#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৪৭,৪৮
#আফনান_লারা
৪৭
________
সারথিকে নিয়ে আনাফ তার বাসায় ফিরে দেখে সোফায় ফারাজ ঘুমাচ্ছে।ভেতরের রুমে পূর্ণতা ঘুমাচ্ছে।এগুলো সে হা করে দেখছিল,সারথি তখন বললো,’কি হয়েছে?নড়ছেন না কেন?ভূত দেখলেন নাকি?’
‘তোমার ভাই আর ভাইয়ের হবু বউ দুুজন দুই জায়গায় ঘুমাচ্ছে।সেটা দেখে অবাক হলাম আর কি ‘
‘মানেহ?ওরা এখানে আসলো কই থেকে?আপনি কি সত্যি বলছেন?’
‘হুম।ফারাজ সোফায়,পূর্ণতা তোমার রুমে,, ঘুমে দুজনেই’
সারথি তাই আনাফকে বললো ফারাজকে ডেকে তুলতে।কিন্তু আনাফ মানা করে তার এই কথায়।কারণ সকালে যারা এমন করে ঘুমায় তারা নিশ্চয় রাতে ঘুুমায়নি।তাই ওদের ঘুমাতে দেয়া উচিত বলে আনাফ সারথিকে ফ্রেশ হতে চলে যেতে বলে সেও গেলো নিজের রুমের দিকে।সারথি ও আর নিজ থেকে ফারাজকে ডাকেনি।
———–
বুয়া নাস্তা টেবিলে সাজিয়ে ঘুমন্ত ফারাজকে দেখে ভাবছিল ডাক দিবে নাকি দিবেনা,সেসময় আনাফ গায়ে তোয়ালে ঝুলিয়ে চেয়ার টান দিয়ে বসতে আসতে বললো,’সারথিকে ডেকে আনো।’
‘ওনাদের ডাকবোনা?’
‘ওদের খাবারটা ঢেকে রেখে দাও।দুজনে ঘুমাচ্ছে,ঘুমাক’
বুয়া মাথা নাড়িয়ে সারথিকে ডাকতে গেলো, সারথি বারান্দায় ছিল।বুয়া গিয়ে ওকে নিয়ে এসেছে।
এখন আনাফ আর সারথি দুজনে কোনো আওয়াজ না করে নাস্তা করে চলেছে।
একটা সময় সারথি বলে উঠলো,’এবার ডাক দেই?’
‘ভাই তোমার নাকি আমার??একটুুও মায়া দরদ নাই?দেখোনা কি সুইট করে ঘুমাচ্ছে সে?’
‘সেটাই তো সমস্যা,এই সাত সকালে এখানে ওরা দুজন কেনো আসলো আর এখনই বা কেন এমন বেঘোর ঘুমোচ্ছে?’
‘কারণ অবশ্যই আছে।তারা উঠুক না, তারপর নাহয় জানা যাবে’
‘আমার গলা দিয়ে খাবার নামছেনা।জানা জরুরি’
আনাফ আরও কিছু বলতে চাইলো কিন্তু তার আগেই ওর ফোনে একটা কল আসে।আননউন বিদেশী নাম্বার।খাবার ছেড়ে ফোন কানে ধরে সে রুমে চলে আসলো।
ওপাশ থেকে শোনা গেলো,’হাই’
আনাফ ও বললো “হাই।”
‘আর ইউ আনাফ?’
‘ইয়েস।হু আর ইউ?’
‘আমি সজীব।’
সজীব নাম শুনে আনাফ বুঝে গেছে পানি ঘোলা হয়ে গেছে। তাই সে চুপ করে থাকলো।সজীব আবার বললো,’বিচ্ছেদের পরে মেয়েদের ভাল সিমপাথি দেখিয়ে,পটিয়ে যে সব ছেলেরা মন জুগায়তে পারে ঐ ছেলেগুলোকে সহজেই মেয়েরা আপন করে ফেলে।তাই না আনাফ?তুমি হয়ত বয়সে আমার বয়সী হবে।তাই তুমি বলছি। সেদিন ও তুমি বলছিলাম।তোমার কি মনে আছে??আমাদের কিন্তু দেখা হয়েছে আগে।’
‘হুম মনে আছে’
‘আমি এতক্ষণ যা যা বললাম শুনেছো নাকি আবার রিপিট করবো?’
‘ফালতু কথা শুনতে সমস্যা হয়না তেমন।আমার কানের পর্দা শক্ত’
‘ফালতু কথা?আমি ফালতু কথা বলেছি?’
