তারকারাজি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ,পর্ব-০৩
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
গাঢ় লালচে সূর্যটা তখন অস্তমিত। পার্কের ক্ষুদ্র জলাশয়ে তার নিখুঁত আকৃতিটা ফুটে উঠেছে অত্যন্ত প্রত্যয়পূর্ণ রূপে। কী গভীর তার পরিধি! যেন কোনো শহীদের রক্ত শুষে নিজের পরিধির রঙ গাঢ় করেছে সূর্যিমামা। নীলাশা জলে জ্বলা সূর্যের রূপে মুগ্ধ হয়ে বেশ প্রয়োজন বোধ করছে তার কাব্যিক চেতনার। দুটো কাব্যিক, ছন্দ-প্রদর্শিত বাক্য এখানে না-বললেই হচ্ছে না যেন! কিন্তু কীভাবে সাজাবে সেই দুটো বাক্য? বাংলার অসীম শব্দভাণ্ডারের শব্দগুলোকে অদৃশ্য বলেই মনে হলো তার। ওই সূর্যের প্রতিচ্ছবি দেখা ছাড়া আর কিছুই করার আকাঙ্ক্ষা যেন জাগছে না তার মনে। তখন নিজ ভাবনায় নিবিষ্ট রমণী হঠাৎই খেয়াল করল তার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো কারো মসৃণ হাত সযত্নে সরিয়ে রাখল কানের পাশে। অতঃপর তার স্বভাবসুলভ শান্ত কণ্ঠে বলল,
“ তোর এই চুলগুলা আঁটকায় রাখতে পারিস না? শুধু শুধু বাতাসে উড়ে আর জট পাকায়। ”
নীলাশা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল মিশমির কথা শুনে। বেশ স্পষ্ট করে বলল,
“ কী করব? তোর মতো জনম-সুন্দরী তো হতে পারলাম না তাই কাটছাঁট করে সুন্দরী হওয়ার ট্রাই করছি। ”
মিশমি বলল, “ জনম-সুন্দরী? আজ মরলে কাল কঙ্কাল আর তুই কি-না সুন্দর হওয়ার কথা বলিস? ”
মিশমি তার কথা শেষ করতে না-করতেই সানামের ডাক পড়ল। ক্যামেরা হাতে নিয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত সে। তারা দুই রমণী যখন পিছন ফিরে তাকাল তখনই ঝটপট কয়েকটি ছবি তুলে নিল সানাম। নীলাশা খানিকটা গলা উঁচিয়েই তাকে কাছে ডেকে বলল,
“ তোর ফটোগ্রাফিটা প্রফেশনালি নেওয়া উচিত সানাম। কেন শুরু করতেছিস না? ”
সানাম এগিয়ে এলো তাদের দিকে। দুই বান্ধবীকে দুই দিকে ঠেলে, ঠিক মাঝখাটায় বসে পড়ল সে। অতঃপর সহর্ষে উত্তর দিল,
“ আরে ধুর! প্যাশনকে প্রফেশন করে কী লাভ? পরে দেখবি আমার এমন অবস্থা হবে যে, ছবি তুলতেই বিরক্ত লাগবে। ”
পিহু হেসে বলল, “ হ দোস্ত, তুই তো আবার এই একটা কাজের কাজ-ই পারিস খালি। সেইটা বন্ধ করে দিলে তো তোরে মানুষ-ই মনে হবে না। ”
