তপোবনে যখন সন্ধ্যা নামে,পর্ব-০১

0
1280

তপোবনে যখন সন্ধ্যা নামে,পর্ব-০১
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

আষাঢ় মাস। মেঘাচ্ছন্ন আকাশে কোনো আলো নেই। থেকে থেকে যে বিদ্যুৎস্ফুরণ হচ্ছে তাতে শিকদার বাড়ির তোরণটা লাগছে বিশাল দুর্গের মতো। সন্ধ্যা থেকে অঝোর ধারায় বর্ষণ হচ্ছে। দুর্গের ভেতর প্রশস্ত লেনে ল্যাম্পপোস্টের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হলদে আলো। প্রধান ফটকের পাশে একটা ড্যানিশ হাউন্ড কুকুর ব্যতিত আর কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই। বিদ্যুৎস্ফুরণের আকস্মিক আলোয় ৮৬ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ২০০ পাউন্ড ভারি কুকুরটির বিশাল ছায়া আর উৎকট চিৎকার আরও রহস্যময় করে দিচ্ছে পরিবেশ। একই সুরে নেমে আসা ঝমঝমে বৃষ্টিতে ছন্দপতন ঘটিয়ে; পৃথিবীর অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে যে বজ্রপাতটা ঘটলো তাতেই আকাশের দিকে মুখ করে তীক্ষ্ণ চিৎকার দিয়ে উঠলো ড্যানিশ হাউন্ড। হাউন্ডের তীক্ষ্ণ চিৎকারের জবাবেই যেন অন্ধকার আকাশের বুক চিঁড়ে ছড়িয়ে পড়লো তীব্র এক বিদ্যুৎস্ফূরণ আলো। সেই আলোতেই দুর্গের তিন তলায় ক্ষণিকের জন্য দেখা মিললো স্থির, বিশালাকার এক মূর্তি। বিদ্যুৎপ্রভ আলো মিলিয়ে যেতেই আবারও শান্ত, নিস্তব্ধ হয়ে এলো চারপাশ। অন্ধকারে মিলিয়ে গেল সেই মূর্তি। কেবল উঠানামা করতে দেখা গেল ছোট্ট এক আগুনের বিন্দু। এই পর্যায়ে সেই অগ্নিবিন্দুর পেছনে থাকা রুদ্রমূর্তি মানুষটিই আমাদের আলোচনার বিষয়।