‘পঁচা পানিতে ডিপকল বসালে কল দিয়ে পঁচা পানিই বের হয়।তেমনই যে মানুষটা নিজেই ফালতু তার কথাও তো ফালতুই হবে তাই না?’
‘তুমি শুরুতেই বেয়াদবি করছো আনাফ!’
‘তুমি আমার মুরব্বি না যে তোমার সাথে বেয়াদবি করা যাবেনা।সত্যি কথা বলা যদি বেয়াদবি হয় তবে হ্যাঁ,আমি বেয়াদবি করতেছি।এখন কি কারণে কল করেছো?গা জ্বলা শুরু করেছে নাকি?’
‘শাট আপ!তোমার মতন ডাক্তার আর দেখি নাই।মানে মেয়ের কি অভাব পড়েছে??শেষে বিবাহিত?? ‘
‘অবিবাহিত একটা মেয়ের চেয়ে যদি বিবাহিত একটা মেয়ের চরিত্র আমার চোখে অসাধারণ হয় তবে বিবাহিতই শ্রেয়! ‘
‘লজ্জা করেনা তোমার আনাফ?’
‘সেম প্রশ্ন আমিও করতে পারি সজীব।তোমার লজ্জা করেনা?ডিভোর্স তো দিয়ে দিছো।তোমার বউ আর তোমার নাই।তোমার আবার জিএফ ও আছে।এখন আবার তোমার এক্স ওয়াইফকে লাগবে?
কতগুলা লাগবে তোমার সজীব??এত কেন জ্বলছে?একটা মেয়েকে বছরের পর বছর ফালাই রাখছিলা অবহেলা করে।এখন তারে ছেড়ে দিয়ে তার দাম বুঝে নাচানাচি আসতেছে তোমার?নাচো।আমাকে ডিস্টার্ব করবানাা।যমুনা ফিউচার পার্কে যাব বিয়ের মার্কেট করতে,রাখছি’
————
সারথি চায়ের কাপ নিয়ে বসে আছে ফারাজ থেকে একটু দূরে।চা খেতে খেতে জোরে জোরে চায়ের কাপ রাখছিল সে টেবিলের উপর।আওয়াজটা ইচ্ছে করেই করছে কারণ সে চায় ফারাজ ঘুম থেকে উঠুক।জরুরি কথা বলা মানুষটা যদি ইচ্ছে করে দেরি করে,,, কথা বলায় দেরি করে তখন ঐ মানুষটাকে কোনো কিছুর বিনিময়ে পিটাতে ইচ্ছে করে।নিজের ভাই বলে এখন আওয়াজের মাধ্যমে তার স্বাদের ঘুম ভাঙ্গানোর আইডিয়া ছাড়া সারথির কাছে আর কোনো উপায় নাই।
সে সফল হয়েছে।তার খটখট আওয়াজে ফারাজ জেগে গেলো।হাই তুলতে তুলতে উঠে বসে দেখে সামনে সারথি বসে বসে চা পান করছে।
ফারাজ এবার পা নামিয়ে বসে।চোখ বুলিয়ে পূর্ণতাকে একবার খুঁজে নেয়।তার হদিস কোথাও নেই,তার মানে সে এখনও ঘুমে।যাই হোক আপাতত সারথির মুড দেখে বোঝা গেলো সে তাদের হুটহাট এখানে চলে আসা নিয়ে বিভ্রান্তিতে আছে।
‘কেমন আছো সারথি?’
‘ভালো।’
এই বলে সারথি চায়ের কাপটা একেবারে রেখে দেয় টেবিলের উপর।মানে সে শুনার জন্য প্রস্তুত ওদের এখানে আসার কারণ।
ফারাজ বলতে চাইছেনা।মাথা ঝিম ধরে আছে।চা খেয়ে শরীর তাজা করলে হয়ত কথা বের হতো কিন্তু সারথিকে এমন অধৈর্য্য হতে দেখে সে নিজের ঘুমকে বিদায় দিয়ে বলাই ধরছিল তাদের এখানে আসার কারণ ওমনি ভেতর থেকে আনাফ এসে বললো,’একি ফারাজ উঠে পড়লে?তোমার বোন ডাকছে নাকি তোমায়?জানো আমি হাজারবার মানা করেছি।
ভাইয়ের প্রতি বোন যে এত হিংসুক হয় তা তোমাদের দেখে সিওর হলাম।আমাকে নিয়ে অধরা কিন্তু এমন করেনা,তোমার বোন কেন যে এমব করছে!’
সারথি তখন রেগে গিয়ে বললো,’তেমন কাজ করলে তো হবেই।ফারাজকে জিজ্ঞেস করেন সে পূর্ণতাকে নিয়ে হুট করে এখানে কি জন্য আসলো আর এসেই ঘুমিয়ে পড়লো কেন?তারা কি রাতে বাড়ির বাইরে ছিল?’
