তবু_ফিরে_আসা,পর্ব : (০৩)

0
541

#তবু_ফিরে_আসা,পর্ব : (০৩)
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু

(৯)
রিসোর্টের পিছনদিকে টু সিটের সোফায় বসে টিস্যু দিয়ে বার বার চোখের পানি মুছছে মেঘ। নীলাশা তাকে তখন থেকেই শান্ত করার চেষ্টা করছে। ইনিয়েবিনিয়ে কতকিছু বলে বুঝাচ্ছে তবুও মেঘ শান্ত হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর পর প্রবলবেগে কান্নারা বেরিয়ে আসছে। নীলাশা গভীর দম নিয়ে মেঘের মাথায় হাত রেখে বলল,

“এত ভাবছিস কেন? চাকরিটা তো ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিস। তাহলে এই এত কেঁদে নিজেকে ছোটো করাটা কি খুব ভালো হচ্ছে?”

চোখে আবারও টিস্যু চেপে ধরলো মেঘ। নাক টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। নীলাশাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ব্যস, আজকের রাতটা। কাল সকালেই রেজিগনেশন লেটারটা জমা দিব স্যারের কাছে। এরপর আর এখানে আসতে হবে না। বিশ্বাস কর, আমি প্রতিবার শ্রাবণকে যথেষ্ট ইগনোর করি। এবারও করলাম। ওই জয়ের বাচ্চারে ফোন দিতে গিয়েই…!”

মেঘ এবার হেসে ফেললো। মাঝেমধ্যে কাঁদতে কাঁদতে হাসির কিছু কথা মাথায় আসলেই আনমনে হেসে উঠে মেঘ। এখন এই কান্নার মাঝখানে হাসিটাই হঠাৎ করে মনের কষ্ট কিছুটা কমিয়ে দিল। দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে বলল,
“জয় কোথায় বলতো? এতবার কল করলাম, রিসিভই করলো না।”
“জয় তো এয়ারপোর্টে। একজন গেস্ট আসবেন। ওনাকেই রিসিভ করতে গেছে। হয়তো ফোন সাইলেন্ট করা তাই ধরতে পারেনি।”
“ওহ। আচ্ছা তুই রিসেপশনে গিয়ে বস। শ্রাবণ রুমে গেলে আমাকে ফোন দিস, আমি তখন বাকি কাজ সামলে নিব। খবরদার ও ভেতরে যাওয়ার আগে ভুল করেও ফোন করবি না, বা আমাকে আসতে বলবি না। আমি ওইপাশটায় আছি।”

শ্রাবণ রিসোর্টের ভেতরে এসে আশপাশে একবার চোখ ঘুরিয়ে নিল। অজান্তেই আঙুল দিয়ে বার বার বাহু স্পর্শ করে কীসব বিড়বিড় করছে। নীলাশাকে দেখেই সেদিকে তাকিয়ে আবারও মনোযোগ দিল আশপাশ। কোনো নতুন মানুষের আগমন টের না পেলেও অবাধ্য মন তার সেটা মানতে পুরোপুরি নারাজ। সন্দেহ এড়াতে নীলাশাকে জিজ্ঞেস করলো,

“আজ কেউ এসেছে রিসোর্টে?”
“আসেনি, তবে একজন আসবেন। জয় তাকেই আনতে গেছে। একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। কেন? কিছু কি হয়েছে? আপনি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন যে?”
“বাচ্চাদের সাথে কানামাছি খেলায় মগ্ন ছিলাম। হুট করে কারও সাথে ধাক্কা লাগলো। জিজ্ঞেস করলাম কে? উত্তর পেলাম না। চোখ খুলে আবার কাউকেই দেখলাম না। বিষয়টা খুব জটিল না?”
“জটিল কেন? এমনতো হতে পারে, কোনো বাচ্চার সাথে ধাক্কা লেগেছে, সে চড়থাপ্পড় খাওয়ার ভয়ে পালিয়েছে।”
“হুম…হতে পারে এটা।”

আপনমনেই বিড়বিড় করে রুমের দিকে পা বাড়ালো শ্রাবণ। মনের ভেতর প্রশ্ন। কার সাথে ধাক্কা খেল আজ? ভাঙলোটাই বা কী? এমন কেন অনুভূতি হচ্ছে মনে! বার বার মনে হচ্ছে, এই স্পর্শটার সাথে কোনোভাবে তার পরিচয় আছে! সত্যিই কি আছে? নাকি সব তার ভ্রান্তির ছলনা!