রুদ্রর ঘরের আলো নেভানো। আকাশ আঁধার করে সন্ধ্যা নামার পরও আলো জ্বালাতে ইচ্ছে হয়নি। যার জীবনে স্বাধীনতা নামক কোনো বস্তু নেই তার ঘরে আলো জ্বালানোর কোনো প্রয়োজন থাকার কথা নয়। রুদ্ররও প্রয়োজন নেই। আজকাল দিনের আলোও ঠিকঠাক সহ্য হয় না তার। মাঝে মাঝেই ঘরের আলোর মতোই পৃথিবীর আলোও সুইচ টিপে বন্ধ করে দিতে ইচ্ছে হয়। আলোহীন পৃথিবীটা খুব খারাপ হবে বলে মনে হচ্ছে না। রুদ্র সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি আলোর স্তম্ভের পেছনেই লাল রঙের ম্লান বিন্দুটা সিসিটিভি ক্যামেরার অস্তিত্বের প্রমাণ দিচ্ছে। সার্চ লাইটের ঘূর্ণিয়মান আলো বাড়ির প্রতিটি কোণে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা অতন্দ্র প্রহরীদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। রুদ্রর কপালের রগ ফুলে উঠলো। বুকের ভেতরের সুপ্ত বিদ্রোহে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো হাতের আঙুল। সপ্তাহখানেক ধরে সার্চ লাইটের গতিবিধি ‘সময়ের কাটায়’ হিসেব করে রাখা মস্তিষ্কটা ধীরে ধীরে সচল হয়ে উঠল। সার্চ লাইটটা প্রতিটি জায়গায় গুণে গুণে দশ সেকেন্ড করে স্থির হয়। তারপর জায়গা বদলে ভিন্ন একটি জায়গায় স্থির হয় পরবর্তী দশ সেকেন্ডের জন্য। রুদ্র যদি তিন তলার বারান্দা থেকে নিচে নামার চেষ্টা করে তবে হাতে সময় পাবে মাত্র দশ সেকেন্ড। হাতে ধরা দশ সেকেন্ডে কী আদৌ তিন তলা থেকে নেমে যাওয়া যায়? রুদ্রর কপালে ভাঁজ পড়লো। ডান ভ্রু’টা বাঁকিয়ে পাথরের মতো শক্ত চোখে চেয়ে রইলো সম্মুখে। মস্তিষ্কটা ছুটতে লাগলো দ্রুত। দশ সেকেন্ডে নিচে নেমে যাওয়া সম্ভব না হলেও দু’তলা পর্যন্ত যাওয়া যাবে অনায়াসে। সেখান থেকে নিচে নেমে যাওয়া নামমাত্র ব্যাপার। রুদ্র সচেতন চোখে দু’তলার ঘরগুলোর দিকে চাইলো। এই বাড়িতে গার্ডস্, বডিগার্ড আর চাকর-বাকর ছাড়া কেউ থাকে না। দ্বিতীয় তলার ঘরগুলো কেবল শিকদার সাহেবের আগমনেই আলো ঝলমল হয়ে উঠে। অন্যান্য দিনগুলোতে দু’তলার ঘরগুলো পড়ে থাকে জনমানবশূন্য। আর এক তলায় যাবতীয় কর্মচারীদের থাকার ব্যবস্থা। রুদ্র মনে মনেই একটা নকশা আঁকলো। বাড়ির ভেতরে বিশ গজ অন্তর অন্তর কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা। রুদ্র চোখের দৃষ্টিতে এমন একটা বারান্দা খুঁজলো যেখানে অপেক্ষাকৃত কম হয়ে এসেছে আলোর তীব্রতা। তারপর নজর দিলো সার্চ লাইটের গতিবিধির দিকে। উত্তর-দক্ষিণ থেকে দুটো সার্চ লাইট আড়াআড়িভাবে ঘুরছে। একটি চলছে ঘড়ির উল্টো দিকে, অপরটি চলছে ঘড়ির গতিকে অনুসরণ করে। রুদ্রকে পা ফেলতে হবে দুটো সার্চ লাইটের যেকোনো একটিকে অনুসরণ করে। তাতে দ্বিতীয় সার্চ লাইট তার উপর এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে হাতে পাওয়া যাবে প্রায় তিরিশ সেকেন্ডের মতো সময়। কিন্তু এই বাড়ির প্রহরী বিন্যাস সম্পর্কে রুদ্রর কোনো ধারণা নেই। রুদ্রর ধারণা এখানে দুইদিন অন্তর অন্তর পাহারা পদ্ধতি পাল্টে যায়। কে, কোথা থেকে কোনদিকে দৃষ্টি রাখছে বুঝে উঠা মুশকিল। নিচে ক’জন, কোথায় পাহাড়ায় আছে কে জানে? রুদ্র নতুন সিগারেট ধরালো। দিয়াশলাইটা নিভিয়ে না ফেলে ছুঁড়ে মারলো ঘাস কার্পেটের উপর। দেখতে দেখতে কার্পেটে আগুন ছড়ালো। রুদ্র বারান্দার পাঁচিলে ঠেস দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে আগুনের ছড়িয়ে পড়া দেখলো। কার্পেটের গায়ে দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে দেখে বুকের ভেতর পৈশাচিক এক আনন্দ হলো। কী অসহ্য সুন্দর দৃশ্য! এভাবে পুরো পৃথিবীটা পুড়িয়ে দেওয়া যায় না? মিনিট কয়েকের মাঝে পুরো শিকদার বাড়িতে ফায়ার সাইরেনের সুতীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে উঠলো। আকস্মিক সাইরেনে গার্ডদের মাঝে সূক্ষ্ম চঞ্চলতা দেখা দিলো। নিচের এখানে সেখানে গার্ডদের নড়াচড়া টের পাওয়া গেলো। বুঝা গেল, প্রচন্ড বৃষ্টিতে গার্ডদের বেশিরভাগই ছাউনিতে আছে। মাঠে ছড়িয়ে থাকার সংখ্যা কম। রুদ্র আড়চোখে নিচের পরিস্থিতি আর গার্ড সংখ্যা হিসেব করে নিয়ে আগের মতোই নিরুদ্বেগ দাঁড়িয়ে রইলো। মিনিটের মাঝে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো কয়েকজন গার্ড। দ্রুত হাতে ঘরের আলো জ্বালিয়ে পুড়তে থাকা কার্পেটের পাশে রুদ্রকে নিরুদ্বেগ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক চোখে চেয়ে রইলো। রুদ্র তাদের দিকে চাইলো না পর্যন্ত। ঠোঁট গোল করে আকাশের দিকে ধোঁয়া ছেড়ে দায়সারা কন্ঠে বললো,

