তবুও_তুমি
১ম পর্ব
মারিয়া আফরিন নুপুর
” তোর নাভির উপরের তিলটা কি মানুষকে না দেখালেই নয়?” পিছন থেকে হঠাৎ এই কথা শুনে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম আমি। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি রাসেল ভাইয়া। ” কিছু জিনিস ঢাকা রাখ না হলে জামাইকে দেখাবি কি” এই বলেই গটগট করে হাঁটা দিল সে। তাড়াতাড়ি করে নিচে তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই পেট বের হয়ে গেছে শাড়ি সরে। মনে চাচ্ছিল সত্যিই মরে যাই। এতটা বেখেয়ালি কেন আমি। উফফ কত মানুষ দেখেছে কে জানে। এসব ভাবতে ভাবতেই বড় আপুর ডাক ” নিপা এদিকে আয় ভাইয়া স্টেজে এসেছে। গায়ে হলুদ দিয়ে যা ভাইয়াকে “। আপুর ডাক শুনে তাড়াতাড়ি স্টেজের দিকে গেলাম যেয়ে দেখি রাসেল ভাইয়া দাঁড়ানো।লজ্জায় মনে হচ্ছিল মাটির সাথে মিশে যাই। ইয়া আল্লাহ কেমনে কি হয়ে গেল।
আজকে আমার খালাতো ভাইয়ের গায়ে হলুদ। তাই খুব শখ করে এক রকম শাড়ি পরেছি সবাই। অন্যন্য্রা শাড়ি পরতে পারলেও আমি খুব অজ্ঞ শাড়ি পরার ব্যাপারে৷ বড় ভাবি এক কুড়ি দশটা সেপটিপিন দিয়ে শাড়ি যেন আমার পেটিকোট আর ব্লাউজের সাথে আটকে দিয়েছে৷ নিচে নামছি আর ভাবছি কি করে কি করব। শাড়ি খোলার সময় এত গুলো পিন কি করে খুঁজে পাবো। তার চেয়ে বড় টেনশন শাড়িটা যদি ছিঁড়ে যায়৷ এসব উনিশ কুড়ি ভাবতে ভাবতে নিচে নামতেই বড় মামী বিশাল এক সাগোরানার প্লেট ধরিয়ে দিয়ে বলল স্টেজ এ রেখে আসতে। প্লেট রেখে আসার পথেই এই কাহিনী। রাসেল ভাইয়ার খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড আগে দেখা হলেও সালাম ছাড়া আর বেশি কিছু কথাই হয় নি কোন দিন।আজকে হঠাৎ করেই উনার এই অবতার দেখে মনে চাচ্ছিল মরে যাই। এমন ভুল হল কি করে। আবার এই ভেবে মন কে স্বান্তনা দিচ্ছিলাম আল্লাহ বাঁচাইছে বেশি লোক দেখার আগেই ধরিয়ে দিয়েছে।সে যাই হোক ভাইয়াকে মেহেদি লাগানোর পরে যখন স্টেজ থেকে নেমে আসলাম এক কোনায় দেখি রাসেল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শিহাব ভাইয়ের সাথে কথা বলছে। আস্তে আস্তে গেলাম তাদের কাছে। আমি যেতেই শিহাব ভাইয়ের কল আসল উনি একটু সরে কথা বলতে লাগলেন। আমাকে দেখে রাসেল ভাই চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বলল ” সমস্যা কি”। ” না কোন সমস্যা না আসলে সরি আর ধন্যবাদ দিতে আসছিলাম” মিন মিন করে শ্বাস আটকিয়ে কোন রকমে কথা গুলো বললাম। ” তোর কি জন্মের সময় মাথায় অক্সিজেন সাপ্লাই কম হয়েছিল রে? ” আমার দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য স্বরে কথা গুলো বলল উনি। ” হঠাৎ এমন মনে হওয়ার কারন? ” আমার প্রশ্ন শুনে উনি আমার দিকে আরো আশ্চর্য হয়ে তাকালেন। ” আচ্ছা বাদ দে, এখন বল সরি আর ধন্যবাদ দেওয়ার কারণ ” আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন উনি। ” সরি কারন শাড়িটা সরে গিয়েছিল আমি টের পাই নি তাই। আর ধন্যবাদ শাড়িটা ঠিক করতে বলার জন্য” এটুকু বলেই বড় একটা নিশ্বাস নিলাম। মনে হচ্ছিল একটু পানি পেলে খুব ভাল হত। কারণ গলাটা প্রচুর শুকিয়ে গিয়েছিল। এটুকু শুনেই রাসেল ভাই কিছু বলার আগেই মিলি এসে হাজির ” নিপাপু তোমাকে আম্মু ডাকছে” এই বলেই হ্যাঁচকা টান দিয়ে আমাকে নিয়ে চলা শুরু করল। পিছনে চেয়ে দেখলাম যেন উনার মুখে বিশাল এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন আঁকা। ঘাড় ঘুরিয়ে মিলির পিছনে হাঁটছি আর ভাবছি আজব কাহিনী এত সুন্দর করে বলে আসলাম তাও বুঝি বুঝল না।
