ডাহুক_নদীর_তীরে,পর্ব-১৮,১৯

0
255

#ডাহুক_নদীর_তীরে,পর্ব-১৮,১৯
#হালিমা রহমান
১৮

প্রাণের বন্ধু সাজ্জাদ, তার ছেলের জন্য জিনিয়াকে পছন্দ করেছে বলে তৌকির সাহেব খুব খুশি হলেন।ইরফানকে অনেক আগ থেকেই পছন্দ তার।ছেলেটা নম্র-ভদ্র,সুন্দর,কর্মঠ।পছন্দ না হওয়ার তো কোনো কারণ নেই।তৌকির সাহেবের রাজকন্যাকে সে ঠিক ভালো রাখবে।তিনি অনেক আগেই ইরফান ও জিনিয়ার বিয়ের কথা সাজ্জাদ সাহেবের কানে দিতে চেয়েছিলেন।তবে মেয়ের বাবা বলে কথা।খুব ইচ্ছা থাকলেও বলতে পারেননি।তার মেয়ে তো সস্তা নয়।সাজ্জাদও খুব ভালো করেই জিনিয়াকে চিনে। ছেলের জন্য উপযুক্ত মনে করলে নিজেই বিয়ের কথা তুলবে।
একটু আগে সাজ্জাদ সাহেব তার বাড়িতে পা রেখেছেন।একা আসেননি অবশ্য।ইরফান ও মেয়ের জামাই শফিককেও বদলদাবা করে নিয়ে এসেছেন।উদ্দেশ্য মেয়ে দেখা। বিয়ের আগে একটু আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়ে দেখতে চান তিনি। তৌকির সাহেব মেহমানদারি করতে করতে খুব অস্থির হয়ে পড়লেন।তার মুখের হাসিই বলে দিচ্ছে তিনি কতটা খুশি।ধবধবে সাদা টুপিটাকে মাথায় চড়িয়ে একবার এদিক তো আবার ওদিকে নজর দিচ্ছেন।ঘরের ভিতর যেয়ে স্ত্রীকেও কয়েকবার হুশিয়ার করে দিয়েছেন।নাস্তা যেন ভালো হয়।মেয়ের ঘরে যেয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছেনঃ” আমার সম্মানটা রাখিস মা।”

সাদা পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে মাথাটাকে নিচের দিকে দিয়ে ভদ্র ছেলে সেজে বসে আছে ইরফান।বাবার সাথে মেয়ে দেখতে এসেছে সে।কিভাবে এসেছে তা জানা নেই।ইরফানের খুব মাথা ব্যাথা করছে।কিছুদিন আগে প্রতিজ্ঞা করেছিল তথাকে আর মনে করবে না,ফোন দেবে না।কিন্তু প্রতিজ্ঞা রাখতে পারেনি ইরফান।এখানে আসার আগে কয়েকবার ফোন দিয়েছে তথার ফোনে।ইচ্ছে ছিল তথাকে আরো একবার প্রেম নিবেদন করবে।আরো একবার নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করবে।হতে পারে ইরফানের অনুভূতি তথাকেও ছুঁয়ে দেবে।মেয়েটা প্রেমে পড়বে ইরফানের।মেনে নেবে ইরফানের প্রথম প্রেমকে।যেভাবেই হোক রাজি করাবে বাবাকে।তারপর দুজনে বিয়ে করবে,প্রেম করবে,স্বপ্নময় কিছু মুহূর্ত কাটাবে,তারপর,তারপর….

এসব কিছুই হতে পারতো। কিন্তু হলো না।ইরফানের স্বপ্নরাজ্য আবারো ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেল।একটু আগেও তথার ফোনে কল দিয়েছিল।কিন্তু এবারেও ফোন বন্ধ বলছে।যতবার কল দিলো ততবার ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। আশ্চর্য! ওখানে কি নেট নেই? নাকি তথার ফোনে চার্জ নেই?খুব কাজের চাপ বুঝি?ফোন চার্জে দেওয়ারও সময় পায় না।অনলাইনেও দেখা যায় না।কাল রাতে ম্যাসেঞ্জারে ম্যাসেজ দিয়েছিল ইরফান।তারপর কতোক্ষণ অপেক্ষা করলো। এই বুঝি তথা অনলাইনে আসে।এই বুঝি ম্যাসেজ সিন করে রিপ্লাই দেয়।কিন্তু তথা আসলো না। ইরফানের প্রতীক্ষাই বৃথা গেল।বেশ রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে ফোন-টোন ছুড়ে ফেলে আবারো নতুন করে প্রতিজ্ঞা করলো ইরফান।তথাকে আর কখনো মনে করবে না,ফোন দেবে না, ম্যাসেজ করবে না।তথার সাথে আড়ি, আড়ি,আড়ি।অভিমানে চোখ-মুখ বুজে শুয়ে ছিল ছেলেটা।কিন্তু সকাল হতেই সব ভুলে গেল ইরফান।এবারেও প্রতীজ্ঞা টিকলো না।এখানে আসার আগে আবারো ফোন দিলো মেয়েটাকে।ইরফান ভীষণ নির্লজ্জ, বেহায়া।নাহয় এতোকিছুর পরেও কোনো মেয়ের পিছনে পড়ে থাকে?একবার,দুবার করে বেশ কয়েকবার দেওয়ার পরেও যখন যান্ত্রিক আওয়াজটা ফোন বন্ধ বলল,তখন আবারো আশা ছেড়ে দিল ইরফান।না,এই জীবনে তথা আর ভাগ্যে নেই।

_” আসসালামু আলাইকুম ভাই,ভালো আছেন?”

