তবু মনে রেখো ০৭,০৮

0
330

তবু মনে রেখো ০৭,০৮
লেখা: জবরুল ইসলাম
(৭ম পর্ব)
.
মহসিন সাহেব আর কথা না বাড়িয়ে কেবল হাসলেন। সাবিনা অল্পতে বড়ো বেশি দুশ্চিন্তা করে। অবশ্য দীর্ঘ সংসার জীবনে মহসিন সাহেব এটাও বুঝতে পেরেছেন স্ত্রীর সকল দুশ্চিন্তা অমূলক হয় না। নারী জাতির সাংসারিক জ্ঞানের কাছে পুরুষ মানুষ বড়োই তুচ্ছ। তারা বিপদ-আপদও অগ্রিম আঁচ করতে পারে। নেতিবাচক ঘ্রাণ শক্তি হয় প্রবল। মহসিন সাহেব সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে, বাতি বন্ধ করে, দুই হাত মাথার নিচে দিয়ে, চিত হয়ে শুয়ে রইলেন।
হঠাৎ ঘরের বাতি জ্বলে উঠলো। পুষ্পিতা এসেছে৷ কোনো কথা না বলে ওয়্যারড্রোব থেকে বিছানা চাদর বের করে বাতি বন্ধ করে চলে গেল।
সাবিনা বেগম স্বামীকে বললেন,

– ‘আলাদা বিছানা চাদর নিল কেন? বুঝতে পারছো কেন আমি দুশ্চিন্তা করি?’

মহসিন সাহেব কোনো জবাব দিলেন না। তিনি সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছেন। দরজার ফাঁক গলে করিডরের খানিক আলো রুমে এসে পড়েছে। অন্ধকারে চোখ সয়ে আসায় দেখা যাচ্ছে সবকিছু৷ সাবিনা বেগম স্বামীকে বললেন,

– ‘কি এতো ভাবছো?’

– ‘ভাবছি আমরা কি বুড়া-বুড়ি হয়ে গেলাম? পুষ্পিতা হঠাৎ আইসাই বাতি জ্বালিয়ে ফেললো। আমাদের কি বিশেষ মুহূর্ত থাকতে পারে না। একটুও সিকিউরিটি নাই।’

সাবিনা বেগম রসিকতাটা ধরতে পারলেন। বিয়ের প্রথম প্রথম পারতেন না৷ লোকটা ঠোঁট-মুখ শুকিয়ে এমনভাবে রসিকতা করবে বুঝা মুশকিল। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন,

– ‘আমি দুশ্চিন্তায় মরে যাচ্ছি, তুমি ঢং করছো তাই না? মনে রঙ লাগছে।’

মহসিন সাহেব হাসছেন। দুশ্চিন্তা যে তিনি করেন না তা নয়। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

– ‘আচ্ছা আমরা তো মেয়েটাকে কিছুই জিজ্ঞেস করিনি। ওইদিন পরিস্থিতি সামলাতে ব্যস্ত ছিলাম।’

– ‘জিজ্ঞেস করার কি আছে। যতটুকু জানি সেগুলোই তো একটা মেয়ের চরিত্রে কালি লাগার জন্য কম নয়।’

– ‘তবুও শহরে নিয়ে গেলেই হতো। সেখানে তো লোকে জানতো না।’

– ‘তো এখানে জানলেও বিয়ে তো হয়েছে৷ আঁটকেছে কিছু?’

– ‘এইযে দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছে তখন এগুলো বর জানতোই না। আমাদেরও দুশ্চিন্তা করতে হতো না।’

– ‘এত বড়ো বিষয় গোপন থাকতো ভাবছো?’

– ‘তুমি আজাইরা এত বড়ো এত বড়ো করবে না তো। এগুলো স্বাভাবিক ঘটনা। আহামরি কিছু না।’

– ‘হ্যাঁ তোমার কাছে সব স্বাভাবিক। তো করো স্বাভাবিক। মেয়ের সংসারে ঝামেলা হচ্ছে কেন স্বাভাবিক যখন?’

– ‘ঝামেলা হইছে সমাধান হবে।’

– ‘হ্যাঁ গায়েবি সমাধান হয়ে যাবে চেষ্টা ছাড়া।’

– ‘তুমি করো গিয়ে চেষ্টা। চেষ্টার ঘরের চেষ্টা কি করিনি? বিয়ে কিভাবে হলো তাহলে? আমার কানের কাছেই শুধু প্যানপ্যান।’

– ‘হ্যাঁ বিয়ে দিয়ে দিছো সবকিছু শেষ। এখন নতুন কনের মতো হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকো।’

– ‘এখন কি বাড়িঘর সুদ্ধা সব লিখে দিতে হবে৷ তাহলেই খুশি তুমি?’

