তারকারাজি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ-০২

0
1444

তারকারাজি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ-০২
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী

ফাল্গুনের ফুলগন্ধি ঝিরিঝিরি হাওয়ার স্পর্শ পেতেই মিশমির গায়ের লোম গোড়া থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার হঠাৎ এই শিহরণ শেষ শৈত্যের, লজ্জার না-কি লুকিয়ে-চুরিয়ে প্রিয়জনের সাথে ছাঁদে এসে দেখা করার এক নামমাত্র ভয়ের তা সত্যিই মিশমি গুলিয়ে ফেলেছে মুহূর্তেই। অত্যন্ত ধীর গতিতে রূপসী কন্যা তার মিঠে সঙ্কর্ষণে এগিয়ে চলল এক গুচ্ছ অন্ধকারে গুনগুনিয়ে গাইতে থাকা কৃশাঙ্গ পুরুষটির দিকে। তিহামের সেই গানের কলি বারবার ধরতে গিয়েও যেন ধরতে পারছে না মিশমি। বরাবর তা-ই হয়ে এসেছে! কিয়ৎক্ষণ বাদে সেই অহেতুক চেষ্টাকে পাশে রেখে, নিষ্ঠাবান মানুষটির অজান্তেই তাকে পিছন থেকে আলিঙ্গন করল সে। তিহাম বোধহয় ভয় পেয়েই হালকা চমকে উঠল। এটি বুঝতে পেরে মিশমি মৃদু নিঃস্বনেই হেসে বেশ খানিকটা দূরে সরে দাঁড়াল। আরও বেশ কিছু শীতের রাত ছিল তার এই হাসিটার সাক্ষী। তিহামকে মাঝে-মাঝে এমন অপ্রস্তুত করে মিশমি খুব ভালোই সুখানুভব করে। আর বরাবরই প্রেমিকার এই উদ্ভট কাণ্ডের পর তিহামের প্রত্যুত্তর হয়,

“ আমি সিরিয়াসলি ভয় পাই যে, এইটা আমার বউ না-কি পেত্নী! একদিন তোমার ভয়েই দেখবে মরে যাব আমি। ”

মিশমি তার হাসি থামাল। খুবই মিষ্টি স্বরে বলল,

“ বাজে কথা! তোমার আমাকে দেখা হয়ে গেলে এবার আমি যাই? আব্বু-আম্মুকে তালা দিয়ে আসছি। ”

তিহাম এই কথা শুনে একটু হাসল না-কি? মিশমির মনে হলো প্রত্যেক বারের মতো তিহাম এইবারও হেসে উঠল নৈঃশব্দ্যে। ঠিক সেই মুহূর্তেই তার মোলায়েম হাতটি টেনে, তাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিল তিহাম। অতঃপর মিশমির গ্রীবায় গভীর চুম্বন এঁকে বলল,

“ তোমার এখনো মনে হয় যে, আমি তোমাকে এতো সহজেই যেতে দিব? ”

তিহামের সেই সুগভীর চুম্বনে মিশমির গলদেশ যেন কণ্টকাকীর্ণ হয়ে উঠল। ঢোক গিলতেও বেজায় কষ্ট অনুভূত হলো মেয়েটির। হয়তো সম্পর্কের এই চার মাসে প্রেমিকের সর্বোচ্চ স্পর্শ সেই সুগভীর চুম্বন এবং বাহুডোরে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরায় নিজেকে অভ্যস্ত করে নেওয়ার সুযোগ ছিল মিশমির। কিন্তু সে পারে না সম্পর্কের এতটা গভীরতায় পৌঁছাতে যেখানে সম্পর্কটা মেনে নিতে তার প্রচণ্ড বেগ পেতে হবে। তবে মিশমি এ-ও মান্য করে যে, দুটি সম্পর্ক ঠিক থাকবে যখন দুজন মানুষ একে-অপরকে খুশিতে রাখবে। এখানেই যে চলে আসে মিশমির দীর্ঘশ্বাস…!
যাইহোক, প্রেমিকের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল মিশমি। কিন্তু তিহামের শক্তপোক্ত হাতের বাঁধনকে ভেঙে ফেলা এতটাই সোজা না-কি? বরং সেই কৃশকায় পুরুষটিকে নেশালো কণ্ঠে বলতে শোনা গেল,

