ডাকপাড়ি #পর্ব_৩৩,৩৪

0
161

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৩৩,৩৪
#আফনান_লারা
৩৩
________
পূর্ণতা জিলাপি বানাতে বানাতে ভাবছিল আজিজ খান এতসব কি করে জানে!এটা তো অসম্ভব। পরে মাথায় আসলো হয়ত দাদাজান সব বলেছেন।
জিলাপি হাতে সোজা দাদাজানের রুমের দিকে যাচ্ছিল সে সেসময় ফারাজ সামনে পড়লো,তাকে নাকি দাদা ডেকেছেন।পূর্ণতার হাতে এক প্লেট তাজা গরম গরম জিলাপি দেখে লোভ সামলাতে পারেনি ফারাজ।এক টান দিয়ে দুটো নিয়ে ফেললো।পূর্ণতা ভ্রু কুুঁচকিয়ে বললো,’খান খান।আপনার বিয়ের মিষ্টি’

‘আমার বিয়ের মিষ্টি মানে?’

‘দাদাজান আমার এই সুন্দর হাতখানা দেখিয়া বলিয়াছেন আমার বিয়ে হবে মিরাজুলের সাথে।’

‘কিহ?মিরাজুল তো আমি।’

‘জ্বী,ঠিক ধরেছেন।’

পূর্ণতা এবার চলে গেছে।ফারাজ অবাক হয়ে হাতে জিলাপি নিয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। এরপর যে প্রস্তাব আসবে টাতে চোখ বন্ধ করে রাজি হয়ে যেতে হবে।নাহলে দেখা গেলো দাদাজান জোর করেই বিয়ে দিয়ে দিবেন পূর্ণার সাথে।

হাতের জিলাপি যে ইচ্ছে নিয়ে সে হাতে নিয়েছিল এখন সেই ইচ্ছা বিস্বাদ মনে হচ্ছে।খাওয়ার ইচ্ছা নেই বলে সিয়ামকে ডেকে হাতে ধরিয়ে দাদাজানের রুমের দিকে চললো সে।
পূর্ণতা ততক্ষণে পৌঁছেও গেছে।
দুজনে একত্রে দাঁড়িয়ে দুই দাদার কথা শুনার অপেক্ষায় আছে এখন।

‘শুনো নাতি নাতিন!তোমরা একে অপরের জন্য শতে শতে দুইশ!!আমি কি বলছি বুঝতে পারছো?তোমাদের দুজনের সাথে দুজনকে মানায় বলেই আমরা বড়রা মিলে তোমাদের বিয়ে দিতে চাইতেছি।তাহলে কেন তোমরা মানা করছো?ক্ষনিকের ঘৃনা কি সারাজীবন থাকে?বিয়ে করলে মনে প্রেম জাগবে,জীবন সুন্দর কাটবে।আমাদের কথা মানো, বিয়েতে বসে যাও।বলো এবার তোমাদের যা বলার’

ফারাজ পূর্ণতার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।পূর্ণতাও ওর মুখের দিকে চেয়েছিল।এরপর ফারাজ বললো,’আমার সাথে যে কেবল পূর্ণাকেই মানায় তা কিন্তু নাহ।
আরও অনেক মেয়ে আছে।আপনারা দয়া করে সেই কাতার থেকে একটি মেয়ে খুঁজে আনেন।পূর্নাকে না প্লিজ!’

বেলায়েত হোসেন গাল ফুলিয়ে পূর্নতার মুখের দিকে তাকিয়েছেন।পূর্ণা বললো,’আমারও একই কথা।আমার জন্য কি ছেলের অভাব পড়েছে?!আমার বাবাও পাশে নেই।আমি এখন বিয়ে করতেও চাইনা। ‘

ওদের দুজনের কথা শুনে দুই দাদা ভীষণ ক্রোধীত হলেন।
রাগে তাদের চোখে যেন আগুন জ্বলছিল।দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ের কাছে তারা এমন সোজা উত্তর হয়ত আশা করেননি।এখনকার ছেলেমেয়েরা গুরুজনদের সম্মান দিতে জানেনা।নাহলে তাদের কথা ধরে হলেও বিয়েতে হ্যাঁ বলা ওদের কর্তব্য ছিল।তা না করে শুরু থেকে মুখের উপর না করে যাচ্ছে ওরা।

ফারাজ হাতের ঘড়িটা দেখে বললো,’আমার কাজ আছে।যেতে পারি?’