সানাম তেতে উঠল, “ তাও তো একটা কিছু পারি! তোর মতো একেবারেই অষ্টরম্ভা তো আর না। ”
সানামের উপরোক্ত উক্তিটি মানল না পিহু। শুরু হলো তাদের তর্ক-বিতর্ক। ঝগড়ায় যে সানাম সবচেয়ে এগিয়ে তা পিহুর জানা। তবুও মেয়েটার সাথে বাজাতে তাদের বেজায় ভালো লাগে। তাদের এই তর্কে-তর্কেই কেটে গেল কয়েকক্ষণ। নীলাশা এবার একটু বিরক্ত হয়েই উচ্চবাচ্যে বলে উঠল,
“ স্টপ ইট ইয়ার! ঝগড়াটা থামিয়ে একটু খোঁজ তো নিবি, নিশানরা আসবে কি-না? ”
সানাম মাছি তাড়াবার ভঙ্গিমায় হাত নেড়ে বিজ্ঞদের মতো বলল, “ আব্বে ওদের পড়ানি বাকি আছে। ওরা আসবে না এখন। ”
এ-কথা শুনে নীলাশার মনটা বোধহয় নিষ্প্রভ হতে-হতেও হলো না। এখানে ওদের দোষারোপ করে লাভ নেই কোনো। বিদেশে বসবাসরত অবস্থায় নীলাশা একটি গান শুনেছিল,
‘ পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়/
ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা,
সে কি ভোলা যায়? ’
বর্তমানে ফাল্গুনী বিকেলের ঝরঝরে হাওয়ার দোলায় নীলাশার মনটা গুনগুনিয়ে উঠছে এই কলিতে। বেশ তো ছিল বন্ধুত্ব! অপরিপক্ব অন্তরে রং-বেরঙের পাখিদের মতো উড়ে বেড়ানোর বাসনাতেই তো ছিল সুমিষ্ট কিছু অনুভূতি। একে-অপরের জন্য কলিজা ছিঁড়ে ফেলার মতো তারুণ্য আবেগও ছিল সেই বন্ধুত্বে। তবুও যে হায়… বেড়ে চলে সংখ্যার ধাপ! এক এক করে পেরিয়ে নীলাশা ও মিশমির সাথে নিশানদের বন্ধুত্বের তিনটে বছর নিকাশ হয়েছে। বন্ধুত্বের বয়স বাড়ার সাথে-সাথে অবুঝ আবেগগুলোও যেন পরিপক্ব হয়ে যাচ্ছে ক্রমে-ক্রমে। নবজাতক শিশু যেমন তিন বছরে ঘুটঘুটিয়ে দৌড়াতে থাকে, তেমন বন্ধুত্বের সেই নবজাত আবেগগুলোও যেন হন্তদন্ত স্বভাবে দৌড়ে জানান দিচ্ছে যে, সে সারাজীবন নবীনের অবুঝটি থাকতেই সৃষ্টি হয়নি। এই সত্যকে মানতে পারাটা সবার জন্য খুব সহজ হলেও হতে পারে। কিন্তু এই বন্ধুপাগল মেয়েটার মনে হয়— সেই অবুঝ বন্ধুত্বটিই শতগুণে যুক্তিসিদ্ধ ছিল। পাখিদের মতো মৃত্তিকার আসমানে উড়ে বেড়ানোর যে স্পৃহনীয় গল্প লিখেছিল তারা; আজ তা রাবীন্দ্রিক ভাষ্যমতে শুধুই পুরানো দিনের কথা! কী আর করার… পাখিরা যতই উড়ে-ঘুরে, বেড়িয়ে চলুক না-কেন, তাদের যে একদিন না-একদিন নীড়ে ফিরতেই হয়!
