তনয়া #পর্ব-১৯,২০

0
921

#তনয়া
#পর্ব-১৯,২০

তনুর হাত ধরে কেঁদেই চলেছে মিশকাতের মা।তনু যে তার ছেলেকে রক্ত দেবে তা কখনও ভাবেন নি তিনি।এতকিছুর পরেও তনু আজ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।অপারেশন থিয়েটারে মিশকাতকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।তনু চুপচাপ বসে আছে।দুব্যাগ রক্ত দেয়াতে খুব দুবর্ল লাগছে।তানভীর সাহেব এক ব্যাগ দিতে বললেও সে কথা মানে নি তনু।সে তো মিশকাতের জন্য নিজের শরীরের সবটুকু রক্তই দিয়ে দিতে পারে।অনেকটা জোর করেই সে দুব্যাগ রক্ত দিয়েছে।এখন মাথাটা ঝিমঝিম করছে। মিশকাত কে এক নজর দেখার জন্য মনটা ছটফট করছে। নিজেকে খুব বিধ্বর্স্ত লাগছে।বারবার শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছে,

“মিশকাত ভাইয়ের কিছু হবে নাতো?” এই আশংকায় ভেতরটা শুকিয়ে গেছে।

অন্যদিকে সবারই একি অবস্থা।হসপিটাল ভর্তি হয়ে গেছে আত্মীয় স্বজনদের।ডাক্তার নার্সরা এ নিয়ে রাগারাগি করেছে বেশ কয়েকবার।আজ মিশকাতকে বেডে দেয়া হবে না।জ্ঞান ফিরলে বিশেষ অর্জারভেশনে রাখা হবে।সকালে কেবিনে শিফট করা হবে।সবাই এখন আপারেশন শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছে।

তনু চোখ বন্ধ করে মিশকাতকে নিয়ে ভাবছে।সিলেটে কাটানো সেই সুন্দর মুহূর্তে গুলো ডানা ঝাপটাচ্ছে চোখের পাতায়।সেই কিশোর বয়সের ভালো লাগা আজ কতটা পূণর্তা পল?!ভালোবাসা আজ জীবন মরন সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে।তনুর গাল বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরল।সবার আড়ালে তা মুছেও নিলো।

ঘন্টাখানেক পর ডাক্তার এসে জানালেন, “অপারেশন শেষ হয়েছে। তবে মিশকাতের জ্ঞান ফিরেনি এখনও। পায়ের একটা হাড় ভেঙে গেছে। মাথায়ও চোট আছে।বুকের কাছের জখমটা বেশি ভয়াবহ ছিলো না জন্য মিশকাত আল্লাহর রহমতে বেঁচে গেছে।তবু সুস্থ হতে অনেকটা সময় লাগবে।”

সকলে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করলো।তনুর তো এখনও ভয়ে কাটছে না। বুকের ধুকপুকানি কমছে না।যতক্ষণ না মিশকাতকে নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছে ততোক্ষণ সে শান্তি পাবে না।

ধীরে ধীরে অনেকে চলে গেল।তানভীর সাহেব তনু কাছে এসে বসলেন।

“বাড়ি যাবি না,মা?”

“এখন যেতে ইচ্ছে করছে না বাবা।”

“তোর শরীর তো দুর্বল হয়ে গেছে।তোর বিশ্রাম প্রয়োজন এভাবে সারারাত বসে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বি?”

“আমার কিছু হবে না বাবা।আমি এখন বাড়ি যেতে পারব না।সকাল হলে নাহয় চলে যাব।”

তানভীর সাহেব এত কষ্টের মাঝেও নিরবে হাসলেন।তনুর কষ্টটা কোথায় হচ্ছে বুঝতে পারছেন।মিশকাত সুস্থ না হলে তার মেয়েটাও সুস্থ হবেন।মিশকাত হয় আজ শারীরিক ভাবে অসুস্থ কিন্তু তনু,সে তো মানসিক ভাবে জখম হয়েছে!

