তবু মনে রেখো ১৯,২০

0
544

তবু মনে রেখো ১৯,২০
লেখা: জবরুল ইসলাম
(১৯ পর্ব)
.
তাসনিম সেদিন ওর হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল। সে সাহায্য করবে। যতটুকু করা যায় অবশ্যই করবে। তবে ওদের প্রেমের ইতিবৃত্ত শুনতে চায় সে।

ইলহাম আশার আলো দেখতে পেয়ে বলতে শুরু করে সব। তাসনিমও মনযোগী শ্রোতা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খুটিনাটি প্রশ্ন করে। কিছুই এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। ইলহাম সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে ডুবে যায় অতীতে৷ ডুবুরির মতো ডুব দিয়ে তুলে আনে একেকটা সুন্দর মুহূর্তের গল্প। ব্রিজের ওপর দিয়ে কত গাড়ি যায়, গোধূলি আসে, তাদের পেছনের পশ্চিম আকাশে রক্তিম সূর্য মেঘে লাল সিঁদুর ছড়িয়ে দিয়ে হরিয়ে যায় দূরের ওই গ্রামের অরণ্যের আড়ালে। ইলহাম বা তাসনিম সেদিকে খেয়াল করে না। চেয়ে দেখে না ব্রিজের নিচ দিয়ে গোধূলি বেলায় নৌকা যাওয়া-আসার অপরূপ সৌন্দর্য। ইলহামের এই বেপরোয়া, অসীম ভালোবাসার গল্প শুনে তাসনিমের চোখ ভিজে আসে। একটা ফেইসবুক প্রেম এতটা প্রগাঢ় হয় জানা ছিল না তার। স্পর্শ নেই, সশরীরে সাক্ষাৎ নেই৷ তবুও প্রেম হয়। ইলহামেরও যেন কথা ফুরোতে চায় না। বুকভর্তি কথা, আকুতি, পুষ্পিতার জন্য নির্ঘুম রাত। পালিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত। তাকে আক্রমণ সবই বলে ফেলে সে। তাসনিমকে স্পর্শ করে সবকিছু। সে যে এই অনুভূতি, বিরহ, বেদনাগুলোর সঙ্গে বড়োই পরিচিত।
তাসনিম সব শুনে বললো,

– ‘আমার কি মনে হয় জানিস? পুষ্পিতার মোবাইল-টোবাইল কেড়ে নিয়ে ওরা ওকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে।’

ইলহাম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

– ‘আমার দু’টাই মনে হয়। হতে পারে পুষ্পিতা আমাকে ভুল বুঝে বিয়েতে রাজি হয়েছে। ওর বাবাই হয়তো লোক পাঠিয়েছিল। আমাকে মা*রধ*র করে সোনা টাকা মোবাইল সহ সব নিয়ে গেছে৷ শেষে এসব লুকিয়ে রেখেছে। পুষ্পিতা স্বাভাবিকভাবেই ভেবে নিয়েছে আমি এগুলো নিয়ে পালিয়েছি।’

– ‘তোর মোবাইল নিবে কেন?’

– ‘পুষ্পিতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারার জন্য হতে পারে।’

– ‘ওরা কি বুঝে না বাসায় গিয়েও অন্য মোবাইল দিয়ে যোগাযোগ করা সম্ভব।’

ইলহাম হেঁসে বললো,

– ‘বাসায় এসে পারিনি তো যোগাযোগ করতে। জানিস কারও সঙ্গে চাইলেও যোগাযোগ করতে না পারার কষ্ট কি য*ন্ত্রণার। আমি সেদিন টের পেয়েছিলাম৷ দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছিল যেন।’

তাসনিম ওর কাঁধে হাত রেখে বললো,

– ‘এভাবে আরও প্রেমের গভীরতা বাড়ে। বাঁধা পেলে প্রেম বেপরোয়া হয়ে যায়৷ স্বাভাবিক অবস্থা থেকে তখন বেশি দেখতে, কথা বলতে ইচ্ছা করে। এই অস্থিরতা থেকেই হয়তো মানুষ নিজেকে র*ক্তাক্ত করে। কেউ কেউ আ*ত্মহ*ত্যা করে।’

ইলহাম ম্লান হাসলো৷ তাসনিম খানিক ভেবে বললো,

– ‘স্যরি, আমি তোর ব্যাপারটা এভাবে বুঝতে পারিনি৷ অনুভব করতে পারিনি। দূর থেকে আসলেই সবকিছু বুঝা যায় না। প্রথমে তোর সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশা করেছি।’

ইলহাম ব্যগ্র গলায় বললো,

– ‘এগুলো ব্যাপার না। তুই আমাকে শুধু সাহায্য কর তাসনিম।’

– ‘কিন্তু ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে। তোর তো ভুলে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।’

– ‘কেন ভুলে যাব? তুইই তো বললি ওরা ওকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে হয়তো। যদি এমন হয় আমার কি হাত গুটিয়ে বসে থাকা ঠিক হবে। কাগজে কলমে শুধু বিয়ে হলেই কি হলো?’

– ‘তো কি করবি। তুই গেলেই কি আর ডিভোর্স দিয়ে চলে আসবে না-কি?’

