ডাহুক_নদীর_তীরে,পর্ব-৮,০৯

0
254

#ডাহুক_নদীর_তীরে,পর্ব-৮,০৯
#হালিমা রহমান
০৮

_” আমি ঠিকঠাক পৌঁছাতে পেরেছি, কাকি।এবার তো কান্না থামাও।”

কান্না থামে না আকলিমা খাতুনের।মুখে আঁচল গুজে আওয়াজ বন্ধ করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন।ধরা গলায় বলেনঃ” গাড়িতে বমি করছিলি?”

_” না।বমি এসেছিল একবার। পরে তেঁতুলের আচার খেয়েছি।”

_” আচার কিনছিলি?”

ইরফানের কথা উল্লেখ করে না তথা।আকলিমা খাতুনের সাথে একটুখানি মিথ্যা বলে।

_” হ্যাঁ, কাকি।বাস স্টেশন থেকে কিনেছিলাম।”

_” রাইতে খাইছোস?”

_” না,এখনো খাওয়া হয়নি।মাত্র গোসল করলাম।”

_” খাওয়া-দাওয়া করবি ঠিকমতো।আর সময় কইরা ফোন দিবি।তাইলে রাখ এখন।কিছুক্ষণ ঘুমায় থাক।’

আকলিমা খাতুনকে ফোন রাখতে দেয় না রুবাইদা ও মাহাদী।তারা এতোক্ষণ মায়ের কানের সাথে কান লাগিয়ে রেখেছিল।আকলিমা খাতুনের কথা শেষ হতেই, রুবাইদা ছো মেরে ফোন নিয়ে নেয়।একরাশ আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করেঃ” তথাপু,তোমার কেমন লাগছে?”

_” খুব ভালো।জানিস রুবি,বাড়িটা ভীষণ সুন্দর।নাটক-সিনেমায় জমিদার বাড়িগুলো যেমন দেখায়,ঠিক তেমন।”

_” ভিডিও কল দেও না,একটু দেখি।”

_” নেট প্রবলেম অনেক।কথা বলার জন্য বাইরে এসেছি।ভিডিও কল দেওয়া যাবে না।আমি ছবি তুলে রাখব সবকিছুর।আসলে দেখিস।বিকালে খেয়েছিস কিছু?”

_” হ্যাঁ। ফুচকা খেয়েছিলাম।”

_” ভালো।ঠিকভাবে থাকিস।রাখছি এখন। মাথা ব্যাথা করছে খুব।”

_” আচ্ছা।ভালো থেকো।আল্লাহ হাফেজ।”

ফোন রেখে দেয় তথা।এই প্রথম ঢাকা থেকে এতোদূর এসেছে সে।খানিক অসুস্থ লাগছে।তবে সেগুলোকে পাত্তা দিলে চলবে না।তাই সামান্য অসুস্থতাকে গায়ে মাখলো না তথা।বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ঘরে নেট পাওয়া যাচ্ছিলো না।তাই বাইরে এসেছে সে।লোহার গেটটা তালা মারা।এই বাড়িতে বোধহয় মামুন ও ইউসুফ ছাড়া কেউ থাকে না।এখন পর্যন্ত একটা কাজের লোকও চোখে পড়লো না তথার।বাড়িতে ঢুকার জন্য মোবাইলের আলো জ্বালতেই টুংটাং শব্দে ম্যাসেজ আসে তথার ফোনে।

_” পৌঁছে গেছো?”

পরিচিত নম্বর।ইরফানের নম্বর দেখেও কপাল কুঁচকায় না তথা।ইরফানের জন্য তার খারাপ লাগে খুব।লোকটা কেমন যেন।খুব ক্ষ্যাপাটে আর পাগলাটে।মাঝে মাঝে মনে হয়, ইরফান সত্যিই তথার প্রতি খুব দূর্বল।শত হলেও তথার নারী হৃদয়। মায়া-মমতা-দূর্বলতা তারও আছে।ইরফানের আজকের আচরণে খুব অবাক হয়েছে তথা।বাস স্টেশনে কি পাগলামিটাই না করলো!

_” কামিনী ফুল,আপনি এখানে কি করছেন?”

ইউসুফের প্রশ্নে অবাক না হয়ে পারে না তথা।বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করেঃ ” আপনি আমাকে বলছেন?আমার নাম তো কামিনী ফুল না।আমি তথা।”

_” ওহ,সরি।আমি গুলিয়ে ফেলেছিলাম।এতো রাতে এখানে কি করছেন?”

_” ফোনে কথা বলতে এসেছি।ঘরে নেট পাচ্ছিলাম না।”

_” এই ভুলটা আর করবেন না,মিস। সবাই বলে এই বাড়িতে ভূত আছে।অনেক রকমের আওয়াজ পাওয়া যায় রাতে।”

_” সত্যি! আপনি পেয়েছেন কখনো?”

_”আমি তো এই বাড়িতে সবসময় থাকি না।গ্রামবাসীরা বলে,এখান থেকে নাকি রাতে মেয়েদের কান্নার আওয়াজ শোনা যায়।কয়েকদিন আগেও মন্দিরের পুরোহিত অজ্ঞান হয়েছেন এই বাড়ির সামনে।”

গায়ে কাটা দেয় তথার।ভূত-প্রেত বিশ্বাস না করলেও জ্বীন-পরীতে অনেক বিশ্বাস তার।এরা তো আর মিথ্যা নয়।পরিত্যক্ত খোলা বাড়ি, দুষ্টু জ্বীন থাকা অসম্ভব কিছু না।দ্রুতপায়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় তথা।শরীর ভারী ভারী লাগছে একটু।ভয়ের চোটে ইরফানের ম্যাসেজের উত্তর দেওয়া আর হলো না।তথাকে ভয় পেতে দেখে খুব মজা পায় ইউসুফ।খোলা আকাশের নিচে গা দুলিয়ে বেশ কিছুক্ষণ প্রাণখুলে হাসে সে। মিনিট পাঁচেক পর পা বাড়ায় বাড়ির পিছনে।খানিকক্ষণের মাঝেই হারিয়ে যায় বড় বড় গাছের আড়ালে।