সাবিনা বেগম কেঁদে ফেললেন, চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন,

– ‘হ্যাঁ পারলে দিয়ে দাও, আমার মেয়ে সুখী না হলে এগুলো দিয়ে কি করবো?’

মহসিন সাহেব আর মেজাজ ধরে রাখতে পারলেন না৷ অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করতে করতে বালিশ নিয়ে উঠে পাশের রুমে চলে গেলেন। স্বামীর গালাগাল আর মেয়ের দুশ্চিন্তায় পরের পুরোটা দিন দেখা গেল সাবিনা বেগম কিছুই মুখে দিচ্ছেন না। পুষ্পিতা বারবার বাবাকে এসে জিজ্ঞেস করে মায়ের কি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি কিছু জানি না। আমি ডাক্তার না-কি যে, কার কখন কি হয় বলতে পারবো।’
পুষ্পিতা বুঝতে পারে বাবা-মায়ের কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া হয়েছে৷ সে অনেক চেষ্টা তদবির করেও কিচ্ছু খাওয়াতে পারলো না। মহসিন সাহেব খুবই বিরক্ত এবং ক্ষুব্ধ হলেন। পরেরদিন ভোরেই হায়দার সাহেবকে কল দিয়ে আনলেন। পুষ্পিতা তখনও ঘুমোচ্ছে। ইমাদ বাজারে। দুইজন দুই সোফায় বসা। মাঝখানে টি-টেবিলে। কাজের মেয়ে এসে নাশতা দিয়ে গেল। মহসিন সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,

– ‘হায়দার, আজ চলো শহরে যাই। আসবাবপত্র কিছু তো দেইনি৷’

হায়দার সাহেব হেঁসে বললেন,

– ‘এগুলো দিতে হয় জানি, কিন্তু আমাদের কি নিয়মের সম্পর্ক। এগুলো লাগবে না।’

– ‘না না, এগুলো মেয়ের প্রাপ্য আমি দিতে চাই। তোমার সমস্যা না থাকলে আজই যাব।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আজই যাই তাহলে।’

– ‘আরও কিছু কথা। আমার একটা মাত্র মেয়ে। ওর সুখই আমাদের সুখ। মেয়ে যখন বিয়ে দিয়েছি, ইমাদ এখন আমাদেরই আরেক সন্তান। তুমি তো জানো শহরের বাসাটা বিক্রি করে দিতে চাইছিলাম। এই সিদ্ধন্তটা বাদ দিয়েছি। এটা আমি ইমাদ বাবাজীর নামে দিয়ে দিতে চাই৷ পুষ্পিতার মায়েরও এই ইচ্ছা। তুমি ছেলেটাকে বলো তার যা ইচ্ছা আমরা দেবো। দরকার হয় চাইলে ইতালিও পাঠাবো। তুমি তো চাইছিলে একবার। তবুও যেন আমার মেয়েটা ভালো থাকে।’

হায়দার সাহেব হেঁসে উঠলেন। তারপর চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,

– ‘তোমার মেয়ে আর আমার মেয়ে কি আলাদা ভাই৷ তোমাদের ছেলেকে তোমরা কি দেবে সেটা তোমাদের মর্জি। কিন্তু আমি থাকতে পুষ্পিতা মায়ের কোনো অযত্ন হতে দেবো না। ছেলেকে এতদিন বুঝাইছি৷ এখন তুমিও যা বললে। এগুলোও তাকে বলবো। আশাকরি ছেলেটা বুঝবে।’

– ‘আচ্ছা তাহলে কাগজপত্র রেডি করবো। আর আজ কখন বের হবে?’

