তবুও_তুমি ২য় পর্ব

0
2488

তবুও_তুমি
২য় পর্ব

” শক্ত করে ধরে বসবি নাকি হার্ড ব্রেক করে উড়িয়ে সামনে ফেলবো ” রাসেল ভাইয়ের হুমকি শুনে যেন আমার অন্তর আত্মা খাঁচা ছেড়ে যাওয়ার উপক্রম হল। ধরবোটা কই আমার এই প্রশ্নে সে বাইক এক সাইডে দাঁড় করালেন। হেলমেট খুলে সোজা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন ” শোন তুই যেমনে খুশি তেমনে বস আমার সমস্যা নাই। খালি লিখিত দিয়ে যা যে তোর মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী না”। মানে টা কি? আমার এই প্রশ্নে সে বলল ” কারন আমি বাইক চালাই সাইকেল না। আর তুই ভাবে বসেছিস আলগার উপরে টুপ করে কখন পড়ে যাবি সেটা আমিও জানি না”। মাথা নিচু করে তার ঘাড়ে হাত দিয়ে বসলাম আমি। ” নিপা এক হাত আমার কাধে দে অন্য হাত বুকের ওপর দে ” এই বলেই রাসেল ভাই হেলমেট মাথায় দিল। কিভাবে যে তার হাতের নিচ থেকে বুকে হাত দিয়েছিলাম আমি নিজেও জানি না। সারা শরীরে থরথর করে কাঁপছিল। তার বডি স্প্রের ঘ্রান যেন মাতাল করে দিচ্ছিল আমাকে। শাহাবাগ পৌঁছিয়ে দেখি এত সকালেও মানুষের ভিড়। ” একা একা হাঁটতে পারিস? ” রাসেল ভাইয়ের এই কথায় ভিষণ খারাপ লাগছিল। ভার্সিটি লেভেলে পড়া একটা মেয়েকে কেউ প্রশ্ন করে যে সে একা একা হাঁটতে পারে কি না। জিদ করেই বললাম না পারি না। বাইক এক সাইডে পার্ক করে খপ করে সে আমার হাত ধরে ফেলল। হাত মুচড়িয়ে ছাড়াতে চেষ্টা করতেই বলল ” একা একা তো হাঁটতে পারিস না তাহলে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছিস কেন”? এরপর সারা ফুলের মার্কেট ঘুরে ফুল কিনলাম দুই জনে। শুধু টাকা দেওয়া ছাড়া আল্লাহর বান্দা আমার হাত ছাড়েনি কখনও। আর কাজের মধ্যে কাজ হল এটুকুই সব ফুল আমার বয়ে বেড়াতে হল। মনে মনে মুন্ডু পাত করতেছিলাম তার।