ইরফানের পাশে ধুপ করে বসে পড়লো একটা ছেলে।ছেলেটাকে চিনে না ইরফান। এই বাড়ির কেউ হবে বোধহয়। কথা বলার ইচ্ছা না থাকলেও ভদ্রতার খাতিরে কথা বলতে হয় ইরফানকে।মুখে শুকনো হাসি ঝুলিয়ে বলেঃ” আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?”

_” এই তো ভাই, আছি একরকম।আপনিই বুঝি ছেলে?”

কেমন খাপছাড়া প্রশ্ন! বিব্রত হয় ইরফান।মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলতেই ফিচেল হাসে ছেলেটা।নিচু গলায় বলেঃ” মেয়ে দেখেছেন নাকি কখনো? আপনার সাথে কখনোই মানাবে না মেয়েটাকে।আপনি তো শুকনা-শাকনা।কিন্তু মেয়েটা একটু ভারী স্বাস্থ্যের। আপনার সাথে দাঁড়ালে পুরো বড়বোন আর ছোটভাইয়ের মতো লাগবে।”

হতভম্ব ইরফানকে রেখেই উঠে দাঁড়ায় অসভ্য ছেলেটা।গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে একটা আঙুর মুখে দিয়ে সামনে হাঁটা দেয়।তা চোখে পড়ে তৌকির সাহেবের।তিনি হাঁক দিয়ে বলেনঃ” কোথায় যাচ্ছ,আশিক? ”

_” রান্নাঘরে মামির কাছে যাচ্ছি।জিনিয়াকে নিয়ে আসতে হবে না?কতক্ষণ আর মেহমান বসে থাকবে।”

_” ঠিক আছে যাও।”

কিছুক্ষণ পর চিন্তিত মুখে ঘরে ঢুকে শফিক।গুরুত্বপূর্ণ একটা কল আসায় বাইরে গিয়েছিল সে।ইরফানের পাশে যেয়ে বসতেই নিচু গলায় প্রশ্ন করে ইরফান।

_” শাফিনের কোনো খবর পেলেন, দুলাভাই?”

_” না রে,ভাই।কি একটা অবস্থা বলো তো! আজ তিনদিন যাবৎ কোনো খবর পাচ্ছি না।না ভাইটার, না বোনটার।”

_” এতো ঝুঁকির কাজ করে কেন?গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি না করলেই পারতো।”

আরেকবার শাফিনের ফোনে কল দেয় শফিক।হতাশ গলায় বলেঃ” ওকে কি আর কম বুঝালাম?শাফিনটা খুব গোঁয়ার। যা ইচ্ছে হবে তাই করবে।সাথে জুটেছে আমার চাচাতো বোনটা।দুটো পাগল একেবারে।”

_” ওই যে শাফিনের বয়সী মেয়েটা, সোনালী না নাম?”

_” হুম।তুমি ওকে দেখেছো নাকি?”

_” না।আপার কাছে ওর কথা শুনেছি।”

_” ওহ।দুটোর একটার সাথেও যোগাযোগ করতে পারছি না।বাড়িতে মা কাঁদে,বাবা চিন্তা করে।কি যে করি।”

_” থাক চিন্তা করবেন না ভাই।এরকম মিশনে তো আরো গেছে।কাজ শেষ হলে নিশ্চয়ই ফিরে আসবে।দরকার ভেবেই হয়তো ফোন বন্ধ রেখেছে।”

কলাপাতা রঙের একটা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে,কপালের সীমানা অবধি আঁচল টেনে, চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে ধীরপায়ে ঘরে ঢুকলো জিনিয়া।নিচু গলায় সালাম দিল সবাইকে।সাজ্জাদ সাহেব, তৌকির সাহেব ও শফিক সোজা হয়ে বসলেও ইরফান আগের মতোই মাথা নিচু করে রাখে।কিছু ভাল লাগছে না তার।এতো আয়োজন,এতো আড়ম্বর–সব যেন কাঁটার মতো ফুটছে গায়ে।

_” এখানে বসো, জিনিয়া মা।ভালো আছো তো?”

ইরফানের বিপরীতে যেয়ে বসে জিনিয়া। নিচু গলায় উত্তর দেয়ঃ” জ্বি, আঙ্কেল। আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।”

_” চাকরি-বাকরির কি খবর? সব চলছে ঠিকঠাক?”

_” জ্বি।”

তৌকির সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেনঃ” সবাইকে চা এগিয়ে দাও ,মা।”

ধীরহাতে চায়ের কাপ সাজ্জাদ সাহেবের হাতে তুলে দেয় জিনিয়া।শফিককেও দেয়।তবে বিপত্তি বাধে ইরফানকে দেওয়ার সময়।মেয়েটা বোধহয় খুব বিব্রত বোধ করছিল।ইরফানের সামনে যাওয়ার সময় তার পা কাঁপলো,হাত কাঁপলো।ফলস্বরূপ কাপের আগুন গরম চা ছলকে পড়লো ইরফানের পায়ের উপর। এরকম এক দূর্ঘটনায় আঁতকে উঠে জিনিয়া।তড়িঘড়ি করে বলেঃ” সরি,সরি আমি ইচ্ছে করে করিনি।”

_” সমস্যা নেই।আমি ঠিক আছি।”

মেয়ের প্রতি খানিক বিরক্ত হন তৌকির সাহেব।বিরক্ত ভঙ্গিতে বলেনঃ” কি করলে এটা, জিনিয়া?”

