তবু মনে রেখো ১৫,১৬

0
446

তবু মনে রেখো ১৫,১৬
লেখা: জবরুল ইসলাম
(১৫ পর্ব)
.
সাবিনা বেগমের মেজাজ ফুরফুরে৷ রাতে ভালো ঘুম হয়েছে৷ প্রশান্তির ঘুম। খাওয়ার টেবিলে পুষ্পিতার চেহারা দেখার মতো ছিল। এখানে আসার পর থেকে দু’জন রুম থেকেও বের হচ্ছে না। আল্লাহ পাক হয়তো তাদের মধ্যে মিল-মহব্বত ঢুকিয়ে দিয়েছেন। রাতে স্বপ্নও দেখেছেন একটা- সুস্বপ্ন। পুষ্পিতার কোলে ফুটফুটে শিশু। কিন্তু ছেলে না মেয়ে বুঝার আগেই ঘুম ভেঙে গেছে৷ আবার ঘুমিয়ে সেই স্বপ্নের বাকিটুকু দেখতে পারেননি। স্বপ্নের এই এক অদ্ভুত স্বৈরাচারী স্বভাব। যতটুকু ইচ্ছা দেখিয়ে আর আসার নামগন্ধ থাকে না। আজ তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিছনাকান্দি যাবেন না। মেয়ে জামাই আছে। তিনি শাশুড়ি হয়ে সঙ্গে যাওয়ার মানেই হয় না। প্রেম-ভালোবাসা জমে অন্ধকারে, আড়ালে, নির্জন-নিভৃতে। আর প্রেম-ভালোবাসা পালায় গুরুজন দেখলে। তিনি তাদের গুরুজন। সুতরাং সঙ্গে যাবেন না। ওদের প্রেম-ভালোবাসা জমুক। রাতের স্বপ্ন থেকে শিশুটিকে বাস্তবে আনতে হবে। তখন মেয়ে না ছেলে হয়েছে দরকার হয় প্যান্ট টেনে খুলে দেখবেন। যতক্ষণ ইচ্ছা বাচ্চাটাকে দেখবেন। ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয় নেই। ইমা এসে রান্নাঘরে ঢুকেছে দেখে বললেন,

– ‘তোমারে তো পুষ্পিতা ভুলে গেছে।’

ইমা মুচকি হাসলো কেবল। তিনি আবার বললেন,

– ‘দু’জনকে কি সুন্দর মানায় দেখেছো?’

– ‘হ্যাঁ আন্টি।’

– ‘আল্লাহ পাক চোখ থাকতে অন্ধ করে দিছিলেন আমাদের। এত ভালো জামাই চোখের সামনে রাইখা মিনারের লগে বিয়ে দিতে গিয়েছিলাম। আরে ব্যাটা তোর বাপ এক খ’বিশ তুই আরেকটা। আমার মেয়েরে বিয়ে করিসনি। তাতে আটকে গেছে বিয়ে। তোরে আরেক বেডি ছাইড়া চলে গেছে৷ তোর আবার ঠেস। আল্লাহ পাক যা করেন ভালোর জন্য করেন।’

– ‘হ্যাঁ আন্টি।’

– ‘যাও মা হাত-মুখ ধুয়ে নাও। আর ওরা আরেকটু ঘুমাক।’