ফারাজ নিজের মাথা চুলকাচ্ছে।লজ্জায় কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা।আনাফ কিছুটা হলেও আন্দাজ করে নিলো তাই সে ফারাজের পাশে বসে বললো,’যা হয়েছে পরে শোনা যাবে।যাও ফ্রেশ হয়ে আসো,নাস্তা করো।’
‘না।আগে ওকে বলতে হবে।আপনি বারবার কথাটাকে কেন ঘুরাচ্ছেন?’
ফারাজ এবার ধীর স্বরে বললো,’আমি আর পূর্ণতা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছি।আসলে আমরা একসাথে না।আলাদা আলাদাই পালিয়েছিলাম তাও কিভাবে যেন এক বাসে উঠে পড়েছি।এরপর কোথায় যাব ভেবে না পেয়ে এখানে আসলাম’
এটা শুনে সারথি আশ্চর্য হয়ে গেছে।আনাফ মিটমিট করে হাসছে শুধু।
—–
‘তোরা পালাতে গেলি কেন?’
‘বাড়ির সবাই আমাদের দুজনের বিয়ের পেছনে লেগেছিল।পালাতেই হতো’
‘তো এখন যে একসাথে পালালি।জীবনে দাদাজানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবি তোরা দুজন?’
‘জানি পারবোনা তাই তো এখানে এলাম’
সারথি মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।আনাফ আগাগোড়া বুঝলোনা
দুজনে বিয়ের ভয়ে পালিয়েছে এটা ঠিক তবে একসাথে কেন পালিয়েছে?
‘আচ্ছা তোমরা কি একজন আরেকজনকে বিয়ে করার ভয়ে পালিয়েছো?’
‘হুম’
‘তবে একসাথে কেন পালালে গাধা রে!!!”
‘এটা পূর্ণতার ভুল।সে আমার বাসে উঠেছে’
ভেতরের রুম থেকে পূর্ণতা হনহনিয়ে কাছে এসে বললো,’আমার দোষ দিচ্ছেন?বাসে আগে আমি উঠেছিলাম।এরপর আপনি উঠেছিলেন’
‘আচ্ছা তোমরা দুজন থামো।ভুল হয়েছে বুঝেছি।আপাতত দুজনেই সেফ আছো।কিন্তু তোমরা কি এটা ভেবেছো বাড়ি ফিরলে তোমাদের নির্ঘাত বিয়ে পরিয়ে দিবে?’
‘জানি আনাফ ভাইয়া।এবার বুদ্ধি দেন কি করবো?’
আনাফ মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলে ফেললো তাদের দুজনের বিয়ে করা উচিত।কারণ দুজনে বিয়ের ভয়ে পালিয়েও তারা দুজন এখনও একসাথে,তার মানে দাঁড়ায় বিধাতাও চায় তাদের বিয়েটা হোক।আর দেরি না করে বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাওয়া উচিত তাদের।
ফারাজ আর পূর্ণা এই কথা শুনে দুজনেই রেগে গেলো।যেখানেই যাচ্ছে তারা সেখানের মানুষই উপদেশ দেয় বিয়ের।
মানে তাদের দুজন রেখে কি দুনিয়াতে আর কোনো ছেলেমেয়ে নাই?
ফারাজের জন্য কি মেয়ে নাই?
পূর্নার জন্য কি ছেলে নাই?
এই কথার উত্তরে সারথি বললো,’কোটি কোটি আছে।কিন্তু বিয়ে তো একজনের সাথেই হয়।কোটিজনের সাথে হয়না’
———-
জনাব বেলায়েত হোসেন মার্কেটে এসেছেন একটা পাঞ্জাবি কিনবেন বলে।সাথে এসেছে আজিজ, অরিন্দম আর জোরপূর্বক আনা হয়েছে মানিক সাহেবকেও।
বেলায়েত আর আজিজ খান মিলে যেই পাঞ্জাবি সুন্দর বলছেন সেই পাঞ্জাবিটাকে খারাপ বলে সম্বোধন করছেন মানিক সাহেব।
শেষে বিরক্ত হয়ে আর তাকে জিজ্ঞেস করাই বন্ধ করে দিছেন ওনারা।
মানিক সাহেব রাগে ফুলতে ফুলতে দোকানের একটা চেয়ার দখল করে বসে রইলেন।অরিন্দম দুটো কাপ চা নিয়ে ওনার কাছে এসে বললো,’খাবেন দাদা?’
