#তবু_ফিরে_আসা,পর্ব : (৫)
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
(১৫)
প্রতি বছর বিদ্যালয়ে বিশেষ দিনগুলোতে কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালনের মধ্যে দিয়ে শিক্ষকগণ দেশের তরে উৎসর্গকৃত শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এছাড়াও ওই বিদ্যালয়ের যুবকদের মধ্যে একটা টান ছিল মঞ্চনাটকের প্রতি। প্রতি বছর নিয়ম করে দুটো মঞ্চনাটক অনুষ্ঠিত হতো বিদ্যালয় সংলগ্ন বিশাল ওই খেলার মাঠে। সেবারও এর ব্যতিক্রম হলো না। ২৬ ই মার্চকে কেন্দ্র করে অপারেশন সার্চলাইটের ঘটনাটা নিয়ে সে-বছরই মঞ্চ নাটকের আয়োজন করে বিদ্যালয়ের প্রাক্তন বড়ো ভাইয়েরা। যেখানে যোগ দেয়, দশম শ্রেণীর পাঁচ থেকে ছয়জন ছাত্র। তারমধ্যে রেহান আর আবিরও ছিল।
ওইদিন মেঘের উপর দায়িত্ব ছিল, সেই অপারেশন সার্চলাইটকে কেন্দ্র করে একটা থিম সাজানো। মেঘ আর রঙতুলি দিয়ে সারাদিনের পরিশ্রমে অনেক চেষ্টায় সে রাতের ভয়ানক কিছু দৃশ্য ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়। সারাদিন চলে মঞ্চ নাটকের রিয়ারসেল। টানা এক সপ্তাহর রিয়ারসেল শেষে ২৬ ই মার্চ রাত আটটায় নাটকটি উপস্থাপন হওয়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি। সেদিন বিকেলেই ঘটে যায় নির্মম এক ঘটনা। যেই ঘটনার সূত্র ধরেই মেঘের জীবন অতিষ্ঠ হওয়ার দিকে ধাবিত হতে শুরু করে।
বিদ্যালয়ের বিশাল মাঠের একপাশে ছিল বড়ো সাইজের দু-তিনটে কড়ই গাছ। যার একটা নিচে রংতুলি রেখে মেঘ প্রতিদিন একটা করে ক্যানভাস আঁকিবুঁকি করতো অথবা কোনো কোনোদিন অযথাই রংতুলি নিয়ে বসে থাকতো। সেদিনও অপারেশন সার্চলাইট কেন্দ্র করে যে আর্ট মেঘ করছিল সেটাও সেই গাছের গুড়িতে দাঁড়িয়েই। বিদ্যালয়ের ভেতরে মঞ্চনাটকের রিয়ারসেলের জন্য আলাদা একটা রুম আছে। সবাই সেখানেই যার যার চরিত্রকে সাজিয়ে নিচ্ছে। মেঘ শুধু একাই কড়ই গাছের নিচে ছিল।
আঁকা শেষে মেঘ সবকিছু গুছিয়ে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়েই থমকে যায়। আবির আর রেহান গাছের থেকে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে তর্কাতর্কি করছে। তাদের তর্কের মূল উৎস মেঘ নিজেই। রেহানের বুকের বা’পাশে সামান্য একটা ধাক্কা দিয়ে আবির প্রায় চেঁচিয়েই বলল,
“শালা একদম মিথ্যে বলবি না। বল, কতদিন ধরে মেঘের সঙ্গে তোর প্রেম চলছে। আমার বাপের কি টাকার অভাব আছে যে, মেঘ আমাকে রেখে তোর মতো একটা নিচু জাতের ছেলের প্রেমে পড়লো?”
“বিশ্বাস কর আবির, ওর সঙ্গে আমার প্রেমের সম্পর্ক নেই। আমরা দু’জন ভালো বন্ধু। আর মেঘ আমাকে বড়ো ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করে। অযথা একটা সুন্দর সম্পর্কে এভাবে নোংরা দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করিস না। তোর দোহাই লাগে!”
