পরিশ্রমের টাকায় কেনা। এর উপর অধিকার তোমার স্ত্রীর থাকতে পারে আমার নয়।মাফ করো,আমি এটা নিতে পারবোনা।আজ আসি, ভাল থেকো’

প্রতিমা বের হয়ে গেলো রুম থেকে।ওদিকে পূর্ণতা প্রতিমার স্বামীকে টেনে বাগানের দিকে নিয়ে গেছে।
প্রতিমার ওর কথা মনে নেই।সে চোখ মুছতে মুছতে চলে যাচ্ছে যতদূর পারছে।
বাগান থেকে ওর স্বামী প্রিতম ওকে দেখে আটকালো।ওর চোখে পানি দেখে জানতে চাইলো কি হয়েছে।কিন্তু প্রতিমা কিছুই বলেনি।
পূর্ণতার মনে পড়লো ফারাজের কথা।সে ওদিকে ছুটলো এবার।
ফারাজ রুমের দরজা লাগিয়ে বসে আছে।তার নিজের চোখকে আর কানকে বিশ্বাস হচ্ছেনা।বার বার এটাই মনে হচ্ছে যে এই সব কিছু স্বপ্ন,কল্পনা ছাড়া আর কিছুনা।প্রতিমা আরেকজনের হতে পারেনা।
পূর্ণতা দরজা বন্ধ দেখে চলে যাবার জন্য পেছনে ফিরতেই দেখলো দাদাজান দাঁড়িয়ে আছেন।মুখটা প্রচণ্ড রকমের গম্ভীর করে রেখেছেন।দুহাত পেছনে নিয়ে দাঁড়িয়ে তিনি পূর্ণতার হাবভাব বোঝার চেষ্টা করছিলেন।

প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ভয়ে পূর্ণতা চুপিচুপি ওখান থেকে সরে যাচ্ছিল তখনই দাদা ওকে দাঁড়াতে বললেন।জানতে চাইলেন সে এখানে কি করছিল।

পূর্ণতা তোতলাতে তোতলাতে কোনোমতে বললো ফারাজের সাথে একটা দরকারে কথা বলার জন্য এসেছে।ফারাজের দরজা বন্ধ বলে সে চলে যাচ্ছে আবার।

‘শুনলাম বাড়িতে নাকি হিন্দু মেয়ে একটা এসেছে তার স্বামীকে নিয়ে?’

‘হ্যাঁ মানে না।মানে হ্যাঁ’

‘তুমি ওদের চিনো?’

‘না চিনিনা’

‘তবে ফারাজ চেনে?’

‘তা তো জানিনা। ‘

দাদাজান এবার দরজায় হাত রেখে ফারাজের নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছেন।ফারাজ সেসময় মেঝেতে বসে চোখের পানি ফেলছিল।দাদার কথা শুনে চট জলদি চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়ে আগে বালা লুকিয়ে তারপর দরজা খুললো।
দাদাজান সাথে সাথে ভেতরে ঢুকে গেলেন।
———-
সজীব তার এবং লেভেনের ভিসা ওকে করে এসেছে।সে কবে আসবে সেটা কাউকে জানায়নি।মাকেও না।চেয়েছে সারপ্রাইজ দিবে।লেভেন তো মহাখুশি।এতদিনে তার ইচ্ছা সফল হতে যাচ্ছে।সজীবকে সে নিজের করে পাবে।তার খুশি আর ধরছেনা।কিন্তু সজীব ভাবছে অন্যকিছু।সারথিকে ডিভোর্স দেয়া সহজ কিন্তু ওর দায়িত্ব নিয়ে তার খারাপ লাগছে।ওর দায়িত্ব তো সজীব নিজে নিয়েছিল,এভাবে ডিভোর্স দিলে তার কি হবে।তার পরিবার যদি তাকে মেনে না নেয়?কোথায় যাবে সে।যতই হোক,সম্পর্কে তো সে স্ত্রী হয়।এসব ভেবে প্রায় সময় সজীবের মন খারাপ থাকে।
——–
ড্রাইভার এসে আনাফের কার ঠিক করাতে নিয়ে গেছে।এদিকে আনাফ সারথিকে নিয়ে একটা রিকশায় উঠেছিল।সারথির বাসা কাছেই।
মতিন হন্ন হয়ে সারথিকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে বাড়ি ফিরে খবরটা সোনালীকে জানিয়ে দিয়েছে।সোনালী পড়ে গেলেন মহাচিন্তায়।মেয়েটা নিজে নিজে তেো চলতে পারবেনা।কোথায় আছে, কেমন আছে! কি করে উধাও হলো! সেসব তো কিছুই জানা নাই কারোর।

