#তবুও
পর্ব- ০২
লেখা: #ত্রয়ী_আনআমতা
রাগীবের কর্মকাণ্ডগুলো দিন দিন অসহনীয় হতে থাকে। সেদিন ক্লাস শেষে ফেরার সময় দেখি রাগীব ভার্সিটির গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে। আমার সঙ্গে মিলিও ছিল। রাগীবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিলি ধরেই নিয়েছিল ওর জন্যেই অপেক্ষা করছে সে। এদিকে আমি আশংকায় কাঁপছি। যদি রাগীব উল্টোপালটা কিছু বলে, করে বসে!
আমাদের দেখে রাগীব এগিয়ে আসে। বলে, ‘এতক্ষণে শেষ হলো ক্লাস! দু’ঘন্টা যাবৎ দাঁড়িয়ে আছি তোমাদের অপেক্ষায়।’
কী ভেবে মিলির দিকে তাকাতেই দেখি ওর মুখে রাজ্য জয়ের হাসি। ও হয়তো স্বাভাবিক ভাবেই ভাবছে, ওর জন্যেই অপেক্ষা করছিল রাগীব! তার মনের গরলের স্বমন্ধে তো আর সরল মিলির ধারণা নেই।
তাই হয়তো রাগীবের দিকে মিষ্টি হাসি ছুড়ে দিয়ে বলল,
‘সকালে আমাকে একটা ফোন দিলেই তো পারতে। তোমার জন্য না-হয় কয়েকটা ক্লাস মিস-ই দিতাম!’
মিলি আচমকাই আপনি থেকে তুমিতে নেমে গেছে। ওদের সম্পর্কটা কি আরেকটু গাঢ় হয়েছে তাহলে? হঠাৎই আমাদের বুকের মাঝখানটায় এক অদ্ভুত যন্ত্রণাময় অনুভূতি হলো। যার মানে, যা হচ্ছে কিচ্ছু ঠিক হচ্ছে না। মিলি ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে। যেখান থেকে ওকে ফিরিয়ে আনবার সাধ্য আমার নেই!
রাগীবের কথায় আমার ভাবনা বিচ্যুতি হলো। ‘তোমার নম্বরে ফোন করেছিলাম প্রথমে। ফোন সুইচড অফ বলল। খেয়ার নম্বরে করলাম এরপরে। সে তো ফোন ধরলোই না!’
মিলি বলল, ‘ওহ! ওর ফোন প্রায়ই সাইলেন্ট মোডে থাকে। তখনো মেইবি ছিল। তাই না খেয়া?’
আমি মাথা নাড়িয়ে মিলির কথায় সায় দিলাম। রাগীবের দিকে আড় চোখে তাকাতেই দেখলাম সে বাঁকা হেসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এর মানে, সে জানে আমি ইচ্ছে করেই তার ফোন ধরিনি।
রাগীব বলল, ‘চলো কোথাও গিয়ে বসি! সামনেই একটা ক্যাফে দেখলাম। ওখানে যাবে?’
মিলি বলল, ‘আচ্ছা চলো!’
এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আয়, খেয়া!’
না যাবার জন্যে বাহানা খুঁজতে লাগলাম। পেয়েও গেলাম একটা।
‘আমি যাবো নারে! শরীরটা ভালো লাগছে না। তোরা যা। আমি নাহয় অন্য কখনো যাবো!’
রাগীব সেই বাঁকা হাসি অটল রেখেই এদিক ওদিক তাকালো। মুখে ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভঙ্গি। তার চোখ যেন আমাকে বলছিল, বাহ কী অভিনয়!
আমার অজুহাত কাজে লেগে গেল। চিন্তিত স্বরে মিলি বলল, ‘আচ্ছা, ঠিকাছে। বাসায় গিয়ে রেস্ট নে তাহলে। একা যেতে পারবি তো?’
‘পারবো। তুই শুধু শুধু টেনশন নিস না!’
বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে মোবাইলটা হাতে নিতেই রাগীবের মেসেজ চোখে পড়ল। প্রায় পাঁচটা। মেসেজগুলো এরকম,
‘ঠিক কতোদিন এক্সকিউজ দিয়ে আমাকে এড়িয়ে চলতে পারবে? সবকিছুরই শেষ আছে। তোমার বাহানার কি কোনো শেষ নেই?’
‘তুমি কী গাড়িতে না-কি বাসায় পৌঁছে গেছ?’
‘তোমাকে ছাড়া ভালো লাগছে না। ওভাবে চলে যাওয়াটা কি খুব দরকার ছিল?
‘মেসেজ সিন করছো না কেন?’
‘রিপ্লাই করবে না-কি তোমার বাড়িতে গিয়ে হাজির হব?’
এ মুহূর্তে তো রাগীবের মিলির সাথে ক্যাফেতে থাকার কথা! সে কী মিলিকে পাশে রেখেই আমাকে মেসেজ করছে? এতো নিচে মানুষ কীভাবে নামতে পারে?
আমি ফিরতি মেসেজ করলাম, ‘আপনার কী মনে হয়? আমার বাড়িতে এসে হাজির হলে আপনাকে আমার মা-বাবা সিংহাসনে বসিয়ে আপ্যায়ন করবে? ‘
পুনরায় মেসেজ এল, ‘উহুঁ, জামাই আদর করবে।’
‘কপাল খারাপ থাকলে জুতোপেটাও করতে পারে!’ শেষ মেসেজটা দিয়ে ফোন অফ করে রাখলাম। ওনার অসভ্যতামো আর সহ্য হচ্ছে না।
দুপুরের খাবারের পর শোবার অভ্যেস আছে আমার। এমন সময়ে একটা ভাতঘুম না দিলে আমার ভালো লাগে না। তাই একটু শুয়ে ছিলাম। যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলেছে। বেলা পেরিয়ে গেল অথচ মা আমাকে ডাকলো না কেন!
দিনের বেলা দীর্ঘক্ষণ শুয়ে থাকাতে শরীরটা ম্যাজম্যাজ লাগছে। হাত-মুখ ধুয়ে এলাম। এখন খানিকটা সতেজ লাগছে নিজেকে। হাত খোঁপা করতে করতে ড্রয়িংরুমে যেতেই এক জোড়া মোহাবিষ্ট চোখ নজরে এলো আমার। সঙ্গে সঙ্গে শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। রাগীব সোফায় বসে!
সে একা নয়। আমার মাও তার সাথে বসে আছে। মায়ের ভাবভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছে কোনো জরুরি বিষয় নিয়ে কথা বলছে। রাগীবের সঙ্গে মায়ের কী জরুরি কথা থাকতে পারে?
আমাকে দেখে মা হাসিমুখে বলল, ‘এতক্ষণে উঠলি! তোর বন্ধু সেই কখন থেকে বসে অপেক্ষা করছে তোর জন্য!’
বন্ধু! রাগীব নিশ্চয়ই এ বাড়িতে আমার বন্ধু সেজেই ঢুকেছে। আর মাও আমার বন্ধু ভেবে তার সঙ্গে খোশগল্পে মেতে উঠেছে।
মা’কে বললাম, ‘আমাকে ডাকোনি কেন?’
মা বলল, ‘ডাকতে চেয়েছিলাম। তোর বন্ধুই নিষেধ করল। বস, আমি তোদের জন্য নাস্তা নিয়ে আসছি।’
বলেই মা চলে গেল। আমি রাগীবের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনি এ বাসায় কী করছেন? আপনার এত সাহস কী করে হয় আপনি আমার বাড়ি অব্দি এসে পড়লেন!’