***

ইরফানের বাড়ির পিছনে একটা মাঠ আছে।তাদের বাড়ির শেষ সীমানা হিসেবে এই মাঠটাকে ধরা হয়।ইরফানের বাবা, সাজ্জাদ সাহেব সস্তার সময় এই জায়গাগুলো কিনে রেখেছিলেন।লোকটা খুব দূরদর্শী। শূন্য থেকে উঠে এসেছেন একদম।একসময় যার নুন আনতে পানতা ফুরাত,তার এখন জমজমাট অবস্থা।বিশাল এক বাড়ি করেছেন,ছোট ছেলেটাকে বিদেশে পড়াচ্ছেন,বড় মেয়েটাকে ডেন্টালে পড়িয়েছেন, ইরফানকে ব্যবসা দিয়ে দিয়েছেন।ধানমন্ডিতে যেই রেস্টুরেন্টটা ইরফানের নামে লেখা,সেটা আগে সাজ্জাদ সাহেবের একক সম্পত্তি ছিল।এই রেস্টুরেন্ট আগে ছিল না।এটা সামান্য ভাতের হোটেল ছিল। টিনশেড হোটেলের এককোনে চটের বস্তার আড়ালে ভাত রান্না হতো।চুলার পাশেই পিঁড়ি পেতে বসে সাত-আট পদের ভর্তা বানাতেন ইরফানের মা খালেদা বানু।আলু ভর্তা, ডিমের ভর্তা,ডালের ভর্তা আরো কত কি।ভাত শেষে বেশি আলু দিয়ে মুরগীর মাংসের ঝোল রাঁধতেন।এরপর কোনো একটা মাছ ভেজে নিতেন।এই ছিল হোটেলের রেসিপি।কখনো কখনো ভোর থেকে কাজ শুরু করতেন খালেদা বানু।একটা মাত্র চুলা,একটা মাত্র রাঁধুনী।খাবার শেষে আবার প্লেট,গ্লাস তাকেই ধুতে হতো।সাজ্জাদ সাহেবও বসে থাকতেন না।কখনো তিনি ওয়েটার আবার কখনো ক্যাশিয়ারের কাজ করতেন।হোটেলের কিছু দূরেই এক কামড়ার একটা রুম ভাড়া করে থাকতেন তারা।সেই নিম্ন অবস্থা অবস্থা থেকে উঠে এসেছেন সাজ্জাদ সাহেব।এককালে যেই মানুষটা নিজের হোটেলে সকাল-সন্ধ্যা খাটতেন,তার বাড়িতে এখন রাত-দিন তিনজন কাজের লোক খাটে।এক সময়ের রাঁধুনী খালেদা বানুকে এখন আর রান্নাঘরে যেতেই হয় না।রান্না-বান্না,কাটাকাটি, ধোয়া-মোছার জন্য আলাদা মানুষ আছে তার।
পরিবারের এতোটা নিম্ন অবস্থা আর কোনো ভাই-বোন না দেখলেও ইরফান দেখেছে।ইরফান সাজ্জাদ সাহেবের অভাবের ঘরের ছেলে।ইরফানের আজো মনে পড়ে সেই ছোট টিনশেডের হোটেলটার কথা।মায়ের আঁচল ধরে এককোনে বসে থাকতো সে।কখনো কখনো সিদ্ধ ডিমের খোসা ফেলে দিত আবার কখনো সিদ্ধ আলুর ছিলে দিত।বাবার সাথে ওয়েটারের কাজও করেছে বারকয়েক।ইরফানের যখন পাঁচ বছর,সাজ্জাদ সাহেব তখন বিদেশে পাড়ি জমান।ছোট হোটেলে হচ্ছে না।দিন বাড়ছে,ছেলে বড় হচ্ছে, খরচ বাড়ছে।হাত গুটিয়ে বসে থাকলে তো হবে না।ঘর-সংসার রেখে সেই দূর দেশ কাতারে পাড়ি দিলেন।দিনে তেলের কারখানায়, রাতে লোকাল ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কাজ করেছেন।দু-বেলা শুকনো রুটি খেয়ে, পরিবারকে ভালোভাবে চলার জন্য হাজার হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। এভাবে বছর কয়েক থাকার পর যখন সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়লো,তখন দেশে চলে এলেন।হোটেল ভেঙে ছোট-খাটো রেস্টুরেন্ট দিলেন,মার্কেটে দোকান কিনলেন,পুরান ঢাকায় সস্তায় জমি কিনলেন।সময়ের সাথে সাথে অবস্থা ভালো হয়েছে,ব্যবসা-বাণিজ্য ফুলে-ফেঁপে উঠেছে।দোকানগুলো ভাড়া দিয়ে বড় ছেলেকে ব্যবসা বুঝিয়ে দিলেন সাজ্জাদ সাহেব।ছেলেটার জন্য তার কষ্ট হয় খুব।প্রথম সন্তান হলেও ইরফানের ঝুলিতে বাবার সঙ্গ,ভালোবাসা,স্নেহের পরিমাণ কম ছিল।এর প্রধান কারণ হয়তো অভাব।ভালোবাসা,স্নেহের প্রতিদ্বন্দ্বী যদি হয় অভাব;তবে ভালোবাসা সেখান থেকে লেজ গুটিয়ে পালায়।চাহিদা,অভাবের দিকে নজর দিতে যেয়ে ছেলের দিকে নজর দেওয়ার সময়ই পেলেন না।ইরফানটাও খুব অন্তর্মুখী। নিজের চাহিদার কথা, পছন্দের কথা,ভালোলাগার কথা কখনো মুখ ফুটে বলেই না ছেলেটা।বাবার সাথে একটা সম্পর্ক আছে বটে তবে সেরকম খোলামেলা স্নেহ-ভালোবাসার সম্পর্ক নেই।তাদের বাবা-ছেলের সম্পর্ক অনেকটা আপনি-আজ্ঞেতেই সীমাবদ্ধ। সাজ্জাদ সাহেব যখন দেশ ছাড়লেন, ইরফান তখন পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলে।আবার সাজ্জাদ সাহেব যখন স্থায়ীভাবে দেশে ফিরলেন,ইরফান তখন বিশ বছরের উঠতি যুবক।এই বয়সের ছেলেরা বাবার কাছে সহজে হাত পাতে না,মন খুলে আবদার করে না, ইচ্ছার কথা জানায় না,ঘরের চাইতে বাইরে বন্ধু-বান্ধবদেরকে বেশি সময় দেয়। তাই তাদের বাপ-ছেলের সম্পর্কে অদৃশ্য একটা সীমারেখা চলেই এসেছে।