***
আরাফ সকাল বেলা মিষ্টি নিয়ে এসেছে খালার বাড়িতে।এসে দেখল রাফাত আয়রা দুজনের কেউই নেই। হাসলো আরাফ, থাকবে কি করে?এখন তো ছোটাছুটির সময়।খালাকে জোর করে মিষ্টি খাইয়ে দিলো সে। খালা যখন জানতে চাইলো,

“কিসের মিষ্টি? ”

আরাফ তখন হেসে উত্তর দিলো,

“আমার একটা স্বপ্ন পূরণ হয়েছে খালা।তাই সবাইকে মিষ্টি মুখ করাতে এলাম। তা রাফাত আর ভাবীকে দেখছি না যে?কোথায় গেছে ওরা?”

“আর বলিস না হঠাৎ কি বিপদ!আয়রার মামাতো ভাই এক্সিডেন্ট করেছে, অবস্থা খুব খারাপ ওরা দুজনেই তো ছুটেছে সেখানে।কাল বিকেল থেকেই তো ওরা হসপিটালে।আরাফ ফোন করেছে ওইদিকটা সামলে তারপর আসবে।”

“তাই নাকি,খুব গুরুতর ভাবে এক্সিডেন্ট হয়েছে বোধহয়!”

“ছেলেটার বাইকের সাথে ট্রাকের ধাক্কা লেগেছে।জখম হয়েছে অনেক রক্ত লেগেছে।তার ওপর আবার সেই রক্ত পাওয়া যাচ্ছিল না নেগেটিভ গ্রুপের। ভাগ্য ভালো আয়রার বোনটারও একি ব্লাড গ্রুপ।তাই বেশি সমস্যা হয়নি।”

আরাফ কপাল কুঁচকে ফেলল।আয়রার বোন মানে খালা নিশ্চয় তনয়ার কথাই বলছে!রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল তার।তনয়া কেন রক্ত দেবে মিশকাতকে?এতো দেখি প্রেম উথলে উঠছে!আসলে ভুলটা তারই হয়েছে।বেয়াদবটাকে একদম মেরে দেয়াই উচিত ছিল!

“আচ্ছা, খালা আমি কি যাব একবার হসপিটালে?”

আয়রার শ্বাশুড়ি একটু চমকালেন।আরাফের তনয়াকে নিয়ে এমনিতেই বাড়াবাড়ি করার অভ্যাস আছে।তার ওপর ওখানের পরিস্থিতি এখন ভালো নয়।কি থেকে কি হয়ে যায় বলা যায়!আরাফটা নতুন কোনো ঝামেলা পাকালে আবার সমস্যা তৈরী হবে।তাই তিনি বললেন,

“তোকে যেতে হবে না।তোর বাবা শুনলে রাগ করবে।রাফাতরা তো আজই ফিরবে তখন ওদের কাছ থেকেই ভালোমন্দ শুনিস।”

আরাফ ফিচলেমি হেসে বলল,

“তুমি কি ভয় পাচ্ছো খালা?”

“শোন বাবা,ওখানে তনয়ার পরিবার সবাই আছে।তুই গেলে সবাই অসস্তিতে পরবে।তাছাড়া দুলাভাই শুনলে তোকে সত্যি সত্যি বিদেশ পাঠিয়ে দেবে এবার।”

“হুম ঠিক বলছো।আমার ওখানে গিয়ে কাজ নেই।আমার কাজ তো অনেক আগেই সেড়ে ফেলেছি।”

“কি কাজ তোর, আরাফ?”

“তোমায় বললাম না আমার একটা অনেকদিনের ইচ্ছে পূরণ হয়েছে সেটাই বললাম। ঠিক আছে তুমি থাকো আমি আসলাম অফিসে যেতে হবে। ”

***

মিশকাতের জ্ঞান ফেরার ঘন্টাখানেক পর কেবিনে শিফট করা হয়েছে।ডাক্তার বেশি লোকজনকে এলাউ করছে না কেবিনে।তাই প্রথমে মিশকাতের বাবা মা গেলেন ছেলেকে দেখতে।মিশকাতের মা ছেলের এমন দুর্বস্থা সহ্য করতে পারলেন না।হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।মিশকাতের বাবা দ্রুত স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন।মিশকাতের শরীরের প্রায় জায়গায় ব্যান্ডেজে মোড়া।মাথায় ব্যান্ডেজ,বুকের কাছে অনেক খানি এবং পায়েও ব্যন্ডেজ। মিশকাতের খারাপ লাগছে মায়ের কান্না দেখে।কি করে যে পেছন থেকে ট্রাকটা এসে ধাক্কা দিলো তা বুঝতেই পারেনি।সে তো ঠিকমতই বাইক চালাচ্ছিল!