ফারাজের কাছে দাদাজান জানতে চাইলেন মেয়েটা আর ছেলেটার ব্যাপারে।পূর্ণতা পাশেই চোরের মতন দাঁড়িয়ে সব দেখছিল।
ফারাজ ধীরে বললো,’ওরা আমার ফ্রেন্ড’

‘তবে চলে গেলো কেন?রাতের খাবার খেয়ে যেতো’

‘না,ওদের কাজ আছে তাই’

‘চোখ ফুলা কেন তোমার?কেঁদেছো?কার জন্য কেঁদেছো?’

‘না তো।বই পড়ছিলাম তাই হয়ত’

‘বই পড়লে চোখ ফুলে?কই আমার তো ফুলেনা।পূর্ণতা তোমার চোখ ফুলে?’

‘না তো’

ফারাজ চোখ বড় করে তাকালো পূর্ণতার দিকে।পূর্ণতা ঢোক গিলে আবার বললো,’আমার মাঝে মাঝে বই পড়লে চোখ ফুলে,আবার মাঝে মাঝে তো মনে হয় চোখ খুলে হাতে চলে এসেছে’

‘ যত্তসব আজগুবি কথাবার্তা! ফারাজের কথার সত্যতা প্রমাণ করতে বলিনি তোমায়।ফারাজ আমার সাথে আমার রুমে আসো’

এটা বলে দাদাজান চলে গেছেন।ওদিকে ফারাজ পিছু পিছু যাওয়া ধরতেই মা ছুটে এসে বললেন সারথিকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা।

ফারাজ কোনো দিক না ভেবে এবার ছুটলো সারথিকে খুঁজে আনার জন্য,ওমনি দেখলো সারথিকে নিয়ে একটা ছেলে এসেছে।মতিন দরজা খুলে দিছে।

সারথির কপালে ব্যান্ডেজ দেখে ফারাজ ছুটে এসে ওর হাত ধরে বললো,’কিরে তোর কি হয়েছে?মাথায় ব্যান্ডেজ কেন?’

আনাফ দাঁত কেলিয়ে হাত বাড়িয়ে বললো,’হাই! আমি আনাফ,সারথির ভাল বন্ধু।আমি ওনার চিকিৎসা করিয়েছি আজ’

ফারাজ এবার আনাফের দিকে চেয়ে জানতে চাইলো সারথির কি হয়েছে।

‘ভুলবশত এক্সিডেন্ট। কারের সামনে পড়েছিল।আমি অবশ্য সঠিক সময়ে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি।মাথায় আর হাতে চোট পেয়েছে’

মিসেস সোনাকী আহাজারি লাগিয়ে দিয়েছেন ততক্ষণে।আনাফ এবার বললো সে চলে যাবে,তার এমনিতেও দেরি হয়ে গেছে।কিন্তু ফারাজ যেতে দিলোনা।মতিনকে বললো নাস্তা নিয়ে আসতে।
এরপর সবার জোরাজুরিতে আনাফ সোফায় বসতে বাধ্য হলো।সারথিকেও ওর পাশে বসিয়ে দিয়েছে মা।সবাই এবার পুরো ঘটনা শুনতে আনাফের মুখের দিকে চেয়ে আছেন।আনাফ শুরু থেকে বলছে এক এক করে।সে একবারও বলেনি সারথি স্বেচ্ছায় এমনটা করেছিল,সে বারেবারে বলেছে এটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল।
মতিন শরবত আর বিসকুট এনে দিয়ে গেছে।
আনাফ ঘটনা বলতে বলতে ওর গলা শুকিয়ে গিয়েছিল তাই শরবত পেয়েই হাতে নিলো খাওয়ার জন্য তখনই পূর্ণতা এক চিৎকার দিয়ে বললো,’খাবেন না ওটা’

সবাই এবার পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে আছে।আনাফ জানতে চাইলো কেন খাবেনা।সারথি হঠাৎ খিলখিল করে হেসে দিলো।হাসির জন্য কিছু বলতেও পারছেনা তাও অনেক কষ্ট করে হাসি থামিয়ে বললো,’যে পানি দিয়ে শরবত বানিয়েছে ওটাতে বাবুদের হিসু মিক্স আছে’

এটা শুনে আনাফ গ্লাস রেখে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here