‘আপনি খান’
‘আমি তো এই এক কাপ খাবো,বাকি কাপটা নাহয় আপনি খান’
রাগ থাকার সত্ত্বেও মানিক সাহেব চায়ের কাপটা হাতে নিয়েছেন।চুমুক দিতেই তার রাগ একটু হলেও কমে গলো।
চা ছিল দারুণ।অরিন্দমের উপর সন্তুষ্ট হলেন তিনি এরপর কথায় কথায় বলে উঠলেন,’আমার ছেলে কোটিতে একটা জানো?’
‘জানি,আপনার পরিবারকে আমি চিনবোনা?সেই পরিবারের ছেলে যে কি পরিমাণ ভাল হবে তা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই’
‘আমি মানতে পারিনা তোমার মেয়ে আমার ছেলের বউ হবে। আমার চাহিদা আরও বেশি ছিল!’
‘দাদা একটা কথা বলি?আপনার ফারাজ যেমন কোটিতে একটা মনে করেন আমার মেয়েটিও তেমন।
ওর মাঝে কোনো খারাপ নেই।আমি ওকে সব শিক্ষা দিয়ে বড় করেছি।গুরুজনদের সম্মান করা,ছোটদের স্নেহ করা।কোনো কিছু বাদ রাখিনি। আশা করতে পারি সে আপনার মাথা কখনও নত হতে দিবেনা’
‘আমি আশা করেছিলাম বড়লোক ঘরের মেয়ে হবে,ফকফকা ফর্সা হবে।আমার ছেলে তো ফর্সা।ওর সাথে তো ফর্সাকেই মানাবে’
অরিন্দম দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলে,’দাদা আপনার ছেলে কিন্তু বড়লোক,সাদা দেখে প্রেমে পড়েনি।সে আমার মেয়ের মন দেখেছে’
‘আমার ছেলে যে তোমার মেয়েকে ভালবাসে সেটার কি গ্যারান্টি? সে তো শুরু থেকেই বলছে পূর্ণাকে সে বিয়ে করতে চায়না’
‘তাহলে সে অন্য কাউকে কেন বিয়ে করছেনা?নিজেকে মিথ্যা বাহানা দিয়েন না আর।আপনার ছেলে একজনেই মুগ্ধ হয়ে আছে’
———
পূর্ণতা মুখে রুটি পুরতেই দেখে বুয়া বড় বড় চোখ বের করে ওকে দেখে যাচ্ছে।খাওয়া বাদ দিয়ে সে জানতে চাইলো উনি কিছু বলবেন কিনা।এটা শুনেই তিনি বললেন,’হ্যাঁ বলবো তো।আচ্ছা আপনারা কি জামাই বউ?’
‘না’
‘তবে কি জামাই বউ হইবেন?’
‘সেটাও না’
‘তাহলে এই বাড়িতে দুবার আসলেন।দুইবারই একসাথে।আপনারা কি হোন তাহলে?’
‘আমরা কিছু হইনা’
‘তাহলে একসাথে কি করেন?’
পূর্ণতা মাথায় হাত দিয়ে বুয়ার দিকে চেয়ে আছে।ফারাজ গাপুসগুপুস করে নাস্তা করেই চলেছে।বুয়া যে পূর্ণাকে পেঁচিয়ে ধরেছে সে দিকে সে খেয়ালই করে নাই।
শেষে বুয়ার কথার সাথে পেরে না উঠে পূর্ণতা টেবিলের নিচে পা দিয়ে ফারাজকে একটা খোঁচা দিলো।ফারাজ ওমনি তাকালো বুয়ার দিকে।কারণ বুয়াই সামনে ছিল।
বুয়া দাঁত কেলিয়ে বলে,’ভাই আমার দিকে তাকাইলেন ক্যান?খোঁচাটা আপামণি দিছে’
পূর্ণতার মাথাটা একেবারে হেট হয়ে গেছে।ফারাজ সরাসরি পূর্ণতার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল,বুয়া এবার হাসতে হাসতে চলে গেলেন ওখান থেকে।
‘খোঁচা দিলেন কেন?’
‘আপনি দেখছেন না বুয়া কত প্রশ্ন করছে?’
