#তবু_মনে_রেখো,১ম পর্ব,০২
লেখা: জবরুল ইসলাম
০১
‘এই মেয়ে, আশ্চর্য! তুমি আমার রুমে কি করছো? তোমাকে বিয়ে করেছি এটাই তো যথেষ্ট। আর কী চাও?’
ইমাদ হাত-মুখ মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বের হয়ে নববধূকে দেখেই কথাগুলো বললো।
পুষ্পিতা বিছানায় বসা ছিল। বিস্ময়ে যেন তার বাকশক্তি লোপ পেয়েছে। ইমাদের এই উপর্যুপরি কথার বানে সে কেবল আহত নয়নে তাকিয়ে থাকে।
ইমাদ পুনরায় ধমক দিয়ে বললো,
– ‘কি হলো? এখনও বসে আছো কেন? বের হও এই রুম থেকে।’
পুষ্পিতার এবার বিস্ময় কাটে। অপমান-অবহেলায় চোখ ভরে আসে জলে। কোনো প্রতিবাদ না করে বিছানা থেকে নামে সে। একবার ভাবে বলবে ‘তোমার বোন এনে দিয়েছিল এখানে।’ শেষপর্যন্ত কিছু না বলেই মাথা নীচু করে ধীরপদে বের হয়ে যায় রুম থেকে। এই লাঞ্ছনার কারণ তার দৈহিক কোনো ত্রু’টি নয়। শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ নিখুঁত সে। দেখতেও যথেষ্ট রূপবতী। কোনো শত্রুও তাকে দেখে অসুন্দর বলবে না। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী সুন্দরী হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে ফরসা হওয়া। দর্শনে সম্মুখ আকর্ষণটা মানুষকে বোধহয় গায়ের রঙই করে থাকে। এই শর্তও পুষ্পিতার গায়ের রঙ করেছে। স্বাস্থ্যবতী তরুণীদের মতো চেহারায় লাবন্যতাও আছে। একজন পুরুষ কোনোভাবেই তাকে বিছানা থেকে তাড়িয়ে দেয়া যুক্তিসঙ্গত নয়। সে বরং কামুক পুরুষের কাছে আরাধনার যোগ্য। রাস্তায় বের হলে পুষ্পিতারও জামা-কাপড়কে তাচ্ছিল্য করে সুডৌল স্তন দু’টো জানান দেয়। ঘন কালো লম্বা কেশ কোমড়ের ভাঁজে এসে আছড়ে পড়ে। হাঁটার সময় নিতম্ব দেহাবয়বের শৈল্পিক ছন্দ আর আভিজাত্যের প্রমাণ রেখে যায়। তবুও কেন আজ সে এই প্রত্যাখানের শিকার?
পারিবারিক পরিচয়ও পুষ্পিতার বিরাট৷ সয়ং ইমাদের বাবা ওদের অফিসে বেতনভুক্ত চাকুরি করতেন। আছে গ্রামে-শহরে দু’খানা বাড়ি। এতকিছুর পরও যে সে ইমাদের কাছে এভাবে নিগ্রহের শি’কার হলো। কারণ কেবল একটাই। একটা ভুল সিদ্ধান্ত একদিনেরই ব্যবধানে পুষ্পিতার জীবনের গল্প পালটে দিয়েছে। কেবল একটা ভুল তার রূপ-যৌবন, পারিবারিক এবং নিজের আত্মমর্যাদাকে টেনে-হিঁচড়ে মিশিয়ে দিয়েছে মাটিতে।
ইমাদের রুম থেকে বের হয়ে পুষ্পিতা এখন কোথায় যাবে বুঝতে পারছে না৷ তবুও ইতি-উতি করে চলে গেল ইমার রুমে। ইমা আলনার কাপড় ভাঁজ করছিল।
তাকে দেখে বললো,
– ‘আরে চলে এলে যে?’
পুষ্পিতা জবাব না দিয়ে ওর বিছানায় গিয়ে বসে পড়ে। ইমা ওর পাশে এসে কাঁধে হাত রাখলো,
– ‘যা হওয়ার হয়ে গেছে পুষ্পিতা আপু, আজকের দিনটা ভুলে যাও। আর এখন যেভাবে পারো ভাইয়াকে ম্যানেজ করে চলো। ওর মন খুব ভালো। না হলে তুমিই বলো এভাবে কেউ বাবার কথায় বিয়েতে রাজি হয়?’