বাইকের পিছনে ফুলের ব্যাগ রাখা হল অগ্যত আমাকে একদম রাসেল ভাইয়ের গা ঘেসে বসা লাগল। আমার নিশ্বাস যেন উনার পিঠের উপরে পড়ছিল। কিভাবে কিভাবে জানি উনার পেটের উপরে হাত পড়েছিল। ” কি রে আমার পেট মাপছিস নাকি?” রাসেল ভাইয়ের প্রশ্ন শুনেই তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নেই। মনে মনে চাচ্ছিলাম এই পথ যেন শেষ না হয়। বাসার সামনে নামতেই আমার হাতে ফুলের ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলল
___ নিপা সোজা বাসায় যা এগুলো নিয়ে।
___ এত গুলো ব্যাগ নিয়ে কি করে যাব।
___ তোর দুইটা পা আছে না ওগুলো দিয়ে যাবি।
এই বলেই বাইক ঘুরিয়ে সোজা চলে গেল। এত জিদ হচ্ছিল যে বলার মত না। পরে সব ফুল হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে উপরে উঠালাম। বাসায় এসে দেখি মোটামুটি সবাই ঘুম থেকে উঠে গেছে। মিলি জিমি আমাকে দেখে এগিয়ে আসলো। ” নিপাপু তুমি গেছিলে কোথায়” মিলির এই প্রশ্নের উওর দেওয়ার আগেই জিমি বলল ” আপু হাডুডু খেলতে গেছিল “। আমি আর মিলি দুই জনে অবাক চোখে জিমির দিকে তাকালাম। ” আচ্ছা মিলি তুই কি আক্কলের পদার্থ ছাড়া নাকি? আপুর হাতের এত ফুল দেখে বুঝতেছিস না যে আপু ফুল আনতে গেছিল। আহাম্মক একটা ” এই বলে জিমি সারতে পারল না মিলি জিমির চুলে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলল ” আমি আহাম্মক হলে তুই কি “? কোন রকমে দুইটারে আলাদা করে বললাম তোরা দুইটাই ভাল আমি হল বড় আহাম্মক বলতে পারিস জন্মের পর থেকেই আহাম্মক। কারন কি জানিস আল্লাহ তোদের মত দুই জাহেলের বড় বোন করে আমারে পাঠাইছে তাই।এই বলেই ফুল ভাইয়ার রুমে নিয়ে গেলাম। ফুল রেখে রুমে আসতেই দেখি মানহা আপু আর বড় আপু চুলে মেহেদি আর মুখে চন্দন দিয়ে ঘুরছে। মনে মনে বললাম সবাই শান্তিতে আছে আর আমি সকাল থেকে গাঁতানির উপরে আছি। দুপুরে খাওয়ার সময় বুঝতে পারলাম বিয়ে বাড়ি কাকে বলে। প্লেটে একগাঁদা তরকারি নিয়ে ঘুরছি কিন্তু ভাত নেই। বড় আপুকে দেখলাম এক কোনায় বসে শুধু মাংস খাচ্ছে। আসলে ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্য ময় চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি এই কথাটা আসলেই সত্যি। খাওয়া শেষে বুঝলাম মাথা যেন টন টন করছে। বড় আপুকে কিছু বলার আগেই উনি শুরু করল উনার গান ” নিপা আমার এখানের কমপ্যাক্টটা কে নিয়েছে দেখেছি? এই বাসায় কিছুই ঠিক থাকে না। আমার কমপ্যাক্ট খুঁজে দে আমি রেডি হব”। আপু পার্লারে চলে যাও না তাইলে তো আর ঝামেলা হয় না।
” পার্লার খরচটা কি তুই দিবি?” বড় আপু ঝাড়ি দিয়ে ওয়্যারড্রায়ার খুঁজতে লাগল। তখন দেখি ভাইয়া কোন রকমে কাঁকাতে কাঁকাতে আমাদের রুমের দরজায় এসে হাজির ” রাসেল এর খোঁজ জানিস নিপা। আম্মা বলল যে সকালে তোর সাথে নাকি গেছিল ফুল আনতে “। ভাইয়াকে দেখে আসলেই খুব খারাপ লাগছিল। যে নিজের বিয়েতে নিজেই বাথরুমবাসী হয়ে গেছে৷ আমাকে নামিয়ে দিয়েই চলে গেছে ভাইয়া এই বলে ভাইয়ার দিকে তাকাতেই দেখলাম তার মুখের ভঙ্গি চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে। আমার উল্টো পায়ে যেতে দেখেই বুঝলাম যে কি হয়েছে।

সন্ধ্যায় পরে যখন সবাই বের হলাম মেয়েদের বাড়ির জন্য হাতে চুড়ি পরতে যেয়ে আমার একটু দেরি হয়ে গেল। সবাই মোটামুটি নিচে নেমে গাড়িতে বসে পড়েছিল। আমি নাকের নথ পরতে যেয়ে আয়নায় দেখি রাসেল ভাই ঠিক আমার পিছনে যেন অপলক ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘুরে তাকাতেই দেখি ডীপ ব্লু পাঞ্জাবি সাদা পাজামা পাঞ্জাবীর হাতা গুলো ভাঁজ করে কনুই পর্যন্ত উঠানো। মানুষটা লম্বায় প্রায় পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি হবে। ঠিক যেন পিটানো ফিগার মাথা ভর্তি এক রাশ চুল মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
চোখ যেন ফেরানো দায়। মনে মনে ভাবছিলাম এত সুন্দর হওয়ার কি দরকার ছিল। পাঞ্জাবির বুকের উপরের দুই বোতাম খোলা এতে বুকের অনেক খানিই দেখা যাচ্ছে। ” কি রে তুই বসে বসে আটা ময়দাই মাখবি? যাওয়া আর লাগবে না? ” রাসেল ভাই হাঁক দিয়ে বলল। তাড়াতাড়ি আয়নার দিকে ঘুরে নথ লাগিয়েই রওনা দিলাম তার সাথে। ড্রয়িংরুমের কাছে আসতেই থামিয়ে দিল আমাকে ” এই দাঁড়া ঘোর তো পিছনে ” রাসেল ভাই বলল। নাক মুখ কুঁচকে বললাম ___ কেন ঘুরব?
___ ঘুরতে বলছি ঘুরবি। কালকে তো নাভির তিল দেখিয়েছিলি। আজকে যাতে কিছু দেখাতে না পারিস তাই চেক করছি।
রাসেল ভাইয়ের কথা শুনে কেন জানি না মাথায় আগুন ধরে গেল। আমার তিল আমি দেখাবো তাতে উনার কি। আমি আর কথা না বাড়িয়ে সোজা বাসা থেকে বের হয়ে গাড়িতে বসলাম। একটা মিনিবাসা ঠিক করা হয়েছে ভাবিদের বাড়ি যাওয়ার জন্য। সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ২০ জন যাবে কিন্তু বের হবার পরে দেখা গেল পাক্কা ৩৫ জন। খালা কিড়মিড়িয়ে বলল ” নির্ঘাত মেয়ে পক্ষরা ভাববে আমরা হাভাতের দল”। খালু খালাকে স্বান্তনা দিয়ে বলল ” হাওয়া মন খারাপ করো না বিয়েতে এমনই হয়৷ আমি তো বিয়ের বরযাত্রীর কথা ভাবছি”। খালাও মাথা নামিয়ে ভাবতে লাগলেন কালকে কি হবে। আজে গায়ে হলুদ তাই এই পালা আর কাল না জানি কি হয়।