‘ আই ওয়ান্ট হুইস্কি এন্ড রেড ওয়াইন। ওয়ান্না মিক্স দেম।’

ডিউটি প্রধান রুদ্রর থেকে চোখ সরিয়ে টেবিলের উপর পড়ে থাকা ইন্টারকম বেলটির দিকে চাইলেন। রুদ্র চাইলেই বেল টিপে সেকেন্ডের মাঝে হুইস্কি চাইতে পারতো। তার ঘরে সকল ধরনের আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা আছে। সামান্য হুইস্কি চাওয়ার জন্য এতো বড়ো কান্ড করার প্রয়োজন ছিলো না। অবশ্য রুদ্রর ব্যাপারে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের বিশেষণ খাঁটে না। তার প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের ধরা বাঁধা নিয়ম হয় না। হতেই পারে, তার ইন্টারকম বেল পর্যন্ত হেঁটে আসতে ইচ্ছে করছিলো না। রাজার পুত্রদের ইচ্ছে না করাটাও একটা প্রয়োজনই বটে। গার্ডরা গম্ভীরমুখে বেরিয়ে গেলো। কার্পেটের আগুন নিভিয়ে মিনিটের মাঝে নতুন কার্পেট বিছিয়ে দেওয়া হলো। টি-টেবিলের উপর সাজিয়ে দেওয়া হলো নানা ব্র্যান্ডের হুইস্কি ও রেড ওয়াইনের বোতল। রুদ্র আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইলো পুরোটা সময়। গম্ভীর কন্ঠে আদেশ দিলো,

‘ আলোটা নিভিয়ে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে যাও। ঠিক দশটায় আমি খাবার খাবো। দশটার আগে কেউ আমায় বিরক্ত করবে না।’

