#তনয়া
#পর্ব-৫
হলুদ অনুষ্ঠানের আনন্দ তিনগুন বেড়ে গিয়েছে রাফাতের আগমনে।অথচ এখানে আসার পর থেকে রাফাত লজ্জায় কাবু হয়ে আছে।আয়রার অবস্থাও একি।কিছুক্ষণ আগেই তো মানুষটা ভিডিও কলে কথা বলল।অথচ হুট করে চলে আসলো কাউকে কিছু না জানিয়ে।আরাফ সবাইকে বলছে,তাকেই নাকি সারপ্রাইজ দেবার জন্য এসেছে ওরা।আয়রার খুশি হলেও লজ্জায় রাঙা হয়ে বসে আছে।বড়রা সবাই নিচে নেমে গেছে।অনেকে তো মুখ টিপে হাসছিল।
তার এক কাজিন ফিসফিসিয়ে কানের কাছে এসে বলে গেছে,
“কিরে,তোর হবু বর তো দেখছি বউপাগল হবে।একরাতও ধৈর্য্য ধরতে পারলো না।তোর কপাল খুব ভালো রে, জামাই তোর আঁচলের তলায় থাকবে। ”
আয়রার লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। কেন যে এমন কান্ড করে বসলো মানুষটা? ভেবে পেল না সে। দরকার ছিল এসবের?সেই তো কাল বিয়ে হয়ে সারাজীবনের জন্য রাফাতের হয়ে যাবে সে!
তবে বুকের ভেতরটা অনাবিল সুখের ফোয়ারায় ভেসে যাচ্ছে।
তনু চোখমুখ কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করছে সবটা।রাফাত যদি সারপ্রাইজ দিতে এসেই থাকে তাহলে এত লজ্জা পাচ্ছে কেন?আপার সাথে নাচ করতে কিছুতেই রাজি হলো না।আপাকেও তো নড়ানো গেল না।দুজনেই একি ধরনের।কিন্তু রাফাতের যদি এতই তো এখানে আসতে লজ্জা করেনি?ঠিক মেলাতে পারছে না কিছু!এদিকে আরাফ আসছে থেকে তার আশেপাশেই ঘুরছে। বলছে,
“সে তনু আর আয়রাকে ছাড়া কাউকে না চেনায় অসস্তি হচ্ছে। রাফাত তাকে জোর করে এনেছে।আয়রার কাছে তো আর থাকতে পারে না তাই তনুর কাছেই আসছে।”
এমন অকাট্য যুক্তির বিপরীতে কিছু বলার মতো খুঁজে পায় নি।বাধ্য হয়ে তনুকে কথা বলতে হচ্ছে। তনুই জোর করে আরাফকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে শুধু, মিশকাত ছাড়া।মিশকাতকে তো চেনার কথা!সেদিন কফি শপে দুজনের পরিচয় হয়েছিল।কিন্ত আপাতত ছাদের কোথাও মিশকাতকে দেখতে পেল না তনু।এ দিকে আরাফকে কেমন বিরক্ত লাগছে।একটু পরেই ওরা আড্ডা বসাবে।নাচ গানে মেতে উঠবে সবাই।তনু তন্ময়কে ডাকলো,
“শোন, মিশকাত ভাই কোথায় রে?”
“জানি না। ছাঁদে তো দেখতে পাচ্ছি না।নিচে আছে হয়তো।”
“ডেকে আন একটু।বলবি, আমি ডাকছি।”
তন্ময় ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে নিচে নেমে গেল।
মিশকাত রাগ করে বসে আছে ঘরে।তার দেয়া ফুল তনু চুলে গুঁজে দেয় নি।ইচ্ছে হচ্ছে তনুর দুগালে দুটো থাপ্পড় দিতে।এত ভাব কেন মেয়েটার?মিশকাতকে কষ্ট না দিলে কি পেটের ভাত হজম হয় না?কি এমন হতো ফুল দুটো চুলে গুঁজলে।এমন নয় যে মিশকাতের ফুল চুলে দিলে সব চুল খসে পরবে! যেই না চুলের শ্রী তার আবার কত বাহার।সারাক্ষণ তো একটা গরুর লেজের মতো বেনুনি করে ঝুলিয়ে বেড়ায়।মিশকাত রাগে গজগজ করছে।
তন্ময় এ ঘর ঐ ঘর খুঁজেতে খুঁজতে পেয়ে গেল মিশকাতকে।দৌড়ে এসে বলল,
“ভাইয়া তোমায় তনুপি ডাকছে!”