পুষ্পিতা ইমার কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। ইমা ওর বছর খানেকের ছোট হবে। পুষ্পিতা গ্রামে এলে ওর সঙ্গেই বেশিরভাগ সময় কাটতো।
হায়দার সাহেব ব্যস্ত হয়ে ইমাদের দরজায় এসে নক করলেন। ইমাদ দরজা খুলে দিল। তিনি নীচু গলায় বললেন,
– ‘পুষ্পিতা মা ভেতরে আছে?’
ইমাদ সংক্ষেপে বললো, ‘না।’
– ‘তুমি আমার সঙ্গে আসো।’
ইমাদ পিছু পিছু যায়। তিনি বারান্দার গ্রিলের দরজা খুলে উঠোনে এলেন। বিশাল জায়গা নিয়ে তাদের এই বাড়ি৷ পাকা ঘর, উপরে টিনের চাল। পেছনে গাছগাছালি আর সবজির বাগান। উঠোন পেরিয়েই শানবাঁধানো পুকুর ঘাট। তারা বসলেন গিয়ে সেখানে। পুকুরে মাছ চাষও করেন। দুইপাড়ে নানান ফল-ফুলের গাছ। হায়দার সাহেব খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর আকাশের দিকে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন,
– ‘প্রথমেই বলি বাবা, অতি প্রশ্ন বিষয়টা খারাপ। প্রশ্ন কম করবা, কথা শুনবা বেশি। ঠিক আছে?’
– ‘কিন্তু বাবা, আমি এসবের মানে বুঝতে পারছি না। তোমার কথামতো একটু আগেও আমি মেয়েটাকে ধমক দিয়ে রুম থেকে বের করে দিয়েছি। আমার বিষয়টা নিজের কাছেই খারাপ লেগেছে।’
হায়দার সাহেব খ্যাকখ্যাক করে হাসলেন। তারপর বুড়ো আঙুল দিয়ে আলগোছে সিগারেট নাড়া দিয়ে আবার ঠোঁটে নিয়ে টান দিয়ে বললেন,
– ‘তুমি কি জানো তোমার জন্য পুষ্পিতাকে বউ করে আনতে মুহসিন খানকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। ওরা তখন দেয়নি৷ এখন দিয়েছে কিভাবে সেটাও আমি জানি। তাই আমার কথাগুলো শুনো, তাতেই মঙ্গল।’
– ‘বাবা শুধুমাত্র আগে দেয়নি বলে কি আমরা এসব আচরণ করবো? জীবনটা সিনেমা না-কি বাবা? এই সামান্য কারণে..।”
হায়দার সাহেব ছেলেকে থামিয়ে দিলেন,
– ‘না, আরও কারণ আছে৷ সময় এলে সব বুঝবে, জানবে। আগেই বলেছি অতি প্রশ্ন ভালো না৷ শুনো, বিয়ে যেহেতু হয়েছে৷ বউ তোমারই থাকবে। শুধু তোমার কাজ হচ্ছে এমন ভাব করা, যেন আমার কারণে বিয়েটা করেছো। না হলে করতে না৷ এটা চালিয়ে যেতে হবে তোমাকে।’
ইমাদ কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ বসে রইল। হায়দার সাহেব কল দিলেন মুহসিন খানকে। ওপাশে রিং হতেই রিসিভ হলো,
– ‘আসসালামু আলাইকুম খান ভাই।’
ওপাশ থেকে বিধ্বস্ত গলায় সালামের জবাব দিয়ে খান সাহেব বললেন,
– ‘কি অবস্থা, সবকিছু কি ঠিকঠাক?’
