#তনয়া
#পর্ব -৯,১০
#সিফাতী সাদিকা সিতু
#পর্ব -৯
ঘুম ভেঙে মায়ের মুখটা চোখে পরলো তনুর।শায়লা বেগম বসে আছেন তনুর মাথার পাশে।কপালে জলপট্টি দেয়া।তনুকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে শায়লা বেগম বললেন,
“কিভাবে এমন জ্বর বাঁধালি?রাতে আমার কাছে আসলি না কেন?”
“খুব সমস্যা হয়নি তো।হঠাৎ জ্বর এসে যাবে বুঝতে পারিনি।আপা ফোন করেছে,মা?”
“হুম করেছে।তোর জ্বরের কথা শুনে অস্থির হয়ে উঠেছে।তুই যেতে পারবি না বুঝতে পেরে বোধহয় খুব মন খারাপ করেছে।”
“কেন যেতে পারবো না?তুমি শুধু শুধু আপার মন খারাপ করিয়ে দিলে।এমনিতেই তো নতুন পরিবেশে গিয়ে আপা খুব নার্ভাস হয়ে আছে!”
“পাগল নাকি তুই,এই শরীর নিয়ে কিভাবে যাবি?বেশি অসুস্থ হলে তখন কে দেখবে?আমি তোকে কিছুতেই যেতে দেব না।আয়রাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলব।”
‘ফুফুরা তো সবাই থাকবে।এখন তো আমার জ্বর কমে গেছে।”
“বেশি বুঝিস না তনু?তোর শরীরে এখনো জ্বর আছে।দূর্বল হয়ে গেছিস।তোর বাবাও বলে দিয়েছে তোর যাওয়া হবে না।”
“আপা খুব কাঁদবে আমায় দেখতে না পেয়ে।যখন দেখবে সবাই আছে কিন্ত তুমিও নেই,আমিও নেই তখন দেখবে সত্যি সত্যি খুব মন খারাপ করবে।তুমি তো জানো আপা কেমন?”
“সেটা জানি জন্যই তোর বাবাকে পাঠাচ্ছি।তোর বাবা গেলে অনেকটা সামলে নিতে পারবে।”
“বাবা যাবে!”
“হুম,তুই যেতে পারবি না জন্যই তোর বাবাকে যেতে বলেছি।তা না হলে তো যেত না।মেয়ের শ্বশুর শ্বাশুড়ি কেউ এখনো আমাদের বাড়িতে আসলো না তার আগে আমরা কিভাবে যাই?তবু আয়রার জন্যই যাওয়া।আমাদের কাউকে দেখতে না পেয়ে মেয়েটা সত্যি সত্যি পাগলামি করবে।তাও তন্ময়কে সাথে দেয়াতে একটু ভরসা ছিল।ওর সময় লাগবে অনেকটা আমাদের ছেড়ে থাকার অভ্যাস গড়ে তুলতে।”
তনু মায়ের কোলে মাথা রাখলো।মায়ের কষ্টটা খুব করে অনুভব করতে পারছে সে।মেয়েরাই বোধহয় মায়ের কষ্ট গুলো বুঝতে পারে!সে নিজে তো মা হতে পারবে না তাই সন্তানের জন্য মায়ের কেমন কষ্ট হয় তা খুব করে বোঝার চেষ্টা করছে।
আয়রাকে সাজানো হচ্ছে।অথচ আয়রা ছটফট করছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মাকে ফোন করেছিল।তখনই তনুর জ্বরের খবর পেল।সেই থেকে মনটা খারাপ হয়ে আছে ।তনু নিশ্চয়ই আসবে না আজ!এটা ভেবেই অস্থির হয়ে আছে।
রাফাত ঘরে ঢুকে আয়রাকে দেখে হাসলো।সে বেশ বুঝতে পারলো আয়রার কি চাই?
রাফাত তনুকে ফোন করলো।তনুর ফোনটা শান্তার কাছে ছিল।শান্তা ফোন এনে তনুকে দিলো।
“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া,কেমন আছেন?”
