ডার্ক সিক্রেট,পর্ব-১

0
2398

ডার্ক সিক্রেট,পর্ব-১
সাইবা চৌধুরী

“মিঃ আনোয়ার আমাকে এমন কিছু দিন যেটায় আমি আমার সবকিছু ভুলে যেতে পারি। আমি কে?কি আমার পরিচয়? আমার অতীত সবকিছু আমি ভুলে যেতে চাই। ”
.
.

চেম্বারে বসে একজন রুগী দেখছিলেন ডাঃ আনোয়ার। হঠাৎ করে অনুমতি ছাড়াই একজন মাস্ক পরিহিত মধ্যবয়সী মহিলা হন্তদন্ত হয়ে চেম্বারে ঢুকেই এমন অদ্ভুত কথা বলতে শুরু করে। পুরো বিষয়টিতে ডাঃ আনোয়ার খুব বিরক্ত হন। কন্ঠে বিরক্তি নিয়ে মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-অনুমতি ছাড়া চেম্বারে রুগী থাকা অবস্থায় ঢুকে পড়া কোন ধরনের সভ্যতা? আপনার একান্ত কোনো প্রয়োজন থাকলে সিরিয়াল মেইনটেইন করুন।
-এভাবে হুট করে এসে আপনাদের বিরক্ত করার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। কিন্তু এ ছাড়া আমার অন্য কোনো উপায় ছিলো না। সিরিয়াল হিসেব করলে আমাকে আরও তিন দিন অপেক্ষা করতে হবে। যেটা আমার জন্য অতোটা সহজ নয়। যত দিন যাচ্ছে আমার বেঁচে থাকা আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। দয়া করে আমাকে এমন কিছু দিন যাতে আমি আমার অতীত বর্তমান সব ভুলে যাই।

-দেখুন আপনার সমস্যা যাই হোক না কেন তার জন্য আলাদা করে সময় দেওয়া আছে। একজন রুগী দেখার সময় তো আপনি কোনো ভাবেই আমাকে বিরক্ত করতে পারেন না।
ডাঃ আনোয়ারের চেম্বারে তখন অল্পবয়সী একটি ছেলে বসে ছিলো। মাঝে মাঝে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে মহিলাটিকে কথাগুলো বলছিলেন ডাঃ আনোয়ার। চেম্বারে বসা অল্পবয়সী ছেলেটি চোখের ইশারায় ডাঃ আনোয়ারকে মহিলার বিষয়টি দেখতে বলে উঠে বাইরে বের হয়ে যায়। ডাঃ আনোয়ার নিজেকে শান্ত করে মধ্যবয়সী মহিলাটিকে চেয়ারে বসতে বললেন।
মহিলাটি তখনও হাঁপাচ্ছিলো। ডাঃ আনোয়ার এক গ্লাস পানি মহিলাটির দিকে এগিয়ে দিতেই ঢক ঢক করে পুরো গ্লাসের পানি নিমিষেই শেষ করে ফেললো।
কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ থেকে ডাঃ আনোয়ার মহিলার উদ্দেশ্যে বলেন,
-এবার বলুন আপনার কি সমস্যা। এমন অদ্ভুত ইচ্ছা কেন আপনার? আজ পর্যন্ত হারানো স্মৃতি ফিরে পেতে চায় এমন মানুষ তো অনেক দেখেছি। আপনি আপনার পরিচয় ভুলতে চান! কিন্তু কেন?
ডাক্তারের কথা শুনে মহিলাটি বলতে শুরু করেন,
-আমি সোফিয়া খান্না। গত ২ বছর ধরে আমি ঠিকভাবে ঘুমাতে পারছি না। আমার পরিচয় জুড়ে, অতীতসহ বর্তমানে এমন কিছু আছে যা আমাকে শান্তিতে থাকতে দেয় না এক মুহূর্তও। আমি ভুলতে চাই সবকিছু মিঃ আনোয়ার। দয়া করে আমাকে সাহায্য করুন। কিন্তু আমার এ অদ্ভুত ইচ্ছার কারণ কোনোভাবেই আপনাকে খুলে বলতে পারবো না। শুধু আপনাকে আমার একটা কথা-ই বলার আছে “আমি বাঁচতে চাই।”
সোফিয়া খান্নার কথা শুনে আবারও খুব বিরক্তবোধ করেন ডাঃ আনোয়ার।
ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলেন,
-আপনি আমার থেকে সাহায্য চান অথচ সমস্যা গুলো আমাকে বলতে পারবেন না! এটা কোন ধরনের মজা করা হচ্ছে আমার সাথে। আপনার সমস্যাগুলো আমাকে খুলে বলুন। সমস্যা না জেনে আমি কিভাবে সঠিক পরামর্শ দেবো?

ডাঃ আনোয়ারের কথা শুনে সোফিয়া খান্না নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলেন। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলেন,
” এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয় মিঃ আনোয়ার ”
আমার কোন সমস্যার সমাধান আপনাকে করতে হবে না। শুধু আপনি আমাকে এমন কিছু দিন যেটা আমার সব স্মৃতি নষ্ট করে দেবে।

-আপনার সমস্যা জানা ব্যতিত আমি কোনোকিছুই করতে পারবো না। আপনি যদি আপনার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, তাহলে দুঃখিত আমার দ্বারা আপনার চিকিৎসা সম্ভব নয়। সুতরাং অযথা সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না আপনি এখন আসতে পারেন।
ডাঃ আনোয়ারের কথায় খুব নিরাশ হন সোফিয়া খান্না। তবে এটা তার কাছে নতুন নয়। এই নিয়ে অর্ধ শতাধিক ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন তিনি। কিন্তু ফলাফল একই। এই মুহূর্তে নিজেকে খুব অসহায় লাগে তার। কিন্তু সে নিরুপায়। নিজের সাথে বয়ে বেড়ানো মস্তবড় সত্যটা কারও সামনে উন্মোচন করা যে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি ডাঃ আনোয়ারের চেম্বার ত্যাগ করেন। শোঁ শোঁ করে নিজের গাড়ি চালিয়ে বাসায় ফিরে আসেন। হাতে থাকা পার্সটি দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে যান তিনি।
রুমের দরজা লক করে সোফিয়া খান্না হাতের কাছে থাকা কাচের ফুলদানি, গ্লাস বই খাতা যা পাচ্ছে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন চারদিকে। এক পর্যায়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পড়েন তিনি।
সবকিছু ভুলতে চান, এমনকি নিজের অস্তিত্বকেও। কিন্তু যেভাবেই হোক নিজেকে জীবিত রাখতে হবে। সময় তার কাছে নিজের মৃত্যু এবং জীবন উভয়টিই অভিশপ্ত করে তুলেছে।
.
.
.
দরজায় ঠক ঠক শব্দ শুনে সোফিয়া খান্না দরজা খুলে দেন। দরজা খুলেই তার বাসায় কর্মরত একজন কর্মচারীকে দেখতে পান।
নক করার কারণ জানতে চাইলে সে বলে,
-বাইরে বেশ কিছুক্ষণ ধরে একটা ছেলে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। কি দরকার জানতে চাইলে ছেলেটি বলছে, যা বলার সে আপনাকেই বলবে। আপনাকে বিশেষ দরকার!
কর্মচারীর কথা শুনে সোফিয়া খান্না ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকায়। মনে মনে চিন্তা করে “এমন অসময়ে আমার সাথে আবার কে দেখা করতে আসবে? ”
চিন্তাকে দীর্ঘ না করে সোফিয়া বলেন, “ছেলেটিকে বসতে বলো আমি আসছি ”
বলেই দরজা লাগিয়ে দেন।
ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে নিচে চলে যান সোফিয়া।
.
.
.
.
প্রায় ১ ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছে সাহাব।
ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে থেকে সোফিয়া খান্নার সব কথা শুনেছে সে। ডাঃ আনোয়ার রেগে গেলেও সোফিয়া খান্নার প্রত্যেকটি কথা খুব অদ্ভুত লেগেছে সাহাবের কাছে। তার কথার মাঝে শুধু ভালোভাবে বাঁচতে চাওয়ার আকুতি ছিলো এমন নয়, ছিলো অনেক অসহায়ত্ব ও চেপে রাখা হাজারও রহস্যের পাহাড়।
এ সম্পর্কে সবকিছু জানার প্রবল ইচ্ছে জাগে সাহাবের। তাই সোফিয়া খান্না চেম্বার থেকে বের হওয়ার পর পরই বাইক নিয়ে তার পিছু নেয় সাহাব। কিছুক্ষণ পরে সোফিয়া খান্নার গাড়ি একটা ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে থামে।
গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে ভেতরে চলে যান তিনি।
সাহাবও বাইক রেখে তার পিছু পিছু বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। বাড়ির ভেতরটা খুব আধুনিক ভাবে সাজানো। তিন চারজন লোককে বাড়িতে বিভিন্ন কাজে কর্মরত অবস্থায় দেখতে পায় সে। সাহাব বুঝতে পারে তারা হয়ত সোফিয়া খান্নার কর্মচারী। সবকিছু দেখে বোঝাই যাচ্ছে সোফিয়া খান্না যথেষ্ট অর্থ-সম্পত্তির মালিক। কিন্তু তার জীবনে লুকায়িত বিষয়গুলো কি যা তিনি বলতে পারছেন না কাউকেই! যেভাবেই হোক সবটা জানতে হবে।
তখন থেকে প্রায় ৪০ মিনিট ধরে সাহাব কর্মচারীদের কাছে নানাভাবে অনুরোধ করছে সোফিয়া খান্নাকে ডেকে দেওয়ার জন্য।
কিন্তু তারা সোফিয়া খান্নার সাথে দেখা করতে দিতে নারাজ। তাদের কথানুসারে “ম্যাডামের কড়া নিষেধ আছে অপরিচিত কাউকে বাসায় এলাও করার ব্যাপারে”
কিন্তু কোনোভাবেই হাল ছাড়ে না সাহাব।
অবশেষে তারা সোফিয়া খান্নাকে ডেকে দিতে রাজি হয়।
.
.
.
সিঁড়ি বেয়ে নেমে সোফিয়া খান্না একটা ২৫-২৬ বয়সী ছেলেকে ডাইনিং রুমে বসে থাকতে দেখে।
মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি ও চোখে সবুজ রঙের একটা চশমা পড়া। মাথা ভর্তি সিল্কি চুল। ছেলেটি তার একদম অপরিচিত।
দ্রুত পা চালিয়ে সাহাবের সামনের সোফায় গিয়ে বসেন তিনি।
“আমাকে দিয়ে তোমার কি দরকার? ”
সাহাবের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেন সোফিয়া খান্না।
নিজের বাসার ভেতরেও সোফিয়া খান্নাকে এভাবে মাস্ক পড়ে থাকতে দেখে সাহাবের খুব অদ্ভুত লাগে। তবে এসব পাত্তা না দিয়ে সে মূল কথায় চলে যায়,
– আমি সাহাব। ডাক্তার আনোয়ারের চেম্বারে আপনাকে দেখেছি। আপনি হয়ত আমাকে লক্ষ্য করেন নি তবে আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আপনার সব কথাই শুনেছি। আপনার কথাগুলো শুনে কেন যেন আমার মনে হচ্ছে আপনি হয়ত খুব বিপদে আছেন অথবা খুব মানসিক চাপে। আমার ধারণা আমি আপনার সমস্যার সমাধান করতে পারবো। তাই আপনার থেকে সবকিছু জানার জন্যই বাসা পর্যন্ত আসা।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে যায় সাহাব।