– ‘আল্লাহর রহমতে সবকিছু সামলে নিয়েছি। চিন্তা করবেন না একদম। ভাবীকেও বলবেন।’
– ‘তুমি যে আজ কি বড়ো উপকার করলে ভাই। আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।’
– ‘আরে কি যে বলেন। সেই যৌবনে গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। তখন থেকে আপনাদের সঙ্গে পরিচয়। ফ্যামিলির মতো থাকলাম সারাজীবন। এখন খারাপ সময়ে পাশে না থাকলে কেমন আপনজন।’
মহসিন সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
– ‘তোমার সঙ্গে তো তখন আজাদও ছিল। তাছাড়া নিশিতা তো পুষ্পিতার আপন খালা। তবুও দেখলে তো কিভাবে বিপদের সময় স্বার্থপরের মতো আচরণ করলো।’
– ‘এসব থাক ভাই, হাতের পাঁচ আঙুল তো এক না। এখন যে ভাই একটা কাজ করতে হবে আপনার।’
– ‘কি?’
– ‘আসলে বুঝতেই তো পারছেন, আমার ছেলেটা শুধুমাত্র আমার কথাতেই রাজি হয়েছে৷ এরকম ঘটনার পর একটা ছেলে কিভাবে রাজি হবে বলুন। তারও তো এলাকায় ফ্রেন্ড-সার্কেল আছে। একটু আগে আবার ইমা বললো ইমাদের রিলেশনও না-কি আছে। আমি ধমক দিয়ে দিলাম আরকি। কি আর করবো বলুন। তবুও তো সব মিলিয়ে ছেলেটা রেগে আছে। মানিয়ে নিতে পারছে না৷ তাই আর কোনো গণ্ডগোল হোক চাচ্ছি না৷ আপনি পুষ্পিতা মা’কে কল দিয়ে বলুন ওর মোবাইলের সব ডিলিট করে দিতে। সিম ইমাদের কাছে দিয়ে দিক। আমি শেষে নতুন সীম কিনে দেবো। আর ফেইসবুকেই তো এতকিছু হয়েছে। বলবেন ফেইসবুক-টেইসবুক আর ব্যবহার না করতে। বুঝতেই তো পারছেন ভাই। ছেলেটা কয়েকবার বলেছে এই মেয়ে…।”
উনাকে থামিয়ে দিয়ে খান সাহেব বললেন,
– ‘আমি বুঝেছি, আর বলতে হবে না। তবে ওর মোবাইল এখনও আমাদের কাছে আছে। ওকে দেয়া হয়নি।’
– ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে৷ তাহলে ফেরত দিলে সবকিছু ডিলিট দিয়ে দিবেন আরকি।’
– ‘আর বলতে হবে না হায়দার। আমি এখন ওর ফোন আর সিমটা পুকুরেই ফেলে দিব।’
– ‘ঠিক আছে, তাহলে রাখি এখন। আর চিন্তা করবেন না৷ যা হওয়ার হয়েছে।’
– ‘শোনো হায়দার, যা হয়েছে খারাপ হয়েছে ঠিকই, তবে অনেক খারাপের পেছনে ভালো হয়। তুমি ফোন দেয়ার আগেই ব্যাপারটা ভাবলাম। যে ছেলে বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়ে করে নিল। এমন ছেলে তো রত্ন। আর যে বিপদের মুখে রেখে চলে গেল। এদের সঙ্গে সম্পর্ক না হওয়ায় তো ভালোই হয়েছে।’
– ‘তা ঠিক ভাই, আমার ছেলেটা খুবই ভালো। শুধু ওই মানিয়ে নিলেই হলো আরকি। আর আপনার মেয়েরও গরীবের ঘরে কষ্ট হবে।’
– ‘একটাই মেয়ে আমার হায়দার, তোমার ছেলে আর আমার ছেলে কি আলাদা। ওর ব্যবস্থা আমিই করবো। আচ্ছা রাখি এখন।’
– ‘ওকে রাখছি।’
ফোন রেখে হায়দার সাহেব আরেকটা সিগারেট ধরালেন। ইমাদ অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে তার বাবার দিকে। কি চাচ্ছেন আর কি করছেন সে কিছুই বুঝতে পারছে না। আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘তুমি কি চাচ্ছ বাবা, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
– ‘সময় হলে বুঝা যাবে বাবা৷ ভাবছি ওই আকাশের মালিকের কথা। উনার খেলা বুঝা বড়ো দায়। এমন সুযোগ আমাকে দিবেন কোনোদিন ভাবিনি।’
– ‘কিসের সুযোগ, কিসের কি?’
