#তবু_ফিরে_আসা,পর্ব : (৯)
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
(২৮)
পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে ঘুম ভাঙলো তার। চোখ মেলতেই সূর্যের কিরণ এসে চোখে পড়লো। খোলা আকাশের নিচে সুন্দর একটা সকালের শুরু। রাতের সৌন্দর্যের চেয়ে ভোরের এই মিঠা রোদের স্বাদটা আরও বেশি সুন্দর মনে হলো তার। উঠে বসে চোখে-মুখে হাত বুলিয়ে ঘুম ঘুম ভাবটাকে দূরে সরালো নওরিন। কাল সারারাত কেটেছে গল্প করতে করতে। পুরো ছাদ জুড়ে রঙিন জ্বলজ্বল করা বাতিগুলো সূর্যের আলো পড়ে মিইয়ে গেছে। নাম না জানা হরেক রকমের ফুলে ভরে আছে ছাদের চারপাশ। সেইসাথে অদ্ভুত সুখ হৃদয়টা নাড়িয়ে দিল হঠাৎ।
পুরনো সব কথা আর নতুন জীবনে সুখে-দুঃখে পাশে থাকা এসব ছাড়াও দুষ্টু মিষ্টি আলাপে রাতটা ছাদেই পার করেছিল ওরা। একেবারে শেষরাতে ঘুমিয়েছিল কেবল। মাত্র তিনঘণ্টার মতো ঘুমিয়েছে। আদনান এখনও গভীর ঘুমে আছে মনে হচ্ছে। মৃদু নাক টানার শব্দ ভেসে আসছে। হেসে ফেললো নওরিন। সকালটা এত্ত সুন্দরভাবে শুরু হবে কে জানতো! মেয়েরা ঘুমিয়ে থাকলে নাকি তাদের আরও সুন্দর দেখায়, অথচ নওরিন দেখছে তার উল্টোটা। মাথার নিচে হাত রেখে উপুড় হয়ে আদনানের ঘুমের স্টাইলটা তাকে ভীষণ জ্বালাচ্ছে। সূর্যের আলো সামান্য আদনানের চোখেমুখেও পড়ছে তবুও তার ঘুম ভাঙছে না। কিন্তু কিছু করার নেই। এখনি ঘুম ভাঙাতে হবে, মা এসে এভাবে দেখলে লজ্জার শেষ থাকবে না।
তার এখনও মনে পড়ে, যেদিন আদনান তাকে প্রপোজ করেছিল, তাকে জ্বালানোর জন্য ইচ্ছে করেই প্রপোজাল ফিরিয়ে দিয়েছিল নওরিন। সেই রাগ ভাঙাতে অনেকদিন লেগেছিল। কী যে রাগ আদনানের! মেঘ সিডনী যাওয়ার পর এক সকালে আদনান নিজেই নওরিনকে ফোন করে দেখা করতে বলে, দেখা করে দুজনেই ক্ষমা চায়। ভুলগুলো শোধরে নিয়ে নতুন একটা অঙ্গীকার নিয়ে একে-অপরের সারাজীবনের সঙ্গী হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। সেই প্রতিশ্রুতিটা পূরণ হলো আজ। আজ সে আদনানের অর্ধাঙ্গিনী। কথাটা মনে মনে ভেবেই পুলকিত হলো নওরিন। ছাদে মিনিট পাঁচেক হাঁটাহাঁটি করলো। ছাদ সাজানোর ধরণটা তার ভীষণ ভালো লেগেছে। এমনভাবে সাজিয়েছে যেন এটা একটা আস্তো রুম। প্রয়োজনীয় সবকিছুই আছে। নওরিন বুঝলো না, একদিনের জন্য এত ডেকোরেশনের কী দরকার! তাছাড়া কাঁচা ফুলগুলো শুকিয়ে যাবে আজকের মধ্যেই। যা টাটকা রোদ। তাকিয়ে দেখলো, গোলাপ ফুলের পাপড়ি ছড়ানো বিছানায় আদনান তখনও ঘুমে।
শাড়ির আঁচলের কোণার অংশটা পেঁচিয়ে আদনানের নাকের ফাঁকে ঢুকিয়ে দেয় নওরিন। অনেকক্ষণ ডাকার পরেও যখন উঠছিল না তাই ইচ্ছে করেই এই দুষ্টামির রাস্তা ধরেছে সে। সুড়সুড়ি টের পেয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠলো আদনান। শুরু হলো হাঁচি। নাক-মুখ ভালো করে ঢলে নওরিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো, ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় ঝলমলে এক হাসি। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়েই হাত ধরে টেনে বিছানায় ফেলে বলল,
“ঘুমের বারোটা না বাজালে চলছিল না তোমার?”