দাদাজান তখন রেগে বললেন,’আমি কি বলেছি আমার কথা শেষ হয়েছে?’

‘আচ্ছা বলুন।শুনছি’

‘তোমাদের না বলেছিলাম একসাথে থাকবেনা?তাহলে একসাথে সারথিকে আনতে কেন গিয়েছিলে?আমি কিন্তু আমার কথায় অটল।আর একদিন দুজনকে একসাথে দেখলে বিয়ে পরিয়ে দিব।আজিজ এখানেই থাকবে।দেখি তোমরা কত লুকোচুরি পারো’

পূর্ণতা আর ফারাজ মুখ ফুলিয়ে চলে এসেছে।বাইরে বের হয়ে দুজনে আবার দুদিকে চলেও গেছে।
————
সারথি মাত্র বিশ ঘন্টায় যেন আনাফের পুরা বাসাটাকে ভরিয়ে দিয়ে ফেলেছিল।সেই পরিবেশটা এখনও যায়নি।চারিদিকে ভাসছে।আর সেই মেয়েটা যদি একেবারে থেকে যেতো তাহলে কি না হতো!তাই ভেবে আনাফের বুকটা খালি হয়ে যাচ্ছে।কবে সেই মেয়েটিকে একেবারে নিজের করে সে পাবে সেই দিনটার অপেক্ষায় আছে সে।
একাকি রাতটায় সারথির বড্ড প্রয়োজন ছিল। মানসিক চাহিদার জন্য হলেও এই মেয়েটিকে তার চাই।এখনই!!
সে বড় একা।তার একাকিত্ব সারথি নামের মেয়েটা ছাড়া আর কেউ মিটাতে পারবেনা।আনাফ পারতে দেবেওনা।
কেন যে এই রাতেই চলে যেতে হলো তার!বেশ তো তার মুখ চেয়ে আরামসে সময় কেটে যাচ্ছিল।যে আনাফের ব্যস্ততার মাঝে সময় বলে জ্ঞান ছিলনা,ধারণা থাকতো না,সে আনাফ এই কয়েক মূহুর্তে বুঝে গেছে সময় কত মূল্যবান।কেবল চাকরিটাই সব হয়না।আমাদের নিজেদের একটা ব্যাক্তিগত লাইফ থাকে।
মেয়েটা সব বুঝেও চলে গেলো,থেকে গেলে কি এমন হয়??আমার অনুভূতির কি কোনো দাম নেই তার কাছে?’
——-
সজীব বাংলাদেশে ফিরে হোটেলে উঠেছে।বাসায় যায়নি।সবার আগে কোর্টে যাবে।তার পরিচিত উকিলের সাথে কথা বলে ডিভোর্স লেটার রেডি করে তারপর সারথির সাথে দেখা করবে।তার আগে না।
একটু রেস্ট করে সে বেরিয়ে পড়েছে কাজে।
ওদিকে সারথি সকাল থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।তার ফুড পয়েজনিং হয়েছে।ফারাজ ডাক্তার এনে দেখিয়ে ঔষুধও এনে দিয়েছে তাও ভাল হচ্ছেনা।বমি করতে করতে সারথির অবস্থা কাহিল।
সবাই সজীবকে কল করে যাচ্ছে কিন্তু ওর ফোন বন্ধ বলছিল বারবার।শেষে বাধ্য হয়ে ওর মাকে কল করেছেন জনাব মানিক।
সজীবের মা জানালেন তিনিও সজীবকে কলে পাচ্ছেন না।হয়ত জরুরি কাজে ব্যস্ত বলে ফোন বন্ধ রেখেছে।
তিনি রওনা হয়েছেন সারথিকে দেখতে আসার জন্য।পূর্ণতা একটা টোটকা হিসেবে শরবত বানাচ্ছিল সারথির জন্য, ঠিক সেসময় কলিংবেলের আওয়াজ শুনে মতিনকে বললো গিয়ে দেখতে।বাকি সবাই উপরের তলায় সারথির রুমে ছিল।মতিনের হাতে আটা মাখা বলে সে পূর্ণাকেই পাল্টা আদেশ করে গিয়ে দরজা খোলার জন্য।তাই পূর্ণা হাতের কাজ রেখে গেলো দরজা খুলতে।দরজা খুলতেই তার সাথে দেখা মিললো এক সুদর্শন পুরুষের।
পরনে কালো ফুল শার্ট,প্যান্ট।এক হাত পকেটে ঢোকানো আর এক হাতে একটা ফাইল।পকেট থেকে হাত বের করে চোখের চশমাটা খুলে সজীব বললো,’হাই??আমি সজীব।সারথি কি বাসায় আছে?’