ইমা হাত-মুখ ধুতে বাথরুমে চলে গেল।

পুষ্পিতা এখনও ঘুমোচ্ছে। ইমাদ আজ ফজরের আজান শুনতে পায়নি। ভোর ছয়টার দিকে হঠাৎ উঠেছে। পুষ্পিতার সঙ্গে শারীরিক কিছু না হলেও গোসল করে নামাজ আদায় করে। এরপর আর ঘুম আসেনি তার। চেয়ারে বসে জানালা দিয়ে দীর্ঘ সময় সকালের সজীব চা-গাছ আর সবুজে মোড়ানো উঁচু-নীচু পাহাড় দেখেছে। ভোর সাতটার উপরে এখন। ক্রমশই জানালার গ্লাস ভেদ করে আলো রুমে ঢুকে পড়ছে। পিছু ফিরে পুষ্পিতার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ খেয়াল হওয়ায় পর্দা টেনে দিল। বাইরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই মায়াবিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে অনায়াসে উপেক্ষা করা যায়। ইমাদ পাশের বালিশে গিয়ে মাথা পেতে দিল। মুচকি হাসলো সে। ঘুমন্ত অবস্থায় চেহারা শিশুদের মতো লাগছে। কিন্তু ক্ষীণ সময় পরেই তার ভুল ভেঙে গেল। শাড়ির আঁচল সরে গিয়ে পুষ্পিতার উম্মুক্ত পেট জানান দেয় পুষ্পিতা মোটেও শিশু নয়। ইমাদ খানিক্ষণ তাকিয়ে থেকে আস্তে-আস্তে ওর নাভিতে নাক-ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। ঘুমের ভেতরেই পুষ্পিতা কেঁপে উঠে ওর মাথা চেপে ধরে। আবার ক্ষীণ সময় পর ঘুম ভেঙে গেলে, চোখ মেলে তাকায়। আচমকা এই দৃশ্যটি দেখে ‘আরে কি হয়েছে’ বলে উঠে বসলো পুষ্পিতা৷

– ‘যাহ বাবা, তোমার ঘুম ভেঙে যাবে ভাবিনি, স্যরি।’

– ‘না সমস্যা নেই। আমি হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম দেখে।’

ইমাদ বালিশে মাথা রেখে পুষ্পিতাকে বুকে টেনে নিয়ে বললো,

– ‘ঘুমাও।’

পুষ্পিতা হাই তুলে বললো,

– ‘না, ঘুম ভাঙায় ভালোই হয়েছে। তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। বিছনাকান্দি যেতেও অনেক টাইম লাগে।’

– ‘তাহলে যাও, হাত-মুখ ধুয়ে নাও।’

পুষ্পিতা বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এসে বিছানায় আধশোয়া হয়ে ইমাদের গালে চুমু দিয়ে কানে ফিসফিস করে বললো, ‘স্যরি, তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি শুধু। বিয়ে নিয়ে তোমার হয়তো কত স্বপ্ন ছিল। আমার জন্য শুধু ঝামেলা হচ্ছে। তবে খুব শিগগিরই নিজেকে উজাড় করে দেবো তোমার কাছে৷’

ইমাদ মুচকি হেঁসে ওর কপালে চুমু খেয়ে বললো,

– ‘কোনো সমস্যা নেই ম্যাডাম৷ এসব নিয়ে ভেবো না।’

পুষ্পিতা উঠে বললো,

– ‘যাই দেখি নাশতার কি হলো।’

নাশতার পর্ব শেষ করে দশটার দিকেই তারা রেডি হয়ে বের হয়ে যায়। গাড়ি সিলেট এয়ারপোর্ট রোড় দিয়ে দ্রুত চলছে। ইমা এক পাশে, ইমাদ অন্যপাশে আর পুষ্পিতা মাঝখানে। সুন্দর পরিষ্কার পিচঢালা রাস্তা। রাস্তার দুইপাশের উঁচু-নীঁচু পাহাড় বেয়ে উঠেছে চা গাছ। ঘণ্টা খানেকের ভেতরেই তারা গোয়াইনঘাট উপজেলার পীরের বাজার এসে পৌঁছায়৷ ড্রাইভার বললো, এখান থেকে নৌকায় চলে যান। হাঁদারপাড় থেকেও যাওয়া যায়। তবে সেদিকের রাস্তা শুনেছি ভালো না৷ পুষ্পিতা আর ইমা গাড়ি থেকে নেমে রঙিন টুরিস্ট নৌকা দেখে বললো,

– ‘এখান থেকেই যাই। নৌকা ভ্রমণও হয়ে যাবে।’