বাড়ির সাথের লাগোয়া মাঠে বসে আছে ইরফান।চারদিকে রাত নেমেছে আরো আগে।শহরে ঝুপঝাপ রাত নামে না।বহু আড়ম্বরে,বহু আয়োজনে একরাশ স্বস্তি নিয়ে রাত নামে এ শহরে।শেষ বিকেলেই এখানে ল্যাম্পপোস্ট আলো দেয়,বাসে বাদুরঝোলা হয়ে মানুষগুলো ঘরে ফিরে, ছেলে-মেয়েরা বাড়ি ফিরে।এতসব কাজের শেষে রাত নামে।ইরফান মাটিতে লেপ্টে বসে আছে। এখানে বসার মতো একটু উঁচু দেয়াল ছাড়া আর কোনো জায়গা নেই।ইরফানের বোন ইমা, অনেকবার তার বাবার কাছে একটা দোলনার আবদার করেছিল।কিন্তু অবহেলায় তা আর লাগানো হয়নি।তাছাড়া ইমা বাড়ি থেকে কম বেরোতো। তাই নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় আবদার ভেবেই সাজ্জাদ সাহেব মেয়ের ইচ্ছে পূরণ করেননি।ইরফান মোবাইলের ম্যাসেজ অপশনে আরেকবার ঢুঁ মারে।প্রতিবারের মতো এবারেও হতাশ হয় সে।না,যার জন্যে আজ তার মন খারাপ;তার পাত্তাও নেই।ইরফান দেয়ালের গায়ে হেলান দেয়।আজ প্রথমবারের মতো নিজেকে ভয়াবহ কিছু অশ্রাব্য গালি দিতে ইচ্ছে করছে।এতোটা নির্লজ্জ,মর্যাদাহীন কবে হলো সে?এতো অবজ্ঞা,এতো তাচ্ছিল্যের পরেও কেন তথার কথাই ভাবতে হবে তার?ইরফানের কি বিন্দুমাত্রও লজ্জা নেই?তথা কে যে তথার কথা ভেবে দেবদাস হতে হবে?নিজেকেই গোঁয়ারের মতো প্রশ্ন করে ইরফান।তার প্রশ্নের আগাগোড়া অভিমান জড়ানো। ইরফান নিজের মাঝেই ডুবে থাকে।মস্তিষ্ক বলছে–” তথা কেউ নয়।তথার চাইতে আত্মসম্মান বড়।যার আত্মসম্মান না থাকে সে আবার মানুষ হয় নাকি?তথা হয়তো একটু ভালোলাগার নাম।কিন্তু আত্মসম্মান অস্তিত্ব। তথাকে ভুলে যা ইরফান।ভালোলাগার প্রাসাদটাকে গুড়িয়ে ফেল।তথা চোরাবালি।ওতে মজে থাকতে নেই।তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।তারচেয়ে তথাকে পিছু ফেলে এগিয়ে যাওয়াই শ্রেয়।দিনশেষে কেউ তো আর তোকে নির্লজ্জ বলে তাচ্ছিল্য করতে পারবে না। ”

ইরফান অন্তকর্ণ খুলে রাখে। আচ্ছা,মন কি বলছে?তারও কি এক কথা?তথা কেবল একটুকরো ভালোলাগার নাম?ভাবনাতে বিভোর হয় ইরফান।তবে তার মন-মস্তিষ্ক সরলপথে চলে না।মন যেন ঘাড় ঝুকিয়ে ভয় দেখায়।সশব্দে নিষেধ করে ইরফানকে। মন বলছে–“কেন ভুলবি ইরফান?সে কোনো ঠুনকো অনুভূতি নয়।তথাকে তোর কবে থেকে ভালো লাগে, বলতো?সেই চব্বিশ বছর বয়স থেকে।অনুভূতির বয়স পাঁচ বছর।পাঁচ বছরে কত দিন হয়,কত মাস হয়,কত ঘন্টা হয়–তা কখনো হিসাব করেছিস?অনুভূতিগুলো বৃদ্ধ।তোর অনুভূতিকে শুধুমাত্র ভালোলাগায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না।এটা প্রথম প্রেম।সেই আদিকাল থেকে চলে আসা বিধ্বংসী প্রেম।প্রেমের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে দোষ কি?প্রেম-ভালোবাসায় আবার আত্মসম্মান কি বাপু?এতো রং-ঢং মেনে প্রেম করা যায়?”

তবে এবার আর মনকে পাত্তা দেয় না ইরফান।মস্তিষ্কের সাথেই তাল মিলায়।ঠিকই তো আত্মসম্মান সবকিছু।তথা তো ভালোবাসেনি।এখানে ইরফানের কোনো জোর নেই।সব চাবিকাঠি ঐ হৃদয়হীনার কাছে। মাথার চুল টেনে ধরে।ভালো লাগছে না কিছু।গলা শুকিয়ে আসছে,শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।মনে হচ্ছে আশেপাশে অক্সিজেনের খুব অভাব।আচ্ছা,ইরফান কি মরে-টরে যাবে।সে শুনেছে মরার আগে নাকি মানুষের অস্থিরতা বাড়ে।ইরফানের এখন সেই দশা।অস্থিরতায় দম আটকে আসছে তার।মেয়েটা পৌছালো কি না কে জানে! তথার চিন্তা মাথায় আসতেই আবারো অসহায়ের মতো হাত-পা ছেড়ে দেয় ইরফান।একটু আগেই ভাবলো তথাকে ভুলে যাবে।সেকেন্ডও যায়নি।দখলদারি মেয়েটা ঠিকই মনের কোনে পড়ে আছে।পুরো পাকিস্তানি হানাদার। যখন-তখন মন-মস্তিষ্কে হানা দেয়।