নীলাশা জলাশয়ের উপর ভাসমান সূর্যের প্রতিবিম্বের দিকে দৃষ্টিপাত করল। একি! ও যে ইতোমধ্যেই লুকিয়ে পড়েছে তার গুপ্ত ঠিকানায়। তবুও সেই পানে চেয়ে মেঘের গায়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা রক্তিম আভার আকাশটাই জলে দেখতে লাগল সে। নীলাশার মনটা বোধহয় দ্বিধায় পড়ল নিজের অনুভূতিকে নিয়ে। তার বাস্তবতা মেনে খুশি থাকা উচিত, না-কি কৈশোরের সেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বন্ধুটি হয়ে বন্ধুদের একত্রে দেখার তৃষ্ণায় ধুঁকে মরা উচিত? এ যেন নীলাশার কাছে এক জটিল সমীকরণ! এই সমীকরণ চট করেই মিলাতে পারল না সে। তাই শুধু রাবীন্দ্রিক ভাষায় গুনগুনিয়ে প্রকাশ করে গেল নিজের আবেগপ্রবণ ইচ্ছে,
‘ আয় আর-একটিবার আয় রে সখা,
প্রাণের মাঝে আয়/
মোরা সুখের দুখের কথা কব,
প্রাণ জুড়াবে তায়। ’
“ কী এতো বিড়বিড় করিস? ” সানামের তীক্ষ্ণ প্রশ্নে মনোযোগ ফিরে পেল নীলাশা। দুর্বল কণ্ঠে উত্তর দিল যে, সে কিছু ভাবছে না। ফের সানামকে বৈদ্যুতিক বেগে বলতে শোনা গেল,
“ ও হ্যাঁ… তোরে তো একটা কথা বলতেই ভুলে গেছিলাম রে, লাল-নীল! ”
নীলাশা বিরক্তি প্রকাশ করে প্রত্যুত্তর করল,
“ আগে আমার নাম ঠিক করে বল আর তারপর কথাটা ঠিক করে বল। ”
সানাম মুখ বাঁকিয়ে প্রথমে বলল, “ উঁহ! যেই না চেহারা, নাম রাখছে পেয়ারা। ”
তার এহেন কথায় এবং কথা বলার ভঙ্গিমায় বাকি দুজন হেসে উঠলেও নীলাশাকে ফুঁসে উঠতে দেখা গেল। তবে সে তার রাগ প্রকাশ করার আগেই সানাম তার কথাটি বলতে লাগল যা সে জানাতে চেয়েছিল নীলাশাকে। সানাম তার বান্ধবীকে বলতে লাগল সেই সকল কথা যা সমুদ্রসৈকতে বসে প্রিয়তমা নীলাশার সম্পর্কে ব্যক্ত করেছিল আরাভ। সেই সকল কথা জেনে নীলাশার উষ্ণ অনুভূতি যেন মুহূর্তেই ফুটন্ত পানির মতো বুদবুদিয়ে উঠল। সে অত্যন্ত গাম্ভীর্যের সাথে বলল,
“ হুয়াট! ডিড হি রিয়েলি স্যায় দ্যাট? ”
সানাম মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাতেই পিহু নাটকীয় ভঙ্গিমায় বলল,
“ হাউ সুইট ম্যান হি ইজ! বোইন, তোর উপ-জামাইরে এতো ভালো হইতে কে বলছিল, বল তো? ”
এই কথা শুনে মিশমি নাক সিঁটকে বলল,
“ এই, উপ-জামাই মানে কী? ”
“ জামাইয়ের একটা ভিন্ন বিপরীত শব্দ আবিষ্কার করলাম। মানে যেইটা জামাই হবে-হবে ভাব, কিন্তু জামাইটা হয় নাই। ”
সানাম হাসল। হাসতে হাসতেই বলল, “ দোস্ত, তোর আবিষ্কার শুনে বাংলা ভাষার বিশেষজ্ঞরা তো হার্টফেল করতো! জেলার মধ্যে যেমন উপজেলা থাকে, জাতির মধ্যে যেমন উপজাতি থাকে তেমন তুই উপ-জামাই বের করতেছিস? ছিঃ ছিঃ ছিঃ। এর থেকে তো আমাদের ব্রিটিইশ্শা নীলশাক-ই ভালো বাংলা বলতে পারে। হাঙ্গামারে হাঙ্গা! ”
