তবুও পর্ব- ০১

0
2271

#তবুও
পর্ব- ০১
লেখা: #ত্রয়ী_আনআমতা

ফোন ধরতেই আমার বেস্টফ্রেন্ডের হবু বর রাগীব হড়বড় করে আমাকে বলতে লাগল,
‘ আমি কখনোই মিলিকে ভালোবাসিনি, খেয়া! শুরু থেকেই তুমি আমার হৃদয়ে ছিলে। আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমাকেই বিয়ে করতে চাই, মিলিকে নয়!’

আমার সবচাইতে শ্রেষ্ঠ বান্ধবীটির বাগদত্তা আমাকে প্রেম নিবেদন করছে। স্পষ্টভাবে সে বলছে, সে শুধু আমাকেই ভালোবাসে এবং আমাকেই বিয়ে করতে চায়। এতে কি আমার চমকানোর কথা ছিল? না-কি দুঃখ পাওয়ার?
সঠিক উত্তর আমার জানা নেই। কারণ এ মূহুর্তে আমার সব অনুভূতিদের দরজা বন্ধ। রাগ নামক অনুভূতিটা ছাড়া অন্য কোনো অনুভূতিই মস্তিষ্কে কাজ করছে না আমার। ইচ্ছে করছে গিয়ে ফোনের ওপাশে থাকা নির্লজ্জ লোকটার গলা চেপে ধরি। তাতে যদি একটু শান্তি মেলে!

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাগীব আবার বলতে লাগল,
‘সেদিন মিলির সঙ্গে সোনালী পাড়ের কালো শাড়ি পরে যখন তুমি আমার সামনে এলে, আমার পৃথিবী সেখানেই থমকে গিয়েছিল। এক সেকেন্ডের জন্যেও আমি তোমার থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। অদ্ভুত এক নেশা গ্রাস করে নিয়েছিল আমায়। বেহায়ার মতো নিজের বাগদত্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখছিলাম আমি! সত্যি বলতে আমিও প্রথমে এই অনুভূতিকে একদমই পাত্তা দিতে চাইনি। কিন্তু আমার অবাধ্য মন সে কথা শুনলে তো! সারাটাক্ষন শুধু নিষিদ্ধ তোমার কথাই ভাবে। দিন-রাত মস্তিষ্কে তোমাকে নিয়ে বয়ে চলতে চলতে আমার অবস্থা পাগলপ্রায়! আমাকে একটুখানি সুস্থ করে দাও না, খেয়া! ‘

কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে সে আবার বলল,
‘আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি খেয়া। জীবনে বিয়ে নামক বস্তুটা যদি করতেই হয়, শুধুমাত্র তোমাকেই করবো! ‘

আর সহ্য করতে পারলাম না আমি। ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠল। কান স্তব্ধ হয়ে এল। ফোন রেখে দিলাম। পুনরায় কল এলো মোবাইলে। রাগীবের নম্বর থেকেই। কল কেটে মোবাইল এরোপ্লেন মোডে দিয়ে রাখলাম। এবার করতে থাকুক যত খুশি কল!

.
কয়েক সপ্তাহ আগের কথা।
ভার্সিটিতে ক্লাসে বসে আছি। ক্লাস শুরু হতে আরো মিনিট দশেক বাকি। মিলি ক্লাসে ঢুকেই টেবিলে ব্যাগ রেখে বেঞ্চে বসতে বসতে বলল,
‘একটা জিনিস দেখবি?’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী?’

মিলি ব্যাগ থেকে স্মার্টফোন বের করে কিছু একটা করল। এরপর ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ছেলেটা দেখতে কেমন?’

দেখলাম মিলির মোবাইলের স্ক্রিনে একজন সুদর্শন যুবক হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। দেখতেও বেশ স্মার্ট।

মিলি আমাকে আলতো করে ধাক্কা দিল। ‘বললি না কেমন দেখতে?’

আমি বললাম, ‘ভালো।’

মিলি বোধহয় আশাহত হলো। ‘শুধুই ভালো?’

‘অনেক ভালো। ‘

মিলি গাল ভরে হাসলো। আমি আবার বললাম, ‘কিন্তু ছেলেটা কে?’

‘তোর দুলাভাই।’ মিলির মুখ ভর্তি হাসি। চোখে কিছুটা লজ্জা।

‘আমার দুলাভাই মানে? আমার তো কোনো বোন নেই। কোনোকালে ছিলও না!’

মিলি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘ গাধি! তোর দুলাভাই মানে আমার উড-বি।’

আমি বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। ‘তোর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে!’

‘এখনো ঠিক হয়নি। ঠিক হবার কথা বার্তা চলছে। ‘ মিলির মুখে তখনো লাজুক হাসি লেগে আছে। যার মানে ছেলেটি তার খুব পছন্দ!

