#ডাকপাড়ি
#পর্ব_১৯,২০
#আফনান_লারা
১৯
________
তারপর মনে হলো বাড়ির নাম “হাবিজাবি” দেখেছিল।তার মানে এরা সবাই রসিক মানুষ।কিন্তু সারথিও যে রসিক হতে পারে সেটা আনাফ ভাবেনি।প্রথম থেকেই সারথিকে তার সাধারণ এবং চাপা স্বভাবের মনে হয়েছে কিন্তু এখন মনে হয় সে বড় রসিক।নাহলে এমন মজা কেউ করেনা।
হাসিমুখে আনাফ গ্লাসের গোটা শরবত ঢকঢক করে খেয়ে নিলো।সবাই ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে হা করে, আনাফ ঠোঁট মুছে বললো,’আমি ঠাট্টা পছন্দ করি।আপনারা দারুণ মানুষ,বাড়ির নাম দেখেই আপনাদের নিয়ে আলাদা একটা জায়গা তৈরি হয়েছে মনে।বিশেষত সারথি তো আরও দারুণ।এবার আমাকে যেতে হয়।বাসায় আম্মু একা,আব্বু অফিসের কাজে টাউনের বাইরে’
এটা বলে আনাফ সালাম দিয়ে চলে গেলো।সারথি ফারাজের কাছে জানতে চাইলো আনাফ কি শরবতটা খেয়েছে।পূর্ণতা ওয়াক ওয়াক করতে করতে বলে গেলো পুরাটা খেয়েছে।
সারথি হাসলো,সে ভাবেনি আনাফ ওকে বিশ্বাস করবেনা।এভাবে অবিশ্বাস করে নিজে ফেঁসে যাবে তা সে একদম ভাবেনি।তাকে হাসতে দেখে মিসেস সোনালী ওর পাশে বসে মাথায় হাত দিয়ে বললেন,’কিরে?বেশি ব্যাথা পেয়েছিস?’
সারথি মাথা নাড়িয়ে না জানায়
ওদিকে ফারাজের মনে পড়লো দাদার কথা।তাই সে ওদিকে চলে গেছে।পূর্ণতা ওকে যেতে দেখে সেও পিছু নিলো।
হঠাৎ সামনে এসে পড়েছে অর্ক।অর্ককে দেখে পূর্ণতা থেমে গেছে।
‘সারাদিন ফারাজ চাচ্চুকে ফলো করেন কেন?’
‘কই না তো।আমি আমার রুমে যাচ্ছিলাম’
‘আপনার রুম তো ঐদিকে।এদিকে না।তবে?’
‘ওহ হ্যাঁ তাই তো।আচ্ছা আসি’
পূর্ণতা মাথা চুলকে চলে গেছে।অর্ক আবার উল্টো ঘুরে পড়তে চলে গেলো।পরের মাস থেকে পরীক্ষা। পড়ার যেন শেষ সীমানাই খুঁজে পায়না সে।এখন এমন হয়েছে সে হেঁটে হেঁটেও পড়ছে।হেঁটে পড়লে পড়া জলদি শেষ হয়।
ফারাজ আবারও দাদাজানের রুমের দরজা খুলতেই ভূতুড়ে পরিবেশের সাথে পরিচিত হলো।
দাদা তখন ধ্যান করছিলেন।কলের গানে একটা পুরোনো গান চলছে। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।ফারাজ ধীরে ধীরে রুমে ঢুকে দাদাকে ডাক দিলো।দাদা পেছনে না তাকিয়ে বললেন,’টেবিলের উপর একটা খাম আছে।ওটা খোলো’
ফারাজ বাধ্য ছেলের মতন গিয়ে খামটা খুললো।খুলতেই ভেতর থেকে শ’খানেকের মতন ছবি ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিচে পড়েছে।
সব মেয়েদের ছবি।ফারাজ মেঝে থেকে ছবিগুলো তুলে দাদার দিকে তাকালো।দাদা এদিকেই চেয়ে ছিলেন।ওকে তাকাতে দেখে তিনি বললেন,’আমাকে কি দেখছো?ছবিগুলো দেখো’
ফারাজ এবার ছবি একটা হাতে নিয়ে দেখছে।ছবির মেয়েটা দেখতে একেবারে বাচ্চাদের মতন।সেসময় দাদা বললেন,’ওর নাম নিহা,বয়স আঠারো বছর দুই মাস।এসএসসি দিয়েছে।ইন্টারে পড়ার ইচ্ছা নাই আর।দেখতে ভাল বলে নিলাম ওর ছবি।লম্বায় তোমার কাঁধ বরাবর হবে।সুন্দর মেয়েরা বেশিরভাগ খাটোই হয়,সমস্যা নেই।বাচ্চা সব সুন্দর হবে,খাটো হবে না।কারণ বাপ বহুত লম্বা।
দেখো কেমন লাগে’
‘আমি দেখে কি করবো?’