তার কথামতো কাজ হলো। আলো নিভিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। চারপাশটা আবারও আগের মতোই জনারবহীন হয়ে আসতেই নড়ে উঠলো রুদ্র। আলসে ভাব কেটে গেলো। সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে শিকারীর মতো ধ্বক করে জ্বলে উঠলো চোখ। মুহূর্তেই শক্ত হয়ে এলো মুখের পেশী। পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক সার্চ লাইটকে লক্ষ্য করে নেমে গেলো দুই তলায়। সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নেমে গেল নিচ তলায়, আলোর উল্টোদিকে একটি স্তম্ভের পেছনে। বহু কসরত করে লেন, বাগান পেরিয়ে পাঁচিলের কাছে আসতেই হঠাৎ ভাবোদয় হলো রুদ্রর। পাঁচিলের উপর লোহার কাঁটাতারের দিকে চেয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো তার। শিউরে উঠলো শরীর। সপ্তাহখানেক আগে একবার পালানোর চেষ্টা করাতে বাড়তি সচেতনতার জন্য কাঁটাতারে বিদ্যুৎ চলাচলের ব্যবস্থা করেছেন শিকদার সাহেব। আরেকটু হলেই মৃত্যু ফাঁদে পা দিতে চলেছিলো ভেবে বুকের ভেতর সূক্ষ্ম এক ভূমিকম্প বয়ে গেল। বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে হওয়া শরীর নিয়েই স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো রুদ্র। নিজেকে সেকেন্ড কয়েক সময় দিয়ে দ্রুত সরে পড়লো বাড়ির পেছন দিকে। দশ একর জমির উপর গড়ে উঠা প্রকান্ড শিকদার বাড়ি এক চক্কর দিয়ে পেছন দিকটায় আসতে প্রায় আধ ঘন্টা খরচ হয়ে গেল রুদ্রর। বাড়ির পেছনের এক সময়কার বিশাল জামগাছের পিচ্ছিল কান্ডের সাহায্যে কোনোরকম পাঁচিল টপকে বেরিয়ে এলো সে। শিকদার বাড়ির ফটকের বাইরে মাটিতে পা রেখেই বিজয়ের আনন্দে বুক ভরে উঠলো তার। শিশুদের মতো লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে হলো। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠতে চাইলো অপ্রতিরোধ্য বিজয়ী হাসি। কিন্তু বিধিবাম! সন্ধ্যামালতী যেমন ফোটার কিয়ৎক্ষণের মাঝেই প্রাণ হারায়, চুপসে যায়। ঠিক তেমনই হাসিটুকু ফোটার আগেই শুকিয়ে এলো রুদ্রর রুক্ষ ঠোঁট। বৃষ্টিস্নাত রাস্তায় চকচকে জুতোয় ঢাকা এক জোড়া সরু পা দেখে ধরাস করে উঠলো রুদ্রর বুক। ধীরে ধীরে চোখ তুলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো আগুন্তকের মুখের উপর। শার্ট, প্যান্ট পরনে লম্বা, ছিপছিপে কঠিন মুখের মানুষটিকে এক মুহূর্তের জন্য রমণী বলে বোধ হলো না তার। এ যেন চাক্ষুষ যমদূত! রুদ্রর যমদূত একদম অভিব্যক্তিহীন কন্ঠে সম্ভাষণ জানালো,

‘ হ্যালো স্যার।’

রুদ্র ভেতর ভেতর ভীষণ চটে গেলো। পুরুষ মানুষের এক অভ্যাস, তারা প্রাণ হারাতে প্রস্তুত তথাপি কোনো রমণীর কাছে হেরে যেতে প্রস্তুত নয়। আর তা যদি হয় বুদ্ধির লড়াইয়ে তবে তো নৈব নৈব চ! রুদ্রর চোখে-মুখে সূক্ষ্ম বিতৃষ্ণার ছাপ পড়লো। মস্তিষ্কের ভেতর দুশ্চিন্তার মাদল বেজে উঠলেও গম্ভীর করে রাখলো মুখ। হাত দুটো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ভীষণ প্রতাপ নিয়ে বলল,

‘ হেই মারিয়া! হোয়াটস্ আপ?’

হাতদুটো পিঠের পেছনে মুষ্টিযুদ্ধ করে, ইস্পাতের মতো কঠিন মুখে উত্তর দিলো মারিয়া,

‘ গুড স্যার।’

পাহাড়ের মতো অনড়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা রমণীর রুক্ষ কন্ঠের ‘গুড’ রুদ্রর কানে ঠিক ‘গুড’-এর মতো শুনালো না। সেই ‘গুড’ অবশ্যম্ভাবী বজ্রপাতের পেয়াদা স্বরূপ গুড়গুড় শব্দ তোলা আষাঢ়ে মেঘ বলে বোধ হলো। রুদ্র উদাস কন্ঠে শুধাল,

‘ হুয়াই আর ইউ হিয়ার?’

‘ ইট’স ইউর ডিনার টাইম, স্যার। দশটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। পাঁচ মিনিটের মাঝে আপনি যেন তিন তলায় নিজের ঘরে পৌঁছাতে পারেন সে ব্যাপারে আমি আপনাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো স্যার।’

রুদ্রর চটে যাওয়া মেজাজটা আরও চটচটে হয়ে এলো এবার। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

‘ আই ডোন্ট নিড ইউর হেল্প। ডিনার করার ইচ্ছে নেই, আমি এখন বৃষ্টিতে ভিজবো। ক্যান ইউ প্লিজ লিভ মি এ্যালোন?’