– ‘অতি প্রশ্ন ভালো না। যাইই করি তোমার ভালোর জন্যই হবে। এখন শুধু তুমি একটু মেয়েটার থেকে দূরে থাকবে৷ যেন তুমি মেনেই নিতে পারছো না। ফোনে আলাপ শুনে তো বুঝেছো তোমাকে কিরকম চলতে হবে।’
পুকুরে যেন নারিকেল গাছ ত্যারচা হয়ে পড়ে গেছে। চাঁদের কোমল আলোয় জলের ভেতর চিরল-চিরল পাতা সহ গাছটিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ইমাদ সেদিকে তাকিয়ে আছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। বাবাকে সে প্রচণ্ড ভালোবাসে। মায়ের মৃত্যুর পর মানুষটা তারা ভাই-বোনকে এতটা বছর পরম মমতায় আগলে রেখেছে। মানুষ হিসাবে অত্যন্ত ভালো। কখনও অন্যায় কিছু করার মতো মানুষ তিনি নন। কিন্তু এবারের বিষয়টা ইমাদ মানতে পারছে না৷ তিনি কি চাচ্ছেন, কেন একটা সহজ ঘটনাকে নাটকের রূপ দিচ্ছেন। তাকে দিচ্ছেন নির্দয় স্বামীর চরিত্র৷ আজ দুপুরের আগমুহূর্তে তার বাবা যখন এসে তাকে পুরো ঘটনা শুনিয়ে বললেন, ‘তোকে আজই খানের মেয়েকে করতে হবে।’
সে চিন্তায় পড়ে যায়। এরকম একটা ঘটনার পর খান চাচারা নিশ্চয় খুবই বিপদে পড়েছেন। তার বাবাও যে মনে মনে পুষ্পিতাকে বউ করে আনতে দিবাস্বপ্ন দেখতেন তার অজানা ছিল নয়। বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ধমকও খেয়েছিলেন খান সাহেবের। পুষ্পিতাকে তারও ভালো লাগে। তাই সে ইতিবাচক ভাবনা থেকে বললো,
– ‘বাবা তুমি আর চাচা যা ভালো মনে হয় করো। তুমি খান সাহেবের বন্ধু মানুষ, বিপদে বন্ধুই তো পাশে থাকবে। আমার কোনো আপত্তি নেই।’
তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাকে বিস্মিত করে দিয়ে গালে একটা চ’ড় দিলেন৷ তখন তারা দু’জন এই পুকুর পাড়ের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। চড়ের শব্দে পাশের আমগাছে বসা একটা কাক কর্কশ গলায় ‘কা-কা’ করে উড়ে চলে গেল। ইমাদ গালে হাত দিয়ে আহত নয়নে তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে৷ তিনি পাঞ্জাবি এঁটো করে শিমুল গাছের শেকড়ে বসে সিগারেট ধরিয়ে টান দিয়ে বললেন, ‘বস।’
সে পায়ের তালুতে ভর দিয়ে কনুই হাঁটুতে ঠেকিয়ে বসলো। তিনি ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘শোনো বাবা, পিতা হিসাবে সন্তান ভালো মানুষ হোক সবাইই চায়। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় ব্যখ্যা করলে বলা যায়, ভালো মানুষ মানেই ব’লদ। আমি নিজেও এক সময় ব’লদ শ্রেণীতে ছিলাম। তোমাকে নিয়ে আমার ভয় হয়। এতো ভালো হওয়াও ভালো না। খান সাহেবের মেয়েকে কেউ বিয়ে করবে না বলেই তো তোমার কাছে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন। তুমি কি ওলি-আউলিয়াদের লেভেলে চলে গেছো বাবা? তুমি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলে কেন?’
সে জবাব না দিয়ে কেবল বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারা বাবা খুব রসিক মানুষ সে তা জানে। রসিকতা এখন উনার চোখ থেকে উপচে পড়ছে। এই মুহূর্তে মানুষটার মন-মেজাজ প্রচণ্ড ভালো। ইমাদ ভালো করেই চিনে তার পিতাকে।
হায়দার সাহেব ক্ষীণ সময় পর নিজেই আবার বললেন,
– ‘শুনো বিয়েতে তুমি রাজি হওনি, আমি হয়েছি, কথা ক্লিয়ার?’