_” আহ,চুপ কর তৌকির।ও কি আর ইচ্ছে করে করেছে? ইরফান, যাও পানি দিয়ে আসো পায়ে।বেশি লাগেনি তো?”

_” না,বাবা।আমাকে ওয়াসরুমটা একটু দেখিয়ে দিলে ভালো হতো।”

_” আমার সাথে আসুন।”

ইরফানকে সাথে নিয়ে ড্রয়িং রুম ছাড়ে জিনিয়া।আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়।দোতলার শুরুর ঘরটাই তার।নিজের রুমে যাওয়ার সাথে সাথে যেন শক্তি ও সাহস বেড়ে যায় মেয়েটার।মাথা থেকে আঁচল ফেলে ফ্যান ছেড়ে দেয়।কাঠের দরজায় ছিটকিনি তুলে দিয়ে ইরফানের দিকে এক টুকরো হাসি ছুঁড়ে দেয়।মিহি গলায় বলেঃ” আজ খুব গরম পড়েছে,তাই না ইরফান সাদিক?”

কিসের পানি আর কিসের কি?পুরো ভ্যাবলার মতো চেয়ে থাকে ইরফান।এটাই কি কিছুক্ষণ আগের সেই ভদ্র জিনিয়া?হতভম্ব গলায় বলেঃ” দরজা লাগিয়ে দিলেন কেন? দরজা খুলুন। আমি বাইরে যাব।”

দরজা খুলে না জিনিয়া।উল্টো দরজার সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। ইরফানের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে বলেঃ” এখন যাওয়া যাবে না।আপনাকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলব।মন দিয়ে শুনবেন,ঠিকাছে?”

***

জমিদার বাড়িতে শুটিং চলছে ঢিমেতালে।ডিরেক্টরের ইচ্ছে থাকলে সবাই কাজ করছে আর ইচ্ছে না থাকলে করছে না।এর মাঝে তথার ডায়রিয়া হওয়ার কারণে ঢিমেতালের শুটিংটাও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল।দেখা গেল ডিরেক্টরসহ বাড়ির মালিকের খুব দরদ তথার জন্য।একজনের ডায়রিয়ায় সবাই যেন মিলেমিশে শোক দিবস পালন করছে। কি বিরক্তিকর একটা ব্যাপার! ইউসুফ বা আখতার হোসেনকে দেখলেই এখন বিরক্ত লাগে পুনমের।একটা মেয়েকে ঘিরে এতো ঢং করার কোনো কারণ আছে?ডায়রিয়া কি ভালো হয় না? একজনের ডায়রিয়া হয়েছে বলে সবাইকে হাত গুটিয়ে ঝিমানো মুরগির মতো বসে থাকতে হবে?দু’দিন যাবৎ এদের ঢং দেখতে দেখতে চোখটা পুড়ে যাচ্ছে পুনমের।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিকাল দেখছিল পুনম।এখানে ভাল লাগছে না একদম।কাজটা যে কবে শেষ হবে! কাজটা শেষ হলেই এই বিরক্তিকর ডিরেক্টরের চেহারায় লাথি মেরে বাড়ি চলে যাবে পুনম।এর চাইতে আরো ভালো একটা কাজ পেয়েছিল সে।কিন্তু সাইড ক্যারেক্টার বলে রাজি হলো না।তাছাড়া,ঢাকা থাকতে কত বড় বড় কথা বলেছিল এই হারামজাদা ডিরেক্টর। তুমি একবার আমার সাথে কাজ করো,ক্যারিয়ার গড়ে দেব,নাটকটা অন এয়ার হওয়ার পরে ডিরেক্টরা তোমার পিছু ঘুরবে,তুমি অভিনয়ের জন্য একদম পার্ফেক্ট —এরকম হাজারটা কথা বলেছে আখতার হোসেন।এখন কি হচ্ছে? কোনো কাজ হচ্ছে এখানে?বাড়িতেও কথা বলতে পারছে না,ফোনটা চুরি হলো।সবাই নিশ্চয়ই খুব্ল দুশ্চিন্তা করছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনম।কবে যে বাড়ি যাবে!

_” পুনম, কি করছো এখানে দাঁড়িয়ে? ”

চন্দ্রানীর কথায় ধ্যান ভাঙে পুনমের।স্নিগ্ধ আকাশের দিকে চোখ রেখে বলেঃ” কিছু না।কিছু করার আছে এখানে?”

_” সেটাই।আমার মেজাজটা পুরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে।এদের কান্ড-কারখানা দেখছো?”

_” তুমিই দেখ।আমার গা জ্বলে এসেব দেখলে।”

ঠোঁটে করুণ হাসি ফুটিয়ে তুলে চন্দ্রানী।মলিন স্বরে বলেঃ” তুমি তো তাও ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে পেরেছো,আমি তো তাও পারিনি।এখানে না আসলেই ভালো হতো।”

_” এসব বলে আর লাভ আছে?”

