তারকারাজি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ (১৪)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
ভার্সিটির ক্লাস শেষে টিএসসিতেই আড্ডা জমিয়েছে নীলাশা ও তার বন্ধুরা। গ্রীষ্মসুলভ খরতায় চৈতালি দুপুরের রৌদ্র তখন সোনারঙা, চকচকে। নীলাশা অন্যমনস্ক হয়ে ফোনের পর্দায় খবর পড়ছে। এক ছটা স্বর্ণালি রোদের সরু রশ্মিতে মাঝে-মাঝেই চোখটা সংকুচিত হয়ে আসছে তার। অথচ ফোনের পর্দায় কী মনোযোগ এই মেয়েটির! সরে বসার প্রয়োজনবোধটাও কাজ করছে না তার মাঝে। তখন নিশান ডাকল,
“ ওই নীলু, সিঙ্গারা খাবি না-কি শেষ করে ফেলমু? ”
নীলাশার কর্ণকুহরে সেই কথা পৌঁছালেও মস্তিষ্কের বিপরীত সক্রিয়তা সেইটা ধরতে পারল নিমিষেই। সে নিশানের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, নিজ কথা তালগোল পাকিয়ে শুধালো,
“ কী? কী শেষ করবি? কী খাবো আমি? ”
নিশান বিরক্ত হয়ে আবারও প্রশ্ন করল, “ আরে সিঙ্গারা খাবি সিঙ্গারা? যেইডার শিং খাঁড়া খাঁড়া ওইডা খাবি? ”
তার গলাবাজিতে বন্ধুমহলটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তো থাকলোই সেই সাথে আশেপাশের মানুষগুলোকেও হাসতে দেখা গেল। লজ্জায় নিশানের মুখটা যেন চুপসে গেল একদম। একে তো চৈত্র মাসেও গরমের জ্বালায় মরমর অবস্থা আর দ্বিতীয়ত বান্ধবীকে ধমকাতে গিয়ে নিজের মান-সম্মানের উথাল-পাতাল দশা! তার উপর পিহুও সুযোগ বুঝে অভিব্যক্তি পোষণ করল,
“ দেখছিস দোস্ত? আকাশের দিকে থুতু মারলে সেইটা নিজের উপ্রেই পড়ে। এখনো সময় আছে সম্মান দিতে শেখ। পরে কিন্তু পস্তাইবি। ”
বান্ধবীর বলা হুল ফোটানোর জ্বালাময়ী কথাটা মাত্রাতিরিক্ত অসহ্য লাগল নিশানের কাছে। কে জানে আজ তার কেন এতো রাগ! তবে তার এই রণতরঙ্গের ন্যায় রাগকে একদমই অবজ্ঞা করে সানাম বলল,
“ রাগলে তো তোরে হেব্বি লাগে, দোস্ত? এক্কেরে বচ্চনের নায়িকা ঐশ্বরিয়া! ”
কথাটা বলেই সানাম যখন চোখ টিপে চাপা ঠোঁটে হাসল তখন হৈহৈ করে উঠল রিশান আর পিহু। ভ্রু জোড়া পুরু হলেও রাগান্বিত নিশান ভ্রু কুঁচকালেই তাতে নারীসুলভ বাঁক দেখা যায়৷ ব্যাপারটা একদিন হুট করেই খেয়াল করে পিহু। আর এই নিয়ে সানামের ঠাট্টা লেগেই থাকে সারাক্ষণ। সে তো মাঝে-মাঝে গানের সুর ধরে এই বাক্যটাও বলে,
“ রাগলে তোমায় লাগে ঐশ্বরিয়া। ”
কিন্তু নীলাশা চুপচাপ হজম করে নেয় সেইসব কথা। দেশে ফেরার এতোদিন বাদেও সে যে হিন্দী ভাষা স্পষ্ট বুঝতে পারে না, তা নিয়ে বাকি সবার মাথাব্যথা থাকলেও উক্ত মেয়েটির একদমই নেই। মাতৃভাষা বুঝলেই হলো। অন্যদেশের মাতৃভাষাতে আগ্রহ নেই তার। অথচ দেশে ফেরার পর কিছু কিছু বাঙালির ভঙ্গিমা দেখে তার বোধ হয়েছিল যেন, বাংলা ভাষার থেকে হিন্দীই তাদের অত্যধিক প্রিয়। এই যে স্বাধীনতা দিবস গত হয়… গত হয় বিজয় দিবস ও মাতৃভাষা দিবস, হিন্দী গানে মাতোয়ারা হওয়া যুবক-যুবতীদের দেখে তাচ্ছিল্যটাও কম করেনি