“বারে, এতক্ষণ ঘুমালে। বাড়ির সবাই কী ভাববে?”
“কেউ নেই ওত ভাবার মতো। শুধু মা আর কাজের লোক আছে।”
“যারাই থাকুক, এত বেলা অবধি ঘুমানো ঠিক না।”
“রাতে যে ঘুম হয়নি।”
“আমি জাগিয়ে রেখেছি তোমাকে? নিজেই তো পুরনো কেচ্ছা তুলে বকবক করে মাথাব্যথা বাড়ালে। দেখো তো, সকাল সকাল মাথাটা কেমন ভার ভার লাগছে! চলো ওঠো, কড়া লিকারের এক কাপ চা খেলে ব্যথা সারবে। ওঠো না প্লিজ।”
নওরিন উঠে আদনানকে টেনে তোলার চেষ্টা করলো। কিন্তু আদনান তার জায়গাতেই অনড়। একটুও নড়ছে না সে। উল্টো নওরিনকে বেডে বসিয়ে গালে হাত ধরে নেশাভরা কণ্ঠে বলল,
“মাথাব্যথা সারিয়ে দিচ্ছি।”
আপনা হতেই দু’চোখ বন্ধ হয়ে গেল তার। অদ্ভুত একটা টান কাজ করছে হৃদয়ে। তুমুলবেগে বাড়ছে হৃদস্পন্দন। ধীরস্থিরভাবে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো আদনান। দু’হাতে তাকে আঁকড়ে ধরলো নওরিন। মাথা রাখলো আদনানের লোমশ বুকে। চোখ বন্ধ করে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললো সে। বহু প্রতীক্ষার পর আজ সে পেয়েছে সুখের ঠিকানা। এই ঠিকানা ছেড়ে কোথাও যাওয়ার নেই তার। এখানেই তো শান্তি, এখানেই তো সুখ, এখানেই তো সব পূর্ণতা।
(২৯)
নাশতার টেবিলে এসে মেঘ তো অবাক, রোশান সেখানে নেই। চোখ ঘুরিয়ে গেস্ট রুমের দিকে তাকালো একবার। কারও সাড়াশব্দ নেই। অদ্ভুত তো, সকাল সকাল কোথায় গেল? ভাবতে ভাবতেই পাউরুটি মুখে তুললো সে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“রোশান কোথায়?”
“নিজের বাসায় আছে। কেন? দরকার তোর? আসতে বলবো এখানে?”
“ধ্যাৎ…! কাল রাতে না ছিল? আমি তো ভাবলাম এখানেই থেকে গেছে হয়তো।”
“খেয়েদেয়ে কাজ নেই তো ওর। নিজের ঘর ছেড়ে পরের বাড়ি এসে থাকবে। তবে তুই চাইলে, ওর এখানে থাকার ব্যবস্থা করতে পারি। ছেলেটা কিন্তু ভালো। ঘরজামাই হলে তো আরও ভালো হয়।”
“মানে! ওর এখানে বাড়ি আসলো কোথা থেকে?”
“হ্যাঁ, ধানমণ্ডিতে ওদের বাসা। নওরিনের খালাতো ভাই তো। তুই জানিস না এটা?”