_” হুম।আচ্ছা, ওই তথা নামের মেয়েটা কি খুব বড় মাপের কেউ?ওর জন্য কেমন ব্যতিব্যস্ত সবাই।”

_” জানি না।স্টুপিডটার নাম নিয়ো না তো।ওই হারামজাদীর নাম শুনতেও বিরক্ত লাগে এখন।”

_” আমারো।মনে হয় না একমাসের মাঝে কাজ শেষ হবে।”

_” কাজের আশা বাদ দাও।ওই যে আহমেদ ইউসুফের চ্যালাটা আবারো ইউসুফের ঘরের দিকে যাচ্ছে।ওই ফাজিল মেয়েটা তো ওই ঘরেই শুয়ে আছে মনে হয়।”

_” হ্যাঁ। একটু আগে ইউসুফকেও দেখলাম ওই ঘরেই ঢুকলো।এদের কি চোখের চামড়া নেই? কিভাবে পারছে এমন? লোকটাও কেমন যেন।কোনো বাছ-বিচার নেই।”

_” লজ্জা থাকলে আর এমন করতে পারতো?সন অফ এ পিগ।মেয়েটারও কোনো লজ্জা নেই।যখন-তখন আরেক ছেলে ঘরে ঢুকবে কেন? মেয়েটার ইন্টারেস্ট না থাকলে এতো সাহস পায়?আমি তথার জায়গায় থাকলে জুতোপেটা করে ছেড়ে দিতাম।”

চন্দ্রানী আর কিছুই বলে না।ইউসুফের আচরণ অতিমাত্রায় চোখে লাগছে সবার।তথার কষ্টে যেন সে মরে যায় একদম।অসহ্য! এতো ঢং যে এরা কোথায় পায়।

***

আলমারিতে টি-শার্ট খুঁজছিল ইউসুফ।ঘরের মাঝে রাখা বিশাল খাটে ঘুমিয়ে আছে তথা।তথা ঘুমিয়ে থাকলেই কেবল এঘরে আসে ইউসুফ।জেগে থাকলে আসে না।কারণ জেগে থাকলে তথা মাথাটাকে নিচু করে রাখে।কাল রাতে স্যালাইন দিতে হয়েছে। স্যালাইন দেওয়ার সময়ও চোখের পাতা টিপে জোর করে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল।একবারো চোখ মেলে ইউসুফের দিকে তাকালোই না।ইউসুফ কতরাত পর্যন্ত প্রেয়সীর পাশে বসে ছিল! স্যালাইন শেষ হওয়ার পর ঘুমাতে গেছে।এতো এতো ঘন্টার মাঝে তথা একটা টু শব্দ পর্যন্ত করলো না।কি নিষ্ঠুর! সেদিন প্রেম নিবেদন করতেই কিভাবে বমি করে ভাসিয়ে ফেললো! ভাবতেও শরীর ঘিনঘিন করে ইউসুফের। শুধু তথা বলে সহ্য করেছে।অন্য কেউ হলে খবর ছিল।দু’দিনের ডায়রিয়ায় শরীরের অর্ধেক শক্তি ফুরিয়ে গেছে তথার।ওকে এখন একটা নেতানো ফুলের মতো দেখা যায়।

_” আসব স্যার?”

তথা ঘুমিয়ে থাকায় মামুনকে ঘরে ঢুকার আদেশ দিলো না ইউসুফ। নিজেই দু’ পা এগিয়ে গেল দরজার দিকে।

_” কিছু বলবে নাকি?”

_” জ্বি,স্যার।আজ রাতে কিছু প্রোডাক্ট আসবে।”

_ ” আজকে?রিভলবার তো আজ আসার কথা নয়।”

_” রিভলবার না ড্রাগস।ঢাকা থেকে আসছে।”

_” গোডাউনটা পরিষ্কার না?”

_” কয়েকটা ছুড়ি দেখলাম স্যার।আর কিছু নেই।ছুড়িগুলো কাজে লাগবে কোনো?”

একপেশে হাসি হাসে ইউসুফ।মাথা নেড়ে বলেঃ” হ্যাঁ। অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ সাড়ব ওগুলো দিয়ে।ওগুলোকে কিছু করো না।”

_” ওকে স্যার।আপনি কি থাকবেন আজ?”

_” হ্যাঁ। কখন আসবে?”

_” রাত বারোটার দিকে।”

_” বাড়ির সামনেই থাকব আমি।তুমিও থেকো সময়মতো ”

_” ওকে স্যার।”

মামুনকে বিদায় করে আবার ঘরে আসে ইউসুফ।কি সুন্দর মাথার নিচে একটা হাত রেখে ঘুমিয়ে আছে! লোভ সামলাতে পারে না ইউসুফ।টুপ করে চুমু দেয় তথার কপালে।

***

তথার খুব বড় অসুখ হয়েছে।কিন্তু সে কাউকে বলছে না।সবসময় বুক ঢিপঢিপ করে,গাল লাল হয়ে যায়,হাত-পা কাঁপে। ইউসুফকে দেখলেই এমন হয়। কি ভয়ংকর একটা ব্যাপার!
নিজের উপর এতোদিন শতভাগ বিশ্বাস ছিল তথার।একশভাগ নিশ্চিত ছিল বিয়ের আগে কোনো প্রেম করবে না,কোনো ছেলে তার সংযমের বাঁধ ভাঙতে পারবে না।সব ঠিকঠাক চলছিল।কিন্তু সেদিনের চুমুটাই সব এলোমেলো করে দিল।বিদ্যুতের মতো ইউসুফের ঠোঁটের স্পর্শ তথার কপালে পড়লো আর সাথে সাথে সংযমের বাঁধ ভেঙে গেল।তথা কিছু বলতেই পারলো না ইউসুফকে।ইউসুফ সামনে আসলেই গলার স্বর আঁটকে আসে।বোবা হয়ে যায় তথা।আজকে বিকেলেও যখন চুমু দিল,তখনও তথা জেগেই ছিল।কিন্তু কিছুই বলতে পারলো না।ইদানিং ইউসুফ সামনে আসলেই অসার হয়ে যায় তথা।চোখ বন্ধ করে রাখে।লোকটার অদ্ভূত সুন্দর মুখের দিকে তাকাতেই পারে না।তথা মনে হয় ইউসুফের প্রেমেই পড়েছে।অকারণেই প্রেমে পড়েছে সে।অবশ্য প্রেমে পড়তে কোনো কারণ লাগে না।হাতের কাছে কাজ না পেলেই মানুষ প্রেমে পড়ে।

_” কি খবর,হাগুকন্যা? একা একা হাসছো কেন? ”

_” খবর ভাল। কিন্তু হাগুকন্যা আবার কেমন নাম?”

