#তবুও
পর্ব- ০৩
আমি একজন অন্তর্মূখী স্বভাবের মানুষ। চাইলেও সহজে কারো সঙ্গে মিশতে পারি না। ভীতু প্রকৃতির হওয়ায় বাবা আমাকে নিয়ে সর্বদা তটস্থ থাকেন। মিলি একদিন ভার্সিটিতে না গেলে সেদিন আমারও আর যাওয়া হয়না। বাবা যেতে দেন না।
চুপচাপ স্বভাবের হওয়ায় স্কুল-কলেজে আমার তেমন কোনো বন্ধু ছিল না। ভার্সিটিতে ওঠার পর দুয়েকজন বন্ধু-বান্ধবী হয়েছে। তবে তাদের সঙ্গে এখনো তেমন একটা মুক্তমনা হয়ে উঠতে পারিনি।
মিলির সঙ্গে বন্ধুত্ব আমার সেই প্রাইমারি থেকে। ছোটো থেকে একসঙ্গে বড় হওয়ার কারণে কিংবা মিলির যেচে মিশতে আসার কারণে হয়তো সেসময় কোনো একভাবে ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা হয়ে যায়। সেই থেকে ওই আমার একমাত্র বান্ধবী। শ্রেষ্ঠ বান্ধবী। এ কথা বাবাও খুব ভালো করে জানেন। তাই হয়তো মিলিকে এতোটা ভরসা করেন!
অথচ আমার সরল মা দিন-দুনিয়ার প্রায় কিছুই বোঝেন না। নিজের স্বামী-সন্তানকেও না! কেউ যদি তাকে এসে বলে,
আন্টি আমি খেয়ার বয়ফ্রেন্ড!
আপা আমি তোমার হারিয়ে যাওয়া বোন!
মা হয়তো সেটাও বিশ্বাস করে নেবে। সত্যি মিথ্যে যাচাইয়ের ঝামেলায় যাবে না।
হয়তো সেকারণেই মায়ের সঙ্গে আমার তেমন একটা নিবিড় হওয়া হয়ে উঠেনি।
তাই পৃথিবীতে একমাত্র মিলিই আছে যার সঙ্গে আমার কখনোই কোনো লুকোচুরি চলে না। যাকে মনের সবচাইতে গোপন কথাটিও নির্ভয়ে বলতে পারি আমি। কিন্তু আজ আমি জীবনের এমন এক কাঠগড়ায়, যেখানে দাঁড়িয়ে মিলিকে সত্যিটা বলার সাহস নেই আমার। অথচ লুকোনোটাও অপরাধের পর্যায়ে পড়ে!
নিজের মনের সঙ্গে দীর্ঘ দ্বন্দ্ব চলল আমার। অবশেষে জয়ী হয়ে মিলিকে ফোন দেবার সিদ্ধান্ত নিলাম।
বেশ কয়েকবার কল করলাম ওকে। রিসিভ হলো না। তাই মেসেজ করলাম,
‘আগামীকালকে ঘুম থেকে উঠেই তুই আমার বাড়ি চলে আসবি প্লিজ! নাস্তা না করেই। আমরা বাইরে নাস্তা করে নেব। তোর সঙ্গে খুব জরুরি কথা আছে আমার!’
মিনিট পাঁচেক বাদে মেসেজটা সিন হলো। কিন্তু কোনো রিপ্লাই এলো না। আবার লিখলাম,
‘কী হলো রিপ্লাই করছিস না কেন?’
এবারও আগের মতোই। সিন হলো কিন্তু কোনো রিপ্লাই নেই! পুনরায় পাঠালাম,
‘রিপ্লাই করছিস না কেন? অন্তত ফোনটা ধর!’
পুনরায় সেন্ড করে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। ভাবলাম কিছুক্ষণ পরে হয়তো করবে রিপ্লাই! এখন নিশ্চয়ই ব্যস্ত! কিন্তু না। দেড় – দু’ঘন্টা হয়ে গেল কোনো সাড়া নেই।
সচরাচর দশটা বাজলেই ঘুমিয়ে পড়ি আমি। আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন। রাত বারোটা অব্দি মিছে জেগে রইলাম মিলির একটা রিপ্লাইয়ের আশায়।
.