‘বলে দিন আমরা কেউ কারোর কিছু হইনা’
‘ওটাই তো সমস্যা। কেউ কারোর কিছু হইনা তাও দিনশেষে ঘুরেফিরে আমরা একসাথেই থাকি ‘
চলবে♥
#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৪৮
#আফনান_লারা
________
সোফায় অধরা মাঝে বসে আর দুপাশে ফারাজ পূর্ণতা সহ বসে টিভিতে একটা সিনেমা দেখছে।সিনেমার নাম”বিয়ের ফুল”
অধরা মনযোগ দিয়ে দেখছিল বটে কিন্তু ফারাজ পূর্ণতা একটুও মনযোগ দিতে পারছিল না।দুজনের মাথায় বিয়ের বোঝা চেপে বসে আছে এমন ভাবে যেন বিয়ে শব্দটা দুজনেরই এখন ঘাড় মটকে দেবে।ছবিটা তাদের কাছে বিষের মতন মনে হচ্ছিল কেবল।
অধরা যে মিষ্টিভাবে সব দেখছিল তারা দুজন তার ঠিক উল্টো চাহনিতে দেখছিল।তাদের মন চাইছে টিভির ভেতরে গিয়ে সিনেমার সকলের গলা টিপে ধরতে।সব খানে শুধু বিয়ে আর বিয়ে।
বিয়ে ছাড়া কি দুনিয়ায় আর কিছু নাই?
দুজনেই বিরক্ত এবং দুজনেই একসাথে একে অপরের দিকে একই সময় তাকায়।দুজনে চোখের ইশারাতে একজন আরেকজনের সাথে সিওর হয়ে নিলো যে সিনেমাটি তাদের দুজনের কাছেই অসহ্যকর লাগছে।তাই একসাথেই তারা উঠে চলে যাওয়া ধরলো ওমনি বুয়া হাতে পপকর্ণ এনে টেবিলে রেখে নিচে একটা মোড়া পেতে টিভির সামনে বসে বললো,’আপনারা উঠে চলে যান ক্যান?ছবি দেখবেন না?’
ফারাজ আর পূর্ণতা একসাথে বললো,’বিয়ে নিয়ে বানানো সিনেমা তারা দেখবেনা’
বুয়া জানতে চাইলো কেন দেখবেনা।
এবার দুজনে একসাথে বলে,’কারণ সেটা বিয়ে নিয়ে বানানো ‘
অধরা মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে পপকর্ণের বাটিটা কোলে তুলে বললো,’বাদ দাও,ওনাদের যেতে দাও বুয়া।ভাইয়া বলছে ওনারা বিয়ে করবেন না,বিয়ে নিয়ে কিছু দেখবেন না,শুনবেননা কিন্তু একসাথে প্রস্থান করবে ঠিকই’
এটা বলে বুয়া আর অধরা হাসিতে লুটিয়ে পড়ে।পূর্ণতা, ফারাজের কাছে বিষয়টা দৃষ্টিকটু লাগলো। যার কারণে তারা দুজন বাসার বাইরে চলে গেছে।
এখন আনাফের বাসার বাইরের ছোট্ট বাগানে দুজনে চুপটি করে বসে থাকলো।
ফারাজ আকাশ দেখছে আর পূর্ণতা ঘাস ধরে ধরে দেখছে।ঘাসগুলো মনে হয় কদিন আগেই কাটা হয়েছে।সবগুলোর মাথা নাই।হাত বুলিয়ে পূর্ণতা বললো,’ভাবছি বাবাকে ছাড়াই ভারতে চলে যাবো’
‘কেনো?’
‘বাবা আমার সঙ্গে যেতে রাজি নয়।আর আমি এখানে থাকলে সবাই মিলে আপনার সঙ্গে বিয়ে পরিয়েই দেবে একদিন না একদিন’
‘তো যান।’
‘সেটাই তো সমস্যা! আমার তো পাসপোর্ট নাই!ওটা করতে অনেক সময় লেগে যাবে।ততদিন কি বিয়ের বাইরে থাকতে পারবো?’
‘আমার নাহয় বোন এখানে তাই আমিও এখানে এসে হাজির হয়েছি।আপনি গিয়ে রোকেয়া হলে থাকুন না।আপনাকে একা পেয়ে তো কেউ কিছু করবেনা’
‘আমার যদি গলা টিপে ধরে জানতে চায় আপনি কোথায় আমি তো বলতে বাধ্য হবো। আমি আবার হুমকি-ধামকি ভয় পাই।’
‘এতকিছু ভাবলে তো হবেনা।আমাদের একসাথে থাকা ঠিক না
তাও কেন আমরা একসাথে থাকছি?এখন সবাই মিলে যে হাসাহাসি করছে আমাদের নিয়ে।এটা কি মানা যাচ্ছে?’