তথার পাশে ধপ করে বসে পড়ে সোনালী।ফিচেল হেসে বলেঃ” পেট পাতলা মেয়েদেরকে আমি হাগুকন্যাই বলি।”

_” আমার পেট টাইট এখন।এইসব নাম আমার সাথে যায় না।”

_” হ্যাঁ, যেই হারে স্যালাইন দিল,সেবাযত্ন করলো–ভালো না হয়ে উপায় আছে?”

উদাস হয় তথা।উদাসমনে বলে ঃ” হ্যাঁ, লোকটা খুব কেয়ারিং।খুব যত্ন নেয় আমার।ভালোই লাগে।”

_” এই তথা আপু,কি হয়েছে তোমার?প্রেমে -টেমে পড়লে নাকি?”

_” কি জানি! আহমেদ ইউসুফকে ইদানিং খুব ভালো লাগে আমার।সে আমায় চুম্বকের মত টানে আমায়।

উত্তেজনায় উঠে বসে সোনালী।হতভম্ব গলায় বলেঃ” কি বলো এসব? পাগল তুমি? মানুষ এভাবে কিভাবে প্রেমে পড়তে পারে? তোমার ব্রেইনটা হাগুর সাথে বেড়িয়ে গেছে নাকি?”

চলবে…

#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-১৯)
#হালিমা রহমান

আজকে খুব গরম পড়েছে।একদম ঘাম ঝড়ানো গরম।কার্তিকের শুরুতে এতো গরম পড়ে?কে জানে! আবহাওয়ার দিকপাল খুঁজে পাওয়া যায় না এখন।ইরফান শার্টের উপরের বোতামটা খুলে দেয়।গরম লাগছে খুব।ছোট হোটেলের একপাশে কাজ করছিলো সোনাই।ওকে ডাক দেয় হাত নেড়ে।

_” এই সোনাই,এদিকে আয়।”

দৌড়ে আসে সোনাই।বিনয়ী ভঙ্গিতে বলেঃ” কিছু লাগব ভাই?”

_” ফ্যানটা আরেকটু বাড়ায় দে তো ।”

_” আর বাড়ব না, ভাই।এর স্পিড কম।”

_” ধুর।তাইলে আমাকে একগ্লাস ঠান্ডা পানি খাওয়া।আছে নাকি?”

মাথা চুলকায় সোনাই।ইতস্ততভাবে বলেঃ” আসলে এইটাও নাই ভাই।”

_” তাইলে তোর ভাইরে একগ্লাস ঠান্ডা কোকাকোলা খাওয়া।এইটা আছে? “__ইরফানের বদলে রাফায়েত ফরমায়েশ দেয়।
রাফায়েতের প্রশ্নে ইতিবাচকভাবে মাথা নাড়ায় সোনাই।ব্যস্ত গলায় বলেঃ” এখনি দিতাছি, ভাই।”

সোনাই একছুটে চলে যায়।রাফায়েত আবারো বিরিয়ানীর প্লেটে হাত দিলেও ইরফান দেয় না।ভাবলেশহীন চোখে সামনের রাস্তার দিকে চেয়ে থাকে।ওই যে ওখানে,ঠিক ওখানে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো তথা।ভার্সিটি বা টিউশনি থেকে ফেরার পর এই হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে খাবার কিনতো।আর ইরফান হোটেলের ভিতর এককোনে বসে চুপিচুপি প্রেয়সীকে দেখতো।কি সুন্দর ছিল তখনকার দিনগুলো! স্বপ্নময় অদ্ভূত সুন্দর কিছু মুহূর্ত ছিল।আজও সব আছে শুধু তথাই নেই।মোটে আট-নয়দিন হয়েছে তথাকে দেখে না ইরফান।অথচ মনে হয় যেন কত বছর,কত যুগ কেটে গেছে। আচ্ছা তথা কি আগের মতোই আছে?এখনও কি ছেলেদের সাথে কথা বলার সময় কপাল কুঁচকে ফেলে? খুশি হলে মুচকি হাসে?কিছুক্ষণ পরপর কপালের একপাশে পড়ে থাকা ছোট চুলগুলোকে অবহেলায় কানের পাশে গুজে দেয়?কে জানে!
তথা যাওয়ার পর থেকে এদিকে এতোদিন আসেনি ইরফান।অবশ্য সময় কোথায়?তাছাড়া, ভালোও লাগে না এদিকে আসতে।সবটা কেমন যেন খালি খালি লাগে।আজ রাফায়েতের কথায় এসেছে। শুক্রবার বলে আসতে পেরেছে,নাহয় অন্যদিন হলে তাও পারতো না।

_” ইরফান, মেয়ে কেমন দেখলি?”

বিকালের কথা মনে পড়তেই মুহূর্তে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় ইরফানের।কপাল কুঁচকে বলেঃ” তুই কার কাছে শুনলি?”