ওরা তিনজন হাসল। শুধু চুপচাপ বসে থাকা মেয়েটা বরাবরের মতো আজও অভিমান করে গেল। বন্ধুরা যাচ্ছেতাই বলুক। তাই বলে আরাভ…? নীলাশার মনঃক্ষুণ্ন হলো খুব। সে তপ্ত অনুভূতি বুকে আগলে রেখেই বলল,
“ তোরা থামবি? ঠোঁটপালিশ, তুই এই খবর জানলি ক্যামনে? ভুয়া-টুয়া না তো? ”
সানাম আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে উঠল, “ আরেহ না, রোহান ভাইয়ের থেকে শুনছি। এক্কেরে খাঁটি খবর! খালি তোরে গরম-গরমই দিতে পারি নাই। ”
নীলাশা আর কোনো প্রশ্ন করল না তাকে। বাকি বান্ধবীদের সাথে কথাও বলল না খুব। দু’গালে বসে যাওয়া ম্লানিমার আভাটা লুকিয়ে পড়ল সেই সূর্যিমামার মতোই। রক্তিম আকাশটাকে রাত্রির রঙে পরিবর্তিত হতে দেখতে লাগল সে৷ কেমন যেন নীলাভ ধূসর রঙ ধারণ করল দ্বিতীয় সন্ধ্যার আকাশ! তখন আরাভকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই কিছু একটা মনে পড়ে গেল তার। হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বার কয়েক পলক ফেলল মেয়েটি। হঠাৎই তার তাড়া পড়ল খুব। এই মুহূর্তে কোথাও একটা যেতে হবে মানে তাকে এক্ষুনিই যেতে হবে। মিশমিদের বিদায় দিয়ে সে সোজা ছুটে চলল পার্কের শেষ ফটকে। ড্রাইভার ভাইজান গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে তার জন্য। তবে তাতে নীলাশার কী যায় আসে? তার যে তাড়া পড়েছে! তাকে এক্ষুনি পৌঁছাতে হবে সেই কাঙ্ক্ষিত স্থলে।
ঠিক সন্ধ্যার মধ্যভাগে বন্ধুমহলের আড্ডা থেকে উঠে দাঁড়াল আরাভ। জবজবে ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত মুখশ্রীতে তখন বাসায় ফেরার অভিলাষ। সে চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে এগিয়ে চলল ফেরার পথে। পাশে পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে চলা বন্ধু শিহাবের সাথে এ-বিষয়ে ও-বিষয়ে আলাপ করতেই মগ্ন থাকতে দেখা গেল যুবককে। তবে এক মুহূর্তে এসে, সেই আলাপে হঠাৎ কথার সুতো ছিঁড়ে শিহাবকে বলতে শুনল আরাভ,
“ ওইটা নীলাশা না, বন্ধু? ”
আরাভ মুহূর্তেই মনোযোগী হয়ে উঠল শিহাবের কথায়। ও নীলাশার নাম শুনল বলে মনে হলো না? সে ভ্রু কুঁচকে তার ঝনঝনে কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, “ কই? ”