‘আমার উপর সব কাজের ভার না দিয়ে নিজেও তো কিছু করতে পারেন।নিজে অন্য একজনকে বিয়ে করে নিলেই পারেন।অন্তত আমাকে বিয়ে করতে হবেনা আপনাকে’
‘তা সঠিক কিন্তু আমি আপাতত কাউকেই বিয়ে করতে চাইছিনা’
‘আপনি নিজেও কিছু করবেন না।আবার আমাকেই সব করতে বলবেনা।এভাবে চললে তো নির্ঘাত কপালে বিয়ে’
———
সারথি আনাফের রুমের বাইরে এসে দরজায় হাত দিয়ে কয়েকবার নক করে জানতে চাইলো সে ভেতরে আসতে পারবে কিনা।
আনাফ সেসময় ভিডিও কলে তার এক রুগীর সাথে কথা বলছিল তাই সে ওকে পাঁচ মিনিট দাঁড়াতে বলে।সারথি তাই দাঁড়িয়ে ছিল পাঁচ মিনিট।
ঠিক পাঁচ মিনিট হতেই আনাফের কথা বলা শেষ হয় এবং সে ল্যাপটপ অফ করে সারথিকে ভেতরে ডাকে।সারথি দেয়াল ধরে ধরে ভেতরে এসে বললো,’আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে’
‘বলে ফেলো’
সারথি বিছানা হাতিয়ে এক কোণায় বসে।তারপর বলে,’ফারাজ আমার অনেক আদরের।জমজ বলেই হয়ত টানটা একটু বেশি ওর প্রতি।ছোট থেকেই আমাকে কেউ না বুঝলেও ফারাজ ঠিকই বুঝতো।এতদিনে বুঝেছি হয়ত পূর্ণতা ওর জন্য একজন ভাল সঙ্গী। কিন্তু আমার বোকা ভাই সেটা বোঝেনি।পূর্ণতা নিজেও বোঝেনি।
আমি চাই ওদের বিয়েটা দিয়ে দিতে।ফারাজ একটা মেয়েকে ভালবাসতো,তার বিয়ে হয়ে গেছে।ভাইটা আমার বাইরে দিয়ে যেমন হাসিখুশি ভেতরে ততটাই ভেঙ্গে আছে।আমি চাই ওর মনটা আবার গড়ুক।পূর্ণতা পারবে ওর মনটা জোড়া লাগিয়ে দিতে।আপনি আমায় সাহায্য করবেন?’
‘পরিবারের অমতে বিয়ে হওয়া ঠিক বলে আমি মনে করিনা’
‘পরিবারের সকলে রাজি শুধু গাধা আর গাধী দুজন রাজি না।আমি চাই আপনি ওদের আমার বাড়িতে নিয়ে যান।ব্যস এইটুকুতে সব কাজ হয়ে যাবে।বাড়ির সকলে মিলেই ওদের বিয়েটা পরিয়ে দিবে।কিন্তু তার জন্য ওদের হাবিজাবি অবধি নিতে হবে।ওরা সজ্ঞানে যাবেনা কোনোদিন’
আনাফ অনেক ভাবলো এরপর আবার বললো,’ওরা দুজনেই ম্যাচিউর।জোরজবরদস্তি করা কি ঠিক হবে?হতে পারে আসলেই তারা একজন আরেকজনের সাথে জীবন কাটাতে প্রস্তুত না’
‘একটা মেয়ে কনে সাজে বসেও ভাবে সে বিয়ে করতে প্রস্তুত না। কিন্তু বিয়ের পরেরদিন থেকে ঠিকই সে সংসার করে।
আমরা আসলে কখনওই প্রস্তুত থাকিনা।যখন প্রস্তুত থাকি তখনই বুঝতে পারিনা তার কথা।ওদের হয়েছে তেমনই একটা অবস্থা।’
——–
ঘাসের উপরে বসে থাকা ফারাজ পূর্ণতাকে দেখে আনাফ সারথিকে বললো,’কি কিউট লাগছে ওদের দুজনকে।কি সুন্দর জোড়া!অথচ তারা নাকি বিয়ে করতে চায়না।তুমি সিওর তো?আমি কিন্তু যাচ্ছি ভেজাল লাগাইতে’
‘আমি সিওর।আপনি গিয়ে আগুনে ঘি ঢেলে দেন’
আনাফ শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বাসার বাইরে চলে আসলো।ফারাজ আর পূর্ণতার কাছে এসে বললো,’কি খবর আপনাদের?ঘাসে বসে ভাইবোন জাতীয় বিতর্ক করছেন নাকি প্রেম সম্বন্ধীয় কিছু? ‘
ফারাজ বললো,’আমরা ওসবে নাই ভাই।আপনি হঠাৎ এখানে??’
‘চকলেট খাইবা তোমরা?’