_” আঙ্কেলের কাছে।বিয়ের দাওয়াত পাব নাকি?”

_” না।ওই মেয়ে বিবাহিত।”

_” কি!”—রাফায়েতের হাতের লোকমা পড়ে যায় প্লেটে।অবাক চোখে চেয়ে থাকে সে বন্ধুর দিকে।

ইরফান ভাবলেশহীনভাবে বলেঃ” মেয়ের জামাই আছে।ওর ফুফাতো ভাই আশিকের সাথে বিয়ে হয়েছে পনেরো দিন আগে।”

_” মানে কি! বিয়ে হলে আবার তোরা দেখতে যাবি কেন?মেয়ে যে বিবাহিত তা তোদেরকে বলেনি আগে?”

বিরক্তিতে তেতো হয়ে যায় ইরফানের ভিতরটা।এই ছেলের মাথায় কি বুদ্ধি নেই?মেয়ের বাবা জানলে কি আর ওদেরকে মেয়ে দেখতে দিতো?

_” জিনিয়া পালিয়ে বিয়ে করেছে।আত্মীয়ের মাঝে আত্মীয় পছন্দ করেন না তৌকির আঙ্কেল।তাই পালিয়ে বিয়ে করেছে দুজনে।”

_” জামাই কি করে?”

_” বিদ্যুৎ অফিসে চাকরি করে।”

_” তো পরিবারকে জানাবে কবে?”

_” আমি কি এতোকিছু জানি রাফাইত্তা?আমারে মেয়ে ঘরের মধ্যে আটকে এতোটুকুই বলেছে।বলেছে ওকে জোর করে বিয়ে করলে, পরেরদিনই জামাইয়ের সাথে পালিয়ে যাবে।মানে চিন্তা কর,কেমন আক্কেল মেয়ের।ও বিবাহিত জানার পরেও আমি জোর করে বিয়ে করব! আমি কি সিনেমার হিরো যে জোর-জবরদস্তি করে বিয়ে করব?বেয়াক্কেল মেয়ে।ইচ্ছে করেছে ঠাটিয়ে দুটো চড় মেরে চলে আসি।ফাজিল কোথাকার।”

ইরফানের কথা শুনে খাওয়া রেখে কুটকুট করে হাসে রাফায়েত।এক চুমুক পানি খেয়ে বলেঃ” কি ব্যাপার, ইরফান? মেয়েরা তোকে শুধু রিজেক্ট করছে কেন?বাংলাদেশের মেয়েরা তোকে বয়কট করলো নাকি?”

রাফায়েতের কথা বুঝতে পারে না ইরফান।কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করেঃ” মানে?”

_” সুন্দর,স্মার্ট,কর্মঠ ইরফান সাদিক খালি রিজেক্টই হচ্ছে।আজকে তাকে রিজেক্ট করলো জিনিয়া, কিছুদিন আগে তথা।আল্লাহ মালুম আর কতো মেয়ে তোকে রিজেক্ট করার জন্য বসে আছে।”

বাম পায়ের চটি জুতো খুলে রাফায়েতের হাঁটুর দিকে উড়িয়ে মারে ইরফান।নিচু গলায় রাফায়েতকে কিছু অশ্রাব্য গালি দেয়।ছেলেটার মুখের ভাষা মাশাল্লাহ রেকর্ড করে রাখার মতো।শুনলে শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যায়।

_” ভাই,এই যে ঠান্ডা।”

_” রাখ এখানে।”—সোনাইকে ফরমায়েশ করতেই ইরফানের চোখে পড়ে মাহাদীকে।সোনাইয়ের দিকেই আসছে সে।

_” সোনা ভাই,দুই প্যাকেট বিরিয়ানি দিয়ো তো।আর্জেণ্ট লাগবে।একটু তাড়াতাড়ি দিয়ো।”

মাহাদীর মুখটা কেমন শুকনো ঠেকছে।মোটাসোটা ছেলেটার চোয়াল ভেঙে গেছে। চোখদুটোর নিচেও একটু কালির আভাস পাওয়া যাচ্ছে।মাহাদীর পরিবর্তন খট করে চোখে বাজে ইরফানের ।যেচে মাহাদীর সাথে কথা বলে সে।

_” কি খবর ছোট ভাই? শরীর ভাল?”

এতোক্ষণ হয়তো ইরফানকে চোখে পড়েনি মাহাদীর।ইরফানের কথা শুনতেই বিনয়ী ভঙ্গিতে সালান দেয় সে।

_” আসসালামু আলাইকুম, ভাই। ভালো আছি।আপনি ভালো আছেন?”

_” এই তো আলহামদুলিল্লাহ। দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো। এই চেয়ারটাতে বসো। বাড়ির সবাই ভালো আছে?”

চেয়ার টেনে বসতে বসতে মলিন মুখে মাথা নাড়ে মাহাদী।

_” না,ভাই।আম্মু অসুস্থ।রুবি আপাও অসুস্থ।”

_” কি হয়েছে?”