“যে জন প্রেমের ভাব জানে না
তার সাথে নাই লেনা-দেনা…

_” রাফায়েত থামবি? তুই দেখছিস আমার অবস্থা,তাও গান গাইছিস?আমি মনে হয় মরে যাব রাফায়েত।”

_” ধুর শালা মরবি না।পৃথিবীতে প্রেমের জন্য কেউ মরে না,বুঝলি।আর গানটা তোকে ডেডিকেট করে গাইলাম।তথা প্রেমের ভাব জানে না। তার সাথে আবার কীসের লেনাদেনা?তথাকে ভুলে যাও বৎস।মেয়েটা তোর সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ নয়।তাই তথাকে দোষ দেওয়া যায় না।দোষ তোরই।তোর যন্ত্রণার কারণ তুই নিজেই। ”

_” সবাই শুধু আমাকেই দোষ দেয়। মেয়েটাকে আমি ভালোবাসি,এটাই কি দোষ?”

_” না,এটা দোষ না।তবে প্রত্যাখ্যানের পরেও আঠার মতো লেগে থাকা দোষের।আচ্ছা,বাদ দে এসব।শ্যামলীতে গেলি আজকে, ইমার বাসায় গেছিস নাকি?”

_” না,বড় আপুর বাড়ি যাইনি আজকে।”

_” নিজের ছোটবোনকে কে বড় আপা ডাকে ইরফান?”

_” আমি ডাকি।সায়েম ছোটবেলায় ইমাকে বড় আপা ডাকতো।ওর সাথে সাথে আমিও ডাকতাম।অভ্যাস হয়ে গেছে।”

_” ইরফান,উঠ এবার।চল বাড়ি যাই।সারাদিন খাওয়া না, গোসল না—কি একটা অবস্থা।শালা,দেবদাস হবি তুই?”

_” জানি না।”

রাফায়েত দীর্ঘশ্বাস ফেলে।যত যাই বলুক না কেন,ইরফানের অবস্থা দেখে হাত-পা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার।মেয়েটা কি পাগল?এতো ভালোবাসা চোখে পড়ে না?তথাকে কষে গালি দিতে ইচ্ছে করে।রাফায়েতের সাধ্য থাকলে এই মুহূর্তে তথাকে ধরে এনে ইরফানের সাথে বিয়ে দিয়ে দিত।ভাইয়ের মতো বন্ধুর এতো যন্ত্রণা সহ্য হচ্ছে না তার।

_” বাস ছাড়ার আগে তথা কি বলেছে,জানিস?”

_” কি বলেছে?”

_” বলেছে,বাবা আমার বউ হিসেবে ওকে মানবে না।”

_” কথাটা কিন্তু খুব বেশি ভুল না।আর কেউ না জানলেও তুই তো জানিস,আঙ্কেল কতটা রক্ষণশীল।”

_ ” আগে এতোটা ছিল না।হুট করেই হয়ে গেছে।”

_” বয়স হওয়ার সাথে সাথে রুচি বদলেছে।তথার নাটকটা অন এয়ার হওয়ার পর, তোর বউ হিসেবে আঙ্কেল কখনোই তথাকে মেনে নিবে না।নায়ক-নায়িকাদেরকে সাধারণ বাঙালি পরিবারগুলো একটু অন্য চোখে দেখে। ”

_” সবাই কি এক হয়?”

_” হয়তো না।কিন্তু আমাদের মাঝে প্রচলিত ধারণাগুলো একইরকম। আমরা ধরেই নেই, ঘর-সংসার এসব নায়ক-নায়িকাদের জন্য নয়।তাছাড়া,তোর ক্ষেত্রে আরেকটা সমস্যা আছে।তুইও বোধহয় আঙ্কেলের কথার বাইরে কিছু করবি না।”

_” রাফায়েত আমার বাবা জীবনে অনেক কষ্ট করেছে।পনেরোটা বছর বিদেশে ছিল।কষ্ট ছাড়া হতদরিদ্র অবস্থা থেকে আজ এই অবস্থায় পৌঁছাতে পারেননি।বাবা এতোটা ত্যাগ স্বীকার না করলে হয়তো আমরা এতো ভালো অবস্থায় থাকতে পারতাম না।আমি হয়তো পড়াশোনা বাদ দিয়ে নিম্ন পদের কোনো কাজ করতাম।আমাদের জীবনকে সহজ করার জন্য যিনি মাথার ঘাম পায়ে ফেললো,তাকে কি অমান্য করব বল।বাবার কথার বাইরে জ্বিভ নাড়ার সাধ্য আমার নেই।”

_” এজন্যই তো বলছি,তথাকে ভুলে যা।এড়িয়ে চল।ভবিষ্যতে যা হবেই তার প্রস্তুতি এখন থেকেই নে।আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, তথার পেশার কারণেই তোদের বিয়েটা আটকাবে।তাছাড়া মেয়েটাও রাজি না।শুধু শুধু নিজের সম্মান খুইয়ে লাভ আছে?”

