#তনয়া
#পর্ব-২১(শেষপর্ব)
তনু আর মিশকাতের বিয়ে নিয়ে বড়রা প্রায় আলোচনা করলেও এ ব্যাপারে কোনো হেলদোল নেই দুজনের।তনু তো মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। বিয়ে সম্পর্কিত কোনো কথা তার মুখ থেকে শোনা যায় না।কেউ কিছু বললে চুপচাপ শুনে। মিশকাতের মা তো তাড়া দিয়েই চলেছেন।শায়লা বেগম তনুকে প্রতিনিয়ত বোঝাতে গিয়ে হাপিয়ে উঠছেন।তিনি ভেবে পান না মিশকাতকে যদি ভালোবেসেই থাকে তনু তাহলে বিয়েতে রাজি না হওয়ার কি আছে?বিয়ে তো করতেই হবে।একটা সমস্যার জন্য কারও জীবন থেমে থাকে কখনও?সমস্যা থাকলে সমাধানও থাকে।অন্যদিকে তনু নিজের সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত।সে মিশকাতের বেড়াজাল থেকে রেহাই পাচ্ছে না।বিয়ের কথা ভাবলেই অন্যরকম একটা ভয়ে কাঁপন ধরে যায়।সাহস কুলায় না।যদি চলতে চলতে মাঝপথে থমকে দাঁড়াতে হয়?নতুন আশা নিয়ে প্রস্বস্ত পথে হাটতে গিয়ে হঠাৎ কাঁটার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হতে হয়?তখন কি করবে সে?এভাবে নিজেকে সামলাতে পারবে তো?রাঙিয়ে দেয়া স্বপ্ন গুলো যদি কোনো একসময় দুঃস্বপ্নে পরিনত হয়?এসব ভাবনা তাকে দিনরাত তাড়া করে বেরোচ্ছো।কাউকে কিছু বলতে পারছে না।মাঝে মাঝে তো দমবন্ধ হয়ে আসে।দোটানায় দুলে ভালো থাকা যায়?একটা সমস্যার জন্য কি সে কখনও সুখি হতে পারবে না?
মিশকাতের চুপচাপ থাকার কারণ সে মোক্ষম সময়ে কথা বলবে।তনুকে কিছুদিন সময় দিচ্ছে। যত সময় লাগুক না কেন,সমস্যা নেই দিন শেষে তনু তারই হবে।তনু অবশ্য তার সাথে কথা বলে না।সেদিন আয়রা আপার পার্টিতে আরাফ ঠিকই ঝামেলা করেছিল।এ নিয়ে তনুর সাথে মিশকাতের একচোট হয়েছে।তনুকে বলেছিল যাতে কোনোরকম সাজগোজ না করে অনুষ্ঠানে, কিন্তু তনু সে কথা শোনেনি।গাঊন পরে হালকা মেকআপ করে নিজেকে অপ্সরা সেজে ঘুরে বেরোলে আরাফের মনে কুবুদ্ধি তো উদয় হবেই!তনু উজ্জ্বল শ্যামলা হলেও মায়াবি চেহারার অধিকারী।তনুর কাজলদিঘী চোখ দুটোর দিকে তাকালেই শান্ত হয়ে যায় মনটা।ইচ্ছে করে দীঘির শান্ত নিটোল ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আজীবন পার করে দিতে।আরাফে সেদিন সবসময় নজরে রেখেছিল সে।তাই তো আরাফ যখন লুকিয়ে তনুর ছবি তুলছিল সেসময় তার মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল।আরাফের শার্টের কলার চেপে ধরে সাবধান করে দিয়েছিল।আরাফ শোনেনি বরং মিশকাতকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল।তখনই আসলে ঝামেলাটা শুরু হয়।দুজনের প্রায় মারামারি লেগে যাবার যোগার হয়েছে।মিশকাত নিজেকে কন্ট্রোল করেছে আয়রার শ্বশুর বাড়ির কথা ভেবে।রাফাত নিজ দায়িত্বে আরাফের ফোন থেকে ছবি গুলো ডিলিট করেছিল।