(১০)
বিকেলবেলার রক্তিম আভার ভেতর সূর্যের ডুব দেয়ার দৃশ্যটা চমৎকার উপভোগ করছেন রেদোয়ান হাসান। হাতে চায়ের কাপ। একবার তাতে চুমুক দেন, তো পরক্ষণেই ভাবনার অতল গহ্বরে প্রবেশ করেন। দু’দিন ধরে মেঘের সঙ্গে আলাপ হয়নি। কী করছে মেয়েটা কে জানে! জীবনের সবচেয়ে জটিল আর কঠিনতম সিদ্ধান্তের কারণেই সন্তান আজ বাবা-মায়ের স্নেহ-মায়া-মমতাকে উপেক্ষা করে দূরে পড়ে আছে। সামান্য ভালোবাসার মানুষের উপর তিক্ততা থেকে এতবড়ো একটা সিদ্ধান্ত নেয়া মোটেও ঠিক হয়নি মেঘের। অন্তত এসব নিয়ে বাবা-মায়ের সাথে একবার আলোচনা করতেই পারতো মেয়েটা।

কোনো বাবা-মা তার সন্তানের খারাপ চেয়ে কিছুই করবেন না। মেঘ কি পারতো না, একবার এই দুটো মানুষকে ভরসা করে দেখতে? অবশ্য এখানে তারই-বা কী করণীয়! এতবড়ো ধাক্কা সামলাতে কম মনোবলের প্রয়োজন হয় না! জীবনের কঠিন থেকে আরও কঠিনতম বিপদ-আপদ সামলাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ মনের জোরই পারে একটা মানুষকে শেষ সীমান্তে পৌঁছে দিতে। তাকে জয় ছিনিয়ে আনার অদম্য সাহস জোগাতে। সেদিনের সেই সিদ্ধান্তটাই মেঘের জন্য পারফেক্ট ছিল। যেখানে আছে, ভালো তো আছে। ওর ভালো থাকাতেই ওনাদের স্বস্তি।

ভাবনার জাল ছিঁড়লো মেঘের আকস্মিক ফোন কলে। এ সময়ে মেয়েটা কাজে ব্যস্ত থাকে তাই প্রতিদিন সকালে আর রাতেই নির্দিষ্ট একটা সময়ে বাবা-মায়ের সাথে চুটিয়ে আলাপ হয়। হয়তো গত দু’দিন ব্যস্ততায় ফোন করতে পারেনি দেখেই আজ শিফটের টাইমে অফিসের ফোন থেকেই কল করছে। এসব ভাবতে ভাবতেই রিসিভ করে মৃদু হেসে সালামের জবাব দিলেন তিনি। মেঘ তখন চট করে বলল,

“সরি বাবা। দু’দিন খুব আপসেট ছিলাম তাই ফোন করতে পারিনি। খুব রেগে আছো না? ফোন ভেঙে গেছে তো তাই এই নাম্বার থেকে কল দিলাম। মা কেমন আছে?”
“রাগ তো একটু থাকতেই পারে। মেয়ে দেশে আছে অথচ বাবা-মায়ের থেকে দূরে। মনে হচ্ছে, তোর বিয়ে দিয়ে তোকে পর করে দিয়েছি!”