ইরফান দেয়ালে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়।তার দৃষ্টিতে বিচলতা।মাথার চুল এলোমেলো,গায়ের টি-শার্ট ঘামে ভেজা।মন স্থির করে ফেলে ইরফান।যা হবে না তা ভেবে লাভ নেই। তথা একমুঠো স্বপ্ন যাকে বাস্তবে ধরা-ছোঁয়া যায় না।তথা বাক্সবন্দি রঙিন প্রজাপতি।এক কল্প রাজ্যের সুখময় অনুভূতির নাম তথা।কল্প রাজ্যে এক মস্ত তালা ঝুলিয়ে দেয় ইরফান।আজ থেকে তথা বন্দি।তার কথা আর ভাববে না ইরফান।মিথ্যে স্বপ্নের দিকে আর হাত বাড়াবে না সে।নিজের ইচ্ছেতেই তো চললো এতোদিন। আজ থেকে নাহয় রাফায়েতের বুদ্ধিতেই চলবে।মন নয় মস্তিষ্কের কথায় তাল মিলাবে সে।তথা প্রথম প্রেম।ভুলে যাওয়া সহজ নয়।
তবে ইরফান চেষ্টা করবে।আপ্রাণ চেষ্টা করবে।তথার কথা মনে পড়লেই ধমক দিয়ে মনকে শাসন করবে।তথার নম্বর ডিলেট করে দেবে,তথার সব ছবি ডিলেট করে দেবে।তথাকে নিয়ে অনেক কথা ডায়রিতে লেখা আছে।সেসব পাতা কেটে কুচি কুচি করে ফেলবে। দেখাই যাক সেই ভয়ংকরীর মায়া থেকে বের হওয়া যায় কি না।

চলবে…

#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-৯)
#হালিমা রহমান

বিশাল এক খাটের এককোনে সোনালী, আরেক কোনে তথা।দোতলার এই ঘরটা শুধু তথা ও সোনালীর।বিষয়টা ভালো লেগেছে তথার।গাদাগাদি করে থাকা যায়? দুজনে বেশ আরামে থাকতে পারবে এই ঘরে।তাছাড়া,সোনালীর সাথে বেশ ভাব তথার।রুমমেট হিসেবে সোনালী একদম পার্ফেক্ট।আর কোনো মেয়ের সাথে তথার পরিচয় নেই।একদম অচেনা কারো সাথে রুম ভাগ করতে হলে একটু সমস্যাতে পড়তেই হতো।দোতলায় অনেকগুলো ঘর।এক ঘরে দুজন করে থাকছে।তথাদের ঘরটা একটু কোনার দিকেই।তাদের রুমের পাশেই আরেকটা রুম।তথা ঘরে ঢুকার সময় দেখেছে রুনটা তালাবদ্ধ। কেউ বোধহয় থাকে না সেখানে।তথা খাট বসে এদিক-ওদিক নজর বুলায়।বিশাল ঘরে একটা খাট,একটা আলমারি,একটা টেবিল, দুটো চেয়ার।আর আছে কয়েকটা ফুলদানি। ফুলদানিতে কৃত্রিম ফুল। ফুলগুলো নতুন রাখা হয়েছে মনেহয়।সাদা রঙের কাপড়ের ফুলে একফোটা ধুলো-ময়লা নেই।তথাদের খাটের পিছনের দেয়ালে একটা দামী পেইন্টিং। তাতে স্থান পেয়েছে অসামান্য সুন্দরী এক নারী।সাদা রঙের শাড়ির উপর শরীরে একগাদা গয়না।মিষ্টি হেসে চেয়ে আছে সামনের দিকে।এরকম সুন্দরী নারী বাস্তবে আছে কি না তা জানে না তথা।তবে এই বংশের অতীত ইতিহাস যে খুব একটা ভালো ছিল না তা বেশ বুঝতে পারছে তথা।এ বাড়িতে আসার পর থেকে দুটো জিনিস খুব চোখে পড়েছে তথার।এক – ফুলদানী আর দুই -নারীমূর্তি ও সুন্দরী রমনীদের পেইন্টিং।যাদের অব্যবহৃত বাড়িতে এতো এতো নারীচিত্র , তাদের চরিত্র যে কতখানি কালিমালিপ্ত ছিল তা বুঝতে কষ্ট হয় না।আচ্ছা,আগের রাজা-বাদশা- জমিদার সবার কি এই একটাই দূর্বলতা ছিল?নাটক-সিনেমাতেও তো এগুলোই দেখায়।তথা অনেক আগে একটা হিন্দি ছবি দেখেছিল।ছবিটার মূল উপজীব্য ছিল এক মধ্যেবয়স্ক জমিদারের বহুবিবাহ। লোকটা একের পর এক বিয়ে করতেই থাকে, করতেই থাকে। পনেরো তম বিয়ের পর আবার তার শখ জেগেছে সে বিয়ে করবে।পাত্রী হিসেবে পছন্দ করে রাজবৈদ্যের মেয়েকে।মেয়েটার বয়স তখন সবে এগারো।অন্যদিকে জমিদারের বয়স পঁয়তাল্লিশ। রাজার পছন্দের কাছে হার মানে রাজবৈদ্য।পুতুল বিয়ের নাম করে কাপুরুষটা রাজার সাথে ছোট্ট মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা করে।ছবির এর পরের অংশটুকু আর দেখেনি তথা।এটুকু দেখেই তার গা ঘিনঘিন করেছে।একটা বাবা কখনো এরকম করে? তথা নিজের বাবাকে দেখেনি,বাবার কোলের উষ্ণতা অনুভব করেনি।তবুও সে জোর দিয়ে বলতে পারে,বাবারা কখনো এতোটা কাপুরুষ হয় না।বাবাকে না দেখুক,পিতৃসম চাচাকে তো দেখেছে।তার চাচাও কোনোদিন এমন কাপুরুষের মত আচরণ করতে পারতো না।বাবারা কখনো কাপুরুষ হয় না, তারা হয় বীরযোদ্ধা।তাছাড়া জমিদারেরও আক্কেলের অভাব।কি করে পারলো মেয়ের বয়সী একটা শিশুকে বিয়ে করতে?আগের দিনের বেশিরভাগ জমিদারদের বোধহয় আর কোনো কাজ ছিল না।সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চেপে ভোগ-বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে।এজন্যই টিকতে পারেনি।শাসনের নামে শোষণ করলে কেউ আবার বেশিদিন টিকে থাকতে পারে?