ইমাদ দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। বাবা কি বুঝাতে চাচ্ছেন? তার মায়ের মৃত্যু বহু বছর আগে হয়েছে। চাইলে তো অনেক আগেই বিয়ে করতে পারতেন। সে আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘বুঝিনি বাবা।’
– ‘বিষটা হইল, তুমি এমন ভাব করবে, যেন এমন লজ্জাজনক কর্মের কারণে পুষ্পিতাকে বিয়ে করতে রাজি না। কিন্তু পিতা বড়োই চাপাচাপি শুরু করেছেন। একপর্যায়ে পিতার মুখের দিকে তাকিয়েই পুত্র রাজি হয়েছে। আপাতত তোমার কাজ এটাই।’
সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। তখনই বাবা তাকে নিয়ে খান সাহেবের কাছে চলে যান।
তার ভাবনায় ছেদ পড়লো হায়দার সাহেবের কথায়। সে জলের ভেতর কাঁপতে থাকা নারিকেল গাছের চিরল-চিরল পাতা থেকে চোখ সরিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকায়।
– ‘এখন যেতে পারো। আর মেয়েটাকে কখনও আর ফেইসবুক-টেইসবুক ব্যবহার করতে দিবা না। সব সময় এমন ভাব করবা, যেন তাকে তুমি বিশ্বাস করো না।’
সে পিতার বাধ্য সন্তানের মতো মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে প্রস্থান করে।
_ চলবে…
তবু মনে রেখো ( ২য় পর্ব )
.
পুষ্পিতার গায়ে এখনও সেঁটে আছে বিয়ের জমকালো শাড়ি। সে ম্লান মুখে ডান হাতের কনুই সোফার হাতলে রেখে, করতল বদ্ধ করে থুতনিতে ঠেকিয়ে বসে আছে।
ইমাদ করিডর পেরিয়ে ইমার কামরার সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। দরজার কাছে আসতেই লাল পর্দা গলে ভেতরে চোখ গেল। বিষণ্ণ মনে আলো ছড়ানো ঝলমলে পোশাকে বসে আছে পুষ্পিতা৷ এ এক নান্দনিক দৃশ্য। কোনো এক শিল্পী যেন পরম যত্নে এঁকেছে তাকে। বিষণ্ণতা যেন ওই মুখশ্রীর আরও বেশি জৌলুশ বাড়িয়ে দিয়েছে। ক্ষীণ সময়ের ভেতরেই ইমাদের অনুভূতির শহরে এক অচেনা আর এতোদিনের অনাবিষ্কৃত গলিতে কেমন অন্যরকম অনুভূতি হলো; যেন ‘ওম ওম’ উষ্ণ অনুভূতি। তার পা দু’টো দরজা পেরিয়ে গেলেও মন থেকে গেল বিষণ্ণ বালিকারা কাছে। ইচ্ছা করছে পুনরায় গিয়ে ভালো করে দেখতে। ওর মন কি ভীষণ খারাপ?