সে। এ-দেশে ফিরে এমন অনেক কিছুই সে দেখেছে যা অন্তরে কাঁটা ফুটিয়ে দিত ভীষণ তীক্ষ্ণতায়। বুড়ো মানুষের রিকশা টেনে নিয়ে যাওয়াটা তো ছিল তার দেখা অন্যতম এক সকরুণ দৃশ্য। অথচ এখন এইসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে। কথায়-কথায় সর্বদেশীয় ভাষা বলাটাও কমে গিয়েছে বহুত কিন্তু স্বদেশীয় বাঙালিদের মতো বাংলাটা বলে উঠতে পারে না নীলাশা। হাজার-হাজার বাংলা সাহিত্যের বই পড়ার পর, অসাবধানতায় মুখ দিয়ে সাধুভাষা বেরিয়ে এলেও এদেশের সহজ ভাষাটা আয়ত্তে আসে না তার। তবুও সূক্ষ্মতম একটা চেষ্টা থেকে যায় নিজের সবকিছুকে আপন করে নেবার। এখন এটাই তো তার জীবন!
যাইহোক, সানামের ঠাট্টায় নিশান যখন রাগান্বিত ষাঁড়ের মতো ফুঁসছে ঠিক তখনই উপস্থিত ঘটলো সাইফের। অকস্মাৎ উপস্থিত হয়ে তার রিশানের পাশে বসা দেখে ঠিক কেমন অনুভূত হলো সানামের তা বোঝা গেল না সঠিক। তবে কিছুক্ষণ বাদেই তাকে দুর্বল কণ্ঠে বলতে শোনা গেল,
“ অফিস-টফিস তুঙ্গে তুলে দিছেন না-কি? ভার্সিটিতে ঢু মারতাছেন কেন? ”
সাইফের ব্যঙ্গাত্মক উত্তর, “ তোমার মুখ দেখতে। কেন, তুমি জানতা না— আমি এতোদিন তোমাকে না দেখে মরেই গেছিলাম প্রায়? হাহ্! ”
এই কথার প্রেক্ষিতে সানাম কিছু বলতে গিয়েও বলল না। বরং অন্য কথা বলল,
“ রাখেন, আপনার সাথে কথা বললেই তো আবার ঝগড়া হয়ে যায়! অতিথি মানুষ হয়ে আমাদের ভার্সিটিতে আসছেন-ই যখন, তখন আর আপনাকে বিরক্ত করলাম না। ”
সাইফ হালকা মুখ বাঁকিয়ে নিজের চুলে হাত চালালো। প্রচণ্ড তিক্ততায় বলল,
“ ছয় বছর রাজত্ব করে আসার পর তুমি আমাকে শোনাও যে, এইটা তোমাদের ভার্সিটি? অবশ্য কারে কী বোঝাই! এই ঘাড়ত্যাঁড়া মহিলাটা আর সোজা হবে না কোনোদিন। সোনা, ময়না, চান্দের কণা ডাকলেও না! ”
এইবার সানাম ফুঁসে উঠল। তার চোখের দীর্ঘ চাহনিতেই যেন অগ্নিকণা স্ফূলিঙ্গের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ছে। তবে সে বাঁকা চোখে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই সাইফ ফের বলে উঠল, “ ও বাবা! চোখও দেখি ত্যাঁড়া! উঁকিও মারতেছে আবার পিটপিট করেও দেখতেছে দেখি। ”
বন্ধুরা হেসে উঠল সাইফের কথা বলার ভঙ্গিমায়। সানাম রোষাবিষ্ট চোখে চেয়ে, আঙুল তুলে, রূঢ়ভাবে বলল,
“ ধুর মিয়া! আপনি ভালো কিছু ডিজার্ভ করার লোকই না। যান তো এখান থেকে! আমার আপনাকে এক মুহূর্তও সহ্য হচ্ছে না। ”
সাইফ গালে হাত দিয়ে বসে, সানামের দিকে মোহনীয় চাহনিতে তাকিয়ে থাকার অভিনয় করল। প্রায় সাথে সাথেই সানামের অধীরতাকে প্রচণ্ডে পরিণত করতে সে বলল,
“ কী সুন্দর তোমার কোকিলের মতো টোন! অথচ মেজাজ দেখো… কাকের মতোই কর্কশ। মাথার তার-তুরও তো মনেহয় ছিঁড়ে গেছে। ”