– ‘ওই বাজারে একবার যাব এখন। জোহরের বাদে বের হই তাহলে।’

– ‘বেশি দেরি হয়ে যায়।’

– ‘দোকানের কর্মচারি ছুটিতে গেছে। তাই আমি গেলে ইমাদ খেয়ে গোসল করে যাবে।’

– ‘তাহলে এখনই চলে যাও। আজ আগে পাঠিয়ে দাও গিয়ে।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে উঠলাম তাহলে।’

হায়দার সাহেব খান বাড়ি থেকে মনে বিজয়ীর আমোদ নিয়ে বের হলেন। সবাই তাকে এক সময় ব’লদ শ্রেণির লোক বলেই ধরতো। বয়স হয়েছে, জীবনে অনেক ঝড়-উতরাই পেরিয়ে এতদূর এসেছেন। তাই আজ খানের মতো চতুর লোকের সঙ্গে বুদ্ধির খেলায় জিতে গেলেন। এক অন্যরকম তৃপ্তি আর আনন্দে ভরে গেল হায়দার সাহেবের মন। শরীরে এক বেসামাল হর্ষে যেন কাঁপছে। রাস্তায় বেরিয়ে একটা সিএনজিকে হাত তুলে দাঁড় করিয়ে বাজারে চলে গেলেন।
ইমাদ তখন দোকানে একা খুবই ব্যস্ত। হায়দার সাহেব ক্যাশে গিয়ে বসলেন। তিনি ঠিক করলেন ইমাদকে এখনই বাসার কথা বলবেন না। মিনিট কয়েক পর সে অবসর হয়েছে দেখে বললেন,

– ‘আজ খান ভাইয়ের লগে শহরে যেতে হবে। তাই তুমি আগে গিয়ে খেয়ে চলে আসো বাবা।’

– ‘শহরে কেন?’

– ‘ওই আসবাবপত্র দেবেন তাই আরকি। কত করে না করলাম এসব লাগবে না। ওরা দিতে চায়। এটা না-কি তোমাদের হক।’

ইমাদ আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘বাবা এগুলো নেয়া কি ঠিক হচ্ছে? যেখানে পুষ্পিতার সঙ্গে এখনও ভালোভাবে কথাই বলি না।’

হায়দার সাহেব হা-হা করে হাসলেন। তারপর পুরো বিষয়টাই ইমাদের কাছে হালকা করার জন্য বললেন,

– ‘আরে বোকা ছেলে, এগুলো আরও বয়স হলে বুঝবে। বড়ো লোকের জামাই হয়েছো। যত নরম থাকবে ততই তোমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে ওরা। তাই গরম থাকতে বলেছি। তবে এখন ধীরে ধীরে মেয়েটাকে মেনে নেয়াটাই ভালো৷ ওরাও বুঝেছে আমাদের জামাই গরিব হলেও যেরকম ইচ্ছা ব্যবহার করা চলবে না।’

ইমাদ বাবার কথার মানে খুব একটা যে বুঝেছে তা নয়। তবে এটা বুঝতে পেরেছে এখন পুষ্পিতার সঙ্গে মিশতে উনার কোনো আপত্তি নেই।

‘আচ্ছা বাবা এখন যাই তাহলে’ কথাটি বলে সে দোকান থেকে বের হয়ে যায়৷ গলি পরিয়ে সিএনজিতে উঠেছে। মনের কোণায় কিঞ্চিৎ আলো ঝলমল করছে। বাবার দিক থেকে এখন কোনো বাঁধা নেই। কিন্তু পুষ্পিতা কি তাকে মন থেকে পুরোপুরি গ্রহণ করবে? সে তো পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছে৷ এই চিন্তাও তার আনন্দ দমিয়ে রাখতে পারলো না। পুষ্পিতা ঠিকই একদিন তাকে ভালোবাসবে৷ বিয়েতে এই অন্যরকম এক রহমত। দু’জন অচেনা মানুষের কোনো এক অলিক ইশারায় মায়া-মমতা তৈরি হয়ে যায়। তাদেরও হবে৷ ইনশাআল্লাহ হবে। ইমাদ রোজ এই প্রার্থনাই করে। বাড়িতে ফিরে এসে মেইন গেইট খুলে ভেতরে যায় সে। পুষ্পিতা আর সাবিনা বেগমকে জরুরি কিছু বলতে দেখা গেল মহসিন সাহেবকে। ইমাদ সোজা নিজের রুমে চলে যায়। গেঞ্জি খুলতেই পুষ্পিতা এসে হাজির হলো। তাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। ইমাদ অন্য দিনের তুলনায় খানিক কোমল গলায় বললো,

– ‘মন খারাপ না-কি?’

পুষ্পিতা বিছানায় বসতে বসতে বললো,

– ‘না, কেন?’