একে একে সবাই এসে দেখে গেল শুধু তনু ছাড়া।মিশকাতের চোখ জোড়া শুধু তনুকেই খুঁজলো।তনু কি আসে নি তাহলে?

মিশকাত চোখ বুজলো।শরীরের ব্যাথার থেকে মনের ব্যাথায় কাতর হলো।একটা বার কি আসতে পারতো না তনু।এতটা সীমার হতে পারল মেয়েটা?ভালোবাসে যদি তাহলে কি করে এতটা দূরে সরে থাকে?

দরজার মৃদু আওয়াজে চোখ খুলল মিশকাত।তনুকে তার পাশে দেখতে পেল।তনু কেমন নির্লিপ্ত চোখে তার দিকে চেয়ে আছে।হাসলো সে অবশেষে মনোহরিণীর দর্শন মিললো।তৃষ্ণা চোখে ঝর্ণার প্রবলধারা বইলো।

“আমাকে দেখতে খুব খারাপ লাগছে নাকি রে?এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?” মিশকাত মিলিয়ে যাওয়া গলায় বলল।গলার স্বর উঠছে না তার।

“তুমি কি কখনও সিরিয়াস হবা না মিশকাত ভাই?”

“আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে আমি নাটক করছি।যেন এক্সিডেন্ট এর সিন করছি তাই আমায় এভাবে মেকআপ গেটআপ করে দেয়া হয়েছে।”

তনু দীর্ঘশ্বাস ফেলল।মিশকাত ভাই ভালো হবে না।হসপিটালের বিছানায় শুয়েও ত্যাড়ামি করা ছাড়ল না।

“তুই কি কেঁদেছিস তনু?”

মিশকাতের এমন হঠাৎ প্রশ্নে তনু হচকিয়ে গেল।নিজের ঠাট বজায় রেখে বলল,

“কাঁদব কেন মিশকাত ভাই?কান্না করার মতন কি কিছু হয়েছে?”

“সেটাই তো। তুই তো জানতিস তোদের কাউকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাব না আমি।তোর তো কনফিডেন্স খুব বেশি আমার ওপর!” মিশকাত গদগদকন্ঠে বলল।

“এত কথা বলছো কেন তুমি?ডাক্তার কথা বলতে নিষেধ করেছেন, তুমি বরং ঘুমোও।”

“এতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম তাতে তোদের শান্তি হয় নি? এখন আবার আমায় ঘুমোতে বলছিস?”

তনু মনে মনে কপাল চাপড়ালো।এই ছেলের ত্যাড়ামি কখনও কমবে না।বরং হসপিটালের বিছানায় শুয়ে আরও বেড়ে গেছে।

আমি আসছি মিশকাত ভাই।আমার এখানে বেশিক্ষণ থাকার পারমিশন নেই।

“তোর কি থাকতে ইচ্ছে করছে?ইচ্ছে করলে পারমিশন ছাড়াই থাকতে পারিস!”

তনু মিশকাতের কথার জবাব দিলো না।টেবিল থেকে টিস্যু নিয়ে খুব যত্নে মুখটা মুছে দিলো।এরপর দ্রুত কেবিন থেকে বেড়িয়ে এলো।

মিশকাত তনুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে হাসল।তনুর চোখে তার জন্য কষ্ট দেখতে পেয়েছে।

তনু মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। তানভীর সাহেব ওখানেই রয়ে গেছেন।রাফাতও চলে গেছে আয়রাকে নিয়ে।মারুফ থেকে গেছে সবার সাথে।মিশকাতের মা ছেলের পাশে বসে আছেন।একদিনেই তার শরীর ভেঙে গেছে।ছেলের চিন্তায় তার পাগল হওয়া শুধু বাকি ছিল।একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে ফেললে তিনি আর বেঁচে থাকতেন না।

মিশকাতের কয়েকঘন্টা শুয়ে থেকে বিরক্ত লেগে গেছে।এভাবে শুয়ে থাকলে সবকিছু উল্টে যাবে তার।নতুন চাকরিটা না হারাতে হয়।

“মা,ডাক্তার কি বলল?কতদিন থাকতে হবে এখানে?”