– ‘না এলে নাই। আমি একবার দেখা করে ওর মুখ থেকে সবকিছু শুনতে চাই। কেন বিয়ে বসলো। তাছাড়া যদি ভুল বুঝে থাকে, সেটাও বলতে চাই। পুষ্পিতা আমাকে ভুল বুঝে আছে এটা মনে হলেই আমার অসহ্য লাগে, অসহায় লাগে। আমরা একই আকাশের নিচে থাকি, একই দেশ, একই ভাষা, অথচ আমি ওকে বলতে পারছি না৷ পুষ্পিতা আমি ওইদিন পালাইনি….।’

তাসনিম ওকে থামিয়ে দিল,

– ‘আচ্ছা ওয়েট আমি রায়হানকে কল দেই।’

তাসনিম নাম্বার বের করে কানে লাগায়। ওপাশে কয়েকটা রিং হতেই রিসিভ হলো,

– ‘হ্যালো।’

– ‘রায়হান কি অবস্থা, কি করছিস।’

– ‘আর বলিস নারে ভাই। তুই গিয়ে বেঁচে গেছিস। নিজেই রেঁধে খেতে হবে। খালা আসতে পারবে না কিছুদিন। ওর মেয়ের বিয়ে লাগছে।’

– ‘তাহলে তো ভালোই ঝামেলা।’

– ‘হ্যাঁ, তুই কোথায় আছিস?’

– ‘গাজিপুর এসেছি ফুপুর বাসায়। এখন তোকে কল দিলাম দরকারে।’

– ‘বল কি দরকার।’

– ‘দোস্ত তোদের হেতিমগঞ্জের মানুষ কি জং*লি?’

– ‘এই কথা কেন বলছিস?’

– ‘সাক্ষাৎ হলে বিস্তারিত বলবো। এখন এতটুকু শোন। আমার ফুপাতো ভাই প্রেম করেছিল হেতিমগঞ্জ।

– ‘তাই না-কি?’

– ‘ হ্যাঁ আগে শোন, মাঝখানে কথা বলবি না।’

– ‘ওকে বল। আমি লাউডে দিয়ে রেখে মাছটা কা*টি।’

– ‘না, আগে শোন, সব কথা। ওদের রিলেশন ফেইসবুকে। কিন্তু খুবই সিরিয়াস ছিল ওরা। দুই পরিবার বিয়েতে রাজি ছিল না। তাই ওরা পালিয়ে যেতে চায়। ইলহাম তোদের রেলস্টেশনে গিয়েছিল রিসিভ করে একসঙ্গে আসতে। ওর প্রেমিকা এসেই ওর কাছে সোনা টাকা-পয়সা দেয়। ইলহাম খাবার নিতে রেলস্টেশনের বাইরে একটু দূরে যায়। হঠাৎ কিছু লোক তাকে বে*ধড়ক মা*রধর শুরু করে। লাইট হাতে ছিল একজনের মাঝ পিঠে মেরেছিল এখনও ওর ব্যথা করে। এরপর সে চিৎকার করতে চাইলেও বলে চুপ থাকতে। ওর থেকে তখন সবকিছু কেড়ে নেয়। তারপর মুরব্বি একজন বলে তোর বাড়ির নাম্বার বল। সে বলতে না চাইলে আরও মারতে শুরু করে। টেনেহিঁচড়ে একটা গ্রামের রাস্তায় নিয়ে যায়। ভয়ে সে নাম্বার বললে, বাড়িতে কল দিয়ে অ*শ্রাব্য ভাষায় ফুপুকে গা*লাগা*ল করে। উনি জানতেনই না ইলহাম মেয়ে পালিয়ে আনতে গেছে। এরপর ফুপুকে বলে কোথায় এসেছে তোমার ছেলে। এখন যদি কে*টে নদীতে ভাসিয়ে দেই কি হবে? বিয়ের আগের রাতে এলাকার মেয়ে পালিয়ে নিতে এসেছে শুনলে গ্রামের লোকও গণপি*টুনি দেবে। ফুপুতো কাঁদতে শুরু করছে। তখন লোকটা বললো মনে রাখবা এখন অল্প মা*রধ*র দিয়েছি। চাইলে কিন্তু ছু*রি পেটে ঢুকিয়ে দিতে পারতাম। ছেলেকে বাসে তুলে দিব এখান থেকে এরপর যেন এদিকে আর না আসে। বুঝতে পারছেন আপনার ছেলে কি কাজ করতে আসছে। মানুষের মান-সম্মানে আ*ঘাত লাগলে মে*রে ফেলতে কি দ্বিতীয়বার চাইবে? ছেলেকে সামলাবেন। ফুপু ওদের কথায় সম্মতি দেয়৷ কাতর হয়ে বলে পাঠিয়ে দিতে। না হলে এখনই বলেন পারবেন না। কে*টে নদীতে ফেলে দেবো। এসব শুনে ইলহামও ভয় পেয়ে যায়। বুঝিসই তো ঢাকা থেকে সিলেট। তাও রাতে একটা গ্রাম এলাকা। সে ভয়ে কাঁপতে থাকে। ওরাই একটা বাসে তুলে দেয়। চুপচাপ আপাতত চলে আসে বাড়িতে। এরপর আর ওই মেয়েকে ফোন দিয়ে পায় না। ফেইসবুকেও পায় না। দুদিন পর আবার সাহস করে যায়। গিয়ে শুনে বিয়ে হয়ে গেছে। তখনও কিছুটা ভয়ে আর কি মনে করে গ*ণ্ডগোল না করে চলে আসে। ভাইরে ভাই, সেদিনও ওই লোকগুলো কিভাবে যেন জেনে যায়। আবার ফুপুকে কল দিয়ে নাকি একটা লোক গা*লাগা*ল করে বলেছে। তোর ছেলে আবার এসেছিল। এরপর আর খুঁজে পাইনি৷ পেলে সত্যিই আজ কে*টে ফেলতাম। তোকে বলেছিলাম কানে যায়নি না? এবার আরেকবার পেয়ে যাই। ছেলের কামাই শেষ হয়ে যাবে। এই হলো অবস্থা। এখন বলতো দোস্ত কি করা যায়। ইলহাম তো একেবারে শেষ রে ভাই। ও এক সময় অন্যরকম ছিল। এখন দেখে চেনাই যায় না। সারাদিন পড়ে থাকে ঘরে। হাত-টাত কে*টে ফেলে যাতা অবস্থা।’