‘বিয়ে করবে’
দাদার কথা শুনে ছবিটাই পড়ে গেলো ফারাজের হাত থেকে।ভূত দেখার মতন মুখ করে চেয়ে আছে সে।কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা।ওকে ওমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে দাদা বললেন পরের ছবিটা হাতে নিতে।ফারাজ হাতের ছবিটা রেখে আরেকটা ছবি হাতে নিলো।
এবার দাদা বললেন,’ওর নাম ইশা।ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছে তবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে দুই নাম্বারের জন্য ফেল করেছে।এমনিতে মেয়ে লম্বা,সুন্দর আছে।দেখতে ফিটফাট। একেবারো সংসারী মনে হলো।কেমন লাগে বলো’
‘দাদা আমি বিয়ে করবোনা’
‘আচ্ছা ওটা রেখে পরের ছবিটা তুলো।’
ফারাজ বিরক্তি নিয়ে পরের ছবিটা নিলো হাতে।এবার আর তাকালো না।
দাদাজান বললেন,’মেয়েটা অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে।দেখতে শ্যামলা তবে গঠন আকৃতি অসাধারণ,লম্বায় তোমার গলা অবধি যায়,ব্যবহার মার্জিত। কিঞ্চিত চঞ্চলতা বিদ্যমান তাতে।রান্নার হাত পাকা।শুচিবায়ু রোগ আছে হয়ত।ওটা আমার কাছে ভালোই লাগলো,হাবিজাবি বাড়ির বউয়ের শুচিবায়ু রোগ হলে অতি মঙ্গল।মেয়েটার সব তোমার সাথে মানিয়ে যায়।হয়ত এরে তোমার ভাল লাগবে।ছবিটার দিকে তাকাও’
ফারাজ ছবিটা রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’দাদা আমি কোনো চাকরি করিনা।মেয়েটাকে খাওয়াবো কি?’
‘এখন যেটা খাচ্ছো’
‘আমি বাবার পয়সায় খাই।ওরেও কি বাবা পয়সাতেই খাওয়াবো?’
‘বউ ঘরে আসলে তুমি এমনিতেই কর্মঠ হবে।তোমার প্রতি আমার সেই আস্থা আছে।সুতরাং যা বলছি করো।ছবিটা দেখে বলো মেয়ে কেমন’
ফারাজ ছবিটা হাতে নিয়ে দেখে কারেন্টের শক লাগার মতন ঝটকা খেয়েছে।এটা পূর্ণতার ছবি।ইয়া বড় হা করে সে দাদার মুখের দিকে তাকালো আবার।দাদাজান আর তাকালেন না ওর দিকে।চুপচাপ ধ্যানে মগ্ন হয়ে গেছেন।
‘দাদা?এটা তো পূর্ণা’
‘ঠিক ধরেছো, এটা পূর্ণা’
‘আমি দরকার হলে ঐ ইন্টারে ফেল করা মেয়েটাকে বিয়ে করবো তাও পূর্ণাকে বিয়ে করবো না।ওর স্বভাব আমার ভাল লাগেনা।যাকে ভাল লাগেনা তাকে নিজের জীবনসঙ্গী কি করে বানাই?তাছাড়া এখন বিয়ে নিয়ে ভাবছিনা আমি’
‘তবে সময় নাও’
——-
ফারাজ বের হয়ে সোজা মায়ের কাছে এসে হাজির।মা তখন সারথির জন্য গরম দুধ গ্লাসে ঢালছিলেন।ফারাজ এসে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মা ওর মন খারাপ দেখে বললেন,’কিরে?আবার কার সাথে কি হলো?’
‘তুমি জানো দাদা আমায় কি বলেছেন?’
‘তোর বিয়ের কথা বলেছে,জানি’
‘তুমিও জানো?তুমি কি এটা জানো কার সাথে বিয়ে দিতে চায়?’