সাহাবের কথা শুনে প্রচন্ড রেগে যান সোফিয়া খান্না। চিৎকার করে তিনি সাহাবকে বলেন,
-তোমার এতো বড় সাহস তুমি আমাকে ফলো করে আমার বাসা পর্যন্ত চলে এসেছো!
এক্ষুনি আমার বাসা থেকে বের হয়ে যাও। আর হ্যা! আমার বাসার আশেপাশেও যেন তোমাকে না দেখি। যদি এমনটা হয় তার ফলাফল কিন্তু ভালো হবে না। কথাগুলো বলে সোফিয়া খান্না সোফা ছেড়ে উঠে চলে যান।
আকস্মিক সোফিয়া খান্নার এমন আচরণে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় সাহাব। এই বিষয় নিয়ে তিনি এভাবে রিয়্যাক্ট করবেন এটা একদমই তার ধারণার বাইরে ছিলো। ভেতরে ভেতরে অপমানবোধ করলেও তার বিষয়ে সবকিছু জানার ইচ্ছাটা যেন দ্বিগুন হয়ে গেল। তখনের মতো কোনো কথা না বাড়িয়ে সে বের হয়ে যায়।
.
.
.
পাঁচদিন ধরে ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে সাহাবকে তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছেন সোফিয়া খান্না। প্রথম প্রথম বিরক্ত হলেও এখন বিষয়টা খুব সিরিয়াসভাবে নিলেন তিনি।
সিদ্ধান্ত নিলেন সাহাবের সাথে কথা বলার। তাই নিজ থেকেই বাসা থেকে বের হন, সাহাবের সাথে কথা বলার উদ্দেশ্যে। হঠাৎ সোফিয়া খান্না কে এগিয়ে আসতে দেখে সাহাব মনে মনে খুব খুশি হয় সাথে অন্যরকম একটা ভয় ও কাজ করে।
সাহাবের কাছাকাছি গিয়ে সোফিয়া খান্না সাহাবের উদ্দেশ্যে বলেন,
– আমার সাথে আসো।
সোফিয়া খান্নার কথা অনুযায়ী সাহাব তাকে অনুসরণ করে।
সোফিয়া নিজের গাড়ি বের করেন। সাহাবকে বলেন তার গাড়িতে উঠে বসতে।
সাহাব গাড়িতে বসার পরে, ধীরগতিতে গাড়িটি চালিয়ে নেন সোফিয়া । কিছুক্ষণ পরে তারা গিয়ে পৌঁছায় একটি ক্যাফের সামনে।
সোফিয়া খান্না গাড়ি থেকে নেমে ক্যাফের ভিতরে চলে যান। তার পিছু পিছু এগিয়ে যায় সাহাব ও।
সোফিয়া খান্না ক্যাফের একদম শেষ প্রান্তে গিয়ে বসেন, তার মুখোমুখি চেয়ারটাতেই সাহাবকে বসতে বলেন।
দু’জনেই নিরব হয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকে।
নিরবতা ভেঙে সোফিয়া খান্না বলে ওঠেন,
-তুমি সবটা জানতে চাও তাই না! তবে সবকিছুর ভার কিন্তু অনেক।
তুমি বইতে পারতে তো?
সোফিয়া খান্নার কথা শুনে তার মুখের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে সাহাব।
সাহাবকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সোফিয়া নিজের মাস্কটি খুলে পাশে রেখে বলেন,
-কি হলো? উত্তর দিলেনা? সবকিছুর ভার বইতে পারবে তো?
মাস্ক খুলে কথা বলার সময় সোফিয়া খান্নার দিকে তাকিয়ে সাহাব দেখতে পায় সোফিয়া খান্নার জিহ্বা তুলনামূলকভাবে বড় এবং কালো কুচকুচে।
যেটা কথা বলার সময় মাঝে মাঝেই বের হয়ে আসে।
এমন অবস্থা দেখে চমকে ওঠে সাহাব।
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here