– ‘এমনিই।’

– ‘কিন্তু তোমাকে খুব খুশি মনে হচ্ছে।’

নিজের খুশি প্রকাশ পেয়ে গেছে দেখে সে খানিক লজ্জা পেল। টাওয়েল নিয়ে ঢুকে গেল বাথরুমে।

পুষ্পিতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তার মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠেছে। একটু আগে তার বাবা সবকিছু বলেছেন৷ শহরের বাসা ইমাদের নামে দেবেন। তার বাবাকে বলেছেন। ইমাদকে হয়তো দেখা হওয়ার পর সেটা বলেছেন। তাই কি ইমাদকে এতো আনন্দিত দেখালো? তার মন খারাপ কি-না জিজ্ঞেস করলো। তার মনের খবর তো এই কয়দিন নেয়নি কখনও। কিন্তু পুষ্পিতা এগুলোর জন্য ইমাদকে দূরে ঠেলে দেবে না৷ মানিয়ে নেবে সে। তার মা-বাবা তো এটাই চান। রান্নাঘরে গিয়ে বললো,

– ‘মজিদা ভাত দাও টেবিলে। ইমাদ গোসল করে খাবে।’
কথাটি বলে সে চলে যাচ্ছিল। মজিদা বললো,

– ‘আপা খালি দুলাভাইকে দিব না-কি তোমারেও।’

মজিদা ইতোমধ্যে দুলাভাই ডাকটা রপ্ত করে নিয়েছে দেখে হাসি পেল পুষ্পিতার।

– ‘না শুধু তোর দুলাভাইয়ের জন্য।’

পুষ্পিতা মায়ের রুমে গেল। বাবা গোসলে চলে গেছেন।

– ‘বস এখানে।’

পুষ্পিতা না বসে মায়ের কোলে মাথা রাখলো। সাবিনা বেগম মেয়ের চুলে আঙুল চালিয়ে বললেন,

– ‘শোন মা, সংসারে স্বামীই সব। এই দেখ তোর বাবার লগে কত রাগারাগি হয়। এগুলো আবার শেষ হয়ে যায়। এভাবেই মানিয়ে চলবি।’

– ‘হ্যাঁ মা, তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো। ইমাদ একটু স্বাভাবিক হলে আমি সব ঠিক করে নিব।’

– ‘হ্যাঁ রে মা, তাই করবি। ছেলেটা মাশাল্লাহ ভালো। দেখবি তোকে ভালোই রাখবে।’

– ‘কিন্তু এগুলো দেয়া কি ঠিক হচ্ছে।’

– ‘আরে বোকা মাইয়া। এসব দিলাম তোর মুখ এখন বড়ো হলো ওদের কাছে। তাছাড়া আমাদের সবকিছু তো তোদেরই।’

– ‘হুম বুঝেছি মা।’

– ‘এই যাহ, আমি তো ভুলে গেছি। জামাই বাবাজী এসেছে দেখে তোকে পাঠাইলাম তুমি আবার চলে এলি যে।’

– ‘তোমার জামাই এখন বাথরুমে, আমিও কি ওর সঙ্গে বাথরুমে চলে যাব মা?’

সাবিনা বেগম ওর পিঠে চাপড় দিয়ে হা-হা করে হেঁসে উঠলেন। তারপর বললেন,

– ‘গোসল শেষ হলে ভাত দে গিয়ে।’

– ‘মজিদাকে বলেছি দিতে।’

– ‘স্বামী খেতে বসলে পাশে থাকতে হয় মা। এভাবেই তো মায়া-মহব্বত বাড়ে, যা।’

পুষ্পিতা উঠে চলে যায়। ইমাদ লুঙ্গি আর গায়ে টাওয়েল প্যাঁচিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়েছে৷ পুষ্পিতা হাত বাড়িয়ে বললো,

– ‘দাও আমি টাওয়েল মেলে দিচ্ছি।’

ইমাদ ওর দিকে মিষ্টি করে তাকিয়ে বললো,

– ‘আমিই মেলে দিচ্ছি ম্যাডাম।’

পুষ্পিতা ওর দৃষ্টি এবং কথার ভঙ্গিতে খানিক বিভ্রান্ত হয়। এভাবে তো সে কথা বলে না৷ তাকায়ও না। ইমাদ এসে গেঞ্জি পরেছে। পুষ্পিতা বললো,

– ‘খাবে আসো।’

– ‘হুম চলো।’