“রাফাত সালামের জবাব দিয়ে বলল,ভালো আছি।কিন্তু তোমার আপা বোধহয় ভালো নেই?তোমাকেও নিয়ে আসা উচিত ছিল।”
তনু হাসলো।গলার স্বর বসে গেছে তাই হাসিটা রাফাত শুনতে পেল না।সে বলল,
“ভাইয়া আপনি ভিডিও কলে আসেন।”
রাফাত বিনাবাক্য ব্যয়ে তনুকে ভিডিও কল করলো।তনু ইশারায় আয়রাকে ফোনটা দিতে বলল।রাফাত আয়রার সামনে ফোনটা রেখে বলল,
“তোমার সাজ বোনকে দেখাও।তা না হলে দেখা যাবে মেকআপ কালো হয়ে গেছে খুব তাড়াতাড়ি।”
আয়রা লজ্জা পেল।রাফাতের দিকে ছলছলে চোখে তাকালো। রাফাত বিনিময়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে চলে গেল নিজের কাজে।আয়রাকে হাসিখুশি রাখার জন্য সে সবসময় চেষ্টা করে যাবে।সে জানে আয়রা নামের মেয়েটা সবাইকে ভালোবাসতে জানে,ভালোবাসায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখতে পারে।রাফাতের তো শুধু ভালোবাসা চাই!মায়ায় ভরপুর মেয়েটার মায়ার সাগরে ডুবে থাকা চাই!
“আপা এত নার্ভাস কেন হচ্ছো?তোমায় বলেছিলাম না তোমার মতোই আরেকজন ভালোমানুষ রাফাত ভাইয়া!তুমি খুব ভাগ্যবতী আপা!তোমার কোমলতা কখনো কঠোরতায় পরিনত হতে দেবে না! ”
“ধুর,কি বলছিস?”
“সত্যি বলছি, তুমি ভেবে দেখতো,ভাইয়া কিভাবে বুঝলো তুমি আমাকে দেখার জন্য ছটফট করছিলে?”
আয়রার ভেতরটা প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল।রাফাত যে অন্যরকম একটা মানুষ তা সে গতরাতেই বুঝতে পেরেছে।একজন নারী তো তখনই পরিপূর্ন যখন সে একজন ভালো জীবনসঙ্গী পায়।সেই জীবনসঙ্গী ধীরে ধীরে আত্মার সঙ্গী হয়ে ওঠে।আয়রার এই প্রথম বাবা,ভাই ছাড়া কোনো পুরুষকে ভালোবাসার হাতেখড়ি হলো রাফাতের মাধ্যমে।জীবন নামক বইয়ে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।
***
মিশকাত সকাল সকাল বেরিয়ে এসেছে তনুদের বাড়ি থেকে।সে এখন বাসে বসে আছে।সোজা ভার্সিটিতেই যাবে।তনুর কথা সে রেখেছে।অনেক দূরে চলে এসেছে সে তনুর থেকে,অনেকটা দূরে!
বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে।তনুর সাথে কৈশোরের কাটানো সুন্দর স্মৃতি গুলো মানসপটে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। তনুর ঝর্ণার মতো প্রানবন্ত চমৎকার হাসির ফোয়ারা যে খুব অল্পসময়ের মধ্যেই তার মন চুরি করে নিয়েছিল!কি সুন্দর ছিল মুগ্ধ হওয়ার দিন গুলো,প্রেমে পড়ার দিন গুলো!মিশকাতের সামনের সিটে দুটো ছেলে মেয়ে বসেছে।মেয়েটা ছেলেটার ঘাড়ে মাথা রেখেছে।দুজনে হাতে হাত রেখে বসে আছে।মিশকাতের বুকটা চিনচিন করে উঠলো। তারও তো এরকম কতশত স্বপ্ন ছিল তনুকে ঘিরে।