শিহাব ইশারা করল ঠিক তাদের সামনের ওই দূরে। বঙ্গীয় যুবতীদের মতো সালোয়ার-কামিজে অত্যন্ত সাধারণ তবে সুরূপার বৈশিষ্ট্য বিশিষ্ট রমণীটি আঁধারের মাঝেও নিজের ক্ষিপ্তবৎ চেহারাকে প্রকাশ্যে এনে হেঁটে আসছে তাদের দিকে। এই অসময়ে ভার্সিটিতে নীলাশার উপস্থিতিতে অবাক হয়নি আরাভ। তবে সে আশ্চর্যান্বিত হয়েছে এটা দেখে যে, নীলাশা ব্রহ্মাণ্ডময় অভিমানে নিজের মুখশ্রীকে মলিন করে তার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে এগিয়ে আসছে যেন, সে কোনো গুরুতর অন্যায় করে ফেলেছে। নীলাশা তখন একদম সামীপ্যে। আরাভ মনে-মনে প্রস্তুতি নিয়ে নিল নীলাশাকে প্রশ্ন করার। তবে একি! আরাভের প্রশ্নের আদিতেই নীলাশা তার ডান হাত উঁচিয়ে, থামিয়ে দিল তাকে। অতঃপর যথামুহূর্তে নিজের পাঁচ আঙুলের গণনায় অত্যন্ত গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল,
“ ফাস্টলি, আপনি আমাকে একশো একটা কিছু দিবেন তা বিবেচনা করে আমি আপনাকে ভালোবাসিনি। সেকেন্ডলি, আমি না চাইতেও আপনি আমাকে কিছু দিবেন তার আশা নিয়েও আমি আপনাকে ভালোবাসিনি। থার্ডলি, আমি সবকিছু ছেড়ে আপনাকে চেয়েছি। কোনো এমপ্লোয়ি চাইনি যে, টুঁ শব্দ করার আগেই তাকে তা হাজির করে দিতে হবে নয়তো তার চাকরি চলে যাবে। ফোর্থলি, আপনি দুনিয়ার সব কিছু বুঝে নেওয়ার পরও এটা বুঝলেন না, আর পাঁচটা রিচ ফ্যামিলির মেয়েদের মতো বড় না হয়েও কী-করে কেউ সাধারণ মানুষের মতো থাকতে পারে? কী-করে বাকি পাঁচটা মেয়েদের মতোই তাদের সাথে মিশতে পারে? সানাম, পিহু, মিশমি… ওরা কি আমার-ই বন্ধু না? নিশান-রিশান, যারা রক্ত পানি করে খেঁটে চলেছে… ওরা কি আমার-ই বন্ধু না? অথচ আপনি এমন একটা যুক্তি দেখালেন যেন আমি কোনো এলিয়েন! কোনো মানুষের কাতারেই পড়ি না আমি, তাই না? ”
নীলাশা হাত নামিয়ে নিজের তীক্ষ্ণ চাহনি স্থির করল আরাভের চোখে। ওই হতভম্ব দু’চোখে চেয়েই দু’ফোটা অশ্রু বিসর্জন দিল অভিমানিনী। এই অশ্রু আরাভের করা প্রত্যাখ্যানের নয় বরং জেদী নীলাশার একটুকরো অভিমান কেবল। ব্যবসায়ী জীবনে বাবার সফলতা ও সেই বাবার সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে নিজের মেয়েকে ভালোবাসাটা কেন মানুষের কাছে বিরাট বড় কারণ হয়ে দাঁড়াবে? বন্ধু, প্রতিবেশীদের ফেলে আরাভও যে এহেন চিন্তা-ভাবনা ধারণ করবে তা নীলাশা এখনও মানতে পারছে না। এদিকে আরাভ পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে নীলাশার এহেন বাচ্য আক্রমণে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ল। ওষ্ঠদ্বয় যেন কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে না! শিহাবটাও বাঘিনী নীলাশার রূপ দেখে সরে দাঁড়িয়েছে। যেন কাছে থাকলে এই বাঘিনীর হাতেই তার প্রাণ যাবে নিশ্চিত!