টেবিলে খাবার দিয়ে সবাইকে ডেকে আনে ইমা। হায়দার সাহেব এসে পুষ্পিতার পাশের চেয়ার খালি দেখে বললেন,
– ‘বাবা ইমাদ, তুমি বউমার পাশে গিয়ে বসো, যাও। তোমার মা আজ বেঁচে থাকলে এগুলো আমার খেয়াল করতে হতো না..।’
কথা শেষ করার আগেই ইমাদ পুষ্পিতার পাশের চেয়ারে চলে গেল। হায়দার সাহেব হৃদয়ে কিঞ্চিৎ ব্যথা পেলেন। বলার সাথে সাথেই চলে যাবে, এতটাও বাধ্যগত সন্তান তিনি আশা করেননি। এই প্রথম অনুভব করলেন পুত্র খুব বেশি অনুগত হলেও মুশকিল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি চেয়ার টেনে বসলেন।
ইমা সবার সামনে প্লেট দিয়ে বললো,
– ‘সকলের একসঙ্গে একটা ছবি তুলি বাবা।’
হায়দার সাহেব সম্মতি দিয়ে বললেন,
– ‘হ্যাঁ ছবি তুলো, বউমা প্রথম এবাড়িতে খাবার খাচ্ছেন। এটা স্মরণীয় করে রাখা দরকার। একটা কথা মনে রাখবা, ডায়েরি আর ছবি ভবিষ্যতে হয়ে যায় ইতিহাস। হা হা হা।’
কেউ সঙ্গে হাসলো না। তবে ইমা বললো,
– ‘আমাদের বাড়িতে সে আগে কয়েকবার খেয়েছে বাবা।’
– ‘ও আচ্ছা, তাই না-কি।’
ইমা তার ভাইকে বললো,
– ‘ভাইয়া তোমার মোবাইল দাও আমার ফোনে ছবি ভালো উঠে না।’
ইমাদ পকেট হাতড়ে বললো,
– ‘রুমে গিয়ে দেখ।’
ইমা তাড়াতাড়ি গিয়ে মোবাইল নিয়ে এলো।
– ‘লক খুলে দাও।’
ইমাদ লক খুলে মোবাইল এগিয়ে দেয়। ইমা সামনে গিয়ে সেল্ফি তুলে একটা। তারপর ভাই-ভাবির দিকে তাকিয়ে বলে,
– ‘দুইজনের মাঝখানে ভারত-পাকিস্তানের কাঁ’টাতার না-কি? কাছাকাছি হও। ভাইয়া তুমি ভাবির পিঠের দিকে হাত নিয়ে কাঁধে রাখো তো।’
হায়দার সাহেব পুত্রকে মুখে বাঁধা না দিলেও অস্বস্তিতে ফেলার জন্য তাকিয়ে রইলেন। ইমাদ আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘আরে থাক না।’
ইমা দাঁত কটমট করে তাকিয়ে নিজে এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে বললো,
– ‘তুমি ধরো তো আপু, অহ স্যরি, আপু না ভাবি হবে। তুমিই হাত নিয়ে ধরো তো ভাইয়াকে।’
তারপর সে নিজেই পুষ্পিতার হাত টেনে নিয়ে ভাইয়ের কাঁধে দিল। পুষ্পিতা লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে। ইমা ক্যামেরা থাক করে বললো,
– ‘আরে এদিকে তাকাও না বাবা।’
পুষ্পিতা চোখ তুলে তাকায়। ইমা সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি ছবি তুলে নিল।
– ‘মোবাইল নাও ভাইয়া।’
ইমাদ মোবাইল রাখলো তার প্লেটের পাশে। পুষ্পিতার প্লেটে ভাত দিল ইমা। ঠিক তখনই বিদুৎ চলে গিয়ে চারপাশে ঘন আঁধার নেমে এলো। হায়দার সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন,
– ‘কিযে হলো, এত বিদ্যুৎ নিচ্ছে কেন আজকাল।’
ইমাদ মোবাইলের বাতি জ্বালিয়ে বললো,
– ‘সরকারের বিদ্যুৎ সাশ্রয় কর্মসূচী চলছে বাবা।’
– ‘সেটা আবার কি?’