কথাটা বলে আনাফ পকেট থেকে একটা বক্স বের করে দুজনের দিকে বাড়িয়ে ধরলো।পূর্ণতা বক্সটা নিয়ে উল্টে পাল্টে বললো,’চকলেটের নাম কি?এমন কেন দেখতে?এটা কিসের চকলেট?’
‘দারুণ একটা চকলেট।এটা খেলে দুনিয়ার সব মানুষকে সুইট লাগবে’
‘নেশা জাতীয়?’
‘আরেহহহহ না!কে বলে তোমায় এত সত্যি কথা বলতে! এটা নেশা জাতীয় কেন হবে?এটা খেলে সব কিছু মিষ্টি লাগবে।এটা অনেক মিষ্টি তো তাই।খাও খাও’
আনাফের কথার আগাগোড়া কিছুই বোঝেনি ফারাজ আর পূর্ণতা।তাও চকলেট নিয়ে মুখে পুরে দিয়েছে।আনাফ বিশ্বজয়ের হাসি হেসে গ্যারেজ থেকে গাড়ী আনতে গেলো।ওদের হাবিজাবি বাড়িতে দিয়ে আসার সময় হয়ে গেছে।গাড়ীতে ফারাজ পূর্ণতার সাথে সাথে সারথিকেও এনে বসালো সে।সারথি তখন বললো,’যে ঔষুধটা চকলেট বলে খাওয়ালেন ওটা আসলে কি?’
‘এটা মার্কেটে নতুন এসেছে।স্পেশালি বাচ্চাদের সুঁই ফোটাতে প্যানিক হতে যাতে নাহয় তার জন্য এই চকলেটটা খাইয়ে দীর্ঘ দশ/বিশ মিনিটের জন্য মাথাটা হ্যাং করে রাখার কাজে দেয় এটা।শুধু বাচ্চা না।বয়স্ক যারা সুঁই ভয় পান।একেবারেই প্যানিক হয়ে যান তাদের জন্য এই চকলেট দারুণ কাজ দেয়।অল্প সময়ের জন্য।তার মানে হলো আমায় এখন বিশ মিনিটের মধ্যে হাবিজাবিতে পৌঁছাতে হবে।পাঞ্জাবিটা পরার সুযোগ পেলাম না।আজকেই আমার শালার বিয়ে আর আমি একটু সাজতে পারলাম না’
‘মজা না করে গাড়ী জলদি চালান।যদি বাড়ি পৌঁছাবার আগে ওদের হুশ এসে যায় তাহলে সব পানিতে’
ফারাজ আর পূর্ণতা গাল ফুলিয়ে গাড়ীর পেছনের সিটে বসে একজনের কাঁধে একজন মাথা রেখে বিড়বিড় করছে।মাথার জ্ঞান বুদ্ধি সব যেন স্থগিত হয়ে আছে।তারা কি করছে,কোথায় যাচ্ছে তার কিছুই তারা জানেনা,বুঝতেছেও না।
গাড়ী চলছে……..
ফারাজ পূর্ণার হাতটা মুঠো করে ধরে বললো,’পূর্ণ আমি যে চকলেট খেলাম সেটা তো তুমিও খেলে তাইনা?’
‘আপনি আমায় তুমি বলছেন?’
‘আগে আপনি বলতাম?’
‘হ্যাঁ তো।’
‘যাই হোক শুনো পূর্ণ।তুমি না অনেক সুন্দরী! ‘
‘আমি একটা সত্যি কথা বলি?’
‘বলো’
‘ভুলে একবার আপনাদের বাসার টাংকির পানি খাই ফেলছি।’
এটা শুনে ফারাজ খিলখিল করে হেসে দিলো।সারথি ওর হাসি শুনে বললো,’চকলেটটা কি নেশাজাতীয়?বলদের মতন হাসতেছে কেন?’
‘ছোটরা ঘুমিয়ে পড়ে আর বড়রা বুঝে যায় তারা ঘোরে আছে।ঘোরে থাকলে সত্যি কথা তো বের হবেই’
সারথি কপালে হাত দিয়ে বললো,’এটা শরীরের ক্ষতি করে?’
‘না।অবশ করে,ক্ষতি না।যেহেতু বাচ্চাদের জন্য স্পেশালি বানানো সেহেতু ক্ষতির প্রশ্ন আসেনা।তবে ফারাজ আর পূর্ণতাকে এত ভাল করে ধরেছে কেন বুঝলাম না।আমিও তো আজ একটা খেলাম,আমার তো কিছু হলোনা’
সারথি জিভে কামড় দিয়ে বললো,’চকলেটের বক্সটা পূর্ণতার হাত থেকে নিয়েছিলেন আবার?’