তথার চোখ যায় জানালার দিকে।একটা বিশাল বড় জানলা আছে ঘরে।জানলা দিয়ে বাড়ির পিছন দিকটা দেখা যায়।বড় বড় ডালপালা মেলে দিয়ে বয়স্ক গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে।অন্ধকারে গাছগুলো চিনতে পারলো না তথা।চেনার চেষ্টাও করলো না।চোখ ফিরিয়ে নিলো।ইউসুফের কথাগুলো মনে আছে তথার।এ বাড়িতে নাকি জ্বিন-ভূত আছে।থাকতেও পারে। এতো এতো বয়স্ক গাছের ভীড়ে জ্বিন-পরী না থাকাই বরং অস্বাভাবিক। তথার গায়ে কাটা দেয়।সে খুব ভীতু মেয়ে।জ্বিন-ভুতের কথা শোনার পরেও অন্ধকারে তাকিয়ে থাকার সাহস তার নেই।

_” এই তথাপু,তোমার কি ক্ষুধা লেগেছে?”

_” না।কেন?”

_” আমার খুব ক্ষধা পেয়েছে।আমাদেরকে খেতে-টেতে দেবে না? ”

_” কি জানি।তাছাড়া খুব বেশি রাত হয়নি এখনো।আরো পরে হয়তো খেতে ডাকবে।আমার কাছে শুকনো খাবার আছে।খাবে? ”

_” অবশ্যই।না খেলে ওগুলো নিজের কাছে রেখে দিয়েছ কেন? ক্ষুধার্ত মানবীকে তোমার চোখে পড়ছে না?”

তথা মুচকি হাসে।খাট থেকে নেমে আলমারির থেকে নিজের ব্যাগ বের করে।দু- প্যাকেট চিপস এখনো আছে।সোনালীর দিকে চিপসের প্যাকেট বাড়িয়ে দেয় তথা।সোনালীও বেশ আরাম করে আয়েশী ভঙ্গিতে চিপস খায়।তার সত্যিই খুব ক্ষুধা পেয়েছে।

_” আচ্ছা তথাপু,তুমি এখানে চান্স পেলে কি করে? শতদল মাল্টিমিডিয়ার খবর কি করে পেয়েছ তুমি?”

_” আমার চাচার মাধ্যমে।ডিরেক্টর আখতার হোসেন আমাদের গ্রামের লোক।শতদল মাল্টিমিডিয়ায় কাজের খবরটা সর্বপ্রথম কাকাই আমায় দেয়।এরপর অনেকটা শখের বশেই একটা স্ক্রিনটেস্ট দেই।ভোজভাজির মতো সিলেক্টও হয়ে যাই।”

_” তোমার বাবা-মা নেই?”

_” না। চাচার কাছেই মানুষ হয়েছি।”

_” এতোদূর আসতে নিষেধ করেনি তোমায়?প্রথমবার তো তাই বলছিলাম আরকি।”

_” কাকি তো কিছুতেই আসতে দিবে না।কাকার সহায়তায় এসেছি এখানে।কাকা না থাকলে কিছুতেই আসতে পারতাম না।এই কাজটা আমার জন্য খুব দরকার ছিল।”

_” কি এমন দরকার যে ঘর-বাড়ি ছেড়ে এতোদূর আসতে হলো?”

_” আমার একটা ছোটবোন আছে।রুবাইদা নাম।ক্লাস টেনে পড়ছে এবার।ওর পিত্তথলিতে পাথর হয়েছে।পাথর নাকি আরো আগেই হয়েছিল।কিন্তু ধরা পড়েছে দেড় মাস আগে।রুবাইদার যখন খুব পেট ব্যাথা করতো , তখন আন্দাজে যেকোনো একটা ব্যাথার ঔষধ বা গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ খেয়ে নিত।আমাদেরকে বলতো না।ওর সমস্যা আমাদের চোখে পড়েছে মাস কয়েক আগে।পেট ব্যাথায় একদম পাগলের মতো করতো।পরে আমি আর কাকা হাসপাতালে নিয়ে যাই। আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্টে পিত্তথলির পাথর ধরা পড়ে।রুবাইদার ট্রিটমেন্টের জন্য অনেক টাকার দরকার।কাকা একা কিছুতেই পারবে না।কাকাকে সাহায্য করার জন্য একটা চাকরি খুঁজছিলাম।ঠিক সেই সময়ে এখানে চান্স পাই।অভিনয় আমার শখ আবার একইসাথে এই মুহূর্তে আমার দরকার।তাই দেরি করিনি।সুযোগটা লুফে নিয়েছি একদম।”

একটানা এতোগুলো কথা বলে হাঁপিয়ে উঠলো তথা।খাটের একপাশে উঁচু করে রাখা বালিশে হেলান দেয়।সোনালী খাওয়া বন্ধ করে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তথার দিকে।তার কপালের চামড়াগুলো দুই ভ্রুর মাঝখানে জড়ো করা।সোনালীকে দেখে মনে হচ্ছে সে গভীর ভাবনায় মগ্ন।তথা তাই ঘাটলো না ওকে।বেশ কিছুক্ষণ পর সোনালী নিজ থেকেই আবার প্রশ্ন করে তথাকে।

_ ” আচ্ছা তথাপু,এই রিপোর্টের কথা আর কে জানে?”

_” শুধু আমি আর কাকা ।আর এখন তোমাকে বললাম।কেন?”

_ ” ওই যে তখন তুমি বললে না,তোমার কাকি এখানে আসতে দিতে চায়নি।তাই বললাম।যদি তিনি মেয়ের অসুখের কথা জানতেন তাহলে বোধহয় নিষেধ করতেন না।তিনি মা।তিনি নিশ্চয়ই চাইবেন তার মেয়ের চিকিৎসা হোক।”

_” কাকির হার্ট খুব দূর্বল।তাই বলিনি।রুবিও মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী।ও জানলে হয়তো ভেঙে পড়বে,পড়াশোনা ছেড়ে দেবে।তাই ওকেও বলিনি।”

_ ” ডাক্তার ওকে কোনো ঔষধ দেয়নি?”

_” দিয়েছে।এখনি অপারেশন সম্ভব না।তাই ব্যাথা দমিয়ে রাখার জন্য ঔষধ দিয়েছে ডাক্তার।”

_” ঔষধ দেখে প্রশ্ন করেনি রুবি?”