“ তোমাকে সারাজীবন এভাবেই ধরে রাখব, মিশমি। দেখি তুমি ক্যামনে পালাও। ”

মিশমি হাসল। ব্যর্থ চেষ্টা ভুলে বলল,

“ তাই না-কি? তোমাকে ছেড়ে পালানোর ক্ষমতা কি আর রাখতে দিছো তুমি? আচ্ছা সরো এখন। আমাকে যেতে হবে, তিহাম। ”

তিহাম সরলো না। বরং তার হাবভাব বুঝে মিশমির মনে হলো যেন, তিহাম পারলে তাকে নিজের মাঝেই বদ্ধ করে রেখে দিবে। মিশমির অস্বস্তি হলো খুব। তবুও সে কোনো এক কারণবশত সরে দাঁড়াল না। কিয়ৎক্ষণ বাদে তিহামকে কেমন বিলাপের স্বরে বলতে শোনা গেল,

“ এই দেখো, কত কাছে এসেও তোমাদের বাসায় যাওয়া হচ্ছে না আমার। একদিন নিয়ে যাবা তোমাদের বাসায়? আমরা না-হয় সারারাত একসাথে কাটাবো আর ভোর হওয়ার আগেই চলে যাব আমি। কী বললাম বুঝলে? তোমার থেকে দূরে-দূরে থাকতে আর ভালো লাগে না আমার। ”

মিশমি ও-কথা শুনে কী বুঝল জানা নেই তবে সে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই বলল,

“ এর জন্যই তো বলি তাড়াতাড়ি পড়াশোনাটা শেষ করে, চাকরি-বাকরি পেয়ে বাসায় আসো। তুমি তো পড়াশোনার নাম-ই নাও না। আমার আর তোমার যে কীভাবে কী হলো! ”

এই মুহূর্তে মিশমির এহেন কথা বোধহয় পছন্দ হলো না তিহামের। সে বাচ্চাদের মতো হু-হা করে বায়না ধরল যে, সে মিশমির সাথে মিশমির-ই শোবার ঘরে একরাত কাটাবে। দুজন-দুজনকে আঁকড়ে ধরে অনেক গল্পগুজব করবে, চিরস্মরণীয় কিছু মুহূর্তের জন্ম দিবে। এইসব নানান আবদারে হঠাৎই মিশমির ঠোঁটের হাসি গায়েব হয়ে গেল প্রেমিকের বলা একটি কথা শুনে,

“ তুমি তো আমার গার্লফ্রেন্ড! এখন আমি তোমার কাছে আবদার করব না তো অন্য কোনো মেয়ের কাছে কী-করে করি বলো? আর আমরা তো শুধু একসাথে রাতটা কাটাবো। মানে ওইরকম কিছু তো আর করব না… ”

মিশমি বাকি কোনো কথা শুনতে পেল না। কর্ণকুহরে যেন ঝিঝি পোকার ঝিমঝিমে ডাকটা অত্যধিক জায়গা করে নিল। তিহামের এই কেমন কথার ধরণ? মিশমি বিস্মিত! এই চারমাসে যে কথা বলতে শুনেনি আজ সেই কথা শুনে তার হঠাৎই খুব কাঁদতে ইচ্ছা করল। তিহামের মুখে এহেন যুক্তি সে মানতে পারছে না। সে তো চাইতো যে, তাদের সম্পর্কটা সাধারণ হোক। কিন্তু তিহামের কথার ধরণ এতটা বিষাক্ত লাগছে কেন তার কাছে? না, মিশমির মাথা কাজ করছে না। সে যথাসম্ভব নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে স্পষ্ট করে বলল,

“ এই তিনটা বছরে নিশান-রিশানরাও বলতে পারবে না যে, ওরা আমার রুমে উঁকিঝুঁকিও দিয়েছে। সেখানে তোমার এমন আবদারটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না, তিহাম? অনেক কিছু অপছন্দ হওয়ার পরও তো মানিয়ে নিচ্ছি আমি। তাহলে তুমি কেন পারছো না? তুমি তো জানো আমি এইসব পছন্দ করি না। ”