গাড়ি যখন কনেদের বাড়ির সামনে পৌঁছালো তখন বাজে সাড়ে আটটা। নামার সাথে সাথেই দেখলাম এক গাদা লোক আমাদের স্বাগতম জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে।মেয়েদের হলুদের অনুষ্ঠান ও আমাদের মত ছাদে এরেঞ্জ করা হয়েছে। অনেকগুলো ছেলেও ছিল।স্বভাবতই বিয়ে বাড়ি ছেলেরা মেয়েরা মজা করেই এটাই স্বাভাবিক। শুরুটা হল তাদের পক্ষ থেকে মিলিরে গোলাপ জল চোখে মেরে একজন বলল ” বেয়াইন গোলাপ জলে চোখে ময়লা কাটে”। সমস্যা হল ছেলেটার কপাল খুব খারাপ কারণ মিলি হল এমন মানুষ যে ইট খেলে পাটকেল ছুঁড়বেই। সেও কোথা থেকে এক মিষ্টি এনে দিল ছেলের মুখে লেপ্টে এক কথায় এলাহী কারবার। নতুন ভাবির বাবা যখন আমাদের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন তখন খেয়াল করলাম একটা ছেলে যেন সব কিছু বাদ দিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে৷ প্রথমে ভেবেছিলাম মনের ভুল পরে দেখি অন্য কেস। আমি যেখানেই যাচ্ছি না কেন আমার পিছে পিছে সেও হাজির হচ্ছে। ভাবির ছোট বোনের সাথে আগেই পরিচয় ছিল।সবার আগে আমার গল্প পড়তে চাইলে “নীল ক্যাফের ভালোবাসা” পেজে পাবেন।
বিয়ে ঠিক হবার পর থেকে ফেসবুকে পরিচয় আরো গভীর হয়। ” ঝুমু ওই ছেলেটা কে রে ভাই ” আমি প্রশ্ন করলাম ভাবির ছোট বোনকে।” কোনটা” ঝুমু চোখ কুঁচকে প্রশ্ন করল আমাকে। আরে ওই যে ক্রীম কালারে পাঞ্জাবি সাদা পাজামা। ” নিপা বোকার মত কথা বলো না তো। সবাই ক্রীম কালারের পাঞ্জাবি পরে আছে ” ঝুমু ঘুরেই বলে উঠল। আঙ্গুল তুলে দেখাতে যাব ঠিক এমন সময় ছেলেটা আমাদের সামনে থেকে ক্রস করল। চোখ দিয়ে ইশারা দিয়ে দেখালাম এই ছেলেটা। ” আরে উনি তো সাদ ভাইয়া। আমার চাচাতো ভাই। ইতালি থাকে আপুর বিয়েতে বেড়াতে এসেছে। কেন বিয়াইন মনে ধরেছে নাকি?” এই বলেই ঝুমু আমাকে একটা ধাক্কা দিল। আমিও মজা করে বললাম৷ ” ছেলে কিন্তু খারাপ না “। দুজনেই খিলখিল করে হেসে উঠলাম এমন সময় পেছনের কোন এক শব্দে ঘুরে তাকিয়ে দেখি রাসেল ভাই সামনে। চোখ মটকে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। খুব আজব লাগল আমার প্রথমে ভেবেছিলাম হয়ত অন্য কারো দিকে তাকিয়ে আছে এ ভাবে৷ পরে ভাল করে দেখে বুঝলাম যে সে আমাকেই দেখছে। মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়া শুরু করলাম আর ভাবতেছিলাম আল্লাহ আবার জানি কি করছি আমি……….

চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here