“বাদল দিনে তনুর হাত ধরে সারা শহর হাঁটবে।মেঘের গুড়গুড় শব্দ ভালোবাসাময় শব্দ হয়ে উঠবে।তনুর কাজলদিঘী চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকবে অপলক,খুঁজতে চাইবে ভালোবাসা।হুট করেই তনুকে নিয়ে পাড়ি জমাবে মেঘেদের দেশে।তনুর কাঁধে মাথা রেখে সূর্যদয় দেখবে,পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে তাদের ভালোবাসার চিহ্ন আঁকবে, গল্প রচনা করবে!কখনো বা তনুর প্রতি অভিমানের পাহাড় জমাবে একটু ভালোবাসা কম পরলেই।ঘুমিয়ে থাকা তনুর পা দুটো কোলে নিয়ে আলতায় রাঙিয়ে দেবে।ঘুম ভাঙার পর তনুর যখন আনন্দে চোখে জল আসবে তখন সে খুব যত্ন নিয়ে তা মুছে দেবে।গভীর রাতে হুটহাট ঘুম থেকে জাগিয়ে তনুর কাছে আবদার জুড়ে দেবে বিরিয়ানি খাবার জন্য!তনু যখন ঘুম চোখে তাকে বকবে আর রান্না করবে তখন সে মিটিমিটি হাসবে!শীতের রাতে বারান্দায় বসে গায়ে চাদর জড়িয়ে দুজনে কুয়াশার আড়ালে লুকিয়ে থাকা চাঁদকে খুঁজবে।অবসরে তনুর কোলে মাথা রেখে কল্পনার রাজ্যে ডুবে যাবে।বুড়ো হলে দুজনকে কেমন লাগবে দেখতে সেই ভাবনায় ব্যকুল হবে।তনুর লম্বা ঘন রেশমি চুলগুলো সাদা হবে,মসৃণ ত্বক কুঁচকে যাবে তখন তনুকে কেমন লাগবে সেই কল্পনায় বিভোর হবে।কল্পনা শেষে চমকে উঠে বলবে,বুড়ি তনুকে তো দেখতে অসাধারণ লাগবে!তনু তখন তার বুকে মৃদু কিল বসিয়ে দেবে লজ্জা পেয়ে।”
মিশকাতের চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো অজান্তেই। ছেলেরা কাঁদে না কে বলল?প্রতিটা ছেলেকেই ভালোবাসার কাছে পরাজিত হতে হয়,প্রিয়তমার অবহেলার কাছে অসহায় হতে হয়।ভালোবেসে গুমরে গুমরে মরতে হয়!আচ্ছা, সে কি চেয়েছিল এমন যন্ত্রণাময় ভালোবাসা?
ফোনের শব্দে মিশকাত নিজেকে স্বাভাবিক করলো। ফোনের স্ক্রীনে বাবার নম্বর দেখে রিসিভ করলো।
“তুই পৌঁছে গেছিস, বাবা?”
“নাহ্,একটু পরেই পৌঁছাব। তুমি চিন্তা করো না।আমি হলে পৌঁছে তোমায় ফোন করবো।”
“তোর মা কিন্তু খুব রেগে গেছে। পরে কথা বলিস একটু।এভাবে হুট করে চলে গেলি,পরিক্ষা না থাকলে তোকে মানা করতাম যেতে।”
“কিছু করার নেই বাবা।মাকে বুঝিয়ে বলো।” মিশকাতের গলাটা ধরে এলো।
“তোর গলাটা এমন শোনাচ্ছে কেন রে?”
“কেমন আবার শোনাবে?বাসে আছি তো তাই হয়ত নেটওয়ার্কের সমস্যা হচ্ছে।”
“কোনো সমস্যা হলে আমায় জানাস।” টাকা লাগলে সেটাও বলিস?”
“বাবা, তোমার কাছে যদি কখনো খুব বেশি কিছু চেয়ে বসি যেটা হয়ত তোমার সাধ্যের মধ্যে নেই তাহলে কি সেট জিনিসটা আমায় দেবে?”
মিশকাতের বাবা একটু চুপ করে থেকে বললেন,
“আমার ছেলেকে আমি জানি।সে আমার সাধ্যের বাইরে কিছুই চাইবে না।যদি কখনো চাস তাহলে বুঝে নিবো খুব প্রয়োজনীয় কিছু যা তোর জীবনের সাথে জড়িত!আমি বাবা হয়ে সেই জিনিসটা তোকে দেয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করবো।”
মিশকাত নিজেকে আর স্বাভাবিক রাখতে পারলো না।কোনোরকমে বলল,
“থ্যাংক ইউ বাবা,রাখছি।”
এত কষ্টের মাঝেও মিশকাতের হাসি পেল।মানবমন কত বিচিত্র। সবাই নিজের মতো করে সম্পর্ক গুলোকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়।অথচ সবাই ভুলে যায় প্রতিটি সম্পর্কেরই নিজস্বতা আছে!