উত্তর এলো। তিহামের সাথে মৃদু বিতণ্ডাও চলল এই নিয়ে। মিশমির না মানে না। সে নিজের নিজস্বতায় কোনো পুরুষ মানুষের উপস্থিতি মেনে নিবে না একমাত্র নিজের বাবা ও স্বামী ব্যতীত। হোক সে ভালোবাসার মানুষ! তাই বলে নিজের শোবার ঘরে নিয়ে যাবে তাও বাবা-মার ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিয়ে? ছিঃ, ভাবতে যতটা না ভয় লাগছে তার থেকেও বেশি ঘৃণা হচ্ছে মেয়েটির। এই ন্যাক্কারজনক কাজটি সে কোনোমতেই ঘটাতে পারবে না। এদিকে তিহামকে মানা করতে-করতেই যখন তার চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত হলো তখন তিহাম নিজেই বোধহয় থমকে যেতে বাধ্য হলো। প্রেমিকার চোখের পানি বোধহয় দেখতে ইচ্ছে করল না তার। তাকে বলতে শোনা গেল,

“ আমি কি তোমাকে জোর করছি মিশমি? জাস্ট কথা বলতেছিলাম আর তুমি এভাবে কেঁদে ভাসাচ্ছো যেন, আমি বাইরের একটা ছেলে হয়ে তোমাকে ব্ল্যাকমেইল করতেছি। এটা আমি আশা করি নাই মিশমি! তুমি যে আমাকে বিশ্বাস করো না তার প্রমাণ পেয়ে গেলাম আজকে। আমি সত্যিই ভাবি নাই যে, নিশানদের তুমি যতটা না বিশ্বাস করো তার এক বিন্দুও আমাকে বিশ্বাস করো না। এ-ই তোমার ভালোবাসা যেখানে কোনো বিশ্বাস-ই নাই? ”

কথাগুলো বলেই মিশমিকে চরম ভর্ৎসনার সম্মুখীন করে, সরে দাঁড়াল তিহাম। অতঃপর মিশমির কোনো কথা কানে না ঢেলে তার হাতটা ধরেই নিচে নামতে লাগল সে। দোতলায় মিশমিদের বাসা। দরজার সামনে মিশমিকে রেখে যখন তিহাম চলে গেল তখন তার বলে যাওয়া কথাটা হয়তো মিশমি ইহকালে কোনোদিনও ভুলবে না। সেই কথাটি ছিল,

“ বাসায় গিয়ে ঘুমাও। আর শোনো, তোমাকে আজকেই সব জায়গা থেকে ব্লক করে দিব। অযথা কল করে, অনলাইনে ঘুরে আমাকে খোঁজার জন্য নিজের টাইম ওয়েস্ট করো না। গুড নাইট এন্ড গুড বাই মিশমি! তোমার ওই মিথ্যে ভালোবাসার কথাটা আর শুনতে চাই না আমি। ”

মিশমিকে ঘিরে ধরল তীব্র আড়ষ্টতা। তিহামের করা এইসব পুরনো ভর্ৎসনায় সম্পর্কের এতগুলো দিনেও দৃঢ় হয়ে ওঠেনি মেয়েটির নরম অনুভূতি। দম বন্ধ হয়ে আসলো মিশমির। সামান্য কারণেই আসা চিৎকারগুলোকে ওষ্ঠাধরের তুলতুলে প্রাচীরের ওপাশে মজবুতভাবে আঁটকে রাখতে বাধ্য হলো মেয়েটা। চোখের সামনেই দেখতে পেল নিজের অধঃপতনের চিত্র! যে তিহামকে সে কঠিন শাসনে রাখত, আজ সেই তিহাম-ই বেশ শিখে গেছে তাকে নিজের আয়ত্তে রাখতে। এ-কেমন জঘন্যতম নিষ্ঠুরতা তার সাথে? মিশমি জানে… নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মানে যে, সে তিহামের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে বিরাট বড় ভুল করেছে। তবে মন যে বড়ই নির্লজ্জ! সে যে ক্ষণে-ক্ষণেই বলে ওঠে,