পুষ্পিতা হাঁটছে৷ ইমাদ পিছু থেকে ওর দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে গেল। কালো সুতির একটা সেলোয়ার-কামিজ। চুলগুলো কোমরের ভাঁজে পরেছে৷ মসৃণ উজ্জ্বল দুটো হাত নগ্ন। এই রূপবতী মেয়েটা তার বৈধ স্ত্রী। আজ থেকে তার বাবার কোনো বাঁধা নেই। পুষ্পিতারও ব্যবহার থেকে মনে হয় তাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছে। কেউ যেন অনেকগুলো খাঁচা থেকে তার ভেতরকার অলি-গলিতে অসংখ্য অগণিত রঙিন প্রজাপতি ছেড়ে দিয়েছে৷ তারা মুক্ত হয়ে উড়ছে আর উড়ছে। পৃথিবী এতটাই সুন্দর। এতটাই মধুর প্রতিটি ক্ষণ। প্রজাপতির মতো সবাই মুক্ত, স্বাধীন। চারদিকে কেবলই ভালোবাসা, মানবিকতা৷ এই জগত অন্যরকম।
ফিক করে হেঁসে ফেলে পুষ্পিতা বললো,

– ‘কি হলো এভাবে দাঁড়িয়ে কি ভাবছো।’

কেউ যেন তাকে ছুড়ে ফেললো নির্মম বাস্তবে। চেতনা ফিরে পেল সে। গিয়ে বসলো খাবার টেবিলে। পুষ্পিতা প্লেটে ভাত দিল তাকে।

– ‘একটা প্লেট কেন? তুমি খাবে না?’

পুষ্পিতা চোখে চোখ রেখে বললো,

– ‘কেন বি’ষের ভয়?’

_ চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম

তবু মনে রেখো (৮ম পর্ব)
.
পুষ্পিতার এমন বিদ্রুপাত্মক প্রশ্ন এবং চাহনিতে ইমাদ চোখ নামিয়ে নেয়। মনযোগ দেয় খাবারে। ডাইনিং রুম থেকে প্রস্থান করে পুষ্পিতা৷ ইমাদ খাবার শেষ করে তাড়াতাড়ি বাজারে গিয়ে হায়দার সাহেবকে বিদায় দেয়। তারপর পুরোটা দিন তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেও পুষ্পিতা মাথার ভেতর থেকে যায়। সন্ধ্যা হতেই বুকের ভেতর শুরু হয় ঘরে ফেরানোর আন্দোলন। ক্ষুদ্র এই জীবনে কখনও এমন ঘরে ফেরার তাড়া তার ছিল না। এশার আজান শুনতেই দোকান বন্ধ করে দিল। নামাজ শেষে আজ আর ক্যারাম খেলতে গেল না। পুষ্পিতার সঙ্গে ধীরে ধীরে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে নিতে হবে। সিএনজিতে উঠে নয়টার আগেই চলে আসে বাড়িতে। রুমে গিয়ে দেখে পুষ্পিতা শুয়ে-শুয়ে বই পড়ছে। তার আগমনে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই ওর। কি সুন্দর দুই হাতে বই ধরে, পা লম্বা করে বিছানায় শুয়ে আছে। বাঁ পা ডান পায়ের ওপরে৷ ফলে দেখে মনে হচ্ছে নগ্ন দু’টো পায়ের পাতা যেন একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে আছে। তার বুকে ভীষণ শিরশিরে অনুভূতি হয়। কোনো কথা না বলে বাথরুমে চলে যায়। হাত-মুখ ধুতে ধুতে মনে হয় এভাবে চুপচাপ থাকলে হবে না। দু’জনের মধ্যে কাজে-অকাজে কথাবার্তা হওয়া দরকার। কারও সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য কথা বলার বিকল্প নেই। এটা-ওটা জিজ্ঞেস করে কথা বাড়াতে হবে। তাতে দু’জনের মধ্যকার অস্বস্তির অদৃশ্য দেয়াল ক্রমশই মিলিয়ে যেতে শুরু করে। টাওয়েল দিয়ে হাত-মুখ মুছতে মুছতে চোরা চাহনিতে ইমাদ বইয়ের নামটা পড়ে নেয়। কবি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কর্মসূচিরই অংশ হিসাবে সে মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘এটা আবার কেমন বই। বইয়ের নাম নেই৷ ওপরে শুধু লেখকের নাম কবি তারাশঙ্কর বন্দোপধ্যায়।’

পুষ্পিতা বই দিয়ে মুখ ঢেকে হেঁসে ফেললো। ইমাদ টাওয়েল মেলে দিয়ে এসে বিছানায় বসে বললো,

– ‘কি? হাসা কি শেষ হয়েছে?’