মেঘ থেমে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“রাগ করো না বাবা। আমি খুব জলদি তোমাদের কাছে আসছি। ভুলগুলো ক্ষমা করে কাছে টেনে নিও। আর এমন ভুল কোনোদিন হবে না। প্রমিস বাবা।”
“তুই যেভাবে ভালো থাকিস, যেভাবে সুখে থাকিস, তোর সেই সিদ্ধান্ততে আমরা কোনোদিন কিছু বলিনি। আজও বলবো না। শুধু বলবো, একবার ফিরে আয়। মানুষের সাথে অতীতে কত কী ঘটে! তাই বলে সবাই কি আপনজন ছেড়ে দূরে গিয়ে ভালো থাকে? আমি জানি মা, তুই ওখানে ভালো নেই। তোর মায়ের কষ্ট যে আর সহ্য করা যায় না। ভেঙে পড়েছে বেচারি। আর কত দূরে সরে থাকবি মেঘ?”

একটানা কথা বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠলেন রেদোয়ান হাসান। মেয়ের কাছে নিজের দুর্বলতাকে আর আটকে রাখতে পারলেন না। ডানহাতে চশমা খুলে পাঞ্জাবির কোণা দিয়ে চোখের পানি মুছে বললেন,
“ফিরে আয় মা। তোর মায়ের কোলে ফিরে আয়। কথা দিচ্ছি, তুই যখন যা চাইবি, যেভাবে চাইবি সেটাই তোর সামনে এনে দিব। তবুও আর দূরে থাকিস না। সন্তান বেঁচে থাকা সত্ত্বেও এমন দূরত্বটা সহ্য করা যায় নারে মা।”
“আমার লক্ষ্মী বাবা, এভাবে আমাকে ভাঙতে দিও না। আমি ফিরবো শীঘ্রই বললাম তো। খালামনিকে সঙ্গে নিয়েই তোমাদের কোলে ফিরবো। এখন রাখলাম। মা’কে সামলে নিও তুমি। আল্লাহ হাফেজ!”

ফোন টেনে ঘাড় ফিরিয়ে চমকে উঠলেন রেদোয়ান হাসান। কখন যে মেঘের মা ওনার পাশে এসে কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়েছেন টেরই পাননি তিনি। সঙ্গিনীর দিকে তাকিয়ে বোবা কান্নায় ঠোঁট চেপে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলেন আবারও।

(১১)
রাত দশটার দিকে নীলাশাকে বলে শ্রাবণকে ডেকে আনতে পাঠিয়ে নিজে চট করে আড়াল হয়ে গেল। সন্ধ্যের দিকে আসা সেই গেস্টের জন্য রাতের খাবারটা নিজেই নিয়ে গেল মেঘ। জয় তখন রিশেপশনে বসে কম্পিউটারে কীসব চেক করছে।

শ্রাবণ রুম থেকে বাইরে এসে দেখলো ওয়েটিং রুমে টেবিলে একটা ছোটো কেক রাখা। কেকের ওপর নিজের নাম দেখে আরও অবাক হলো সে। নীলাশার দিকে তাকিয়ে দেখলো সে মুচকি হাসছে। শ্রাবণকে টেনে টেবিলের কাছে নিয়ে হাতে ছুরি ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“জলদি কেক কাটুন। আজকের তারিখ শেষ হতে বেশি বাকি নেই।”
“তোমরা কীভাবে জানলে?”
“ভুলে যাবেন না, আপনার সব তথ্যই সংগ্রহ করা আছে। জন্মদিন জানা খুব বেশি কঠিন কাজ নাকি?”
“এসবের কোনো দরকার ছিল না। শুধু শুধু কষ্ট।”
“আপনি আমাদের স্পেশাল গেস্ট। আর আপনার জন্য এইটুকু করবো না। সেটা হয়?”

রিশেপশন থেকে জয় দ্রুত তাদের সাথে জয়েন হলো। কুল ড্রিংকস এনে তিনটে গ্লাসে ঢেলে আরও অন্যান্য খাবারের আয়োজন করলো দ্রুত। শ্রাবণের কাছে গিয়ে বলল,
“ইউ গেট রেডি, থ্রি, টু, ওয়ান…লেটস স্টার্ট!”