_” রুবি আপার পিত্তথলিতে পাথর হয়েছে।অপারেশন করতে হবে।এই টেনশনে মা আজ দুইদিন যাবৎ অসুস্থ। বিছানা থেকে শরীর উঠাতে পারে না।”

_” আহা রে।কান্নাকাটি করে লাভ আছে?আন্টিকে শক্ত হতে বলো।”—-রাফায়েতের সহানুভূতির কন্ঠ কানে আসে।

_” সবাই বুঝায়।কিন্তু আম্মু বুঝেই না।তথা আপুর চিন্তায়ও আম্মু অর্ধেক শেষ।”

_” কেন কি হয়েছে তথার?কোনো বিপদ নাকি?”—ইরফানের অস্থির কন্ঠ কানে আসতেই মনে মনে হাসে রাফায়েত।
হায়রে ইরফান! এ আর মানুষ হলো না।

_” তথা আপুর খবর পাচ্ছি না আমরা।যতবার ফোন দেই, ততোবার শুধু ফোন বন্ধ দেখায়।”

ইরফানের ভিতরটা তেতো হয়ে আসে।হৃৎপিন্ডে শক্তিশালী এক ভূমিকম্প হলো যেন।কি বললো মাহাদী?ফোন বন্ধ দেখায়? হ্যাঁ, সত্যিই তো ফোন বন্ধ তথার।কাল রাতে, আজ সকালে,বিকালে কতবার কল করলো ইরফান।প্রতিবার সেই ঘ্যানঘ্যানে যান্ত্রিক স্বরটা একই কথা বলেছে।ইরফান উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্ন করেঃ” কবে থেকে ফোন বন্ধ পাচ্ছো?আমিও আজকে ফোন দিলাম, কিন্তু প্রতিবার বন্ধই বললো।”

_” আম্মুর সাথে শেষ কথা হয়েছিলি সেই দুই তারিখে।এরপর আর কথা হয়নি।তথা আপুর যেই ডিরেক্টর,উনি নাকি খারাপ লোক।আমাদের গ্রামের তো,আম্মু চিনে।আম্মু তথা আপুকে বলছিল ঢাকা চলে আসতে।আপু কথা শুনে নাই।পরে আম্মু রাগারাগি করে কল কেটে দিয়েছিল। পরেরদিন থেকে আর যোগাযোগ করতে পারেনি।আম্মু সকালবেলা থেকে যতবার কল করেছে ততোবার ফোন বন্ধ বলেছে। এখন পর্যন্ত ফোন বন্ধ।”

_” ডিরেক্টর যে খারাপ,এটা আগে জানতো না?”

_” আম্মু মনে হয় ডিরেক্টরের নাম শুনে নাই আর।শুনলে যেতে দিতো না।”

_” তোমার বাবা কি বলছে? উনি কি পঞ্চগড় যবেন নাকি?তথার তো খোঁজ নেওয়া দরকার।বিপদ-টিপদও হতে পারে।”

_” রুবি আপু অসুস্থ না থাকলে হয়তো যেতো।আম্মুও অসুস্থ, আপুও অসুস্থ। আব্বু কি করে যাবে?”

কথায় যুক্তি আছে।ইরফানের মনটা কেমন অস্থির হয়ে উঠছে।বিপদ না হলে এতোদিন যাবৎ কারো ফোন বন্ধ হয়?তথার বিপদই হয়েছে।নিশ্চিত গুরুতর কোনো বিপদ হয়েছে।ইরফানের হাসফাস লাগে।শ্বাস আটকে আসে।ইরফানের সর্বস্ব জুড়ে একটা কথাই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে_মেয়েটা ভালো নেই,একটুও ভালো নেই।

_” মাহাদী,এই নেও।”

মাহাদী উঠে দাঁড়িয়ে খাবারের প্যাকেট হাতে নেয়।পকেট থেকে টাকা বের করতে করতে ইরফানকে উদ্দেশ্য করে বলেঃ” আসছি, ভাই।আসসালামু আলাইকুম।”

_” ওয়া আলাইকুম আসসালাম।”

মাহাদীর গমন পথের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ইরফান। মাথাটা ধরে গেছে মুহূর্তেই। আচ্ছা তার এখন কি করা উচিত?পঞ্চগড় যাওয়া উচিত না?অবশ্যই যাওয়া উচিত। সে তো তথার একনিষ্ঠ প্রেমিক।সে না গেলে কে যাবে?কার এতো দায় পড়েছে যে তথাকে খুঁজতে সেই পঞ্চগড় ছুটে যাবে?ঠান্ডা খাবারের প্লেটটাকে সামনের দিকে ঠেলে দেয় ইরফান।পাগল পাগল লাগছে নিজেকে।রাতটুকু কখন শেষ হবে?

_”ইরফান,ইরফান।”

_” হুম।”

_” টেনশন করিস না।তথার কোনো বিপদ হয়নি।”

_” আল্লাহ তোর কথা কবুল করুক।”

_” হ্যাঁ, তুই চিন্তামুক্ত থাক।বিপদের আশঙ্কা থাকলে নিশ্চয়ই তথার কাকা নিজে মেয়ের খোঁজে যেত।তাই না?ইরফান,ইরফান।”

_”হু?কি বলছিলি?”

রাফায়েত বিরক্ত হয়।ইরফানের কানে কি কথা ঢুকছে না?মুহূর্তের মাঝেই কেমন অমনোযোগী হয়ে গেল।হতচ্ছাড়া বদমায়েশ কোথাকার।রাফায়েত বিরক্ত মুখে বলেঃ” বলছি তুই চিন্তামুক্ত থাক।যাদের মেয়ে তারাই টেনশন করুক। ”

_” তাদের চিন্তার আশায় আমি বসে থাকব?তুই আমাকে চিনিস না?”

_” কি করবি তুই?”