“জানিস না, সাহিত্যিকগণ কী বলে গেছেন? ছেলে আর মেয়ে কখনও ভালো বন্ধু হতে পারে না। তাদের মধ্যে প্রেম হতে বাধ্য। হয়তো দু’জনেই প্রেমে পড়বে নয়তো দু’জনের একজন প্রেমে পড়বেই। এখনও সময় আছে মেঘের পিছু ছেড়ে দে। নইলে…!”
ঠিক সেই মুহূর্তে মেঘ দ্রুত এসে ওদের দু’জনের মাঝখানে দাঁড়ালো। হাতের ক্যানভাস ঘাসের উপর রেখে টেনেটুনে আবিরকে কোনোরকমে রেহানের থেকে দূরে নিয়ে বলল,
“ভুল ভাবছো আবির ভাই। আমরা দু’জন ভালো বন্ধু। আমাদের মধ্যে এরচেয়ে গভীর কোনো সম্পর্ক নেই। আমি রেহান ভাইকে যেরকম সম্মান করি সেরকম সম্মান তোমাকেও করি। দয়া করে এই সম্মানটা নষ্ট করো না তুমি। প্লিজ আমার জন্য তোমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করে দিও না।”
“কিন্তু মেঘ, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর এটাই সত্যি যে, আমি রেহানের সঙ্গে তোমাকে একদম সহ্য করতে পারি না। তুমিও আর ওর সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ রাখবে না।”
“ঠিক আছে। এতে যদি তোমাদের বন্ধুত্ব টিকে থাকে তবে তাই হোক। আমি আর রেহান ভাই কেউ কোনোদিন কারও সঙ্গে কোনোপ্রকার যোগাযোগ রাখবো না। তবে হ্যাঁ, তুমিও দ্বিতীয়বার আর ভালোবাসার দোহাই দিয়ে আমার পিছু ঘুরবে না। যদি মানো তাহলে এখন অন্তত দু’জনে একটু জড়াজড়ি করে আমাকে বিদায় দাও।”
সামান্য হেসে রেহানের দিকে তাকিয়ে বললো মেঘ। রেহানও বিনিময়ে সামান্য হাসলো যদিও, তবু যেন কোথাও না কোথাও মেঘের জন্য সুপ্ত একটা অনুভূতির জন্ম হলো মনে। দ্রুত সেটাকে মনের মধ্যে চেপে আবিরকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“চল, নাটকের বাকি কাজ সেরে নিতে হবে না? বিকেল পাঁচটায় শেষবার রিয়ারসেল হবে।”
“ওকে, চল তাহলে।”
“আসছি মেঘ। ভালো থেকো।”
রেহান ফেরার পথে একবার পিছু তাকালো। আবির সেটা লক্ষ্য করেও চুপ করে সামনের দিকে হাঁটা দিল। নিজের ব্যাগ আর রংতুলিসহ ক্যানভাস নিয়ে অফিসে গিয়ে দ্রুত সেটা জমা রেখে সন্ধ্যের আগে একবার আসবে জানিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয় মেঘ।
(১৬)
বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে মেঘ তার আরও দু’চারটে বান্ধবীকে নিয়ে বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে উপস্থিত হলো। সবাই তখনও যে যার চরিত্রটাকে বার বার প্রাকটিস করছে। ভুল হলে সেটা আবার শোধরেও নিচ্ছে। ঠিক ওই সময়ে মেঘকে ক্যাম্পাসে দেখে সবার অলক্ষ্যে তাকে বিদ্যালয়ের পিছনে নিয়ে গেল রেহান। মেঘ পুরোপুরি ভরকে গেছে রেহানের এই অহেতুক কাণ্ডে। হাত ছাড়িয়ে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে বলল,
“অদ্ভুত লোকতো তুমি, আবির ভাইকে কথা দিয়েছি তোমার সঙ্গে আর দেখাসাক্ষাৎ করবো না। এভাবে জোর করে এখানে আনার কী মানে? তোমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হবে আমার জন্য।”
“হোক নষ্ট, তার আগে একটা সত্যি কথা বলো।”
“আমাকে মিথ্যে বলতে দেখেছো কখনও?”