‘জানি’
‘মানেহ!তুমি কিছুই বলবেনা?তোমার কি মত আছে এটাতে?’
‘বাবা না ভেবে কোনো সিদ্ধান্ত নেন না কখনও।তোর ভালোর কথা চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত টা নিয়েছেন।আমি তো খারাপ দেখিনা।’
ফারাজের মাথা হ্যাং হয়ে গেছে মায়ের কথা শুনে।মাথায় হাত দিয়ে সে ঠিক করলো যার সাথে কথা বললে এর একটা বিহিত হবে তার সাথেই কথা বলবে।তাই সে সোজা পূর্ণতার রুমে এসে হাজির।
পূর্ণতা সে সময় ক্লাস ওয়ানের একটা বই উল্টে পাল্টে দেখছিল।নতুন করে একটা চাকরি খুঁজতে হবে,এভাবে তো পরের বাড়িতে বসে বসে খাওয়া যায়না।ওদের হাতে কিছু টাকা দিলে সম্মানটা বজায় থাকবে।
দরজার কড়া নাড়ার আওয়াজ পেয়ে মাথা তুলে তাকায় পূর্ণতা।ফারাজ ভেতরে ঢুকে গাল ফুলিয়ে রেখেছে।ওকে দেখে পূর্ণতা ভাবছে সে আবার কি দোষ করেছে যার জন্য ফারাজ গালকে মিষ্টি কুমড়ার মতন ফুলিয়ে রেখেছে।
ফারাজ আরেকটু এগিয়ে এসে টেবিলের কাছ থেকে চেয়ার টেনে পূর্ণতার সামনে বসে।পূর্ণতা বইটা বন্ধ করে ওর কথা শুনার অপেক্ষায় চেয়ে আছে।ফারাজ কি দিয়ে শুরু করবে ভেবে পাচ্ছেনা।কিন্তু কথা তো বলতেই হবে।না বললে এখানে আসাটায় বৃথা হয়ে যাবে।
পূর্ণতা ফারাজকে এদিক- সেদিক চোখ বুলাতে দেখে মনে মনে ভাবছে ফারাজ হয়ত কিছু একটা বলতে চাইছে কিন্তু ভয়ে নাকি সংকোচের কারণে বলেও বলতে পারছেনা।কি এমন কথা যে রাগী ফারাজকে এমন ভেজা বেড়াল বানিয়ে দিলো?কি হতে পারে সেই কথা।
“আমার যতদূর মনে আছে,আমি কোনো শয়তানি করি নাই যেটার অভিযোগ নিয়ে তিনি এখানে আসলেন।তবে কি হলো? আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করবো?না থাক।দেখি কি বলে ‘
——-
ফারাজ গলা ঠিক করে বলে, ‘দাদাজানের সাথে কথা হয়েছে আপনার?’
‘কি নিয়ে?’
‘ববববববিয়ে’
‘কার বিয়ে?’
‘আমার আর আপনার’
‘ফাজলামো করতেছেন?’
‘দাদাজান ফাজলামো করে?’
‘আপনি কি সিরিয়াসলি বলছেন এসব?’
‘আমি আগে কখনও ফান করেছি আপনার সাথে?দাদাজান আমায় এটা বললো সেটা আপনাকে বলতে আসলাম।শুনুন,আপনাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে অসম্ভব।এদিকে দাদাজান ঠিক করে নিয়েছেন আমাকে বিয়ে করাবেনই।তাই আমি বলে দিবো অন্য একটা মেয়েকে দেখতে।আপনি আবার গিয়ে বলবেন না যেন যে ‘ফারাজ ভাইয়াকে বিয়ে করতে সমস্যা নাই আমার’
‘আপনি নিজেকে কি ভাবেন?সাদা পাঞ্জাবি,উষ্কখুষ্ক চুল,চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা।উজবুুকের মতন হাঁটাচলা দেখে আমি দিওয়ানা হবো?আপনাকে যে বুড়া নানার মতন লাগে তা জানেন?খালি দাঁড়ির অভাব।দাঁড়ি থাকলে একেবারে নানার মতন দেখতে হতেন।চশমা সহ আপনাকে একটা বড় সড় ভাল্লুকের মতন দেখতে।আর চশমা খুললে পান্ডার মতন দেখতে লাগে,শুকনা পান্ডা।আপনাকে আমি বিয়ে করবো?আপনি চাইলেও আমি মানা করে দিতাম’