রায়হান ওপাশ থেকে বললো,

– ‘এখন কি বরবি। মেয়েটার তো বিয়ে হয়ে গেছে বললি।’

– ‘ইলহামের ধারণা জোর করে না হয় ভুল বুঝিয়ে বিয়ে দিছে।’

– ‘ও বুঝেছি, কিন্তু এখন কি করতে চাও।’

– ‘কিছু কি করার নেই? তার কাছ থেকে সব ছিনিয়ে নিল। মা*রধ*র করলো। হুমকি দিল।’

– ‘সেটা তো গ্রামের বিচার বসলে মাফ-টাফ চাইয়ে শেষ করে দিবে। আর ওর যা যা নিয়েছে ফেরত দেওয়াইবে না হয় ক্ষতিপূরণ দেবে। এগুলোর জন্য এতকিছু করবা?’

– ‘কিন্তু ওই মেয়ের কি সামনা-সামনি হতে পারবে না ইলহাম? কথা বলতে পারবে না?’

– ‘কি যে বলিস। গ্রামে আরেকজনের বউয়ের সঙ্গে লোকে প্রেমিককে কথা বলার পরিবেশ করে দেবে বুঝি? এগুলো এমনিতে সমাধান করে শেষ করে দেবে।’

– ‘মেয়ে যদি বলে তাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে। বা মিথ্যে নাটক সাজিয়ে আলাদা করেছে তাদের।’

– ‘এরকম বললে ঠিক আছে। যদি বলে ওই বিয়ে মানে না৷ তাহলে এলাকার মানুষ ভাবতে পারে কি করবে। তাছাড়া এর চাইতে ভালো ওরে পালিয়ে নিয়ে যাক আবার।’

– ‘ওদের যোগাযোগই করার সুযোগ নেই। আচ্ছা দোস্ত, তোর আব্বা কিছু করতে পারবেন না?’

– ‘তা তো পারবে। কিন্তু নিয়মের বাইরে গিয়ে তো কিছু করতে চাইবে না।’

– ‘আরে ভাই তুই তোর আব্বার কাছে আমাদের নিয়ে চল। হয়তো উনি অনেক কিছুই করতে পারবে। ফলাফল কি আসবে পরে দেখা যাবে। তোর যতটুকু করার কর দোস্ত। ওর ইচ্ছা একবার মুখামুখি হতে।’

রায়হান হেঁসে বললো,

– ‘আব্বা আমাদের দেখে সিরিয়াসলি নিবে না তো। ভাববে পোলাপাইনদের কারবার। তবে যদি সিরিয়াসলি নেয় তাহলে ডিভোর্স করিয়ে বিয়ে দেওয়ানোরও ক্ষমতা আছে তাদের। এগুলো ব্যাপার না।’

– ‘তুই বলবি তোর ফ্রেন্ড। তাহলে সিরিয়াসলি নিবে না কেন?’

– ‘আচ্ছা ইলহামের আম্মুকে দিয়ে কথা বলাতে পারবি? আমরা আব্বুর কাছে গেলাম সবকিছু বলার পর বলবো ওর আম্মু পাঠিয়েছে এলাকার চেয়ারম্যান হিসাবে উনার কাছে। বিচার চায় সে। আর আমিও বলবো আমার পরিচিত।’

– ‘হ্যাঁ পারবো দোস্ত।’

– ‘ও হ্যাঁ, ওই মেয়েরে চিনবো কি করে। ঠিকানা, বাবার নাম এইসব বল।’

– ‘আচ্ছা ওর কাছে মেয়ের বিয়ের কার্ড আছে। ছবি দিচ্ছি।’

কথাটা বলে কল কেটে দিল তাসনিম। ইলহাম নিজের মোবাইল থেকে ওর হোয়াটসঅ্যাপে কার্ডের ছবি সেন্ড করে বললো,

– ‘তাসনিম, ও কেমন অনাগ্রহ দেখাচ্ছে মনে হয়। ওর বাবা এলাকার চেয়ারম্যান। সেও ওই এলাকার ছেলে।’

– ‘কি জানি, ও তো এরকম না। আচ্ছা দেখি কি করে।’

– ‘এক কাজ কর না ভাই। ওকে বল মেসে যেহেতু খালা নাই। এর চাইতে বাড়িতে চল। আমরা তার সঙ্গে চলে গেলাম।’

– ‘এটা ঠিকই বলেছিস। কিন্তু ও কয়েকমাস থেকে ছুটিতেও বাড়ি যায় না কেন যেন।’

– ‘তোর সঙ্গে সম্পর্ক কেমন?’

– ‘অনেক ভালো।’

– ‘তাইলে একটু জোরাজোরি করলেই হবে।’

– ‘মনে হয় ওর বাড়িতে কোনো সমস্যা। থাকে না রাগারাগি টাইপ কিছু। এক কাজ করি। ওকে বলি ঢাকায় চলে আসতে। আমরা গিয়ে রিসিভ করে তোদের বাড়িতে আনবো। একটু সম্পর্ক হবে তোর সঙ্গেও। ফুপুকে আমি আজ সবকিছু বুঝিয়ে বলবো। তাকেও তুই রাজি করাতে হবে। সেও যদি বলে বিষয়টা গাঢ় হবে।’

– ‘ঠিকই বলেছিস। ও যদি বাবাকে বলে তার ফ্রেন্ড আমি। বাবা কি ছেলের বন্ধুদের জন্য এটুকু করবে না। তাছাড়া যদি এভাবে কাজ না হয়। ওর এলাকা যেহেতু তার ফ্রেন্ড সার্কেল আছে ওদের মাধ্যমে কোনোভাবে পুষ্পিতার সঙ্গে যোগাযোগ করবো। রায়হানই আসল। আগে ওকে লাইনে আনতে হবে।’

আচ্ছা আমি কার্ডের ছবি সেন্ড করেছি। এবার কল দিয়ে দেখি। তাসনিম কল দিল। দুইবার রিং হতেই রিসিভ করলো রায়হান।

– ‘হ্যাঁ দেখেছি কার্ড।’

– ‘চিনতে পারলি দোস্ত?’