পুষ্পিতা পুনরায় হেঁসে বললো,

– ‘বইয়ের নামই “কবি” আর লেখকের নাম তারাশঙ্কর।’
কথাটি বলে পুষ্পিতা আবার বইয়ের পাতায় মনযোগ দেয়। ইমাদ সতর্ক হয়ে যায়। কথা বাড়াতে গিয়ে আবার বালিকাকে বিরক্ত করতে যাবে না সে। কিন্তু পাশের বালিশে শুয়ে কি নিজের মতো মোবাইল টিপতে পারে না? যদিও এই ক’দিনের সম্পর্কের সঙ্গে এই দৃশ্যটা বড্ড বেমানান৷ ইমাদ তবুও অস্বস্তি নিয়ে ওর পাশের বালিশে শুয়ে যায়। অজান্তেই দু’টি দেহের স্পর্শ হয়। কেমন একটা শঙ্কা আর দ্বিধায় ইমাদের শরীর যেন কাঁপছে। ওর পাশে সে যেন বড়ো ভীষণ তুচ্ছ। পুষ্পিতা বই থেকে মুখ সরিয়ে তাকিয়ে আছে। তার যেন দমবন্ধ হবার জোগাড়। ওর অবাক দৃষ্টির কারণে হাত বিছানায় ফেলে রাখবে না-কি বুকে তুলে আনবে বুঝতে পারছে না।
ইমাদের বিকৃত অবস্থা দেখে পুষ্পিতাই বললো,

– ‘কোনো সমস্যা?’

ইমাদ অজুহাত খুঁজে না পেয়ে বললো,

– ‘না, একটু মাথা ব্যথা করছে।’

– ‘হ্যাঁ, তাইতো মনে হচ্ছে। তাহলে আমি সোফায় গিয়ে বসছি।’

– ‘না, তা কেন?’

– ‘অসুস্থতার কারণেই হয়তো শুয়েছো, না হলে তো আমার পাশে শুইতে না তুমি।’

সে আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘না সমস্যা নেই। বই পড়ছো, পড়ো।’

– ‘তুমি হয়তো ক্লান্ত, আমি গিয়ে খাবার দিতে বলি৷ খেয়ে ঘুমিয়ে যাও।’

ইমাদ মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। পুষ্পিতা গিয়ে টেবিলে খাবার দিয়ে এসে বললো,

– ‘আসো।’

ইমাদ টেবিলে যেতে যেতে ভাবে পুষ্পিতা এখনও তার সঙ্গে কোনো বিশেষণ ছাড়া কথা বলে। চেয়ার টেনে টেবিলে বসে বললো,

– ‘তুমি খাবে না পুষ্পিতা?’

নামটা ইচ্ছা করেই জুড়ে দিল সে। ইচ্ছা করছে বারবার এই নাম ধরে ডাকতে। পুষ্পিতা অসম্মতি জানিয়ে বললো,

– ‘আমি বই পড়া শেষে খাব। তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে যাও। দেখতে কেমন অসুস্থ লাগছে।’

ইমাদ কোনোভাবেই যেন পরিবেশটা নিজের অনুকূলে আনতে পারছে না। তার শরীরে কোনো অসুখ নেই, ক্লান্তি নেই, ঘুমানোর তাড়া নেই। আছে অনুরাগ, কামনা, ভালোবাসা৷ মুখ ফুটে তবুও বলতে পারছে না সে। চুপচাপ খেতে শুরু করে। খাওয়া শেষে রুমে চলে যায়৷ বিষণ্ণ মনে বালিশে মাথা রাখে।
পুষ্পিতা খানিক পর এসে বললো,

– ‘আজ তুমি বিছানাতেই ঘুমাও। আমি নিচে থাকবো।’

ইমাদ প্রতিবাদ করে বললো,

– ‘না, আমার কোনো সমস্যা নেই, তুমি পালঙ্কেই ঘুমাও।’

পুষ্পিতা তার মুখের ভাষা, মনের আকুতি কিছুই বুঝলো না৷ বাতি বন্ধ করে ড্রিম লাইটের সুইচ টিপে দিয়ে বললো,