“ মিশমি? তোর ভালোবাসা কি সত্যিই এতোটা দুর্বল যে, ওই মানুষটাকে নিজের ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে পারবি না? ভালোবাসা তো পারে একটা মানুষকে পরিবর্তন করতে। তাহলে তুই কেন হাল ছাড়ার কথা ভাবিস? মিশমি, মানুষটাকে হাতছাড়া করে ফেললে এই অনুভূতির কড়া অনলেই যে তোর মৃত্যু নিশ্চিত! ধরে রাখ ওকে। তিহাম ছাড়া তুই বাঁচবিই-বা কী নিয়ে? ”

মিশমি ফুঁপিয়ে উঠল। তিহামের কথা অমান্য করে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করল মেয়েটি। কিন্তু কোনোভাবেই সেই মানুষটির সাথে যোগাযোগ করে ওঠা হলো না তার। এখন একটাই ভরসা… কাল ভার্সিটিতেই সবটা মিটমাট করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল মিশমি! তবে ভার্সিটিতে গিয়েই যে বন্ধুদের কাছে এভাবে ধরা পড়তে হবে তা মিশমি বুঝতে পারেনি। নীলাশা তো বলল,

“ দিস ইজ নট অ্যাক্সেপ্টেবল। যেইটা ওয়ার্কআউট করছে না সেইটাকে জোর-জবরদস্তি টিকিয়ে রাখার কি সত্যিই কোনো মানে হয়, মিশা? ”

মিশমি খানিকটা চমকে উঠল। জলবৎ মন থেকে উথলে পড়ল কষ্টের উষ্ণ বিষন্নতা। সে হাসার চেষ্টা করল একবার। কিন্তু সেই কাঁদো-কাঁদো মলিন ঠোঁট জোড়ায় হাসি ফুটলে তো…! বন্ধুদের অনেক উপদেশ পেল তাদের সম্পর্ক নিয়ে। পেল অনেক জিজ্ঞাসা তার এরূপ বিষন্ন চেহারার উপর। কিন্তু বন্ধুদের কাছে কী-করে স্বীকার করবে যে, তিহাম তার কাছে যে লজ্জাজনক আবদার করে বসেছিল তা প্রকৃতপক্ষেই চরম ঘৃণিত বলে মনে হয়েছে তার? সেই ‘পেট পঁচা পুঁটিমাছ’ আখ্যা পাওয়া মিশমি আজ এই সত্যিটা লুকিয়ে ফেলল নির্দ্বিধায়। তবে সে এইটা স্বীকার করল,

“ আমি যদি ওকে ছাড়া থাকতে পারতাম তাহলে তো কক্সবাজারেই ব্রেকআপ করে ফেলতাম। আমি ওকে ছাড়া কীভাবে থাকব, বল? পিহু, নীল, তোরা পারবি আদ্রাফ ভাইয়া আর আরাভ ভাইয়াকে ভুলে থাকতে? ”

মিশমির সহজ প্রশ্ন শুনে সানামের বিরক্তি আকাশচুম্বী হলেও তা প্রকাশ করল না সে। এই মেয়েটার আচরণে হয়তো কেউ-ই সহজে নিজের বিরক্তি বা রাগ প্রকাশ করে উঠতে পারবে না। তাই সানামের মতো স্পষ্টভাষী মেয়েটাও অত্যন্ত নরম স্বরে বলতে লাগল,

“ দেখ মিশ্শি, সব-সময় এতো তুলনা খাটে না। আদ্রাফ ভাই আর পিহু কিন্তু দুজন-দুজনকে বিশ্বাস করেই লং-ডিস্ট্যান্স রিলেশনশিপে আছে। আর সেইটাও কবে থেকে তা নিশ্চয় আমার থেকে তুই ভালো জানিস? আর নীলের কথা বলতেছিস তুই? শোন, নীল কিন্তু আরাভ ভাইয়ের সাথে রিলেশনশিপে নাই। সো এক তরফা ভালোবাসা নিয়ে নীল ভুলে যাবে কি যাবে না তা কিন্তু এতটাও বিগ-ডিল না যেখানে রিলেশনশিপে থাকা মানুষটার কাছে এটা বিগ-ডিল হয়। সেখানে তুই আর তিহাম এতটা কাছাকাছি থেকেও কীভাবে বিশ্বাস করা বা না-করা নিয়ে ঝগড়া করিস? অবশ্য আমি তো এতদিন ধরে দেখেই আসতেছি যে, ঝগড়া করে তিহাম তোকে নাচায় আর তুই সেইভাবেই নাচিস। ”