সজীব শুনে পূর্ণতা ইয়া বড় হা করে এক দৌড় দিলো।
সজীব ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকেছে।মতিন আটামাখা হাত নিয়ে বাইরে বের হয়ে সজীবকে দেখে সেও এক দৌড় দিলো।
সিয়াম আর অর্ক একটা সাবজেক্ট নিয়ে তর্কাতর্কি করছিল।করতে করতে সজীবের সামনে এসে ওকে দেখে তারা ইয়া বড় হা করে এবার দুজন মিলে দৌড় দিলো।সবাই উপরের তলায় এসে বাকি সবাইকে গিয়ে জানালো সজীব এসেছে।কেউ শুরুতে বিশ্বাস করেনি।পরে যখন একসাথে সবাই বলা শুরু করলো তখন তারা বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো।
সবাই এবার সারথিকে রেখে নিচ তলার দিকে ছুটেছে।সারথি এখন একা।
সারথিও শুনেছে সজীব এসেছে।কিন্তু সে তার কানকে বিশ্বাস করেনি।কেবল কানের ভ্রম বলে ধরে নিয়ে সে চোখ বুজে দম ফেললো।শরীর এমনিতেও টানছেনা তার উপর উদ্ভত সব কল্পনা।

মিনিট দশেক পর দরজা খোলার আওয়াজ শুনে সারথি।তখন সে এপাশ করে ফিরে বললো,’মা আমি একটু ঘুমাবো।সবাইকে বলবে যেন বিরক্ত না করে।’

দরজাটা খুলার পর এবার বন্ধের আওয়াজ ভেসে আসলো।সারথি বুঝলো চলে গেছে হয়ত।তার এক মিনিট পর নিজের কাছে কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে চট করে উঠে বসে সারথি।খোলা চুলগুলোকে সামলে মৃদু স্বরে বলে,’কে?’

‘আমি’

কণ্ঠস্বরটা খুব চেনা সারথির।মূহুর্তেই সে বুঝে গেছে এটা কল্পনা নয়,সত্যি সজীব এসেছে।হাসবে নাকি কাঁদবে সেটা ভেবে পাচ্ছেনা সারথি।
হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করলো।ওমনি তার হাতটা যাকে খুঁজতে এগিয়েছিল সেই মানুষটা নিজেই ছুঁলো তাকে।সারথি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।কাঁদতে কাঁদতে বলে,’কেন দিলেন এত বড় শাস্তি!আমার কি দোষ ছিল!’

‘সারথি প্লিজ কেঁদোনা’

কথাটা বলে সজীব ওর পাশে বসে পড়ে।দুহাত বাড়িয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,’আমি তোমায় ধোকা দিতে চাইনি।তোমার বাকি জীবনে কোনো কষ্ট হবেনা সারথি।এই দেখো আমি একটা দলিল এনেছি।এটাতে লেখা আছে আমার উত্তরার যে ফ্ল্যাট আছে ওটা তোমার নামে।আমি তোমার নামে করে দিয়েছি পুরাটা।তাছাড়া তোমার সারাজীবনের ভরণপোষণের দায়িত্বটাও কিন্তু আমার।তুমি ভেবোনা সারথি’

সারথি তাচ্ছিল্য করে হাসে এবার।চোখ মুছে ফেলে বলে,’এটাই কি একটা মেয়ের চাহিদা?আর কিছু নেই আগে পরে?’

‘তুমি চাইলে বিয়েও করতে পারো।ধরা বাঁধা নেই’

‘আপনি আজ কি কারণে এসেছেন?’