‘আর আপনি নিজেকে কি ভাবেন, বিশ্বসুন্দরী??আমার প্রতিমা আপনার থেকে হাজারগুণ সুন্দর।ওরে পাই নাই বলে আমার ভাগ্যটা এবার আপনার কাছে গিয়ে আটকালো।তা আমি হতেই দিবোনা’
‘তো যাননা প্রতিমার ডিভোর্স করিয়ে ওরেই বিয়ে করেন।দাদাজান সোজা বাসা থেকেই বের করে দিবে আপনাকে’
‘আপনার এত ভাবতে হবেনা’
ফারাজ দাঁড়িয়ে গেলো।রেগেমেগে আবার বললো,’আপনার সাথে সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো মানুষ কথা বলেনা।বলতে পারেওনা,আপনি নিজে একটা পাগল,সামনের মানুষটাকেও পাগল বানিয়ে তোলেন।
আপনাকে আমার জ্ঞান থাকতে আমি বিয়ে করবোনা।জীবনেও না’
এরপর ফারাজ হনহনিয়ে চলে গেলো।পূর্ণতা ভেংচি কেটে আবার বইটা হাতে নিয়ে দেখছে।
———
সজীবের মা সারথি যায়নি বলে তিনি ফিরে গেছিলেন একাই।সারথি বলেছিল পরে ইচ্ছে হলে যাবে।এদিকে সজীব যখন জানলো সারথি ফেরেনি তখন তার মনে হলো ওকে কল করা উচিত।তাই রাতে ফ্রি হয়ে একবার সারথিকে কল দিলো সে।সারথি সবেমাত্র শুয়েছিল বিছানায়,চোখে ঘুম নেই।মাথায় অসহ্যকর ব্যাথা।
ফোনের আওয়াজ পেয়ে সোজা হয়ে বসে সারথি।বিছানায় ফোন হাতিয়ে খুঁজে নিয়ে রিসিভ করে কানে ধরলো।ওপাশ থেকে সজীবের গলা শুনে আজ সারথির বিরক্তি বোধ হয়।
এর আগে সজীবের একটা কলের আশায় সে সারাটা দিন ধরে প্রহর গুনতো আর আজ তার কেবল বিরক্তি লাগছে।
সারথি চুপ হয়ে আছে দেখে সজীব বললো,’ডিনার করেছো?’
‘হ্যাঁ’
‘আমি করিনি।এদের রান্নায় স্বাদ পাইনা’
সারথি তাও চুপ হয়ে আছে।সজীব কি বলবে,কি দিয়ে শুরু করবে আগাগোড়া না পেয়ে বলে দিলো,’আচ্ছা ঘুমাও,অনেক রাত হয়েছে’
ও ভেবেছিল সারথি আরও কথা বলবে,কিন্তু সজীবকে অবাক করে দিয়ে সারথি লাইন কেটে দিয়েছে।
চলবে♥
#ডাকপাড়ি
#পর্ব_২০
#আফনান_লারা
________
ফারাজ নিজের রুমে চলে এসে দরজা বন্ধ করে রুমের বাতি নিভিয়ে চুপ করে খাটে বসে আছে। প্রতিমার ছবি চোখের সামনে ভাসছে শুধু।
এত প্রতিক্ষার পর এভাবে সব শেষ হয়ে যাবে তা ফারাজ কখনও কল্পনাতেও ভাবেনি।প্রতিমা না আসলে হয়ত আরও কত স্বপ্ন দেখতো ফারাজ।ওর ইচ্ছে ছিল নিজের পরিশ্রমের টাকায় এক এক করে সব কিনবে।শুরুতে বালা,এরপর বেনারসি এরপর বিয়ের খরচাপাতির জোগান।
পরিবারের কাছে সবসময় ভালবাসাগুলো হেরে যায় কেন?দুটো মানুষ যখন দুজনকে ভালবাসে তখন পরিবার কেন বাধা দেয়?সমাজকে ভয় পেয়ে?সমাজের কটু কথা শোনার ভয়ে?
কিন্তু দিনশেষে যখন তারা ভাল থাকে সমাজ তখন বলার কে?আচ্ছা কতদিন বলবে সমাজ?
‘আমাদের মিল হতে পারতো, হয়নি!আমি না বিশ্বাস করতে পারছিনা।আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।ভীষণ!!
প্রতিমা একবার এসে বলে দাও,এসব মিথ্যে।তুমি এখনও আমার হতে পারবে!!’