তনুর তো লজ্জায়,ভয়ে জান যায় অবস্থা।তাকে নিয়ে এভাবে দুটো ছেলের মাঝে ঝামেলা হচ্ছে ভাবলেই কেমন লাগে?কোথাও একটু শান্তি নেই তার।সেদিন রাগের মাথায় মিশকাত তনুকে থাপ্পড় মেরে বসেছিল।সেই থেকে তনু কেমন নিরব অভিমানে মিশকাতের সাথে সবরকমের সংযোগ কমিয়ে দিয়েছে।মিশকাত আসলে ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকে।ভার্সিটির সামনে দেখলে পাশ কাটিয়ে দ্রুত রিকশা নিয়ে বাড়ি ফিরে।ফোন দিলে কখনও রিসিভ করে না।অবশ্য এই ঝামেলার একটা ভালো দিক হয়েছে। আরাফের বাবা ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে দিয়েছেন। এ নিয়ে মিশকাত বেশ খুশি।আরাফ দেশে থাকলে সবকিছুতেই ঝামেলা পাকাতো।
আজ শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় মিশকাতকে ডাকা হয়েছে।সবাই তনুদের বাড়িতে এসেছে।ওদের দুজনের বিয়ের ব্যাপারটা আর ফেলে রাখা যাচ্ছে না।দুজনে খাপছাড়া এভাবে অভিমান নিয়ে তো জীবন কাটিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছে।বড়রা তো তা হতে দিতে পারে না।তাই আজ দুজনকেই পাকড়াও করা হয়েছে।শায়লা বেগম রান্নাঘরে ব্যস্ত।আজ সবার জন্য ভালোমন্দ রাঁধবেন।মিশকাতের মা টুকটাক সাহায্য করেছেন ননদ ভাবীর পুরোনো বন্ধুত্ব ফিরে এসেছে।তানভীর সাহেব একবার তনুর ঘরে আসলেন।তনু বিছানায় বসে আছে।হাতে একটা বই।হয়ত উপন্যাসের কিন্তু তনুর দৃষ্টি বইয়ের পৃষ্ঠায় নেই।বিছানার পাশের খোলা জানালাটার দিকে তাকিয়ে আছে।জানালাটা দিয়ে খোলা আকাশ ছাড়া কিছু দেখতে পাওয়া যায় না।তনুর দৃষ্টি খোলা আকাশের পানে।তানভীর সাহেব তনুর পাশে বসলেন।তনু বইটা বন্ধ করে বলল,
“তুমি বোধহয় কিছু বলতে এসেছো, বাবা?”
“আমি শুধু তোর মতামত জানতে এসেছি।তুই আমার “তনয়া” তোকে এত ভয় পাওয়া মানায় না।”
তনু করুন চোখে চেয়ে রইলো বাবা দিকে।সত্যি সে নতুন সম্পর্কে জড়াতে ভীষণ ভয় পাচ্ছে। বিয়ের কথা ভাবতে গেলেই মনে পরে যাচ্ছে অনেক কিছু।
তানভীর সাহেব মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
“দেখ মা সমস্যা থেকে কি কখনও পালিয়ে বাঁচা যায়?যত পালিয়ে বেরোবি সমস্যা তত তোর পিছনে ধাওয়া করবে।তুই একবার ঘুরে দাঁড়া। সমস্যাটার সাথে লড়াই কর দেখবি নিজেকে শক্তিশালী মনে হবে।তোর নামটা আমি খুব শখ করে রেখেছিলাম।সেই নামের মর্যাদাটা তোকে রাখতে হবে।জীবনে সমস্ত ঘাত প্রতিঘাত শক্ত হাতে মোকাবিলা করবি।তোর বাবা তো আছে তোর পাশে কখনও হারতে দেবে না। মিশকাত তোকে সেই পরিস্থিতিতে পরতেই দেবে না।দেখিস না ছেলেটা তোর জন্য গোটা পৃথিবীর সাথে লড়াই করতে প্রস্তুত। আমার পরে যদি তোকে কেউ খুব ভালোবাসতে পারে সেটা একমাত্র মিশকাতই পারবে!