‘আরেকটি দলিল এনেছি।ডিভোর্সের।’

‘দিন,সই করে দিচ্ছি।’

কথাটা বলে সজীবের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয় সারথি।তারপর কলম নেয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে রাখে।সজীব পকেট থেকে কলম নিয়ে ওর হাতে দিয়ে কাগজ দেখিয়ে দিলো।সারথি দম আটকে সই করে দিয়েছে।দিয়েই একটু দূরে সরে বললো,’চলে যান।আজ থেকে আপনি মুক্ত।আমি আর আপনাকে বিরক্ত করবোনা।’

সজীব কাগজগুলো একপাশ করে রেখে ফ্ল্যাটের ফাইলটা সারথির সামনে রেখে বললো,’এটা রেখে দাও’

‘বিয়ের আগে কি আমার মাথার উপর ছাদ ছিল না?তিন বেলা ভাত খেতে পারতাম না?পরনে পোশাক ছিল না?
সব ছিল। সুতরাং আপনার দয়া না ঢাকলেও আমি বেঁচে থাকতে পারবো।আপনি যান এখন’

সারথি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।সজীব সব একপাশ করে রেখে সাররথির পাশে বসে থাকলো,যাচ্ছেনা।সারথি চোখ মুছে ধরে নিলো সজীব চলে গেছে।এবার সে নিজে নিজে বিছানা ছেড়ে নামলো।হেঁটে দরজার কাছে গিয়ে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে সেটাতে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মনে হয় যেন পায়ের তলার মাটি সরে গেছে ওর।বাইরে থেকে হইচই শোনা যাচ্ছে।জামাই আদরের ব্যবস্থা করছে সবাই।সারথি যতবার চোখ মুছো ততবারই চোখ ভিজে যায় অশ্রুতে।
মেঝোতে বসে সে হাউমাউ করে কাঁদছে।সজীব খাটে বসে এক দৃষ্টিতে ওকে কাঁদতে দেখছে।
সারথির এমন হোক সেটা ও চায়নি।এখন তার নিজের ভেতরটা পুড়ে যচ্ছে সারথির জন্য।বারবার মন বলতে চাইছে সারথি তুমি কোঁদোনা।আমি সই করিনি এখনও,কখনও করবোনা।

সারথি হঠাৎ উঠে দ্রুত দেয়াল ধরে ধরে ওয়াশরুমে চলে গেলো বমি করতে।শরীর আর কোনো কিছু সহ্য করার অবস্থাতে নেই।মুখ ধুয়ে বের হয়ে দূর্বল শরীরে সে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।

সজীব নিজের কোটটা খুলে বালিশের উপর রেখে মাথার চুল ধরে টানাটানি করছিল,সারথিকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজে উঠে এসে ওর সামনে দাঁড়ায়।সারথি তখন অন্য দুনিয়ায়।তার বিশ্বাস হচ্ছেনা সে ডিভোর্স লেটারে সই করে দিয়েছে।মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে সেসবই ভাবছিল সে ঠিক তখন হাতের সাথে সজীবের হাতের স্পর্শ পেলো ।চমকে বললো,’আপনি যান নি?’

‘নাহ,পরে যাব।আসার পর থেকে ভাল ভাবে রেস্ট নিতে পারিনি।আধ ঘন্টা হোটেল রুমে থেকে কাজে লাগতে হয়েছে।’

‘আপনি এই রুম থেকে বের হয়ে যান,এটা আমার অনুরোধ’

‘কই যাব?তুমি চাও হোটেলে ফিরে যাই?’

‘যেখানে খুশি যান’

‘এত বছর পর স্বামীকে পেয়ে হোটেলে পাঠাচ্ছো?’

‘ স্বামী?ডিভোর্স পেপারে সই করলাম পাঁচ মিনিট হলো’

‘আমি কিন্তু করিনি।এখনও তোমার আমার সম্পর্ক ভাঙ্গেনি।সো আমি এখন যাব না।কয়েকদিন থাকি,ঘুরিফিরি তারপর যাব’

সারথি বিরক্ত হয়ে হাত ছাড়িয়ে পা বাড়াতেই হোচট খেলো।সজীব ওকে এক হাতে ধরে ফেলে বলে,’তোমার বিরক্ত হওয়া স্বাভাবিক। তবে কি জানো?আমি জানি তুমি আমায় ভালবাসো।ফায়দা লুটতে সমস্যা কোথায় বলোতো?’

‘আপনি জানেন আপনি একজন কাপুরুষের মতন কথা বলছেন?আপনার নিজের ভালবাসার মানুষ আছে,আপনি তাকে বিয়েও করবেন।আপনি নিজের স্ত্রীকে সে জন্য ডিভোর্স ও দিবেন, আবার বলছেন সেই স্ত্রীর ফায়দা লুটবেন?’