বাইরের শীতল হাওয়া এসে গায়ে লাগলো ফারাজের।চোখ শক্ত রেখে গায়ের পাঞ্জাবিটা খুলে ফেলে ফারাজ।এবার হাওয়া এসে ওর পিঠে সরাসরি লেগে যাচ্ছে।
চোখ বন্ধ করে ফারাজ বারবার প্রতিমার নাম নিচ্ছে।ওর ছবিটা চোখের সামনে থেকে সরছেইনা ফারাজের।যখনই মনে পড়ে ওর বিয়ে হয়ে গেছে তখনই ছবিটা যেন ওরই চোখের সামনে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।
বড় বড় শ্বাস নিয়ে ফারাজ একটা চিঠি লিখতে বসে।চিঠিটা সেই পুরোনো প্রাপকের প্রতি।প্রিয় অঙ্গীকারিনীর প্রতি।এই চিঠি লেখা হবে,পোস্ট করা হবে।মানুষটা পাবে,পড়বে এবং দুঃখ পাবে।
তাকে দুঃখ দেয়ার উদ্দেশ্যে ফারাজ চিঠিটা লিখতে বসেনি বরং নিজের কষ্টের সামান্য ভাগিদার করতে চায় সে প্রতিমাকে।
প্রিয় অঙ্গীকারিনী,
শুনলাম তোমার বরের নাম প্রিতম।তোমাদের নামের বেশ মিল আছে।ফারাজের সাথে মিল রেখে ফারিজা খুঁজে দিতে পারবে?ওহ হো!ফারিজা নামে আদৌ কোনো মেয়ে আছে?হয়ত আছে হয়তবা নাই।জানো,আমার ধারণা আমার স্ত্রীর নাম অন্য রকম হবে, তোমার মতন মিলিয়ে হবেনা।তার নাম কি হবে বলোতো?আচ্ছা তুমি আমার বিয়েতে আসবে তো?এই চিঠিটা আমি তোমায় আমন্ত্রণ হিসেবে পাঠাচ্ছি।আমার বিয়ে ঠিক হলে আরেকটা চিঠি যাবে তোমার কাছে।তুমি কিন্তু অবশ্যই আসবে।
তুমি হয়ত এখন ভাবছো ফারাজ এত জলদি সব কি করে ভুলতে পারে!
ফারাজ কিন্তু কিছু ভোলেনি প্রতিমা।ফারাজ এখনও সেই প্রতিমার ছবি মনের ভেতর টাঙিয়ে রেখেছে।ভোরে চোখ খুলে মনের ভেতর গিয়ে একবার ছবিটা দেখেই তার দিন শুরু হয়।তুমি আমার সেই মোহ যে সত্যি মোহ হিসেবেই রয়ে গেলো।জীবনে পদার্পণ করতে আর পারলোনা।কেন যে তোমায় মোহ বানাইলাম।মোহ জিনসিটা অদ্ভুত!আজীবন মোহ থেকে যায়,বাস্তবে ঐ জিনিসটা আর আমাদের হয়না।আমি বোকাসোকা,প্রতিমার রুপে মোহিত হয়ে গেছি।সেই রুপ আমায় আর কোনো নারীতে আসক্ত করেনি এতদিন।তবে কি জানো!আমার ও একটা জোর ছিল, যে আমি অন্য নারীতে আসক্ত হবোনা।তুমি চলে যাবার পর থেকে হঠাৎ সেই জোর যেন কমে আসছে।তোমার কি এই লাইন পড়তে কষ্ট হলো প্রতিমা?
হাসি আসছে আমার।যাই হোক শুনো,তোমার অপেক্ষায় থাকবো সেটা সত্যি।তবে তোমাকে পাবার অপেক্ষা না সেটা।কিসের অপেক্ষা তা আমি নিজেও জানিনা।দেড় বছর ধরে ডাকপাড়িতে পাড়িতে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি শুনেও কেমন অপেক্ষার চাদর খুলে বসে আছি।আমি গাধা,গাধাটাই রয়ে গেলাম। তোমায় ডাকপাড়ি শেষে হবেনা আর।আজীবন ডাকপাড়বো।তুমি এসোনা,ভাল থেকো।ফারাজের ডাকপাড়ি ডাকবাক্স অবধি গিয়ে আবার ফিরে আসবে।ভিনদেশে পাড়ি জমাবেনা’
হঠাৎ দরজার খটখট আওয়াজে ফারাজের কলম থেমেছে।সবার আগে পূর্ণতার কথা মাথায় আসায় উঠে রাগী লুকে ঠাস করে দরজা খুলে ধমকতে গিয়ে দেখে সারথি দাঁড়িয়ে আছে।ফারাজ দরজা খুলেছে শুনেই সারথি এগিয়ে দেয়াল ধরে ভেতরে ঢুকে হাতিয়ে ফারাজকে জড়িয়ে ধরলো।
ফারাজ আশ্চর্য্য হয়ে গেছে।সারথি কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।নিজেকে ঠিক করে ফারাজ ওর মাথায় হাত রেখে বললো,’কাঁদিস কেন?আমি আছিনা?’