– ‘অসুস্থ অবস্থায় তুমি ফ্লোরে থাকবে আর আমি পালঙ্কে তা তো হয় না। ড্রিম লাইট জ্বেলে দিয়েছি ঘুমাও, আমি মায়ের রুমে গিয়ে বই পড়বো।’

পুষ্পিতা চলে যায় রুম থেকে৷ নিজেকে আজ পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানব মনে হচ্ছে ইমাদের। একই রুমে একটা মানুষকে সে কথা বলে নিজের মনের ভাবটা বুঝাতে পারলো না। এরচেয়ে কি বোবারাই ভালো নয়? তারা তো ইশারা- ইঙ্গিতেও ভাব প্রকাশ করতে পারে। বিছানায় ছটফট করে তার নির্ঘুম সময় কাটছে। পুষ্পিতা বই শেষ করে বলেছে খেতে বসবে। ওর পড়া শেষ হবে কখন? কখন আসবে রুমে? ঘণ্টা দুয়েকের ভেতরে তার চোখ বুজে এলো নিদ্রায়। ঘুম ভেঙে গেল দূর থেকে ভেসে আসা মুয়াজ্জিনের আজানে। হাই তুলে উঠে বিছানায় বসে। রুমে ড্রিম লাইটের মৃদু আলো। ফ্লোরে তাকিয়ে দেখে পুষ্পিতা গুটি-শুটি হয়ে এদিকে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে আছে। হাত দু’টো বুকের কাছে ভাঁজ করে রাখা। দীর্ঘ সময় এভাবে তাকিয়ে রইল সে। তারপর যেন সম্মোহিত হয়ে ওর পাশে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। ইচ্ছে করছে ওর নরম, কোমল গালটায় একবার হাত রাখবে। কিন্তু ঘুমন্ত অবস্থায় হাত রাখা কি ঠিক হবে? একবার ভাবে তারই তো বৈধ স্ত্রী। পুনরায় ভেতর থেকে যেন কেউ বলে দেয়, তোমাদের দু’জনের সেই সম্পর্ক এখনও হয়ে উঠেনি৷ একবার হয়ে গেলে ঘুমন্ত অবস্থায় হাত দিলেও সমস্যা ছিল না। ইমাদ এবার ওর দিকে তাকিয়ে ফ্লোরেই শুয়ে রইল। একেবারে কাছাকাছি। পুষ্পিতার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে। এভাবে কখন যে ঘুমিয়ে গেল বুঝতেই পারেনি। ভোরে ঘুম ভাঙলো কারও সুরেলা হাসির শব্দে। চোখ মেলেই দেখে পুষ্পিতা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। হাসি নয় যেন সংগীত।

– ‘কি হলো, তুমি কি রাতে পালঙ্ক থেকে পড়ে গিয়েছিলে? বালিশ বিছানা ছাড়া ফ্লোরে ঘুমিয়ে আছো যে।’

ইমাদ চারদিকে তাকায়। বিভ্রান্তি কেটে গেল তার ক্ষীণ সময় পর। আজ তো বিছানায়ই ঘুমিয়ে ছিল। পুরো ঘটনা মনে পড়ে যায়। উঠে বসে আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘আসলে নিজেই বুঝতে পারছি না কিভাবে এলাম।’

– ‘অসুখ-টসুখ হলো না তো আবার। না-কি এভাবে বাচ্চাদের মতো প্রায়ই পড়ে যাও।’

– ‘না না এভাবে পড়ি না কখনও।’

– ‘ডাক্তার আনতে বলবো না-কি? চোখও কেমন লাল। রাতে বললে মাথা ব্যথাও ছিল। জ্বর এলো না-কি?’

ইমাদের ইচ্ছা হলো বলতে ‘দেখো তো আমার কপালে হাত রেখে জ্বর এলো কি-না’ কিন্তু বলতে পারলো না সে। ফ্লোর থেকে উঠে বললো,

– ‘না তেমন কিছু হয়নি।’

পুষ্পিতা আবার হেঁসে বললো,

– ‘যাক পড়ে তো ব্যথাও পাওনি দেখছি।’

ইমাদ এই বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে বাথরুমে চলে গেল। সে এখানে ঘুমিয়ে গেল কিভাবে? নিজের প্রতি তীব্র বিরক্ত হলো। দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে বের হয়ে দেখে পুষ্পিতা নেই। মুখ-হাত মুছে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে আটটা বেজে গেছে। আজ কর্মচারী এসে দোকান খোলার কথা। খুলেছে কি-না কে জানে। তাকে কল দিতে যাবে, তখনই আবার পুষ্পিতা এসে বললো,

– ‘আঙ্কেল এসেছেন। আমাদেরকে রেডি হতে বললেন।’

– ‘এখনই?