“কে ডাকছে?”
“তনুপি!”
মিশকাত ভ্রু কুঁচকে তাকালো।মহারানী আবার তাকে ডাকছে কেন?সে কোনো উজির নাজির নয় যে পেয়াদা পাঠিয়ে ডাকা হচ্ছে। নিজে আসতে পারতো না!সবকিছুতেই এই মেয়েটার নকড়া!ভাব খানা এমন সে।তার নাম শুনলেই আমি ছুটে গিয়ে পায়ে পরে বলল,মহারানী আদেশ করুন!
যত্তসব,চড়িয়ে সোজা করতে পারলে মনটা শান্ত হতো।
“কেন ডাকছে?”
“জানি না।আমায় শুধু বলল তোমায় ডেকে আনতে।”
“তুই গিয়ে বলে দে,আমি এখন আসতে পারব না।”
তন্ময় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল।বলল,
“সেকি! আমরা তো একটু পর ফানুস ওড়াব।তুমি আসবে না বলছ কেন?”
মিশকাত দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল,
” আচ্ছা, চল।”
মিশকাতের ছাঁদে উঠেই মেজাজ প্রচন্ড খিঁচে গেল।সেদিনের কফি শপের ওই ছেলেটার সাথে দাঁড়িয়ে তনু হেসে হেসে গল্প করছে।সে গটগট করে হেঁটে তনুর সামনে দাঁড়াল।
“ডেকেছিস কেন?”গলার ঝাঁঝটুকু লুকোতে পারলো না।
তনু ভেবে পায় না মিশকাত ভাই এর রাগ সবসময় কি নাকের ডগায় থাকে?নাকি তনুর বেলাতেই এত রাগের বাহার!
“হ্যাঁ।”
আরাফকে দেখিয়ে বলল,” উনাকে চিনতে পেরেছ তো?সেদিন কফিশপে পরিচয় হয়েছিল।রাফাত ভাইয়ার কাজিন উনি।”
আরাফ একবার তীক্ষ্ণ চোখে তনুকে পরখ করলো।এরপর আরাফের সাথে হ্যান্ডশেক করলো।
তনু বলল,” উনি একটু আনকমফোর্ট ফিল করছেন।তুমি একটু ওনার সাথে গল্প করো তো।
তনু আর কিছু না বলেই দ্রুত কেঁটে পরলো।
আরাফ তনুর যাওয়ার পানে অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইলো।
মিশকাতের খটকা লাগলো।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আরাফের দিকে তাকালো।ভেবে আশ্চর্য হলো যে, শিক্ষিত একটা ছেলে কিনা এরকম একটা পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে না!
এছাড়া রাফাতেরও ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় না সে সারপ্রাইজ দিতে এসেছে আয়রাকে।ঠিক বাচ্চাকে জোর করে তেতো ঔষুধ খাওয়ালে বাচ্চা যেমন করে! মনে হচ্ছে তাকে জোর করে আয়রার পাশে বসিয়ে রাখা হয়েছে।তবে ধীরে ধীরে মিশকাতের কাছে সবটা পরিষ্কার হয়ে গেল।সেই সাথে রাগ উথলে উঠলো যেন।আরাফের কোনো কথার জবাব না দিয়ে সরে গেল।
আরাফ কিছুই বুঝলো মা।তনুর হঠাৎ চলে যাচ্ছে, মিশকাতও এভাবে ফট করে উঠে চলে গেল।এদের কর্মকান্ড কেমন অদ্ভুত!