‘কি করবি তুই!’
‘আমি সব ঠিক করে দিব।তোর জীবন রাঙিয়ে দিবো’
‘আগেও পারিসনি।এইবার কি করে পারবি?’
ফারাজ সারথির হাত ধরে বিছানায় এনে বসিয়ে রুমের আলো জ্বালায়।এতক্ষণ টর্চ দিয়ে চিঠি লিখছিল সে।সারথির সামনে টুল টেনে বসে ওর দুহাত ধরে ফারাজ বললো,’বল আমায়, তোর কি লাগবে।সব এনে দিবো’
কথাটা বলে ফারাজ সারথির চোখ মুছে দেয়।
সারথি কান্নার জন্য কথা বলতে পারছেনা,ফারাজ ওর হাতে চুমু দিয়ে মাথা তুলে বললো,’গান শুনবি?’
‘তুই তো ঐ একটা গানটা ছাড়া আর কোনো গান গাস না।’
‘তুই বললে সব গান গাইবো,বল কোন গান শুনবি?’
‘গান শুনার ইচ্ছে নাই।মন ভাল করে দে।তারপর ঘুমাবো’
ফারাজ চট করে বিছানায় উঠে বসে সারথির চুলে সিতা কেটে দেয়া শুরু করে।সারথি চোখ বন্ধ করে বললো,’জানিস?সজীবকে আমি অনেক ভালবেসেছিলাম।একটা মানুঢকে না ছুঁয়ে, না দেখে কি করে ভালোবাসা যায় তা আমাকে দেখে শিখতে পারিস।অথচ আমার সেই ভালবাসার প্রতিদান আমি পাইনি।কেন বলবি?দোষটা কি আসলেই আমার?আমার কপালের দোষ নাকি আমারই দোষ?স্বামীকে হাতের মুঠোয় না আনতে পারায় আজ এই দিন দেখতে হচ্ছে আমায়?কেন বলতে পারিস?’
ফারাজ সারথির চুলে বিনুনি করছে চুপ করে। সারথির প্রশ্নের জবাব তার কাছে নেই।ছোটবেলা থেকে সারথিকে তার অন্ধত্ব নিয়ে কোনো কথা শুনতে হয়নি।তবে বড় হবার পর থেকে শুরু হলো যেন আসল পরিস্থিতি। যেই বিয়ের জন্য দেখতে আসছে সেই মুখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছে।হাসিখুশি সারথির মুখ দিনের পর দিন মলীন হতে চলছিল।যেন এর শেষই নেই।কত শত পরিবার এসে মুখের উপর না করে দিয়ে চলে গেছিলো তার হিসেব নেই।
শেষে একদিন সজীবের পরিবার আসলো,সাথে আসলো সজীব নিজেও।এক দেখাতেই সে বলে দিলো সারথিকে তার পছন্দ।
এই বিষয়টা সারথি সহজ ভাবে নেয়নি।সে বারবার করে বলেছে একটা অন্ধ মেয়েকে কেন এত বড়লোকের ছেলে,এত বড় চাকরি করা ছেলে বিয়ে করতে আসবে?এটা হয়না।
কেউ সারথির কথায় পাত্তা দেয়নি।সকলের ধারণা সজীব সারথির ভাগ্য বদলে দেবে।আসলে কি তাই হলো?এমন করে ভাগ্য বদলাবে জানলে হয়ত সেদিন ফারাজ নিজেই বিয়েটা ভাঙ্গতো।
সারথি ফারাজের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে।ওর মাথার নিচে বালিশ দিয়ে ফারাজ বিছানা ছেড়ে নামে।মাথার ভেতর সারথির কষ্ট গুলো ঘুরপাক খাচ্ছে।একদিনে এত ঝটকা সে সামলে নিতে পারছেনা।
রুম থেকে বের হতেই ফারাজ দেখে পূর্ণতার রুমে আলো জ্বলছে এতরাতে আলো জ্বলার পেছনে কারণ আছে নিশ্চয় তাই ভেবে ফারাজ এগিয়ে গেলো দেখতে।কাছে এসে দেখলো পূর্ণতা বই পড়ছে।কিছু না বলে ফারাজ ওখান থেকে চলে আসলো।সবাই ঘুমে।অর্কর রুম থেকেও পড়া শোনা যাচ্ছিল।দুই জ্ঞানীর রুম ফারাজের রুমের একদম কাছাকাছি।অবশ্য ফারাজ ও কিন্তু আগে এমনই পড়তো।পড়ালেখার গণ্ডি শেষ হবার পরেও সে পড়ে।নতুন নতুন বই বের হলেই সংগ্রহ করে পড়ে ফেলে।অথবা অর্কর লাইব্রেরি তো আছেই।