কেকের ওপর ছুরি বসালো শ্রাবণ। কেকটা দেখতে ভীষণ সুন্দর। কর্ণারে হাসির একটা ইমোজি। সেই ইমোজিটার দিকে তাকিয়ে শ্রাবণ নিজেও হেসে ফেললো তৎক্ষনাৎ। দু’জনের উইশ শুনতে শুনতে কেক কেটে দু’জনকে যত্ন করে খাইয়ে দিল শ্রাবণ। তারপর বলল,
“ধন্যবাদ দু’জনকে। অচেনা একটা মানুষকে এতটা গুরুত্ব দেয়ার জন্য।”
“ওইযে বললাম, আপনি আমাদের স্পেশাল গেস্ট। এখানে যারা আসে সবাইকেই আমরা সাধ্যমতো যত্ন করি তবে কিছু কিছু মানুষ আলাদা, যাদেরকে একান্তই আপন মনে হয়, তাদের জন্য এই স্পেশাল আয়োজনের ব্যবস্থা আমরা রাখি।”

জয় হেসেই জবাব দিল। শ্রাবণ তখন বলল,
“তাহলে গতবছর এই স্পেশাল আয়োজন হয়নি কেন? সেবারও তো এখানেই ছিলাম।”
“সেবার আমাদের প্রস্তুতি ছিল না এজন্যই। এই কয়েকমাস ধরে এভাবে চলছে।”
“একটা অদ্ভুত ব্যাপার জানো, গত বছর যে নাম্বার থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা এলো, এবারও সেইম। কিন্তু মানুষটা কে তাকে তো চিনতে পারলাম না। আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার, গতকাল রিশেপশনের ইন্টারকমে যে কণ্ঠস্বর শোনলাম, সেই একই কণ্ঠস্বর ওই অচেনা নাম্বারের মেয়েটার! তোমরা নিশ্চয়ই জানো মেয়েটা কে? হুট করে অচেনা কেউ তো এসে ইন্টারকমটা কানে তুলবে না!”
“কী বলছেন? এটা কখন ঘটলো!”

জয় না জানার ভান ধরেই নীলাশার দিকে তাকালো। দু’জনেই চিন্তিত মুখে একে-অপরকে ভ্রু নাড়িয়ে দেখালো। জয় ঠোঁট চেপে বলল,
“হয়তো আমাদেরই কেউ। ছেড়ে দেন। এসব মনে রেখে কাজ কী?”
“আমার কী কাজ সেটা তো তোমাদের বুঝানো কঠিন জয়।”

বিড়বিড় করলো শ্রাবণ। জয় পুরোটা না শোনলেও ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটিয়ে মনে মনে বলল,
“আরও খুঁজেন ভাই, খুঁজতে খুঁজতে ছুটির ঘণ্টা বাজবে তবুও মেঘ আপনাকে ধরা দিবে না। শুধুমাত্র আপনার জন্য মেয়েটা এত্ত কষ্ট পাচ্ছে। দেখা যাক, আপনার মনের জোর কতটা! আমরা তো আছিই গেইম পালটে দেয়ার জন্য।”

এইবলে জয় দ্রুত পাশ কেটে রিশেপশনে গিয়ে বসলো। মেঘ দু’তলা থেকে নিচে আসার যে করিডোর তার ঠিক কর্ণারে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। চোখের জলে গাল ভেসে যাচ্ছে তার। এই প্রথম শ্রাবণের জন্য নিজ হাতে কিছু বানিয়েছিল সে, অথচ মুখে তুলে খাইয়ে দেয়ার সৌভাগ্যটা তার হলো না। কীভাবে দেখাবে এই মুখ! এখনও তার মাঝে রাত্রির মিথ্যে ছায়া লুকিয়ে আছে। সব ভুলে শ্রাবণের মুখোমুখি হওয়ার সাহস যে তার নেই। যতবারই মনকে বুঝাতে চায় ততবারই শ্রাবণের দেয়া অবহেলাগুলো ভেসে উঠে সামনে। আনিকার প্রতি শ্রাবণের এত্ত ভালোবাসা টের পেলে নিজেকে সেই তুলনায় অতি নগন্য একটা মানুষ মনে হয় তার। যেসব শুধু একজীবনে একটা মানুষকে তিলে তিলে শেষ করার জন্য যথেষ্ট বিরহের ব্যথা অনুভব করায়।

চলবে…

(ভুল ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইলো।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here