ডার্ক সিক্রেট,পর্ব-২

0
1540

ডার্ক সিক্রেট,পর্ব-২
Saaiba Chowdhury

মাস্ক খুলে কথা বলার সময় সোফিয়া খান্নার দিকে তাকিয়ে সাহাব দেখতে পায় সোফিয়া খান্নার জিহ্বা তুলনামূলক বড় এবং কালো কুচকুচে।
যেটা কথা বলার সময় বার বার বের হয়ে আসছে।
এমন অবস্থা দেখে সাহাব চমকে ওঠে।
তবুও কোনো প্রশ্ন না করে চুপচাপ তার কথার হ্যা-সূচক জবাব দেয়।
সোফিয়া খান্না বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করে,
-আমার বয়স তখন ১৪ বছর। সবেমাত্র ক্লাস নাইনে পড়ি।
মা বাবা ও আমি। এই তিনজন মিলে সুখের একটা সংসার ছিলো। বাবা ও আমার চাচা পার্টনারশিপে বড় বড় কয়েকটি ফ্যাক্টরির মালিক ছিলেন।
দু-ভাইয়ের মাঝে সম্পর্কটা ছিলো দুই দেহে এক প্রাণের মতো।
কোনোকিছুরই অভাব ছিলো না সংসারে। তবে একদিন আসে ভয়াবহ ঝড়। শেয়ার নিয়ে বাবা ও আমার চাচার মাঝে অনেক কথা কাটাকাটি হয়।
সেদিন চাচা ভিষণ রাগ ও কষ্ট চেপে আমাদের বাসা থেকে চলে যান। হঠাৎ শেয়ার নিয়ে ঝামেলা বাঁধায় বাবার ব্যবসায় ও অনেক ক্ষতি হয়।
তার কিছুদিন পর স্কুল থেকে ফিরে আমি সম্মুখীন হই সবচেয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতির।
বাসায় ফিরে আমাদের বাসার সামনে অনেক মানুষের ভীড় ও কান্নাকাটির শব্দ শুনে বুকটা ধুক করে কেঁপে ওঠে।
ভীড় ঠেলে বাসার ভেতরে ঢুকে আমি যা দেখি তাতে আমার পুরো পৃথিবী থমকে যায়।
আমাদের বাসার মেঝেতেই সাদা কাপড়ে ঢাকা পড়ে আছে আমার মা বাবার মৃতদেহ।
শোকে চোখ থেকে আমার এক ফোঁটা পানিও পড়ে না। একভাবেই ঠায় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেদিন।
আমাকে দেখে বাবার পাশ থেকে কান্নারত অবস্থায় চাচা উঠে এসে আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলো,
-আজ থেকে তুই আমার সব। তোকে কখনোই মা বাবার কষ্ট বুঝতে দেবো না।
.
চাচার কথায় আমি কতোটা আস্বস্ত হলাম জানিনা তবে মনে একটা প্রশ্ন থেকেই গেলো,
“সবাই বলছে মা বাবা না-কি আত্মহত্যা করেছে, কিন্তু কেন? সকালেও সবকিছু ঠিক ছিলো এরমধ্যে এমন কি হলো যার জন্য দু’জন সচেতন মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিলো?”