“চুপ করে শুয়ে থাক তো বাবা।যতদিন না সুস্থ হবি ততোদিন তুই এখানেই থাকবি।ডাক্তার তোকে বেশি কথা বলতে নিষেধ করেছেন।”

“আচ্ছা মা,আজ যদি আমার কিছু হয়ে যেত, আমি যদি মরে যেতাম তাহলে কি তনুকে নিয়ে তোমার যে সমস্যা তার কোনো ভিত্তি থাকতো?”

মিশকাতের মা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।সত্যি তো আজ যদি ছেলেটাই বেঁচে না থাকত তাহলে এত জেদের ফলাফল কি হতো?

“তুই সুস্থ হয়ে যা বাবা।আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তোদের দুজনকে বিয়ে দিবো।তুই যা চাস তাই হবে।কখনও আর মরে যাওয়ার কথা মুখে আনবি না।”

মিশকাত মায়ের দিকে ছলছল দৃষ্টিতে রইলো।স্বপ্ন গুলো কি সত্যি হতে যাচ্ছে?

এরপর কেটে গেছে অনেকটা সময়।মিশকাত পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছে।চাকরিতেও জয়েন করেছে।অসুস্থতার জন্য মাস খানেক লিভ নিয়েছিল।পুরোদমে সব কাজ শুরু করে দিয়েছে।আর মাত্র কিছুদিনের অপেক্ষা এরপর তনুর থেকে আর দূরে থাকতে হবে না।আজ অফিস থেকে দ্রুত বেরিয়েছে।এখন সে তনুর ভার্সিটির বাইরে বসে আছে।আজ আয়রা রাফাতের প্রথম বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে আয়রার শ্বশুর বাড়িতে ঘরোয়াভাবে আয়োজন করা হয়েছে।সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান হলেও মিশকাত মারুফকে বিকেলের মধ্যে ডেকেছে।মিশকাত তনুকে নিতে এসেছে।কিছুক্ষণের মধ্যে মারুফও এসে যাবে।তনুকে সাথে নিয়ে যাওয়ার কারণ হলো আরাফ!বেয়াদব টা নিশ্চয়ই আজকের সুযোগটা ছেড়ে দেবে না।তনুকে আজ সে নিজের সাথে বেঁধে রেখে দেবে ওই বাড়িতে।আরাফকে কোনোরকম সুযোগ দেবে না।

তনু ভার্সিটি থেকে বেরোতেই মিশকাত সামনে এসে দাঁড়াল।বলল,

“দ্রুত চল আমার সাথে।আয়রা আপা বারবার ফোন করছে।”

তনু কপাল কুঁচকে ফেলল।মিশকাত ভাই ইদানীং তাকে বড্ড জ্বালাচ্ছে। বড়মামি সবকিছু মেনে নেয়ার পর থেকেই অন্যরকম হয়ে গেছে।বড়মামির কারণে মিশকাত ভাই অসুস্থ থাকার বেশ বেশ কয়েকবার তাকে মায়ের সাথে যেতে হয়েছে ওদের বাড়িতে।সেই থেকে মিশকাত ভাই পেয়ে বসেছে।তনু এত সহজে সবটা ভুলে যায় নি।সে যে বিশেষ একটা ব্যাপারে অক্ষম তা যতই কেউ ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করুক না কেন সত্যি টা তো মিথ্যা হয়ে যাবে না।সে তো সত্যি কোনোদিনও মা হতে পারবে না!এই চিরন্তন কথাটা তার জীবনে দিনের আলোর মতন স্বচ্ছ। এত সহজে যদি সব ঠিক হয়ে যেত তাহলে এত কষ্টের কিছু ছিল না!

“মিশকাত ভাই,আমি বাবার সাথে সন্ধ্যায় যাব আপার বাড়ি।তোমরা চলে যাও।”

ফুপা আমায় বলেছে,”তোকে নিয়ে যেতে।এত ভাব না নিয়ে তাড়াতাড়ি আয়।তোর সাজগোজ নিয়ে ভাবতে হবে না কারণ আজ তোকে আমি সাজতে দেব না।যেমন আছিস ঠিক সেভাবেই আজ অনুষ্ঠানে থাকবি।আপার বাসায় গিয়ে মুখটা ধুয়ে নিবি।”

তনু হা হয়ে তাকিয়ে রইলো মিশকাতের পানে।কি বলতে চাইছে বোঝার চেষ্টা করলো।এক্সিডেন্ট এর পর বোধহয় মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে বেচারার!

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here