হাত থেকে পাউরুটি পড়ে গেল মেঘের। এটা সে কী শুনলো! রোশানের বাড়ি ঢাকাতেই। ও আল্লাহ্, কী একটা মসিবত। আপদটাকে কেন এখানেই আসতে হলো! ভাবছিল সে। ঠোঁট কামড়ে বিড়বিড় করে বলল,
“নওরিন, তুইও তাহলে সামি আর ইরার সাথে যোগ দিয়েছিস। তোদের তো আমি দেখে নিব।”
নাশতা ফেলে উঠে দাঁড়ালো মেঘ। সোজা রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে পড়লো। ভাবতে ভাবতে নওরিনের নাম্বারে ডায়াল করলো। নওরিন সবে নাশতা শেষ করে শাশুড়ি মায়ের সাথে গল্প করছিল, কিন্তু মেঘের ফোন পেয়ে শাশুড়ি মায়ের অনুমতি নিয়ে আলাদা সরে আসলো।
“কীরে, একদিন পার হতে না হতেই মিস করা শুরু করেছিস? বেস্টুর বিরহে ঘুম হয়নি বুঝি?”
“মাথা ফাটিয়ে ফেলবো তোর। রোশান তোর ভাই?”
“হ্যাঁ, কেন? তুই সেটা জানিস না? ওহ সরি, তোকে তো কখনও বলা হয়নি। যাক বাদদে, আমার ভাইটা কিন্তু হ্যান্ডসাম, তোর সঙ্গে যা মানাবে না!”
“চুপ থাক, নাক থেতলে দেব একদম। আমার জন্য যত চিন্তা ওদের! দরদ দেখাতে আসছে সবাই। ওই স্টুপিডটাকে তো আমি দেখেই ছাড়বো।”
রাগে ক্ষোভে যা মুখে আসছে তাই বলছে মেঘ। নওরিন ওর এই পাগলামিমার্কা কথাবার্তা শোনে হাসতে হাসতে দিশেহারা। তবুও হাসি থামিয়ে বলল,
“মেঘ, সিরিয়াসলি বলছি। ভেবে দেখ। তুই তো শ্রাবণ ভাইয়াকে আর ফিরে পেতে চাস না। তাহলে রোশান ভাইয়াকেই বা আর অপেক্ষা করাবি কেন?”
কোনো জবাব দেয়নি মেঘ। কল কেটে রাগে গজগজ করতে করতে নিজের রুমেই পায়চারি করছে সে। অস্থির লাগছে তার, কখনও বসছে, কখনও হাঁটছে আবার কখনও সবাইকে বকে গোষ্ঠী উদ্ধার করছে।
(৩০)
ক’দিন ধরে অফিসের কাজে ভীষণ ব্যস্ত শ্রাবণ। সিলেট যে কাজে গিয়েছিল সেটা তো থেমে গেল মাঝপথে। মেঘের সঙ্গে দেখা না হলে এতদিনে কাজটা গুছিয়ে উঠতো। অথচ সব থেমে আছে। এদিকে কোম্পানির মালিক চাপ দিচ্ছেন। সিদ্ধান্ত না জানালে তিনি অন্য কোম্পানির সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হবেন। কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না শ্রাবণ। দিশেহারা অবস্থা এখন তার। এই অবস্থায় কাজটা হাতছাড়া মানে কোম্পানির অর্ধেক লস। অন্যদিকে আবার মেঘও ঢাকায়। তার সাথে যোগ হয়েছে আরেকটা পাগল। কোনদিক সামলাবে সে? ভাবতে ভাবতে ম্যানেজার আংকেলের সাথে দেখা করতে গেল। তিনি তখন কারও সাথে ফোনালাপে ব্যস্ত ছিলেন। শ্রাবণকে দেখে ফোন কেটে এগিয়ে এসে বললেন,
“কী হয়েছে বাবা? খুব চিন্তিত লাগছে?”