সবাই আয়রার বউভাতে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে। তনু বালিশে ঠেস দিয়ে বসে দেখছে।সকাল থেকেই সে মিশকাতের কথা ভাবছে।গতরাতে কি হয়েছিল ছাঁদে কিছুই মনে নেই।ছাঁদ থেকে একা কি করে ঘরে এসেছে সেটাও জানে না।ঘর ছেড়ে বের হতে ইচ্ছে করছে না।উঠলেও মায়ের বকুনির খেতে হবে।অথচ মনটা ছটফট করছে মিশকাত ভাইকে দেখার জন্য। হঠাৎ খাতাটার কথা মনে হলো তার।বিছানায় ভালোভাবে দেখলো কিন্তু পেল না।তার স্পষ্ট মনে আছে সে গতরাতে তার শোয়ার বালিশের নিয়ে রেখেছিল।তাহলে নেই কেন? শান্তাকে ডেকে বলল,
“আমার খাতাটা তুই নিয়েছিস?”
“নাহ,তোর খাতা তো আমি সকালবেলা টেবিলে দেখেছিলাম।”
তনু দ্রুত বিছানা ছেড়ে টেবিলের কাছে আসলো।হুড়মুড়িয়ে পরতে ধরলে চেয়ারের হাতল ধরে নিজেকে আঁটকালো।শান্তা তাই দেখে রাগী চোখে তাকালো।তনু হেসে বলল,
“মাকে বলিস না প্লিজ!আর উঠবো না বিছানা ছেড়ে।”
“তুই এই খাতাটায় কি পেয়েছিস বলতো?মনে হচ্ছে তোর প্রান ভ্রমরা এই খাতাটা!”
তনু কিছু না বলে শুধু হাসলো।
“তাহলে বোধহয় আমার ধারনাই ঠিক তুই প্রেমপত্র লিখছিস? ”
“ধুর,এসব কথা বলা ছাড়া তুই থাকতেই পারিস না।আচ্ছা শোন,তোরা তো সবাই এক গাড়িতেই যাবি, তাহলে মিশকাত ভাইকে বলিস তো ফিরে এসে যেন আমার সাথে দেখা করে।”
“মিশকাত ভাই তো সকালে চলে গেছে, জানিস না?”
তনুর বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো।নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“কেন হঠাৎ চলে গেল?”
“শুনলাম পরিক্ষার ডেট দিয়েছে নাকি । তাড়াতাড়ি হলে ফিরতে হবে।তাই তো সকালেই বেরিয়ে গেছে।”
“ওহহ।বড়মামা মামি আছে? ”
“হ্যাঁ আছে।মামি নাকি আয়রা আপার শ্বশুর বাড়ি থেকে সোজা চলে যাবে।এখানে আর আসবে না।ওনার নাকি শরীরটা খারাপ।”
তনুর কেমন যেন খটকা লাগলো।মিশকাত ভাই চলে গেল মামিও থাকতে চাইছে না!নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে।সে এবারও মিশকাত ভাইকে কথা গুলো জানাতে পারলো না!দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো তনু।মিশকাত ভাই কাছে এসে আবার চলে গেল অথচ কিছু বলা হয়ে উঠলো না।এই বিষয়টা গলার কাঁটার মতো বিঁধে থাকবে মনে।নিমিষেই মনটা খারাপ হয়ে গেল।কান্না গুলো গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে! এত কেন কষ্ট হচ্ছে তার?
চলবে..
#তনয়া
#পর্ব -১০
বেশ কিছু মাস পার হয়েছে আয়রার বিয়ের।এরই মধ্যে আয়রা বেশ গুছিয়ে নিয়েছে নিজেকে।একটু একটু করে সংসার বুঝে উঠতে শিখছে।রাফাতের পুরো পরিবার তাকে আগলে রাখে সবসময়।বাড়ির জন্য মন খারাপ হলেই রাফাত প্রায় সময় অফিসে যাওয়ার পথে আয়রাকে নামিয়ে দিয়ে যায় আবার ফেরার পথে নিয়ে আসে।তবে আজ আয়রা বেশ চিন্তিত হয়ে আছে। একটু আগেই শ্বাশুড়ি ডেকেছিল।শ্বাশুড়ির ভাষ্যমতে,