– ‘করোনা আর ইউক্রেন রাশিয়ার যু’দ্ধের কারণে না-কি অর্থনৈথিক সমস্যা দেখা দিছে দেশে।’
– ‘চু’র বা’টপাররা দেশটারে লু’টে-পু’টে খেয়ে এখন যু’দ্ধ আর করোনার দো’ষ দিচ্ছে। দেশটা রসাতলে গেল। সবকিছুর দাম বেড়ে আ’গুন। এবার ইদে কাপড়ও বেশি বেচা-কেনা হলো না। মানুষ খেতে পারছে না, কিনবে কি।’
– ‘বাবা কর্মচারী বাদ দিলে হয় না। এখন থেকে আমি ফুল টাইম থাকলাম।’
– ‘দু’দিক একা সামলানো মুশকিল হবে।’
ইমা গিয়ে চার্জার বাতি নিয়ে এসেছে। হায়দার সাহেব বললেন,
– ‘বউমার দিকে রাখো বাতি।’
ইমা বাতি রেখে খেতে বসলো। খাবার পর্ব শেষ হওয়ার পর হায়দার সাহেব রুমে চলে গেলেন। পুষ্পিতা কি করবে বুঝতে পারছে না৷ অন্ধকারে কি ইমার ঘরে গিয়ে বসে থাকবে? ইমাদ রান্নাঘরে মোবাইলের বাতি জ্বালিয়ে রেখে এসে বোনের সাহায্যের জন্য টেবিল থেকে প্লেটগুলো নিয়ে যায়। পুষ্পিতা খানিকটা অবাকই হলো। পুরুষ মানুষকে সচরাচর এগুলো করতে সে কখনও দেখেনি। ইমা এসে টেবিল মুছতে শুরু করলো। ইমাদ তার মোবাইল নিয়ে চলে গেল রুমে।
– ‘কি হলো ভাবিজান, চেয়ার-টেবিলের সঙ্গেই রাত কাটাবে না-কি।’
কথাটি বলে ফিক করে হাসলো ইমা। পুষ্পিতা বিব্রতবোধ করছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না৷
– ‘ভাইয়া তো চলে গেছে, তুমি যাও।’
পুষ্পিতা অকারণ আঙুল ফোটানোর চেষ্টা করে বললো,
– ‘তোমার সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ থাকি।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
ইমা টেবিল মুছে বাতি হাতে নিয়ে বললো,
– ‘চলে আসো।’
পুষ্পিতা ওর সঙ্গে বিছানায় গিয়ে বসলো। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় প্রচণ্ড গরম লাগছে। আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘কাপড় খুলে ফেলি? অনেক গরম লাগছে।’
ইমা মুচকি হেঁসে ওর কানে ঠোঁট নিয়ে কিছু একটা বলতেই পুষ্পিতার মুখ লাল হয়ে উঠলো।
– ‘দুষ্টামি করো না ইমা, আমি কাপড় চেঞ্জ করতে বলেছি।’
– ‘সেটাও ভাইয়ার রুমে। বাসর ঘরে বিয়ের সাজেই তো স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে হয়, তাই না? না-কি সাজগোজ করে সেন্টারে যায় অতিথিদের দেখাতে আর ছবি তুলতে।’
পুষ্পিতা হেঁসে ফেললো।
– ‘তুমি এতো পাকা পাকা কথা তো আগে বলতে না ইমা।’
– ‘আগে কি ভাবি ছিলে?’
– ‘আচ্ছা এখন বলো এই গরমে এগুলো পরে থাকবো?’
– ‘আমি কি জানি? আমি বড়োজোর পাখা দিয়ে বাতাস করতে পারি।’
কথাটা বলে ইমা পাখা নিয়ে এলো। পুষ্পিতা বাঁধা দিলেও সে উপেক্ষা করে বাতাস করতে করতে বললো,
– ‘চিন্তা করো ভাবি, কারেন্টের লোকেরা কেমন বেরসিকের দল। মানুষের বাসর রাতেও বিদ্যুৎ নিয়ে বসে থাকে। এরা কি মানুষ!’
পুষ্পিতার ভীষণ হাসি পেল। সে হাসির শব্দ আঁটকে রাখার জন্য করপুটে মুখ ঢেকে বিছানায় হেলে পড়লো। হাসির তোড়ে ওর শরীর এখন নড়ছে। করিডরে হায়দার সাহেবের কথা শুনে পুষ্পিতা সঙ্গে সঙ্গে মাথায় কাপড় তুলে স্বাভাবিকভাবে বসলো।
– ‘আরে বউমা এখানে কেন? ইমা, যাও মা, তাকে ইমাদের রুমে দিয়ে আসো।’
ইমা পাখা নাড়তে নাড়তে বললো,
– ‘থাকুক বাবা আরও কিছুক্ষণ।’
– ‘আহা, নারে মা। সবকিছুর একটা নিয়ম-নীতি বলে কথা আছে। এগুলো মানতে হয়। যাও, নিয়ে যাও।’