সাইফ ঠিক যতটা ক্ষিপ্ততা আশা করেছিল সানাম তার একভাগও প্রকাশ করল না। বদ্ধ ঠোঁটেই মেকি হাসল শুধুমাত্র। অদ্ভুত! এই দেড়টা বছর কেটে গেল অথচ মেয়েটাকে এমন স্থির হতে দেখেনি সে। হ্যাঁ, দেখেছিল একবার যখন তার ক্যামেরাটা ভেঙে ফেলেছিল সাইফ। অথচ ওর সাধের আরেকটি ক্যামেরা বরাবরের মতোই ঝুলে আছে ওর গলায়। তাহলে হঠাৎ এই ছন্নছাড়া মেয়েটার গল্পে এমন অদল-বদল আসছে কেন? সাইফ ধরতে পারে না সেই কারণ। আর ধরতে পারারই-বা কথা আছে না-কি? ছন্নছাড়া সানামের সর্বপ্রিয় জিনিসটি তার তার ক্যামেরা —এই ব্যতীত সাইফ তো আর কিছুই জানে না তেমন। নিজেকে প্রশ্ন করা সেই প্রশ্নদাতাটাও উত্তরহীন হয়ে বসে রয় কেবল। খুব ফাঁকা-ফাঁকা লাগছে সাইফের। মনে হচ্ছে কী যেন একটা নেই!
অঘোষিত নীরবতাকে ঠেলে নিশান প্রশ্ন করল,
“ আরে ভাই, নতুন গাড়ি কিনলা যে? তুমিও আবার বিয়ে-টিয়ের প্রস্তুতি নিতাছো না-কি? ”
সানামরা সবাই একবার ওই দূরের ছাইরঙা গাড়িটির দিকে তাকাল। অতঃপর দেখতে পেল সাইফের অভিব্যক্তি,
“ আরেহ না, বাবা কিনছে। আর গাড়ি কিনলেই বিয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হয় না-কি, ছাগল? ”
নিশান উত্তরহীন হাসল। তারপর যখন প্রশ্ন উঠল তার এখানে আসা নিয়ে তখন সাইফ বলল,
“ সোহার সাথে দেখা করতে আসছিলাম। ওই-ই যাওয়া-আসা করে গাড়িতে। আমাদের বাসাটা তো আর কম দূরে না! ওকে হোস্টেলে দিয়ে দিব ভাবতাছি। ”
তার কথাটা শ্রবণেন্দ্রিয় হতেই রিশান যেন বৈদ্যুতিক বেগে চমকে উঠল,
“ সোহা? ”
সাইফ শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল, “ হু, সোহা। আমার ছোট বোন। এইবার এডমিশন নিল না? ”
“ বাট ওর নাম না সাইমা? ”
“ হ্যাঁ, দুইটাই ওর নাম। ক্যান, তুই ভাবছিলি তোর সোহা? ”
সাইফ হেসে ফেলল। অথচ উপস্থিত পাঁচ বন্ধুদের মুখ ছিল থমথমে, ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি। না-জানি কতদিন পর এই অতি পরিচিত নামটি উতলা করে তুলল রিশানকে। তার মনে পড়ে যায় কক্সবাজার থেকে ফেরার পরবর্তী ঘটনাগুলো। কী বিষাক্ত আম্লিক স্মৃতি তা! যে মেয়েটার সাথে দিন-রাত কথা না বললে তার মনটা ছটফট ছটফট করতো, আজ সেই মেয়েটার সাথেই তার যোগাযোগহীন প্রহর কাটে। বিষাক্ততায় ডুবুডুবু মন সম্পর্ক ছিন্ন করতে দুটো দিনও সময় নেয়নি তখন। মেয়েটির সেই কী কান্না! ছলছলে চোখে অনুরোধ করেছিল সম্পর্ক ছিন্ন করার কারণটি জানাতে। তার কোনো দোষ থাকলে না-কি সে শুধরে নিবে নিজেকে। অথচ এই কথা শুনে আনমনে হেসে ফেলেছিল রিশান। দোষ তো আসলে সেই সদ্য কিশোরী খেতাব মুছে ফেলা মেয়েটির ছিল না! বয়স কুড়ির ঘরে পা রাখলেও মেয়েটির কিশোরী মন কেমন ছটফটিয়েই-না উঠেছিল একটি ধ্বনিতে,
“ আমি নিজেকে শুধরে নিব। তুমি কারণটা তো বলো একবার? ”
কিন্তু বন্ধু-বান্ধবদের সকল গোপন কথাও সোহাকে বলে দেওয়া রিশানটা সেদিন বলতে পারেনি নিজের মায়ের কথা। সর্বস্ব ছেড়ে এসে দু’চোখে ধু ধু মরুভূমি দেখা সে এবং তার বড় ভাইটা জানে— কতটা কষ্টে এখনও শরীরকে খাদ্য দিয়ে আত্মসম্মানের সাথে বেঁচে আছে তারা। কতটা কষ্টে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে পড়াশোনা করছে তারা। আমাদের জীবনটা যে এমনই এক রণক্ষেত্র! হয়তো ব্যক্তিভেদে শুধু যুদ্ধের কারণটাই থাকে ভিন্ন।