“সেখানেই তো আমার ভয় বাবা।সেই প্রবল ভালোবাসা বইবার শক্তি যে আমার নেই?সেই ভালোবাসা যদি আমায় কখনও প্রশ্নবিদ্ধ করে বসে আমার অক্ষমতাকে নিয়ে তখন যে আমি ভেঙে গুঁড়িয়ে যাব বাবা!”
তানভীর সাহেব হাসলেন।মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
“সবাই এক হয় না রে, মা। কিছু কিছু পুরুষ সত্যি হয় যে নিজের সমস্ত সত্তা দিয়ে একজন নারীকে ভালোবাসতে পারে আগলে রাখতে পারে। মিশকাত তেমনি একজন।তোর বাবা তোকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছে না?তুই আজ নিজের যে অক্ষমতার কথা ভাবছিস দেখবি মিশকাত তোর সেই অক্ষমতাকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছে। ”
তনু বাবার বুকে মাথা রাখলো।বলল,
“আমার কি করা উচিত বাবা?”
“অবশ্য রাজি হওয়া উচিত।বেচারাকে আর কত অপেক্ষায় রাখবি।কখন না পাগলামি শুরু করে দেয়!
তনু লজ্জা পেয়ে মুখ লুকোলো বাবার বুকে।মিশকাত ভাইকে কি সে সত্যি সত্যি পেতে যাচ্ছে? তনু কেঁপে উঠলো অজানা শিহরনে।
এরপর গোটা বাড়িতে ধুম পরে গেল আনন্দের।মিশকাতই সবাইকে ধরে ধরে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে। মিশকাতের কান্ডে রাফাত মারুফ আয়রা হাসছে।এই ছেলের লজ্জা শরমের বালাই নেই।তনু তো সেই যে ঘরে ঢুকেছে বের হওয়ার নাম নেই।আগামী শুক্রবার ওদের বিয়ে। দুপুরে সবাই খেতে বসে তনুকে ডাকল।
শায়লা বেগম বললেন,
তনু লজ্জায় খেতে আসতে পারছে না। তোমরা সবাই খেয়ে নাও।আমি ওকে সাথে করে খেয়ে নিবো।
মিশকাত খেতে খেতে ভেংচি কাটলো।তনুর আবার লজ্জা!সব ঢং এতদিন তাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে আর এখন লজ্জা পাওয়া হচ্ছে?মনে যদি ছিলই তাহলে শুধু শুধু এত কষ্ট করলো কেন সে?তনু কি একবারও বলতে পারলো না মিশকাত ভাই, আমি তোমার হতে চাই! তুমি সব বাঁধা ডিঙিয়ে আমায় তোমার করে নাও!
তনু যদি একবার মুখ ফুটে বলতো সে আরও আগেই সবকিছু জন্য প্রস্তুত হতো।ভাগ্যিস নিজের অভিমান গুলো সরিয়ে সে আয়রা আপার বিয়েতে এসেছিল।তা না হলে তো জানতেই পারতো না!