সজীব হেসে সারথিকে ছেড়ে বললো,’ফায়দা লুটা মানে কি বুঝলে?শারীরিক চাহিদা?উহু!!আমি সেরকম পুরুষ না।তুমি জেনে অবাক হবে আমার আর লেভেনের সম্পর্কটা এখনও শারীরিক অবধি গড়ায়নি’

‘আমার কাছে খারাপ মানে কেবল শারীরিক দিক দিয়ে না!
যে স্ত্রী থাকার পরেও মানসিক ভাবে আরেকজনের জন্য উন্মাদ আমার কাছে সেই মানুষটা খারাপ’

চলবে♥

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৩৪
#আফনান_লারা
________
সজীব জানে সে এখন যাই বলবে সারথির কাছে সেটাই বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।তাই চুপচাপ দরজা খুলে সে বের হয়ে গেছে জামাই আদর খেতে। সেটা খেয়ে যদি মনটা ভাল হয়,বউকে দিয়ে তো মন ভাল হয়নি।

বের হতেই দাদাজান এসে সামনে দাঁড়ায় সজীবের।দুহাত দিয়ে ওকে ধরে বলেন,’খাওয়া দাওয়া ঠিক ঠাক করোনা নাকি?আগের চেয়ে শুকিয়ে গেছো’

‘খাই।তবে ওখানকার খাবার আর এখানকার খাবারের তো তফাৎ আছে’

‘সেটাও ঠিক।তা কতদিনের জন্য এসেছো? ‘

‘আসলে আমি ছুটিতে আসিনি।জরুরি একটা কাজে এসেছি।এক সপ্তাহ পর চলে যাব’

‘ততদিন আমাদের এখানেই থেকো।তোমার মা তো আসছেন এখানেই’

‘মা আসছে?ওহ!কেন?আমার কথা জানিয়েছেন?’

‘নাহ,সারথির তো সকাল থেকে শরীর খারাপ।বদহজম হয়েছে।তাই দেখতে আসতেছে’

‘সারথি এ নিয়ে আমায় কিছু বলেনি,দূর্বল দেখলাম অবশ্য’

‘জানোই তো, সারথি তার অসুখ নিয়ে কাউকে বলতে পছন্দ করেনা।বুঝে নিতে হয়।চলো বাগানের দিকে, তোমার সাথে গল্প করবো’

দাদাজান সজীবকে ধরে বাগানের দিকে নিয়ে গেছেন।নাতিন জামাই আলাদা ব্যাপার স্যাপার।এদের সাথে আড্ডাটাও দারুণ জমে।তার উপর একমাত্র নাতিন জামাই।যাই বলবেন তাতেই ভেতর থেকে ভাল লাগা কাজ করবে।কত বছর পর একসাথে হলো তারা।কথার তো শেষ খুঁজেই পাওয়া যাবেনা।