– ‘না দোস্ত, হেতিমগঞ্জ আসলে অনেক বড়ো এলাকা। ওরা হেতিমগঞ্জ আর আমরা পশ্চিম হেতিমগঞ্জ। দুই ওয়ার্ড এখানে।’

– ‘তোর বাবা ওই এলাকার চেয়ারম্যানই তো।’

– ‘হ্যাঁ, আমরা একই ইউনিয়নের অবশ্য।’

– ‘তাহলে তো তোর বাবার কাছে দিলে উনি মিনিটের ভেতরে বের করে ফেলবেন। ওই এলাকার মেম্বারকে বললেই চিনে ফেলবে।’

– ‘তা চিনবে। কিন্তু আমি বলি কি৷ বাবাকে বাদ দে। আমি পালিয়ে আনিয়ে দিতে পারি কি-না দেখি। কারও মাধ্যমে মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগ করবো। তারপর সে চাইলে তোদের সঙ্গে ট্রেনে তুলে দিয়ে দিলাম।’

– ‘এরকমও হয়। তবে ডিভোর্স হতে হবে তো। অনেক ব্যাপারই আছে। তোর বাবার মাধ্যমে হলে কোনো ঝামেলা হতো না৷ রিস্কও নাই। তুই এক কাজ কর।’

– ‘কি কাজ।’

– ‘খালা নাই যেহেতু ঢাকা চলে আয়। ইলহামদের বাড়িতে থাকবি কয়েকদিন। তিন বন্ধু মিলে আড্ডা হবে। ছুটিতে মেসে হুদাই কি করবি।’

– ‘না দোস্ত, সমস্যা নেই আমি রেঁধেই চালিয়ে নেব।’

– ‘কিরে শালা তুই এত মিনমিনে করতেছিস কেন? তোর এলাকায় সমস্যা। বন্ধু হয়ে হেল্প চাচ্ছি৷ তুই লাফ দিয়ে উঠার কথা। অথচ তুই বিড়ালের মতো মিউমিউ শুরু করছিস। বুঝলাম না কিছু।’

রায়হান হেঁসে ফেললো।

– ‘আচ্ছা দোস্ত বল কি করতে হবে।’

– ‘আমরা কি জানি না, এলাকায় চেয়ারম্যানের কি প্রভাব থাকে৷ তুই চাইলে অনেক কিছুই করতে পারিস৷ কিন্তু তুই বন্ধু নামে ক*লংক দেখছি।’

– ‘আচ্ছা আচ্ছা বল কি করবি এখন।’

– ‘কাজটা তোর বাবার মাধ্যমে কর একটু। বলবি তোর বন্ধুর সমস্যা। পোলা আ*ত্মহ*ত্যা করার অবস্থা। এভাবে সিরিয়াসলি নে বিষয়টা।’

– ‘আচ্ছা বুঝেছি, এখন আমি কি আসবো ঢাকা।’

– ‘হ্যাঁ রাতের বাসেই উঠে পর। একেবারে গাজিপুর চলে আয়।’

– ‘আচ্ছা শোন, আমি বুঝেছি সবকিছু। আর ইলহামদের বাড়ি গিয়ে কি হবে। বাসেই শুনতে পারবো বাকিসব। আমি বাসে আসছি৷ তোরাও রেডি হয়ে যা৷ একেবারে সিলেট চলে যাব। কথা হবে বাসে।’

– ‘ধন্যবাদ দোস্ত৷ এইতো লাইনে এসেছিস। ঠিক আছে তুই আয়।’

ফোন রেখে দিল তাসনিম।

– ‘চল এবার বাড়িতে যাই, ফুপুকে সব বুঝিয়ে বলতে হবে।’

দু’জন ব্রিজের ওপর থেকে নেমে গেল। রাত আটটা বেজে গেছে। ইলহাম আরেকটা সিগারেট ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

– ‘তা তুই কি বলেছিলি। তোর প্রেমিকা আমাকে চিনে?’

– ‘হ্যাঁ চিনে তো। তোর কত গল্প করেছি ওর সঙ্গে।’

– ‘তোদের তো শুনেছি বহু বছরের রিলেশন৷’

– ‘স্কুল লাইফের।’

– ‘বিয়ে করবি কবে?’

তাসনিম আকাশের দিকে তাকালো। ঝাপসা চোখে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লো সেদিকে। তারপর বললো,

– ‘করোনায় ও মারা গেছে।’

ইলহামের গায়ের লোমগুলো কেন যেন হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেছে। তার মনে হলো তাসনিম বাইরে কাঠিন্যের খোলস পরে হাঁটছে। ভেতর টলটলে জলের দীঘির মতো। তার খেয়াল হয়নি এতক্ষণ৷ পৃথিবী এত অদ্ভুত কেন। কার কাছে সে বিরহের গল্প এতক্ষণ বলেছে। ও তো নিজেই বিরহবিধুর। তার থেকেও অসহায়। কিছুই করার নেই। ফিরিয়ে আনার সুযোগ নেই।
আকাশে চাঁদ উঠেছে। ইলহাম সেদিকে তাকালো। তাসনিম তাকে আর কিছুই বলেনি। সেও জিজ্ঞেস করে না। তবুও ইলহামের গাল বেয়ে দু’ফোঁটা জল বেয়ে পড়লো তাসনিনের কথা ভেবে।

__চলবে__
লেখা: জবরুল ইসলাম

তবু মনে রেখো (২০ পর্ব)
.
সকাল দশটায় দু’জন মহাখালীতে এলো। রায়হান রাতে এখানে একটা হোটেলে উঠেছে৷ তাসনিম কল দিয়ে বললো,

– ‘দোস্ত আমারা মহাখালি এখন। তুই কোথায়?’

– ‘তোরা বক্ষ ব্যাধি হসপিটালের কাছে আয়। আমি আসছি।’

– ‘কেন? বাস স্টেশনেই তো আছি, তুই চলে আয়।’

– ‘আরে না, তোরা আয়, হোটেলে ফ্রেশ হবি। আমিও গোসল করবো। তারপর নাশতা করে যাব।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

তাসনিম আর ইলহাম রিকশা থেকে নেমে দেখে রায়হান হসপিটালের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। রিকশা ভাড়া চুকিয়ে তারা এগিয়ে গেল। ইলহাম দূর থেকে ভালোভাবে পরখ করে রায়হানকে। গোলগাল সারল্য মুখ, কান অস্বাভাবিক মোটা। বাঁ হাত প্যান্টের পকেটে রেখে সিগারেট ফুঁকছে। এরকম চেহারার লোকেরা কতটুকু পরোপকারী হয় কে জানে৷ তবে প্রথম দর্শনেই ইলহাম যেন ভরসা পেয়ে গেল। তাসনিম চুপিচুপি গিয়ে ওর পিঠে একটা চাপড় দেয়। চমকে উঠে পিছু ফিরে তাকায় রায়হান। ওদের দেখে মুচকি হেঁসে হাত বাড়িয়ে দিল সে।

– ‘আপনিই সেই ইলহাম।’

সেও হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

– ‘হ্যাঁ।’

তারপর তাসনিমের দিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘চল হোটেলে আগে যাই। আমি ভোরে তোর কল রিসিভ করে আবার ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। এখন গোসল করেই বের হয়ে নাশতা করবো।’

– ‘হুম চল, কিন্তু কথা হলো গোসল এত জরুরি হয়ে পড়লো কেন।’

রায়হান ওর পেছনেই ছিল। পিঠে ঘু*সি দিয়ে বললো,

– ‘শা*লা, এতদূর জার্নি করে কাল এসেছি। এখন আবার গোসল না করে যাব না-কি। গোসল করলে সবকিছু ভালো লাগে।’

– ‘হুম তা অবশ্য ঠিক বলেছিস।’

তিনজন হোটেলে ফিরলো। ইলহাম ব্যাগটা খুলে রাখলো বিছানায়। দু’জনে একটা ব্যাগই নিয়েছে। ক’দিন থাকতে হবে বুঝতে পারছে না। তাসনিম তাড়া দিয়ে বললো,

– ‘যা গোসল করে নে।’

রায়হান গেঞ্জিটা খুলে একটা গামছা নিয়ে ঢুকে গেল। খুব একটা দেরি হলো না তার। মিনিট বিশেকের ভেতরে পরনের প্যান্টই আবার পরে গামছা দিয়ে শরীর মুছতে মুছতে বের হয়। তাসনিম বিছানা থেকে পা লম্বা করে ওর পেছনে লা*ত্থি দিয়ে বললো,

– ‘শা*লা তোর স্বভাব আর গেল না।’

ইলহাম বুঝতে পেরে হাসছে৷ রায়হান গামছা নিয়ে বেলকনিতে যেতে যেতে বললো,

– ‘বাথরুমে কি আর কেউ থাকে যে আরেকটা কাপড় পরাই থাকতে হবে? তাছাড়া গামছা এখন ভিজালে শুকাবে না।’

– ‘তুই তো ফকিন্নি, একটা গামছা ফেলে গেলে কি হবে? কয় টাকা একটা গামছা।’

রায়হান আবার রুমে ফিরে এসে বললো,

– ‘তোরা হাত-মুখ ধুয়ে নে, এবার নাশতা করে আসি৷’

– ‘নাশতা করে আসব কেন আবার? একেবারেই চলে যাই।’

– ‘আরে না, রাস্তার ওপাশেই একটা হোটেল আছে নাশতা করে আসি।’

– ‘শা*লা তুই এত উলটা কেন? তাহলে নাশতা করেই উঠতাম।’

– ‘গোসল করে নাশতা করা আলাদা শান্তি আছে।’

তাসনিম বাথরুমে যেতে যেতে অস্ফুটে বললো,

– ‘প্রশান্তি না-কি কোন অঘটন ঘটিয়েছিস সেটা বল।’

রায়হান গেঞ্জি দিয়ে মারার আগেই তাসনিম বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিল। রায়হান গেঞ্জিটা গায়ে দিয়ে চুলটা হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে ইলহামকে বললো,

– ‘আপনার মামাতো ভাই খুবই অ*শ্লীল। ওর মুখ খুলেছে মানেই নোং*রা কথা।’

ইলহাম স্মিথ হাসলো। রায়হান বাথরুম থেকে বললো,

– ‘আপনি আপনি করো কেন তোমরা? দু’জন কি খুব ভদ্রলোক? চু*তিয়ামি না করে ডায়রেক্ট ‘তুই’ করে কথা বলো।’

ইলহাম সম্মতি জানিয়ে বললো,

– ‘হ্যাঁ, তাই হোক। তাসনিমের বন্ধু মানে আমারও বন্ধু।’

রায়হান কেডস এর ফিতা বাঁধতে বাঁধতে মাথা নেড়ে বললো, ‘তা ঠিক।’

তাসনিম বের হয়ে ইলহামকে বললো,

– ‘বাথরুমে যাবি?’