একটা নৌকা ভাড়া করে তারা উঠে গেল।
তিনজনই সামনের চেয়ারগুলোতে বসেছে৷ নৌকা চলছে সচ্ছ পানির টলটলে পানি দিয়ে। দুইপাশে নদী পাড়ের গ্রামীণ জীবন-যাপনের কিছু কিছু ঝলক দেখা যাচ্ছে। নৌকা যাচ্ছে দ’পাশের সবুজ মাঠে, গরু ছাগল আর ধান খেত পেছনে ফেলে। মাঝে মাঝে নদীতে বাঁশ দিয়ে বানানো নড়বড়ে ঘাটগুলোতে ছেলে-বুড়ো থেকে শুরু যুবতী মেয়ে অবধি গোসল করতে দেখা যাচ্ছে। আঁকাবাঁকা এই নদীটি ধরে নৌকা আরও খানিকটা যেতেই উঁকি দিতে শুরু করলো ভারতের আকাশ ছোঁয়া পাহাড়৷ দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে সবুজ নয় এগুলো সাদা মেঘের পাহাড়। শুভ মেঘগুলো ঢেকে রেখেছে সবুজকে ইমা বিস্ময়ে বললো,

– ‘ওয়াও, ভাবি এইগুলো কি পাহাড়?’

পুষ্পিতা মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘হ্যাঁ, এটা ভারতের।’

– ‘মনে হচ্ছে মেঘের সঙ্গে মিশে গেছে।’

– ‘দূরে তাই এমন মনে হচ্ছে।’

– ‘কিন্তু মনে হচ্ছে আমাদের নৌকা কাছে চলে যাচ্ছে।’

– ‘হ্যাঁ এরকমই লাগে।’

ক্রমশই পাহাড়গুলো দৃশ্যমান হচ্ছে। যেন পাহাড়গুলো তাদের স্বাগত জানাচ্ছে অলিক কোনো ভুবনে। চারপাশ যেন ছবির মতো সুন্দর। নদীর দুইপাশে যেন রূপকথার সুন্দর গ্রাম। সামনের মেঘজমা মোহনীয় পাহাড় প্রকাশ পাচ্ছে দ্রুত। দু’টা পাশাপাশি পাহাড় দেখে পুষ্পিতা বললো,

– ‘ইমা যাও তোমার একটা ছবি তুলি।’

ইমা সামনে যেতেই ইমাদ ওর কয়েকটি ছবি তুলে নিল।

ইমা এসে বললো,

– ‘তোমরা যাও। আমি তুলি।’

ইমা তাদের ছবি তুলে বললো,

– ‘ওই দুইটা পাহাড়ে যেন হেলান দিয়ে আছো তোমরা।’

পুষ্পিতা মিষ্টি হেঁসে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে। তারপর চুপচাপ বসে থাকে তারা। মুগ্ধ হয়ে দেখে চারপাশ। যেদিকে তাকায় নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
নদীতে চলতে চলতে চোখ ধাঁধানো দৃশ্যগুলো বিমোহিত তারা। এক সময় দূর থেকে দেখতে পাওয়া পাহাড়ের কাছেই চলে আসে। পাহাড়ের কোলে এসে চোখে পড়ে বিস্তীর্ণ পাথর কেয়ারি। বর্ষায় পাথর কেয়ারি পানিতে ডুবু ডুবু। এখান থেকে একটু সামনেই সীমান্ত ঘেঁষা পাথর-জলের বিছনাকান্দি।
ভারতের পাহাড় ভেদ করে বাংলাদেশের বুকে জল গড়িয়ে আসছে। এই অগভীর জলের নীচে আছে পাথরের প্রলেপ। প্রকৃতি এতো সুন্দর করে পাথর বিছাতে পারে, সেটা ইমা ভাবতেই পারছে না। সে এর আগে জাফলং বিছনাকান্দি কোথাও যায়নি। সবচেয়ে বেশি রোমাঞ্চিত সে।

– ‘ভাবি ওই জায়গা কি ভারত?’

– ‘হ্যাঁ, ওই দেখো ভারতের মানুষ দেখা যায়।’

ইমা সেদিকে মুগ্ধ হয়ে তাকায়। তারপর জুতো খুলে রাখে সে। নিচে পাথরের বিছানা যেন। আস্তে আস্তে গিয়ে পানিতে পা দেয়। অস্ফুটে বলে উঠলো ‘ওয়াও এত ঠাণ্ডা পানি।’

ইমাদ নিজের প্যান্ট গুটিয়ে নিতে নিতে বললো,

– ‘দেখিস পড়বি। এখানে পড়লে যেদিকেই লাগবে রক্ত বেরুবে। চারদিকেই পাথর।’

ইমার সেদিকে খেয়াল নেই। হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে তার। আঁজলা করে ঠাণ্ডা সচ্ছ জল মুখে দিল সে।

পুষ্পিতা জুতা খুলে বললো,

– ‘ভোলাগঞ্জ সাদাপাথরে পানি বেশি থাকে। টিউব নিয়ে সাঁতার কাটতে পারতে। এখানে পানি কম।’

ইমাদ প্যান্ট গুটিয়ে নিয়ে মাথা তুলে বললো,

– ‘তুমি তো আর সাঁতারই জানো না।’

পুষ্পিতা মুচকি হেঁসে সামনে তাকায়।
একটু আগের কথাটার উত্তর দিয়ে দেয় এখানকার প্রকৃতি। ছোট বড়ো ডুবু-ডুবু পাথর বিছিয়ে আছে চারদিকে। পাথরের বিছানার উপর দিয়ে পাশের পাহাড় থেকে অনবরত স্বচ্ছ পানির ধারা বহমান।

পুষ্পিতা ইমাদের কাঁধে ধরে বললো,

– ‘এখানে পানি কম থাকায় পাথর দিয়ে হাঁটা যাবে। মাঝখানে গিয়ে ছবিও তোলা যাবে।’

– ‘হ্যাঁ।’

ইমা বেশিদূরে গেল না। পুষ্পিতা আর ইমাদ পানিতে হাঁটাহাঁটি করছে৷ ক্যামেরাম্যানকে পুষ্পিতা ডেকে এনে বললো,

– ‘ইমা ছবি তুলো।’

ইমা নানানভঙ্গিতে কিছু ছবি তোলার পর পুষ্পিতা একেবারে মাঝখানের বড়ো পাথর দেখিয়ে বললো,

– ‘আমরা দু’জন সেখানে গিয়ে তুলতে চাই।’

ক্যামেরাম্যান সম্মতি দিয়ে বললো,

– ‘চলুন।’

পুষ্পিতা আর ইমাদ দু’জন দু’জনকে ধরে খুবই সাবধানে হাঁটছে। পাহাড় থেকে নেমে আসা জল পাথরের উপর দিয়ে মৃদু কলকলানির শব্দ তুলে ছুটে যাচ্ছে। পুষ্পিতা বারবার পাথরে পা দিয়ে পড়ে যাচ্ছে। ইমাদ ধরে আছে তাকে শক্ত করে। দু’জন এক সময় এসে পাথরে উঠে। পেছনে দু’টি পাহাড়। মাঝখান দিয়ে জলের ধারা।
পুষ্পিতা ইমাদকে বললো,

– ‘তুমি আমাকে পিছু থেকে ধরে ক্যামেরার দিকে তাকাও।’

ইমাদ সাবধানে পেছনে গিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকায়। এভাবে তোলার পর পুষ্পিতা দুইহাত দু’দিকে দিয়ে বললো,

– ‘এভাবে তুমিও দুইহাত মেলে আমার আঙুলগুলোর ফাঁক তোমার আঙুল নিয়ে ধরো।’

ইমাদ ঠিকঠাক ধরতে পারছিল না। ক্যামেরাম্যান বুঝিয়ে দিয়ে সামনে গিয়ে পুনরায় বললো,

– ‘আরেকটু সামনে আসেন।’

পুষ্পিতা ভাবলো তাকে বলছে৷ খানিকটা এগুতে গিয়েই পা পিছলে ধড়াম করে পড়লো পাথরে সে। পলকেই পিছলে সে পড়লো গিয়ে পানিতে। আলগোছে পিছলে পড়ায় নিতম্বে ব্যথা ছাড়া তেমন কিছুই হলো না ওর। কিন্তু নড়ে যাওয়ায় সোজা দাঁড়িয়ে থাকা ইমাদ পেছন দিকে প্রায় ছিটকে পড়লো। দুই কনুই লাগলো গিয়ে দু’টা পাথরে। খুবই বাজেভাবে মাথার পেছন দিক পড়লো তৃতীয় পাথরে। আর্তনাদ করে উঠলো ইমাদ। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুল দুই কনুই এবং মাথা থেকে।

_চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম

তবু মনে রেখো (১৬ পর্ব)
.
পশ্চিমের জানালার বাইরে পাশাপাশি তিনটা কদম গাছ। এরপর পাশের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থান। ইলহামের পালঙ্ক জানালার ঠিক পাশটায়। কবরের দেয়ালে একটা শালিক পাখি সেই কখন থেকে বসা।
সে বালিশে কনুই ঠেকিয়ে থুতনি হাতের তালুতে রেখে বিষণ্ন মনে সেদিকে তাকিয়ে আছে। প্রায় তিন মাস হয়ে গেল। এখনও সে পুষ্পিতাকে ভুলতে পারছে না। কাটা হাতের দাগ মিলিয়ে যাচ্ছে৷ অথচ হৃদয়ের ক্ষত যেন শুকাতে চায় না। তবে পুষ্পিতা কিভাবে পারে? কিভাবে অন্যের সংসার করছে? ইলহাম বিশ্বাস করতে পারে না৷ এখনও সে রোজ রাতে পুষ্পিতার ছবি দেখে চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে ফেলে। পুরোনো মেসেজগুলো দেখলে বুক ফেটে তার কান্না আসে। চ্যাটে এতো প্রণয়বাক্য আদান-প্রদান। দিন-রাত ফোনালাপ, যখন-তখন ভিডিয়ো কল, এইযে এতসব স্মৃতি, পুষ্পিতার কি একবারও মনে পড়ে না? কেন একবারের জন্য হলেও ফেইসবুকে ওর নামের পাশে সবুজ বাতি জ্বলে উঠে না৷ কেন হঠাৎ তার ফোনে “বিমোহিনী” নামে কল আসে না৷ কিভাবে সে বিয়ে বসলো? কিভাবে সংসার করছে! সে তো ঠিকই ভুলতে পারছে না। প্রতিটি মুহূর্তে তাকে মনে পড়ে। তার বিরহ যন্ত্রণায় কত রাত নির্ঘুম কেটে যায়। কোনোকিছুই ভালো লাগে না। কোনোকিছুতেই মন বসে না৷ সবকিছুই যেন আরও বেশি পুষ্পিতার কথা মনে করিয়ে দেয়৷ গান শুনলে কান্না গলায় দলাপাকিয়ে আসে। মুভি দেখলে মনে হয় এই নায়িকাটাই পুষ্পিতা। জিমে গেলে মনে হয় কি হবে জিম-টিম করে? পুরো জীবনটাই যেন মিথ্যে। সবকিছু থেকে আগ্রহ হারিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছা করে ম*রে যেতে। শুধু মায়ের জন্য পারে না। মা কত কষ্ট পাবেন তা সে জানে। মায়ের জন্যই ম’রতে ম’রতে এই বেঁচে থাকা। হেতিমগঞ্জ গিয়ে যখন শুনেছিল পুষ্পিতার বিয়ে হয়ে গেছে। তখনই তার দুনিয়াটা এলোমেলো হয়ে যায়। ফেরার পথে বাস কাউন্টারের পেছনে গিয়ে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কেঁদেছিল সে। খুব কষ্ট করে মা’কে ধোঁকা দিয়ে গাজিপুর থেকে দ্বিতীয়বার সিলেট গিয়েছিল। পুষ্পিতাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা শোনার পর তার মা ভীষণ কেঁদেছিলেন। এমন কাণ্ড সে করবে তিনি ভাবতেই পারেননি। তাছাড়া ফোনে হুমকি-ধামকি। তার উপর আক্রমণ। সবমিলিয়ে তিনি একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। তাকে রেলস্টেশন থেকে এসে রিসিভ করে নিয়েছিলেন। বাসায় গিয়ে কাতর হয়ে বলেছিলে আর যেন সিলেটের দিকে পা না বাড়ায়৷ ফোনে কথা বলা লোকগুলো ভয়ংকর। গায়ে হাত তুলে আজ ছেড়ে দিয়েছে। আরেকদিন যে কে*টে নদীতে ভাসিয়ে দিবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। নিজের মোবাইল, সোনা, টাকা-পয়সা সবই সেদিন ছিনিয়ে নিয়েছিল ওরা। এরপর থেকে তার মা আম্বিয়া বেগম কড়া নজরে রাখেন। কিন্তু বাড়িতে আসার পর থেকে কোনোভাবে পুষ্পিতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে পুনরায় সে সিলেট চলে যায়৷ মেসেঞ্জারে পুষ্পিতার বিয়ের কার্ডের ছবি ছিল। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর এটা পাঠিয়ে তাকে বলেছিল, ‘দেখো কার্ড ছাপানো শেষ।’

সেই কার্ডের ঠিকানা নিয়েই সে হেতিমগঞ্জ যায়। কাজটা রিস্কি ছিল সে জানে। গ্রামের রাস্তায় গিয়ে লোকজনকে একটা মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করা মোটেও সহজ ছিল না। সবাই উল্টো নানান প্রশ্ন শুরু করেছি। গহিন গ্রামে তাকে ধরে মে*রে ফেললেও কেউ জানবে না। তবুও গিয়েছিল সে। খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে রাস্তায় মজিদার কাছে জানতে পারে পুষ্পিতার বিয়ে হয়ে গেছে। পুষ্পিতা নিজের শ্বশুরবাড়ি। এরপর ফিরে এলে মা খুব রাগারাগি করেন। তাকে জানান আজও কল এসেছিল ওই নাম্বার থেকে। ওরা টের পেয়ে খুঁজতে বেরিয়েছিল৷ পেয়ে গেলে নি’র্ঘাত মে’রেই ফেলতো। মা তার পায়ে ধরে অবধি কান্নাকাটি করেছিলেন। আর যেন সিলেট না যায়৷ মেয়েটির বিয়ে যেহেতু হয়ে গেছে আর কিছু করার নেই। সেও বলেছিল আর যাবে না। আজও যায়নি। কিন্তু পুষ্পিতাকে তো ভুলতে পারেনি সে। মেসেজ বা কল এলেই তাড়াতাড়ি হাতে নেয়। এই বুঝি বিমোহিনী নামটা ভেসে উঠবে। কিন্তু তার বিমোহিনী কখনও আর মেসেজ বা কল দেয় না। প্রথম প্রথম প্রায়ই পাগলামি করতো। হেতিমগঞ্জ থেকে এসে রাতে হাত-টাত কেটে র’ক্তা-র’ক্তি কাণ্ড করেছিল। সবাই ধরাধরি করে পাশের ক্লিনিকে নিয়ে যায়। সেসব এখন আর করে না। আম্বিয়া বেগম তাকে সব সময় চোখে চোখে রাখেন। গতকাল রাতে খাওয়ার টেবিলে বললেন,

– ‘আমাদের স্কুলে একজন এক্সট্রা টিচার দরকার। স্কুলে প্রতিদিন একবার আয় না। তাহলে দিনও কাটবে। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি স্কুলে পড়ালে মন্দ কি?’

ইলহাম মাথা নেড়ে বলেছে,

– ‘আচ্ছা মা সমস্যা নেই যাব।’

মা তাকে ব্যস্ত রাখতে চান সে বুঝতে পারে। খানিক পর দরজায় নক পেয়ে সে ভাবনা থেকে চমকে উঠে। এভাবেই সারাক্ষণ ডুবে থাকে নিজের ভেতর। দেয়ালে শালিক পাখিটি এখন আর নেই। ইলহাম উঠে দরজা খুলে দিল। এই একটা বদ অভ্যাস হয়েছে। সারাক্ষণ এখন দরজা বন্ধ করে অন্ধকারে পড়ে থাকে।

– ‘কিরে বাবা, রেডি হয়ে যা। কাল কি বললাম।’

– ‘রেডিই আছি মা। শুধু গেঞ্জিটা পরে নিচ্ছি।’

ইলহাম গেঞ্জি গায়ে দিয়ে মায়ের সঙ্গে স্কুলে চলে গেল। জোহরের আগেই আবার সে চলে এলো বাড়িতে। তাসনিম তখন কল দিল। তাসনিম তার মামাতো ভাই। রিসিভ করলো ইলহাম,

– ‘হ্যালো।’

– ‘কিরে ইলহাম বাড়িতে আছিস?’

– ‘হ্যাঁ আছি তো, তুই কোথায়?’

– ‘আমি তোদের বাড়িতে আসছি। রাস্তায় আছি।’

– ‘আচ্ছা আয়।’

তাসনিম বিকেলেই চলে এলো। আম্বিয়া বেগম ফিরলেন তার কিছুক্ষণ আগে। দরজা খুলে তাসনিমকে দেখে অবাক হয়ে বললেন,

– ‘আরে তুই? আয় আয়, কি মনে করে। বাবা এতদিন পর ফুপুর কথা মনে পড়লো বুঝি।’

তাসনিম মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘কেন তুমি কি জানতে না আমি আসবো।’

– ‘না তো।’

– ‘ইলহাম কই, তাকে কল দিয়েছিলাম তো।’

– ‘আর বলিস না ওর কথা। বস তুই আসছি।’

আম্বিয়া বেগম তাকে এনে ড্রিংক দিলেন। বসলেন সামনের সোফায়। তাসনিম চুমুক দিয়ে বললো,

– ‘ইলহাম কই?’

– ‘ওরে নিয়ে যে কি যন্ত্রণায় আছি বাবা বলে বুঝাতে পারবো না।’

– ‘হ্যাঁ শুনেছি আম্মুর কাছে। হাত-টাত না-কি কেটে ফেলেছিল।’

– ‘হ্যাঁ, এইতো সারাক্ষণ দরজা বন্ধ করে পড়ে থাকে। রাতেও ঘুমায় না। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে৷ খাওয়া-দাওয়ারও ঠিক নাই।’

– ‘বলো কি, এই অবস্থা৷ ও তো আগে জিম -টিম করতো। অনেক ফ্যাশন সচেতনও ছিল।’

– ‘সেসবের কিছুই এখন নাই বাবা।’

– ‘এখন কই, আমি তো কল দিয়েই এলাম।’

– ‘এইতো স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলাম চলে এলো। এখন দরজা বন্ধ করে রুমে পড়ে আছে। এরকমই চলছে বাবা। কোন কা*লনাগিনীর পাল্লায় যে ছেলেটা পড়েছে আল্লাহই জানেন।’

তাসনিম উঠে গ্লাস রেখে ইলহামের রুমের দিকে গেল। দরজায় চাপড় দিয়ে ডাকলো সে,

– ‘ইলহাম, এই ইলহাম।’

ইলহাম দরজা খুলে দিল,

– ‘আরে তুই এসে গেছিস। আয় বস এসে।’

– ‘কই বসবো শা*লা পা*গল৷ ঘর অন্ধকার কেন।’

– ‘ওয়েট জানালা খুলে দিচ্ছি।’

ইলহাম জানালা খুলে দিল। তাসনিম চেয়ার টেনে বসে হেঁসে ফেললো ওর দিকে তাকিয়ে।

– ‘তুই তো ছ্যাঁকা খেয়ে একেবারে ব্যাঁকা হয়ে গেছিস রে।’

ইলহাম বিছানায় বসে ফ্যাকাসে মুখে হেঁসে বললো,

– ‘তোর খবর কি?’

– ‘আমার খবর আবার কি। আমার তো সব স্বাভাবিক। খবর তো তোর কাছে। গাঁ*জাখোরের মতো অবস্থা কি করে হলো।’

ইলহাম কিছু না বলে কেবল হাসলো।

– ‘আচ্ছা কিরকম কি বলতো। আমি এসে মায়ের কাছে শুধু শুনলাম এগুলো। এতো সিরিয়াস অবস্থা জানতাম না। ফেইসবুকে না-কি প্রেম? ফেইসবুকের প্রেম এতো সিরিয়াস হয় কিভাবে? বাচ্চামো ছাড়া কিছু হইল এগুলো?’

– ‘বাদ দে তাসনিম। চল বাইরে যাবি?’

– ‘বাইরে কেন, আর রুমে দেখি সিগারেটের গন্ধ। সিগারেট খাওয়া ধরেছিস না-কি?’

– ‘হ্যাঁ, একটু-আধটু খাই এখন।’

তাসনিম হেঁসে ফেললো।

– ‘তুই না সিগারেট খাওয়া নিয়ে জ্ঞান দিতি। সব জ্ঞান হাওয়া হয়ে গেছে তাহলে?’

ইলহাম লাজুক হেঁসে বললো,

– ‘চল তো বাইরে চল। সিগারেট আনতেই যাব।’

দুইজন বাইরে যাচ্ছে দেখে আম্বিয়া বেগম পেছনে এসে বললেন,

– ‘কোথায় যাও তোমরা।’

ইলহাম দরজা খুলে বললো,

– ‘বাইরে মা, সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবো।’

পাকা রাস্তা ধরে দু’জন হাঁটছিল। তাসনিম ওর কাঁধে হাত রেখে বললো,

– ‘মেয়েটার সঙ্গে যোগাযোগ কি একেবারে নেই? মানে হয়েছে কি? আমি তো পুরোপুরি জানি না।’

– ‘ভাব ধরছিস। সবই জানিস।’

– ‘আরে না, আমি বাড়িতেই তো আসি না।’

– ‘তুই না-কি মেসে থাকিস এখন।’

– ‘হ্যাঁ, মামা চট্টগ্রাম থেকে ট্রান্সফার হয়ে অন্য জায়গায় চলে গেছেন। আমার ভার্সিটি থেকে দূরে।’

– ‘ও আচ্ছা, বুঝেছি।’

– ‘এড়িয়ে যাচ্ছিস কেন বল। শা*লা তুই আবাল না-কি। প্রেম কি বন্ধু-বান্ধবদের লুকানোর কিছু।’

ইলহাস হেঁসে বললো,

– ‘আরে তা না, তোর সঙ্গে তো দেখাই হয় না। বলবো কিভাবে।’

– ‘তাইলে আজ বল। তোর মতো ফুটানি মারা পোলার এই অবস্থা কিভাবে হইল জানতে আগ্রহ হচ্ছে।’

ইলহাম পাশের দোকানে গিয়ে সিগারেট নিয়ে এলো।

– ‘চল সামনের ব্রিজে গিয়ে বসি।’

– ‘হুম চল।’

দু’জন ব্রিজের রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো। তাসনিম সিগারেটে টান দিয়ে বললো,

– ‘মেয়েটার ছবি দেখাবি না?’

ইলহাম মোবাইলের পাওয়ার বাটনে ক্লিক করে ওর সামনে ধরলো।

– ‘বাব্বাহ ওয়ালপেপার দেয়া। কিন্তু ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না৷ ফটো দেখা বের করে।’

– ‘এটা কি ফটো না।’

– ‘থাক ভাই দেখানো লাগবে না৷ আমার গার্লফ্রেন্ডকে দেখবি? শা*লা ও তোর নাম পর্যন্ত জানে। তোকে রাস্তায় দেখলে চিনে ফেলবে। আর তোর কাছ থেকে কোনো কথা বো*মা মা*রলেও বের হয় না।’

ইলহাম হেঁসে মোবাইল থেকে একটা ছবি বের করে দেখালো। পুষ্পিতার পেছনে চা বাগান। পরনে কালো কামিজের উপর গোলাপি কটি। তাসনিম দেখে বললো,

– ‘বাহ সুন্দর তো। মেয়েটির বাড়ি কোথায় রে?’

– ‘সিলেট।’

– ‘সিলেট কোথায়।’

– ‘জেলা কোথায় জানি না। গ্রামের নাম হেতিমগঞ্জ।’

– ‘হেতিমগঞ্জ, মানে হবিগঞ্জের হেতিমগঞ্জ।’

ইলহাম অবাক হয়ে বললো,

– ‘আরে তুই চিনিস না-কি? কিভাবে চিনিস বল।’

– ‘আমার রুমমেটের বাড়ি হেতিমগঞ্জ। ওর বাবা চেয়ারম্যান। গ্রামের নাম মনে আছে কারণ ওর বাবা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিল তো। ওর ফেইসবুকে আর মুখে সারাক্ষণ এগুলোই ছিল।’

ইলহাম সিগারেট ছুড়ে ফেলে ওর হাত ধরে ফেললো,

– ‘তোর ফ্রেন্ডের সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই। প্লিজ তাসনিম৷ তুই আমাকে একটা হেল্প করতে হবে।’

__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here