তবু মনে রেখো ২৩,২৪ শেষ
লেখা: জবরুল ইসলাম
(২৩ পর্ব)
.
– ‘ইলহাম মানে! তুমি ওকে কোথায় পেলে?’
– ‘আমি হেতিমগঞ্জ এসেছি পুষ্পিতা, এই নাম্বার আমার। তুমি এটা সেভ করে ফ্রি হয়ে নক দাও জরুরি কথা আছে।’
– ‘হোয়াট! তুমি এখানে আবার কোন মতলবে এসেছো? তুমি একটা বে*ইমান প্র*তারক। তোমার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নাই। ফোন রাখো।’
ইলহাম উত্তেজনায় হাঁপিয়ে গেছে। শরীর কাঁপছে। সে বড়ো করে একটা শ্বাস ছেড়ে বললো,
– ‘পুষ্পিতা তুমি কিছুই জানো না। তোমার অজান্তে অনেককিছুই ঘটে যাচ্ছে। অকারণ ভুল না বুঝে একা হয়ে কল দাও তাড়াতাড়ি।’
কথাটি বলে সে কল কেটে দিল। শরীর ঘেমে একাকার তার। কপালে হাত ঠেকিয়ে বসলো বারান্দার চেয়ারে। বুক ধড়ফড় করছে। বৃদ্ধ মানুষের মতো শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে। তাসনিম ওর পিঠে হাত দিয়ে বললো,
– ‘শান্ত থাক ইলহাম। এখন যোগাযোগ হইছে। এবার পুষ্পিতার উপর সবকিছু নির্ভর করছে।’
রায়হান মজিদার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিতে গেলে মজিদা টাকাটা নিল না। কেন নিল না মজিদা নিজেও বুঝতে পারছে না। সে আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘লাগবো না আমি এখন গেলাম।’
– ‘টাকা নে মজিদা, তোর মেয়েরে কিছু দিস কিনে।’
টাকা না নিয়ে মজিদা চলে গেল। রায়হান এগিয়ে এসে বললো,
– ‘কিরে তাসনিম। ওর মাথা এরকম ঘামছে কেন?’
– ‘প্রেশারের সমস্যা হতে পারে।’
রায়হান তার বাহুতে ধরে বললো,
– ‘রুমে চলো। মোবাইল কাছে রাখলেই হবে।’
ইলহামকে ওরা রুমে নিয়ে ফ্যান ছেড়ে দিল। শব্দ করে ইলেকট্রনিক ফ্যান ঘুরছে। ইলহাম তাকিয়ে আছে সেদিকে।
তাসনিম ওর মাথায় হাত রেখে বললো,
– ‘কিরে? কোনো সমস্যা?’
– ‘বুক কেমন ধড়ফড় করছে।’
– ‘আচ্ছা চোখ বন্ধ করে রাখ।’
ধীরে ধীরে ইলহামের শরীর শীতল হয়ে এলো। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সে।
কল এলো এর খানিক পরেই। তাসনিম ফোনটা হাতে নিয়ে বারান্দায় গেল।
– ‘হ্যালো পুষ্পিতা আপু বলছেন?’
– ‘হ্যাঁ আপনি কে? ইলহামের নাম্বার না এটা?’
– ‘হ্যাঁ, এটা ইলহামের নাম্বার। কিন্তু আপনার সঙ্গে কথা বলার পর ওর শরীর কেমন করছিল৷ এখন ঘুমিয়ে গেছে।’
– ‘আচ্ছা আমি পরে কল দিচ্ছি।’
– ‘না আপু, সব শুনুন। অনেক ঝড়-ঝাপটা পেরিয়ে আপনার নাম্বার জোগাড় করা হইছে।’
– ‘আপনি কে?’
– ‘আমি ওর মামাতো ভাই তাসনিম।’
– ‘ও আচ্ছা, ওর কাছে শুনেছি আপনার কথা৷ বলুন কি বলবেন।’
– ‘আপনি কি জানেন আজ সকালে হেতিমগঞ্জ স্কুলের মাঠে বিচার ছিল? সেই বিচার ইলহাম বসিয়েছে আপনাদের এলাকার চেয়ারম্যানের মাধ্যমে।’
– ‘না তো, এসব কি বলছেন আপনি?’
– ‘আমি ঠিকই বলছি। এবং সেই বিচারে আপনার বাবা ছিলেন। অথচ আপনাকে জানানো হয়নি।’
– ‘কিন্তু ইলহাম কেন বিচার বসাবে। সে তো আমাকে রাতের অন্ধকারে রেলস্টেশনে রেখে পালিয়েছিল।’
– ‘যাকে ভালোবাসেন তার প্রতি এইটুকু বিশ্বাস আপনার! অথচ ছেলেটা আপনার জন্য কতকিছু করছে। গত তিন-চারটা মাসে পাগলের মতো হয়ে গেছে।’
ওপাশে অস্থির গলা। পুষ্পিতা তাড়া দিয়ে বললো,
– ‘প্লিজ এত কথা না বলে ক্লিয়ার করে বলুন সবকিছু।’
– ‘তাসনিম ওইদিন পালায়নি। সে বাইরে খাবার নিতে আসার পর কিছু লোক তার উপর আক্রমণ করে। মা*রধ*র করে সবকিছু কেড়ে নেয়। তারপর ওর মায়ের নাম্বার নিয়ে হুমকি-ধামকি দিয়ে তাকে বাসে তুলে পাঠিয়ে দেয়। তার সঙ্গে তখন মোবাইল ছিল না। আপনার সাথে যোগাযোগও করতে পারেনি। বাসায় গিয়ে আপনাকে আর কোনোকিছুতে পায়নি খুঁজে। এর কয়দিন পর সে আবার সাহস করে আপনাদের বাড়িতে পর্যন্ত চলে আসে। মজিদা নামে যে কাজের মেয়ে ওর সঙ্গে দেখাও হয়। সে জানায় আপনার বিয়ে হয়ে গেছে। ইলহাম ওইদিনও বাড়িতে এসে শুনে আন্টিকে ফোনে সেই লোকটি আবার হুমকি দিয়েছে।’
– ‘কি বলেন এসব! কে হুমকি দিল৷ এগুলো কি বলছেন আপনি! আর ওইদিন ইলহাম এসেছিল মজিদাও আমাকে বলেনি কেন তাহলে?’
– ‘কেন বলেনি জানি না। ইলহাম এখানে এসে বিচার অবধি বসিয়েছে সেটাও তো আপনাকে পরিবার জানায়নি। আর হুমকি কে দিয়েছে জানেন? বিচারে সেটা প্রমাণও হয়েছে। নাম্বার আমি দেখিয়েছি সবাইকে৷ সেটা ছিল হায়দার নামে এক ব্যক্তির।’
পুষ্পিতা বেলকনির গ্রিল বাঁ হাতে শক্ত করে ধরলো। কথাগুলো গলায় এসে আঁটকে যাচ্ছে। এগুলো কি শুনছে সে। হায়দার চাচা তাহলে এসব করেছেন তার সঙ্গে? অথচ উনিই তাকে পালিয়ে যেতে বলেছিলেন। কেন এমন করলেন উনি? কেন?
তাসনিম ওপাশ থেকে ব্যঙ্গ করে বললো,
– ‘কি হলো আপনার কি সবকিছু মিথ্যে মনে হচ্ছে।’
পুষ্পিতা ফ্লোরে বসে গেল।
– ‘না, আমার সবকিছু বিশ্বাস হচ্ছে। আমি এখন কথা বলতে পারছি না। রাখছি। প্লিজ এখন রাখছি।’
তাসনিম ‘হ্যালো হ্যালো’ করে ফোন রেখে দিল। মেয়েটির ধাক্কা সামলাতে সময় লাগতে পারে। সে ঘরে চলে গেল। রায়হান এলো খানিক পরেই।
পুষ্পিতা বেলকনির দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। সে মা-বাবাকে বলেছিল ইলহাম নামে একজনকে পছন্দ করি। তাকে ছাড়া আমি কাউকে বিয়ে করতে চাই না৷ রাজি হয়নি ওরা। উল্টো মিনারের সঙ্গে বিয়ের দিন তারিখ দ্রুত ঠিক করে ফেলেন। কি করবে সে ভেবে পায় না। ইলহামও তখন সংসার জীবনের জন্য প্রস্তুত ছিল না। পালিয়ে যেতেও দ্বিতীয়বার না ভেবে উপায় নেই। একটাই পথ ছিল হাতে, বিয়ে ভেঙে দেয়া। সেটাও কোনোভাবে সম্ভব ছিল না। একদিন রাতে হায়দার চাচাকে ধরে সে। ভেবেছিল বাবা-মা উনার কথা শুনবে। হায়দার সাহেবকে সম্পর্কের কথা সবকিছু বলে সে। কিভাবে রিলেশন, ছেলের বাড়ি কোথায়। সবকিছু শুনে বলেন। তোমার বাবাকে বলে লাভ নেই মা। এখন বিয়ের কার্ডও ছাপানো হয়ে গেছে। পুষ্পিতা তখন কান্নাজুড়ে দেয়। হায়দার সাহেব ভেবেচিন্তে বলেন। তুমি পালিয়ে চলে যাও মা। আমি যতটুকু পারি সহযোগিতা করবো। কিন্তু বুঝোই তো আমি মুরব্বি মানুষ। এগুলো লোকে জানলে মন্দ বলবে। তুমি কাউকে কোনোদিন বলবে না আমি সহযোগিতা করেছি। পালানোর দিনও তিনি তাকে সহযোগিতা করেছেন। স্টেশনে সে যখন ঢুকে যায় তিনি আর আসেননি৷ বলেন ছেলেটার মুখোমুখি হতে চাই না। ঘণ্টা কয়েক পর যখন ইলহাম ফিরছিল না। তখন সে বাধ্য হয়ে হায়দার সাহেবকে ফোন দেয়। তিনি স্টেশনে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে যান। পুষ্পিতা সবকিছু খুলে বলে। তিনি সান্ত্বনা দেন। ছেলে মনে হয় প্র*তারক মা। তোমার সর্বনা*শ করে পালিয়েছে। এদিকে পুরো এলাকা জেনে গেছে। সবাই তোমাকে খোঁজাখুঁজি করছে। পুষ্পিতা তখন কাঁদতে শুরু করে। তিনি মাথায় হাত রেখে বলেন, মা এবার বাড়ি চলো। যা হবার হয়ে গেছে৷ পুষ্পিতা যেতে রাজি হয় না। এই মুখ কিভাবে মা-বাবা দেখাবে। হায়দার সাহেব তখন বলেন তাহলে এখানে বসে থাকবে না-কি মা?
পুষ্পিতা কাঁদতে কাঁদতে বলে আমাকে আজ রাত কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দেন চাচা৷ আমি কাল যেদিকে ইচ্ছা চলে যাব।
হায়দার সাহেব মাথায় হাত রেখে বলেন। এই বয়সে আমাকে সবার কাছে বেইজ্জত করবে নাকি মা। মানুষ যদি জানে আমি তোমাকে সহযোগিতা করছি কি হবে বুঝতে পারছো? পুষ্পিতা বলে কেউ জানবে না চাচা। তিনি আমতা-আমতা করে বলেন আমার দোকানের কর্মচারি আছে না। ওর আত্মীয় একজনের বাসায় নিয়ে আজ রাখা যাবে। কিন্তু মা তোমার মোবাইলটা অফ করতে হবে। তোমার বাবা পুলিশের কাছে যাচ্ছেন। জানোই তো মোবাইলের মাধ্যমে মানুষ বের করা যায় আজকাল। যদি তোমাকে গিয়ে সেখানে পায়। আমার উপর সব দোষ চলে আসবে। পুষ্পিতা মোবাইল বন্ধ করে দেয়। হায়দার সাহেবের সঙ্গে সেখানে চলে যায়। দু’দিন পরে সে সিদ্ধান্ত নেয় বাড়ি যাবে। হায়দার সাহেব তাকে একা একা বাড়িতে পাঠান। সবকিছু দু’দিনে একেবারে ঘোলাটে হয়ে যায়। রটিয়ে পড়ে নানান গল্প। মিনারও তাকে আর বিয়ে করেনি। তখন হায়দার সাহেব আর বাবা মিলে তাকে ইমাদের সঙ্গে বিয়ে দেন। হায়দার সাহেব লোভী, বিয়ের পর এটা সে টের পেলেও এতদিন একবারও ভাবেনি উনি এই সবকিছুর পেছনে দায়ী৷ কিন্তু উনার স্বার্থ কি? কেন এসব করেছেন। পুষ্পিতার আর বুঝতে বাকি থাকে না। সবই লোভে। এতকিছু করেও স্বার্থ হাসিল না হওয়ায় উনি পাগল হয়ে গেছেন। ইমাদ এসে ঘরে ঢুকেছে। পুষ্পিতা বুদ্ধি করে আইস্ক্রিম আনার জন্য তাকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তাকে এভাবে বসা দেখে সে এসে বাহুতে ধরে বললো,
– ‘কি হয়েছে তোমার? কোনো সমস্যা?’
পুষ্পিতা ইমাদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বসা থেকে উঠে গেল। বিছানায় গিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো।
ইলহামের ঘুম ভাঙার পর বাইরে কাকের ‘কা কা’ ডাক শুনতে পেল। এতো জোরে ডাকছে যে। ইলহাম বুঝতে পারছে না উঠে শুনেছে না-কি কাকের ডাকের কারণে ঘুম ভেঙে গেছে। ঘরে সে একা। মনটা কেমন বিষণ্ণ লাগছে। উঠে বাইরে গেল সে। রায়হান আর তাসনিম বারান্দায় বেঞ্চে বসা। তাকে দেখে ওরা ডাকলো। সে চেয়ার টেনে বসলো গিয়ে। রায়হান উঠে বললো,
– ‘এখানে বসে লাভ নেই। ইলহাম তুমি মোবাইল সঙ্গে নাও। ওদিকে হেঁটে আসি।’
তাসনিম তাচ্ছিল্যের গলায় বললো,
– ‘এদিকে গিয়ে কি হবে। একটা দোকান নেই আশেপাশে।’
রায়হান হেঁসে বললো,
– ‘আরে না, পশ্চিম পড়ার রাস্তার মোড়ে আছে চা স্টল আছে।’
ইলহাম মোবাইল পকেটে রেখে বললো,
– ‘কিন্তু ও তো কল দিল না।’
তাসনিম একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– ‘দিয়েছে আমি কথা বলেছি।’
ইলহাম বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বললো, ‘মানে! ও কল দিছে আর এতক্ষণ পর বলছিস। ডাক দিলি না কেন।’ কথাটি বলে সে কল ব্যাক করার জন্য মোবাইল বের করলো।
তাসনিম থামিয়ে বললো,
– ‘আমি কথা বলেছি।’
– ‘কি কথা বলেছিস?’
– ‘হাঁটতে হাঁটতে বলি। নে সিগারেট ধরা। রায়হান এদিকে খেয়ে গেলে কি কোনো সমস্যা?’
– ‘না কেউ খেয়ালই করবে না।’
তিনজন হাঁটছে। তাসনিম সিগারেটে টান দিয়ে বললো,
– ‘অস্থির হবি না। ওইদিকে ম্যাডামও অস্থির হয়ে গেছে শুনে।’
কথাটির মধ্যে কিছু একটা ছিল। ম্যাজিকের মতো তার মনে ভালো করে দিল ইলহামের। তবুও ব্যগ্র গলায় বললো,
– ‘বল সবকিছু শোনার পর কি বললো?’
– ‘আমি রেকর্ড করেছি। সবই শুনতে পারবি। তোর ফোনেই আছে।’
– ‘তাই না-কি।’
ইলহাম বের মোবাইল করতে চাইল। তাসনিম আবার থামিয়ে দিল।
– ‘রাতে শুনিস। খাওয়া ঘুম ছাড়া তোর শরীর দূর্বল হয়ে গেছে। অস্থির হবি না।’
– ‘আচ্ছা বল সে শুনে কি বললো।’
– ‘সবকিছু শুনে সে বিশ্বাস করেছে। কিন্তু বললো এখন কথা বলতে পারবে না। বুঝতেই তো পারছিস অনেক বড়ো ধাক্কা খেয়েছে৷ বলেছে কল দিবে পরে।’
ইলহাম ডায়ালে টাইম দেখে বললো,
– ‘কিন্তু অনেক্ষণ তো হলো কল দেয় না কেন?’
– ‘আরে ভাই দিবে সময় দে। তাছাড়া সে তো জেনে গেছে সব। এখন তো ও কি করবে ওর ব্যাপার। তোর কোনো হাত তো নেই এখানে।’
– ‘কিন্তু আমার সঙ্গে তো কথা হয়নি।’
– ‘শা*লা বিশ্বাস না হলে শুনে ফেল রেকর্ড।’
ইলহাম তাড়াতাড়ি মোবাইলের লক খুলে নিল। তার শুনতে হবে। রায়হান থামিয়ে বললো,
– ‘ওইখানে গিয়ে বসি।’
তিনজন খোলা একটা মাঠের দিকে গিয়ে সবুজ ঘাসে বসে পড়লো।
পুষ্পিতার এমন আচরণে ইমাদ বিস্মিত হয়ে যায়। কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না। পুষ্পিতার কান্নার তোড় ক্রমশই বাড়তে থাকে। কান্না শুনে সাবিনা বেগম এসেছিলেন। তিনি মাথায় হাত রেখে বললেম,
– ‘কি হয়েছে রে মা? বল আমাকে?’
– ‘আমাকে মা ডাকবে না একদম। তোমরা সবাই একেকজন মু*খোশধারী শয়*তান। রুম থেকে বের হও। বের হও বলছি।’
সাবিনা বেগম ইমাদকে ইশারা করে নিয়ে বের হলেন। কল দিলেন মহসিন সাহেবকে। সবকিছু খুলে বললেন। তিনি মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। সাবিনা বেগম এসে ডেকে বললেন,
– ‘মা তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলো।’
পুষ্পিতা মোবাইল কানে নিয়ে গালাগাল শুরু করলো, ‘তুমিও শ*য়তান। তোমরা সবাই আমার সঙ্গে প্র*তারণা করেছো। আরেক ছেলের জীবন নষ্ট করেছো।’
– ‘মা বলতে তো হবে কি হয়েছে। বল বাবাকে।’
– ‘আমি বলবো কেন? ইলহাম এসেছে গ্রামে। তুমি বলেছো আমাকে সে কথা?’
– ‘মা এসব তোকে কে বলেছে। তাছাড়া এখন তোর বিয়ে হয়ে গেছে। পেটে সন্তান আছে। এগুলো তোকে বলে লাভ কি মা?’
– ‘আমাকে তোমরা সবাই ষ*ড়য*ন্ত্র করে বিয়ে দিয়েছো। হায়দার চাচা আমার সঙ্গে প্র*তারণা করেছেন। উনি নিজে আমাকে পালিয়ে যেতে বলেছিলেন। আবার নিজে ইলহামকে মা*রধ*র করে মোবাইল সোনা কে*ড়ে নিয়েছেন। সবার চোখে খারাপ বানিয়েছেন ইলহামকে। এভাবে প্র*তারণা করে এই বিয়ে দিয়েছে লোকটা।’
– ‘কি বলিস মা এগুলো? আমি তো এসব জানি না। তাছাড়া বিচারে হায়দারের হু*মকি দেয়ার কথা শুনেছি। কিন্ত আমি তো এগুলো তাকে করতে বলিনি।’
– ‘তোমরা সবাই এক। এগুলো তোমাদের ষ*ড়য*ন্ত্র ছিল।’
– ‘বোকা মেয়ে। তোকে পালিয়ে যেতে যদি হায়দার সাহায্য করে তাহলে কিভাবে আমরা সঙ্গে থাকলাম। আচ্ছা মোবাইল ইমাদ বাবার কাছে দাও।’
পুষ্পিতা বিছানায় রেখে দিল মোবাইল।
ইমাদ হাত বাড়িয়ে মোবাইল কানে নিল। মহসিন সাহেব বললেন,
– ‘সবকিছু শুনলে তো বাবা৷ আর গ্রামেও ওই ছেলে এসেছে। চেয়ারম্যানের বাড়ি সে। বড়ো মুসিবতে পড়লাম। তোমার বাবার কাছে কি সোনা মোবাইল এগুলো দেখেছিলে।’
– ‘না না, এগুলো কিছুই তো আমি জানি না। আমি এসবে ছিলাম না।’
পুষ্পিতা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
– ‘কে ছিল না ছিল আমি জানি না। এই বিয়ে আমি মানি না। আমার জন্য
নির্দোষ একটা ছেলের জীবন নষ্ট হচ্ছে। সব দোষ তোমাদের।’
সাবিনা বেগম মেয়ের মুখ চেপে ধরে বুকে টেনে নিলেন,
– ‘এসব কথা মুখেও আনবি না মা। তোর পেটে আল্লাহ একটা সন্তান দিয়েছে।’
ইমাদ মহসিন সাহেবের সঙ্গে কথা শেষ করে তাড়াতাড়ি ইমাকে কল দিল। ইমা রিসিভ করলো ওপাশ থেকে।
– ‘ইমা তুই একটা কাজ কর তো।’
– ‘কি?’
– ‘বাবার রুমটার সবকিছু খুঁজে দেখতো সোনা আর টাকা কোথাও আছে কি-না।’
– ‘কি বলো এসব!’
– ‘যা বলছি তাই কর।’
ইমা ফোন রেখে বাবার রুমে গেল। সবকিছু তন্নতন্ন করে সে কিছুই খুঁজে পেল না। একটা সিন্দুক আছে খাটের তলায়। সেটা তালা দেওয়া। ইমাদকে কল দিল সে। জানালো কিছুই পায়নি। শুধু খাটের নিচের সিন্দুক তালা। এটার চাবি পাচ্ছে না। ইমাদ বললো ইট এনে ভেঙে ফেলতে। ইমা হা*তুড়ি দিয়ে অনেক্ষণ চেষ্টা করে ভাঙলো। ভেতরে একটা ব্যাগ দেখে সেটা খুলে সোনা দেখে বিস্মিত হয়ে যায় সে। তাড়াতাড়ি কল ব্যাক করে বললো। একটা ব্যাগে সোনা পেয়েছি। ইমাদ কল কেটে দিল। বসে পড়লো সোফায়। সাবিনা বেগম বললেন কি হয়েছে বাবা। ইমাদ ধরা গলায় বললো হ্যাঁ আন্টি বাবার রুমে সবকিছু পাওয়া গেছে। সাবিনা বেগম মহসিন সাহেবকে জানালেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে হায়দার সাহেবের বাড়িতে চলে গেলেন। ইমা বের করে দেখালো তাকে। তিনি দেখে চিনে ফেলেন।
__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম
তবু মনে রেখো
.
(শেষাংশ: ২৪ পর্ব)
.
ইলহাম পুকুরের সিঁড়িতে বসে আছে। প্রতিটি মুহূর্ত তার ভীষণ অস্থিরতায় কাটছে। আজকের এই আধবেলা দিনটি যেন অনন্তকাল ছিল। দীর্ঘ একটা বিরক্তিকর জীবন যেন চলে গেছে এটুকু সময়ে। ফোনালাপের রেকর্ড সে শুনেছে। তাসনিমের বলাতে কোনো ফাঁকফোকর ছিল না। সবকিছুই বুঝিয়ে বলেছে। সে নিজেও হয়তো এভাবে বলতে পারতো না। তবুও ইলহাম সন্ধ্যায় কল দিয়েছে পুষ্পিতাকে। রিং হয়ে কেটে এসেছে বারবার৷ রিসিভ হয়নি। কেন রিসিভ হয়নি? পুষ্পিতার সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে সেটা কেউই জানে না। সুতরাং ওর ফোন পুনরায় কেউ কেড়ে নেয়ার প্রশ্নই আসে না। তাহলে সবকিছু শোনার পর, জানার পরও এই নীরবতা কেন? তাকে কি আর চাইছে না পুষ্পিতা? স্বামী সংসার নিয়ে কি সে সুখী? প্রবল অভিমান হয় তার। চোখ ডুবু-ডুবু হয়ে যায় নোনাজলে। বাঁধ ভাঙা কান্নায় ঠোঁটে কাঁপন ধরে।
তাসনিম আর রায়হান তাকে খোঁজে এলো পুকুরঘাটে। ইলহামের পিঠে হাত রেখে তাসনিম বললো,
– ‘কিরে? তুই এখানে এসে বসে আছিস কেন?’
ইলহাম কোনো জবাব দিল না। রায়হান আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘আমি বুঝতে পারছি না, সে তো এতক্ষণে কল দেয়ার কথা।’
তাসনিমের মনেও সন্দেহ জাগে।
– ‘আমিও বুঝতে পারছি না।’
রায়হান বসতে বসতে বললো,
– ‘যে ইলহামকে আ*ক্রমণ করেছিল। তার ছেলের সঙ্গেই পুষ্পিতার বিয়ে হয়েছে। বুঝতেই পারছো পুরোটাই ষ*ড়য*ন্ত্র। তাই এখনও কোনো সমস্যা হতে পারে।’
ইলহাম কথাটি শুনে অভিমান ভেঙে মোবাইল বের কল দিল। বারবার রিং হয়ে কেটে আসে। ইলহাম একের পর এক কল দিয়ে যায়। একপর্যায়ে কল রিসিভ হলো। ওপাশে কেবল কান্নার শব্দ। ইলহাম অস্থির হয়ে বললো,
– ‘পুষ্পিতা কি হয়েছে? তুমি কলও রিসিভ করছো না। নিজেও দিচ্ছ না। সমস্যা কি?’
পুষ্পিতা কান্নায় কথা বলতে পারে না। বারবার ওর গলা ধরে আসে। ইলহাম তাড়া দিয়ে বললো,
– ‘এখন কান্নার কিছু নেই তোমার। এতদিন কান্নার দরকার ছিল। এখন কাঁদবে কেন? এখন তো সবকিছু ক্লিয়ার। আমার কোনো দোষ নেই। তুমি ওই প্র*তারকদের লা*ত্থি মেরে চাইলেই চলে আসতো পারো। কান্নার কি আছে এখন।’
– ‘তোমার কি মনে হয়? লা*ত্থি মেরে চলে আসা এতো সহজ? আমার বিয়ে হয়ে গেছে৷ বুঝতে পারছো তুমি?’
– ‘বিয়ে হয়েছে তো কি হয়েছে? তোমার শ্বশুরের নাম হায়দার না? এই লোকটাই তো এতকিছু করেছে৷ আবার ষ*ড়য*ন্ত্র করে তোমাকে বিয়ে দিয়েছে ছেলের সাথে।’
– ‘প্লিজ ইলহাম আমার সাথে এভাবে কথা বলো না। আমি কল দেইনি কি বলবো তোমায় ভেবে পাচ্ছিলাম না। আসলে নিজেই জানি না আমি কি করবো।’
– ‘আশ্চর্য কথাবার্তা পুষ্পিতা। তুমি জানো আমার কোনো দোষ নেই। তোমার বিয়েটা পুরোপুরি একটা ষ*ড়য*ন্ত্রের ফসল। এটা জানার পরও তুমি কি করবে জানবে না কেন? আমি তোমার জন্য কত রিস্ক নিয়ে এতকিছু করলাম। আর তুমি এখন কনফিউজড!’
– ‘ইলহাম প্লিজ শান্ত হও, আমাকে সময় দাও।’
– ‘শান্ত হব কিভাবে? তুমি কল রিসিভ করছো না৷ নিজেও কল দিচ্ছ না।’
– ‘রিসিভ করে আমি কি বলবো?’
– ‘আশ্চর্য তো, তুমি সবকিছু জানার পর দু*শমনের সংসার করবে?’
– ‘আমার হাসবেন্ডের কোনো দোষ নেই। সবকিছু ওর বাবা করেছে।’
– ‘গুড, তাহলে তো ভালোই। তোমার হাসবেন্ড ভালো মানুষ। এখন কি তাকেও ভালোবাসো তাহলে?’
– ‘ইলহাম শান্ত হও। আমি বলতে চাইছি ওর দো*ষ নেই। তাকে ছেড়ে গেলে ওর জীবনটাও নষ্ট হবে।’
– ‘আমার জীবন কি খুব সুন্দর হবে?’
– ‘আমি তা বলিনি ইলহাম৷ আমি কনফিউজড এই কারণেই। তোমরা দুজনেরই দোষ নেই এখানে।’
তাসনিম ফোন কেড়ে নিল।
– ‘আপু আমি তাসনিম, আমার কথা একটু শুনবেন?’
– ‘হ্যাঁ বলুন।’
– ‘আপনি কনফিউজড কেন হচ্ছেন বুঝতে পারছি না৷ ধরুন একটা মেয়ে খুব সুন্দর৷ ওর পাড়ার দুইটা ছেলে তাকে ভালোবাসে। মেয়েটা জানে দুজনের ভালোবাসাই খাঁটি। দু’জনই ভালো মানুষ।
কিন্তু সে তাদের একজনকে ভালোবাসে। তখন কি দ্বিতীয়জন কষ্ট পাবে ভেবে তার ভালোবাসা বিসর্জন দেবে? এটা কোনো যৌক্তিক কথা হলো আপু? আপনি ইলহামকে ভালোবাসেন। তাকে পাওয়ার জন্য পালিয়েও গিয়েই ছিলেন। মাঝখান থেকে এক ডা*কাত ছি*নিয়ে নিয়ে তার ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছে। এখন কি ওর ছেলে ভালো বলে ভালোবাসার মানুষকে ফিরে পেলেও তাকে ত্যাগ করবেন? এগুলো হয় আপু?’
– ‘প্লিজ ভাই ফোন রাখেন। আমাকে সময় দেন। আমি কোনোকিছুই ভাবতে পারছি না।’
পুষ্পিতা লাইন কেটে দিল। তাসনিম ওর দিকে মোবাইল বাড়িয়ে দিয়ে ইলহামকে বললো,
– ‘তুই এত রেগে গেলি কেন?’
– ‘ভুল কিছু তো বলিনি।’
– ‘সবই ঠিক বলেছিস। কিন্ত এত রাগারাগির দরকার ছিল না।’
ইলহাম কোনো জবাব দিল না। রায়হান তার হাত ধরে বললো,
– ‘চলো ঘরে চলো। তাকে সময় দাও। সে তো এখনও তোমাকে না করেনি। সুতরাং অপেক্ষা করো।’
তাসনিম সম্মতি দেয়। ইলহাম তাদের সঙ্গে ঘরে চলে এলো। দুইহাত নিচে দিয়ে বালিশে মাথা রাখে। পুষ্পিতা কেন ওই ছেলেকে ছেড়ে আসতে দ্বিতীয়বার ভাবছে? সে তো বিয়ে হয়েছে জেনেও ভুলে যায়নি। এখনও তাকেই চায়। অথচ যাদের কারণে তাদের মিলন হয়নি। তাদের জন্যই সে ফিরে আসতে দ্বিধায় ভুগছে কেন? সে তো এরকম ভাবেনি, তার ধারণা ছিল যখনই পুষ্পিতা সবকিছু জানবে। তখনই ওই বিয়ে ভুলে যাবে, মিথ্যে ঠুনকো নড়বড়ে কাঁচের সংসার ভেঙে-ছুড়ে ছুটে আসবে তার কাছে।
মহসিন সাহেব রাতে বাসায় এসেছেন। পুষ্পিতা পুরোদিন দরজা বন্ধ করে রুমে পড়ে আছে। ইমাদ অসহায়ের মতো সিটিং রুমের সোফায় বসা। তার সকল ক্ষো*ভ, রা*গ নিজের বাবার প্রতি। কিন্তু এখন তার কি করার আছে? বাবাকে খু*ন করে ফেললেও তো এই সমস্যার সমাধান হবে না।
*
পুষ্পিতা দরজা খুলে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে দেখে সাবিনা বেগম পিছু পিছু গেলেন। প্লেটের পাশ থেকে হঠাৎ ছু*রিটা হাতে নিল সে, সাবিনা বেগম দেখে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। দৌড়ে এলেন মহসিন সাহেব এবং ইমাদও। পুষ্পিতা ছু*রি নিজের পেটে চেপে রেখে বললো,
– ‘আমি এখনই ঘর ছেড়ে চলে যাব। কেউ বাঁধা দিতে চাইলে ছু*রি সোজা নিজের পেটে ঢু*কিয়ে ফেলবো বলে দিলাম। তোমাদের মতো শ*য়তানদের সাথে থাকার চেয়ে ম*রে যাওয়া ভালো। আমি ইলহামের কাছে আজই চলে যাব। আর এইযে নিষ্পাপ ফেরেশতা৷ তুমি তো বলেছো কিছুই জানো না৷ তোমার কোনো দোষ নেই। তাহলে ডিভোর্স দাও আমাকে।
তোমরা আমার ডিভোর্সের ব্যবস্থা করবে। ডিভোর্স না দিলে এই সন্তান আমি ন*ষ্ট করে ফেলবো। কসম করে বলছি। ডিভোর্সের কাগজ সাইন দিয়ে আমার কাছে পাঠাবে। আমি গেলাম।’
ইমাদ ইতস্তত করে বললো,
– ‘পুষ্পিতা আমি সত্যিই কিছু জানতাম না। এখানে আমার দো*ষটা কোথায় বলো। একবার ভেবে দেখো তোমার পেটে আল্লাহ আমাদের একটা সন্তানও দিয়েছেন…।’
– ‘চুপ, সন্তান এখনও আসেনি। বেশি কথা বললে সন্তান ন*ষ্ট করে ফেলবো। ওরে জন্ম দিয়ে কি হবে? ওর শরীরে তোদের মতো শ*য়তানদের র*ক্ত আছে।’
ইমাদ অসহায় হয়ে পড়ে। বাস্তবতা সে জানে। এখান থেকে পুষ্পিতা চলে গেলে ইলহাম নিশ্চয় এই সন্তান রাখতে চাইবে না। আবার সেও পুষ্পিতাকে এখানে জোরাজুরি করে রাখতে পারছে না৷ কারণ এই বিয়েটাই হয়েছিল একটা ভুল বোঝাবুঝি থেকে। এই ভুল বোঝাবুঝির পেছনে আবার তারই জন্মদাতা পিতার হাত। সে আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘পুষ্পিতা আমি আবার বলছি, আমি নির্দোষ, এখন তুমি যদি আমাকে না চাও আমি বাঁধা দেবো। আমি তোমাকে ডিভোর্স দেবো৷ তোমাদের বিয়েতে কোনো সমস্যাই হবে না৷ কিন্তু একটা কথা দাও আমাকে৷ এই সন্তান তুমি ন*ষ্ট করবে না। দরকার হয় তুমি এখানে থাকো। আমি চলে যাচ্ছি গ্রামে। সন্তান জন্ম দাও ঠিকঠাক মতো। সন্তান হয়ে গেলে। তাকে রেখে তুমি চলে যেও। আমি ওকে নিয়েই বাঁচবো। যেভাবে পারি আমি ওকে লালন-পালন করবো।’
– ‘তোমাদের দিয়ে আমার বিশ্বাস নেই।’
সাবিনা বেগম বললেন,
– ‘মা বিশ্বাস কর আমাদের। তুই এখানে থাক। ইলহামের পরিবারের সঙ্গে আমরা দরকার হয় কথা বলবো। তুই সন্তান জন্ম দে আগে৷ না হয় ওরা নষ্ট করতে বলবে। দরকার হয় ইলহাম এখানে যখন ইচ্ছা আসবে।’
পুষ্পিতা ছু*রি হাতে রুমে যেতে যেতে বললো,
– ‘ঠিক আছে, ইমাদকে আমি এখানে আর দেখতে চাই না। সন্তান জন্ম দিয়ে আমি চলে যাব। কিন্তু এর ভেতরে ডিভোর্স হতে হবে।’
মহসিন সাহেব সম্মতি জানালেন। পুষ্পিতা রুমে চলে গেল। ইমাদ আর দেরি করলো না। বুকভরা বিষাদ নিয়ে, জল টলমল চোখে, রাতেই সে বাসা ত্যাগ করলো।
ফুটফুটে এক মেয়ে সন্তান জন্ম নিল ডিসেম্বরের দুই তারিখ দুপুর বারোটায়৷ পুষ্পিতার মেয়েটিকে মায়া লাগলেও সে নিজেকে শক্ত করে নিল। মেয়েকে এখানে রেখে চলে যাবে সে। কিভাবে ওরা লালন পালন করবে তা সে ভাবতে চায় না। তার নিজের জীবন আছে। ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে থাকার তারও অধিকার আছে। ইতোমধ্যে ইমাদের সঙ্গেও ডিভোর্স হয়ে গেছে। সন্তান জন্ম দেয়ার দুদিন পরই ইলহাম ওর মা’কে নিয়ে এলো। একসপ্তাহ পরেই ওরা কাজি এনে বিয়ে পরিয়ে বউ নিয়ে চলে যেতে চাইল। কেউ বাঁধা দিল না তাদের। মহসিন সাহেব বিয়ের সকল ব্যবস্থা করলেন।
ইলহামের সঙ্গে বিয়ের প্রায় চার বছর পর পুষ্পিতা বাপের বাড়ি আসে। ততদিনে বাসা বিক্রি করে তারা পুরোদস্তুর হেতিমগঞ্জ চলে গেছেন। পুষ্পিতা শুনেছে মেয়ের নাম ইমাদ ওর সঙ্গে মিলিয়ে মৌমিতা রেখেছে। প্রথমদিকে মৌমিতা নানির কাছেই থেকেছে বেশি। ইমাদ আর ইমা রোজ এসে দেখে গেছে। দুই পারিবারের মায়া-মমতায় বড়ো হয়েছে সে। পুষ্পিতা বাপের বাড়ি গিয়ে জানলো মেয়ে ইমাদের কাছে। খবর দেয়া হলো নিয়ে আসতে। ইমাদ এক বিপর্যস্ত পুরুষ। চেহারা-ছবিতে দীর্ঘ মেয়াদি ক্লেশের ছাপ। মেয়েকে নিয়ে এসে বারান্দায় উঠেছে। পুষ্পিতা মৌমিতাকে নিতে হাত বাড়ালে গেল না। মা’কে চিনতে পারে না সে। ইমাদ সাবিনা বেগমের কাছে মৌমিতাকে দিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে গেল উঠানে। পুষ্পিতা তাকিয়ে দেখলো, মুখভর্তি দাড়ি, এলোমেলো উষ্কখুষ্ক চুলের ইমাদ কোনভাবে কান্না আটকে রাখতে পারছে না। কান্না আড়াল করতে গিয়ে ওর মুখটা বিকৃত হয়ে গেছে। অন্যদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দ্রুত উঠান পেরিয়ে চলে গেল সে। পুষ্পিতার বুকে চাপা একটা কষ্ট অনুভব হলো। চোখ ফিরিয়ে মৌমিতার দিকেও গেল সে৷ কোনোভাবেই কোলে আনতে পারলো না মেয়েটিকে। সাবিনা বেগম বললেন, ওকে যে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করে তার কোলে যায়। নে কোলে নিয়ে পুকুর পাড় দিয়ে হেঁটে আয়।’
মৌমিতাকে কোলে নিয়ে সে উঠান পেরিয়ে পুকুর পাড়ে আসে। মেয়ে কান্না থামাচ্ছে না৷ কোনোভাবেই ওর কোলে থাকতে চায় না। পুষ্পিতা বারবার বলছে আমি তোমার মা৷ মায়ের কোলে কাঁদে না। মৌমিতা কিছুই শুনতে চায় না। যেন অচেনা নারীর কাছে থাকতে চায় না সে।
হঠাৎ পুষ্পিতার চোখ যায় তাদের শিমুল গাছের গোড়ায়। সেখানে বসে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কাঁদছে ইমাদ। পুষ্পিতারও ভীষণ কান্না পেল। কাঁদতে কাঁদতে ঘুম ভেঙে গেল ওর। বিছানায় উঠে বসলো পুষ্পিতা। শরীর ঘেমে গেছে। এ কেমন স্বপ্ন দেখেছে সে? নিজের মেয়েই তাকে চিনতে পারছে না এর মানে কি! আর ইমাদ, ইমাদকে ছেড়ে গেলে এভাবে কাঁদবে না-কি সে? রাত কয়টা বাজে এখন? পুষ্পিতা বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা হাতে নিল। মাত্র এগারোটা বাজে। সে দুশ্চিন্তা করতে করতে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিল। ইমাদ কি করছে? কতক্ষণ হলো দেখে না, আশেপাশেও আসছে না। তাড়াতাড়ি উঠলো বিছানা থেকে। সিটিং রুমের সোফায় এক হাত নিচে দিয়ে ঘুমিয়ে আছে৷ এই মানুষটার কোনো দোষ নেই পুষ্পিতা জানে৷ সংসার করতে যেয়ে এটুকু বুঝা হয়েছে পুষ্পিতার। তার মনটা খুবই পবিত্র। সহজ সরল একটা মানুষ। বাবার দোষে কি ইমাদ কি পুরো জীবনভর কাঁদতে হবে? পুষ্পিতা হাঁটু গেড়ে ফ্লোরে বসে ওর মাথায় হাত রাখে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে তাকায় ইমাদ। অবাক হয়ে উঠে বসে সে।
– ‘তুমি ফ্লোরে বসে আছো কেন?’
কথাটি বলে ইমাদ তাকে টেনে দাঁড় করায়। পুষ্পিতা ওর বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।
ইমাদ ওর মাথায় হাত রেখে বললো,
– ‘শান্ত হও পুষ্পিতা। আমি আসলেই এগুলো জানতাম না। তোমার মতো আমিও ভাবতাম ওই ছেলেটা প্র*তারক। এমন সময় সবকিছু সামনে এলো। ততদিনে আমাদের অনাগত সন্তান তোমার পেটে৷ আমাদের সঙ্গে এখন আরেকটা নিষ্পাপ প্রাণ জড়িয়ে আছে। আমি এখন কি করবো বলো? তবুও তুমি যা চাইবে আমি তাই করবো।’
পুষ্পিতার কান্নার তোড় আরও বেড়ে যায়। ইমাদ তাকে নিয়ে গেল খাবার টেবিলে,
– ‘তোমার এখন ঠিকঠাক মতো খাওয়া-দাওয়ার প্রয়োজন পুষ্পিতা।’
– ‘না আমি খাব না।’
– ‘কেন? বসো তো খাবে।’
ইমাদ গিয়ে সাবিনা বেগমকে ডাকলো। তিনি টেবিলে খাবার দিলেন। পুষ্পিতা প্লেট ধাক্কা দিয়ে ফেললো ফ্লোরে। কাঁদতে কাঁদতে আবার রুমে চলে গেল। সাবিনা বেগম ওর পিছু পিছু গেলেন। ওর পিঠে হাত রেখে বললেন,
– ‘মা’রে পাগলামি করিস না। যা হওয়ার হয়ে গেছে। বিয়ে করেছিস। সন্তান পেটে। এখন অতীত ভুলে যা। আর ওই ছেলের পুরো জীবন পরে আছে৷ সে কেন বিবাহিত মেয়ে, সন্তান সহ মা’কে বিয়ে করবে? ওই সংসারও তোর জন্য সহজ হবে না। তোর সন্তানের জন্যও ভালো হবে না। তাই মাথা ঠাণ্ডা কর।’
পুষ্পিতা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
– ‘কিন্তু মা, আমি ওকে কি বলবো৷ তাকে আমি কিভাবে বুঝাবো। ওর কষ্টও তো আমার সহ্য হয় না।’
– ‘তুই শক্ত হ মা, শক্ত হয়ে ছেলেটাকে না করে দে। তাহলে দেখবি সব ঠিক। ও তোর কাছে যখন কোনো আশা পাবে না তখন ভুলতেও পারবে।’
মহসিন সাহেব নিচে ছিলেন। এসে ঢুকলেন পুষ্পিতার রুমে। কথাগুলো শুনে তিনিও বললেন,
– ‘এটাই কর মা৷ না করে দে। তুই কি এতদিন অসুখে ছিলিরে মা? এখানে আমরা আছি। ইমাদ কত ভালো ছেলে। তোর সন্তান পেটে। সবকিছু ভেবে দেখ।’
পুষ্পিতা উঠে বসে। চোখ মুছে নেয়।
– ‘আমি এখন কি করবো বাবা। ওর সঙ্গে আমি কথা বলতে পারছিই না৷ কি বলবো তাকে ভেবে পাই না।’
– ‘এক কাজ কর মা, তুই ছেলেটাকে মেসেজ দিয়ে বল ওর মায়ের নাম্বার দিতে। আমরা আগে ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলি। মাও বুঝিয়ে বললে বুঝবে।’
পুষ্পিতা সত্যি সত্যি মেসেজ পাঠায়,
– ‘আন্টির নাম্বারটা দাও।’
ফিরতি মেসেজ আসে, ‘কেন?’
– ‘দরকার আছে দাও তুমি।’
ইলহাম তাকে নাম্বার দেয়। মহসিন সাহেব সেই নাম্বারে কল দেন। দুইবার রিং হতেই রিসিভ করেন আম্বিয়া বেগম।
– ‘হ্যালো কে বলছেন?’
– ‘আমি পুষ্পিতার বাবা।’
– ‘ও হ্যাঁ, আসসালামু আলাইকুম।’
– ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।’
– ‘আপনার সাথে বোন কিছু কথা আছে। ইলহাম এখানে এসে বিচার বসিয়েছে। আমি এলাকায় মুখ দেখাতে পারছি না। আপনি একটু দয়া করে আপনার ছেলেটাকে চলে যেতে বলুন।’
– ‘আপনি মুখ দেখাতে পারছেন না। আমিও ছেলের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। আপনার মেয়ে আমার ছেলের জীবন নষ্ট করেছে।’
– ‘এসব কথা থাক, আপনিই বলুন এসব পাগলামির এখন কি কোনো মানে হয়? আমার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ওর গর্ভে সন্তান আছে। এই সময় আপনার ছেলে চায় আমার মেয়ে ডিভোর্স দিয়ে বিয়ে বসুক তার কাছে এটা কিভাবে সম্ভব। আপনিও তো ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন কি ভেবে বুঝলাম না।’
– ‘আমি পাঠিয়ে দিয়েছি মানে? আমার তো ঠেকা পড়েনি যে একটা পেট বাঁধানো বিবাহিত মেয়েকে ছেলের বউ করে আনতে। আমি তো বিপদে আছি ছেলেকে নিয়ে। ও কোনোভাবে ভুলতে পারছে না তাই। আপনার মেয়ে যা বলার নাটকবাজি বন্ধ করে ওকে বলুক।’
– ‘সে আর কি স্পষ্ট করে বলবে। সন্তান পেটে নিয়ে কি বিয়ে বসবে আরেকটা?’
– ‘সেটা ছেলেকে বলুক। যা বলার একটা ক্লিয়ার করে বলুক। এভাবে আমার ছেলের জীবন নষ্ট হচ্ছে৷’
– ‘আচ্ছা আমি বলছি ওকে ক্লিয়ার করে বলতে। আপনিও ছেলেকে বুঝান।’
কল রেখে দিলেন মহসিন সাহেব। বসলেন গিয়ে পুষ্পিতার পাশে,
– ‘উনি এখনই সন্তান পেটে শুনে খোঁচা মে*রে কথা বলছেন। উনার কথা হলো তুই যা বলিস, স্পষ্ট করে ইলহামকে জানিয়ে দে।’
পুষ্পিতার অনবরত চোখের জল পড়ছে। নিজেকে বুঝিয়ে নিয়েছে সে। ইলহামকে ফিরিয়ে দেয়া ছাড়া আর ভালো কোনো পথ খোলা নেই। মা-বাবাকে বললো রুম থেকে বের হয়ে যেতে। তারপর মন শক্ত করে ইলহামকে কল দিল সে, একবার রিং হতেই ইলহাম রিসিভ করলো,
– ‘পুষ্পিতা বলো।’
– ‘ইলহাম আমি অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷’
– ‘হ্যাঁ বলো তোমার সিদ্ধান্ত।’
– ‘তুমি প্লিজ পাগলামো করবে না। যা বলি শুনো। আমাদের মিলন ভাগ্যে ছিল না৷ যেভাবে হোক আমাদের বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। আমি আগে শুধু তোমার প্রেমিকা ছিলাম। ভালোবেসে পালিয়েও গিয়েছিলাম। তারপর আমাদের জীবনে একটা দূ*র্ঘটনা ঘটে গেছে। এরপর আমি একজনের স্ত্রী এবং অনাগত সন্তানের মা হয়ে গেছি।’ এটুকু বলে পুষ্পিতা বাঁ হাতে চোখের জল মুছে আবার বললো, ‘চাইলেই আমি এখন আর তোমার কাছে যেতে পারবো না। আমার হাত-পা খোলা থাকলেও, বন্ধনের অদৃশ্য সুতোয় আমি বাঁধা।’
– ‘তুমি কি বলতে চাচ্ছ? পাগল হয়ে গেছো না-কি তুমি? ওই অমানুষের বাচ্চার সংসার করবে কেন? ওর বাবার কারণেই তো আজ এই অবস্থা হয়েছে।’
– ‘ইলহাম প্লিজ শান্ত হও। ওর কোনো দোষ নেই।’
– ‘তাহলে কি আমার সব দোষ?’
– ‘দোষ সব ওর বাবার। ইলহাম কিছুই জানতো না।’
– ‘এখন তুমি কি চাও?’
– ‘তুমি চলে যাও এখান থেকে। নিজের মতো জীবন শুরু করো। তুমি অবশ্যই আমার থেকে অনেক ভালো, সুন্দর মেয়ে পাবে ইলহাম। কেন তুমি একটা বিবাহিত বাচ্চার মা’কে বিয়ে করতে যাবে।’
– ‘আমার চিন্তা তুমি করতে হবে না। তোমার ফাইনাল ডিসিশন তাহলে এটাই?’
– ‘হ্যাঁ এটাই।’
– ‘তুমি পারবে আমাকে ছেড়ে থাকতে?’
– ‘পারতে তো হবে। আমি এখন যেদিকেই যাই একই কষ্টে ভুগবো। সংসার করতে গিয়ে মায়া কিংবা ভালোবাসা। যেকোনো একটায় তো আমি ইমাদের সঙ্গে জড়িয়েছি। তাকে ফেলে যেতেও আমার কষ্ট হবে৷’
– ‘বাহ, তুমি ওই শু*য়োরের বাচ্চারও প্রেমে পড়ে গেছো দেখছি। এতো গভীর প্রেম যে ওদের সকল চ*ক্রান্ত ফাঁ*স হওয়ার পরও তাকে ছাড়তে পারছো না।’
– ‘ইলহাম রাখছি আমি, আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া শেষ।’
পুষ্পিতা কথাটি বলেই কল কেটে দিল। ইলহাম সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক কল দিতে থাকে। পুষ্পিতা মোবাইল সাইলেন্ট করে বালিশের পাশে রেখে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়ে। হাউমাউ করে কাঁদছে সে।
ইলহাম এখন হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিচ্ছে৷ পুষ্পিতা সিন করলো,
– ‘আমি সকাল পর্যন্ত তোমার ফাইনাল সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করবো। আমি জানি তুমি অবশ্যই সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করবে। আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল না পুষ্পিতা। এখনও দুজনের চ্যাট আমি পড়ি। তুমি এভাবে বদলে যেতে পারো না।’
পুষ্পিতা রিপ্লাই দেয় না। বালিশে মুখ গুঁজে থাকে৷ দরজায় এসে নক করছেন সাবিনা বেগম। পুষ্পিতা খুলে দিল না দরজা। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেল সে। ভোরে স্বাভাবিকভাবেই হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে সাতটা বেজে গেছে। ডাটা অন করাই ছিল। হোয়াটসঅ্যাপে ইলহামের অসংখ্য মেসেজ। পুষ্পিতা ঘুম আসছে না আমার। কি করবো আমি আমি? রাত জেগে জেগে আমাদের পুরাতন মেসেজগুলো পড়ছি। কি থেকে কি হয়ে গেল পুষ্পিতা। তোমার ছবিগুলো এখনও আমার কাছে আছে। রোজই দেখি। তুমি দেখো না কখনও?
একেবারে নিচে একটা ভিডিয়ো। পুষ্পিতা কাঁপা কাঁপা হাতে ভিউ করে। ওর পুরাতন অনেক মেসেজের স্ক্রিনশট। দুজনের ছবি। একটা স্ক্রিনশটে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ‘ইলহাম তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না আমি।’ ছবির সঙ্গে ভিডিয়োতে রবীন্দ্র সংগীত বাজছে,
“তবু মনে রেখো
যদি দূরে যাই চলে
তবু মনে রেখো
যদি পুরাতন প্রেম
ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে…… তবুও মনে রেখো…।
একটা লাইন পুষ্পিতার বুকে যেন তীরের ফ*লার মতো বিঁধে গেল, “যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে”
পুষ্পিতা দুইহাতে মুখ ঢেকে আবার হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
সকাল দশটা। আকাশে ঝকঝকে রোদ। হায়দার সাহেব বাজারের যাওয়ার জন্য বের হয়েছেন। যৌবনে তিনি মহসিন খানের শালীকে পছন্দ করতেন। তাদের মধ্যে একসময় প্রণয়ও হয়েছিল। কিন্তু অসহায় শালী থাকতো দুলাভাইয়ের বাসায়। তার মতামতের কোনো গুরুত্বই ছিল না। মহসিন সাহেব নিজের ব্যবসায়ীক বন্ধুর কাছে তাকে একরকম জোর করেই বিয়ে দিয়ে দেন। সেটার জন্য ক্ষু*ব্ধ হয়ে হায়দার সাহেব গ্রামে চলে আসেন। কিন্তু অভাবের তাড়নায় আবারও মহসিন সাহেবের অফিসে চাকুরিতে জয়েন করতে হয়। হায়দার সাহেব তপ্ত রোদে হাঁটতে হাঁটতে বাজারের গলিতে এসে ঢুকেছেন।
ইলহাম ভোর ন’টা অবধি পুষ্পিতার অপেক্ষা করেছে। কোনো সাড়া পেল না ওর। পুরোরাত ভীষণ কেঁদেছে। ভোরে আম্বিয়া বেগম কল দিয়ে বুঝিয়েছেন। বাড়ি ফিরে যেতে বলেছেন। তাসনিমও বললো অন্যের বাড়িতে আর থাকা ঠিক হচ্ছে না। এখন রীতিমতো লজ্জা লাগছে। চল বাড়ি ফিরে যাই৷ মেয়েটি তোকে চায় না আর। তাহলে কি আর করবি তুই? কি আর করার আছে? ইলহাম কিছুই বলে না। তবে বাড়ি ফিরতে রাজি হয়। এখন তিনজন বাজারের ব্রিজে চলে এসেছে। হঠাৎ ইলহাম দেখতে পায় হায়দার সাহেবকে। দেখে চিনে ফেললো সে। মাথায় র*ক্ত উঠে গেল। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই ওদের সঙ্গে সিএনজি অবধি গেল সে। এখানে পাঁচজন প্যাসেঞ্জার না হলে ছাড়বে না সে জানে৷ তিনজন পেছনের সিটে বসলো। ওরা বসে মোবাইল টিপছে।
হঠাৎ ইলহাম বললো,
– ‘আমি পেশাব করে আসছি। তোরা বস।’
কথাটা বলেই সে নেমে গেল। একটা বন্ধ দোকানের সামনে ডাবের ভ্যান। ডাবওয়ালা কোথাও গেছে। সে দ্রুত পায়ে গিয়ে ভ্যান থেকে দা হাতে নিল। হায়দার সাহেব ততক্ষণে কয়েকটা কু*কুরকে তাড়া করে বাজারের বাইরে চলে এসেছেন। এদিকটায় কোনো লোকজন নেই। ইলহাম কাছাকাছি গিয়েই দা’র উল্টো দিক দিয়ে প্রচণ্ড জোরে মাথায় কয়েকটা আঘাত করলো। ফিনকি দিয়ে বের হলো র*ক্ত। হায়দার সাহেব আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। তারপর বৃষ্টির মতো শরীরের যেখানে-সেখানে অবিরাম কোপ পড়তে থাকলো। হায়দার সাহেবের চিৎকার শুনে মানুষ দৌড়ে এসে ভয়াবহ দৃশ্য দেখে থমকে গেল। সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে র*ক্ত। ইলহামের মুখও চেনা যাচ্ছে না র*ক্তে। এলাকার লোকজন চারদিক থেকে ঘেরাও করে নিল তাকে। হায়দার সাহেব হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পর জানা গেল লোকটা মারা গেছে। পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেল ইলহামকে।
_____সমাপ্ত_____
লেখা: জবরুল ইসলাম