ইমাদ রুমে এসে ইয়ারফোন কানে গুঁজে লতা মঙ্গেশকরের ‘লাগ যা গালে’ গান শুনছে আর পুষ্পিতাকে নিয়ে ভাবছে। তার বাবা যেরকম বলেছেন, সেসব পুরোপুরি মানতে সে নারাজ। আবার উনার কথা পুরোপুরি ফেলতেও সে পারবে না। আচ্ছা পুষ্পিতা কি তাকে পছন্দ করে? না-কি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর বাধ্য হয়েই বিয়ে বসেছে? নিশ্চয় সেও প্রস্তুত নয় তার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর মতো জীবন যাপনের জন্য। বাতির আলো দেখে দরজার দিকে তাকায় সে। পুষ্পিতাকে নিয়ে এসেছে ইমা। আস্তে করে বিছানা থেকে উঠলো। মনে মনে ঠিক করেছে সন্ধ্যার মতো আর রূঢ় আচরণ করবে না সে৷ আবার পুরোপুরি মিশবেও না। মধ্যমপন্থা জীবনের বহু জটিল সমস্যার একমাত্র সমাধান। ইমা চলে গেল। পুষ্পিতা ধীরপদে বিছানার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘আসলে আমি আসতে চাইনি, ওরা..।’
ইমাদ থামিয়ে দিল,
– ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুমি বিছানায় ঘুমাও আমি ফ্লোরে থাকবো।’
কথাটি বলে সে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।
পুষ্পিতা ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না এই মুহুূর্ত তার করণীয় কি? পায়ে হাত দিয়ে সালাম করবে? কিন্তু যদি ধমক দেয়? অপমান করে। বিভ্রান্তিতে খানিকক্ষণ কেটে গেল পুষ্পিতার। ইমাদ বালিশ আর বিছানা চাদর হাতে নিয়ে বললো,
– ‘কি হলো দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
সে ইতস্তত করে বললো,
– ‘আমি কি সালাম করবো?’
ইমাদ মেঝেতে বালিশ ফেলে বললো,
– ‘আশ্চর্য, সেটা কি আমার বলে দিতে হবে?’
– ‘না, মানে সালাম করতে পারি কি-না জিজ্ঞেস করছি।’
ইমাদ এগিয়ে গিয়ে বললো,
– ‘সালাম করে শান্তি পাইলে করো। তোমার শান্তির জন্যই তো আমার আজ এই অবস্থা। দোষ করছে একজন, শাস্তি পাচ্ছে আরেকজন।’
পুষ্পিতা লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেললো।
– ‘কি হলো সালাম করলে করো। আমার মাথা ধরেছে, এখনই ঘুমাতে হবে।’
সে আস্তে আস্তে নীচু হয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করে বললো,
– ‘আমি নিচে ঘুমাই, তুমি বিছানায় থাকো।’
ইমাদ রূঢ় গলায় বললো,
– ‘শোনো পুষ্পিতা, আমি যেটা বলবো এর বাইরে অতিরিক্ত কথা কখনও বলবে না। তোমাকে আজ বলেছি বিছানায় ঘুমাতে, প্রতিদিন এই নিয়মেই চলবে।’
কথাটা বলে সে মোবাইল হাতে নিয়ে মেঝেতে শুয়ে গেল। প্রচণ্ড গরম। বিদ্যুৎ দেয়ার নাম নেই। ইমাদ হাঁসফাঁস করছে। হঠাৎ মনে হলো তার পরনে থ্রি কোয়ার্টার আর গেঞ্জি। তবুও এতো গরম লাগলে, ওর পরনে তো শাড়ি। নিশ্চয় গরম লাগছে। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ইমার দরজায় নক করলো সে৷ ইমা দরজা খুলে দিল।
– ‘কি হয়েছে ভাইয়া?’
– ‘কিরে ওর কি কাপড় আনে নাই?’
– ‘এনেছে তো, ব্যাগ তোমাদের রুমে না?’
– ‘না তো।’
– ‘তাহলে সামনের রুমে আছে, দাঁড়াও আনি গিয়ে।’
ইমা ব্যাগ নিয়ে এসে ইমাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– ‘এই নাও।’
– ‘আমি এখানে আছি তুই যা নিয়ে। কাপড় চেঞ্জ করিয়ে আয়।’
‘আমি কেন চেঞ্জ করাবো’ বলে ভেংচি কেটে ইমা ব্যাগ নিয়ে গেল। ইমাদ ওর রুমে বসে আবার ইয়ারফোন কানে গুঁজে দিল। খানিক পরেই এলো বৃষ্টি। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ ক্রমশই তীব্র হতে শুরু করেছে।
_চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম