তারকারাজি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ (০৬)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
মন কেমন করা বিষন্ন সন্ধ্যায় বাড়ির ব্যাক ইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে আছে নীলাশা… মজবুত একটি স্তম্ভে ঠেস দিয়ে, অত্যন্ত আনমনে। দখিনা হাওয়ায় দু’কাঁধের পাশ দিয়ে উড়ে চলেছে তার রেশমি চুল। কী যেন ভাবছে সে! অথচ কী ভাবছে তার অস্তিত্বও ভুলে যাচ্ছে মুহূর্তেই। বিকেলের মিইয়ে আসা থেকে শুরু করে সায়াহ্ন পর্যন্ত এখানেই অবস্থান করা সেই ভাবুক নীলাশার হুঁশ ফিরল তখন, যখন দুটো হাত খুব যত্ন করে তাকে আগলে ধরল পিঠ-পিছন থেকে। নীলাশা চমকালো বেশ। কম্পমান বক্ষে দু’হাত রেখে ছিটকে দূরে সরে গেল। অতঃপর তাকে চমকে দেওয়া ব্যক্তিকে দেখে সে স্তম্ভিত কণ্ঠেই বলে উঠল,
“ গায়কবাবু, আপনি? বাট হাও? ”
সামনের শ্যামবর্ণ পুরুষটি তার নিচের পুরু ঠোঁট কামড়ে ধরে, বেশ অম্লানে হাসল। অতঃপর চুলে সর্ব আঙুল চালিয়ে বলল,
“ ভাবলাম বিষাদপ্রিয়াকে একটু চমকে দিই! মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ”
নীলাশা উত্তর দিল না। তার প্রখর বায়না— আরাভকে বলতেই হবে হঠাৎ এমন সময়ে তাদের আঙিনায় তার দেখা দেওয়ার কারণ। বেশ কিছুক্ষণ বাদে আরাভ জানালো সেই কারণটি। তার বড় ভাই অভ্রর বিয়ের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে। এ-খবর শুনে নীলাশা অর্ধচন্দ্রাকারে ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,
“ হুয়াট আ গুড নিউজ! ফাইনাইলি বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন মিস্টার ডক্টর, তাই তো? ”
আরাভ স্তম্ভে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল আর বলল,
“ হুম। শোনো, তোমাদের কিন্তু দু’বাড়িতেই দাওয়াত। বাবা আর ভাইয়া কথা বলতে গেছে আঙ্কেলের সাথে। ”
নীলাশা দু’কদম এগিয়ে এসে দাঁড়াল। প্রিয়র এলোমেলো ঝাঁকড়া চুলগুলো গুছিতে দিতে দিতে বলল,
“ আচ্ছা শুনুন, ভাইয়ার বিয়েটা তো হচ্ছেই। এরপর কিন্তু আপনার পালা। ড্যাডের সাথে কথা বলতে হবে তো! প্লিজ গায়কবাবু, আমি কিন্তু ওই বুড়ি-টুড়ি হয়ে বিয়ে করতে পারব না। ”
আরাভ হাসল। নীলাশার সরু, তেলতেলে নাকটা টেনে দিয়ে বলল,
“ আরেহ্, আমরা তো ম্যারিড-ই আছি! এইতো দুইদিন আগেই সিগনেচারে বিয়ে করলাম। হারিয়ে তো আর যাচ্ছি না? ”
এই সত্য কথাটা নীলাশার একদমই ভালো লাগল না। সে স্পষ্টতই নিজের অভিমান প্রকাশ করে বলল,
“ ওইটা দুইদিন? বলুন পাঁচ মাস দুইদিন। আমার ওইসব লিগ্যাল পেপারে সাইন করার বিয়েতে চলবে না। আমি কবুল বলে বিয়ে করব আবার। তারপর আপনাদের সংসার সামলাবো। আমার সংসার করার খুব ইচ্ছে, জানেন? একদম শাড়ি পরে, হাতখোঁপা করে, বউ-বউ সেজে সংসার করব। আর আপনি বলেন কি-না আমার মাস্টার্সের পর আমাকে বিয়ে করবেন? অতো বুড়ি হয়ে গেলে সংসার করতে মন চাইবে না-কি? ”
আরাভ আবারও তার নিচের ঠোঁটটি কামড়ে ধরল৷ তবে হাসল না একটুও। নীলাশার থেকে এহেন কথা শোনা তার জন্য নতুন নয়৷ সেদিন ফাল্গুনী পূর্ণিমায় হাতে হাত রেখেই দুজন একটি কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল— আইনত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া৷ হুট করেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পিছনে যথার্থ কোনো কারণ ছিল না। দুজনেরই ইচ্ছে ছিল বিয়ে করবে। কারণ তাদের পরিবার থেকে যে কোনো প্রকার অসম্মতি আসবে না তা তারা নিজেরাও ভালো করে জানে। এমন উন্নত জ্ঞান ধারণ করা মস্তিষ্কের মানুষগুলো প্রবৃদ্ধ রীতিনীতি চাপিয়ে দেওয়ার মতো বিরাট বড় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে না বলেই নিশ্চিত হয়েছিল তারা। আর আরাভ জানে, এই দেশের ছেলেদের বিয়ের বয়স তখনই হয় যখন তারা নিজেদের কর্মে সফলতা লাভ করে। মনেপ্রাণে মানা এই রীতি ভঙ্গ করে নীলাশার ‘কবুল’ বলার ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারেনি সে। তাই নিজেদের শখকে প্রাধান্য দিয়ে বিয়ের কিছুটা হলেও পূরণ করে নিয়েছে তারা। কিন্তু এই শখের সমাপ্তিটা আদৌ কেমন হবে সেই বিষয়ে আরাভ এখন বড্ড বেশিই চিন্তিত। কথায় বলে ‘হুজুগে বাঙালি’। এমন একটি কাজ নিতান্তই শখের বশে করাটা আরাভ কিছুতেই মানতে পারছে না। এই অভিমানী মেয়েটাকে ভালোবেসেই কি এমন অধঃপতন হলো তার? সে আজও ভেবে চলেছে একটি কথা— নীলাশাকে তার বাবার মতো ভালো রাখতে না পারলে তার নিজের আয়নার সামনে দাঁড়ানোটা কি আগের মতোই সহজ হবে? এই যে প্রণয়-প্রীতি… ভালোবাসায় নির্বোধ হওয়া ও একে-অপরের সাথে সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়ার সুঘ্রাণময় বাসনাটাকে ছাপিয়ে আবার গড়ে উঠবে না তো আত্মসম্মানের দেয়াল? আত্মসম্মান নিয়ে অত্যধিক সচেতন আরাভ যে— আত্মসম্মানের জন্য ভালোবাসার মানুষটাকেও ত্যাগ করতে পারে, এমনটা নয়। তবে এটা অস্বীকার্য নয়, ইয়াসিন চৌধুরীর এই এক টুকরো হীরার যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব সম্পর্কে তরুণটি ভীষণ-ই ভীত!
“ ও গায়কবাবু? ”
ভাবনায় নীলাশার ডাক পেয়ে আরাভ খানিকটা চমকালো। সে সুন্দর করেই বুঝ দিল তাকে,
“ নীলা? তুমি তো আমার-ই, নীলা। আছো আর থাকছোও। তাহলে এতো তাড়াহুড়া কীসের বলো তো? আমাকে না-হয় একটা বছর-ই টাইম দাও? আর মাত্র দুটো মাস পরেই তো আমার ফাইনাল এক্সাম। তার পরেরটা তো জানোই— আমি, সায়ান, সাইফ আর শিহাব মিলে আমার বড় চাচ্চুর কোম্পানিতেই জয়েন করব। সংসার করার জন্যও তো প্রস্তুতি নিতে হবে আমাকে, তাই না? নয়তো আঙ্কেলকে তো আর বলতে পারি না যে, তার মেয়েকে একটা বেকার ছেলে হয়ে বিয়ে করব! একটা বছর যাক… তারপর তোমার সংসার করার ইচ্ছাটাও পূরণ করব। একদম পার্মানেন্টলি! ”
অতঃপর সে মজার ছলে আরও ব্যক্ত করল,
“ ততোদিনে তুমি এই দেশের বাংলাটা শিখো তো। তোমার সাথে কথা বলতে বলতে আমার ভাষাটাও কেমন ওই দেশের বাংলার মতো হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা হাস্যকর যে, তুমি এতোদিন এতো মানুষের সাথে কথা বলেও নিজের দেশের ভাষা শিখলা না। এখন থেকে নিশান-রিশানদের মতো বাংলা বলবা, বুঝছো? ওদের বাংলা কিন্তু অস্থির শোনায়! ”
নীলাশা ম্লানমুখেই হাসল ক্ষীণ। মনটা ভীষণ খারাপ করল তার। দুটো দিন থেকেই মনটা বেশ খচখচ করছে নীলাশার। ঘুমের স্বপনে বা নির্ঘুমের কল্পনায় শুধু একটি সংকেত-ই পেয়ে চলেছে সে, বিপদ! ঘোর শনি! মনটা মোটেও শান্ত করতে পারছে না মেয়েটি। এই সময়টায় আরাভকে যে সত্যিই তার খুব প্রয়োজন তা-ও ঠিকঠাকভাবে প্রকাশ করতে পারছে না অন্তর্মুখী নীলাশা। বিপদের কথা যে প্রকাশ করতে নেই!