রাগীব অকপটে বলল, ‘এতে সাহসের কী আছে? তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করলো তাই এলাম। আর তুমি বলেছিলে না তোমার প্যারেন্টস আমাকে জুতোপেটা করবে? কই! করলো তো না। বরং হাসিমুখে গল্প করলো। ‘
বিরক্তিতে মনটা ছেয়ে গেল। ‘বাবা বাসায় থাকলে ঠিকই জুতোপেটা করতো। আর আপনি তো আপনার আসল পরিচয়ে এ বাড়িতে ঢোকেননি! কাপুরুষের মতো মিথ্যে কথা বলে আমার বন্ধুর পরিচয়ে ঢুকেছেন। তাই এ যাত্রায় বেঁচে গেছেন মা’র হাত থেকে।’
আমার কথায় রাগীবের কিছু গেল এল বলে মনে হল না৷ এরইমধ্যে মা নাস্তা নিয়ে এল। মা’কে বললাম, ‘মা আমরা বাইরে থেকে খেয়ে নেবো! এসব নিয়ে যাও। শুধু শুধু কেন আনতে গেলে!’
মা বলল, ‘ সেকি! খেয়ে তারপর যা।’
রাগীবও মায়ের কথায় তাল মেলালো, ‘হ্যা। আন্টি কত কষ্ট করে রান্না করল এতকিছু। না খেয়ে গেলে কেমন দেখায়!’
আমি ভ্রুকুটি করে তাকাতে রাগীব কথা ঘুরিয়ে বলল, ‘আন্টি, আজ আমি আসি। বেলা পরে যাচ্ছে। অন্য কোনোদিন এসে আপনার হাতের নাস্তা করে যাবো।’
মা হাসিমুখে জবাব দিল, ‘আচ্ছা বাবা, সাবধানে যেও!’
মা’র এই এক দোষ। যখন তখন যাকে তাকে বাবা-মা ডেকে ফেলে! অসহ্য!
আমার পিছু পিছু রাগীব বেরিয়ে এল। বাসা থেকে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে রাগীবকে শুধু একটা কথাই বললাম, ‘এতটা সাহস যখন দেখিয়েছেনই বুকের পাটা থাকলে আরেকটা সাহস দেখান! আমার লাইফে ইন্টারফিয়ার করাটা বন্ধ করে দিন।’
রাগীব জবাব দিল, ‘স্যরি, এতোটাও বুকের পাটা নেই আমার!’
‘আপনি আসলে কী বলতে চাইছেন?’
‘এটাই, তোমার জীবনে দখলদারি করাটা আমি বন্ধ করতে পারবো না।’
তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম, ‘আমার দেখা পৃথিবীর সবচাইতে নিকৃষ্ট জীব আপনি, রাগীব!’
রাগীব নিজের কিছুই পরোয়া না করা ভাবটা বজায় রেখেই বলল, ‘জানি!’
.
পরদিন ভার্সিটিতে মিলির সঙ্গে দেখা হল। ক্লাস ব্রেকের সময় ওকে প্রশ্ন করলাম, ‘মিলি! একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?’
মিলি বলল, ‘বল এতে সংকোচ করার কী আছে!’
‘দুলাভাইকে মানে রাগীবকে তুই কতটা পছন্দ করিস?’
মিলি লাজুকলতার মতো গুটিয়ে গেল। কন্ঠে লাজুকতা এনে বলল, ‘আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি রে!’
আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি ওকে কীভাবে বোঝাবো, রাগীব তোর জন্য সঠিক ছেলে নয়, তুই ভালো কাউকে ডিজার্ভ করিস!
.
রাত নয়টার দিকে একটা অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ আসে। মেসেজটা দেখে আমার আর বুঝতে বাকি রইল না কার পাঠানো।
‘মা’কে তোমার কথা সব জানিয়ে দিয়েছি খেয়া। এখন শুধু মিলিকে বুঝিয়ে বলা বাকি! এরপর তুমি আমার হতে আর কোনো বাধা থাকবে না!’
পিলেচমকে উঠলাম আমি। রাগীব নিজের মা’কে জানিয়ে ফেলেছে মানে! উনি কী বিনাবাক্যেই মেনে নিয়েছেন সেটা! নাহ আর কিছু ভাবতে পারছি না আমি। মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে। রাগীবের আগেই মিলিকে আমার সব জানানো দরকার! পাছে রাগীব ওকে ভুজুংভাজুং বোঝায়। আর আমাদের সম্পর্কটাকে বিষিয়ে না তোলে!
চলবে…