খালার সামনে আসতেই দেখলাম বাকি তিনবোন মাথা নিচু করে দাঁড়ানো। মানহা আপু আর বড় আপুর চোখে পানি৷ জিমি মিলির মুখ অন্ধকার তখনই বুঝি নিলাম আজকে শনির দশা আছে কপালে। ” নিপা এই সব গুলোর মধ্যে আমি ভেবে ছিলাম তোর আক্কেল পছন্দ একটু বেশি৷ এখন দেখি তুইও ওদের দলে নাম লিখিয়েছিস” এটুকু বলেই খালা চোখ গরম করে আমার দিকে তাকালেন। আমি মাথার মধ্যে ক্যালকুলেশন করতে লাগলাম এরা করেছে কি। সে যাই হোক আমি করেছি কি? আর এখন খালার সামনে কথা বলা আর নিজেরে সিংহের খাঁচায় ঠেলে দেওয়া এক কথা। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে চুপ করে থাকলাম। কেননা আমরা বোনেরা সবাই জানি খালা তার এপিসোড পুরো করবেই।” জয়রে জামাল গোটা খাওয়াইছে কে? আমি জানি তোদের মধ্যেই কেউ একজন এই কাহিনী করছে” এই বলেই খালা ফোঁস ফোঁস শব্দ করতে লাগল। যেন মানুষ না কোন সাপ। পাঁচ বোন একজন আরেক জনের দিকে তাকালাম। বড় আপু আর মানহা আপুর গাল লাল মানে কষিয়ে চড় পড়েছে গালে। চোখের ইশারায় বুঝি গেলাম এই কাজ আমার কোন বোনেরা করে নাই। কারণ আমরা যাই ফাজলামি করি না কেন কখনও বোনদের কাছে লুকাই না। খালা তখনও তার অল ইন্ডিয়া রেডিও ইষ্টেশন অন করে রেখেছেন আর সমান তালে বকে যাচ্ছেন। ভাইয়া একটু পর পর স্টেজ থেকে উঠে উঠে ওয়াশরুমে যাচ্ছে আর আসতেছে।বড় করে একটা নিশ্বাস নিয়ে খালাকে বললাম
___ আপনি কখনও দেখেছেন আমাদের এই টাইপের ফাজলামি করতে। আমরা মজা করি তাই বলে এমন মজা কখনও করেছি।
আমার কথায় খালা থতবত খেয়ে বললেন
___ তো করেছেটা কে?
___ ভাইয়ার বিয়ে ভাইয়াকেই আমরা জামালগোটা খাওয়াবো? আপনি এক কাজ করেন ভাইয়াকেই জিজ্ঞেস করে দেখেন কি খাইছিল ও।
আমার সাথে সাথে জিমি মিলি মানহা আর বড় আপুও সায় দিল। খালা যখন সোজা রুম থেকে চলে গেলবড় আপু রাগে গজরাতে গজরাতে বলল ” উনার কথা হল আগে মাইর পরে বিচার। কিছু না করেও শাস্তি পেতে হয়”। সব কিছু ম্যানেজ করে যখন আবার ছাদে গেলাম হলুদের আসরে তখন মোটামুটি হলুদ দেওয়ার পর্ব শেষ। স্টেজের সেট আপ চলছে গানের জন্য। তাড়াতাড়ি করে দ্বিতীয় সারির চেয়ারে যেয়ে বসলাম পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলাম বাকিরা কই। একসাথে বসে গান দেখবে। ভাইয়াকে হুড়োহুড়ি করে নিচে নামছে মানে নেচার ইজ কলিং। খুব আফসোস হচ্ছিল ভাইয়ার জন্য। ইসস জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানেই বদনা হাতে ওয়াশরুমে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে।ভাইয়ার জন্য এক বালতি সমবেদনা জানাতে জানাতে যখন সামনে ফিরলাম দেখি জিমি মিলি সামনে। বড় আপু আর মানহা আপু একদম পিছনে আর আমার একপাশে বড় মামি বসে পড়েছে৷ খুব মন খারাপ হল যে এরা আমাকে দিল একা করে। গান শুরু হওয়ার আগ মূহুর্তে রাসেল ভাই এসে ধপ করে আমার পাশে বসে পড়ল। বসেই বলল ” নিপা একটু পানি খাওয়া তো গলা শুকিয়ে গেছে “। ” একটু পরে খেলে হয় না ” আস্তে করে বললাম আমি। গানের এত শব্দ ছিল যে কোন কথাই ভাল করে শোনা যাচ্ছিল না। না পারতে উনার কাছের কাছে মুখ নিয়ে বললাম ” একটু পরে পানি আনলে চলবে না?”। ” না এখনই আনবি” এই কথাটা ঠিক আমার কানের কাছে এসে বললেন উনি। যখন কথা বলছিল তার ঠোঁট আমার কানে এসে ছুঁয়ে গেল। মনে হল যেন ভেতর থেকে কেউ খুব জোরে একটা নাড়া দিয়ে গেল আমাকে৷ তাড়াক করে উঠেই পানি নিয়ে এসে উনাকে দিলাম। বোতলে ঠোঁট ছুঁইয়ে ঢকঢক করে পানি অর্ধেকটা খেয়ে আমার হাতে বোতল ধরিয়ে দিয়ে বলল ” রেখে দে পানি নষ্ট করতে হয় না “। আস্তে করে উঠে যেয়ে বড় আপু আর মানহা আপুর সাথে বসলাম। উনিও দিব্বি শিহাব ভাইকে ডেকে নিয়ে দেদারসে গল্প চালিয়ে দিলেন।
রাতে যখন শুতে এলাম প্রায় রাত তিনটার কাছাকাছি। পরের দিন হবু ভাবিদের বাসায় গায়ে হলুদ। ওখানে যেতে হবে সন্ধ্যায়। শাড়ি খুলে যখন আয়নার সামনে দাঁড়ালাম নিজের দেখে নিজেই লজ্জা পেলাম। ইসস নাভির উপরে তিলটা কেউ দেখে ফেলেছে। হঠাৎই মনে পড়লে তার ছোঁয়া যেন সারা শরীরে পশম দাঁড়িয়ে গেল এক নিমেষে। নিশ্বাস যেন খুব ঘন হয়ে পড়তে লাগল আমার। এমন তো আগে কখনোই হয় নি। ” কিরে অর্ধউলঙ্গ হয়ে কি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি শুইতে আসবি” মানহা আপুর ডাকে তাড়াতাড়ি টিশার্ট আর প্লাজু পরে ঘুমাতে গেলাম। আইক্যাপ পরে ঘুমানোর খুব বাজে একটা অভ্যাস আছে আমার। আইক্যাপ ছাড়া ঘুমই আসে না আমার। সকালে টের পেলাম হঠাৎ করেই দুনিয়া আলোকিত হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি চোখ খুলে দেখি আমার সামনে বড় ভাইয়ের পিচ্চি ছেলেটা দাঁড়ানো ওর হাতে আইক্যাপ। যা বোঝার বুঝ হয়ে গেল যে আইক্যাপ খোলা ময়দানে ডাকাতি হয়ে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি মাত্র ছয়টা বাজে। মনটা এতটা খিঁচে গেল যে বলার মত না। সবাই ঘুমাচ্ছে আর আমি হাঁ করে উঠে বসে আছি। জোর করে দাঁত বের করে পিচ্চিটার দিকে তাকিয়ে বললাম ” বাপ খুশি হইছিস মুক্তা মানিক পাইয়া”। পিচ্চিটা কি বুঝল কে জানে যে দুই চাইরটা দাঁত উঠছে তাই বের করে বিমল আনন্দে এক হাসি দিয়েই পগার পার। আর ঘুম আসবে না। তাই উঠে ফ্রেশ হয়ে সোজা যখন ড্রইংরুমে গেলাম যেয়ে দেখি খালা আমাকে দেখেই উঠে এসে বলল ” নিপা একটু রাসেল এর সাথে যা তো৷ ছেলেটা একা একা ফুল আনতে পারবে না”। এটুকু শুনেই আমি বিস্ফোরিত নয়নে খালার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি রাসেল ভাইয়ের সাথে ফুল আনতে যাব? এটাও সম্ভব। খালা তাড়া দিলেন ” কি হল কই চলে গেলি। টিশার্ট এর নিচের প্লাজু খুলে স্কার্টটা পরে চলে যা। এত সকালে কাক ও ওঠে নাই। তাই কি পরলি না পরলি তাও দেখার কেউ নাই।”
আস্তে আস্তে রুমের দিকে যাচ্ছি আর ভাবছি সকালটার শুরু হল কি ভাবে ভাল না খারাপ……..
চলবে