_” ওরে বাবা! করবে না আবার? ওর কত কত প্রশ্ন।এতো ঔষধ কেন? পেট ব্যাথা না থাকলেও ঔষধ কেন খাব?ঔষধগুলো এতো বড় বড় কেন? হাজারটা প্রশ্ন ওর।”

_” কি বলে বুঝ দিয়েছো?”

_” বলেছি ওগুলো গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ।”

_” ওহ,আচ্ছা।”

তথা বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে।ফুরফুরে মনটা খারাপ হয়ে গেছে রুবাইদার কথা ভেবে।বোনটা তার খুব আদরের।তথার যখন পাঁচ বছর,তখন রুবাইদার জন্ম।রুবাইদা তথার আপন বোন না।তাই রুবাইদার জন্মের পর, পাড়া-প্রতিবেশীরা তথাকে দেখলেই আফসোস করতো।স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে তাকে ডেকে ডেকে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞেস করতো।আকলিমা বেগম আগের মতো আদর করে নাকি,খাইয়ে দেয় নাকি,ইকবাল মিয়া ঘরে ফিরেই আগে তথার খোঁজ নেয় নাকি–এরকম হাজারটা প্রশ্ন।তথা তো তখন তাদের এতো প্রশ্নের উদ্দেশ্য বুঝতো না।সেও সরল মনে ঘরের কথা পরের কাছে বলতো।প্রতিবেশীদের প্রশ্নের উত্তরে আগ্রহের সাথে বলতোঃ” কাকি এখন মোটেও আদর করে না।খাইয়ে দেয় না,গোসল করিয়ে দেয় না।সারাদিন রুবিকে নিয়ে থাকে।রুবিকে খাওয়ায়, গোসল করায়।কাকাও আদর করে না।কাজের থেকে এসে আগে রুবিকে কোলে নেয়।রুবিকে সারামুখে চুমু দেয়।রুবির জন্য সেদিন এক সেট জামা এনেছে। আমার জন্য এনেছে শুধু একটা চিপস।এখন আমাকে কেউ আদর করে না।”

প্রতিবেশীরা তখন আফসোস করতো।আহারে! চাঁদের টুকরা মেয়েটার কপাল বুঝি ভাঙলো।নিজের অংশকে পেলে আর কেউ পরের অংশকে আদর করে? তথা তো আর আপন মেয়ে না।নিজের পেটের মেয়ে হলে এমন বদলে যেতে পারতো? উঁহু কখনোই না।
এসব নিম্নস্তরের কথা-বার্তা তথার মনে প্রভাব ফেললো।সে তো আর আপন- পর বুঝতো না।খালি বুঝতো রুবির জন্য ওর আদর কমে গেছে।রুবি না থাকলে কাকা-কাকি আগের মতোই আদর করতো।রুবি আছে বলেই তথাকে কেউ আদর করে না।এরপর থেকে তথা রুবির ধারে-কাছেও যেতো না।ঘরের কারো সাথে কথা বলতো না।নিজের কাজগুলো নিজেই করার চেষ্টা করতো।সারাদিন ঘরে বসে থাকতো।তথার এই অসংলগ্ন আচরণ আকলিমা খাতুনের চোখে পরে কয়েকদিন পরেই।এক সন্ধ্যায় রুবিকে ঘুম পাড়িয়ে তথার ঘরে গেলেন তিনি।তথা তখন খাটে বসে পড়ছিল।আকলিমা বেগম যেয়ে তথার পাশে বসেন।তথার চুলে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করেনঃ ” তথা, কি হইছে তোর মা?”

_” কিছু না”– আকলিমা খাতুনের হাত নিজের মাথা থেকে সরিয়ে দেয় তথা।
আকলিমা খাতুন রাগ করলেন না।তথার দিকে আরেকটু চেপে বসলেন।তথাকে জড়িয়ে ধরে বললেন ঃ” আমার মার কি হইছে? কাকির উপর রাগ করছে?”

তথার অপরিণত মনের অভিমান ঝরে পড়ে মুহূর্তেই।কাকির বুকে মাথা গুজে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে।

_” আমাকে তোমরা আদর করো না।সবাই শুধু রুবিকে আদর করে।”

_” কে কইছে তোরে?”

_” আমি বুঝতে পারি।আবার ঐ পাশের বাড়ির আন্টিরাও বলে।আমি তোমাদের আপন মেয়ে না।তোমরা এখন আর আদর করবে না আমাকে।”

আকলিমা খাতুনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।এই বিষাক্ত অভিযোগ মেয়েত মাথায় ঢুকানোর কোনো দরকার ছিল? আকলিমা খাতুন মেয়ের থেকে সবটুকু শুনেন।তারপর মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেঃ” রুবি তো এখন অনেক ছোট। তাই ওরে সময় বেশি দিতে হয়।আমার তথা মা কি রুবির মতোন পিচ্চি? তুই যখন এইটুকু আছিলি,তখন তোরেও এমনেই পালছি। আমার তথার মাথায় অনেক বুদ্ধি।তুই বল,রুবিরে সময় না দিলে সে বড় হইতে পারব?আর কাকির অনেক কাজ থাকে না?কাকি কি সবদিকে নজর দিতে পারি? মাইনষের কথা আর শুনবি না।এই যে আমি তোরে আদর কইরা চুল বাইধা দেই,তোর পছন্দের খাবার রান্না করি– ওরা কি এগুলি করে? ”

তথা মাথা নাড়ে।আকলিমা খাতুন মেয়ের চুলের উপর চুমু দেয়।

_” ও গো কথা আর শুনবি না।আমরা যা করি তোর ভালোর লেগাই করি।রুবি তোর ছোট বইন।তুই না বড়? বড় বইনেরা ছোট বইনেরে আদর করে।তুই করোছ না কেন? আদর না করলে রুবি তোরে আপু ডাকব না।তোর কাছেও যাইব না।এডা কি ভালো হইব?”