তার দিন কয়েক বাদেই সেই ছেলেটির সাথে মিলির বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। জানতে পারি তার নাম রাগীব আবসার। পড়াশোনা শেষ করে বাবার ব্যাবসায় অংশগ্রহণ করেছে। মিলির বাবা মোশতাক আহমেদ রাগীবের বাবার বিজনেস পার্টনার। তারই সুবাদে দু’পরিবারের জানাশোনা। মিলিকে নিজেদের ঘরের বউ বানানোর প্রস্তাব রাগীব আবসারের বাবা শওকত হকই দিয়েছিলেন মিলির বাবাকে। মেয়ের জন্যে মনের মতো পাত্র পেয়ে মোশতাক আহমেদও আর দ্বিমত করেননি।
এসবকিছুই মিলির মুখে শোনা।

এরপর এনগেজমেন্টের দিন-তারিখ ঠিক হয়। এনগেজমেন্ট পার্টিতে আমিও গিয়েছিলাম। আর সেটাই আমার জন্যে কাল হয়।

সেদিন মিলির উড-বি’র সঙ্গে মিলিই আমাকে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেয়। রাগীবের সঙ্গে আমার শুধুমাত্র কুশল বিনিময় হয়। আর তেমন কোনো কথা হয় না।

এনগেজমেন্টের পর মিলিদের বাড়িতে রাগীবের নিয়মিত যাতায়াত শুরু হয়। মিলির বেস্টফ্রেন্ড হবার সুবাদে তাদের ঘরোয়া আড্ডায় আমাকেও অংশগ্রহণ করতে হতো। হঠাৎ একদিন কথার একপর্যায়ে রাগীব আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমার কেমন ধরনের ছেলে পছন্দ। আমি স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দেই স্মার্ট, মিশুক, চঞ্চল তবে উশৃঙ্খল নয় এমন ধরনের।
তখনো আমি বুঝতে পারিনি রাগীবের মনে কী চলছে!

আরেকদিন কথায় কথায় রাগীব মুখে হাসি এটে আমার সামনেই মিলিকে বলে, ‘মিলি, শাড়িতে কিন্তু খেয়াকে দারুণ লাগে তাইনা?’
সেই প্রথম রাগীবের কথাটা আমার কানে আঘাত করে। হবু স্ত্রীর সামনেই তার বান্ধবীকে কীভাবে কেউ এতটা স্বাভাবিকভাবে শাড়িতে দারুণ লাগে কথাটা বলতে পারে! কিন্তু মিলির হয়তো তাতে কিছুই যায় আসেনা। সে দিব্যি হাসতে হাসতে বলে, ‘একদম! দেখতে হবে না কার বেস্টি?’

রাগীবও তাল মিলিয়ে উত্তর দেয়, ‘হ্যা, সেটাই তো!’

কিন্তু আমি আর আগের মতো রাগীবের সাথে সহজ হতে পারি না। এর পেছনে আরো কিছু কারণ আছে অবশ্য।
আড্ডায় মিলিকে ছেড়ে পুরোটা সময় আমাকে এটা-ওটা প্রশ্ন করা, আমার ব্যাপারেই তার সকল আগ্রহ দেখানো, আমার দিকে তার নেশাগ্রস্ত হয়ে তাকিয়ে থাকা এসব কিছুই আমার দৃষ্টি এড়ায় না। আমার সবটা কেমন অস্বাভাবিক লাগে। অথচ মিলি কিছুই বোঝে না। সে সারাটাক্ষন রাগীবের ছোটো ছোটো ব্যাপারগুলো নিয়েও প্রশংসায় মত্ত থাকে। রাগীব তাকে কতোটা ভালোবাসে, তার ব্যাপারে কতটা ক্যারিং ইনিয়েবিনিয়ে সেসব বলতে থাকে আমাকে। আর ওদিকে রাগীব একদিন কীভাবে যেন আমার ফোন নম্বর জোগাড় করে ফেলে। প্রায়শই আমাকে ফোন দিতে থাকে। প্রথম প্রথম কল রিসিভ করে কুশল বিনিময় করে রেখে দিতাম। হবু দুলাভাই কি-না! দু-তিনদিন পরে সেটাও বন্ধ করে দেই আমাকে পাঠানো রাগীবের ছোটো একটা মেসেজে।

সেদিন আমার জন্মদিন ছিল। ঠিক রাত বারোটাতে সর্বপ্রথম রাগীবই আমাকে বার্থডে উইশ করে মেসেজ পাঠায়। ‘শুভ জন্মদিন ‘ কথাটার সাথে আরেকটা বাক্যও ছিল সে মেসেজে।

‘শুভ জন্মদিন, খেয়া! আশা করি তোমার জীবনের প্রত্যেকটা মূহুর্ত চমৎকারভাবে কাটুক আর সেই চমৎকারগুলো যেন শুধু আমাকে ঘিরেই থাকে!’

কথাগুলো কি মোটেও স্বাভাবিক?