খুব ভোরে এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো। রাতে ফোনে ভোর ছয়টার এলার্ম সেট করে রেখেছিলাম। মিলির সাথে দেখা করার জন্যে। হাত-মুখ ধুয়ে ফোন ঘেটে দেখলাম মিলি রিপ্লাই করেছে কি-না। নাহ! কোনো মেসেজই আসেনি একটা আননোন নম্বরের মেসেজ ছাড়া। ‘গুড মর্নিং ‘ লেখা সেখানে। আমার আর বুঝতে বাকি রইল না কার পাঠানো। এই নিয়ে মোট চারটা সিম ব্লক করলাম রাগীবের। সামনে আর কতগুলো করতে হবে কে জানে!
সকাল আটটা বেজে গেল মিলি এল না। আসবেও না। আমার বোঝা হয়ে গেছে কী ঘটেছে ওর সঙ্গে! রাগীবের পরিবার নিশ্চয়ই বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে! ওর ওপর দিয়ে কী যাচ্ছে ভাবতেই গা শিউরে উঠল আমার। আচ্ছা মিলি জেনে যায়নি তো রাগীব আমাকে পছন্দ করে! রাগীব যে ধরনের ছেলে ও নিশ্চিত এসব নিজ মুখেই বলে দিয়েছে মিলিকে। ওর বাগদত্তা যাকে ও ভালোবাসে সে আর কাউকেই নয়, ওর বেস্টফ্রেন্ডকে পছন্দ করে। এটা কী সহ্য করতে পারছে মিলি? ওর হৃদয়ে কী রক্তক্ষরণ হয়ে বন্যা বয়ে যাচ্ছে না? দুঃখে আমার চোখে জল চলে এলো। আমার বেচারি বান্ধবী! না জানি এসব কীভাবে সহ্য করছে ও!
সেজন্যেই হয়তো ও আমার ফোন ধরছে না। মেসেজের রিপ্লাইও করছে না। ও কী আমাকে ভুল বুঝছে? ও কী ভাবছে আমিও রাগীবকে ভালোবাসি! ভাবতেই আমার গা গুলিয়ে এলো। আমার বেস্টফ্রেন্ডকে যে ধোঁকা দিয়েছে তাকে আমি ভালোবাসবো? অসম্ভব! মিলির সাথে আমার এক্ষুনি দেখা করা দরকার। ওকে সত্যিটা জানালে হয়তো ওর কষ্টটা কিছুটা হলেও কমবে!
মিলিকে ফোন করতে করতেই বাসা ছেড়ে বেরোলাম। গন্তব্য মিলিদের বাড়ি। কিছুদূর এগোতেই একটা রিকশা পেয়ে গেলাম। হেঁটে যাবার মতো মানসিকতা আমার নেই। দু’সেকেন্ড দেরিও আমার সইছে না। রিকশায় বসেই মিলিকে ফোন দিতেই থাকলাম। যাতে বিরক্ত হয়ে হলেও ফোনটা অন্তত ধরে। কিন্তু ধরলোই না মেয়েটা!
এসে পড়েছি। রিকশাওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে মিলিদের বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম। সিড়ি বেয়ে দুরুদুরু বুকে উঠতে লাগলাম। ভয়ে বুক কাঁপছে। না জানি ওখানে কী অপেক্ষা করছে আমার জন্য!
দু’বার কলিংবেল বাজাতেই মিলি এসে দরজা খুলল। ওর বিধ্বস্ত চেহারা দেখে আমার ভীষণ মায়া লাগল। দেখে মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে কাঁদছে ও।
এতক্ষণ হয়তো মিলি খেয়াল করেনি দরজার বাইরে কে দাঁড়িয়ে। ভেতরে ঢুকতে নিতেই আমার ওপর চোখ পরল ওর। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিল।
দরজা ধাক্কাতে লাগলাম আমি।
‘মিলি দরজা খোল! প্লিজ মিলি! তোর সঙ্গে আমার ভীষণ জরুরি কথা আছে!’
মিলি দরজা খুলল না। খোলার প্রয়োজনই বোধ করছে না হয়তো। তা স্বত্তেও দরজা ধাক্কাতেই থাকলাম।
পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে অন্য ভাড়াটিয়ারা আমার দিকে অদ্ভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি পেছন ফিরে তাকাতেই তারা দরজা লাগিয়ে দিল। আমার অপ্রস্তুত লাগতে লাগল।
কলিং বেল বাজিয়ে আবার ডাকতে লাগলাম মিলিকে।
‘মিলি প্লিজ দরজাটা খোল! তুই যদি আমাকে কিছু বলার সুযোগই না দিস আমি কীভাবে ভুল ভাঙাবো তোর?’