ফারাজ দূরে দূরে থাকছে।যেদিন থেকে শুনেছে সজীব সারথিকে মেনে নিতে পারেনি সেদিন থেকে সজীবকে ওর ভাল লাগেনা।তাছাড়া ও সারথিকে কতটা অবহেলা করতো তার সবই ফারাজ দেখতো। সে কারণে এখন সে সজীবের সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেনা।এই বিষয়টা ভাল লাগেনি মানিক সাহেবের। তিনি রেগে আছেন ফারাজের উপর।তার কথা হলো ফারাজ একমাত্র শালা হিসেবে উচিত গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করা।সেটা না করে ফারাজ বিশ হাত দূরে দূরে থাকছে।তিনি পারছেন না ফারাজকে ঠেলে পাঠাচ্ছেন।কিন্তু ফারাজ হলো মহা ঘাড়ত্যাড়া। তাকে জোর করে কিছু করানো যায়না এই নিয়ে তিনি পরিচিত বলেই চুপ করে শুধু রাগে ফুঁসে যাচ্ছেন।এর বাইরে তার কিছুই করার নেই বলে সোনালীকে ডেকে বললেন তিনি যেন ফারাজকে বলে গিয়ে সজীবের সাথে কথা বলতে।
মিসেস সোনালীর নাক অবধি কাজে ডুবে আছে,একমাত্র মেয়ে জামাই বাড়িতে আসলে বুঝি সব শাশুড়ির এমন হয়।কি রেখে কি রাঁধবেন সেটা গুছাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।পূর্ণতা,সায়না আর মতিন ও কাজে লেগে আছে।
তাও যেন কাজের লোকের অভাব।বড় বাড়ির ছেলে,কত বছর পর এসেছে।তাও আবার একমাত্র মেয়ের জামাই।২০পদ করলেও কম মনে হবে।মানিক সাহেব বাজারের ব্যাগ হাতে মতিনকে কাজ থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন।ফারাজ গাল ফুলিয়ে বসে আছে তখনও।সজীবকে ঘিরে যত আয়োজন হচ্ছে সে একটাতেও সামিল হতে চায়না বলেই কাজের মধ্যিখানে মূর্তি হয়ে বসে আছে।
সিয়াম,অনন্ত অর্ক চকলেট নিয়ে হইচই করছে।সজীব মার্কেটে লোক পাঠিয়ে বিশাল বিশাল দুইটা বাক্স চকলেট এনেছে শুধুমাত্র বাড়ির বাচ্চাদের জন্য,আসার পথে বিদেশী চকলেট আনার কথা ভুলে গেছিল।
এখন যেগুলো এনেছে তার থেকে মাঝারি সাইজের একটা বাক্স সারথির রুমের দিকে গেছে।
সারথি দরজা বন্ধ করে বসেছিল।মিসেস সায়না চকলেট দেয়ার জন্য কয়েকবার করে দরজা ধাক্কিয়েও সারথির সাড়া না পেয়ে চলে এসেছেন।

সজীবের সামনে এক থালা পিঠা রেখে গেছে পূর্ণতা।সজীব তখন দাদার কাছে জানতে চাইলো ও কে।দাদাজান সোজা ভাষায় বলে দিলেন ফারাজের হবু বউ।
সজীব হেসে বললো,’শালাবাবুর জন্য তো ম্যাচিউর মেয়ে দরকার।ভাইয়ের পছন্দ তো সেরকমই জানি,তা এ কেমন?’

‘হুম।এই মেয়েটা বাচ্চার মধ্যে ম্যাচিউর’

সজীব খিলখিল করে হেসে ফেললো দাদাজানের কথা শুনে।
————
সারথি সব হইচই শুনছে রুমে বসে থেকে।তার ইচ্ছে করে!! হয় নিজের জীবনটা এই মূহুর্তে নিয়ে নিতে নাহয় গিয়ে সজীবকে মেরে ফেলতে।রাগে হাত বাড়িয়ে বালিশ ফেলতে গিয়ে দেখলো হাতের কাছে সজীবের ফোন।এটা সজীবের সে জানে কারণ তার ফোন তো ফারাজের রুমে।
ফোনটা আগের জায়গায় রেখে চুপ করে আছে সারথি।সে জানে সজীবের ফোন লক করা থাকে তাই আর এটা নিয়ে গবেষণা করে নাই।
দরজার কড়া নাড়ালেন মানিক সাহেব।গলার স্বরে বোঝা গেলো ফারাজের সাথে সাথে এবার তিনি সারথির উপরও রেগে আছেন।
রেগে রেগে বললেন,’জামাই এত বছর পর এসেছে তার কাছাকাছি না থেকে দরজা বন্ধ করে রেখে কি বুঝাতে চাস সারথি??দুই ভাই- বোন মিলে কি আমার মানসম্মান ডুবাবি??এটা কেমন বেয়াদবি?ছেলেটা কি এসেছে কেবল বাবার সাথে কথা বলার জন্য?তোরা কেউ ওকে সময় দিচ্ছিস না।ওর মা কিছুক্ষণ পর এসে পড়বেন,কি ভাববেন বুঝতে পেরেছিস??তুই তৈরি হয়ে এখন ওর কাছে যাবি।আমি কিছু শুনতে চাইনা’

এই কথা বলে মানিক সাহেব চলে গেছেন।
সারথি বিছানা ছেড়ে চোখ মুছে ধীর পায়ে এসে দরজা খোলে।খুলতেই কিসের যেন আওয়াজ হলো।নিচু হয়ে হাতিয়ে বুঝলো একটা চকলেটের বাক্স।
এই বাড়িতে চকলেট কেনা হয়না।মাঝে মাঝে ফারাজ হাতে করে দুই একটা আনে বাচ্চাদের জন্য।কেনা হয়না কারণ বত্রিশ বার দাঁতের ডাক্তার এসেছে এই বাসায়।তাই দাদাজানের কড়া নিষেধে এই বাড়ি থেকে চকলেট নিষিদ্ধ হয়ে ছিল এতদিন।এখন সজীব এনেছে বলে কেউ কিছু বলবেনা হয়ত।