ঘুরতে ঘুরতে সারথির রুমে এসে ওখানেই শুয়ে পড়ে ফারাজ।তার রুম তো সারথি দখল করে নিয়েছে
———-
সজীব প্রতিদিনকার মতন সমুদ্রের বালিতে এসে বসে আছে।পরনে ছিল থ্রি কোয়াটার একটা প্যান্ট আর উদম শরীর।
বসে বসে পানির উত্তালতা দেখছিল সে।আর কিছু সময় পরেই পানিতে নামবে।রাতে সমুদ্রে সচরাচর কেউ নামেনা বিপদ হতে পারে ভেবে কিন্তু সজীব সেটা মানে না কখনও।সে দক্ষ সাঁতারু। এর আগেও গভীর রাতে সে পানিতে নেমেছে।মন খারাপ থাকলেই পানিতে নেমে যায়।
বালিতে পা ঘষে উঠে দাঁড়ায় সে।চাঁদের আলো সমুদ্রের পানিকে আরও আকর্ষিত করছে।সজীব মুখে হাসি ফুটিয়ে পানিতে নেমে গেলো।কয়েকটা ডুব দিয়ে উপরে আকাশের দিকে চেয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে।রাতের আকাশে মিশে থাকে নিস্তব্ধতা, প্রেম,ভালবাসা,সবকিছু।রাতের আকাশের যে দাম তা কেবল তারাই জানে যারা দেখে।
সজীব অবাক চোখে আকাশ দেখছিল হঠাÞ পিঠ জড়িয়ে ধরলো কেউ একজন।সজীব প্রথমে গাবড়ে গেলেও পরে কানের কাছে চেনা গলার স্বর শুনে নিজেকে মানিয়ে নিলো।লেভেন সজীবকে সারপ্রাইজ দেবে বলে লুকিয়ে সে নিজেও পানিতে নেমেছিল।সজীবকে জড়িয়ে ধরে ওর কানে কানে বলছে’ চলো আজ আমরা ডুবে যাই।’
‘রাতে সুইমিং করা ঠিকনা লেভেন।উঠে যাও’
‘যাব না।সব স্বাদ তুমি একা নেবে কেন?আজ আমিও নিব’
‘আমি সাঁতারে পটু,কিন্তু তুমি না।এখন ঢেউ আসলে যদি কিছু হয়ে যায়?’
‘আমার কিছু হলে তো তোমার জন্য সারথি আছেই’
‘চুপ করো লেভেন।এটা কেমন কথা?যাও কিণারায়।আর ডুবতে হবেনা,অনেক ডুবছো’
‘আমি যাব না ব্যস’
—-
ঠিক সেময়ে একটা বিরাট ঢেউ এসে পড়েছে।সজীব লেভেনের হাতটা শক্ত করে ধরে ফেললো।লেভেন সেই সুযোগে সজীবকে জড়িয়ে ধরে ফেলে।ঢেউটা চলে যাবার পর দুজনেই দম ফেলেছে।সজীব ভয় পেয়ে গেছিলো কিন্তু লেভেন ভয়ের জায়গায় দারুণ মজা পেয়েছে। সজীব লেভেনকে ওভাবে জড়িয়ে ধরে থাকতে দেখে হেসে ফেললো।তারপর ওর মুখটা সামনে এগিয়ে ধরলো সে।ঠিক সেসময় হঠাৎ সারথির মুখ ভেসে উঠেছে সজীবের চোখের সামনে।শেষবার এমন করে সে সারথির মুখ ধরেছিল।যেদিন সে চলে আসে এখানে, সেদিন সারথির মুখে ময়দা লেগেছিল,সজীব নিজ হাতে মুছে দিয়েছে সেটা।হঠাৎ করে ঐ দৃশ্যটা মনে পড়ে গেছে।
লেভেন অপেক্ষায় আছে সজীবের একটা স্পর্শের।সজীব ওর কোমড় থেকে হাত সরিয়ে পিছিয়ে গেছে।সারথির চেহারা সামনে থেকে নড়ছেইনা।
ওকে সরে যেতে দেখে লেভেন নিজে একটু কাছে এগিয়ে বললো,’সজীব?!আজকেও কি ফিরিয়ে দিবে?’