– ‘না।’

তিনজন বাইরে এসে নাশতা করে পুনরায় উপরে গিয়ে সবকিছু নিয়ে বের হলো। বাসে ইলহাম জানালার পাশে একা বসেছে। তার সামনের সিটে পাশাপাশি তাসনিম আর রায়হান। তীব্র গরম। ঘেমে-নেয়ে একাকার। অসহ্য গরমে কোনো কথা হলো না তাদের। বাস চলতে শুরু করার পর ধীরে ধীরে পরিবেশ শীতল হয়ে এলো। পকেটে কেঁপে উঠলো ইলহামের মোবাইল। আম্বিয়া বেগমের কল। ইলহাম রিসিভ করে।

– ‘হ্যাঁ মা বলো।’

– ‘ছেলেটাকে পেয়েছিস?’

– ‘হ্যাঁ, আমরা এখন সিলেটের বাসে উঠে গেছি।’

– ‘তোর বাবা ফোন দিয়েছিল। শুনে আমাকে বকেছে।’

– ‘বুঝিয়ে ম্যানেজ করে নাও মা।’

– ‘আচ্ছা ওই ছেলেটার কাছে দে তো। কথা বলি।’

ইলহাম খানিত ইতি-উতি করে তাসনিমকে বললো,

– ‘আম্মু রায়হানের সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন।’

– ‘আচ্ছা দে।’

তাসনিম রায়হানের কাছে মোবাইল দিল। সে কানে লাগিয়ে সালাম দিল।

– ‘বাবা ছেলেটাকে যেতে দিয়ে মনে হচ্ছে বোকামি করলাম। খুব ভয় করছে। ওর বাবাও রাগ করেছে শুনে। তাসনিমের কথায় শুধু রাজি হয়েছি। ছেলেটার যা অবস্থা হচ্ছে দিন দিন। ভাবলাম একবার দেখা করে নিশ্চিত হলে শান্তি পাবে। দোদুল্যমান কিছুই ভালো না। মেয়েটার মুখ থেকে একটা কিছু শুনে ক্লিয়ার হোক। সমাধান হলে হয়তো সান্ত্বনা পাবে।’

– ‘বুঝেছি আন্টি, ভয় পাবেন না৷ আমি তো আছি। কিছুই হবে না৷’

– ‘কোনো ঝামেলা হবে না তো বাবা? লোকগুলোর কথাবার্তা শুনে ওইদিন খুবই ভয় পেয়েছি। মোটেও ভালো না ওরা।’

– ‘কারা এমন করেছে সবই পাব আন্টি। যাচ্ছি যখন সবই হবে। চিন্তা করবেন না।’

– ‘আচ্ছা বাবা, আর তোমার দাওয়াত। একদিন বেড়াতে আসবে ওদের সঙ্গে। আন্টিকে দেখে যাবে।’

– ‘আচ্ছা আন্টি যাব একদিন।’

– ‘আর শোনো বাবা, বুঝতেই তো পারছো ছেলের অবস্থা দেখে মা হয়ে এগুলোতে প্রশ্রয় দিচ্ছি। কয়টা মাস থেকে ছেলেটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। এগুলো দেখে আর সহ্য হয় না৷ তাই প্রশ্রয় দিতে হয়েছে৷ তাই বলে পালিয়ে যেন না আনে। মুরব্বিদের মাধ্যমে যেটা হয় কইরো। মেয়ে যদি চায় আমার ছেলেকে। তাহলে বিবাহিত হলেও আমি বউ করে আনবো। আগে বেকার ছিল। আর এত সিরিয়াস ভাবিনি। তাই না করতাম। কিন্তু এখন এসব ভাবছি না৷ হয়তো জোর করেই বিয়ে দিয়েছে। শুনেছি গ্রামে এসব হয়। তাই মেয়েটা যদি চায়। মুরব্বিদের মাধ্যমে সুন্দরভাবে ডিভোর্স দিক। আমি বউ করে আনবো। পালিয়ে আনতে দিয়ো না বাবা। এগুলো সুন্দর সমাধান না৷ ঝামেলা লেগে থাকবে।’

– ‘আচ্ছা আন্টি বুঝেছি।’

– ‘ওকে বাবা, আল্লাহর হাওলা।’

ফোন রেখে দিল রায়হান। বাড়িয়ে দিল ইলহামের কাছে।

– ‘বাহ আন্টি তো খুব পজিটিভ।’

তাসনিম মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘মোটেও না, এখন ছেলের অবস্থা দেখে মেনেছেন। আগে না-কি মানেননি।’

– ‘ও আচ্ছা।’

– ‘উনি তাদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের টিচার। আমি ছোটবেলায় তাদের ওখানে পড়তে গেছিলাম প্রচুর মা*র খেয়েছি স্কুলে।’

– ‘ওইখানে পাঠশালা দিয়েছিস না-কি?’

– ‘না, এক বছর পরেই আবার চলে এসেছি। আম্মুকে ছাড়া তখন থাকতে পারতাম না।’

– ‘হুম বুঝেছি।’

এসব এলোমেলো আলাপচারিতায়, মোবাইল টিপে, ঘুমিয়ে তাদের দীর্ঘ জার্নির সময় কেটে গেল। সন্ধ্যায় চলে এলো তারা সিলেট। হেতিমগঞ্জ বাজারে আসতে না আসতেই এশার আজান। সিএনজি থেকে নেমেই রায়হান পরিচিত একটা ছেলেকে দেখে ডাকলো।

– ‘এই রাতুল দাঁড়া।’

ছেলেটি তাকে দেখে এগিয়ে এলো,

– ‘আরে এতদিন পর বাড়িতে এলি তাহলে।’

সিএনজি ভাড়া চুকিয়ে তারা এগিয়ে গেল। রায়হান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

– ‘হ্যাঁ অনেকদিন পর এলাম। কোথায় যাচ্ছিস এখন?’