“আজ বিকেলে রাফাতের বড় খালা আসবেন।আয়রাকে নিয়ে আগামীকাল তনুকে দেখতে যাবেন।আরাফ নাকি তনুকে খুব পছন্দ করেছে।যদিও একি ঘরে দুবোনের আত্মীয়র সম্পর্ক হোক তাতে নাকি আয়রার খালা শ্বাশুড়ির আপত্তি ছিল।আরাফ একমাত্র ছেলে হওয়ার দরুন না করতে পারেননি।তাছাড়া তনুকে অপছন্দও হয়নি।সবমিলিয়ে কথা হচ্ছে, বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আয়রাদের বাড়িতে যাবে।”
কথা গুলো শোনার পর থেকেই আয়রা অস্থির হয়ে আছে।শ্বাশুড়িকে কিছু বলতে পারেনি।তনুর কথা ভেবে কান্না পেয়ে যাচ্ছে। এসব ব্যাপার নিয়ে তনুকে ঘাটানো মানে পুরোনো ক্ষতয় আঘাত করা।বাবা এখনো কিছুই জানে না তনুর বিষয়টা নিয়ে।এরকম ভালো একটা বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে বাবা নিশ্চয়ই খুশি হবে।আরও একটা ব্যাপার আছে,বলতে গেলে প্রস্তাবটা আয়রার শ্বশুর বাড়ি থেকেই যাচ্ছে!এটা নিয়ে তেমন আপত্তি করা মানে ঝামেলা তৈরি হওয়া।সমস্যাটা খুলে বলতে হবে না হয় একদম মানা করে দিতে হবে।সরাসরি মানা করে দেয়াটা আয়রার শ্বশুড় শ্বাশুড়ি ভালো ভাবে নেবে না।এসব ব্যাপার আয়রা আগে বুঝত না।বিয়ের পর অনেক বিষয় এখন বুঝতে শিখেছে। আয়রা ঠিক করেছে মাকে আগে জানিয়ে রাখবে।এখন প্রায়ই এই ধরনের পরিস্থিতিতে পরতে হবে।তাই বাবাকে সবটা জানানো প্রয়োজন। দূ্র্বলতা কখনো ঢেকে রেখে চলা যায় না।প্রকাশ করতেই হয়।আর সম্পর্কের মধ্যে স্বচ্ছতা থাকা খুব প্রয়োজন।যে তনুকে ভালোবাসবে সে সবটা জেনেই ভালোবাসবে।সৃষ্টিকর্তা চাইলে তনুর জীবন অনেক সুন্দর হবে।যেটা দেয়ার ক্ষমতা মানুষের নেই সেটা নিয়ে আঘাত দেয়ার অধিকারও নেই।
তনুর দিনগুলো ভালোই কাটছে।নিয়মিত ভার্সিটিতে যাওয়া,মাঝে মধ্যে বান্ধবীদের সাথে বেড়াতে যাওয়া,বাড়িতে থাকলে পড়াশোনা, মায়ের সাথে টুকটাক কাজ করা,ছাঁদের দোলনাটায় বসে বই পড়া এভাবেই বেশ ভালো সময় পার করছে।আয়রার বিয়ের পর প্রায় একা হয়ে গেছে।তন্ময় দিনের বেশি সময় স্কুলে থাকে,বাবা অফিসে। শায়লা বেগম সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকেন।সময় চলছে তার নিজস্ব গতিতে সেই সাথে তনুও এগিয়ে চলছে নিজের মতন।নতুন করে ওঠা ঝড়টা খুব দ্রুত সামলিয়ে নিয়েছে।মিশকাত নামটা খুব করে ভুলে থাকতে চাইছে।তনু নিজের মতো বাঁচতে চায়।সামাজিক নিয়মের বাইরে বেরিয়ে নিজের নিয়মে চলতে চায়।পড়াশোনা শেষে চাকরি করবে।কাজের মধ্যে থাকলে ভালো থাকবে সে।সময় পেলে শহরের কোলাহল থেকে দূরে যাবে।কিছুটা সময় প্রকৃতির বুকে শুয়ে কাটিয়ে দেবে।এইতো,জীবনে আর কি চাওয়া?সবাইকেই যে ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে থাকতে হবে,পরিপূর্ণ থাকতে হবে এমনটাও নয়।কিছু অপূণর্তা থাকুক না,ক্ষতি কি?
বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে জানতে পারলো, আয়রার শ্বশুর বাড়ি থেকে মেহমান আসবে । তাই আজ কিছু রান্নাবান্না করে রাখছে।তনুকে শুধু বলেছে ড্রয়িংরুমটা ভালোভাবে গোছাতে।
তনু ঘরে এসে শুয়ে পরলো।ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।ভার্সিটি থেকে ফিরলে খুব ক্লান্ত লাগে।কাল আপা আসবে ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে গেল।গোসল করার জন্য উঠে কার্বাড থেকে কাপড় বের করতেই ফোনটা বেজে উঠলো।অচেনা নম্বর দেখা ফোনটা রিসিভ করবে কিনা ভাবতেই বন্ধ হয়ে গেল।সাথে সাথেই আবার ফোনটা বেজে উঠলো।এবার সে রিসিভ করে সালাম দিলো,
ওপাশ থেকে কোনো জবাব পেল না।তনু কয়েকবার হ্যালো বললেও কোনো সাড়া না পেয়ে কেটে দিলো।বিরক্ত হয়ে ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।
ওপর প্রান্তে থাকা মিশকাত তখনও ফোনটা কানে চেপে ধরে আছে।অনেকদিন পর তনুর কথা শুনতে পেল,নিশ্বাসের শব্দ অনুভব করতে পারলো!সেই রাতে ছাঁদে বলা তনুর কথাতেই আঁটকে ছিল এতদিন।মনটাকে আর দমিয়ে রাখতে না পেরে আজ তনুকে ফোন করে বসলেও গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারেনি।কি দরকার তনুর তিক্ততা বাড়িয়ে তোলার?
সেদিন জ্বরের ঘোরে তনু যখন লুটিয়ে পরেছিল মিশকাতই তাকে আঁকড়ে ধরেছিল।তনুর শরীরের তীব্র উষ্ণতা খুব করে টের পাচ্ছিলো।সেই প্রথম ছিল দুজনের উষ্ণ আলিঙ্গন। না ভুল হলো,দুজনের নয় তার একার।তনু তো নিজের জ্ঞানেই ছিল না।ছিল না জন্যই মিশকাত তনুর কাছাকাছি আসতে পেরেছিল।তনুকে অসুস্থ দেখে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল।তনুকে পাঁজাকোলা করে ছাঁদ থেকে নামিয়ে ঘরে নিয়ে এসেছিল।ঘন্টাখানেক পাশে বসে তনুর হাত চেপে ধরেছিল।পরে মারুফের সাহায্য নিয়ে শান্তাকে ডেকে এনেছিল।ব্যাগ থেকে ওষুধ এনে শান্তাকে দিয়েছিল তনুকে খাইয়ে দেয়ার জন্য। এরপর সে রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে পরেরদিন সকালেই বেরিয়ে পরেছিল ফুফু আর বাবাকে বলে।পরিক্ষার অযুহাত দেয়ায় খুব সহজ হয়েছে আসাটা।অসুস্থ তনুকে ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হয়েছিল।সে কষ্টটাও সহ্য করে নিয়েছিল শুধুমাত্র তনুর জন্য!একদিন সে ঠিক তনুকে বুঝিয়ে দেবে তার ভালোবাসা কোনো ঠুনকো বিষয় নয়।মিশকাতের কাছে তনুকে ভালোবাসা গোটা একটা জীবনের নাম!
***
শায়লা বেগম মনে মনে ছটফট করছেন।এমন একটা সময় তনুর জন্য এমন ভাবে বিয়ের প্রস্তাব আসবে তা কি ভাবতে পেরেছিল?তনুর বাবা নিশ্চয়ই খুব খুশি মনেই প্রস্তাবটা গ্রহণ করবেন!তনুর মতামত জানতে চাইলে তখনই হবে আসল সমস্যা। তনু কিছুতেই রাজি হবে না।বিয়ে বিষয়টা ভাবলেই তনু অন্যরকম হয়ে যায়।এবার বোধহয় তনু চুপ করে থাকবে না?বাবাকে সবটা জানিয়ে দেবে মেয়েটা।মেয়েটার বুকে যে কষ্টের পাহাড় জমে আছে!
“মা, তনুকে তো কিছুই বলা হয়নি?ওরা এখন হয়ত বাবার সামনে কথা গুলো বলবে।তনু যে কি কান্ড ঘটিয়ে বসে কে জানে?আয়রা ফিসফিসিয়ে মায়ের কানের কাছে এসে বলল।”
“তাই তো ভাবছি।এতদিন যা চেপে ছিল তা আজ বলে বসবে?তনু রেগে গেলে তোর শ্বশুর বাড়ির মানুষজন কি ভেবে বসে কে জানে?”