মিশকাত তনুর কাছে গিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,তোর নাগরের সাথে তুই রসিয়ে গল্প কর,আমাকে কেন পাঠিয়েছিস?খবরদার যদি এমন আলতু ফালতু বিষয়ে আমায় ডেকেছিস তো তোর হাত পা ভেঙে ফেলবো একদম।
মিশকাতের যাওয়ার পানে হতভম্ব তাকিয়ে থাকলো তনু।কি বলে গেল এসব?”নাগর” কথাটার মানে কি?ছি!মিশকাত ভাই আসলেই বেশি বাড়াবাড়ি করছে।কে নাগর আর কেনই বা এমন আচরণ করলো কিছুই বোধগম্য হলো না।মনটা শুধু বিক্ষুব্ধ হয়ে রইলো।
সারারাতের হইচই শেষে ভোরের দিকে সকলে গাদাগাদি করে শুয়ে ঘুমে কাত হয়ে পরে রইলো।তনু ওদের সাথে থাকলো সারাটা সময় মনমরা হয়েই ছিল।মিশকাত মাথা ব্যাথার অযুহাত ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।অনেকে ডাকাডাকি করেও বের করতে পারেনি ঘর থেকে।বাধ্য হয়ে মিশকাতকে ছাড়াই আনন্দে মেতে উঠেছিল সবাই।
তনুর ঘুম হয়নি।সে সবার আগে উঠে পরেছে।বাড়ির সামনে ক্যাটারিং এর লোকজন কাজে ব্যস্ত।তনু রান্নাঘরে ঢুকে মা কে দেখতে পেল।আরও কয়েকজন মহিলাও আছে।সবাই তনুর দাদুর বাড়ির আত্মীয় স্বজন।তনু চা বানিয়ে নিয়ে ছাঁদে দিকে পা বাড়ালো।শায়লা বেগম বলে দিয়েছেন,একটু পর আয়রাকে ডেকে তুলে গোসলে পাঠাতে।এগারোটার মধ্যে পার্লারের মেয়ে গুলো চলে আসবে।
তনুর হাসি পায় মায়ের কথায়।আপার আজ বিয়ে তবুও আপাকে ছোট বাচ্চার মতো ঘুম থেকে ডেকে তুলে গোসল করার তাড়া দিতে হবে?
মা তার পুরোনো অভ্যাস এত সহজে ভুলতে পারবে না।হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল।আজ আপা চলে যাবে।মা নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পাবে।আপাকে ছাড়া মা কখনো থাকে নি।কোথাও বেড়াতে গেলে আয়রা আপাকে একা ছাড়তেন না।মামা খালাদের বাসায় সে তন্ময় একা গিয়ে কিছু থেকে আসলেও আয়রা আপা তা কখনো করেনি?আচ্ছা, তার এত ভালো আপাটা কি এসব বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নিতে পারবে?
তনু ছাঁদে উঠে থেমে গেল। মিশকাত এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে।ছেলেটা কি ঘুমোয় নি নাকি?এত সকালে এভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন?তনু দীর্ঘশ্বাস ফেললো।এভাবে মিশকাতকে দেখতে ভালো লাগে না, কষ্ট হয়।এসবের শেষ কোথায় সে জানে না তবে এবার সে মিশকাত ভাইকে সবটা জানাবে।মিশকাত ভাই জলন্ত আগুন নিয়ে খেলা শুরু করার আগেই থামানো উচিত।এভাবে আর চলতে পারে না।তনু ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেল।আয়রা আপাকে ডাকতে গিয়ে দেখলো আয়রা ঘুম থেকে উঠে গেছে।কি মিষ্টি লাগছে দেখতে আপাকে!বিয়ের দিন সব মেয়েকেই বুঝি এত ভালো লাগে?
“আপা তুমি গোসলটা সেড়ে নাও।একটু পরেই হইচই পরে যাবে।”
“আচ্ছা।আমার না অনেক খিদে পেয়েছে তনু,আমি কিন্তু গোসল শেষ করেই খাবো?”
তুই মাকে বলিস।
তনু হেসে ফেললো এমন বাচ্চামো কথায়।বলল,
“তুমি বোধহয় একমাত্র বিয়ের কনে, যে ঘুম থেকে উঠেই খাবার চাইছে।আচ্ছা তুমি গোসল করে নেও আমি মাকে বলছি।দেখে যাবে তোমার গোসল শেষ হওয়ার আগেই মা খাবার নিয়ে হাজির হয়ে যাবে।”
তনু মাকে বলে নিজের ঘরে এলো।তার বিছানায় সব বোন গুলো এলোমেলো হয়ে ঘুমাচ্ছে। তনু খাতা কলম নিয়ে জানালার কাছটায় বসলো।কলমের খোঁচায় নিজের এতদিনের জমে থাকা কথা গুলো অনুভূতি, কষ্ট গুলো উগরে দিচ্ছে।
চলবে..