– ‘বাজারে এসেছি, আড্ডা দেবো। তুইও আসিস, রাতে ক্যারাম খেলা হয়।’

– ‘আচ্ছা ওই ব্রিজের দিকে চল। কিছু কথা আছে।’

– ‘কি কথা?’

– ‘আরে আয় না।’

রাতুলকে নিয়ে রায়হান এগিয়ে গেল। তাসনিম আর ইলহাম গেল পিছু পিছু। খালের ছোট্ট ব্রিজের ওপর গিয়ে রায়হান মোবাইল থেকে বিয়ের কার্ড বের করে বললো,

– ‘পুষ্পিতা জান্নাত মেয়েটা কে? পিতা মহসিন তালুকদার।’

রাতুল কার্ডের দিকে তাকিয়ে হেঁসে ফেললো।

– ‘এই মেয়ের খবর নিয়ে ঘুরতেছিস কেন? এই মেয়েকে একটা ছেলে খেয়ে ছেড়ে দিছে।’

তিনজনই অস্বস্তিতে পড়ে গেল। রায়হান তবুও আবার বললো,

– ‘কাহিনিটা কি বলতো।’

– ‘বাজারে লোকমুখে শুনেছি। ওই মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু সে বিয়ের রাতে বাড়ির সোনা, টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়ে চলে যায়। মানুষ পরেরদিন বিয়েতে গিয়ে ফিরে আসে। কয়েকদিন পর বাড়ি ফেরেছে ওই মেয়ে। ওরে নন-সিলেটি একটা ছেলে খেয়ে সোনা আর টাকা নিয়ে পালিয়েছে।’

কথাগুলো শুনে ইলহামের কান দিয়ে যেন গরম ভাপ বেরুচ্ছে৷ শরীর মৃদু কাঁপছে।

রায়হান আবার জিজ্ঞেস করলো,

– ‘আচ্ছা এরপর কি হলো?’

– ‘এরপর যার সাথে বিয়ে ঠিক ছিল সেও বিয়ে করেনি। একটা খাওয়া মেয়েকে কে বিয়ে করবো রে ভাই?’

– ‘কিন্তু শুনলাম তো বিয়ে হইছে, সেটা কার সাথে?’

– ‘বাজারে মাঝগলিতে একটা কাপড়ের দোকান আছে না৷ হায়দার বস্ত্র বিতান। ওর ছেলের সাথে হইছে। মেয়েটা সুন্দর আছে। যার সাথে বিয়ে হয়েছে একেবারে বলদা টাইপ। আসলে মেয়েকে আর কে বিয়ে করবো। তাই কোনোভাবে বিকাইল আরকি।’

– ‘ছেলেটাকে তো চিনি না। কাপড়ের দোকানও খেয়াল নেই।’

– ‘কিন্তু এতকিছু তুই জিজ্ঞেস করছিস কেন? কাহিনি কি?’

– ‘কারণ আছে জানতে পারবি৷ আর ওই মেয়েকে ছেলে খেয়ে ছেড়ে দেয়নি। মাঝখানে কাহিনি আছে। ওই ছেলেও টাকা আর সোনা নিয়ে পালায়নি।’

– ‘বলিস কি? তুই কিভাবে জানলি।’

– ‘এখনই সব বলার দরকার নেই। জানবি সব। এখন যা, পরে দেখা হবে।’

রাতুল চলে গেল। রায়হান মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে বললো,

– ‘চলো যাই।’

ইলহাম অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছে। একটু দূরে গিয়ে অবাক গলায় তাসনিম বললো,

– ‘কিরে ভাই, ঘটনা দেখি এইখানে ভিন্নভাবে জানে সবাই।’

– ‘গ্রামগঞ্জে এরকমই হয়। একটা ঘটনা থেকে রটনা বেশি হয়ে যায়৷ যা বুঝলাম মেয়েটাকে সবাই চ*রিত্রহী*ন হিসাবে নিয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে একটা ছেলে ধরে কোনোভাবে বিয়ে দিতে হইছে। কারণ এমনিতে পালিয়ে গিয়ে বাড়ি ফিরলে হয়তো কেউ জানতো না। পরেরদিন বিয়ে ছিল তো। আত্মীয়-স্বজন এবং গ্রামের মানুষ সবাইই গেছে। গিয়ে সব একে অন্যের থেকে জেনে ফেলেছে। ব্যস পুরাই ফেঁসে গেছে পরিবার। গ্রামে একটা প্রেমও যদি করে কোনো মেয়ে, সেটাও লোকে শুনলে অবস্থা শেষ। আর এটা তো অনেক বড়ো ঘটনা।’

ইলহাম খানিক পর বললো,

– ‘কিন্তু পুষ্পিতা তো এভাবে বিয়ে না বসে, আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারতো।’

তাসনিম জবাব দিল,

– ‘তোর কথাই ঠিক। পুষ্পিতার বাবা হয়তো লোক পাঠিয়েছিল। ওর পরিবার সোনা-টাকার বিষয় হাইড করায় পুষ্পিতা ভেবেছে তুই এগুলো নিয়ে পালিয়েছিস।’

ইমাদের শরীর লোমগুলো দাড়িয়ে যায়। ভালোবাসার মানুষের মনে এমন জ*ঘন্য মানুষ হয়ে থাকার যন্ত্রণা কত ভয়াবহ সে টের পায়। ভুল ভাঙতে না পারার জন্য বড়ো অসহায় লাগে। রায়হান খানিক পর বললো,