মারিয়া উত্তর দিলো না। আগের মতোই পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার আচরণে কোনোরকম চলিষ্ণু দেখা গেলো না। রুদ্র প্রথমে রাগে-দুঃখে চোখ লাল করে চাইলো। অতঃপর চিৎকার করে উঠে বললো,

‘ তোমাকে যেতে বলেছি আমি।’

মারিয়ার মাঝে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। যান্ত্রিক কন্ঠে বললো,

‘ আই কা’ন্ট। ইট’স মাই ডিউটি স্যার।’

রাগে কপালের শিরা ফুলে উঠলো রুদ্রর। হিংস্র বাঘের মতো মারিয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রবৃত্তি হলেও মারিয়ার কোমরে ঝুলানো M1911 পিস্তলটি দেখে থমকে গেলো। মনে পড়লো, মেয়েটির হালকা-পাতলা শরীরে আশ্চর্য জোর ও কৌশলের কথা। মারিয়ার সাথে সপ্তাহখানেকের পরিচয় রুদ্রর। এই স্বল্প পরিচয়ের মাঝেই রুদ্র দুই দুইবার পালানোর চেষ্টা করেছে। আর প্রত্যেকবারই খুব বাজেভাবে ধরা পড়েছে। রুদ্র পুরুষ হিসেবে কোনো সাধুপুত্র নয়, সে কথা সত্য। সেই সাথে এ-ও সত্য এর আগে কখনো কোনো রমণীর সাথে শক্তি পরীক্ষায় নাম লেখানোর প্রয়োজন হয়নি তার। একটি প্রাপ্ত বয়স্ক রমণীকে কোথায় ধরে; কোথায়, কীভাবে আঘাত করা যেতে পারে, ভেবেই পায় না রুদ্র। আর তাতেই মারিয়ার জয়। শিকদার সাহেবের হঠাৎ করে যুবতী বডিগার্ড নিয়োগের চিন্তা কী করে এলো সে নিয়ে মনে মনে খুব বিরক্ত হলো রুদ্র। একজন শেতাঙ্গ আমেরিকান তরুণীকেই-বা কেন দেশ-জাতি ছেড়ে বাঙালি এক পুরুষের দেহরক্ষী হয়ে যেতে হবে সে নিয়েও বিতৃষ্ণায় ভারী হয়ে এলো বুক। পর পর তিনবার পরাজিত হয়ে পুরুষিত এক অহং-বোধেও পুড়তে লাগলো মন। শেষমেশ কিনা একটা মেয়ে তাকে পাহারায় রাখবে?পুরুষত্ব বলেও তো একটা কথা আছে নাকি? এ তো তার পুরুষত্বে নির্মম আঘাত! রাগে-দুঃখে অসহায় বোধ করলো রুদ্র। মারিয়া থেকে এক চুল ছাড় পাওয়ার উপায় নেই জেনেও হতাশ কন্ঠে বিড়বিড় করলো,

‘ আমার এখানে দমবন্ধ লাগছে। আমি একটু একা থাকতে চাই। লেট মি গো মারিয়া। লেট মি গো!’

_____________

পাহাড়ে রাত নেমেছে প্রায় ঘন্টা চারেক হলো। চারদিকে নিশ্চিহ্ন অন্ধকার। সেই নিশ্চিহ অন্ধকারকে চিড়ে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে চার চাকা মোটর গাড়ির শব্দ। কোথায় যেন হুঙ্কার দিচ্ছে অচেনা এক বুনো জীব। কী তীক্ষ্ণ তার আর্তনাদ! তপু কান খাঁড়া করে রইলো। চালকের সীটে বসে থাকা বড় মামাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘ বড় মামা এ কীসের ডাক? বুনো হাতি নিশ্চয়!’