তবে আরাভ যখন কিছু বলার জন্য সক্ষম হলো তখন নীলাশাকে দেখা গেল— ফের তাকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে দু’কদম এগিয়ে আসতে। এতো কাছ থেকে আরাভের চোখে চোখ রাখতে নীলাশাকে গোড়ালি উঁচিয়েই দাঁড়াতে দেখা গেল। আরাভ যে তার তুলনায় একটু বেশিই লম্বা! অতঃপর নীলাশা তার ডান হাতের পাঁচ আঙুল মেলে ভীষণ অভিমানের সহিত বলে উঠল,
“ এন্ড ফাইনালি, আত্মসম্মান খালি আপনার-ই আছে? আমার কোনোদিনও ছিল না, তাই না? আই ওন্ট্ লাভ ইউ অ্যানিমোর, গায়ক সাহেব। ”
নীলাশা গোড়ালি ফেলল। এক মুহূর্ত ব্যয়ে হাঁটতে লাগল ফিরে যাওয়ার পথে। অপ্রত্যাশিত ঘটনায় স্তব্ধীভূত আরাভ প্রিয়তমার যাওয়ার পথে তাকিয়েই ভাবতে লাগল সেই দিনগুলোর কথা। যেই আরাভকে দেখলে লজ্জায় মরমর নীলাশা বাচ্চাদের মতো দৌড়ে পালাতো, আজ সে কেমন বীরাঙ্গনা রূপে এসে বলে গেল যে, সে আরাভকে ভালোবাসে। মেয়েটা কি খুব বেশিই ক্ষিপ্ত হয়েছে আজ? কোনো এককেই কি সেই ক্ষিপ্ততা পরিমাপ করা সম্ভব না? আরাভ পিছু থেকে ডাকল একবার,
“ নীলা! ”
“ আমায় ডাকবেন না আর। ”
চকিতেই ওই ছুটন্ত অভিমানিনীর উত্তর পেয়ে আর পিছু ডাকা হলো না আরাভের। সে সত্যিই ভীষণ আশ্চর্যান্বিত! নীলাশার কথা শুনে মনে হলো যে, সে সেদিনকার কথাগুলো জেনে গিয়েছে। তাকে জানালো কে? আরাভের মন স্পষ্ট উত্তর দিল- এহেন গণ্ডগোল সৃষ্টি করা নিশ্চয়ই তনয়ের কাজ!তাকে তো সে দেখে নিবে৷ তবে এই মুহূর্তে কী করবে না-করবে তার কিছুই যেন মস্তিষ্কে স্থির করতে পারছে না সে। এমন সময় শিহাব এসে পাশে দাঁড়াল আরাভের। বন্ধুটা চট করেই ফিসফিসিয়ে বলে দিল,
“ আব্বে শালা, ওরে আঁটকাবি তো? তোর বাস চলে যাচ্ছে আর তুই ব্যাটা কন্ডাকটর এইখানে খাঁড়ায়ে কী করোস? শোন আরাভ, সুযোগ কিন্তু দ্বিতীয়বার না-ও আসতে পারে। ওর সাথে কথা বল। ”
আরাভ একবার শিহাবের দিকে তাকাল। তার আদৌ নীলাশার সাথে কথা বলা উচিত কি-না তা নিয়ে এখনো ভাবতে লাগল সে। কিন্তু ফলাফল? তার তাড়াহুড়োর ফলাফল শূন্য না-হয়ে পারল না। শেষমেশ শিহাবের মুখে অকথ্য গালিগালাজ শুনেই অশ্বের ন্যায় দৌড়ালো আরাভ। পৌঁছেও গেল নীলাশা অবধি! সে নীলাশার মসলিন হাতটা ভীষণ যত্নে ধরে, তার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে লাগল। সে অবশ্য হাত ধরার মুহূর্তে কাল্পনিক কথামালা-ও সাজালো যে, নীলাশা রেগেমেগে বলবে,
“ আমার হাত ছাড়ুন, গায়কবাবু। আপনার সাথে আমার আর কোনো কথা থাকতেই পারে না। ”
কিন্তু না, তা হলো না। ফাল্গুনী পূর্ণিমার সেই নৈসর্গিক সৌন্দর্যের উদাহরণ— চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় হাতে হাত রেখে, মনের অত্যন্ত নিভৃতে কিছু মিষ্ট অনুভূতিকে আগলে, হেঁটে চলেছে তারা। কথা হলো না তাদের। অথচ তাদের নির্বিকারে হেঁটে চলা দেখে পিছে দাঁড়িয়ে থাকা শিহাবের মনে হলো যেন, তাদের নিজেদের সেই পদধ্বনিতেই একসাথে পথ চলার প্রতিজ্ঞার বিশুদ্ধ বাক্যে নিজেদের আবদ্ধ করে নিচ্ছে তারা।
চলবে ইন শা আল্লাহ!