“আমি বা কি করবো? নিজের বোনের কথা তো ওভাবে বলা যায় না!আর তনুকে ছোট করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।ওরা যা ইচ্ছে ভাবুক, তনু শুধু কষ্ট না পেলেই হয়।”
“কষ্ট নতুন করে আর কি পাবে?আমার এত ভালো মেয়েটার জীবনে এতকষ্ট কেন আসলো বলতো?বড় ভাবীর কাছ থেকে যেদিন জেনেছিল সেদিন থেকেই ওর সমস্ত সুখ হারিয়ে গেছে?মাঝে মাঝে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখতাম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।হুট করে এসে আমায় প্রশ্ন করে বসতো,মা আমার বাচ্চা না হলে কি খুব সমস্যা হবে?বাচ্চা না থাকলে কি সুখ থাকে না?এটা কি খুব বড় দোষ আমার?ও যখন নিজেকে বোঝাতে পারতো না তখন এসব বলতো।এখন দ্যাখ, এসব প্রশ্ন ভুলেও কখনও করে না।ধীরে ধীরে মেনে নিয়েছে,স্বাভাবিক হয়েছে।ভুলেও বুঝতে দেয় না ওর কষ্ট গুলো।”শায়লা বেগম শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন।
আয়রাও প্রায় কেঁদে ফেলেছে। তনুর জীবনটা কেন এত এলোমেলো?আয়রা মনে মনে ঠিক করে নিলো যতদিন না তনুর জীবনটা সুন্দর হচ্ছে ততদিন সে বাচ্চা নেবে না!তনুর দুর্বল জায়গায় আঘাত সে কখনো করবে না।নিজের বোনটা গুমরে গুমরে শেষ হয়ে যাবে আর সে হাসি আনন্দে জীবন কাটাবে তা হতে পারে না!
আরাফের মায়ের পাশে বসে তনু উসখুস করছে। সেই কখন থেকে বসে আছে!ভদ্রমহিলা তার হাত ছাড়ছেই না।অথচ বড়দের কথার মাঝে একটু থাকতে ইচ্ছে করছে না তার।তনু খেয়াল করেছে ভদ্রমহিলা নিজের ছেলের গুনগান করছেন খুব।আরাফের ছোট বেলা থেকে পড়াশোনা চাকরি,প্রমোশন সবকিছু বলা শেষ করেছেন।তনু বুঝতে পারছে না কেন এত আরাফের কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাকে শোনানো হচ্ছে। বিয়ের দিন উনি অনেক প্রশ্ন করছিল কথাটা মনে হতেই তনু খুব সহজেই বিষয়টা বুঝে গেল।সাথে সাথেই শিরদাঁড়ায় শিরশিরে অনুভূতি হলো।বুকের ভেতর কাঁপন ধরলো।চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
আন্টি আপনারা বসেন আমি একটু আসছি।কথাটা বলে দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।এমন পরিস্থিতিতে যে তাকে পরতে ত অনেক আগে থেকেই বুঝেছিল।।মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিল এসবের মুখোমুখি হওয়ার জন্য। তবু আজ নিজেকে হঠাৎ অসহায় লাগছে।আরাফের মায়ের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বিধ্বস্ত হয়ে গেল কেন?কেন নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারলো না?
এরপরের ঘটনা গুলো খুব দ্রুতই ঘটে গেল।তনুর বাবা খুশি মনে প্রস্তাবটা গ্রহণ করলেন।আয়রার খালা শ্বাশুড়ি সবাই নিজের বাড়িতে আসার নিমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেন।তনুর মতামত থাকলেই দ্রুত সবকিছু করার ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন।তনুর বাবাও আস্বস্ত করেছেন,তনুর মতামত অবশ্যই থাকবে।
শায়লা বেগম আয়রা অসহায় হয়ে সবটা দেখে গেল।শায়লা বেগম নিজের ভুলটা এতদিনে বুঝতে পারলেন।তনুর বাবার থেকে এতবড় একটা বিষয় লুকোনো মোটেও ঠিক হয়নি।এই ব্যাপারটা লুকিয়ে তিনি তনুকেও কষ্ট দিয়েছেন।কারণ,মা হতে না পারাটা কোনো অন্যায় বা দোষের নয়!এই বিষয়টা তনুর গোটা জীবন হতে পারে না বড়জোড় জীবনের একটা অংশ হতে পারে।সত্যি তো এতবড় দুর্বলতাও নয় যে এভাবে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক করে তুলতে হবে?যেটা মানুষের হাতে নেই তা নিয়ে দুর্বল হওয়ারও কিছু নেই!
চলবে..