“আংকেল, ইমিডিয়েট সিলেট যেতে হবে। আমার এদিকে ব্যক্তিগত কিছু কাজ আছে। অফিস থেকে কাউকে পাঠালে ভালো হতো। তুমি আর রাতুল যদি ওই কোম্পানির সাথে আলোচনা করে কাজটা হাতে রাখতে ভালো হতো।”
“ঠিক আছে, কোনো অসুবিধা নেই। আমি স্যারের সাথে কথা বলে সব ঠিক করছি। তুমি বরং এদিকটা সামলে নিও।”
“থ্যাংক য়্যু আংকেল৷ আমি তাহলে আসছি।”
অফিস থেকে বের হওয়া মাত্রই অচেনা একটা নাম্বার থেকে শ্রাবণের ফোনে কল আসলো। গাড়ির গতি কমিয়ে ব্লুটুথটা কানে সেট করে ড্রাইভ সামলে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো শ্রাবণ? কতদিন পর তোমার গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম!”
চমকে গেল শ্রাবণ। কপালে দু’তিনটে ভাঁজ পড়লো তার। ভ্রু কুঁচকে কণ্ঠস্বরটা আন্দাজ করার চেষ্টা করলো। কয়েক সেকেন্ড পর অবিশ্বাস্য স্বরে বলল,
“তুমি! এতদিন পর! নাম্বার কোথায় পেয়েছো?”
“পুরনো সিম থেকে। আমার নাম্বারটা হারিয়ে ফেলেছো নাকি ভুলে গেছো?”
“ভুলে যাওয়াটাই তো স্বাভাবিক। কেমন আছো আজকাল?”
“সামনে থেকে দেখে যাও। আসবে একবার? আমি বাসাতেই আছি।”
“কী হয়েছে তোমার? এমন ধরা গলায় কথা বলছো কেন?”
“কিছু হয়নি। অনেকদিন পর দেশে ফিরেছি। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। বন্ধুত্বের খাতিরে আসতে তো পারোই। নাকি এখন শুধু মেঘই তোমার সব?”
“হলো কই আমার? এখনও পাখিটাকে খাঁচায় ভরতে পারছি না।”
“তাহলে তাকে ছেড়ে দিয়েছিলে কেন?”
“তুমি আমাকে কেন ছেড়েছিলে সেটা মনে আছে তো?”
“থাকবে না আবার। মেঘ, কাশফিয়া হাসান মেঘ। যে কিনা অচেনা একটা মানুষকে স্বপ্নে আবিষ্কার করে তাকে এতটাই ভালোবাসলো যে, আমার ভালোবাসা সেখানে তুচ্ছ হয়ে গেল। তবে আমাদের দু’জনের মধ্যে পার্থক্য আছে। সেটা কী জানো? মেঘ আজও একই জায়গায় স্থির, আর আমি ঢেউয়ের তালে ছিটকে পড়া এক টুকরো নুরি পাথর। ওই বিশাল সমুদ্রের বুকে আজ আর আমার কোনো জায়গা নেই। এদিক-সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছি শুধু। গন্তব্য জানা নেই।”
“মানে! গন্তব্য তো একটা ছিলোই তোমার। নিজেই চলে গিয়েছিলে। যাই হোক, এত কথার প্রয়োজন বোধ করছি না। আজ একদম মন ভালো নেই, ফোনটা রাখো। আমি ড্রাইভে আছি।”
“শ্রাবণ একবার শোনো, একটা দরকারি কথা বলবো।”
“প্লিজ আনিকা, অন্যদিন। রাখলাম।”
ফোন কেটে দীর্ঘশ্বাস ফেললো শ্রাবণ। জীবনটা ক্রমশ জটিল হচ্ছে। যে নিজের ভালোবাসাকে অবিশ্বাস করে সামান্য ভুল বুঝাবুঝিকে কেন্দ্র করে মাঝপথে ফেলে যেতে পারে তারজন্য আবারও নিজের জীবনে বিপদ ডেকে আনার কোনো মানেই হয় না। একদিন আনিকাই তো বলেছিল, মেঘকে আরেকটা সুযোগ দিতে। তবে আজ কেন আবারও আমাকেই তার প্রয়োজন হবে! বুঝতে পারছে না শ্রাবণ, বার বার মনে হচ্ছে আনিকা নতুন কোনো বিপদ নিয়েই দেশের মাটিতে পা রেখেছে। নয়তো সিঙ্গাপুর থেকে কেনই বা ব্যাক করেছে সে?
চলবে…
(ভুল ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইলো।)