– ‘হ্যাঁ কাল যে আসবাবপত্র এনেছেন। তাই বাড়িতে তোমার কাজ আছে বললেন।’

– ‘ও আচ্ছা।’

– ‘কেন তুমি জানো না ওরা এগুলোর জন্য গতকাল শহরে গিয়েছিলেন?’

ইমাদ সরল মনেই জবাব দিল,

– ‘হ্যাঁ বাবা গতকাল দোকানে গিয়ে বলেছিলেন।’

পুষ্পিতা মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘আসো নাশতা করবে।’

ইমাদ ওর সঙ্গে নাশতার টেবিলে গেল। দু’জন সামনা-সামনি দুই চেয়ারে বসে গিয়ে। মজিদা এনে নাশতা দেয়। পুষ্পিতা তার সঙ্গে নাশতা করতে বসেছে দেখে ভীষণ ভালো লাগে৷ ডাইনিং রুমের পশ্চিমের জানালাটা খোলা। বাইরে সবজি বাগান। চড়ুই পাখি ক’টা জানালায় এসে কিচিরমিচির করছে। মাঝে মাঝে বাতাস আসছে দূর-দূরান্ত থেকে। বড়োই সুন্দর, প্রশান্তির পরিবেশ। এর আগে এই রুমটা এতো সুন্দর মনেই হয়নি। এর আগে কোনোদিন চড়ুই পাখির কিচিরমিচির এতটা সুমধুর লাগেনি। পুষ্পিতা চায়ের কাপ হাতে জানালার কাছটায় যায়। চড়ুই পাখিগুলো উড়ে চলে গেল। বাইরে তাকিয়ে চুমুক দেয় পুষ্পিতা। ওর চা খাওয়ার ভঙ্গিতেও যেন আভিজাত্য ভাব উপচে পড়ছে। পুষ্পিতা চা শেষ করে চলে যাচ্ছে দেখে সেও উঠে দাঁড়ায়৷ রুমে এসে দেখে পুষ্পিতা চুলটা ভালো করে বেঁধে মাথার ওড়না দিয়েছে। ইমাদ ঢুকতেই বললো রেডি হয়ে নাও। সিএনজিকে কল দিয়ে এনেছেন। বেচারা অপেক্ষায় আছে।
ইমাদ অবাক হয়ে বললো,

– ‘তুমি কি রেডি?’

পুষ্পিতা ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘কেন এইটুকু রাস্তা, সেজে-গুজে এতো ঢং করার কি আছে?’

বুকে যেন তির বিঁধেছে। এই কয়দিন কি একটু বেশিই করে ফেলেছে? পুষ্পিতা তুমি যতক্ষণ ইচ্ছা সাজতে পারো। ওইদিন তোমাকে কি যে সুন্দর লেগেছিল। এতো সৌন্দর্য আমি আর কোনোদিন কোথাও দেখিনি। তুমি সাজতে থাকো একটা জনম। আমার কোনো বাঁধা নেই পুষ্পিতা।
কিন্তু ভাবনাগুলো কথার রূপ পেল না৷ বুকের ভেতর অপচয় হয়ে গেল। পুষ্পিতা ততক্ষণে রুম থেকে বের হয়ে গেছে৷ সেও তাড়াতাড়ি কাপড় পালটে নিয়ে বের হয়। পুষ্পিতা ওর মায়ের রুমে। সে শ্বশুর-শাশুড়িকে সালাম করে বিদায় নেয়। মহসিন সাহেব তাদের সিএনজিতে তুলে দিলেন। সাবিনা বেগম বারবার শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের অশ্রু মুছে নিচ্ছেন। সিএনজি চলতে শুরু করেছে। ইমাদ যতটুকু সম্ভব ওর ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো। হঠাৎ সিএনজির আয়নায় চোখ পড়তেই মনে হলো তার কলিজাটা যেন কেউ মোচড়ে ধরেছে। পুষ্পিতার চোখে জল টলমল করছে। সংক্রামিত হয়ে তার চোখও ঝাপসা হয়ে এলো।

_চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here