চেয়ারে হেলান দেয় ইরফান।নির্দ্বিধায় বলেঃ” আমি কাল শ্যামলী থেকে হানিফ পরিবহনের একটা বাসে উঠব।তারপর পঞ্চগড় যাব তথার খোঁজে।ডাহুক নদীর কাছেই একটা জমিদার বাড়ি আছে।তথা সেখানেই আছে।তুই যাবি নাকি,ডাহুক নদীর তীরে? ”

***

রাত পৌনে বারোটা বাজে।শহরাঞ্চলে এটা খুব বেশি রাত নয়।কিন্তু গ্রামের জন্য এই রাত পৌনে বারোটাই অনেক কিছু।সারাদিনের খাটাখাটুনির পর মানুষগুলো নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে।কার্তিকের শুরু হওয়ায় রাতের দিকে একটু ঠান্ডা পড়ে।খুব সকালে কুয়াশার মতো একটু ঘোলাটে দেখায় সবকিছু।এই সময়টা খুব ভালো লাগে মামুনের।খুব ঠান্ডাও না,খুব গরমও না।ফুল স্পিডে ফ্যান ছেরে কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকার মজাই আলাদা এখন।
রাতের স্বপ্নময় সুখনিদ্রাকে বয়কট করে, জমিদার বাড়ির পিছন দিকে হাঁটছে মামুন।ভারী কেডসের নিচে শুকনো পাতা ভাঙে মরমর করে।আশেপাশে গাঢ় অন্ধকার।একটুখানি চাঁদ আছে আকাশে তবে খুব বেশি আলো নেই।ডানপাশে ফেলে আসা আমগাছের নিচু ডালে একটা পেঁচা বসেছিল।সেদিকে নজর দেয় না মামুন।অভ্যস্ত পায়ে হেঁটে চলে আরো সামনে।জমিদার বাড়ির পিছনে অনেক গাছ।আম,জাম,করমচা,কাঁঠাল,অর্জুন,ঝাউ,দেবদারু
ইউক্যালিপটাস —কি নেই সেখানে।বিশাল বিশাল বয়স্ক গাছ সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে।
মামুনের নাকে ভেসে আসে তীব্র হাসনাহেনার ঘ্রাণ।কোথায় যেন একটা গাছ হয়েছে।রাতেরবেলা বেশ ঘ্রাণ পাওয়া যায়। আশেপাশের কোনোকিছু বিচলিত করতে পারে না মামুনকে।দশ মিনিটের মাথায় পৌঁছে যায় অর্জুন গাছের কাছে।অর্জুন গাছের সামনে চার দেয়ালের একটা জীর্ণ ঘর আছে।দেয়াল ফাটা,দরজায় মরচে ধরা তালা ঝুলানো।মামুন সেই ঘরের সামনে যেয়ে দাঁড়ায়।এটাই সেই জায়গা, যেখানে জমিদার বংশের সবাইকে গনকবর দেওয়া হয়েছে।তবে পুরো জায়গাটা এখন সমতল।আহমেদ ইউসুফ পরবর্তীতে এই জায়গাটাকে কবরস্থানের মতো যত্ন করতে পারতো।কিন্তু করেনি।দেখা গেল তার কোনো আগ্রহই নেই এ বিষয়ে। মামুন পকেট থেকে ফোন বের করে ইউসুফের ফোনে কল দেয়।দু’বার রিং হতেই ফোন ধরে ইউসুফ।

_” বলো মামুন।”

_” আপনি কি এখন আসবেন স্যার?”

_” হ্যাঁ। ট্রাক এসেছে?”

_” না স্যার।”

_” আচ্ছা।আসছি আমি।দশ মিনিট সময় লাগবে। ”

_” ওকে স্যার।”

ফোন রেখে দেয় মামুন।পকেট থেকে চাবি বের করে।গোডাউনটা এখানেই।মামুন এদিক-ওদিক হালকাভাবে চোখ বুলায়।আশেপাশে অন্ধকারে বেশি কিছু চোখে পড়ে না।তবে উপরে তাকালে নিশ্চিত অবাক হতো মামুন।কারণ,নারিকেল গাছের উপর থেকে একজোড়া তীক্ষ্ম চোখ চেয়ে আছে তার দিকে।

***

মোবাইলটা পকেটে পুরলো ইউসুফ।ট্রাউজারের পকেটে রিভলবারটাও ঢুকিয়ে নিলো।দরজা খুলে বের হওয়ার আগে আয়নায় একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। ঠিক তখনই। তখনই দরজার ঠকঠক আওয়াজ হল।মৃদু আওয়াজ।ইউসুফ অবাক হয়।এ সময় আবার কে এলো?
দরজা খুলে বাইরে তাকাতেই আকাশ থেকে পড়ে ইউসুফ।তথা দাঁড়িয়ে আছে বাইরে।পরনে ধবধবে সাদা রঙের সুতির শাড়ি। চুলগুলো ছেড়ে রাখা।ইউসুফের পেটে ডান হাত দিয়ে মৃদু ধাক্কা দেয় তথা।আদুরে স্বরে আবদারের ভঙ্গিতে বলেঃ” চাঁদ দেখতে যাবেন?আকাশে আজ কাঁচির মতো একফালি বাঁকা চাঁদ জেগেছে।দেখবেন?
নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে….”

গুনগুন করে গান গেয়ে ভিতরে ঢুকে তথা।তথার আচরণ বুঝে আসে না ইউসুফের।হতভম্ব গলায় বলেঃ” আপনি ঠিক আছেন, কামিনী ফুল?”

_” উঁহু। আমার কঠিন অসুখ হয়েছে।একদম মরণ অসুখ।এক হাতুড়ি ডাক্তারের উপর পা পিছলে গেছে। এখন কি করি বলুন তো?”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here