‘লেভেন! ঢেউ আরও আসতে পারে।ফিরে যাও।আমিও উঠবো’
এই কথা বলে সজীব ডুব দিয়ে কিণারার দিকে চললো।লেভেনের মনটা ভীষণরকম ভাবে খারাপ হয়ে গেছে।সাথে রাগ ও হলো।মাথায় একটা বুদ্ধি আসছে সেসময়।পেছনে ফিরে দূরে থেকে আসতে থাকা ঢেউটার দিকে চেয়ে লেভেন হাসি দিয়ে সেদিকে সাঁতরে যেতে লাগলো।সজীব বালিতে পা রেখে পেছনে ফিরে দেখে লেভেন এখনও আসেনি, বরং আরও গভীরের দিকে যাচ্ছে।সজীবের আর বুঝতে বাকি নেই যে লেভেন আজ একটা কিছু ঘটিয়ে ছাড়বে।
——–
পূর্ণতা ভোরের দিকে সারথির রুমের কাছে এসে দাঁড়ালো।দরজা খুলে অন্যদিকে ফিরে পা টিপে টিপে কাছে এসে বিছানার দিকে না তাকিয়েই সে বললো,’আপু আমি জানি তুমি এখন তোমার ভাইয়ের সাইড নিবা তাও বলছি।তোমার ভাইটা একদম তোমার উল্টো হয়েছে। চোহারায় যত মিল হোক না কেন!! ব্যবহার,আচার আচরণে পুরো উল্টো। বদমেজাজি,আর আমায় তো সহ্যই করতে পারেনা।তুমি ওনাকে বলবা যেনো আমার সাথে আর ঝগড়া না করে।আমি এমনিতেও কদিন পর বাবার কাছে চলে যাব।ওনার সাথে আমার বিয়ে সম্ভব না।আমি ওনাকে বিয়ে করবো ও না।দুই প্রকৃতির মানুষ কখনও মিলতে পারেনা।তাছাড়া উনিও রাজিনা।তোমার কাজ হলো দাদাজানকে বোঝানো।কি হলো কিছু বলছোনা যে?’
পূর্ণতা পেছনে ফিরে চোখ কপালে তুলে ফেলেছে।ফারাজ হেলান দিয়ে বসে বই একটা পড়ছে ওখানে।পূর্ণতা ঢোক গিলে পা টিপে টিপে সরে যাচ্ছিে ঠিক সেসময় ফারাজ বললো,’সাপ্লাই পানি এসেছে।আমার জন্য এক কাপ চা বানিয়ে আনুন’
‘বয়ে গেছে’
‘যা যা বলেছেন তার সাথে দশ কথা মিশিয়ো দাদাজানের কানে তুলবো যদি কথা না শুনেন তবে’
‘আপনি সব শুনেছেন?’
‘আমি বদমেজাজি? ‘
‘না না।একেবারে না।আপনি অনেক ভাল,এত ভাল যে আমার নিজেরই সহ্য হয়না’
‘সহ্য হবে কি করে!ভাল জিনিস তো আপনার সহ্য হবার কথানা’
পূর্ণতা বিড়বিড় করতে করতে চলে যাচ্ছিল আবার কি মনে করে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললো,’আচ্ছা আপনি সারথি আপুর রুমে কি করেন?’
‘কেন?ভাই বোনের রুমে থাকতে পারেনা?’
‘পারে তো।কিন্তু হঠাৎ কেন?’
‘আমার রুমে সারথি ঘুমিয়ে পড়েছে কাল রাতে তাই’
চলবে ♥