কথার শেষ অবধি এসে সানাম আর পারল না নিজের অনুভূতিকে ধৈর্য্য ধরে আঁটকে রাখতে। পিহু অবশ্য হাতের ইশারায় মানা করল যাতে এমন তীক্ষ্ণ কথা না বলে সে। সানাম মানল সেই মানা। তবে সেই সাথে আবারও একটা প্রশ্ন রাখল তাদের বৈঠকে,

“ আমি বুঝতেছি না যে, ওই ব্যাটা তিহাম শুধু এইটুকুর জন্য কমিউনিকেশন অফ করল? ওই মিশি, তোদের এই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রসঙ্গটা উঠল ক্যামনে রে? ”

মিশমি উত্তর দিল না। নীরবে চোখ বেয়ে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়তেই সে নিজেকে সামলে নেওয়ার হুলুস্থুল প্রস্তুতি নিতে লাগল। বন্ধুরা অবশ্য খেয়াল করেনি তা! তবে ছন্নছাড়া নিশানটাও আজ অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সহিত বলল,

“ দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দে। তুই সুন্দর দেখে বলতাছি না দোস্ত। তোর যা কোয়ালিটি! তোর পিছে সারি-সারি ছেলে পড়ে থাকবে। আর তুই ওই ধলা চামড়ার পিছনে ঝুলে আছোস? তোরে এইটা মানায় না। এইযে বলতাছোস তুই ওরে ছাড়া বাঁচবি না… এতো দিনের এতো ঝগড়ায় তুই কি মরে গেছিলি? কেউ কারো জন্য মরে না, মিশ্শি। উপর থেকে হুকুম না-আসা পর্যন্ত আমাদের বাঁচতেই হয়। তুই এতোদিন একটা রিলেশনে ছিলি তাই সেইটা ভাঙার কথা শুনলে তোর কষ্ট হবে, এইটাই স্বাভাবিক। আমারও হইতো আর যাদের হওয়ার তাদের সবার-ই হয়। এটা শুধুই সেই মানুষটার প্রতি তোর ফিলিংস ছাড়া অন্য কিছুই না। আর তুই তো ভাবিস যে, আমরা আন্টিরে নিয়ে খালি তামাশাই করি! কিন্তু একবারও কি ভাবছিস, তোর চোখমুখের অবস্থা খেয়াল করলে আন্টির ধারণা করতে বিন্দুমাত্রও সময় লাগবে না যে, তুই কোনো রিলেশনশিপে আছিস? আন্টির চোখ না তো শিকারীর চোখ! এতো কথা সামনে চলে আসলে কী করবি তুই? ”

মিশমি ভীত হলো বেশ। আর যাইহোক, ঝুমুর বেগমের চোখকে ফাঁকি দিতে নিজেকে সামলেই রাখতে হবে তার। কিন্তু মিশমি তো মিশমিই! সে চিরবিশ্বাসী যে, ভালোবাসা দিয়ে মানুষকে পরিবর্তন করা সম্ভব। তাই সে ছোট্ট করেই উত্তর দিয়েছিল যে, তার বন্ধুরা যাতে তাকে ভুল না বোঝে। সে আরেকটু চেষ্টা করতে চায় তিহামকে বোঝানোর। মিশমির সেই আবেগী কথার পিঠে কেউই আর কোনো কথা চাপাতে পারল না। নীলাশা অবশ্য চেষ্টা করল কারণ, সে বন্ধু হয়ে বন্ধুর কোনো ক্ষতি চায় না। তবে তার মতো করে বন্ধুদের আর কেই-বা ভালোবাসে?