সোহার কোনো বড় ভাই নেই। তবে সহসা তার নাম শুনে মনে হয়েছিল যেন, সাইফ সেই সোহার কথাই বলছে যাকে রিশান স্ব-ইচ্ছায় হারিয়েছে বহুদিন আগেই। রিশানের অকস্মাৎ মনে পড়ল সোহারও এইবার এডমিশন নেওয়ার কথা! মেয়েটি বলেছিল তাদের ভার্সিটিতেই পড়ার জন্য অবিশ্রান্ত চেষ্টা করবে সে। তার কি আদৌ এখানে পড়ার সুযোগ হয়েছে? রিশান কেমন অপ্রস্তুত হলো। তা যদি হয় তো মেয়েটার চোখে চোখ পড়লেই যে সর্বনাশ!
এদিকে সাইফ চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। দাঁড়িয়ে নিজের শার্টের আস্তিন ঠিক করে বলল,
“ তাহলে তোরা কখন রওনা হবি, নিশান? আমি আর শিহাব আসব তোদের হেল্প করতে। ”
এই প্রশ্নে নিশান নিজেও একটু অপ্রস্তুত হলো। সায়ানরাই তাদের দুই ভাইকে প্রস্তাব দিয়েছে যে, তারা দুজন যেন সায়ানদের ভাঁড়া নেওয়া বাসাতেই থাকে। নিশানরা তো এই প্রস্তাব পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়েছিল! এই কাজটা করলে তাদের যে তুলনামূলক কম খরচ করতে হবে তা নিশানদের জানা কথা। কিন্তু সায়ানরা চায় আজ-ই যেন তারা জিনিসপত্র নিয়ে তাদের বাসায় চলে যায়৷ আজ এই মাসের শেষ দিন। অন্যদিকে অফিসের কীসের যেন ব্যস্ততা থাকায় পরবর্তী সময়ে নিশানদের সাহায্য করতেও ব্যর্থ হবে তারা। তাইতো এতো তোরজোর করে আজ-ই যেতে বলা হচ্ছে তাদের! কিন্তু নিশানরা আজ যেতে ঠিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না। সে রিশানের দিকে একপলক তাকিয়ে সাইফকে বলল,
“ আর দুইটা দিন পরে যাই, ভাই? আসলে একটু কাজ ছিল এখানে। ”
রিশান জানে কেন তার ভাইয়ের এরূপ আবদার। ওই মেয়েটা হুটহাট কোনো সন্ধ্যায় এসে উপস্থিত হয় তাদের হল-রুমের ঠিক জানালার সামনেটায়। সেদিনের পর এখনো অবধি দেখা মিলেনি মেয়েটার। হ্যাঁ, একদিন দেখেছিল তবে তখন মেয়েটা প্রস্থানের জন্য উদ্যত ছিল বলেই নিজেদের পরিকল্পনাটা আর বাস্তবায়ন করা হয়নি তাদের। এখন তারা যদি বরাবরের মতো হল ছেড়ে চলে যায় তো কীভাবে বুঝবে ওই মেয়েটা ঈশা না-কি অন্যকেউ? আর এই কথাটা স্পষ্টভাবে বলতেও পারছে না কাউকে। তাই ভাইয়ের মতো করে রিশানও সেই আবদার জুড়ে বসল। কিন্তু লাভ হলো না কোনোকিছুতেই। বড়ভাইদের মুখের উপর এতোবার ‘না’ শব্দটা উচ্চারণ করা নিতান্তই বেয়াদবি। হাজারহোক, তারা যে নিজ থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তাদের জন্য! তারা রাজি হলো আজ-ই তাদের স্থান বদল করতে। মেয়েটা ঈশা হলে নিশ্চয়ই তাদের না-পেয়ে খোঁজ করবে? হলের সকলকে না-হয় বলে দিয়ে যাবে বিষয়টা— যেন মেয়েটিকে তাদের নতুন ঠিকানা জানানো হয়। ঈশা হলে নিশ্চয়ই সেই ঠিকানা অবধি পৌঁছাতে চাইবে? যত যাই হয়ে যাক, এটাই যে তাদের শেষ চেষ্টা!