‘আরে হ্যাঁ।আমি তো ভুলেই গেছিলাম ওটা নিতে।হায়হায় মনে হয় পুরো চকলেটের বক্স খালি করে ফেলেছে দুজনে।কত বড় ভুল হয়ে গেলো’
———-
সজীবের মেজাজ বিগড়ে আছে।কোথাকার কোন ছেলে এসে সারথিকে হাত করে নিলো।তাও এমন ব্যবহারের একটা ছেলে!
‘মানে ও নিজেকে কি ভাবে?আমার চাইতে বেশি ইনকাম করে সে?নাকি আমার চেয়ে সুন্দর!’
লেভেন চুপিচুপি এসেছিল সজীবের অফিসে।এসেই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,’কি মিস্টার?কি ভাবছেন?’
‘জানো? সারথি অন্য একজনকে পেয়ে গেছে’
‘তাহলে তো ভালই।তোমার তো খুশি হবার কথা।সে নিজের জীবন টাকে গুছিয়ে নিচ্ছে।’
সজীব মুখ গোমড়া করে বলপয়েন্ট ঘুরাচ্ছে টেবিলের ওপর।জ্বলছে,খুব জ্বলছে।এরকম এ্যাটিটিউডের দোকানের সাথে কিনা সারথি জোড়া লাগালো?
মনে তো হয় সারথির সাথে আর জীবনে কথাও বলতে দিবেনা।’
লেভেন সজীবের যত কাছে আসার চেষ্টা করছে কিন্তু সজীব কিছুতেই সেদিকে মন দিতে পারছেনা।সে কেবল সারথির কথা ভাবছে।
——–
কলিংবেলের আওয়াজ শুনে মতিন গামছা গলায় ঝুলিয়ে গেলো খুলতে।খুলতেই দেখে ফারাজ আর পূর্ণতা দাঁড়িয়ে আছে।দুজনের মুখেই হাসি।
মতিন ওদের দেখে ইয়া বড় হা করে বললো,’খালু,নানা, দাদা সবাই দেখে যান।ফারাজ ভাই আর পূর্ণতা আপা চলে আইছে।সবাই দেখে যান’
এই বলে মতিন ছুট লাগালো।তার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সবাই এক এক করে এসে হাজির হচ্ছে ওখানে।দূরে আনাফ আর সারথি দাঁড়িয়ে ছিল।তারা কাছে আসেনি।আগে দেখে বুঝে নিচ্ছে কি হবে সামনে।
দাদাজান ফারাজ আর পূর্ণতার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।ওরা যে সজ্ঞানে এই বাড়িতে পা রাখার মানুষ না তা তিনি অবশ্যই জানতেন।কিন্তু সমস্যা হলো তবে তারা এখানে এলো কি করে।তার চেয়ে বড় সমস্যা হলো দুজনেই দাঁত কেলাচ্ছে কেন?মদ-টদ খেলো নাকি!
না সেটা খেলে তো গব্ধ আসতো।’
মতিনকে পাঠিয়ে দুই জগ পানি আনালেন তিনি।এরপর দুই জগের পানিই ওদের দুজনের মুখের উপর ছুঁড়ে মারলেন।দুজনেই পানিতে ভিজে একাকার হয়ে নিচে বসে পড়েছে।আনাফ দূর থেকে সব দেখছে।কারণ ঘটনাটা বাগানে হচ্ছে।সে সারথিকে এটা বলায় সারথি বললো,’এবার তো ওদের হুশ ফিরবে’
‘আরে এটা কি মদ নাকি যে পানিতে হুশ ফেরানো যাবে।এটা অবশ জাতীয়।ওদের হুশ আছে কিন্তু প্রয়োগ করার ক্ষমতা নাই।এই তো বিকালের দিকে এসে যাবে হুশ’
দাদাজান ওদের দুজনকে দেখলেন এখনও দাঁত কেলাচ্ছে ওরা।
‘মনে হয় ওদের হুশ নাই।বিয়ে এখন পরানো উচিত ছিল কিন্তু বিনাহুশে তো বিয়ে করানো ঠিক না।তোমরা এক কাজ করো সব তৈরি তে লেগে যাও।ওদের হুশ ফিরলে আমরা বিয়ে পরিয়ে নিব।প্রস্তুতি নাও সবাই’
এই বলে দাদাজান ভেতরে চলে গেছেন।মতিন ও তার পিছু পিছু চললো।আনাফ এবার সারথিকে বাড়িতে ঢুকতে বলে।সারথি আজ আনাফকেও সাথে নিয়েছে।সবার সাথে এবার পরিচয় করাবে ওর’
চলবে♥