বাকি বন্ধুদের মানায় নীলাশাও থেমে যেতেই সকলের ঘরে ফেরার তাড়া পড়ল। কাল একটা পরীক্ষা আছে। বই নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব পড়তে বসে যাওয়া যায় ততোই যেন মঙ্গল তাদের! তাই নীলাশা বাড়ির পথে পা বাড়ালেও মিশমি ছুটে গেল তিহামের ডিপার্টমেন্টের দিকে। প্রেমিকের সাথে দেখা না করে যাবে না সে। অন্যদিকে বাকি চারজন ফিরে গেল তাদের হলে। কিন্তু বান্ধবীর এহেন বোকামো রিশানের মাথা থেকে বিতারিত হলো না। হলে ফিরে পড়া তো হলোই না বরং মাথায় যত আজগুবি চিন্তা গুঁজে নিয়ে জানালার মুখে দাঁড়িয়ে রইল সে। দুপুর থেকে শুরু হবে তাদের তিন-তিনটে ব্যাচ পড়ানো। নিজেরাই তো পড়াশোনা করতে চায় না। সেখানে প্রতি ব্যাচে বিশজন করে পীড়াদায়ক বাচ্চাগুলোকে যে কীভাবে পড়াতে হয় তা তারাই বোঝে। নিশান তো বাবা ভীষণ ধমকি-ধামকিও করে বাচ্চাদের! তার এতো ধৈর্য্য আছে না-কি? তবুও এটাই তো জীবনের সূত্র! চলুক বা না-চলুক, চালিয়েই নিতে হয়।

রিশান হাসল। নিজের ভাবনাটা তার পছন্দ হলো বেশ। বিড়বিড়িয়ে সেই কথাটিই আওড়াতে লাগল সে, “ চলুক বা না-চলুক, চালিয়েই নিতে হয়…। ”
পর-পর সাতবার কথাটি আওড়ানোর পর রিশানের উদাসীন চোখ দুটো স্থির হলো রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ের উপর। হলে এসেছে পর্যন্ত রোজ-ই মেয়েটিকে ওই নাম না-জানা গাছটির তলায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে তারা। মেয়েটি তাদের ঘরের জানালার দিকেই তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ। সালোয়ার-কামিজ পরিহিত মেয়েটির মুখে সাধারণ মাস্ক ও মাথায় ঘোমটা টানা। রিশানরা দুই ভাই মিলে তাদের রুমমেটকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে, মেয়েটি আগেও আসতো কি-না। সে উত্তর দিয়েছিল,

“ না তো, এই মাইয়ারে আগে দেখছি বলে তো মনে হয় না। তোরা আসার পর-ই তো দেখি দাঁড়ায় থাকে এখানে। বোধহয় তোরে নাহলে নিশানরে লাইন মারতাছে। ”

মেয়েটিকে নিয়ে কৌতূহল বাড়তেই রিশান ভাবল একবার কথা বলে নিবে। কিন্তু তা আর হলো কই? নিচে যাওয়ার আগেই মেয়েটিকে রিকশা ঠিক করতে দেখা গেল। রিশান অবশ্য গলা উঁচিয়ে বলল,

“ এক্সকিউজ মি? ”

মেয়েটা বোধহয় চমকেই তাকাল তার দিকে। একটু ভয়-ও পেল বলে মনে হলো না? রিশান বলল,

“ একটু দাঁড়ান। আপনার সাথে কথা আছে। ”

মেয়েটিকে ভদ্রতার সাথে থামতে বলে যে রিশান কত বড় ভুল করেছে, তা সে বুঝতে পারল যখন মেয়েটি রিকশাওয়ালাকে তাড়া দিয়ে ক্ষিপ্রতার সাথে চলে গেল চোখের অগোচরে। চলে গেল না-কি পালিয়ে গেল তা নিশ্চিত হতে অবশ্য দারুণ বেগ পেতে হলো এই ভাবুক যুবকটিকে। তার চিন্তাশক্তি বিস্ময়ে গোলমেলে হয়ে পড়ল। রিশানের মনে শুধু একটাই প্রশ্ন জাগল, কে ওই মেয়েটা? কার জন্যই-বা তার চাতক পাখির মতো প্রচণ্ড বর্ষার তৃষ্ণা?

#চলবে ইন শা আল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here