রুদ্ররোষে সূর্যের রূপ পাল্টাতে শুরু করেছে ইতোমধ্যেই। সাদা থেকে হরিদ্রাভবর্ণ ধারণ করেছে তার আকৃতি। নিশান-রিশানরা ব্যস্ত পায়ে উঠে দাঁড়ায় তাদের নিত্যদিনের কর্মসূচিতে মশগুল হতে। সাইফেরও ভীষণ তাড়া পড়ে তখন। অফিস থেকে পার্ট টাইমের ছুটি নিয়েছিল সে। এখন ক্ষিপ্রতায় ছুটে কর্মস্থলে উপস্থিত হওয়াটাই যেন শ্রেয়তর তার কাছে। এই অবধি সবটাই ছিল স্বাভাবিক। তবে এই তুষারশুভ্র মানবটি যখন সানামকে চোখের ইশারায় তার সাথে যেতে বলল তখন তা দেখে পিহু আর নীলাশার চক্ষুছানাবড়া! একটু আগেই-না দুজনে মিলে ঝগড়া করল? বিস্ময়ের মাত্রাটা অবশ্য এখানেই থেমে থাকল না। সাইফ চলে যাবার পর মিনিট দুয়েক যেতেই সানামও বিদায় নিল। যাওয়ার আগে বলল,
“ আমার একটা কাজ আছে। কয়েকটা জিনিস আনার জন্য চাচার বাসায় যাওয়া লাগবে। তোরা থাক তাহলে, আমি যাই। ”
অথচ পিছু করার পর দুই বান্ধবী ঠিকি দেখতে পেল— তারা ভার্সিটির বাইরে থেকে একসাথে রিকশায় উঠেছে। কী বড় ধোঁকা! সানামদের রিকশা চলে যেতেই নীলাশা পিহুর দিকে তাকাল। চোখের পরিধি বাড়িয়ে বলল,
“ সিংকিং সিংকিং ড্রিংকিং ওয়াটার! ”
পিহু তো আরও নাটকীয়তার সহিত নিজের দু’হাত মাথায় রেখে বলল,
“ হেইডা হামি কী দেইখা ফেলাইলাম, দোস্ত? এতো বড় মীরজাফরি? ”
তারা দু’জন বেশ কিছুক্ষণ একে-অপরের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা চালালো সবটা। সাইফের ব্যস্ততা নাটক, সানামের কাজ দেখানোটাও নাটক… তাহলে ঝগড়াটাও কি নাটক? একে-অপরকে সহ্য করতে না পারাটাও নাটক? রৌদ্রতপ্ত দুপুরের ভীষণ নির্জন অবস্থানে থেকে কী সাংঘাতিক চোর-পুলিশি খেলায় মেতে উঠল দুই সহচরী। যেন কৈশোরের এক স্মৃতি আজ ডায়েরির হলুদ পাতা থেকে বেরিয়ে ধরণীর সবুজে পরিণত হয়েছে। নীলাশার এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে সেই স্মৃতির কথা। এমন-ই তো ছিল হারানো প্রেমিকযুগল রিশান আর সোহার প্রণয়ের গল্প! ঠিক এমনই তো লুকোচুরি খেলা ছিল সেই গল্পের শুরুটায়! অথচ তা এখন ডায়েরির হলুদ পাতায় লেখা এক স্মৃতিই থেকে গেল কেবল।
শুধু রয়ে গেল কারো দীর্ঘশ্বাস…!
রয়ে গেল কারো দগ্ধ হৃদয়..!
#চলবে ইন শা আল্লাহ!