“না, এজন্যই জানতে চাইছি। মনের মধ্যে যা আছে পরিষ্কার করে বলবে আর স্পষ্ট বলবে।”
“কীসব আবোলতাবোল বকছো বলো তো! তোমার কথার আগামাথা যদি বুঝতে পারি। ধ্যাত্তেরি, সরো তো যাই।”
মেঘ যেতে চাইলে রেহান আবার দু’হাত মেলে তাকে আটকে নেয় ওখানে। মেঘ হাতের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাড়িয়ে বলল,
“ভূতে ধরেছে তোমাকে। সরো, যেতে দাও।”
এইবলে রেহানকে সামান্য ধাক্কা দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে যায় মেঘ। রেহান পিছন থেকেই স্পষ্ট করে বলল,
“বন্ধুকে দেয়া কথা রাখতে ভালোবাসাকে দূরে সরিয়ে দেব?”
থমকে দাঁড়ালো মেঘ। পিছন ঘুরে রেহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কী ফাজলামি করছো?”
“সত্য কথা তোমার কাছে ফাজলামিই লাগবে। কখনও অনুভূতি জন্মায়নি না? কীভাবে টের পাবে!”
“কয়েক ঘণ্টায় কী এমন হলো যে, আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা জন্মে গেল? রেহান ভাই, আমি তোমাকে যথেষ্ট সম্মান করি। আর এই সম্মান রক্ষা করার দায়িত্ব তোমার। কীভাবে করবে সেটা তুমি জানো। তবে এই কথা যেন আর দশজন না জানে। আবির ভাই জানলে খুব যে ভালো হবে না তা তো নিশ্চয়ই জানো। এসব অনুভূতি সেই মানুষটার জন্য তুলে রাখো, যে তোমাকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসবে।”
মেঘ আর না দাঁড়িয়ে সামনের দিকে হাঁটা দিল। পিছন থেকে রেহান একবার বলল,
“একবার তো বুঝার চেষ্টা করো তুমি। আমি সত্যিই ভালোবাসি তোমাকে।”
মেঘ পিছু ফিরলো না। রেহান ওর যাওয়ার পানেই তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পিছু হেঁটে প্রাকটিসে মনোযোগ দিল সে।
(১৭)
বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই শেষ বিকেলের গোধূলি লগ্নে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠলো মেঘ। হঠাৎ খেয়াল করলো আবির, রেহানের কাঁধে হাত রেখে কোথাও একটা নিয়ে যাচ্ছে। আর তো কিছু সময় পরেই নাটক শুরু হবে। এরা এখন যাচ্ছে কোথায়! কেন যেন অদৃশ্য একটা ভয়ের জন্ম নিল মেঘের মনে। বান্ধবীদের রেখে একাই হাঁটা দিল ওদের পিছনে। যদিও আবির খুব স্বাভাবিকভাবেই হেসে হেসে কথা বলছে রেহানের সাথে তবুও তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই রেহানের। সে একধ্যানে মনের রাজ্যে মেঘের বিচরণ অনুভব করছে। আবির সেটা লক্ষ্য করে বলল,
“খুব ভালোবাসিস মেঘকে?”
“মানে!”
“তোদের কথাবার্তা সবই শুনেছি রেহান। তুই তখন মিথ্যে বলেছিলি।”
হাঁটতে হাঁটতে দেয়াল ঘেঁষা গাছের আড়ালে চলে এলো দু’জন। রেহান চারিদিকে তাকিয়ে বলল,
“এখানে আবার কীসের জরুরী কথা? যা বলার ক্যাম্পাসেই বলতি।”
“বেঈমান! কীভাবে পারিস বন্ধুকে ধোঁকা দিতে? তুই কী ভাবিস, তোর এই অভিনয় আমি ধরতে পারবো না? খুব ভালোবাসা হয়ে গেছে না। আজই, এই মুহূর্তে তোর সব ভালোবাসা শেষ করে দিব।”
মেঘ কী করবে বুঝতে না পেরে ওদের কথা রেকর্ড করার চিন্তাভাবনা করলো। ভিডিও করে সেটা প্রিন্সিপালকে দিলেই দু’জনের ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিশ্চিত হয়ে যাবে। তখন আর দু’জনের এই ভালোবাসার কাহিনি শুনে রোজ রোজ বিরক্ত হতে হবে না তাকে। এইভেবেই মোবাইলের ভিডিও রেকর্ডারটা অন করে ইটের উপর এমনভাবে রাখে যেন দু’জনকে স্পষ্ট দেখা যায়। ওদের তর্কাতর্কি দেখে আড়ালেই দাঁড়িয়ে রইলো মেঘ। সাহস হলো না সামনে গিয়ে কিছু বলার। যা বলার সে তো আগেই বলেছিল। ঝামেলাটা তো রেহানই পাকালো। কেন যে তখন ওইভাবে প্রপোজ করলো কে জানে!