মিশকাত যাবার আগে একবার তনুর ঘরে এলো।তনু ঘুমোচ্ছে, বিকেলের রাঙা আলো এসে পড়েছে আনকোড়া মুখটায়।মাখনের মতন লাগছে দেখতে।কালোঘন চোখের পাতা গুলো সারিবদ্ধ হয়ে নিশ্চুপে তাকে যেন কাছে ডাকছে।মিশকাত এগিয়ে এলো।তার মনে হলো তনু পরম শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। ঠিক যেন রূপকথার রাজকুমারীর মতো।যার কোনো দুঃখ দূর্দশা, দৈন্যতা নেই।মিশকাত মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলো প্রেয়সীর দিকে।জাগতিক সব নিয়মকানুন ভুলে।সময় যেন থমকে গেছে দুজনের মাঝে।
***
লাল বেনারসি শাড়ি জড়িয়ে তনু বাসর ঘরে বসে আছে।প্রচুর ক্লান্ত সে।বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আছে।বাবা মাকে ছেড়ে আসার কষ্টটা খুব করে পোড়াচ্ছে তাকে।মিশকাত এখনও আসে নি।বাইরে কি করছে কে জানে?ঘুমে দুচোখ বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে।যদিও আজ প্রাপ্তির খাতাটা পরিপূর্ণ। মিশকাত ভাইকে সে আজ থেকে তার সবচেয়ে কাছের মানুষ। গলার কাছে ভারী গহনা গুলো কেমন কুটকুট করছে।
মিশকাত ঘরে ঢুকেই বলল,
“তাড়াতাড়ি সব খুলে ফ্যাল।সময় নেই আমাদের যেতে হবে।”
তনু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল।হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো মিশকাতের দিকে।
তা দেখে মিশকাত বলল,
“তোর বিয়ে হয়ে গেল তবু বুদ্ধি বাড়ল না।” শাড়ি গহনা গুলো পাল্টে নে।আমাদের একটু বেরোতে হবে।”
তনুর দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো।দশটার কাটা পার হয়েছে।এত রাতে কোথায় যাবে সে।আর আজ তাদের বাসর রাত।এ রাতে তো কোথায়ও যাওয়ার নিয়ম নেই!
মিশকাত এগিয়ে এলো তনুর দিকে।একটু ঝুঁকে দুষ্টুমি চোখে বলল,
“তুই কি বাসর করার মুডে আছিস?
তনু চট করে উঠে দাঁড়ালো।লাগেজ থেকে একটা সুতি শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমের ঢুকলো জলদি।মিশকাতের মতন সেও মনে মনে আওড়ালো,
“তোমারও তো বিয়ে হয়ে গেল মিশকাত ভাই তবু ত্যাড়ামিটা গেল না!”
মিশকাত তনুর হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে তার স্বপ্নের জায়গায়।ছোট ছোট কয়েকটা নতুন ঘরের সামনে।সবগুলো বেলুন ছোট ছোট লাইট দিয়ে খুব সুন্দরভাবে সাজানো।তনু কাঁপছে তার চোখ ছলছল করছে।যেকোনো মুহুর্তে জল গড়িয়ে পরবে।যতবার সামনে জ্বলজ্বল করা সাইনবোর্ডটা দিকে তাকাচ্ছে ঠিক ততোবার মিশকাতের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরছে।
সাইনবোর্ডে গোটা গোটা কালিতে লেখা,”তনয়ার সুখের নীড়।”
মিশকাত ফিতে কাটার জন্য তনুর হাতে কাঁচি দিলে।তনু কাঁচিটা হাতে নিয়ে মিশকাতকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দিলো।মিশকাত তনুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
এখানে যত অনাথ শিশু আসবে সবার “মা” হবি তুই।এটা হবে তোর স্বপ্নের স্থান।একটা দুটো সন্তান জন্ম দেয়ার তোর কোনো দরকার নেই।তুই অনেক সন্তানের “মা” হবি।আমরা সবাই তোর এই পথ চলার পাশে থাকব।
তনু কেঁদেই চলেছে।চোখের পানিতে মিশকাতের শার্ট ভিজে যাচ্ছে। মিশকাত গাঢ় আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিলো প্রিয়তমাকে।ওদের শুদ্ধতম ভালোবাসার স্বাক্ষী হয়ে রইলো বিশাল আকাশ ও আকাশের বুকে থাকা একফালি চাঁদ টাও।
সমাপ্ত
(গল্পটা কেমন লেগেছে জানাবেন।)