সে যাইহোক, মনের অস্থিরতাকে দূরে ঠেলেই দুজনে গল্প করতে লাগল বেশ কিছুক্ষণ। সেই সময় শুকনো পাতার উপর কারো পদচারণার আওয়াজ এলো তাদের কানে। পা দুটো তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। আশেপাশে তাকাতেই দুজনের চোখে যখন পরিচিত কিশোরী মেয়েটির হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী নজরে এলো, তখন ঝলমলিয়ে উঠল আরাভ ও নীলাশার চেহারাটাও৷ মেয়েটি এসে একদম নীলাশার গা ঘেঁষে দাঁড়াল। অতঃপর হাসিমুখে বলল,
“ তোমরা এখানে একা-একা কী করো? ”
নীলাশা হেসে ফেলল সেই প্রশ্ন শুনে। আরাভ উত্তর দিল,
“ একা কই দেখো তুমি? আমরা তো দোকা। কখন আসলে প্রাইভেট থেকে? আমি তো এসে আগে তোমাকেই খুঁজলাম। ”
মেয়েটির বিস্ময়কর উত্তর, “ আমাকে? কেন কোনো দরকার না-কি ভাইয়া? ”
“ হুম, তোমাকে তো তোমার ভাইয়েরা তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমাদের তো আর অতো পাওয়ার নাই যে, তোমাকে একদম নিখোঁজ করে রাখব। যেকোনো সময়েই তোমাকে পেয়ে যাবে ওরা। এর চেয়ে ভালো নাহ্ আগেভাগে দেখা করে নেওয়া? দরকার কি এতো লুকোচুরি খেলার, ঈশা? ”
ঈশার মুখের হাসিটা বোধহয় একটু মলিন দেখালো। মুহূর্তেই ভীষণ ঘোলাটে, অস্বচ্ছ এবং ফ্যাকাশে রূপ ধারণ করল তার হাসি! মেয়েটা বোধহয় বেশ অভিমান বুকে আগলেই বলে উঠল,
“ দেখা করে কী হবে, ভাইয়া? আমি তো আর ওদের বোন না। ”
কী তীক্ষ্ণ অভিমান মেয়েটির! মানুষ যে একজনের সংস্পর্শে থাকলে তার দ্বারা প্রভাবিত হয়, তা বেশ লক্ষ্য করতে পারছে আরাভ। এ যেন ঈশা না… আস্ত একটা নীলাশা! এইতো আরাভ স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পাচ্ছে— তার নীলার মতোই অভিমানে পরিপূর্ণ মেয়েটির কণ্ঠ। কী বিষাদ! সেই সময় মেয়েটির ধপ করে নিভে যাওয়া দেখে নীলাশা তাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরল। বেশ আদুরে স্বরে বলল,
“ ওর যখন ইচ্ছে হবে তখনই না-হয় কথা বলে নিবে। আর ওরা খুঁজছে যখন বেশ করছে… খুঁজুক। এটা আহামরি কোনো শাস্তি না ওদের জন্য। ”
নীলাশার কথাটাও বোধহয় পছন্দ হলো না ঈশার। সে বলল,
“ নীলাপু, আহসান আঙ্কেল ডাকছে তোমাকে। তোমরা আসো। আমি না-হয় যাই। ”
মেয়েটির বলতে দেরি হলেও স্থান ত্যাগ করতে এক মুহূর্তও দেরি হলো না। সে চলে গেল বাড়ির ভিতরে। তাকে চোখের অগোচরে যেতে দেখেই আরাভ বলল,
“ আমি ওদের এক করতে চাচ্ছি আর তুমি কি-না ওকে এইসব শিখায়ে দিচ্ছ? কানে বিষ ঢালছো কেন, শুনি? ”
নীলাশা হাসল। আরাভের অনুরূপ সেও স্তম্ভে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“ আমার মাথায় একটা দারুণ আইডিয়া এসেছে। ”
আরাভ আগ্রহী হলো তা শুনতে। তবুও মুখে বিস্ময়াবিষ্ট চিহ্ন ফুটিয়ে তুলে বলল,
“ আবার! প্লিজ তোমার ওই ডেঞ্জারাস আইডিয়াগুলো আমাকে এপ্লাই করতে বলো না, নীলা। জানোই তো কতকিছু করে ঈশাকে আড়ালে রাখতে হচ্ছে। এরপর সাহেল আমাকে মেরেই ফেলবে! ”
নীলাশা হাসল, “ আরেহ ওমন কিছুই না! এবার অন্যকিছুই ঘটবে। আপনাকে কিছু করতে হবে না। শুধু জেনে রাখুন। ”
নীলাশা গোড়ালি উঁচু করে দাঁড়িয়ে, হাতের তালু দ্বারা আচ্ছাদিত করল তার ওষ্ঠদ্বয় ও আরাভের কান। ফিসফিসিয়ে বলে গেল অনেক কথাই। আর আরাভ নিয়মমাফিক মেয়েটার সকল কথাই শুনে গেল অত্যন্ত শান্ত স্বভাবে। হয়তো অযথাই ভীষণ মনোযোগ দিয়েও…!
#চলবে ইন শা আল্লাহ!