আবির দ্রুত প্যান্টের পিছন থেকে ছুরি বের করে রেহানের পেট লক্ষ্য করে বসিয়ে দিল কুপ। প্রবল আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে গেল বিদ্যালয়ের পুরো প্রাঙ্গণে। মেঘ চিৎকার দিয়ে মুখে হাত চেপে দ্রুত ছুটে গেল ওদের দু’জনের দিকে। আবির ভূত দেখার মতো চমকে উঠে ছুরি সেখানে ফেলে রেখেই পালিয়ে যায়। মেঘ দু’হাতে আঁকড়ে ধরে রেহানের মাথা। কোনোভাবেই তাকে তোলার মতো শক্তি মেঘের নেই। কাঁপা কণ্ঠে কয়েকবার রেহানকে সাহস দেয়ার চেষ্টা করলো মেঘ। দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি চলতে লাগলো তার। মেঘের সারা হাত তখন রেহানের শরীরের রক্তে মাখামাখি। শ্বাস টানতে টানতে মেঘের কোলেই ঢলে পড়লো রেহান। বাকরুদ্ধ হয়ে তার ওই রক্তমাখা শরীরের দিকে তাকিয়ে অশ্রু টলমল চোখে সেখানেই স্ট্যাচুর মতো বসে রইলো মেঘ।
(১৮)
একটানা অতীতের কাহিনি বলতে বলতে চোখে পানি জমা হয়ে গেল তার। হাতের উল্টোদিক দিয়ে চোখ মুছে শ্রাবণের দিকে তাকালো। শ্রাবণ অবাক হয়ে মেঘকেই দেখছে আর ওর কথা শুনছে। মেঘের অমন দৃষ্টি দেখে বলল,
“পুলিশকে জানাওনি কিছু?”
“ভিডিওতে সব রেকর্ড হয়ে যাওয়ার পরেও প্রিন্সিপাল সেবার কোনো এ্যাকশন নেননি। উলটে আমার হাতেই টান্সফার সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিলেন। বাবার সঙ্গে পরামর্শ করে মা আর আমি শেষে ঢাকায় আসি। এরপর ক্যান্টনমেন্টে এসে ওখানেই একটা স্কুলে আবারও পড়াশোনা শুরু করি।”
“রেহানের বাবা-মা কেউ চাননি খুনিকে ধরিয়ে দিতে?”
“চেয়েছেন কিন্তু আবিরের বাবা-চাচাদের জন্য পারেননি। কয়েকদিন জেল হলেও পরে ঠিকই বেরিয়ে যায় আবির। এরপর আমাকে অনেক খুঁজেছে তবুও পায়নি। ধীরে ধীরে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে সে। শুনেছিলাম ধর্ষণের অপরাধে তার কয়েকবছর জেল হয়। কিন্তু ওখান থেকে একবার পালিয়ে আসে। এরপর আবারও তার সাজা হয় কিন্তু পালিয়ে এসে শেষবার আমাকে কিডন্যাপ করে। কীভাবে যেন আমার নাম্বার পেয়ে গেছে সে! হয়তো স্কুল/কলেজ কোথা থেকে পেয়েছে। নয়তো ফেইসবুক। যে যাই হোক, এখন আর ওর ভয় নেই আমার।”
“আমার অপরাধটা কী ছিল মেঘ? এই এতগুলোর মাঝে আমি তো জড়িয়ে ছিলাম না। তবে কেন এই দুটো বছর আমাকে শাস্তি দিলে?”