কথাটা বলতে বলতেই উত্তেজিত চোখে চাইলো তপু। রুহুল আমিন এক গাল হেসে মাথা নাড়তেই উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠলো সে। চোখ বড় বড় করে বললো,

‘ ওহ মাই গড! এতো কাছে বুনো হাতি! গাড়ির সামনে পড়ে গেলে কী হবে? হঠাৎ আক্রমণ করবে না? এক শর্টে বর্ডার আউট। হুসসসস….”

তপু হাত দুটো জড়ো করে ছক্কা মারার মতো ঘুরিয়ে দেখালো। রুহুল আমিন হাসলেন। পায়ের কাছে একটা দোনলা বন্দুক ইশারা করে বললেন,

‘ আই হ্যাভ মাই ওয়ন ম্যাথডস্ মাই সান।’

তপু উৎসাহিত চোখে চাইলো। বড় মামা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার। এক সময়কার দুর্ধর্ষ সাহসী যুবা পুরুষ। তার কাছে এমন দু-একটা বন্দুক থাকা অসম্ভব কিছু না। তবুও উত্তেজনায় বুক কেঁপে উঠল তপুর। বড় মামা কী সত্যি সত্যিই বন্দুকটা চালায়? মাথায় এক দলা আগুন নিয়ে ছুটে যায় কারো বুকে? এই বন্দুক দিয়ে কী সত্য সত্যই হাতি মারা সম্ভব! এমন প্রকান্ড হাতি! তপুর বিস্ময় ভাবনার মাঝেই গাড়ি থামলো। বড় মামা মোটর থেকে এক রকম লাফিয়ে নামলেন। তপু চেয়ে দেখলো অন্ধকারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রকান্ড বাড়ি। রঙ চটে যাওয়া দেওয়াল আর লতাপাতা জড়ানো জীর্ণ বাড়িটা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে যাবতীয় অশুভ অন্ধকার। হাজারো ভৌতিক রহস্য বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একা, নিশ্চুপ। চারপাশে সহস্র অতৃপ্ত আত্মার কোলাহল। তপু বড় মামাকে অনুসরণ করে মোটর থেকে নেমে দাঁড়াল। তার পেছন পেছন নামলো মিতু। পায়ের চাপে শুকনো পাতার মরমর শব্দ হলো। কাছে কোথাও ভয়াবহ আর্তনাদ করে উঠল বুনো হাতির দল। এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠল জঙ্গল। তপু চমকে উঠল। পায়ের নিচের টিলাটিকে এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো কোনো ঘুমন্ত অজগর। এই বুঝি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াবে উপন্যাসের পাতার মতো। মিনিট পাঁচেক পর জং ধরা লোহার ফটকে ক্যাচক্যাচ শব্দ তুলে ছুটে এলো এক ভৃত্য। এক হাতে তার লণ্ঠন। চোখজোড়া সর্বদাই অস্থির, ভীত। তপু তাকে এক নজর দেখে আশেপাশে তাকাল। কিশোর মস্তিষ্কে অচেনা উত্তেজনা নিয়ে অন্ধকার জঙ্গলের দিকে চাইতেই নিজের ভেতর একদম অন্যরকম এক অনুভূতি খেলে গেলো। নিজের অজান্তেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো তপুর। অচেনা এক অস্বস্তিতে ঘিরে ধরলো মন। ঠিক তখনই দূরের ওই অন্ধকার বনে মানুষের ছায়ার মতোই কিছু একটা দেখতে পেলো তপু। ভ্রু কুঁচকে সেদিকে চেয়ে থেকেই শুনতে পেলো ভৃত্যের চাপা আতঙ্ক,

‘ তাড়াতাড়ি ভিতরে চলুন স্যার। এতো রাইতে বাহিরে থাকা ঠিক না। তেনার আসার সময় হইয়া গেছে। একটা বিপদ ঘটে গেলে…..’

তপুর ভ্রু জোড়া ত্রিভুজাকৃতি হয়ে গেল এবার। জঙ্গলের জটলা অন্ধকার থেকে চোখ সরিয়ে বাহাদুরের দিকে আগ্রহ নিয়ে চাইলো। মিতুর চোখেও দেখা গেলো কৌতুহল। শুধালো,

‘ কে আসবে? কার আসার কথা বলছেন?’

# চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here