বাবা মারা যাওয়ার পর সব সম্পত্তি ও ফ্যাক্টরির একমাত্র মালিক হয়ে যান আমার চাচা। আমিও তাদের সংসারে বেড়ে উঠতে থাকি। কিন্তু আমি বোধহয় চাচীর কাছে বড় একটা বোঝা স্বরুপ ছিলাম।
উঠতে বসতে খোঁটা শুনতে হতো আমার।
কাজের বুয়া থাকা সত্যেও বেশিরভাগ কাজ আমাকে দিয়েই করাতো।
আমার চাচার মাঝেও কিছুদিনের ভিতরেই অনেক পরিবর্তন আসে।
তার সামনে আমাকে চাচী নানা বিষয় নিয়ে মারধর করতো, মা বাবা তুলে কথা শুনাতো তবুও তিনি কোনো প্রতিবাদ করতেন না।
শুরুতে সবকিছু মেনে নিতে কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে সবটা নিয়তি বলে মাথা পেতে নিয়েছিলাম।
এভাবে কেটে যায় আরও দুমাস।
একদিন দেখতে পাই চাচী ব্যাগপত্র ও ৫ বছরের চাচাত ভাইকে নিয়ে বাবার বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়েছে।
যাওয়ার সময় আমাকে ভালোভাবে বলে যায়,
দুই দিনের জন্য একটু বেড়াতে যাচ্ছি সব কাজ ঠিকমতো করে রাখিস।
কাজের চাপের জন্য তোর চাচাকে নিচ্ছি না তার সবকিছুর দিকে খেয়াল রাখবি।
আর হ্যা! আমরা চলে যাচ্ছি কাজও কম তাই বুয়াকে দুইদিনের জন্য ছুটি দিয়েছি।
কাজে হেয়ালিপনা কিন্তু আমার পছন্দ না সেটা তো জানিস ই।
চাচীর কথার আমি কোনো উত্তর দেই না।
সেদিন টুকটাক কাজের ভেতরে একাকী সময়টা ভালোই কাটে আমার।
কিন্তু পরেরদিন রাতে ঘটে আমার জীবনে সবচেয়ে বড় সর্বনাশ।
রাত ১২ টার দিকে বাসায় নেশাগ্রস্থ অবস্থায় ফেরে আমার চাচা।
ঠকঠক শব্দ শুনে দরজা খুলে দিতেই আমার চাচা আমার উপর ঢলে পরে। চাচার গা থেকে ড্রিংকসের তীব্র গন্ধে আমার গা গুলিয়ে ওঠে।
অনিচ্ছা সত্যেও দরজা লাগিয়ে চাচাকে তার বেডরুমে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেই।
চাচাকে শুইয়ে দিয়ে বের হওয়ার সময় পশুটা আমার হাত টেনে ধরে। ভয়ের একটা শিহরণ পুরো শরীরে বয়ে যায়।
পশুটা মাতাল অবস্থায় আমাকে নিয়ে খুব বাজে কথা বলতে থাকে। হাত ধরে টেনে বিছানায় ফেলে আমার দেহের বিভিন্ন অঙ্গ নিয়ে অকথ্য ভাষায় মন্তব্য করতে শুরু করে।
আমি জানোয়ারটার থাবা থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য আমার সবটা দিয়ে চেষ্টা করি।
সব শক্তি দিয়ে চিৎকার করি।
চিৎকার করার কারণে ও আমাকে জোড়ে একটা থাপ্পড় দেয়।
থাপ্পড়ের জোড় এতোটা বেশি ছিলো যে আমি সাথে সাথে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
.
.
.
.
এরপরে চোখে আলো পড়তে আমার জ্ঞান ফিরে আসে।
চোখ মেলে নিজেকে আমি আমার রুমেই দেখতে পাই।
শোয়া থেকে উঠে বসতে গিয়ে তলপেটে প্রচুর ব্যাথা অনুভব করি। ধীরে ধীরে আমার কাল রাতের সব কথা মনে পড়ে। কাল রাতে আমি জ্ঞান হারানোর পরে আসলে কি হয়েছিল সেটা বুঝতে আর আমার বাকি রইলো না।
আমি চিৎকার করে কাঁদতে থাকি।
আমার কান্না শুনে চাচা নামক পশুটা আমার রুমে দৌড়ে আসে। এসেই আমার চুল মুঠো করে ধরে ধরে বলে,
কাল রাতের কথা যদি কাউকে জানাই তাহলে আমাকে চিরতরে শেষ করে দেবে।
ভয়ে পেয়ে আমিও এটা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করি না। তবে ভেতরে ভেতরে প্রবল ঘৃণায় পুড়তে থাকি সারাক্ষণ।
নিজেকে সেদিন খুব নিঃস্ব মনে হচ্ছিল।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অসহায় মানুষ মনে হচ্ছিলো নিজেকে।
.
.
এর পরে কেটে যায় আরও ২ মাস।
এরমাঝে আমার পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায়।
মাঝে মাঝে বমি ও হয়। মাথা ব্যাথা, বমি ও শারীরিক অস্বস্তি নিয়ে বাসার সব কাজ করতে হতো আমার।
শারীরিক অনেক পরিবর্তন হওয়া শুরু হয় আমার মাঝে। আমি বুঝতে পারি আমার জীবনে আরও খারাপ একটা অধ্যায়ের শুরু হতে চলেছে।
.
.
এরপর কেটে যায় আরও ৪ মাস।
আমার ভেতরে একটা প্রাণ বড় হতে থাকে। তার সাথে শুরু হয় সমাজের ধিক্কার।
চাচীর থেকে মার খাওয়া, নষ্ট মেয়ে, পতিতা এসব কিছু শোনা আমার নিত্যদিনের রুটিন হয়ে গেছিলো।
চাচি আশেপাশের আন্টিদের কাছে আমার নামে খারাপ খারাপ কথা বলে বেড়াতো।
দল বেঁধে মাঝে মাঝেই মহিলারা আসতো আমাকে দেখতে, আসতো আমার কাটা ঘাঁয়ে নুনের ছিটা দিতে।
যেভাবেই হোক দিনগুলো কোন রকমে চলেই যাচ্ছিলো
এরপর আমার ডেলিভারির সময় চলে আসে।
ডেলিভারির দিন সকাল থেকে সীমাহীন ব্যাথায় আমি পাগলের মতো হয়ে গেছিলাম।
আমার পাশে তখন কেউ ছিলো না।
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে যায়।
আমার অবস্থা বেগতিক দেখে চাচী একজন বয়স্ক মহিলাকে ডেকে আনেন।
কিছুক্ষণ পরে একটা পাপের ফল পৃথিবীতে আসে।
এসময়ে প্রতিটা মায়ের অনেক খুশি হওয়ার কথা ঠিকই কিন্তু আমি হতে পারছিলাম না একটুও।
বাচ্চাটাকে দেখলেই আমার শরীর তেলে বেগুনে জ্বলে উঠতো।
তার দু’দিন পরে চাচা নামক জানোয়ারটা আমার রুমে আসে। বেডের উপর অনেকগুলো টাকা রেখে আমার টুটি চেপে ধরে বলে,
-বাচ্চাটিকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যা।
এখানে যে পরিমাণ টাকা আছে তাতে তুই আর তোর বাচ্চা অনেকদিন আরামসে কাটিয়ে দিতে পারবি।
কিন্তু যদি কখনও আমার পথের কাটা হয়ে দাঁড়াতে চাস তাহলে তোর বাবা মার মতো তোকে সরিয়ে দিতেও আমার একটুও হাত কাঁপবে না।
কথাগুলো বলে শয়তানটা রুম থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু আমি পাথরের মতো স্থির হয়ে যাই।
এতোদিনে বাবা মার মৃত্যুর আসল রহস্য আমি বুঝতে পারি।
তার প্রতি ঘৃণা এবার মাথার চূড়ায় উঠে যায়।
প্রবল ঘৃণায় আমি আমার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
হাতের পাশে থাকা কাঁচের জগ দিয়ে দু’দিনের বাচ্চাটার মাথায় আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত করতে থাকি।
জগটা ভেঙে কাচ গুলো কচি মাথাটার ভেতর ঢুকে যায়। একটু শব্দ করে নিষ্পাপ বাচ্চাটা চিরতরে শান্ত হয়ে যায়।
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি, ভালো মানুষের মুখোশ পড়া জানোয়ারটাকেও আমি ভয়াবহ শাস্তি দেবো, খুব ভয়াবহ।