“শাস্তি তো আমি তোমাকে দেইনি। নিজেকে শাস্তি দিয়েছি।”
“মানে! কী বুঝাতে চাও? তোমার চলে যাওয়ায় কি আমি কষ্ট পাইনি?”
“যখন আবিরকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম তখনই অদ্ভুতভাবে অচেনা একটা মানুষ আমার স্বপ্নে আসতে শুরু করলো। তার চোখ, মুখ, ঠোঁট সব আবছা। কখনও কোনোভাবে আমি তাকে পুরোপুরি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। একদিন ফুচকা খেতে গিয়ে শুকনো মরিচের ঝাঁঝে চোখ-মুখের খারাপ অবস্থা হয়, সেদিন আদনান ভাই একটা পানির বোতল বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, তার বন্ধু এটা পাঠিয়েছে। হাতের কাছে পানি ছিল না তাই সেই বোতল থেকেই পানি খেলাম। সেদিন তার সেই বন্ধুটাকে পেছন থেকে অল্পই দেখেছি। আরেকদিন হুট করে ক্যাম্পাস থেকে ফেরার পথে একটা প্রাইভেট কার পাশ ঘেঁষে ছুটে গেল। আবারও সেই মানুষটার পিছনের সাইড দেখলাম। কয়েক সেকেন্ডই আমি স্তব্ধ। ওই একটুখানি চোখের দেখাতেই আমার স্বপ্নপুরুষ পুরোপুরিভাবে আমার দু’চোখে ভেসে উঠলো। পরদিন স্বপ্নে আবারও ওই একই চেহারা দেখে দ্রুত স্কেচ আঁকতে বসে সেই মানুষটাকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হই। কিন্তু নিয়তি আমাকে তার সাথে বেঁধে দেয়নি বলেই, মিথ্যে পরিচয়ে তার জীবনে প্রবেশ করতে বাধ্য হই। যেদিন রেস্টুরেন্টে তাকে প্রথম দেখলাম তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে, অদ্ভুতভাবে হৃদয়ে যন্ত্রণা অনুভব করলাম। আমি যে তার জীবনে প্রবেশ করার কোনো অধিকারই রাখি না, এইভেবে কষ্ট পেলেও এত সহজে সেটা মানতে পারছিলাম না। জীবনসঙ্গী নাইবা হতে পারলাম তাতে দোষ কী! অন্তত বন্ধু হিসেবে কাছে পেলে মনের যন্ত্রণা তো কমবে। এজন্যই নিজের কষ্টকে চাপা দিয়ে রাত্রি নামের আড়ালে নিজের ভালোবাসাকে চেপে রাখার উপায় খুঁজে নিতে বাধ্য হলাম। কিন্তু কে জানতো, আমারই একটা ভুল আমার সব স্বপ্ন ভেঙে দিবে। সেই স্বপ্নপুরুষটা আমাকে ভুল বুঝে দূরে না সরলে আমি তো মৃত্যুর স্পর্শ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে ছাড়তাম না। তাই নিজের অপরাধের শাস্তি নিজেকেই দিলাম। সব ছেড়ে সিডনীতে গেলাম। এরচেয়ে বেশি শাস্তি দেয়ার মতো কোনো অপশন পাচ্ছিলাম না আমি। আমার অপরাধ কি খুব বড়ো ছিল শ্রাবণ যার জন্য আজ দুটো বছর ধরে সেই অপরাধের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছি?”
ভাঙা গলায় একটানা অনেক কথা বলে গলাটা শুকিয়ে গেছে মেঘের। শ্রাবণ সেটা লক্ষ্য করে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“পানি খাও। হালকা লাগবে। আনিকার জন্য এমনটা করেছো না?”
গম্ভীরমুখে শ্রাবণের দিকে তাকালো মেঘ। সেদিনও এই মানুষটা তার যন্ত্রণা কমাতে পানির বোতল বাড়িয়ে দিয়েছিল, তবে আজ কোন যন্ত্রণা মেটাতে এগিয়ে এলো সে? ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ মেঘ দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলো।
চলবে…
(ভুল ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইলো।)