– ‘কিন্তু রাতুল যে বললো যার সাথে নিয়ে ঠিক ছিল সে বিয়ে করেনি। এরপর যার সাথে বিয়ে হয়েছে সে ব’লদা টাইপ। তাহলে পরিবার ওর কাছে বিয়ে না দিয়ে তখনও তো পুষ্পিতাকে সবকিছু বলে দিতে পারতো। ওর মাধ্যমে ইলহামের সাথে আবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে পারতো।’

তাসনিম তাচ্ছিল্য করে বললো,

– ‘পরিবারগুলো এসব বুঝে না। তাদের জেদই বড়ো।’

ইলহাম খানিক পর বললো,

– ‘আর ওই ছেলে যে বললো, পুষ্পিতা কয়েকদিন পর বাড়ি ফিরেছে। তা কেন হবে? সে তো কয়েক ঘণ্টা পরই অপেক্ষা করে না পেয়ে বাড়ি চলে যাওয়ার কথা।’

তাসনিম ওর কথায় সম্মতি জানায়। রায়হান অন্যমনস্ক, সে অন্যকিছু ভাবছে। তাসনিম তার বন্ধু মানুষ। তার এলাকায় একটা সমস্যা। বিষয়টা হালকাভাবে নেয়া যায় না৷ তাছাড়া ইলহামের মায়ের কথা শুনেও মনে হয়েছে কিছু একটা করা দরকার। বাবাকে বললেই এসব ঠুনকো বিষয় সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু বাবার সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো নয়। ভদ্রলোক কমবয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করেছেন। তার মা না পারতে ব্যাপারটা মেনে নিলেও সে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। রাগ করে বাড়িও আসে না৷ বাবার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে মনে হয় বাবার সঙ্গে কথা বলতেই হবে। বিষয়টা ভাবতে তার আমিত্বে লাগছে। তবুও বলতে হবে। যতটুকু করা যায় সর্বোচ্চ করবে সে।

তাসনিমের কথায় তার ধ্যানভঙ্গ হলো।

– ‘এত অন্ধকার কেন রে রাস্তা।’

– ‘গ্রামে তো চারদিকে বাতি থাকে না।’

– ‘কিন্তু সামনে কি বাড়িঘর নেই। অন্ধকার কেন?’

– ‘বিদ্যুৎ নেই হয়তো।’

– ‘আর কতক্ষণ? বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে তো মনে হচ্ছে।’

রায়হান হাত মেলে বললো,

– ‘হ্যাঁ, তাইতো। তাড়াতাড়ি হাঁটো। আরও দশ-পনেরো মিনিটের মতো হাঁটতে হবে।’

– ‘রাস্তা তো ভালোই। গাড়ি আসে না এদিকে?’

– ‘সরি দোস্ত, আসে কিন্তু খেয়াল করিনি। আর বৃষ্টি আসবে ভাবিনি।’

– ‘আচ্ছা তাড়াতাড়ি হাঁটো।’

বৃষ্টি ক্রমশই তীব্র হতে শুরু করলো। তারাও হাঁটার গতি বাড়াতে বাড়াতে এবার দৌড়াচ্ছে। কিন্তু তাতে কাজ হলো না। আসমান ডেকে এখন বড়ো বড়ো ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। সঙ্গে মৃদু বাতাস। তিনজনই ভিজে একাকার। ইলহামের ব্যাগ ভিজে ভারী হয়ে গেছে। সে দৌড়াতে পারছে না। ব্যাগ যেন পেছনের দিকে টানছে। পলকেই যেন কাঁচা রাস্তাও পিচ্ছিল হয়ে গেল। দৌড়াতে গিয়ে মনে হচ্ছে পড়ে যাবে সে। কিন্তু সে পড়লো না৷ তাসনিম পা পিছলে পড়তে পড়তে বাঁচার জন্য জাপটে ধরলো রায়হানের গেঞ্জি। রায়হান টাল সামলাতে না পেরে চিত হয়ে পড়লো। তাতে শেষ রক্ষা হলো না তাসনিমেরও। রায়হানের কাঁধের ধাক্কা তার পায়ে লেগে রাস্তার সাইটে গিয়ে পড়লো। ইলহাম হাসতে হাসতে গিয়ে তাসনিমকে টেনে তুললো। রায়হানের মোবাইল মাটিতে পড়ে আকাশের দিকে বাতি জ্বলছে। ইলহাম সেটা তুললো গিয়ে৷ রায়হান কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে। সে উঠে বললো,

– ‘সামনে একটা বাড়ি আছে। তাড়াতাড়ি হাঁটো, বাড়িতে উঠি গিয়ে।’

তাসনিম হতাশ গলায় বললো,

– ‘তার আর দরকার কি? অবস্থা তো এমনিতেই খারাপ।’

– ‘মোবাইল তো বাঁচাতে হবে। ভিজে গেছে এমনিতেই।’

– ‘ব্যাগে ঢুকিয়ে নে, কাপড়ের ভাঁজে রাখ।’

ইলহাম বিরক্ত হয়ে বললো,

– ‘ব্যাগই তো ভিজে ভারী হয়ে আছে। আপাতত একটা বাড়িতেই উঠি।’

তিনজন দৌড়ে গিয়ে একটা বাড়িতে ঢুকলো। মাটির ঘর৷ খোলা বারান্দা। দরজার ফাঁক দিয়ে হারিকেনের আলো দেখা যাচ্ছে। একটা বাচ্চা সুরে সুরে পড়ছে,
“আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি….।”

তিনজন চুপিচুপি গিয়ে বারান্দায় উঠে। কেউ একজন দরজা ঠেলে বের হলো তখনই। মানুষটিকে দেখে ইলহাম অবাক হয়ে গেল।

_ চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here