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন সোফিয়া খান্না। কিছু সময়ের জন্য পুরোপুরি অন্ধকার অতীতে চলে গিয়েছিলেন তিনি।
কান্নার এক পর্যায়ে তিনি সাহাবের দিকে তাকিয়ে দেখেন, সাহাব পলকহীন ভাবে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।
সাহাবের নামধরে দুই তিনবার ডাক দিতেই সাহাব কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে বলে,
-জ্বী বলুন তারপর!
সাহাবের কথাশুনে সোফিয়া খান্না বুঝতে পারেন,
এতক্ষণ যা যা তিনি বলেছেন তার কিছুরই সে মন দিয়ে শোনে নি।
কিছুটা বিরক্তির সাথে মুখে মাস্ক পড়ে “আজ আসি” বলে তিনি উঠে দাঁড়ান।
সোফিয়া খান্নাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে সাহাব বলে,
-প্লিজ ম্যাম আপনি যাবেন না।
আপনার থেকে অনেক কিছু জানার আছে আমার।
“যেদিন তুমি পুরোপুরি বিশ্বস্ততা অর্জন করতে পারবে সেদিন সব কিছু জেনে নিও।” কথাটা বলে সোফিয়া খান্না ক্যাফে থেকে বের হয়ে যান।
তার চলে যাওয়ার দিকে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সাহাব
.
.
.
গাড়ি ড্রাইভ করার সময় অচেনা একটা নাম্বার থেকে কল আসে সোফিয়া খান্নার ফোনে।
ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে,
-মিস সোফিয়া খান্না!
আমি ডাঃ আনোয়ার বলছি। আপনার সাথে আমার দরকারী কিছু কথা আছে।
ডাঃ আনোয়ারের ফোনকল পেয়ে সোফিয়া খান্না বেশ অবাক হয়ে বলেন,
“হঠাৎ আপনি আমাকে কল করলেন যে!
কি এমন বিশেষ কথা বলুন।”
প্রতিউত্তরে ডাঃ আনোয়ার বলেন,
আপনি যেদিন আমার চেম্বারে এসেছিলেন, সেদিন একটা ছেলে ছিলো ভেতরে, নাম সাহাব।
আপনি তাকে দেখলে চিনবেন কিনা জানিনা, তবে যদি এই নামে কেউ আপনার সাথে পরিচিত হতে চায় আপনি তার থেকে দূরে থাকবেন।
এমনকি সে হাজার বললেও আপনি আপনার জীবনের কোনো সিক্রেট তার কাছে প্রকাশ করবেন না। আপনার ভালোর জন্য বলছি।
দয়া করে কেন বলছি সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না।
আমি একজন ডাঃ হয়ে একজন পেসেন্টের সিক্রেট উন্মোচন করতে পারব না।
ডাঃ আনোয়ারের কথা শুনে সোফিয়া খান্না বিরাট এক দ্বিধায় পড়ে যান।
মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে,
সাহাবের আবার কি এমন সিক্রেট আছে!
যা হতে পারে আমার জন্য বিপদজনক?
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here