এ কথায় হয়তো কাজ হলো। মিলির মা এসে দরজা খুলে দিলেন। আন্টি আমার দিকে তাকিয়ে অগ্নিবৃষ্টি বর্ষণ করলেন যেন। রুষ্ট কন্ঠে বললেন,
‘এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা না করে ভেতরে ঢোকো।’
আন্টি কখনোই আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলেন না। বরং মিলির সঙ্গে এবাড়িতে এলে কতো আদর-যত্ন করতেন! এখনকার অবস্থা পৃথক। মিলির মতো আন্টিও নিশ্চয়ই আমাকে ভুল বুঝছেন! ভাবছেন তার মেয়ের এ অবস্থার জন্যে আমিই দায়ী!
আমি ভেতরে ঢুকতেই মিলি তেড়ে এল।
‘মা ওকে ভেতরে আনলে কেন?’
আন্টি বললেন, ‘ও যদি বাইরে দাঁড়িয়েই সব বলতে শুরু করে? তখন তো পুরো বিল্ডিংয়ে ছড়িয়ে যাবে আমার মেয়ের বিয়ের ভেঙে গেছে একটা বাইরের মেয়ের জন্য!’
আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, ‘আন্টি আপনারা আমাকে ভুল বুঝছেন। মিলির বিয়ের ব্যাপারেও, বাইরের লোকদের জানানোর ব্যাপারেও। আমি কখনোই চাইবো না আমার বান্ধবীর বিয়ে ভাঙুক কিংবা সে কথা লোক জানাজানি হোক! ও আমার বেস্টফ্রেন্ড!’
মিলি নিজের রুমে গিয়ে শব্দ করে দরজা আটকে দিল।
আন্টি কন্ঠে একরাশ ঘৃণা ঢেলে বললেন, ‘তুমি কী করতে পারো না পারো তা আমাদের বেশ ভালো করেই জানা আছে! যে মেয়ে নিজের বান্ধবীর হবু স্বামীকে ফুসলিয়ে নিজের প্রেমে ফেলতে পারে সে আর কী কী করতে পারে তা আর তোমার আলাদাভাবে জানানোর প্রয়োজন নেই।’
আমি তাজ্জব বনে গেলাম। আমি রাগীবকে ফুসলিয়েছি মানে! ‘আন্টি আমার রাগীবের সঙ্গে কখনো ভালো করে কথাও হয়নি! আর সে তো বাচ্চা নয়! ও যা করেছে স্বইচ্ছায় করেছে। দোষ যদি দিতে হয় ওকে দেওয়া উচিৎ! আপনি কেন শুধু শুধু ওর রাগটা আমার ওপর রাগ ঢালছেন আন্টি!’
‘তোমার মতো বেয়াদবকে ঘরে ঢোকানোটাই আমার ভুল হয়েছে। অন্যায় করেও বড়দের মুখের ওপর সমানে তর্ক করে যাচ্ছো! ‘
এরপর এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে বললেন, ‘বের হও! আর কখনো যেন তোমাকে মিলির কাছে ঘেষতে না দেখি!’
‘আমার মিলির সঙ্গে কথা আছে আন্টি!’
‘আবার মুখের ওপর কথা বলো! বের হও আমার বাড়ি ছেড়ে!’
আন্টি প্রায় গলাধাক্কা দিয়েই বের করে দিলেন আমাকে। একপ্রকার অপমানিত হয়ে মিলিদের বাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম।
এরপর এক সপ্তাহ পেরিয়ে যায়। পুনরায় মিলির বাড়িতে যাবার সাহস না হলেও ওকে ফোন করতে ভুলিনি। ও আমার নম্বর ব্লক করে রেখেছে। এমনকি আমার মায়ের নম্বরও। ভার্সিটিতে যাচ্ছিনা রাগীবের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে। তাই এক সপ্তাহ যাবৎ মিলির সঙ্গে দেখা, কথা কিছুই হচ্ছে না। মিলিও নিশ্চয়ই ভার্সিটিতে যাচ্ছে না।
নিজের ঘরে এক প্রকার বন্দী হয়ে আছি আমি। মা’কে বলে রেখেছি বাবা আর মিলি ছাড়া অন্য কেউ যদি আমার খোঁজ করে যাতে বলে, আমি বাড়ি নেই। কারো সঙ্গে দেখা করার, কথা বলার মানসিকতা নেই আমার।
___
এরই মধ্যে ঠিক একমাস পরপরই রাগীব নিজের মা’কে নিয়ে আমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে।
চলবে…
লেখা: #ত্রয়ী_আনআমতা