এরপর থেকে রাগীবের ফোনকলসহ মিলিদের পারিবারিক আড্ডা আমি এড়িয়ে যেতে থাকি। তাতে মিলি রাগলেও। যাতে কখনো রাগীবের মুখোমুখি হতে না হয় আমাকে। কারণ তখনো আমার মনে ক্ষীণ একটা বিশ্বাস ছিল, হয়তো সবটাই মনের আমার ভুল! হয়তো রাগীব সম্পর্কে শ্যালিকা বলেই আমার সঙ্গে দুষ্টুমিস্বরূপ আচরণগুলো করছে!
কিন্তু আমার সব ধারণাকে ভেস্তে দিয়ে রাগীব একদিন হুট করে আমার বাসার সামনে এসে হাজির হয়। আমাকে মেসেজ করে, ‘খেয়া, আমি তোমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। একটু বারান্দায় এসে দাঁড়াবে প্লিজ! তোমাকে একনজর দেখেই আমি চলে যাবো।’

আমি জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি সত্যিই রাগীব দাঁড়িয়ে আছে। তৎক্ষনাৎ ওনাকে ফিরতি মেসেজে পাঠাই, ‘আপনি আমার বাড়ির সামনে কী করছেন? চলে যান প্লিজ! মিলিদের বাড়ির কেউ দেখে ফেললে উল্টোপালটা কী ভাববে আপনার কোনো ধারণা আছে!’

রাগীব পুনরায় লিখে পাঠালো, ‘কে কী ভাবলো তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আড়ালে বসে কেন টেক্সট করছো! বারান্দায় এসো।’

আমি লিখে পাঠালাম, ‘আপনার কিছু যায় না আসলেও আমার আসে। আমি বারান্দায় যাবো না।’

‘তুমি বারান্দায় না এলে আমিও এখান থেকে এক পাও নড়ব না!’

‘তাহলে দাঁড়িয়েই থাকুন! আমি কিছুতেই যাবো না বারান্দায়।’

রাগীব সত্যি সত্যিই দাঁড়িয়ে থাকে। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে, সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হয়ে যায়। মিলির পরিবারের কেউ দেখলে সেটা সত্যিই কেউ স্বাভাবিকভাবে নিতো না। তাই বাধ্য হয়ে আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। দূর থেকেই আমি রাগীবের মুখ ভর্তি হাসি স্পষ্ট দেখতে পাই। ওই হাসি যেন আমাকে ব্যঙ্গ করে বলছিল, ‘তুমি না-কি আসবে না? দেখলে তো, ঠিকই আসলে!’

বারান্দায় দাঁড়িয়েই আমি রাগীবকে মেসেজ দেই। ‘প্লিজ এখন চলে যান। আর কাইন্ডলি কখনো এমন ঘটনা ঘটাবেন না। ‘

মেসেজের প্রতুত্তরে রাগীব মেসেজ করে, ‘ঘটাবোই।’

আমার মেজাজ খারাপ হয়। এসব কী ধরনের কথা?
‘তাহলে আমিও বাধ্য হবো মিলিকে আপনার কর্মকাণ্ড স্বমন্ধে জানাতে।’

‘কী জানাবে?’

‘আপনি যেসব আচরণ করছেন আমার সঙ্গে। ‘

‘জানাও। আমি কাউকে ভয় পাই না!’

এবার আমি বিরক্ত হই। ‘আপনি এসব কেন করছেন আমার সঙ্গে বলুন তো!’

রাগীব টেক্সট করে, ‘তুমি কি সত্যিই বুঝতে পারো না, খেয়া!’

‘না আমি বুঝতে পারি না, বুঝতে চাইও না। আপনি দয়া করে এসব বন্ধ করুন!’

রাগীব মেসেজ না পাঠিয়ে সরাসরি আমাকে কল করে। আমি রিসিভ করতেই বলে,
‘সেটা সম্ভব নয়, খেয়া। অনেক দেরি হয়ে গেছে। ইতোমধ্যেই আমি তোমার প্রেমে গভীরভাবে পরে গেছি।’

‘আপনার কী কোনো লজ্জাবোধ নেই রাগীব?একজনের বাগদত্তা হয়ে অন্য আরেকটি মেয়ের প্রেমে কীভাবে পরতে পারলেন? তাও আবার কোনো যেনতেন ব্যাক্তি নয়। আপনার বাগদত্তার বান্ধবী! ‘

‘আমার কী দোষ খেয়া! তুমিইতো দেরি করে ফেললে আমার জীবনে আসতে! আমি একটা ডিসিশন নিয়ে ফেলেছি। অনেক দেরি হয়েছে আর না। অতি শীঘ্রই আমার মা-বাবাকে তোমার কথা জানিয়ে দেব। বলবো, আমি মিলিকে নয় তোমাকে ভালোবাসি। মিলিকেও সব বুঝিয়ে বলবো। ও বুঝদার মেয়ে। বুঝিয়ে বললে ঠিকই বুঝবে।’

‘আপনি খুবই জঘন্য একজন মানুষ, রাগীব।’

ওপাশ থেকে হো হো করে হাসির শব্দ ভেসে আসে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here