এরপর থেকে রুবি যেন তথার প্রাণ হয়ে উঠলো।রুবি তার সর্বক্ষণের খেলার সাথী,আদুরে পুতুল।রুবির কখন কি দরকার, রুবির ইচ্ছা,রুবির চাহিদা-শখ এসব তথার চাইতে বেশি আর কে জানে?রুবির জন্য নিজের কলিজাটাও কেটে দিতে হয়তো দ্বিধা করবে না তথা।বড় আদরের,বড় সাধের বোন তার।টাকার অভাবে রুবির চিকিৎসা বন্ধ হয়ে থাকবে–তা কি কখনো মেনে নিবে তথা? উঁহু, কখনোই না।এজন্যই তো এতোদূরে আসা।পড়াশোনা বাদ দিয়ে,ঘর-বাড়ি বাদ দিয়ে আজ এখানে এসেছে তথা।সংসার চালিয়ে,রুবির চিকিৎসা চালানো একেবারে অসম্ভব ইকবাল মিয়ার পক্ষে।তাই তো হাজার বারণ পায়ে ঠেলেছে তথা।কোনোদিন আকলিমা খাতুনের নিষেধ অমান্য করেনি।এবার এতো মরিয়া হয়ে কেন নিষেধ অমান্য করলো? সব তো এই রুবির জন্যই।না হয় মায়ের মতোন মানুষটার কথা অমান্য করতো? অন্য কোনো চাকরি বা উপায় থাকলে তথা পঞ্চগড় আসতো না।কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত কোনো ভালো মানের চাকরি করার যোগ্যতা তার নেই।সবে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে।এতুটুকু পড়াশোনায় টিউশনি ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।আর টিউশনির টাকায় রুবির চিকিৎসা তো দূরের কথা সংসারের তিনবেলা খাবারের যোগাড় করাও সম্ভব না।সবকিছু ভেবে-চিন্তেই কাকির অবাধ্য হয়েছে তথা।এই কাজটা একইসাথে তার শখ এবং প্রয়োজন।রুবির চিকিৎসার প্রয়োজনীয় খরচাপাতি আখতার হোসেন দিচ্ছেন।তথার পারিশ্রমিক তিনি শুটিংয়ের আগেই দিয়ে দিয়েছেন।কয়েকদিন পরেই রুবির অপারেশন। কাকি যখন তথার অবাধ্যতার সঠিক কারণ জানবে,তখন নিশ্চয়ই আর রাগ করে থাকতে পারবে না।তথা চোখ বন্ধ করে।মনে মনে আল্লাহর কাছে মন খুলে বোনের জন্য দোয়া করে।

–” রুবিকে ঠিক করে দেও, খোদা।প্রয়োজনে আমার সুস্থতার একাংশ রুবিকে দান করো।তাও ওকে সুস্থ করে দেও,প্লিজ।”

***

চারদিকে নিস্তব্ধ রাত।কোথাও কোনো সাড়া-শব্দ নেই।যে যার ঘরে সুখনিদ্রায় মজে আছে।গ্রামে একটু রাত হলেই চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায়।আর গভীর রাত হলে তো কথাই নেই।চারদিকে কেবল শব্দহীনতা। তথা ঘুমিয়ে কাদা।সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বেশ তৃপ্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছে সে।ঘড়িতে বোধহয় আড়াইটা বাজে।হুট করে দু-চোখের পাতা খুলে ফেলে সোনালী।একটুখানি মাথা উঁচু করে তথার দিকে তাকায়।সে ঘুমিয়ে আছে।পা টিপে টিপে খাট থেকে নেমে দাঁড়ায় সোনালী।একটুও শব্দ হয় না।পরনের ঘাগড়া পাল্টে কালো রঙের জিন্স পরে নেয়।চুলগুলো মাথার উপরে শক্ত খোপায় বেঁধে নেয়।মোবাইলের সিম খুলে অন্য একটা সিম ভরে নেয়।তারপর আরো একবার তথার দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
ধীরে ধীরে শব্দহীন পায়ে হাঁটে সোনালী।হৃৎপিণ্ডে তুমুল শব্দ হচ্ছে।সোনালী ভীতু মেয়ে নয়।কিন্তু তবুও খুব ভয় হচ্ছে এখন।মনে হচ্ছে এই বুঝি কেউ পিছন থেকে ডাক দেয়,এই বুঝি হাতেনাতে ধরে ফেলে তাকে।এখানে আসার আগে আহমেদ বংশের ইতিহাস পড়েছে সে।কোন জমিদার কি করেছে,যে কতখানি খারাপ ছিল তার সবটাই জানে সোনালী।তাই ভয়টা একটু বেশিই হচ্ছে। আহমেদ ইউসুফ ভয়ংকর মানুষ।সোনালীকে ধরতে পারলে সে যে কি করবে তা আন্দাজ করতে পারে না সোনালী।দুরুদুরু বুকে ধীরে ধীরে নিশাচর প্রাণীর মতো নিচতলায় চলে আসে সোনালী।দরজা খুলে বেরিয়ে আসে বাইরে।কোনো বাতাস নেই আশেপাশে। গুমোট আবহাওয়া।গাছের একটা পাতাও নড়ছে না।আজ বোধহয় অমাবস্যা চলছে।চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার।এই অন্ধকার সোনালীর জন্য আশীর্বাদ। আপাতত তাকে দেখা যাবে না।একটা বিশাল গাছের পিছনে চলে যায় সোনালী।হাতের উল্টোপিঠে ঠোঁটের উপরের ঘাম মুছে নেয়।অতি সন্তর্পণে মোবাইলের আলো জ্বালে। কল করে কাঙ্ক্ষিত নম্বরে।বার দুয়েক রিং হয়।কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই নির্ধারিত ব্যক্তিটি ফোন ধরে।
সোনালী নিচু গলায় বলেঃ” হ্যালো,সোনালী বলছি।”

_” মিস সোনালী, টেল মি ইয়োর কোড নম্বর প্লিজ।”–ওপাশ থেকে খ্যাটখ্যাটে গলা শোনা যায়।

সোনালী বিরক্ত হয় খুব।এই রাতদুপুরে কত ঝুঁকি নিয়ে ফোন করেছে।এতো ঢং করার সময় আছে?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here