বাক্সটা যেখানে ছিল ওখানে রেখেই সারথি দেয়ালে হাত রেখে সিঁড়ির দিকে গেলো।সিঁড়ি অবধি এসে নামতে যেতেই নিচ থেকে সজীব বললো,’আসতে হবেনা।আমি আসছি ওখানে’

‘আমি আপনার জন্য আসছিনা।’

‘তাও আসতে হবেনা।সিঁড়িতে পড়ে যেতে পারো’

‘ছোটবেলা থেকে অভ্যাস আছে।’

‘অসুখের সময় অভ্যাস কাজে দেয়না।’

ফারাজ সোফায় বসে সব শুনছে।সারথি যে রাগ দেখাচ্ছে তাতে সে খুশি হলো।সজীবের মতন ছেলের সাথে এমন ব্যবহারই করা উচিত বলে তার মনে হয়।
সজীব মন খারাপ করে পেছনে ফিরতেই ফারাজকে দেখে এক গাল হাসি দিয়ে ওর পাশে বসলো।তারপর বললো,’কি খবর শালাবাবু।শুনলাম তোমার বিয়ে ঠিক?’

‘নাহ’

‘দাদাজান বললো।তা বলো কি খবর?ফোন -টোন তো দাওনা’

‘আপনি দিতেন?’

‘আমি তো ব্যস্ত থাকতাম’

‘আমিও ব্যস্ত ‘

মানিক সাহেব সব শুনে গেলেন রেগে।এক ধমক দিয়ে বললেন,’দুলাভাইয়ের সাথে কেউ এমন করে কথা বলে ফারাজ?এটা কিরকম বেয়াদবি!!সুন্দর করে কথা বলবে!’

‘আঙ্কেল সমস্যা নাই।ফারাজ তো মজা করছে আমার সাথে।আপনি বসুন না এখানে’

সারথি এক সিঁড়ি এক সিঁড়ি করে নিচে নেমে মায়ের কাছে গেছে।সজীব তখন ডাইনিয়ের কাছে এসে এক গ্লাস পানি নিয়ে রান্নাঘরের দিকে তাকালো।সারথি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। নিচে বসে ওর মা আর কাকি মাছ,মাংস কাটছেন।সারথি এখন আর ঠিক আগেরমতন নেই,চোখের নিচে কালো দাগ বসে গেছে,ঠোঁটে সেই রঙটা নেই।কেমন যেন মনে হয় গোলাপির উপর কালচে রঙ পড়ে গেছে।যে রুপ সজীব বিয়ের আগে দেখেছিল সেই রুপ এখন নেই।মনে হয় সব কিছুর উপর একটা ছাপ বসে গেছে। এত কিছুর পরেও সারথিকে দেখতে সজীবের ভালই লাগছিল।সাধারণের মাঝেও তাকে অসাধারণ লাগছিল আজ।নিজের স্ত্রী বলেই কি!!!

মিসেস সায়না সজীবকে দেখে লজ্জা পেয়ে ঘোমটা টেনে বললো,’ভাবী আপনার মেয়েরে বলেন জামাইর কাছে যাইতে।জামাই বেচারা তো দূর থেকে দেখছে উপায় না পেয়ে’

মিসেস সেনালী মুচকি হেসে সজীবের দিকে চেয়ে এবার সারথির আঁচল ধরে টান দিয়ে বললেন সজীবের কাছে যেতে।ওর কি লাগবে না লাগবে সেটা দেখতে।

সারথি যেন শুনলোইনা।যেভাবে ছিল ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।
সোনালী এবার পূর্ণতাকো ইশারা করলেন।পূর্ণতা উঠে সারথির হাত ধরে সজীবের সামনে দিয়ে আসলো।
সজীব মুখে হাসি ফুটিয়ে সারথিকে দেখছিল,সারথি তখন রাগে ক্ষোভে বললো,’আপনার ভাল মানুষীর পেছনে যে রুপ আছে সেটা কবে সবাইকে জানাবেন?’

‘যখন আমি সই করবো তখন সবাই জানবে!’

‘আমাকে ডিভোর্স দিয়ে এত প্রেম কেন দেখাচ্ছেন?সবাইকে বুঝাতে চাইছেন দোষটা আপনার না, দোষটা আমার?আমি নিজের ইচ্ছেতে সব করেছি?’

‘তা নয়।অনেকদিন পর আসলাম তো।বউয়ের প্রতি তাই দরদ উতলিয়ে পড়ছে’

‘আপনার সাথে কথা বলাই আমার ভুল’

এটা বলে সারথি হনহনিয়ে চলে গেলো।দ্রুত হাঁটতে গিয়ে টেবিলরে কোণার সাথে লেগে ব্যাথা পেয়ে থেমে গেছে।সজীব ওর হাঁটুতে হাত রেখে বললো,’আমি না থাকলেও কি এমন কোণায় কোণায় ব্যাথা পাও?নাকি আমি আসাতে নিজের খেয়াল রাখা কমিয়ে দিয়েছো??’

‘আমি কারোর উপর নির্ভরশীল না।হাত সরান।আপনি প্লিজ এই মিথ্যে আদর দেখাবেননা।আমার সহ্য হচ্ছেনা এইসব’

সজীব হাত সরিয়ে নিলো।সারথি চলে গেছে আবার।ফারাজ সব দেখছে তাও চুপ করে আছে।পূর্ণতা সজীবকে দেখলো সারথির পিছু পিছু লুকিয়ে যাচ্ছে যেন সে টের না পায়।এসব দেখে মিটমিট করে হাসছে পূর্ণা।তারপর পেছনে ফিরতেই ফারাজকে অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে কাছে এসে বললো,’দুলাভাইকে ওমন চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছেন কেন?’

‘আপনার কি তাতে?’

‘আচ্ছা আমি বুঝলাম না,আপনি আর সারথি আপু সজীব ভাইয়াকে পছন্দ করেন না কেন?’

‘মানুষকে অপছন্দ করার পেছনে যথাযথ কারণ থাকে।আমাদের সেই কারণ আছে এবং সেটা আপনাকে বলতে চাইতেছিনা’

সেসময় দাদাজান এসে ওদের দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন,’তোমাদের দুজনকে আলাদাই করতে পারিনা আবার বিয়েও দিতে পারিনা।তোমাদের আসলে কি সমস্যা বলতে পারো?’

‘আমি ওরে বলিনি আসতে।ও এসেছে সেধে সেধে কথা বলতে’

ফারাজের কথা শুনে পূর্ণতা একমাত্র দোষী হয়ে গেলো দাদার কাছে।ঢোক গিলে সে দাদার মুখের দিকে চেয়ে আছে।তিনি আঙুল তুলে বললেন,’এতবার মানা করতে পারবোনা।আমার নেহাত মনমানসিকতা ভাল।এরপর যদি মন খারাপের সময় তোমাদের একসাথে দেখি তো দেখিও কি করি।যাও সামনে থেকে।
সারাদিন কাছাকাছি থাকবে,বিয়ের কথা বললেই দুজনে মুখ ফিরিয়ে নিবে।
কি আজব দুটি মানুষ!’

ফারাজ আছে সারথির চিন্তায় এর ভেতরে বয়স্ক দুজন এসে সারাদিন এক কথা বলে।বিয়ে বিয়ে!!পূর্ণতাকে বিয়ে বিয়ে বিয়ে!!
————
সারথি সিঁড়ি শেষ করে উপরে চলে এসেছে।উঠার সময় বারবার মনে হয়েছিল কেউ তার পাশে আছে।
সজীব বিয়ের পরে শুরুতে যেমন ব্যবহার করত এখনও একই ব্যবহার করছে।তফাৎ হলো বিয়ের পরে প্রথমে সারথি জানতোনা সজীব নাটক করছে।আর এখন জানে!!
রুমের কাছে এসে থামলো সারথি।পেছনে ফিরে বললো,’আপনি আর কি চান আমার থেকে?সই তো করে দিলাম।আর কি চাওয়ার থাকে?’

‘তুমি জানলে কি করে আমি এসেছি?’

‘সেটা যদি জানতেন তবে ডিভোর্স পেপার আনতেন না আসার সময়’

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here